



সম্পাদকীয়
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মনের চাপ বৃদ্ধি ও সামাজিক প্রকৌশলের পরিবর্তনের সামাজিক রীতিনীতির ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সাশ্রয় নিউজ-এর উৎসব সংখ্যা প্রকাশে বিলম্ব! আপনারা যাঁরা এই শারদীয়া উৎসব সংখ্যার জন্য লেখা পাঠিয়েছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের কাছে আসা উপন্যাস, ছোটগল্প, বড় গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী ও কবিতা এ সংখ্যায় প্রকাশিত হল। যাঁদের লেখা প্রকাশ করতে পারলাম না তাঁদের কাছে আমরা ক্ষমা প্রার্থী। কারণ আশা করব তারাই আগামীতে আরও উৎকৃষ্ট লেখা পাঠাবেন। আমাদের প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও আপনাদের একান্ত সহযোগিতায় উৎসব সংখ্যা প্রকাশিত হল। আগামীতেও প্রকাশ হবে আশা রাখি। আমাদের সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য আপনারা প্রত্যেকেই নিয়মিত যেভাবে লেখা পাঠিয়ে থাকেন- এর জন্য সাশ্রয় নিউজ-এর পক্ষ হতে আমরা আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আগামীতেও ‘রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল’ এ লেখা পাঠাবেন আশা করি। এই সংখ্যার ‘রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল’ ও ‘উৎসব সংখ্যা’ একই সঙ্গে প্রকাশিত হল। 🍁
🍂প্রবন্ধ
অন্তিমে কবিগুরুর দায়িত্ববোধ ও রসিকতা
অমিয় আদক
বিশ্বকবির মহাপ্রয়াণ তেরোশো আটচল্লিশ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবন। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের তারিখ উনিশশো একচল্লিশ খ্রিস্টাব্দের সাতই আগস্ট। এখন থেকে তিরাশি বছর আগের ঘটনা। আমি পৃথিবীর আলো দেখি তার প্রায় এক দশক পরে। কবিকে দেখার সৌভাগ্য ছিলনা। যাঁরা কাছে থেকেছেন, সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাঁরা সত্যই ভাগ্যবান। যাই হোক আজকের আমরা, বেশিরভাগই তাঁকে জীবিত দেখার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাইনি।
মহাকবির জীবন কাল আশি বছর তিন মাস। তাঁর জীবনের অন্তিম মাসে, তিনি বেশ অসুস্থ। তখনও তিনি শান্তিনিকেতনে। কবির তখন চিকিৎসা রত কবিরাজ কমলাকান্ত ঘোষ। কবির সারাদিনের পরিচর্যায় থাকেন রানী চন্দ, নির্মলকুমারী মহলানবিশ, কবি কন্যা মীরা এবং পুত্রবধূ প্রতিমা ও আরও কয়েকজন। নির্মলকুমারী, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পত্নী। কবি মজাকরেই নির্মলকুমারীকে বলেন প্রথমা এবং রানী চন্দকে বলেন দ্বিতীয়া। আবার কখনও তাঁদের পরিবর্তিত নাম ‘হয়রানি’ এবং ‘নয়রানী’। সুধাকান্তবাবুর একমাথা টাক। তাঁর নাম দেন বলডুইন। তিনি হিন্দি ভবনের জন্য আর্থিক দান চাইতে যান বাজোরিয়া কানোরিয়াদের কাছে। হিন্দিতে কথা বলেন। সেই কারণে নাম সুধোড়িয়া। তাঁর সম্পর্কে অন্যদের কাছে বলেন, ‘ওর মাথাটা বলডুইন নামের যোগ্য। তাছাড়া ও আমাকে যেরকম নানা বিষয় যুক্তি পরামর্শ দিতে আসে, তাতে ওকে প্রাইম মিনিস্টারের সামিল মনেকরা অন্যায় নয়, কি বলো? শুধু একটা ছাতা বগলে নেই এইযা।’ অসুস্থ অবস্থাতেও কবির রসিকতার ফল্গুধারা সময়ের ফাঁকফোঁকরে বেরিয়ে আসে।
সাতই জুলাই, উনিশশো একচল্লিশ সোমবার সকালে কবি কক্ষে আসেন হয়রানি। কবি জানতে চান, ‘খব্রু এসেছে? খব্রু।’ ‘হয়রানি’ বুঝতে পারেননি বিষয়টি। বেশ হয়রানিতেই আছেন। কবি বলেন, ‘আরে, খব্রুকে জানোনা?’ হয়রানি আন্দাজ করেন খবরের কাগজকে কবি বলেন ‘খব্রু’। তিনি হোহো শব্দে হেসে ওঠেন এবং জানান, ‘না খব্রু এখনো আসেনি।’ রোগীর কক্ষ নিরানন্দ থাকার কথা। অসুস্থ কবি নিজেই সূক্ষ্ম রসিকতায় অন্যদের মুখে হাসি ফুটিয়ে থাকেন।
তেরোই জুলাই উনিশশো একচল্লিশ রবিবার সকালেই কবি অনেক ক্লান্তি নিয়ে লেখেন নাতনি বুড়ীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর কবিতা। সেদিনেই দুপুরে সুধাকান্তবাবুকে কাগজ কলম নিয়ে বসান। কবি নিজে বলেন। সুধাকান্তবাবু লেখেন ভাইপো অবনীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিনের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা ও প্রশস্তি। চোদ্দই জুলাই সোমবার বিকেলে রানী চন্দ কোলকাতা রওনা দেন। তাঁর যাওয়ার সময় বলেন, ‘বলিস তোর দাদাকেও (শিল্পী মুকুল দে) যে, জয়ন্তী যেন উপযুক্ত হয়। যা তা করে কিছু না করে।’ রানী চন্দ চলে যাওয়ার পরেও অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। সেই কথার কিছু উল্লেখ করি। কবি বলেন, “অবন কী আশ্চর্য মানুষ সত্যিই আর্টিস্ট। ওর তুলিতেও ছবি। কলমেও ছবি। একেবারে নিজস্ব স্টাইল। ওর যদি ভালোকরে জয়ন্তী না করা হয় তাতে ওর ক্ষতি হবেনা, কিন্তু সেটা হবে দেশের কলঙ্ক। ও একটা পাগলা! ‘রবিকা’র উপর চিরকাল বেজায় টান।”
কবিগুরু নিজেও ভাইপো অবনকে বেশ স্নেহের চোখেই দেখেন। শিল্পী ভাইপোর শিল্পকর্ম এবং সাহিত্যের প্রতিও তাঁর অগাধ আস্থা। কবি স্রষ্টা হিসাবে অবনীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট গুরুত্বও দেন। কবির একান্ত প্রিয় ভাইপোর জন্মদিনের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা ও প্রশস্তি পাঠান রানী চন্দের মাধ্যমে।
পনেরোই জুলাই মঙ্গলবার। সেদিন কবির সেবায় কেবল একা নির্মলকুমারী মহলানবিশ। কবি তখন শায়িত অবস্থায়। তিনি তাঁর প্রিয় ‘হয়রানি’কে বলেন, ‘আমায় একবার তোলো।’ ‘হয়রানি’ ভাবেন তিনি একাই তুলতে পারবেন। কবিও দাঁড়াতে পারবেন। সাহস নিয়ে তুলে দাঁড় করান। কিন্তু কবির পায়ের জোর কম। ভারসাম্য রাখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। ‘হয়রানি’কে নিয়েই পড়ে যান। সেই অবস্থাতেও যাতে ‘হয়রানি’ হতাশ না হন, তিনি কষ্ট সত্ত্বেও হাসতে থাকেন। ‘হয়রানি’ কবিকে তোলার চেষ্টাকরেও পারেন না। তখন বাইরের মানুষদের জানানোর জন্য ‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু’ বলে চিৎকার করতে থাকেন।
নিচে তখন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ চা পানে ব্যস্ত। কিছু বিপদের অনুমান করেই তিনি উপরে ওঠেন। রথীন্দ্রনাথকে দেখেই কবি উচ্ছ্বসিত হাসির সাথেই বলেন, ‘রথী, কিছু হয়নি রে, আমি উঠতে চেয়েছিলাম। বীরাঙ্গনা ভাবলেন, উনি একাই আমাকে তুলতে পারবেন। তাই যেই তুলে দাঁড় করিয়েছেন, আর আমি ওঁকে সুদ্ধু নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলুম। ভয় পাসনে, কিচ্ছু হয় নি আমার।’ তখন রথীবাবু কবিকে তোলার জন্য ধরেছেন। তখনও তাঁর মুখে ভয়ের চিহ্ন নেই। মুখে লেগে আছে হাসি। কবিকে তুলে বসানোর পরেও বলতে থাকেন, “বাব্বাঃ! কি কণ্ঠস্বর! ‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু’ আরে আমার পায়ে জোর নেই বলে পড়ে যাচ্ছি ডাক্তারবাবু কী করবে? চেঁচিয়ে একেবারে পাড়ামাত। অমন গলা নাহলে ডাকাত পালিয়েছিল? ভদ্রমহিলার আর কিছু না থাক গলার জোর আছে। সে রাত্রেও তো এমনি আওয়াজে আমি ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে আসছিলুম।” তখনও কবির ঠোঁটে হাসি।
তার কিছুক্ষণ পরে কবি সুরেনবাবুকে ডেকে পাঠান। তাঁকে বলেন, “আজ নবীনমাধবের পা ভাঙা জেনেও আমার বলডুইন তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন? আরও খানিকক্ষণ তো থাকলে পারতো? আজ ‘নয়রানি’ও নেই, একা ‘হয়রানি’ পারবে কেন আমার ভার বইতে? আজ আমি ভারি বিরক্ত হয়েছি- বলডুইনকে বলো।” এই ঘটনায় অনেক কিছুই ঘটা অসম্ভব ছিলোনা। তবুই স্বভাব রসিক কবি পরিহাসের ছলেই অনেক কিছুকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্বভাব রসিক। একান্ত শারীরিক অসুস্থতাতেও সেই অনাবিল রসবোধের বিরাম থাকেনা। নির্মল রসালো বাক্য কিংবা বাক্যাংশের মাধ্যমেই কবি তাঁর পরিমণ্ডলে সুক্ষ্ম রসিকতারশ্মির বিকিরণ ঘটান।
ষোলই জুলাই বুধবার। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সহ আরও ডাক্তারবাবুদের আসার কথা। তা জানেন কবি স্বয়ং। ডাক্তারবাবুরা আসার আগেই তিনি তাঁর প্রিয় ‘হয়রানি’কে বলেন, “দেখো, আজ আমি কি করবো জানো? ওরা যখন আমার পেট টিপবে, আমি তখন বলবো যে, কোথাও লাগছে না। তখন আমরা ভাবতেই পারি কবি যেন শৈশবে ফিরে গেছেন। এমন বাক্য তাঁর রসিক মনের পরিচয় হিসাবেই আমরা স্বীকার করতে বাধ্য। সেদিন কবি লেখেন একটি কবিতা। সেটি ‘দ্বিধা’ শিরোনামে ‘সানাই’ কাব্যগ্রন্থে সামান্য পরিবর্তন সহ প্রকাশিত। পরে সেটি গান হিসাবেও গীতবিতানে সংযুক্ত।
সতেরোই জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুরে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এবং অন্যান্য চিকিৎসকগণ যান শান্তিনিকেতন। তাঁরা কবিগুরুর অপারেশনের পরামর্শ দেন। ভালো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁরা ওই দিন বৈকালেই কোলকাতা ফিরে আসেন। কবি অপারেশন বিষয়টি অন্তর থেকে মানতে পারেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায় দিতে তিনি বাধ্য থাকেন। সেই বিষয় পরবর্তি কালে তাঁর কথাবার্তায় তখনের সেবক-সেবিকারা পান।
পরদিন আঠারোই জুলাই শুক্রবার দুপুরে কবি ‘সুধোড়িয়া’ তথা সুধাকান্তবাবুর সাথে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের বিষয়ে আলোচনায় বসেন। বলেন, ‘কিরে শুনেছিস তো কাল থেকে আবার মাছের ঝোল খেতে হবে? আহারটা কি রকম হবে বলতো? তুই তো মনে করিস নিরামিষটা কোন খাদ্যই নয়; তোর তো একটা আস্ত পাঁঠা পেলেও আপত্তি নেই, কি বলিস?’ উত্তরে সুধোড়িয়া জানান, ‘আজকাল আর সেদিন নেই গুরুদেব। এখন আর তেমন খেতে পারিনে। সে খেতে পারেন রামবাবু (ডাঃ রাম অধিকারি)। সেদিন রাত্রে চল্লিশখানা লুচি খেলেন, তারপরে আবার আম মিষ্টিও বাদ গেলোনা।’ বাক্যের শেষেই কবি নির্মলকুমারী মহলানবিশ বা ‘হয়রানি’কে বলেন, ‘বাপ্রে, শুনছো হেড নার্স? সেই জন্যই তো আমার আমবাবুর (রামবাবুর রসিকতায় দেওয়া নাম) চেহারাটা অমন গোলগাল। ওঁর গোঁফজোড়াটাও কম না, খুব জবর গোঁফ।’ এমনটা শুনেই সবার হাসি। অনন্ত রসের ভাণ্ডার না হলে অসুস্থ শরীরে এমন রসিকতা করা একান্ত অসম্ভব।
পরদিন উনিশে জুলাই শনিবার সকাল। কবির ঘরে ‘হয়রানি’ সমেত আরও কয়েকজন। মেয়েদের গয়না পরা নিয়ে সরস আলোচনা। কবির নজর পড়ে ‘হয়রানি’র হীরের আংটিতে। বলেন, ‘খোলো তো ঐ আংটিটা। দেখি আমাকে কি রকম মানায়।’ তিনি আংটিটি দেন। কবি নিজের ডান হাতের কড়ে আঙুলে পরেন। হালকা হাসির সাথে বলেন, ‘বাঃ! আমার হাতে এটা খুব মানিয়েছে তো; এটা তুমি আর ফেরৎ পাচ্ছো না।’ ‘হয়রানি’ বলেন, ‘বেশ তো, আপনি নিন না আংটিটা, কিন্তু একটা শর্ত- আপনাকে ওটা পরে থাকতে হবে।’ কবি বলেন, ‘ঐ দেখো, এ যে আবার সেই অ্যানড্রুজ সাহেবের বালিশের দশা হবে- শেষে আমার মনে হবে ফিরিয়ে দিতে পারলে বাঁচি।’ ‘হয়রানি’ বলেন, ‘তা কেন? বেশ তো পরে রয়েছেন, ঐ রকম থাকুন না পরে।’ তখনি কবি বলেন, ‘আচ্ছা, আমার মামনিকে চমক লাগিয়ে দেবো আংটি দেখিয়ে। জিজ্ঞাসা করলে শুধু মুখ টিপে হাসবো, বলবো না কোথায় পেয়েছি? তুমি কিন্তু বলে দিও না।’
দুপুরে খাওয়ার সময় পুত্রবধূ প্রতিমা আসেন কবির ঘরে। তাঁকে দেখেই বলেন, ‘মামণি, দেখেছো কি রকম হীরের আংটি পরেছি? আমার এক বন্ধু পাঠিয়ে দিয়েছে।’ বাক্যটি বলেই মুখ টিপে হাসেন। ‘হয়রানি’ও চোখের ইশারায় হাসির সাথে জানিয়ে দেন আংটি রহস্য।
সেদিন প্রায় সারাদিন আংটি পরে কবি একান্তই অতিষ্ট। সন্ধ্যায় কোলকাতা থেকে আসেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তিনি কবির কক্ষে হাজির হতেই বলেন, ‘এই নাও জ্যোতি, তুমি এসেছো বলে তোমাকে একটা বকশিস দিলুম।’ বলেই হাতের আংটিটা খুলে যেই দিতে গেলেন, তখনি ‘হয়রানি’ আপত্তি জানিয়ে, পলকে আংটিটা কেড়ে নেন। তারসাথে বলেন, ‘এটা তো কথা ছিল না। শর্ত যে আপনাকে পরে থাকতে হবে। না-ই যদি পরবেন তাহলে দেবো কেন?’ কবি বলেন, ‘ওটা তো তুমি আমাকে দিয়েছো।’ উত্তরে ‘হয়রানি’ বলেন, ‘হ্যাঁ দিয়েছি যদি পরেন তাহলে, তাই বলে দান বিক্রির অধিকার দিই নি।’ কবি বলেন, ‘তাহলে বাপু তুমি ফিরিয়ে নাও। ওটা যে আঙুলে ছিলো সে আঙুলেই যাক, আমার হীরের আংটিতে কাজ নেই। বাবা, সারাদিন আংটি পরে অস্বস্তিতে আমার প্রাণ হাঁফিয়ে উঠেছে। কি হে জ্যোতি, কোলকাতার সব খবর ভালো?’ জ্যোতিবাবু জানান, ‘না খুব ভালো নয়। প্রশান্তর বেশ একটু অসুখ। পেটে একটা ব্যথা, সঙ্গে জ্বরও আছে- এখনও ঠিক ধরা যায়নি কি হয়েছে। আমার তো মনেহয় আমার সঙ্গে রানীর কাল ফিরে যাওয়া উচিত।
কবি বেশ উদ্বিগ্ন প্রশান্ত মহলানবিশের অসুখের খবরে। জ্যোতিবাবুর বাইরে যাওয়ার পর ‘হয়রানি’কে বোঝতে থাকেন, তিনি স্বার্থপরের মতো তাঁকে আটকে রাখতে চান না। তাঁর কোলকাতায় ফেরাই সঙ্গত। প্রশান্তবাবুর আত্মীয়রাও উদ্বিগ্ন। হাসি ঠাট্টা মজায় তিনি আছেন তাঁর প্রিয় ‘হয়রানি’র সান্নিধ্যে। তবুও তাঁর ফিরে যাওয়াই কর্তব্য। অবশেষে ‘হয়রানি’ও কবিকে বুঝিয়ে বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর সেবায় আছেন। কবি কখনও জোর করেন নি। তিনি কোলকাতায় ফিরে যাবেন। যদি তেমন দরকার পড়ে। কবি যেন চিন্তা না করেন।
এদিকে ‘হয়রানি’ বেশ দোটানায়। তাঁর মা চিঠিতে জানান, কোলকাতায় ফিরে স্বামীর সেবা করতে। আবার স্বামী ফোনে জানান, তাঁর তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা। কোনভাবেই তিনি যেন কবির সেবাযত্ন ছেড়ে না আসেন। অবশেষে প্রতিমা দেবী, মীরা দেবীর অনুরোধে তিনি কবির সেবায় থেকে যান। পরে কবির সাথেই ট্রেনের সেলুনে ফেরেন।
তথ্য ঋণঃ বাইশে শ্রাবণ, নির্মলকুমারী মহলানবিশ।🍁
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস / দুই
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
শুরু হচ্ছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গিয়েছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই আজকে দ্বিতীয় পর্ব।
পাঠশালার পাঠ
একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবার। সামান্য জমিজমা থাকলেও তেমন ফসল ফলে না। বছরে একবার যেটুকু ধান হয় তা ধার-দেনা শোধ করার জন্যই বিক্রি হয়ে যায়। রবিশস্য বলতে মসুর-খেসারি এবং সামান্য তিসি। কিন্তু সেসবও বাড়ির লোকেদের পোশাক-আশাক কেনার জন্য বিক্রি করে দিতে হয়। অসুখ-বিসুখ হলে কখনো শহরের বড় ডাক্তারকে দেখানোর অভ্যাস নেই। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার হৃদয় সিংহই দু চার টাকার ওষুধ দেয়। এক শিশি ঘোলা ওষুধ এবং কয়েকটি ট্যাবলেট। ধুঁকেধুঁকে তাতেই জ্বর সারে। অনেক সময় তাও জোটে না। বড় পিসি বিধবা কোথা থেকে কালমেঘা সংগ্রহ করে আনে। আর তাই বেটে সেবন করতে দেয়। তার তিক্ত স্বাদ কিছুতেই সহ্য করতে পারি না, বমি পর্যন্ত হয়ে যায়। অবশ্য এতেই জ্বর ছাড়ে। জ্বর ছাড়লেই তখন ভাতের ব্যবস্থা হয়। কারো বাড়ি থেকে চেয়ে আনা হয় কাঁচা কলা অথবা পেঁপে। নুন হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করে ভাতের সঙ্গে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই খেতে পারি না।
—ওয়াক থু! জিভে স্বাদ নেই! ভালো লাগে না খেতে!
—এসবই তো খেতে হবে!জ্বর হলে এসবই খেতে হয়!
—আমি খাব না, আমাকে বিস্কুট দাও।
—কোথায় পাব বিস্কুট? পয়সা তো নেই বাবা!
—ধার করে আনো! পরে শোধ দিও।
—অনেক টাকা ধার আছে তো, এখন আর ধার দেবে না।
তখন নিরুপায় হয়ে কিছুটা খেয়ে আর খেতে পারতাম না। ঘরের কাছেই নিমগাছ তলায় উঁচু এক ঢিপিতে গিয়ে বসতাম। ডিপির নিচেই এঁদো পুকুর। সারা বছর ধরেই পচা জল। সেইখানেই ছিপ ফেলে বসে থাকতাম। দু একটা চ্যাং মাছ উঠলে তা নিয়ে এসে মায়ের কাছে আবদার করতাম—আমাকে পুড়িয়ে দাও।
সেই চ্যাং মাছ পোড়া অনেকদিনই খেতে হতো। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে আমাদের আর দুঃখের অন্ত থাকত না। সারাদিন মাঠে মাঠে ঘাস কেটে বিক্রি করতো বাবা। ঘাস বিক্রির বদলে কিছু খুদ বা গম জুটতো। তাই দিয়ে রান্না হতো জাউ। আমি তখন ওই চ্যাং মাছ ধরতাম কেঁচোর টোপ গেঁথে। পচা জলের সেইসব মাছগুলির রং হতো অত্যন্ত কালো। মা ধুয়ে বেছে সেগুলি আগুনের আঁচে লোহার শিকে গেঁথে পুড়িয়ে দিত। সারাদিন পর সেগুলো খেতে খেতে মনে হতো আহা কী যেন অমৃত ভক্ষণ করছি! খাওয়া শেষ হলে এক ছুটে বাইরে যেতাম, পাকা তালের খোঁজে। কখনো বা বাঁশের কঞ্চি কেটে নতুন ছিপ বানাতাম। সুতো দিয়ে বেঁধে তার সঙ্গে একটা বঁড়শি ঝুলিয়ে দিতাম। একসঙ্গে অনেকগুলো বঁড়শি নিয়ে কখনো কখনো মাঠের কোনো জলাধারে গিয়েও টোপ গেঁথে সেগুলো ডুবিয়ে দিতাম। আর তীরে বসে অপেক্ষা করতাম। মাছে টোপ খেলে সেই ছিপের আগের দিকটা জলের দিকে নুইয়ে দিত। তখন তাড়াতাড়ি গিয়ে টেনে সেটা তীরে তুলতাম। চ্যাং মাছ,ল্যাটা মাছ অথবা মাগুর মাছ উঠতো। বেশ কয়েকটা পেলে তখন বাড়ির দিকে রওনা দিতাম। এইসব মাছ ধরতে ধরতে এবং মাছ পোড়া খেতে খেতে নিজেদের আদিম শিকারি মনে হতো। মা পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমাদের ভাই-বোনদের দিতো আর আমরা তা চকাস চকাস শব্দ করেই খেতাম। খাওয়ার পর এক ঘটি জল পান করে তবেই স্থান ত্যাগ করতাম। ছোটতেই একশ্রেণির যাযাবর মানুষদের দেখতাম, নানারকম পশুপাখি শিকার করে এনে আগুনে পুড়িয়ে তারা খাচ্ছে। জ্যান্ত বকের বাচ্চাকে কী নির্মমভাবে তারা মারছে। কাঠবেড়ালি, বন-বিড়াল অথবা শেয়াল পর্যন্ত তাদের খাদ্য। আর আমরা শুধু মাছ খাই তবুও তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই। কারণ আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য নিজেদের পেট ভরিয়ে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার জন্যই সব।
গ্রামের অনেকেই স্কুল যেতে শুরু করেছে। আমি কেন যাচ্ছি না তবে? বাবা বলল, আজ তোকে স্কুলে দিয়ে আসি।
আমি বললাম, আমি কি পরে যাব? আমার তো একটাও প্যান্ট নাই, জামা নাই!
বাবা বলল, আয় আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
বাবার ঘাড়ে মাথায় বেঁধে কাজ করা একটা গামছা আটকানো ছিল। সেইটা টেনে নিয়েই আমাকে পরিয়ে দিলে। আমি বললাম, গায়ে কী পরব? খালি গায়ে আমি স্কুলে যাব না।
তখন মা বলল, থাম আমি দেখেছি!
আমাদের পাশের ঘরেই থাকত দূর সম্পর্কের শালেমান পিসি। মাঝেমধ্যেই মুম্বাই যেত ঝি-র কাজ করতে। তার কাছ থেকেই একটা পুরনো ছেলেদের জামা চেয়ে আনল আর সেটাই পরিয়ে দিল আমাকে। আমি মহানন্দে বাবার হাত ধরে সেদিন প্রথমে স্কুলে গেলাম।
স্কুলের হেডমাস্টার ছাত্রদের কড়া শাসন করতেন। প্রথমত দেখেই আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বাবা সঙ্গে আছে তবুও কাঁপতে লাগলাম।
হেডমাস্টার বললেন, এটাই তোমার ছেলে?
বাবা বলল, হ্যাঁ, আমারই বড় ছেলে।
হেডমাস্টার জানতে চাইলেন,বয়স কত হলো?
বাবা বলল, সাত বছর!
হেডমাস্টার বললেন, এতদিন স্কুলে দাওনি কেন?
বাবা বলল, ছেলের মুখ দিয়ে কথা বের হতো না, তোতলা বলে স্কুলে আনিনি।
তারপর হেডমাস্টার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, পড়তে পারবে তো?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
বাবা বলল, প্রণাম করো।
বাবার কথায় সেই প্রথম প্রণাম করতে গেলাম হেডমাস্টারকে। কিন্তু প্রণাম করতে গিয়ে এত ভয় পেলাম যে, দুই হাতে পা স্পর্শ করতে গিয়ে কাঁপতে লাগলাম। আমার কম্পন দেখে হেডমাস্টার বললেন, থাক্ থাক্ হয়েছে, আর করতে হবে না।
গামছা পরে, পরের দেওয়া ঢলঢলে একটা জামা পরে সেদিন স্কুলে আমাকে বড় বেমানান লাগছিল। লজ্জায় কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তবু চট পেতে সকলের সঙ্গে বসতে গেলে টের পেলাম, স্কুলে আসা অন্যান্য ছাত্ররা আমাকে ঠিকভাবে মেনে নিতে পারছে না। পরের দেওয়া জামার একটা গন্ধ, এবং হাফ প্যান্টের বদলে একটা গামছা পরা ছেলে কখনো ছাত্র হতে পারে না। বরং মাঠের রাখালবাগাল হতে পারে। সেই অপমান হজম করেই প্রথম দিন বিদ্যালয়ে আমার সারাদিন কেটেছিল।
কিন্তু পরের দিনগুলিতে এই লজ্জা অতিক্রম করতে পেরেছিলাম। আমার জন্য সেলাই করা হয়েছিল জর্জেট কাপড়ের একটি দড়ি দিয়ে বাঁধা হাফ প্যান্ট এবং সুতির একটা জামা। অবশ্য ততদিনে আমি পরপর দুটি শ্রেণি অতিক্রম করতে পেরেছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় এবং রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ। হেডমাস্টার আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন প্রথম শ্রেণির জন্য বরাদ্দ সহজ পাঠের প্রথম ভাগ। তা হেডমাস্টারের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তার সম্পূর্ণ পাঠ শেষ করেছিলাম। উনিশএর ঘর নামতা পর্যন্ত গড় গড় করে বলতে পেরেছিলাম। সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগ তখন আমাকে দেওয়া হয়েছিল।
বাবার কাছেই তখন পড়াশোনা করে নিতাম। অংকগুলি এতই মুখস্থ হয়ে গেছিল যে
স্কুলে স্লেটে করতে দিলেই নিমেষের মধ্যেই করে ফেলতাম। খুব অল্পদিনেই সব আয়ত্ত হয়ে যেত। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সেই সময় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তাই মাস্টার মশাইরা সকলের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখতে পারতেন। ক্লাস টু-তেই আমরা ইংরেজি হাতের লেখা শিখে নিয়েছিলাম। রোজ এক পৃষ্ঠা করে খাতায় লিখে নিয়ে যেতে হতো। মাস্টারমশাই দেখতেন আর যে লেখাটি খারাপ হয়েছে তা ঠিক করতে বলতেন। আগের ক্লাসের বড় বড় ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা না করলে তাদের কান ধরে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। কখনো-বা হাঁটু গেড়ে বসিয়ে পড়া মুখস্থ করানো হতো।
সন্ধ্যাবেলায় রোজ লম্ফুর আলোয় পড়তে ভালো লাগতো না। উঠোনে তালাই পেতে পড়তে বসতাম। একটু হাওয়া দিলেই লম্ফু নিভে যেত। সেবার বাবা মাঠের যোগানদারি করে কিছু ধান সংগ্রহ করেছিল। ধানগুলি শহরের আড়তে বিক্রি করে বাড়ির জন্য কাপড়-চোপড় এবং অন্যান্য আনাজপাতিও কিনেছিল। তারপরেও কিছু টাকা বাড়তি থেকে যায়। তখন আমার জন্য কিনেছিল একটি ল্যাম্প । লম্বা কাচওয়ালা লম্ফু। কিন্তু নিচে বাতি ওঠানামা করার একটা স্ক্রু। তেল ভ’রে বাতি জ্বালিয়ে দিলেই বাতাসে আর নিভে যেত না। চারিদিকে আলোও ছড়িয়ে পড়তো। গ্রামের মানুষ সেদিন এই ল্যাম্পটি দেখার জন্য একে একে এসেছিল। বাবা বলেছিল, দেখো কেমন নতুন জিনিস এনেছি, পড়াশোনা করলে তো এরকম জিনিস লাগবেই!
সবাই দেখে বলেছিল, না এবার চমৎকার হয়েছে। এই বাজারে হ্যারিকেন কেনা মুশকিল, কিন্তু আড়াই টাকা দিয়ে একটা ল্যাম্প কেনা সহজ।
বহুদিন যত্ন করে এই ল্যাম্পটি রেখেছিলাম। রোজ সাবধানে কাপড়ের টুকরো দিয়ে মা সেটি পরিষ্কার করে দিত। আর উঠোনের চারিপাশে গ্রামের মানুষেরা আসতো কত রকম গল্প করতে। আমি পড়তে পড়তে তখন ঘুমিয়ে যেতাম আর কিছুই মনে থাকতো না। অনেক রাতে দেখতাম কোথাও আমাদের বাড়ির পাশেই বাঁশের ঝাড়ের আড়ে শেয়াল ডাকছে। তখন ভয়ে উঠে মাকে চেঁচাতাম। খোলা আকাশের দিকে চেয়ে দেখতাম, একা শুধু চাঁদ জেগে আছে সারা পৃথিবীতে আলো ছড়িয়ে। ভাসমান মেঘেরা নানা আকৃতির দূরে দূরে ভেসে চলেছে। হয়তো বর্ষা আসতে আর দেরি হবে না। ব্যাং ডাকারও শব্দ পেতাম। অনেক রাতে উঠে তখন ঘরের ভিতরে গিয়ে ঘুমাতাম। প্রথমদিকে এভাবেই কাটতে কাটতে যখন একটু বড় হলাম তখন মনের মধ্যে কল্পনা শক্তিরও প্রাদুর্ভাব ঘটলো। মহাশূন্যে চেয়ে থাকতে থাকতে আনমনে কোথাও যেন চলে যেতে লাগলাম। যেখানে অন্য কোনো দেশ, অন্য সব ঘরবাড়ি, অন্য সব মানুষেরা আর অঢেল সব খাবার-দাবার। নিজের মনেই হাসতে লাগলাম, কাঁদতে লাগলাম, কথা বলতে লাগলাম। বাবার পাঁচালি পাঠের সুর একটানা কানের মধ্যে বাজতে লাগলো। আর সেই সব চরিত্রগুলি তাদের রূপ ধরে আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। কেউবা তরবারি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে, হাতির পিঠে অথবা রথে চড়ে যেতে লাগলো। কোথাও যুদ্ধ হতে লাগলো, তাদের তরবারির ঝনঝনাৎ শব্দ পেতে থাকলাম। কোথাও দৈত্যদানো তাদের বীভৎস রূপ নিয়ে হাজির হলো। আমার সেই রূপকথার বইটিতে তখন যে ছবিগুলো দেখছিলাম, সেগুলোই যেন ফিরে ফিরে আসতে লাগলো। রাক্ষস-খোক্ষসের বড় বড় নোখ আর দাঁত দেখে আমি শিহরিত হলাম। (চলবে) 🍁
🍂গল্প / এক
রাখী নাথ কর্মকার
ফেরা
–“কাল সকালটা ছুটি দেবে বৌদি? বিকেলে ঠিক চলে আসব। বুধোর বাপটা ফোন করেছিল। কালকেরের ভোরের টেরেনে ফিরছে গো…” উচ্ছ্বাসের প্রাচুর্যে পদ্মার ঘামে চকচক, ক্লান্ত মুখটায় যেন হ্যালাইডের আলো ঠিকরে পড়ছে! বাসনগুলো মুছতে মুছতে একটু নিচু স্বরে আবদারটা করল পদ্মা। আলতো বিরক্ত হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না রেবতী-“বেশ তো, তবে দেখিস, বিকেলটা যেন কামাই করিস না। পরশু তোর দাদাবাবুর জন্মদিন। মাবাবা আসবেন। একা হাতে এতসব সামলাতে পারব না আমি।” তারপর বেশ হালকাভাবেই বলল –“দেখ তো, কতো চিন্তা করছিলি! বলেছিলাম, চিন্তা করিস না…”
-“কী করব বৌদি, ঐ বুধো আর বুধোর বাপ…ওরা ছাড়া যে কেউ নেই আমার…” একরাশ অব্যক্ত কষ্ট এসে জমাট বাঁধে পদ্মার ছলছলে চোখের কোণে। বাপমার অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিল মেয়েটা। বিয়ের পরে চাঁদকোণার ঝুপড়িতে থাকতে থাকতেই একা পোয়াতি বউটাকে ফেলে রেখে বরটা সোনাপট্টির জহুরি বাজারে কাজ করতে মুম্বাই চলে গিয়েছিল। প্রতিমাসে টাকাও পাঠাত না, বাধ্য হয়ে কোলের বাচ্চাটাকে নিয়েই ওদের বাড়িতে কাজে লেগেছিল পদ্মা। গত বছর লোকটা একবার ফিরেছিল বটে, তারপর এতদিন বাদে আবার এই ডামাডোলের মাঝে…
আরে বাবা, ফিরতে তো হবেই, নিজস্ব আশ্রয়ের নিভৃত উষ্ণতায়…! বাড়িঘরদোর ছেড়ে বিদেশবিভুঁইয়ে যতই পেটের টানে দৌড়তে হোক, শেষ অবধি নিজের ঠাঁই বলে কথা!
-“দিসোনার দুধ, তোমার চা…সব রেডি করে রেখে দেছি। চিন্তা কোরো নে বৌদি,কাল বিকেলে ঠিক চলে আসব’খন!” কোমরে গোঁজা আঁচলটা খুলে নিয়েই পদ্মা দৌড় লাগায় দরজার দিকে। চারবছুরে ছেলেটা নির্ঘাত এতক্ষণে দুপুরের ঘুম থেকে উঠে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
গতকাল রাতেই টিভিতে ঘোষণা করা হয়েছে, ভাইরাস সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় পরশু থেকে দেশে লকডাউন জারি হচ্ছে। গৃহবন্দি জীবনের রোজনামচা শুরু হবে এবার! ভাবলেও অবাক লাগে, কী একটা নগন্য, তুচ্ছ ভাইরাস এসে সমগ্র বিশ্বেই যেন মানব সভ্যতার ভিতটা নাড়িয়ে দিয়েছে! খবরের কাগজ; পলাশ; পাশের ফ্ল্যাটের তৃষাদি; মিষ্টুনির নার্সারি স্কুলের মায়েরা; ফোনের ওপারে শ্বশুরশাশুড়ি; পদ্মা…সবার মুখে এখন এক কথা। ছোটখাটো নামহীন মুহূর্তগুলোর মধ্যে দিয়ে সবসময়ই যেন বয়ে চলেছে এক চাপা আতঙ্কের স্রোত! প্রত্যেকে যেন এক একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মুখে বসে আছে,যে কোন সময় প্রবল বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সকল পার্থিব বন্ধন!
পনেরো দিনের জন্যে সাইট ভিজিটের কাজে চালসা যেতে হয়েছিল পলাশকে। ইতিমধ্যে পনেরো দিনের কোটা পের হয়ে কুড়ি দিন হতে চলেছে, মানুষটার এখনো ফেরার সময় হল না! রেবতী কিছু বললেই রাগ করে কাজপাগল লোকটা-“আরে, এভাবে কাজ ফেলে রেখে চলে আসা যায় নাকি? সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ারের একটা দায়িত্ব আছে তো!” নাও, চলো! পরশু থেকে এবার সমস্ত কাজ বন্ধ! অনির্দিষ্টকালের জন্যে।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রেবতী । শহরের একপ্রান্তে ওদের ফ্ল্যাটের বারান্দায়, বিকালের এই সময়টা কমলাআভার নরম সূর্যটা চুপটি করে গা এলিয়ে এসে বসে থাকে। একটু দূরে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর জলাজমি। আম, জাম, নিম, ডুমুর ছাড়া বেশ কিছু জানাঅজানা গাছও রয়েছে। নানা ধরনের স্থানীয় পাখি এসে ভিড় করে এখানে-বক, পানকৌড়ি, দোয়েল, ফিঙে, শামুকখোল। শীতকালে উড়ে আসে নানা পরিযায়ী পাখি। কিছু পরিযায়ী পাখি আবার দক্ষিণ ভারত থেকে বর্ষার শুরুতেই চলে আসে, চাতক! যেন সঙ্গে করে নিয়ে আসে বর্ষাকেও। ঝুঁটিওলা সাদাকালো ছোট্ট পাখিটা তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে হাঁটে, সুরেলা কণ্ঠস্বরে মাতিয়ে তোলে অলস বিকেল…‘পিউ…পি-পি-পিউ’! কোকিলের মতোই ইনিও নাকি পরের বাসায় ডিম পাড়েন! লম্বা লেজের সাদাকালো মাথার প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার সন্ধে হলেই জলাজমিতে ঝাঁপ দিয়ে স্নানে মাতে! জলায়, মাঠে চরে বেড়ানো গরুগুলোর পিছনে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায় কালোমাথা কাস্তেচরার দল…ঝোপঝাড়ে গবাদিপশুদের শরীরের নড়াচড়ায় ছিটকে আসা কীটপতঙ্গগুলো খাওয়ার আশায়! কাস্তেচরাগুলোকে কুচো মাছ,ব্যাঙও খেতে দেখেছে রেবতী। তবে স্থানীয় বদমায়েশ ছেলেগুলোর জন্যে এখন এখানে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পদ্মার কাছে শুনেছে, জলার ধারে বিদ্যুতের তার বিছিয়ে রাখে ছেলেগুলো! কখনো বা শামুক, ব্যাঙ, গমের মধ্যে বিষ দিয়ে রাখে। পাখিগুলো সব ঐ টোপ খেয়ে ছটফটিয়ে ছিটকে পড়ে! ইশ, দমবন্ধ হয়ে আসে রেবতীর! আচ্ছা, প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানালে হয় না?
হাতপা ছড়িয়ে ইজিচেয়ারটায় বসে রেবতী। আজ থেকেই মিষ্টুনির স্কুল বন্ধ। পাশের ঘরে মেয়েটা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। এখন আর ঘড়ির কাঁটা ধরে জীবনটাকে ছন্দে বাঁধার তাড়া নেই। চরাচর ব্যাপ্ত নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে বয়ে চলেছে। এই যে এক অদ্ভুত অসুখে অস্থির পৃথিবী, প্রকৃতির কোথাও তার কোন চিহ্নমাত্র নেই, কোন হেলদোল নেই! পরশু রাতে পলাশ ফিরবে। শুধু এই ভাবনাটুকুই এই মুহূর্তে রেবতীর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে জলতরঙ্গের টুং টাং সুর তুলে চলেছে!
* * *
-“গতকাল লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দিতে পারলুম নে গো বৌদি! ঘরে যে আমার কচি ছেলে…” হাউ হাউ করে কাঁদছে পদ্মা। বরটা জেলায় ফিরলেও ঘরে ফিরতে পারেনি। শ্রমিকদের নিয়ে এসে পৌঁছনো বিশেষ ট্রেন থেকে নামতেই নাকি বেশ কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। স্টেশানেই তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে, তাতে ধরা পড়েছে পদ্মার বরসমেত আরো পাঁচজন শ্রমিক মারণ ভাইরাসের শিকার। ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাকি সবাইকে গৃহ নিভৃতবাসের কথা বলা হয়েছে। সরকারি কোয়রান্টিন সেন্টারে আর জায়গা নেই। হাসপাতালেও না। অনেকেই নিজের নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কিন্তু ওদের ঝুপড়িতে পদ্মার বরকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পদ্মা নিজেও চায়নি ঐ একফালি দরমার ঘরে লোকটা পা রাখুক! কোলের ছেলেটার কথা ভেবে বুকে পাথর চাপা দিতে বাধ্য হয়েছে! চুপটি করে শুধু শোনে রেবতী, এক অদ্ভুত যন্ত্রণা আর অবসন্নতার বোধ যেন ওকে আঁকড়ে ধরতে থাকে।
খাটের ওপর ছড়িয়ে থাকা মিষ্টুনির বইখাতাগুলো গুছিয়ে তুলতে তুলতে মনে পড়ে যায় রেবতীর, কাল পায়েসের জন্যে দুটো দুধের প্যাকেট নিয়ে আসতে বলতে হবে পদ্মাকে। ছয়বছরের মিষ্টুনি এক মনে ড্রইং খাতায় হাবিজাবি কাটছিল-লাল ফুল, সবুজ পাতা, হলুদ পাখি, ট্যারাবেঁকা সূর্য! মাকে দেখেই খলবলিয়ে ওঠে-“মা, পাপার জন্যে গ্রীটিং কার্ড বানাচ্ছি, দেখো – ভালো হয়েছে?” টুক করে মেয়ের গালে একটা স্নেহের পরশ এঁকে দেয় রেবতী।
আগামী কাল সকালেই শ্বশুরশাশুড়ি চলে আসবেন। থাকবেন কিছুদিন। রেবতীর বাবামা নেই। তবে, দেশের বাড়িতে শ্বশুরশাশুড়ি এই দিনটার জন্যে বসে থাকেন! কিন্তু কাজপাগল পলাশের কাছে বোধহয় সবই গৌণ। সেদিক থেকে লকডাউনটা রেবতীর কাছে শাপে বরই হয়েছে! আরে বাবা, প্রজেক্ট-প্রেজেন্টেশন সব তো সারা বছর থাকবে, জন্মদিন তো বছরে একটি বারই আসে!
* * *
পলাশ রোজ দুপুরে লাঞ্চের সময় একবার ফোন করে, আজ কোন কারণে করতে পারেনি। রেবতী বেশ ক’য়েকবার চেষ্টা করেছিল। আউট অফ নেটওয়ার্ক কভারেজ বলছে। গতকাল রাতে শেষবারের মতো পলাশের সঙ্গে কথা হয়েছে ওর। অফিসে নতুন একটা প্রজেক্ট ঢুকেছে, একটা মিটিং ছিল গতকাল বিকেলে। কাল রাতে একটু যেন উদ্বিগ্ন লাগছিল পলাশকে। জোর করতে বলেছিল, সাইটে আজকাল খুব চুরি হচ্ছে। রিইনফোর্সমেন্ট; স্টোর রুম থেকে সিমেন্টের বস্তা; এমনকি ভাইব্রেটর মেশিনও চুরি হয়ে যাচ্ছে। সাইটে কতগুলো স্থানীয় ছোকরা আসে মাঝে মাঝে, তাদের একজনকে পরশু রাতে একবার পিছনের জঙ্গলে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল পলাশ। গেস্ট হাউসের জানলা থেকে টর্চের আলো মারতেই জঙ্গলে উধাও হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। এরা মাঝে মাঝে নাকি জঙ্গল থেকে শাল, সেগুন কাঠও চুরি করে নিয়ে যায়, স্থানীয় মাফিয়াদের সঙ্গে ওদের যোগসাজস আছে। এই তো কিছুদিন আগেই চালসা রেঞ্জের বিট অফিসার মি.পাইনের নেতৃত্বে বনকর্মীরা মেটেলি ব্লকের ধূপঝোরায় প্রচুর অবৈধ চোরাই কাঠ উদ্ধার করেছে। সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও আসল পান্ডা অবশ্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
শুনেই রেবতীর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠেছিল-“শোন, আগ বাড়িয়ে তুমি কিছু করতে যেও না! আর ডিনারের পরে গেস্ট হাউসের আশেপাশে হাঁটার অভ্যেসটা এবার বন্ধ করো, প্লিজ। আমার জন্যে না হোক, অন্তত মিষ্টুনির জন্যে!”
কথা ঘুরিয়েছিল পলাশ-“ওসব কথা থাক, তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এখন এখানে সমস্ত কাজ বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকবে। কাল রাতে অফিসের গাড়িতেই ফিরছি। তোমাদের জন্যে কিছু নিয়ে আসব?”
ঘরে চাল, ডাল, আলু, ডিম সব মজুত আছে। পদ্মা আজ দুপুরে এসে চিকেন বিরিয়ানি, রায়তা করে দিয়ে গেছে। আর গাজরের হালুয়া। পলাশের প্রিয়। বারান্দাবাগান থেকে তুলে আনা দুটো লাল গোলাপ টিটেবিলের ফুলদানিটায় সাজিয়েছে রেবতী। দুপুর থেকেই আজ তুমুল বৃষ্টি। উত্তাল বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ছিলই। পলাশকে বলেছিল, সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে, কী করেছে কে জানে! এদিকে খবরে জানাচ্ছে, নিম্নচাপের জন্যে গতকাল রাত থেকেই অতি ভারি বৃষ্টি শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গে, অনেক জায়গায় গাছ ভেঙে পড়েছে। প্রবল বর্ষণে তিস্তা, বাংড়ি নদীতে ক্রমশ জল বেড়ে চলেছে। বিচ্ছিন্ন ডুয়ার্সের টোটোপাড়া এলাকা। জলপাইগুড়ির কাছে দোমোহনিতে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।
দুপুর-বিকেল সব একাকার হয়ে যাওয়া আঁধার অবেলায় টুং করে একটা মেসেজ ঢোকে রেবতীর মোবাইলে। পলাশের কলিগ সুজিত পাঠিয়েছে। “ফোনে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। নেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ নেই। কাল রাতে ডিনারের পরে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও গেস্ট হাউসের পিছনের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছিল পলাশ। একান্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আজ ভোরে পলাশকে গেস্ট হাউসের পিছনের জঙ্গলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার। আমাদের বিডিএসের ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, মাথায় ভারি গাছের ডাল পড়ে…!”
* * *
দিনরাতের বোধ এখন সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছে রেবতীর। বৃদ্ধ শ্বশুরশাশুড়ি, মিষ্টুনির অবয়ব…ঘুরে বেড়ায় ঝাপসা চোখের সামনে। ঘুমহীন, জ্বালাধরা চোখের দৃষ্টিতে জেগে থাকে শুধু নীরব শোকের দাগ! পদ্মাটা চুপচাপ কাজ করে চলে যায়। অসুস্থ ঐ পাঁচজন শ্রমিকের সঙ্গে পদ্মার বরটা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। অবস্থা উন্নতির দিকে। খুব শিগগিরই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবে। পদ্মার দেওর আর ঝুপড়ির কয়েকজন শ্রমিক অবশ্য এখনো মুম্বই থেকে ঘরে ফিরতে পারেনি।
এক অস্তিত্ববিহীন অবকাশে, সন্ধের অন্ধকারে রেলিংএ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিথর রেবতী। মনের মধ্যে ভেঙেচুরে তালগোল পাকিয়ে চলে শুধু একটাই প্রশ্ন- গাছের ডাল নাকি ভারি কিছুর আঘাত? ব্যাঙ নাকি বিষ ব্যাঙের টোপ? চটচটে আকাশে, অন্ধ নক্ষত্রের নিচে অন্ধকারের জটিলতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। দূরে জলার এক কোণে মরা চাতকটাকে ঠ্যাং ধরে হাতে ঝুলিয়ে ঘরে ফেরে দুটো ছেলে।
সবাই তো ঘরে ফিরতে চায়। কিন্তু চাতকটার মতো তাঁদের ঘরে ফেরা হয় কই? 🍁
🍂বড় গল্প
শাশ্বত বোস
জতুর্থ কলম ও রুইতন রেজোন্যান্স
বর্ষা কিংবা বসন্তের ঘন থকথকে হয়ে আসা একটা বিকেলবেলা। নদীর পাড়ের নগরবর্ত্তীকায় সূর্য্যের শেষ চিহ্নটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এমন আত্মঘন মুহূর্তের একটা সীমাহীন দখল কাজ করছে সর্বস্বান্ত সভ্যতার ক্যানভাসে। নদীতে হয়তো এক্ষুনি জোয়ার আসবে, জল বাড়ছে একটু একটু করে। নদীর পাড়ের শেষ প্রান্তে ঝুলে থাকা গাছটার শিকড় ভাবী ভাঙ্গনের মুখে অল্প খুঁড়িয়ে হাঁটা জমিটার শেষটুকুকে আষ্টে পৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরতে চেয়ে বুনেছে দোষ আর আক্ষেপের স্পেক্ট্রামি কক্ষপথ। তার ছলাৎ ছলাৎ ভাবসম্প্রসারণে ভেসে উঠছেন শ্রাবস্তীর বনলতা। এতো অনুকূল পরিবেশেও গাছটির গায়ে একটাও পাতা নেই। তার বিবস্ত্র বিবরে দময়ন্তী নোটিফিকেশনের স্মৃতি উস্কে দিয়ে বেরোনো সাতপুরোনো ডালপালা বেয়ে, বুঝি নেমে আসবে মৃত্যুর হীমশীতলতা। পিছন দিক থেকে উঠে আসা আলগা একটা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে একজন বৃদ্ধ, শূন্যচোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর অস্বাভাবিক ফ্যাটফ্যাটে রঙের শরীর থেকে সব কলকব্জা বেরিয়ে যাওয়া, দ্রাঘিমার ঐশ্বরিক চরিত্র অববাহিকায়। সেই বৃদ্ধ হয়ত বিগত ৭৫ বছর ধরে প্রেমের কবিতা লিখে আসছেন সমানে। নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। হয়তো ছেলেটি নদীর উৎস আর মেয়েটি মোহনা। ছেলেটির আলজিভ থেকে বেরিয়ে নদীটা একটা আঁকা বাঁকা স্বার্থপর সরীসৃপ গতিতে ভেসে গিয়ে ব্রাত্যজনের বিলুপ্তির কড়চা লিখছে মেয়েটির পেলভিস বরাবর। গাছটার হাড় গিলগিলে শরীরটা জুড়ে দিনে দিনে যেন ফুটে উঠছে বিষণ্ণ দেশকালের মানচিত্র আর তাতে বিন্দুর মত ভেসে রয়েছে একটি পাখির বাসা। ‘হয়ত পাখিটাকে বুকে করে একদিন উড়ে যাবে গাছটা’, এমনটা মনে হয় এইরকমের আবছা আলো আঁধারিতে। গাছটাই হয়ত জগৎ সংসারের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, একদিন সে বনবীথিকা হবে। ছেলেটি দিগন্তের নির্জনতার পেটের ভেতর খুঁজে চলেছে বিলম্বিত বিষক্রিয়ার সীমাহীন অসভ্যতা। ঈষৎ পৃথুলা মেয়েটি ছেলেটির সঞ্চারী দুচোখে সমানে খুঁজে চলেছে, দশমীর ভেজা গায়ে ঈশ্বরী মূকাভিনয়। ছেলেটি এবং মেয়েটি এই ক্ষণে একে অন্যতে মগ্ন, সমাধিস্থ। মেয়েটি তার গোল গোল হাতগুলি বাড়িয়ে দেয় ছেলেটির দিকে,
মেয়েটি: “তোমার ঠোঁটে আমার ঘ্রাণ, যেন অপরাহ্নে নবান্নের অঘ্রান
তোমার কানে আলতো চুমু, যেন প্রদাহের আতিশয্যে
অভিসারী তল মাপে নীরব অক্ষর।”
ছেলেটি হাতের মুঠো থেকে বার করে একটি সাদা খাম বাড়িয়ে দেয় মেয়েটির দিকে। A4 সাইজের খাম একটা।
ছেলেটি: “ফর ইউ! যেমনটা চেয়েছিলে রঙ্গীন পাতায় রঙ্গীন কালির দাগ, দুটোই আদ্যোপান্ত ভিন্ন সত্তা, কিন্তু বিকেলের উদ্বৃত্ত ছায়ায় মিলে মিশে একাকার।”
এই দৃশ্যটি সত্যি হয়ে যেত হয়ত সহজ জীবন্ত ধূলিকণার রোমকূপে আগডুম বাগডুমের জাগতিক সঞ্চারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সিচুয়েশনটা এন্টাগোনিস্ট হয়ে ওঠে সমান্তরাল সময়ে লীন দুটি নিসর্গ চিত্রে। নদীর মানচিত্র জুড়ে একটা অনিবার্য্য নৌকার প্রবেশ ও সেই সঙ্গে এই এলেবেলে কনভার্সেশনের মধ্যে প্রতিসরণের খেলা দেখায় খোলা আকাশের প্রিজম তর্জনীর গায়ে ধাক্কা খাওয়া, সূর্য্যের সদ্যঃপাতী তপশ্চর্য্যার প্রতিক্রিয়াশীল নিদর্শন স্বরূপ ঠিকরে আসা ‘শেষের দিকের আলো’। এই চিত্রটা হয়ত গোঙানির ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণের ভেতরে। নাগালের মধ্য থেকে স্থান-কাল-পাত্রের নৈসর্গিক রূপান্তরের মাঝে, শুক্লপক্ষের ঈশ্বরী জোয়ারের দিকে ভেসে যায় একদল সিঁদুরে মেঘ পাপিয়ার দল।
সুলগ্নাকে কৌশিক দেখে শুনেই বিয়ে করেছিল। মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন প্রেম করার আগ্রহ বা ধৈর্য্য কোনোটাই তার আর থাকে না। বিশ্বাসটা টোল খায়, এদিকে মন থিতু হতে চায়। ঠিক তখন প্রেমের ব্যাপারে আশাবাদী থাকাটা নিতান্ত বিপরীতগামীতার পর্যায়ে পরে। বত্রিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে খানিকটা এমনতর ভাবনা চিন্তা থেকেই ম্যাট্রিমোনি সাইট, আনন্দবাজার পাত্র-পাত্রীর অ্যাড এ চোখ রাখা। অনলাইনে পাত্রী দেখা পর্ব সারার পর হুট করে একদিন সামনা সামনি মেয়ে দেখা। কয়েকদিনের ফোনালাপ ও অবশেষে বেদত্রয়ের নির্মেদ আচারে,মধুপর্কের মিছরি গল্পে ‘তুহু মম প্রাণ হে’। বিয়েতে দানসামগ্রী বেশ ভালোই পেয়েছিল কৌশিক। বাবা মায়ের একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, খুঁতখুঁতে সৌখিন। ঘরদোর ভরিয়ে নিজের পছন্দের আসবাব করিয়েছিল ও। এটা অহং নাকি আত্মসচেতনতা জানি না। কিন্তু শিক্ষা, কোয়ালিফিকেশন, এল.পি.এ রুপী মানি মেকিং অ্যাবিলিটি এগুলো ক্রমশঃ কৌশিককে ঢেকে ফেলছিল। সেই কৌশিক যে একদিন মনে প্রাণে বিশ্বাস করত, মেয়ের বাড়ি থেকে কিছু নেওয়াটা অন্যায়, ওর বাবা নেননি ওও নেবেনা। যে কথাগুলো একদিন ও নমিতাকে বলেছিল গর্ব করে, সেগুলো নিজেই ভুলতে বসেছিল তিলে তিলে। হয়ত সেজন্য নমিতাই দায়ী। এই মেরুদন্ডহীন সমাজের দর কষাকষি, পাত্রের রোজগার সম্পর্কে অদম্য কৌতুহল, ডেটা ভেরিফিকেশনের রকমারি পদ্ধতি কৌশিককে ভেতর থেকে পাল্টে দিয়েছিল আমূল। এক মেয়ের বাবা তো রীতিমত গোয়েন্দা লাগিয়েছিলেন, কৌশিকের পেস্লিপ ভেরিফিকেশনের জন্য। একভাবে দেখতে গেলে পাত্রীপক্ষের এই আয়বহুল সুপাত্রের জাগতিক চাহিদা, ভুল কিছু নয়। তবু উপভোক্তা সম্প্রদায়ের সামনে নিজের এই ক্লীব পণ্যগামীতা আর অন্যায় ভোগবাদের নেক্সাসের মুখে পরে, ক্যামেরার লেন্সের সামনে নুহ্য ধূমকেতুর মত প্রায় নিভে আসা বিশ্বাসের একটা তেল কাসটে গন্ধ গায়ে মেখে, ওয়েব সিরিজের ঢঙে অনর্গল নিজের আজন্ম লালিত ছবিটা পাল্টে ফেলতে থাকে কৌশিক। সুলগ্নার সাথে ওর বিয়েটা নিয়ে কৌশিক নিঃসংশয় হয়েছিল, যখন সুলগ্নার বাবা ওর মাইনে নিয়ে প্রায় একটা কথাও জিজ্ঞেস করেননি। অবশ্য মফস্বলের বুকে কৌশিকের প্রাসাদোপম বাড়ি, গাড়ি এগুলো দেখে প্রশ্ন করার কথাও নয়। তবু যেন কৌশিকের মনে হয়েছিল পরিবারটা কোথাও আর চারপাঁচটা চলতি উদাহরণের থেকে আলাদা। অবশ্য কৌশিক বুঝতে পারেনি পাত্রীর বাবার সেদিনের সেই কৌতূহলহীন দর্শকশৈলী আসলে এসেছিল ওর উদারতার পুরস্কার স্বরূপ। সুলগ্নার একটা জন্মখুঁত ছিল। মেয়ে দেখতে গিয়ে অবশ্য ওর বাবা স্পষ্ট করে কৌশিককে জানিয়েছিলেন সে কথা। তবু না বললেও এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হত না কৌশিকের কাছে। কৌশিকের শিল্পী চোখ সুলগ্নার মুখশ্রী দেখেছিল, সুলগ্নার অমেধ্য দুটো চোখে নীহারিকার চারা বপন করেছিল মনে মনে। সুলগ্নার ঠোঁটের ওই চেরা দাগটা মালকোষ বিছিয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল কৌশিকের পেরিটাল লোবের পশ্চাৎভাগে। কিন্তু বিয়ের পর মগরা আতরের তুলো ভিজিয়ে চারপ্রহরী উপন্যাসে ঘটলো পার্থিব পরিবর্তন। সংসার নামের ভীষম বস্তুটি কৌশিকের কাছে হয়ে দাঁড়ালো এক মূর্তিমান মরীচিকার মতন। যে সুলগ্নাকে কৌশিক চেয়েছিল নিজের গৃহিনী হিসেবে, যে তার ঘর গৃহস্থালীর দিকে নিপুণ নজর রাখবে, তার সংসারের খুঁটি নাটি সামলাবে নির্মোহ, নির্বেদী পরিচ্ছন্নতায়, সেই সুলগ্না হঠাৎই ভীষণ বারমুখো হয়ে উঠলো। চাকরির পরীক্ষা দেবার নাম করে ঘন ঘন উঠে বসে থাকতে লাগল নিজের বাপের বাড়িতে। অথচ বিয়ের আগে সুলগ্না ও তার পরিবার স্পষ্ট বলে দিয়েছিল, চাকরীর বয়স তার পেরিয়ে গেছে সুতরাং ওর আর চাকরী হবে না ধরেই এগোতে। আসলে পরে কৌশিক বুঝেছিল এই বাংলা বাজারে চাকুরিরতা মেয়েই ছেলেরা খোঁজে, যাতে হাতখরচ কিংবা ডিভোর্স হয়ে গেলে খোরপোষ এই দুটোরই কোন ঝামেলা না থাকে। আসলে একটা উপযুক্ত চাকরীর অভাবে সুলগ্নার মত খুঁতি মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চাইছিল না। সেখানে কৌশিকের চাই ‘চাকরি করবে না’ এমন গৃহবধূ। অতএব ভুলের সাথে চিবিয়ে খাওয়া মানবিক প্রার্থনা ঢেকে দিল সহজ যামিনী খুঁত, আড়ালে মেপে নিল একে অন্যের ভগবতী খামতি। কৌশিক একদম গোড়া থেকেই জীবনের কাছে নিজের চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারে খুব পরিস্কার ছিল। শিক্ষানবীশ গৃহিনী হিসেবে সুলগ্নাকে নিয়ে সংসারের নিয়মমাফিক গার্হস্থ্য দর্শনের অমৃতক্ষণ গোড়াতেই ধাক্কা খেয়েছিল কৌশিকের জীবনে। সুলগ্না ঘরের প্রায় কোনো কাজই জানতো না, এমনকি একটা দেশলাই জ্বালতেও ভয় পেত। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কৌশিক অ্যাডজাস্ট করত। হয়ত উল্টোদিকে সুলগ্নাও অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করছিল। রেগে গেলে কৌশিকের মাথার ঠিক থাকে না, মুখে যা আসে দু চার কথা শুনিয়ে দেয় সুলগ্নাকে। বিছানায় রতিসুখ তবু সে এডজাস্ট করতে পারে কিন্তু সংসার সুখ? দাম্পত্যসুখ? ওদের বিবাহিত জীবনে রাতের আয়ু বাড়ে। ক্রমশঃ সেই রাত গভীর অসুখে ভুগতে থাকে। তারপর একদিন সাংসারিক সূচক নামতে নামতে অসুখী বারান্দায় ধুতরো ফোঁটে। তবু সেই নিশ্চুপ, নির্ভার, ছায়াচ্ছন্ন রাতগুলোয় বিশ্বাসের আগে বুকমার্ক লাগিয়ে সুলগ্নাকে কাছে ডেকে নিতে চেয়েছে কৌশিক। গভীর রাতে সুলগ্না ঘুমিয়ে পরার পর ওর খোলা চুলে আলগোছে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তবু আলগা ভূমিকার বিপরীতে আলগোছে বেঁধে ফেলা ভালোবাসার শিরা উপশিরায় কৌশিকের সম্ভোগ ক্ষুধা সুলগ্নার কাছে কুলকুচি প্রলাপ হয়েই রয়ে গেছে। তবুও শেষের রাতে যখন ওদের ভেতর অশান্তি চরমে, আশেপাশের ফ্ল্যাটের কৌতূহলী দেওয়াল কান পেতেছে স্থানু পরশ্রীকাতরতার হুটপাট প্রবণতায়। তখনও উত্তাল বিবাদী কলহে টলমল নিজের সংসার তরণী কৌশিক বাঁধার চেষ্টা করেছে, আপ্রাণ গল্পগুচ্ছের মুখবন্ধে। তবু প্রবল অভিযোগ আর উভমুখী বিস্ফুরিত তেজে তা তলিয়ে গেছে বারবার। তারপর যখন কাঠের বাক্সে ভিজতে থাকা বাদামের খোসার মতন ঘনীভূত উড়নচন্ডী প্রহরে সুলগ্না বলল, “আমি আর তোমার সাথে সংসার করতে পারবো না। আমি বাবাকে ফোন করে দিয়েছি। কাল এসে ওরা আমাকে নিয়ে যাবে।” কৌশিকের চোখে তখন ভেসে উঠেছে গতিহীন উপসর্গের পঞ্চভূতে পঞ্চমী চাঁদ। ঠিক যেমনটা এখন ও দেখতে পাচ্ছে ওদের বাড়ির ছাতে সার দিয়ে সাজানো ফুলের টবগুলোয়। জমি হাঙ্গরের বীভৎস থাবায় কল্লোলদের বাড়ি লাগোয়া বাগানটা থেকে বয়ঃবৃদ্ধ গাছগুলোকে মাটি সমেত উপরে ফেলে যখন কৌশিকের আজন্ম লালিত কবিতাময় দেশটার মানচিত্রের নবীকরণ হয়, তখন এই টবগুলোয় এক চিলতে কৃত্রিম মাটির আশ্রয় খুঁজে ও জন্ম দিয়েছিল একটা বিরিঞ্চি সভ্যতার, যেখানে কোনো উদ্ভিদের মৃত্যু নেই। এই খানটায় সুলগ্নার স্মৃতি লেগে আছে। এতদিন আপ্রাণ চেষ্টা করেছে কৌশিক, প্রতিদিন দশ ঘন্টার ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে বাগানটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু কদিন ধরে বেশ কিছু গাছ মরতে শুরু করেছে। সৌর ঝাড়ু প্রহরে একান্নবর্তী নিরন্তর একটা অসুখ যেন পেয়ে বসেছে ওদের। বুক ফাঁটা একটা আর্তনাদ ভিজে বারান্দাটার গায়ে কান পাতলে শুনতে পায় কৌশিক। ফুল গাছ ওর প্রথম প্রেম। রাতের হাসি আর কথা নিয়ে মামাবাড়ির বিশাল বাগানের মাঝে সারস্বত বোধ, শিক্ষা আর সাহিত্যের আঁচল বুনতো ওরা ছোট্ট কৌশিকের একাদশী শরীরে। ওকে জাপ্টে ধরতো গৃহিনী ঘরে সভ্য ছড়ানো গুঁড়ো কর্পূরের মতো। বিয়ের পর প্রথম প্রথম ও নিজে হাতে বাগানটা দেখভাল করতো। তারপর আস্তে আস্তে বাগানটার পুরো ভার তুলে দিতে চেয়েছিল সুলগ্নার হাতে। হর্টিকালচারে সুলগ্নার প্রায় কোন ইন্টারেস্টই ছিল না। এমনকি কৌশিকের আগ্রহের যে কোন ব্যাপারেই সুলগ্না নির্লিপ্ত থেকেছে চিরকাল। চিরকালই সে যেন স্বার্থপরতা আর অলস একঘেঁয়ে যাপনচিত্রের সংমিশ্রণে ঢিমে আছে সিদ্ধ হওয়া পাঁচমিশালি সবজি গোছের। অথচ বিয়ের আগে ওর মা বলেছিলেন ‘আমার মেয়ে এই পারে, ওই পারে, দেখো তোমাকে খুব ভালো রাখবে’। এরকম হয়তো সব মেয়ের মা ই বলে থাকেন বিয়ের আগে। হাজার হোক মেয়ের মা তো! “তবু একসাথে থাকতে থাকতে মেয়েদের সংসারে আগ্রহ জন্মায়”, কেউ যেন বলেছিল কৌশিককে। সেকেন্ড লিস্টের চাকরীটা পেয়ে যাবার পর সুলগ্না তো আর ঘরের কোন কাজ করতেই চাইত না। ওর নাকি হাতের টাইপিং স্পিড কমে যাবে। সবই প্রায় ঠেলে দিয়েছিল কাজের লোক আর কৌশিকের প্রায় অথর্ব হয়ে যাওয়া বৃদ্ধা মায়ের ঘাড়ে। আজ প্রায় চোদ্দ মাস অতিক্রান্ত। এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে সুলগ্না যোগাযোগ অবধি রাখেনা কৌশিকের সাথে। উকিলের চিঠি পাঠালে কিছু মিথ্যে আরোপ এনে অস্পষ্ট উত্তর দেয়। এই অসহ্য একাকীত্ত্ব থেকে মুক্তি চায় কৌশিক। ওর মনের নর্দমা জুড়ে সুলগ্নার প্রতি ঘৃণা আর আক্রোশ মিলে মিশে স্নায়ু শাসনের বিশ্রী খেলা চলে। শেষ বিকেলের রোদটা তেরছা হয়ে টবের গাছগুলোর হলদেটে শরীর বেয়ে চুঁয়ে এসে পরে কৌশিকের অযত্ন লালিত আলুথালু চুলে। অবচেতনে হয়তো ও আজও সুলগ্নাকে চায়। যেমনটা ও একদিন নমিতাকে চেয়েছিল। আজ অনেকদিন পর ইউ টিউব সার্চ করতে করতে, একটা কণ্ঠস্বর ওকে ভাবাল। একটা আনকোরা নতুন চ্যানেল থেকে কিছু বাংলা ক্লাসিক পাঠ করে শোনাচ্ছে একটি যুবতী নারী কণ্ঠ। কণ্ঠটি কৌশিক চেনে ওদের পুরোনো বাড়ির সিঁড়ির খোলা ঘর থেকে ভেসে আসা, রুটির গন্ধে গা ঘষে। তখন ফেসবুক সবে শুরু করেছে ও, কলেজের ফাইনাল ইয়ার, কলেজ ক্রাশ ঘা দিয়েছে। সেবছরই ভ্যালেন্টাইন্স ডে এর দিন একটি অচেনা প্রোফাইলের সাথে পরিচয় হয়। কথা বললে বোঝা যায় প্রোফাইলটি একটি মেয়ের, কিন্তু ডিপি দেওয়া নেই। কথা বলতে বলতে এই ভার্চুয়াল মিডিয়ামে ওদের সম্পর্ক ক্রমশঃ গাঢ় হয়। মনের গোপনে জমে থাকা খুচরো কথা শেয়ার করতে করতে একদিন হঠাৎই কৌশিক খেয়াল বশে ‘ভালোবাসি’ বলে দিয়েছিল প্রোফাইলটিকে। ঘোলাটে নিভু নিভু ক্ষণে ওপাশ থেকেও সম্মতি আসে। ওই বাড়িটার একচালা ছাদে শীতের শুরুতে হামা দিয়ে মলাসনে বসে থাকত হলদে ইলশেগুঁড়ি রোদ। অনেকগুলো বছর পর আজ ছিটকে গেছে স্মৃতির ডিসর্ডার, যতদূর ছড়িয়ে যাওয়া যায়। এই অচেনা সুন্দরী কন্ঠটাই এক সময় দিবারাত্রির কাব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল কৌশিকের কাছে। নির্বাক কাঁচের জানালাটার পেটের ভিতর ঢুকলে মনে পরে যায় কৌশিকের, ফাইনাল সেম এর আগের সেই রাতে হঠাৎ ফোনে ঝগড়ার কথা, মেয়েটির নিজের আরেক বান্ধবীকে দিয়ে ওর সাথে হানি ট্র্যাপে কথা বলিয়ে, রিলেশনের অনেস্টি টেস্টে ওকে জোর করে ফেল করিয়ে ‘ব্রেক আপ’ করে নেবার কথা। সেই রাতের পর থেকে ওপারের যতিহীন নিস্তব্ধতা ঢেকে ফেলেছিল কৌশিকের সব ঋতুর উৎসবময় জীবন। শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদের তখন ভরা মাস, মিহি উড়ছে আষাঢ়-শ্রাবণ। একটা প্রতীকী প্রেম বা ফোনালাপ ভেঙে গিয়েছিল মুহূর্তেই। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলটা ডিলিট করে দিয়েছিল কৌশিক। পরাবাস্তবে কি না হয়! স্বপ্নদোষ লেগে থাকে ভাঁটায়, নদীর বুকে। আজ এইক্ষণে মনে পরে যায় কৌশিকের কিবোর্ডের ব্যাক স্পেসে লাথি খেয়ে ফিরে যাওয়া নির্বিকার নির্বাক দৃশ্যগুলো। এ ঘটনার অনেক দিন পর, আবার কোন এক নির্লজ্জ রাতে কোন এক আননোন নম্বরে লেগেছিল মেয়েটির অ্যালিবাই মাখা কণ্ঠস্বর। ফোনটা কেটে দিয়েছিল কৌশিক। চোখ বুজে এসে ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফুটে উঠেছিল ইতর শোক। ফেসবুকে একটা ফেক প্রোফাইল খুলে মেয়েটির প্রোফাইলে চোখ রেখেছিল ও। মেয়েটি তখন মধ্য কলকাতার একটি নামজাদা কলেজে পড়ে। তখনও তার প্রোফাইল পিক নেই। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল কৌশিক, বাক্যব্যঞ্জনার এঁটো কলম আর প্রবন্ধকালীন ভাব মানসে ভর দিয়ে যে মানবীকে নিয়ে সে কবিতা লিখেছিল একদিন, নিদ্রাহীন শর্বরীর সেই আস্তীর্ণ কঞ্জমটি আসলে রিয়েল লাইফে একটি এসকর্ট সার্ভিসের সাথে যুক্ত। শেষ রাতের ছদ্ম কলহের কারণটা মুহূর্তে পরিস্কার হয়ে গেছিল ওর কাছে। এই এককেন্দ্রিক তিলোত্তমার সম্পূর্ণ উল্টোপিঠে তখন সে একা দাঁড়িয়ে। ঠিক যেখান থেকে এসে নমিতা ওর হাত ধরেছিল। সেও ছিল কোন এক পঞ্চমুখী ভোরের সকাল। আক্ষরিক অর্থে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী ছিল সেই ভোরের গা ঘেঁটে খাবলে তুলে ফেলা কিছুটা অমনোযোগী সূর্য্যশোক। নমিতার সাথে ওর যেটা ছিল তাকে গোদা বাংলায় বলে ‘প্লেটোনিক লাভ’। প্রপোজ করার কয়েকদিনের মধ্যেই মোটা নমিতা পিএইচডি করতে চলে গেলো নর্থ ইস্টে। প্রেমের রং তখন গাঢ় কৌশিকের যুবক জীবনে। কিশলয় সুখের সময় পেরিয়ে নদীর পারে নেড়া গাছতলায় লোকচক্ষুর আড়ালে কমলা রঙের রোদটাতে, নমিতার দুটো জরিপ করা ঠোঁটের ভেতর থেকে কস্তুরী গন্ধের স্যালাইভাকে ও টেনে বার করে এনেছিল যেদিন, ক্ষিতি-মরুৎ-ব্যোম তখন শুধু হাসছে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলো কয়েকটা সাদা রঙের পাখি, বোধহয় বালিহাঁস। কয়েকটা মৃত ফড়িং কিংবা প্রজাপতির দল বাতাসে মিশে মিশে গেলো। রাগী, জেদি, একগুঁয়ে সব আলোর তো আর রোদ হয়ে ওঠা হয় না, হওয়ার ইচ্ছেটা থাকা চাই। ওই ইচ্ছেটাকে বুকে করেই ওদের চারপাশটা দপ করে জ্বলে উঠেছিল সেদিন। সেই মুহূর্তটার যেন একটা অচেনা গন্ধ ছিল। যেমন ছিল সেই ফোনালাপের রাতগুলোর। বিয়ের পর গন্ধটা কৌশিক প্রায়ই পেত। নতুন ঘর, নতুন বিছানা সুলগ্নার সাথেই চেনা হতে থাকলো ক্রমশঃ। কিন্তু নমিতার নিজের জীবনের কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশী। যদিও সম্পর্কটায় নমিতাই এগিয়ে এসেছিল, তবু শেষ পর্যন্ত্য এস্টাব্লিশমেন্টের ব্যাপারে ও হয়তো ওর বাবা মায়ের পছন্দের বাইরে যেতে চায়নি। ত্রিযামার অন্তরীপে যে নারীমনে আটকা পরেছিল কৌশিক, বিচ্ছেদের পর অবচেতনে তাকে পাওয়ার আকাঙ্খাই যেন তীব্রতর হয়ে উঠলো কৌশিকের কাছে। নমিতা কি আদৌ ওকে কোনদিন ভালোবেসেছিল? একসাথে থাকতে, খুব করে ওদের বাড়িতে আসতে বলতো নমিতা। ‘নদীটার শেষের দিকে, তার আকাঙ্খা, তার ভয়-ক্রোধ-সমবেদনা-কল্পনা সব কিছু মিলেই যেন ওদের বাড়িটা তৈরী’, এমনটা ভাবত কৌশিক। আশপাশ থেকে একটা হারমোনিয়ামের সুর ভেসে এসে তাল কাটতো ওর ভাবনায়। ঠিক যেমন সেই নারীকণ্ঠ ওকে বলতো, ওদের বাড়ির ঠিক পাশেই একটা চাঁপা গাছের স্বেদ বরাবর ওঠাপড়ার খেলায় মেতে থাকা একদল পিঁপড়ের কথা। সূর্য্যের অতিবেগুনী রশ্মি হয়তো তখনও কুয়াশার সর সরিয়ে এসে স্পর্শ করেনি, নির্বিবাদে মরার মত পড়ে থাকা গাছটার জননাঙ্গকে।
সুলগ্নার দায়বদ্ধতা নিয়ে আজ কৌশিকের মনে বড় প্রশ্ন জাগে। চুনসুড়কি খসে পড়া রাতে ধীরগতির ইন্টারনেটের মত কচ্ছপের গতিতে ধূলিকণা উড়ে বেড়ায় ওর চারপাশে। সেই স্নায়ু শাসনের দরজা ঠেলে রাতের জটিল বর্গক্ষেত্রের মধ্যে বাহকহীন পালকিতে দোল খেতে খেতে আজকাল একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখে কৌশিক, একটি মেয়েলী সেলুনে বসে কোন এক অচেনা পৃথুলা মহিলা তার স্পা-শ্যাম্পু-মেনিকিওর-পেডিকিওর শেষ হয়ে যাবার পর উঠে যাবার সময়, কৌশিককে একটা টোকা মেরে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার হয়ে গেছে? আমরা এবার বন্ধ করবো!” মুহূর্তে কৌশিকের চোখে ভেসে ওঠে শিয়ালদাহ গুরুদাস কলেজ থেকে একা গেট এর ক্লাস করে ফেরার সময় ফোনে নমিতার সঙ্গে কাটানো একটা নিশ্চিত ক্ষুধার রাত, গভীর ভাস্কর্য্য তার গোটা শরীর জুড়ে কিংবা চিৎপুর রোড ধরে গরানহাটা থেকে চিৎপুর ক্রসিং অবধি সুলগ্নার হাত ধরে হেঁটে পার করা জীবনবহুল রাস্তাটার কথা। সুলগ্নাকে কি ভুলতে পারবে মুহূর্তরা? কিংবা সুলগ্না কি ভুলতে পারবে কৌশিকের চারিপাশের মানুষজনকে? যে লোকটা ওদের বাড়ি দুধ দিত কিংবা যে লোকটা দীপাবলিতে ওদের বাড়িময় লাইট খাটাতে হাতে হাতে হেল্প করত, এদের কারোর গাফিলতিও কি ওকে আর ভাবাবে না? অনেকক্ষণ ধরে মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেও না? এই বাড়িটার বন্ধ জানালা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছের পাতা, হারমোনিয়ামের সুর, গলিটার কয়েকটা ল্যাম্পপোস্টের আলো এদের কাউকেই কি ও আর মনে রাখবেনা কখনো? নমিতা যাবার আগে বলে গিয়েছিল, “আমি তো দেখতে পাচ্ছি এই মোটা হাতির মত চেহারা নিয়ে তোর পাশে আমি ফিট করছিনা একেবারেই। একটা ছোট্টোখাট্টো লক্ষ্মী ঠাকুরের মত চেহারার মেয়ে তোদের সারা বাড়িতে ঘুরঘুর করছে আমি দেখতে পাচ্ছি রে। এরপর থেকে ফোনে হয়তো আমাদের আর কথা হবে না কিন্তু তুই আমার কথা ঠিক শুনতে পাবি। কখন কি করতে হবে আমি ঠিক তোর কানে কানে বলে দিয়ে যাবো।”
“আমার মেয়েকে তুমি আর ফোন করবেনা সাবধান করে দিলাম”, সেদিনের নমিতার মায়ের এই আর্তনাদি স্বরের পর থেকে গলাটেপা মধ্যরাতগুলোতে নমিতা এসেছে কৌশিকের অবচেতনে বহুবার, কানের কাছে নির্দোষ বিষের মত বেজে গিয়েছে নমিতার তেজী কণ্ঠস্বর, আর প্রতিবারই হুঁশ ফিরে কৌশিক দেখেছে নমিতা ওকে পোক করার চেষ্টা করছে ভার্চুয়াল মিডিয়ামে। কখনো ফোন ম্যাসেজও করেছে। এমনকি যখন কৌশিক চাকরীর জন্য দিশেহারা, ওর দিবারাত্র ক্রমশঃ ঢেকে যাচ্ছে এক অন্ধকার প্রতিবন্ধী যাপনে, তখন সারেঙ্গীটার সপ্তম সুরের কম্পাঙ্কে ওর কানের কাছে ভেসে এসেছে প্রায় নিঃশব্দ ফিসফিস, “২৬ বছর বয়স হয়ে গেলো শিগগির কিছু একটা কর কৌশিক! বয়স বেরিয়ে যাচ্ছে, সফটওয়্যার এ সুইচ কর! এরপর ওখানেও দেরী হয়ে যাবে।” মনের দরজা খুলে যেন অমলতাসের ছায়া পেয়েছে কৌশিক, ওর দাড়ি কমা ভেসে গেছে উপসংহারের নীচে।
কদিন ধরে একটা অচেনা মেয়ের প্রোফাইলের আবির্ভাব হয়েছে কৌশিকের আপেক্ষিক দুনিয়ার বন্ধুবৃত্তে। গতকাল বিকেলে সুলগ্না ডিভোর্স পেপারে সই করে পাঠিয়ে দিয়েছে অথচ রাত্রে আবার কৌশিকের হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাস দেখেছে। আজ সকালে সেই অচেনা মেয়ের প্রফাইলটি লিখেছে, “লাভ ইউ ফরএভার গুলু! ভালোবাসা ছিল আছে থাকবে”, হাজতবাসের রোজনামচায় অকৃপণ ঘুমঘোরে চমকে উঠেছে কৌশিক। এই নামে তো আদুরে বেড়াল গলায় সুলগ্না ওকে ডাকতো!
নদীর পারে শব্দহীন, ক্লান্তিহীন ভাবে পৃথুলা মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে থাকে কৌশিক। অবয়বটার নরুন চেরা দুটো চোখ বেয়ে নমিতা নেমে আসে কখনও। আকাশের রং পাল্টায়, মুখোশহীন পৃথিবীটাকে বুকে করে ন্যাড়া গাছটা থেকে কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ ভেসে আসে। চোখ জোড়া গোল পটল চেরা হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে। টিয়াপাখির ঠোঁটের মত নাক, জন্মদাগ বয়ে চলা চেরা ঠোঁটে সেটা ক্রমশঃ সুলগ্নাকে এঁকে ফেলে পারিপার্শ্বিকের ক্যানভাসের গায়ে। তারপর সেটা বগলে করে নিয়ে একটা বড় নৌকার পেটের ভেতর ঢুকে পরে ইতিহাস আর টাকডুমাডুমের ধুলোকে জড়িয়ে ধরে। যেন এই নদীটার গতিপথ জোর করে ঘুরিয়ে দিতে চাইলে, ও একটা কাগের ডিম বগের ডিম মার্কা ডিমভাত খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা জোরদার প্রতিশোধ নেবে। পৃথিবীর তিনভাগ ঘুম আর একভাগ আলস্য। এই ঘুমিয়ে পরার মুহূর্তটায় নদীর বিকলাঙ্গ শরীরে আত্মার রজঃ সঞ্চার হয়। পরিচিত নারী স্বরেরা ভেসে আসে ক্রমশঃ। ছাতের টবে তখন সবে ব্রম্ভকমল ফুটছে। কার হাতে সে ভালোবাসা পাবে আর কার থেকে ফিরে পাবে অবহেলা, এটা ভাবতে ভাবতে সে ঝরে যাবে আগামী কাল ভোরে। মূক অথচ একটা চেতনাময় চলাফেরার মধ্য দিয়ে। 🍁
🍂ছোটগল্প / ২
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
রুগ্ন মানচিত্র এবং জলছায়া
সীমাহীন সম্পত্তি আর ঝকঝকে একখানা বাড়ি। বাড়ির গেটে দারোয়ান বসে থাকবে সবসময়। মাটি থেকে তিনফুট উপরে থাকবে পা। চারপাশে ঘিরে থাকবে কিছু বশংবদ কর্মচারী। জীবন এরকমই হওয়া উচিত। ভাঙা থালায় চপ মুড়ি খেতে খেতে সুবিমলদা বলে উঠত।
-আর লাল টুকটুকে একটা বউ। আমরা কখনও কখনও বলে ফেলতাম।সুবিমলদা ভাঙা সানকির আড়াল থেকে তির্যক তাকাত আমাদের দিকে-
বউ পোষার কত খরচ জানিস?
জানার কথা নয় আমাদের। তখন কতই বা বয়স হবে। তের চৌদ্দ। বলতাম- কত?
সুবিমলদা হো হো করে হেসে বলত- আমিও তো জানিনা।
সীমাহীন সম্পত্তি, পুকুর, বাড়ি, গোরু ছাগল আর দারোয়ানের বাইরেও যে জীবন আছে সুবিমলদা জানত না। একটি মাত্র পুকুর ছিল ওদের আর দেড় বিঘা জমি। ঠিক পুকুর নয়। আমাদের আঞ্চলিক গোদা বাংলায় তার নাম ছিল শালুকগড়্যা। ক্লান্ত বর্ষণ শেষে ভাদ্র মাসের রোদের আভায় ঝলমল করত সেই জলাশয়। তার তীরে বসে গম্ভীর মুখে সুবিমলদা মাছ ধরত। নানা সাইজের মাছ। আমরা মাছের চেয়েও বেশি করে দেখতাম সুবিমল বিশ্বাসের মত মানুষটিকে। তার কথা বলার ধরণ, মাছের চার ফেলার ভঙ্গি, লাটসাহেবি চালচলন, মাছ না পাওয়ার হতাশা কিংবা আকস্মিক বড় মাছ পেয়ে যাওয়ার উল্লাস লিপিবদ্ধ করতাম আমাদের কমবয়সী চোখে। গাছের পাতার ফাঁকে বৃত্তাকার আলো এসে পড়ত পুকুরে। হাততালি দিয়ে উত্তেজনায় বলে উঠতাম– দেখো সুবুদা, কী অপূর্ব আলো। অথবা পুকুরের জলে যখন স্থির প্রতিবিম্ব ভাসত আমাদের। সেই মৌন নীরব আয়নার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়চিহ্ন ছড়িয়ে দিতাম– দেখো দেখো তোমাকেও দেখতে পাবে জলে।
সুবিমলদা চুপ করে থাকত। কখনও সখনও উত্তর দিত– ওসব দেখার কি সময় আছেরে। দু’টো মাছ ধরলে দশটা টাকা আসবে।
-পয়সা ছাড়া তুমি কি আর কিছু বোঝো না ?
-বুঝি, জমি জায়গা ঘরবাড়ি।
-তার বাইরে কোনও স্বপ্ন ?
-একদিন অনেক পয়সা করবো। হাজার হাজার লোক সেলাম করবে।
সুবিমলদার বাবার নাম ছিল কালিপদ বিশ্বাস। সবাই ডাকত কালু বলে। কালিবাবু বলে কাউকে কখনও ভুলেও ডাকতে শুনিনি। কুঁজো হয়ে হাঁটত সবসময়। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকত। অঙ্কে শূন্য পাওয়া মানুষের মত চেহারা। আপাদমস্তক ব্যর্থ অসফল। সেই কালু জেঠুর ছানি পড়া চোখে ছিল সবুজের সমারোহ। সারা দুনিয়াকে শ্যামল করার অঙ্গীকারে শক্ত হয়ে উঠত হাত। কেউ এর প্রশংসা করলেই কাঁচুমাচু হয়ে বলত– এ আর এমন কি? আমি তো কিছুই পারি না। আর মনের মধ্যে চলত অন্য বিক্রিয়া– পৃথিবীর প্রাণবায়ু কমে যাচ্ছে মানুষ বাঁচবে কি করে? তার ছিল গাছ লাগানোর বাতিক। এক চিলতে ফাঁকা জায়গা পেলেই হল, নিত্য নতুন চারা এনে পুঁতে দিত সেখানে।অপত্য স্নেহে আর মমতায় ভরিয়ে তুলত গাছেদের।
মুখোমুখি ঘর ছিল আমাদে। মাঝখানে স্যাঁতস্যাঁতে সরু রাস্তা। কাদায় ঢেকে যেত বর্ষাকালে। সেই রাস্তায় যে কতবার পিছলে পড়েছি তার হিসেব মেলা দুস্কর। সুবুদার মাকে অণুমাসি বলে ডাকতাম আমরা। মায়ের সাথে অণুমাসির ছিল গলায় গলায় ভাব। যেদিন আমাদের বাড়িতে পায়েস রান্না হত, মা বলত – শুভ, যা তো সুবুকে একবাটি পায়েস দিয়ে আয়। ছদ্মরাগে ফেটে পড়ত অণুমাসি – রুমি টার কোনোদিন জ্ঞান গম্যি হবে না, এত পায়েস কেউ পাঠায়।তোরা খেয়েছিস তো বাছা? ঠিক সেভাবেই অণুমাসি আমাকে দিয়ে যেত ছোলার ডাল বা পটলপোস্ত। গরমের দুপুরে যখন আমরা লুডো খেলতাম আর মা অনুমাসির উকুন বেছে দিত।তখন অনেক প্রাণের কথা হত মা আর অণুমাসির মধ্যে ।যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না আমরা। এক নির্জন নিরালায় গড়ে উঠেছিল তাদের বন্ধুত্বের জগত। মাঝে মাঝে রাগ অভিমান ও কম হত না। একদিন মাকে দেখতে না পেলে ছটফট করত অণুমাসি- তোর শরীর ভাল আছে তো রুমি ? সকালে দেখিনি যে।
-আমি তো ঠিকই আছি। তোমার মুখটা শুকনো লাগছে কেন অণুদি ?
তারপর মা অণুমাসির পেট থেকে কিল মেরে বার করে আনত কত গোপন কথা। সারাদিন না খেয়ে বা শুধু জল খেয়ে কাটানোর নির্মম ইতিহাস। শাশুড়ির সঙ্গে চরম ঝগড়ার খবর।
-তুমি আমাকেও লজ্জা পাও অণুদি। এটা রাখো বলে মায়ের জমানো টাকা অণুমাসির হাতে তুলে দিত মা, কতবার। কতবার।
সুবিমলদার বোন টুসকি। সে আমাদের সাথে পড়ত। পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার জন্য একটা পা টেনে টেনে অনেক কষ্টে হাঁটত।প্রায়ই যেতে পারত না ক্লাসে।প্রতিদিনের পড়া বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত আমাকেই। সন্ধ্যেবেলা ছাড়া আমার কোনও অবকাশ ছিল না। ওই সময় টুসকির সঙ্গে অনেক কথা হত আমার। ওর যন্ত্রণা দুঃখ বিপন্নতা ছায়া ফেলত মনের গভীরে। অভাব আর দারিদ্র ঘেরা বাতাবরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে টুসকি যখন বলত- আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে, শুভ।
-অমন কথা মুখেও আনবি না একদম।
-কী লাভ বেঁচে? এই ঘৃণা আর অবজ্ঞার ভেতরে। আমি তো বাড়তি এক বোঝা।
-একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিস । সবকিছু… বলে পকেট থেকে ঠাকুরের প্রসাদ আর ফুল ওর হাতে দিয়ে বলতাম– আমাদের মত গরীবদের তো এসবই ভরসা।
আমাদের চোখের জলে বর্ষা আসত।সুবিমলদা মেতে উঠত পুকুরটা ভর্তি করার জন্য। কিন্তু কোনওমতেই পেরে উঠত না।পুকুরটা ছিল অদ্ভুত। জমি থেকে অনেক উঁচুতে ছিল তার অবস্থান।বহমান জল সেখানে পৌঁছতে পারত না।
-দেখছিস পুকুরটাকে। অনন্ত তৃষ্ণা নিয়ে বসে আছে। কোনওদিন ওর পেট ভরবে না।
আমি মাথা নাড়তাম আর দেখতাম অসীম মমতা আর হার্দিক শ্রমে সুবুদা পুকুর ভর্তি করছে জলে। জলাশয়ের চারপাশে অনেক গাছ। নানা রঙের পাখি এসে বসত সেখানে। আলোহীন এক ভীরু অন্ধকারের ছায়া পড়ত পুকুরের জলে। সুন্দর মায়াবী জগত, যা ছিল সুবিমলদার নিজের পৃথিবী। অল্প অল্প করে আমিও ঢুকে পড়ছিলাম সেই পরিমণ্ডলে আর দেখছিলাম চারদিক। কথায় কথায় সুবিমলদা একদিন বলেছিল- এই পুকুরটাই আমার সব। আমার স্বপ্ন, ভালবাসার দুনিয়া। গাছগুলো আমার ভবিষ্যৎ। গাছে আর মাছেই তো টাকা রে শুভঙ্কর। সেরকম ভাবে চাষ করতে পারলে একদিন কত উপরে উঠে যাব।
২.
মাধ্যমিকে তিনবার ফেল করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিল সুবিমলদা। অনেক অনুরোধ করলাম আমরা। কিন্তু কে কার কথা শোনে। সুবিমলদার সেই এক কথা- তোরা আমার হাঁটুর বয়সী তোদের সঙ্গে পরীক্ষা দেব? নেভার। তার চেয়ে গলায় কলসি বেঁধে মরাই ভাল।
এরপর থেকে ঐ ছোট পুকুরটাই হয়ে উঠল তার ধ্যানজ্ঞান। তার একান্ত আশ্রয়। জলাশয় ঘিরে চারপাশে যে ভূমিখণ্ড যেখানে কালুজেঠুর হাতে তৈরি হওয়া গাছের ছায়া, সেই ছায়ার মধ্যে তার খেলার মাঠ। সুন্দর এবং অনিবার্য এক খেলায় মেতে উঠল সুবিমলদা।গাছ লাগানোর খেলা।মাছ তৈরির ক্রীড়াভূমি তৈরি হল পুকুরের জলে। সেখানে হাজার মাছের অবাধ সাঁতার। এইসব দেখতে দেখতে আলো বাতাস ও এক জলজ ভালোবাসায় নিবিড় হয়ে উঠল তার দুনিয়া। মাঝে মাঝে আমরা তার কাছে যেতাম।আমি মৈনাক আর শম্ভু। মৈনাক কথা প্রসঙ্গে বলেছিল– তোমাদের গাছগুলো দারুণ।এই বিউটির জন্যই তো বারবার এখানে আসি।
-বিউটি দিয়ে পেট ভরেনা মৈনাক। – মানে?
-ওসব বট অশথের কোন দাম নেই, ওগুলো কেটে দামি গাছ লাগাবো।
-তোমার বাবার স্মৃতি।
-নিকুচি করেছে স্মৃতির
-কোনও সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু নেই এই শিকড়, এই মাটির?
-ওসব ছেঁদো আবেগ প্যানপ্যানানি আমার নেই। আমার মধ্যে খিদে আছে, পেটে জ্বলন্ত আগুন, আগ্নেয়গিরি।
এরপর আর কোনও কথা হত না।পুকুরটার দিকে চেয়ে চেয়ে ফুরিয়ে আসত বিকেল। ফড়িং উড়ে যেত জলের উপর। মাছেরা খেলত জলের নীচে।
-কী সুন্দর সুন্দর মাছ পুষেছ তুমি! দেখেও মন ভরে।
-মাছ আমি পুষিনি রে, ওরাই আমাকে পুষছে পালন করছে এক নির্মম সত্যকে।
এরমধ্যেই টুসকি একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল।অণুমাসি খুব কেঁদেছিল, মাও আটকাতে পারেনি চোখের জল। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে গিয়ে সুবিমলদার হাতে ধরা পড়েছিলাম– দূর বোকা, কাঁদতে নেই। মানুষ তো একদিন মরবেই।
আমি চমকে উঠি
তাছাড়া বেঁচে থেকেই বা কি করত বল?
-তুমি একথা বলছ সুবুদা?
-হ্যাঁ, আমিই বলছি।
আমি স্থির তাকিয়েছিলাম শূন্য দিগন্তের দিকে। যেন আমার সামনে কোনও মানুষ নেই। আর ভাবছিলাম শোকবর্জিত এক পাথরের অবয়ব। যেখানে খনন চালিয়েও উঠে আসবে না টান মায়া স্মৃতি কিম্বা অশ্রুপাত।
-টুসকিটা মরে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে, শুভ ।
আমার চোখের পাতায় তখনও দাগ। সুবিমলদা বলে চলেছে- বিশ্বাস কর ওর বিয়ে দিতে পারতাম না। সে অনেক টাকার ব্যাপার। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। অনেক ঘৃণা নিয়ে উঠে এসেছিলাম। আত্মসর্বস্ব এই লোকটা কোনোদিন চিনবে না দুনিয়ার রঙ। দেখতে পাবে না গাছের ছায়ার নীচে ফড়িঙের ধ্যানমগ্ন ঘুম। শুনতে পাবে না অপূর্ব আঁধার রাতে ডাহুকের ক্লান্ত আর করুণ আওয়াজ। সে কীভাবে অনুভব করবে প্রতিটি সম্পর্কের ভিতরে নিঃশব্দে শিশির ঝরে পড়ে।
এরপর রাগে আর কোনওদিন সুবিমলদার মুখোমুখি হইনি।কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দ্রুত ফুরিয়ে যেতে লাগল সময়।পুজোতে বাড়ি এলে অণুমাসির সাথে দেখা করতে যেতাম। ওদের বাড়িটা খাঁ খাঁ করত।খাপছাড়া কিছু গল্প হত সেরকম জমাট বাঁধত না আসর। ধূসর ছায়াপথে ঘুরতে ঘুরতে ফুরিয়ে যেত সব কথা।মায়ের কাছে শুনতাম নানা গল্প সুবিমলদার দ্রুত উত্থানের কাহিনি।আক্ষেপের সুরও শুনতাম –অণুদির খুব কষ্ট।
-সে কি? চমকে উঠতাম আমি।
-হ্যাঁ পেট পুরে খেতে পায় না বেচারা, শাড়ীগুলো ছেঁড়া।
-তবে যে বললে সুবুদার অনেক টাকা।
-সে তো ওর নিজের, ব্যঙ্কে সুদে আসলে বাড়তে থাকে।গোপন দীর্ঘশ্বাস মায়ের আঁচল থেকে ঝড়ে পড়ত, আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম।
৩.
আমাদের কৈশোরের দিনগুলো ম্লান হয়ে আসছিল। রুমালে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা কিশোর বয়স টুপ করে পড়ে গেছে কোথায়।বদলে যাওয়া চারপাশ।কাদামাখা পথও রূপসী হয়ে উঠছিল। তার জায়গা দখল করে নিচ্ছিল বিটুমিনাসের রাস্তা। ভুবন ময়রার মিষ্টির দোকান ভেঙে তৈরি হচ্ছিল পঞ্চবটী গেস্টহাউস। মফঃস্বলের গন্ধ মুছে গ্রামটার পেটে ঢুকে যাচ্ছিল নাগরিক হাওয়া। চেনা মানুষগুলোও পাল্টে যাচ্ছিল দ্রুত। যেন এটাই স্বাভাবিক রীতি । কেউ কাউকে নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না। বিপদেও পাশে দাঁড়ায় না।এক ব্যক্তিগত খোলসের মধ্যে সুখযাপন পর্ব। তবু অভ্যেস বশত সুবিমলদার বাড়ি যাওয়া আসা থামেনি আমাদের।আমি মৈনাক আর শম্ভু তিনজনে মিলে অনেক গল্প হয়। ভবিষ্যতের গল্প। আলো অন্ধকারের গল্প ।দিশা খুঁজে পাই না ।চারপাশের সবকিছুই আসতে আসতে ছোট হয়ে যাচ্ছে ।কোন ঋজু বৃক্ষ নেই শুধু বনসাই। নিজের পুকুরটাকে আরও অনেক জলে ভর্তি করার এক আত্মঘাতি খেলা চলছে । প্লাবনের অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।
৪.
এরপরই শম্ভুর রোগটা শুরু হল। ডাক্তার বলল- ব্লাড ক্যানসার । দুরারোগ্য । অনেক টাকার ব্যাপার।মৈনাক ছুটে এসেছিল আমার কাছে – কিছু একটা করতেই হবে, শুভ।
আমি মৈনাকের কাঁধে হাত রেখেছিলাম – সব ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিস।
জানি এ শুধু কথার কথা। এতে চিড়ে ভেজে না।তবু এই কথাগুলি বলা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না।
কল্পনা আর বাস্তবের টানাপোড়েন যখন চলে তখন মানুষ এভাবেই হয়ত কোনো নাতিশীতোষ্ণ আশ্রয় খুঁজে নেয়। নির্বোধ ভাঙচুর চলে মনের মধ্যে।
-সুবিমলদাকে ধরলে হয় না ?জিজ্ঞাসা নয় প্রস্তাবের আকারে কথাটা বলেছিল মৈনাক ।আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলাম। তখনও বুঝতে পারিনি সুবিমলদা কখন এসে দাঁড়িয়েছে সবার অলক্ষ্যে ।অনেকদিন পর বাইরে বৃষ্টির মেঘ জমছি।ঝমঝম শব্দ হচ্ছিল বুকের মধ্যে।মৈনাকের কাঁধে হাত রেখেছিল সুবুদা –আমি তো আছি । দরকার হলে আমার পুকুর ঘরবাড়ি জমানো সব সঞ্চয় শেষ করে দেব।
আমি চমকে উঠেছিলাম । বাইরে বজ্রপাতের তীব্র শব্দ। নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিল কথাগুলো –
মানুষ তো একদিন মরবেই…।
মারব টেনে এক থাপ্পড়। যতসব অমঙ্গুলে কথা। আমি যতদিন থাকব। পৃথিবীর কিনারা অবধি যেতে হয় যাব, তবু শম্ভুকে সুস্থ করে তুলবই। আর কিছুই নেইরে দুনিয়াতে ভালোবাসা ছাড়া।
আমি সুবিমলদার দিকে চেয়ে থাকি ।ওর চোখে জল । বাইরে অঝোর বৃষ্টি । আমি নিঃশব্দে ধুয়ে ফেলি চোখ ও গালের আবর্জনা ।সুবিমলদা মৈনাকের হাত নিজের মুঠিতে ধরে রাখে। চোখ দুটো চিকচিক করে এক অপূর্ব আলোয় । আমি দেখতে পাই রুগ্ন মানচিত্রের বন্দীদশা থেকে এক মুক্ত দিগন্তের দিকে উড়ে যাচ্ছে পাখিগুলি । জলছায়ায় স্নিগ্ধ স্নাত হয়ে উঠেছে তারা । এই প্রথম সুবিমলদার সেই পুকুরটি জলে ভরে ওঠে কানায় কানায়। 🍁
🍂ছোটগল্প / ৩
সুশান্ত কুমার দে
তুর্কি বন্ধুদের নিয়ে স্বদেশ ভ্রমণ
তুহিন, চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে, অমলের এখনও আসার খোঁজ নেই।
কি যে মানুষটা,তা বোঝার উপায় নেই?
এতো করে বললাম, বেশি সময় থাকবি না,দেশ কাল ভালো না।
তবুও শুনলো না আমার কথাটা।
এই সব ভাবতে ভাবতেই, তুহিনের সামনে এসে দাঁড়াল, চার জন ইয়ং মানুষ।
তাদের পোশাক- পরিচ্ছদ একটু ভিন্নতা।
পাঞ্জাবি ও প্যান্টের ডিজাইন গুলো অতি চমৎকার।
যা আমাদের দেশে প্রায় দেখা যায় না।
তুহিন মনে মনে ভাবল, ওরা বুঝি ছদ্মবেশে ছিনতাই করতে এসেছে।
তুহিনের গাঁ শিউরে উঠল, মনে মনে ভাবল, এইবার বুঝি আমার জীবনটা শেষ করে, সবকিছুই ছিনিয়ে নেবে।
টাকা, পয়সা না হয় নিয়ে যাক, তবে মেরে ফেলবে কেন?
একটা যুবক জিজ্ঞেস করল, আঙ্কেল আপনার বাড়িটা কি এই শহরের আশেপাশে ?
তুহিনের বুকটা ভয়ে ধড়ফড় করছে, কথা বলার শক্তিটা ও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
তবুও একটু কথার জড়তা কাটিয়ে বলে উঠলো, তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে চাও?
আমার কাছে যা কিছু আছে সবই দিয়ে দিচ্ছি।
গলার একটা সোনার চেন আছে, তা-ও তোমাদেরকে দিয়ে দিচ্ছি।
আমাকে তোমরা প্রাণে মেরো না!
আমার ছেলে-মেয়ে, বৌ আছে, তারা তো না খেয়েই মরে যাবে।
পকেট থেকে তিন চার হাজার টাকা, সোনার চেন, একটা স্মার্ট ফোন বের করে বললো, এই নাও ভাই? এগুলো নিয়েই আমাকে ছেড়ে দাও,আমি বাড়ি চলে যাই?
আমার কাছে আর কিচ্ছু টি নেই?
যুবক চারজন বিষয়টা বুঝতে পারছে না।
এমন করছে কেন লোকটা।
ওরা চারজন তুহিনের কাছে জানতে চাইলো, আপনি এমন করছেন কেন?
আমরা তো কোন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি কিংবা চোর ডাকাত নই!
আপনি এসব টাকা পয়সা, সোনার চেন , মোবাইল ফোন আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন কেন?
আমরা তো আপনার কাছে কিছুই চাই নি?
আমরা সকলেই অপরিচিত, কোথাও কিছু চিনি না।
তাই শুনতে চাইছিলাম, আপনার বাড়ি টা এই শহরের আশপাশে কিনা?
তুহিনের এবার একটু সাহস হলো, এবার তাদের কে বললো, আমি ভেবেছিলাম, আপনারা কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর লোক?
আমার এ ধরনের আচরণের জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।
আজকাল তো রাস্তা -ঘাটে, গ্রামে শহরে, বাড়িতেই যেন একটা ভয় ভয় কাজ করছে।
যখন তখন চাঁদাবাজি করছে, ডাকাতি করছে, মেরে ফেলছে,গুম হচ্ছে।
তাই ভীষণ ভয়ে ভয়ে আছি, আর অমল টা বাথরুমের নাম করে সেই যে বেরিয়েছে, এখনো ফিরে এলো না।
লোকগুলোর মধ্যেই একজন বললো,ভাই আমরা পর্যটক, বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছি।
আমরা সুন্দরবন, কুয়াকাটা,কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ঘুরতে যাবো।
আমার সাথে ঐ তিন জনই তুরস্কের অধিবাসী।
আমি ও তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে চাকরি করি।
আমার বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়।
এই তো সবে ইস্তাম্বুল এয়ার লাইন্স এ চড়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নেমে একটা মাইক্রো গাড়িতে উঠে এখানে এসেছি।
ভেবেছিলাম,এখান থেকেই সুন্দরবনে যাব।
কিন্তু আপনার কথা শুনেই তো আমরা হতবাক হয়ে যাচ্ছি!
তাছাড়া আমি একা বাঙালি, আমি বাংলায় কথা বলি, উনারা তুরস্কের লোক, তুর্কি ভাষায় কথা বলে।
সন্ত্রাসীরা হয়তোবা ভাবতে পারে ওরা বিদেশি, টাকা পয়সা আছে, সবকিছুই লুটে নেবে!
তখন তো আর বাঁচার উপায় থাকবে না।
বাঙালি লোকটা বলল, প্রায় পনের বছর পর এই বাংলাদেশে এসেছি।
অনেকটাই পটপরিবর্তন হয়েছে, মানুষের ধ্যান -ধারণা ও পাল্টে গেছে।
বদলে গেছে মানুষের মন -মানসিকতা।
একদিকে হীনমন্যতা, হিংস্র মনোবৃত্তির প্রেষণে নিষ্পেষিত গণমানুষের জীবন যাত্রা।
হয়তোবা জঙ্গি সন্ত্রাসীরাও ঢুকে পড়েছে।
আহারে, আমার সোনার বাংলাদেশ, আজকে একী হাল হয়েছে?
লোক টি মনে মনে ভাবছে, আর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
এ দেশে আমার আত্মীয় -স্বজন, বন্ধু বান্ধব আর কেউই নেই।
আমার পরিবার ও তুরস্কের আঙ্কারায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে।
আমি চাকরির সুত্রে এখনো ইস্তাম্বুলে আছি।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণার অবগত হলাম এবং খুবই ব্যথিত ও মর্মাহত হলাম ।
আমার ইস্তাম্বুলের তিন বন্ধুকে বেড়াতে নিয়ে এসেছিলাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের অনেক কৌতুহল ছিল।
এখন এসেই মহাবিপদে পড়েছি!
এতো দিন তুরস্ক বাসীদের ধারণা ছিল বাংলাদেশ একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এদেশে নব্বই শতাংশই মানুষ মুসলিম।
মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশকে ভেবেছিলাম,কোন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই , গুম কিছুই হয়না।
এখানে সুফি,সাধক, দরবেশ, আউলিয়া বসবাস করে,
সকলেই সৎ ও ধার্মিক।
তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশে সুফি,সাধক ,দরবেশরা অনেকটাই ধর্মীয় বিশ্বাসী।
তাঁরা নাকি ঝাড় ফুঁক দিয়ে অসুখ -বিসুখ সারে।
অনেক কঠিন রোগ- ব্যাধি ও ঝাড় ফুঁকে সেরে যায়।
আমি ভিনদেশিদের বুঝিয়ে এনেছি, বাংলাদেশ অনেক ভালো , সুন্দর ও নিরাপদ দেশ?
এখন তাদের ধারণাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা হতে চলেছে।
আমি ও জানতাম, বাংলাদেশ একটা ধার্মিক মুসলিম দেশ।
এখানে কোন প্রকার ছল – চাতুরির আশ্রয় নেই।
আমার বন্ধুরা ইস্তাম্বুলের অধিবাসী।
তারা তুর্কি ভাষায় কথা বলে।
তাদের দেশে নব্বই শতাংশই মুসলিম বসবাস করলেও এখনো একটা ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত।
তুরস্কে কোন কলহ বিবাদ নেই, চুরি, ডাকাতি ছিনতাই গুম বলে কোন কিছুই ওরা বোঝে না।
মাঝে মধ্যেই জাতিগত সংখ্যালঘু -কুর্দিদের সাথে একটু সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
তাছাড়া তাদের মধ্যে হিংসা -বিদ্বেষ নেই!
তারা কখনো অন্যের ক্ষতি করে না, সবাই সুখ- শান্তিতে বসবাস করে।
তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা ছিল, তা আজকে যেন সবই ভুল বলে প্রমাণিত হল।
প্রবাসী বাঙালি লোকটির একথা গুলো বলতে বলতেই, অমল চিৎকার করে ছুটে আসছে,কিছুটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
তবে অমল হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল, তুহিনের সামনে আর যেতে পারছে না।
তুহিনের সামনে চার জন লোককে দেখে আরও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল অমল !
অমল ভাবলো, তুহিনকে বোধহয় উত্তম মধ্যম দিচ্ছে, হয়তো টাকা পয়সা ও ছিনিয়ে নিয়েছে ঐ লোকগুলো।
তুহিনের ও বুঝতে বাকি রইল না, তার সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে হয়তোবা চোর, ডাকাত ভেবে সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে অমল?
অমল, তুহিন কে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো,আয় আয় তুহিন? উনারা পর্যটন কারী, খুবই ভালো মানুষ, তুরস্ক থেকে এসেছেন।
অমল এবার সাহস করে নিকটে আসতেই বিষয় টা পরিস্কার হয়ে গেল।
অমল কিছুটা কেঁদে ফেলেই বললো, শিগগিরই বাড়ি চল, তুহিন?
কয়েক জন গুণ্ডা বাহিনী এসে আমাকে বেধড়ক প্রহার করে টাকা পয়সা, মোবাইল ফোন সব কিছুই ছিনিয়ে নিয়েছে।
এখন হয়তো এদিকে আসতে পারে, চল আর কালবিলম্ব না করে বাড়ি ফিরে যাই।
তোর সামনে ঐ চারজন মানুষ কে দেখে আমিও প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম।
তুহিন বলল,উনারা তুরস্কের অধিবাসী। বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছেন।
কোন ভয় নেই, তুই কাছে আয়?
লোক গুলো হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, আহ্ রে এদেশে কি এমনই ভীত সন্ত্রস্তের দেশ?
বাংলা ভাষা না বুঝলেও অমল ও তুহিনের চোখের ভাষা, মুখের ভাষায় সহজেই অনুমান করতে পেরেছে তুরস্কের চার বন্ধু!
তাদের ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখেই,পরের দিন বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স এ চড়ে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্য বিদায় হল! 🍁
🍂কবিতা
অরুণ কুমার চক্রবর্তী
সেইদিন, জন্মদিন
এখনও জন্মই হয়নি আমার…..
শুধু ওল্টানো কলসীর ঘর থেকে ছয় দেয়ালের ঘরে নির্বাসন হলো,
অতঃপর,
নীচে মাটির চাতাল, ওপরে আপাত নীল ছাদ,
মাঝখানে টালমাটাল টাগ-অফ-ওয়ার,
অথচ, গভীর নির্দেশের তরঙ্গমালা হটাৎ হটাৎ বলে যায়
অনন্ত আলোর দেশে জন্ম হোক তোমার, এসো এসো চলে এসো কাছে ——-মরমিয়া প্রেমের বাগান দুটো হাত পেতে আছে…
পঞ্চপদার্থের ঘুম ভেঙে গেছে তোমার ভেতরে…
ছয়দেয়ালের ঘর কিছুতেই ছাড়বে না জানি, জানি
নেমেছে মায়াটান স্বর্গীয় রাজনীতির প্রচারে প্রশয়
মুক্ত করো এই পশ্বাচার,
প্রকৃতই মানুষ হলে মানুষেরই জন্মদিন হয়….
গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
নদী
আমরা কথা বলতে বলতে একটা নদী
পেরিয়ে এলাম
বেলা শেষের ছায়ায় গাছের ছায়াও
এখন অন্ধকারে ভাসছিল
আমাদের তো কোনো নির্মিত আকাঙ্ক্ষা
ছিল না
ছিল না নিজেদের কোনো স্বর
কেবল সেই যে একটা নদী
যার সঙ্গে আমাদের প্রায়ই দেখা হতো
অথচ আমাদের ভিতরে ভিতরে যে স্বীকৃতি
তাকে নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তায় থেকেছি
মিল হয়নি
অনন্ত নির্জন
সম্পূর্ণ পৃথিবী যেদিন বদলে যাবে
সেদিন আমরা আর কেউ থাকব না
কিছু মুগ্ধ নিবিড় সান্নিধ্য
কিছু হাওয়ার ফিসফাস আর অনন্ত নির্জন
কিছুদিন নন্দিত হয়ে থাকবে
তারপর রাত্রির অন্তরাল
আর সংবেদন সমগ্রতাই থেকে যাবে
বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়
তুমি চলে গেছো
তুমি চলে গেছো
সেইটুকু মনে পড়ে আজও বারান্দার ফুলটব চলে যেতে দেখেছে তোমাকে
তুমি ভ্রুক্ষেপ করনি কোন
কত দিন মাস বছর বয়ে গেছে
তবু তোমার ফেরার অপেক্ষায় একটি ঘাসও
নিজের জায়গার পরিবর্তন করেনি!
তুমি চলে গেছো
আগে যে একটি দুটি পাখি আসত এখানে
তারাও মুখ ঘুরিয়ে অন্য কোন বৃক্ষে
হয়ত বসেছে-
তুমি চলে গেছো সেই থেকে
ঘর ঝাঁট দেওয়া বন্ধ
মশারির মধ্যে একটি শরীর শুধু খোঁজে, সম্ভবত তোমাকেই
খোঁজে, কেন খোঁজে
তার সদুত্তর হয়তবা ঘাস জানে
আর জান তুমি!
সুনীল মাজি
আমাদের মাঠগুলো
এক বিস্তৃত প্রান্তর ছাড়া আমরা কিছু চাইনি।
চেয়েছি রৌদ্রকরোজ্জ্বল—চেয়েছি বৃষ্টিস্নাত জ্যোৎস্নায়
অরণ্যঘেরা এক দ্রাঘিমার ভিতর ও বাহির পতঙ্গধ্বনি।
স্টেথোয় ধরা পড়বে তারার আগুন—আলোর বাজনায়
বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে মানুষ ঘুমাবে জানালা খুলে।
কিশোর বাজবে কিশোরী নাচবে জাতধর্ম বিভাজন ভুলে।
গাছের সবুজ পাতায় ভরে যাবে পোশাক আসাক
অগ্রজরা অনুজের মাথায় হাত রেখে বলবে : সুখে থাক।
কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের মাঠ? বহুতল ছায়া
ডায়ানাসোরের কঙ্কাল গুহা— উদ্বৃত্ত মানুষের মনুষত্ব
ঢুকে পড়েছে সংকীর্ণ অন্দরে —প্রকৃতিহীন এক আজব দুনিয়া
কেড়ে নিয়েছে আমাদের পায়ের ধুলোমাটির মানচিত্র
ছোট ছোট গাছগুলো দুলছে দোলনায় পাখিরা খাঁচায়
ফুলে গন্ধ নেই— স্বরে কলতান নেই, মোবাইলে এর তার দিকে চায়
কেউ তেমন কথা বলতে চায় না ঝড়বৃষ্টির সুরে।
কোথায় হারিয়ে গেল নদীমাঠচাঁদ দৃশ্যের ওপারে !
আমাদের আর কারও ঘর নেই বোধ হয়
সূর্যাস্তের পারে বসে প্রতীক্ষায়—এখনও হয়নি সূর্যোদয়।
তৈমুর খান
চরিত্র আসলে কিছু নয়
এখন আলোর ঘুম তুলে রাখি
আর পেছন ফিরে
মৃত্তিকার সন্নিধি ছড়িয়ে পড়তে দেখি
পার্থিব চেতনার গান গাইতে থাকে পাখি
উত্তেজনার দম ফুরিয়ে এলে
আবার নতুন উত্তেজনার খোঁজে
মাঠ পেরিয়ে যাই
বিরামহীন মানুষ শুধু
সেও পেয়েছে মানব হবার দায়
কলঙ্কিত খোঁপা খুলে গেলে
নষ্ট রাত , ভ্রষ্ট পথে
চরিত্রগুলি হাঁটতে থাকে
চরিত্র আসলে কিছু নয়
পারিবারিক কুয়োর জলে
বালতি নামায়, বালতি তোলে
উত্তরাধিকার…
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ
গান
লালিত সংলাপে বিস্তারিত প্রলাপ
হিংস্র গলি ছেড়ে মন
আলোচিত হয় বিভক্ত টানাপোড়েনে
ট্রেনের গান বিশেষনে
বাজারের পরিসংখ্যান সংখ্যাতিত…
সিদ্ধার্থ সিংহ
কী করে বলি
হাইকমান্ডকে কী করে বলি!
ও রকম দু-চারটে খুন সবাই করতে পারে
কিন্তু এক কোপে কারও মাথা নামিয়ে
সেই মুণ্ডু নিয়ে কখনও কি ফুটবল খেলেছেন প্রকাশ্য রাস্তায়?
তবে?
ও রকম দশ-বিশটা ধর্ষণ সবাই করতে পারে
কিন্তু আপনার নাম শুনলেই
মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যাবে মেয়েদের স্কুল, পাপড়ি গুটিয়ে নেবে ফুল
সে রকম বিভীষিকা কি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন চারিদিকে?
তবে?
আপনাকে আসতে দেখলে
আশপাশের বাজার, চৌরাস্তার মোড়
কিংবা অফিসপাড়া
খরগোশ হয়ে যেতেই পারে
কিন্তু ওদের ভিতরের বাঘটাও যে মাথা নুইয়ে কোণে গিয়ে লুকোবে
সে রকম কুচকুচে কালো মেঘে কি ঢেকে দিতে পেরেছেন গোটা আকাশ?
তবে?
হাইকমান্ডকে আমি কী করে বলি
এবার অন্তত ভোটে দাঁড়ানোর জন্য আপনাকে একটা টিকিট দিক।
কুন্তল দাশগুপ্ত
হেরো
আমি কেবল তোমার কাছেই হারি।
তুমি আমায় চক্ষে হারাও
আপন নরম বক্ষে হারাও
এবং সকল কক্ষে হারাও
আমি কেবল তোমার কাছেই হারি।
হারতে হারতে নিঝুম আমার
বুক ভ’রে যায় আন্দোলনে।
হারতে হারতে বুঝি আমার
সুর ভুলেছি সকল গানের।
তুমি আমায় প্রাত্যহিকে
হেরো বলে দাগিয়ে দিলে
তিলকপ্রভ।
সমর্পিতের ললাট কবে
জয়তিলকের প্রত্যাশাপর?
কবেই বা কে জিততে চেয়ে
খুন করেছে সোনার পাখি?
পড়লে কেহ সর্বনাশের আশায় থাকা
চোখের ভাষা, বুঝেই যাবে
যা বুঝবার খুব সহজে।
তোমায় আমি হারাই না তো,
পারিই তো না।
মোদ্দা এটা বুঝে নিও
তোমায় আমি
আমৃত্যু
এক মুহূর্তেকে
হারাতে চাই না।
রেহানা বীথি
পরাবাস্তবতা
দেখো –
যেন জড়িয়ে ধরে আছে আয়ু
কীভাবে ছেড়ে যাবে তুমি?
কফির পেয়ালায় বাষ্পীভূত বিষণ্ণতা
উড়ছে…
তুমি খসে পড়ছ পালক হয়ে
একটি ডিঙি নৌকা ধীরে ধীরে
এগিয়ে আসছে তোমার দিকে
তোমার চোখ দুটো যেন চলৎশক্তিহীন…
তুমি তোমার হাত বাড়ালে
ইচ্ছে না থাকলেও মাঝে মাঝে
মুঠো খুলে যায়
ইচ্ছে না থাকলেও
মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরতে হয়
মাতাল ঢেউ…
অ-চেনা
নেমে এসেছি
তবুও আলো হাতে আকাশ
উপুড় হয়ে আসে
এত আলো
ধাঁধাঁয় অন্ধ হয়ে আসে চোখ
হাতড়ে ফিরি চিবুকের ডুকরে ওঠা ঢেউ
দেখা হয় না আমাদের
যেন আমরা আপন নই
আমরা যেন অন্যের, অন্য কারও কেউ
সুপ্রভাত মেট্যা
ধুলো ময়লার মেয়ে
তুমি জলের মতো সহজ হয়ে দাঁড়াও।
আমার ডুব খেলে যায় লেখা।
সামনে-পিছনে যাওয়া-আসার মধ্যবিন্দু চাঁদে আমাদের ঘর
জন্ম নেয়। আমরা ভেসে বেড়াই। ঘর মানে কি সংসার?
ভাত ফুটে ওঠা কাঠের আগুনে কোনও?
ধুলো ময়লার মেয়ে, বলে লোকে।
লোকে বলে পাথুরে কালো, রাতে মিশে গেলে আর চেনাই যায় না!
নষ্ট হয়ে, নষ্টে গিয়ে হারায়।
দ্যাখো, ওই খারাপী রাতের শরীরে যত পারো মন্দ ঢালো তুমি,
অন্ধ সে কিন্তু নয়; তারও চোখ সুচেতনাষুর, সুখমণ্ডলচমকিতের…
অথচ ওই শহর, গ্রামে এলে তুমি হাওয়া করো, পেন্নাম ঠুকে, বসতে দাও। আর গ্রাম শহরে গেলে? তখন?
কেন এই জল যেদিকে ভাল, সেদিকে গড়িয়ে যাওয়ার নেশা?
কেন এই শীর্ষকারিতা, মর্দনতৈলের?
তাপস ওঝা
অবেলার কলকে গাছ
কলকে ফুলের গাছের ডালে ঝুলছিল
আমার পুরনো দিনের সংলাপগুলি,
ভাঙাচোরা মন্দিরটির ভেতরের অন্ধকারে
এখনও সেই কথাবার্তা গান হয়ে কাঁদে!
হেরে যাওয়া ছবি
মনে বড় বাজে!
কেলেঙ্কারির গাজনতলায় বাজ পড়ে,
যে কেঁদে কেঁদে বেসামাল
অবেলায় তার ট্যারা চোখে আমারই
হেরে যাওয়া ছবি।
দেবাশিস সাহা
ছল
স্নানজলে শীতগন্ধ
এটাচবাথে তিড়িংতিড়িং
গ্লিসারিন সাবান
খড়ি উঠছে গায়ে
অপেক্ষায় অলিভ অয়েল
শীতকালীন ভ্রমণসূচী নিয়ে
হাত নাড়ছে রেলওয়ে
হেমন্তের হিমে ঝরে যায় পাতা
ঝরা পাতার আবডালে ছোঁয়ার চেষ্টা
সে তো তোমাকে ওম দেবার ছল।
রোকসানা রহমান
হাতের মুঠোয় একটা আকাশ
তুমি করজোড়ে প্রার্থনা কর নারীর দেহে গোলাপের সৌরভ
আর চোখের আবর্তে রচনা কর কাল্পনিক প্রার্থনার ইতিহাস।
তুমি পঞ্চইন্দ্রিয়ের সীমানা অতিক্রম করে মিলিত হও রজনীর সাথে।
আর তখনই সূর্য্য উন্মুক্ত করে দেয় দিনের আলো
লালসালু কোটরে জড়িয়ে।
আমি শুনি তোমার কণ্ঠস্বর
আকাশের ছায়াপথ থেকে নেমে আসা এক বৃক্ষ,
মৃত্তিকা দিয়ে গড়া সে বৃক্ষের উপরে অধিষ্ঠিত সাধনার পোশাক
সেখানে আগুনের উত্তাপ।
অনায়াসে গেঁথে নিয়েছো হাতের মুঠোয়
একটা আকাশ।
দীপান্বিতা রায় সরকার
রোদের খবর
পাখির চোখ এফোঁড় ওফোঁড়
কোথায় সে ধ্রুবক বাণ?
সে বোধ আর জাগলো কোথায়!
যেখানে সব আয়ুষ্মান।
এই যে ভীষণ ক্রান্তিকালে,
ফুরায় আয়ু ঘনায় ঘুম।
বরফ কঠিন জমাট ঘৃণায়
যুগলবন্দী এ মরসুম।
তোমার কখন সময় হবে?
রোদ লেফাফায় খবর দাও
আমাদের শৈত্য শহর
প্রবল শীতে কম্পমান।
আমারা শুধুই ক্ষয় দেখেছি,
ঘুণ পোকাদের ঘর দেখেছি বৃক্ষমূলে,
শুদ্ধ সহজ, আবার কবে? নতুন করে
সবুজ পাতার উপত্যকা আমার হবে?
🍂ভ্রমণ কাহিনী
মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
হ্যালোউইন ও পায়োনিয়র ভিলেজ
১.
“আরে বাবা! ছুটির দিনে ভোর বেলা উঠে কেউ ডাইনীবুড়ি দেখতে যায়?”
“ডাইনীবুড়ি নয় মোটেই! আমরা দেখতে যাব উইচ, মানে জাদুকরী!”
“তাই যদি হয় তাহলে হ্যারি পটার চালিয়ে দিচ্ছি। ঘরে বসে জদুকরী দেখো।”
“সে হ্যারি পটার আমি রোববারও দেখতে পারি। কিন্তু কাল আমরা যাব নিউ ইংল্যান্ডের উইচক্র্যাফট ক্যাপিটালে।”
“হুঁ:! শুধু উইচ কেন? নেটফ্লিক্সের আধা সে যাদা ভূতের মুভি এই নিউ ইংল্যান্ডের ঘটনা ঘিরেই। অ্যানাবেল, কনজুরিং আরও কী না কী! বাপ রে! পেটের দায়ে বিদেশে এসে শেষে কিনা ভূতের রাজ্যে বাস।”
“বোকার মত কথা বোলো না! যা কিছু মুভিতে দেখ তা সবই এখন ‘ভূত’ মানে অতীত! পাঁচতলা মল পুরোটাই এখন মানুষ গিজগিজে। উল্টে ভূতেই এখন দর্শন দিতে ভয় পায়!”
“তুমি বুঝতে পারছ না কাকলি, এই অক্টোবরে কী ভীষণ ভিড় হয় সালেমে! ওই মিউজিয়ামগুলো তো বছরের যে কোনও সময় যাওয়া যায়, তাই না?”
“মিউজিয়াম যাব তোমাকে কে বলল? কাল এত লাইন দিয়ে মিউজিয়াম যাওয়া যাবে না সেটা জানি।”
“উইচ মিউজিয়াম, উইচ ডানজন মিউজিয়াম, হাউস অফ সেভেন গ্যাবল, পিবডি এসেক্স মিউজিয়াম এগুলোই তো মুখ্য আকর্ষণ! ওগুলোয় না গেলে আর সালেম গিয়ে হবেটা কী?”
“ভাবো একবার, একজন দুর্গাপুজোর সময়ের কলকাতা দেখতে চাইছে, আর তুমি তাকে বলছ কলকাতা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! মার্চ এপ্রিলে এসে ঘুরে যান না! সেই লোকটা ঘন্টা ফিল পাবে দুর্গাপুজোর! তাও তো আমি তোমাকে হ্যালোউইনের দিনে যেতে বলছি না। বলছি তার এক সপ্তাহ আগে চলো। গোটা অক্টোবর মাস জুড়েই ওখানে উৎসব পালন হয়।”
এরপর আর কথা হয় না। অকাট্য যুক্তি। কাকলির সঙ্গে কথায় আর কবেই বা পেরে উঠেছে বিমান! কাল ডেস্টিনেশন সালেম ফাইনাল। কিন্তু এই ট্রিপটা মনের মতো হবে না, সেটা বিমান আগেই টের পাচ্ছে। কাকলি ঠিক কী কী দেখতে চাইছে, বিমানের মাথায় ঢুকছে না। সালেম ছোট এক কোস্টাল শহর। পার্কিং পাওয়া খুব চাপ। অক্টোবর মাসে সালেমের বাইরের লোকেরা স্ট্রিট পার্কিং ব্যবহার করলে নাকি গাড়ি তুলে নিয়ে চলে যায়। সে গাড়ি ছাড়াতে তারপর ফাইন আর আইনের হামলা। আর এম.বি.টি.র পাবলিক পার্কিং লটে জায়গা পেতে হলে আগের রাতে গিয়ে স্লট দখল করা ছাড়া উপায় নেই। অতএব ভালো রকম ডলার গচ্চা দিয়ে প্রাইভেট পার্কিং বুক করতে হবে। তারপর গাড়ি সেখানে সারাদিন আরাম করবে আর মানুষ দু’জন হন্যে হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে। মনে মনে গজগজ করতে করতে গুগলে সালেমের ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশনে চোখ বোলায় বিমান। কাকলি ততক্ষণে নিশ্চিন্তে সোফার নরম গদিতে ডুব দিয়েছে হুমায়ুন সাহেবের হিমুর সঙ্গে।
২.
যা ভাবা হয়েছিল তাই। এম.বি.টির পার্কিং ফুল। গাড়ি ঘুরিয়ে ডাউনটাউনের দিকে যেতে যেতে দেখা গেল পথের দু’পাশে যাদের বাড়ি তারা ‘পার্কিং পঞ্চাশ ডলার’ বোর্ড লাগিয়ে দিব্য দু’পয়সা কামানোর ধান্দায় আছে। এদিকে চলমান যানবাহন ছাড়া পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে শয়ে শয়ে গাড়ি। সবই কি সালেমবাসীদের? কে জানে! সালেম খুব বড় শহর না। যে ক’টা দেখার জায়গা যেমন উইচ মিউজিয়াম, হোকাস-পোকাস হাউস, প্রক্টর’স লেইজ, উইচ ট্রায়াল মেমোরিয়াল ইত্যাদি সবই পায়ে হেঁটে গেলে কুড়ি থেকে ত্রিশ মিনিটের বৃত্তেই পড়ে। গাড়িটা নিয়েই সমস্যা। এদিকে কাকলি এক মনে গুগল ম্যাপ দেখছে,
“শুনছ, জায়গা যখন নেই তখন পায়োনিয়র ভিলেজ চলো। ওখানে অঢেল গাড়ি রাখার জায়গা। আর গ্রামটায় তো যেতেই হবে।”
“কিন্তু সে তো সূর্য ডুবলে ‘নাইট ফেয়ার’ ইভেন্ট আছে বলেছিলে ওখানে!”
“হ্যাঁ, কিন্তু বারোটা থেকেই খুলে যায়। ওখানে ঘুরে নিয়ে, গাড়ি ওখানেই রেখে আমরা হেঁটে শহরটা ঘুরে নিতে পারি।”
প্ল্যান মন্দ নয়। তবে পায়োনিয়র ভিলেজ শহরের একদম শেষ প্রান্তে। ওখান থেকে মূল শহরে পৌঁছতে ন্যূনতম আধ ঘন্টা। তার ওপর যে জায়গায় বিকেলে যাওয়াই হবে সেখানে সকালে গিয়ে কি লাভ? কথাগুলো কাকলিকে বলতেই ও কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেল,
“দিনের আলোয় আর রাতের আঁধারে একই জায়গা কেমন আমূল বদলে যেতে পারে জানো? এই গ্রামটা ১৯৩০ -এ তৈরি জর্জ ফ্রান্সিস ডোয়ের উদ্যোগে। কিন্তু সেই ১৬৩০ -এ সালেম কেমন ছিল, তার আত্মাকে ধরে রেখেছে পায়োনিয়র ভিলেজ। বলা হয় ১৬৩০ -এ ‘উইনথ্রপ ফ্লিট’ নামক এগারোটি জাহাজ এই সালেমে আসে আর তারপর এখানে কলোনি শুরু হয়। যত্ন করে সেই সময়ের বাড়িঘর, দোকান, কামারশালা, এমনকি ওয়াম্প্যানোগ আদিবাসীদের বাড়ি উইগোয়ামও সংরক্ষিত আছে এখানে। আমেরিকার প্রথম ‘লিভিং হিস্ট্রি মিউজিয়ামে’ একবারের বেশি দু’বার কি যাওয়া যায় না?”
প্রবেশ দ্বারে এক সুন্দরীর কাছে পাঁচ ডলার দিয়ে ঢুকতে হয়। আজকালকার বাজারে এক প্যাকেট চিপস হয় না এই টাকায়, অথচ এক ইতিহাস সমৃদ্ধ জায়গার টিকিট হাতে চলে এল। ছোট ছোট বাড়িগুলোর মধ্যে পুরনো দিনের খাট-বিছানা, আসবাব, বাসন ইত্যাদি রাখা। ফায়ার প্লেসের পাশ বরাবর সরু সিঁড়ি, কিন্তু ওপরে ওঠা বারণ। কোথাও একটা চরকা রাখা তো কোথাও এক কোণে খড়ের গাদায় বসার জায়গা। কাকলি ঠিক এমনটা আশা করেনি। একটু যেন কৃত্রিম মনে হচ্ছে সবকিছু। ওয়াম্প্যানোগ আদিবাসী নিয়ে যা কিছু পড়াশুনো করে এসেছিল তার গন্ধ যেন এখানে নেই। প্রচুর ভিড়। মানুষ আসছে, সেলফি নিচ্ছে আসবাবে হাত দিয়ে দেখছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে। কাকলি দেখতে চাইছিল সেই আদিবাসী মেয়েটিকে যে সন্ধে রাতে আগুন পোয়াতে পোয়াতে চরকা কাটত, অথবা সেই ছেলেটাকে যে কামারশালে হাপর টেনে আগুন টিকিয়ে রাখত এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে।
সামান্য হতাশ হলেও চারিদিকের শান্ত পরিবেশে মন ভালো হয়েই যায়। খোলা আকাশের নীচে আগুন জ্বেলে সসেজ রান্না হচ্ছে। তা কিনে খেতেও পারে ট্যুরিস্টরা। দুই হাত আর মাথা দু’টো কাঠের পাটাতনের ফুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে মানুষ বন্দী রাখার ব্যবস্থা আছে। অনেকটা হাঁড়িকাঠের মতো ব্যাপার। বেশিরভাগ জায়গাতেই দড়ি ফেলে রাস্তা বন্ধ। হয়ত সন্ধেবেলায় খুলবে। পায়োনিয়র ভিলেজে ডিজনির বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘হোকাস পোকাস’ -এর কিছুটা অংশ স্যুটিং করা হয়েছিল। সেই সব বাড়িগুলোয় এখন ঢোকা যায় না। বাইরে থেকে সবাই সেই বাড়ির সঙ্গে সেলফি তুলছে বা রিল বানাচ্ছে। যে বাড়িতে স্যান্ডারসন বোনেদের অভিশাপগ্রস্ত হয়ে থ্যাকারে বিনক্স কালো বিড়াল হয়ে বাস করত, সেই বাড়িটার জানলাটা খোলা। তাতে উঁকি দিলে দেখা যায় টেবিলে একটা কুমড়ো আর খাটে সেই বিড়াল বসে ঠিক ভিজিটার্সের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।
ছবিটবি কাকলি বিশেষ তোলে না। ওর প্রাপ্তি হল প্রতিটি বাড়িতে যত্ন করে সাজিয়ে রাখা টুকরো টুকরো লিখিত ইতিহাস। কলোনির মেয়েদের যাপন ছিল কত কঠিন। মেয়েদের পড়াশুনা, ভোটিং বা সম্পত্তির অধিকার ছিল না। বাচ্চার জন্ম দেওয়া আর ঘর সামলানো এই দুই প্রধান কাজ তাদের। হেসে ফেলে কাকলি। প্রায় চারশ বছর পরেও কি সবকিছু বদলেছে? অথচ কলোনি স্থাপনের আগে যারা এই অঞ্চলের আসল অধিবাসী ছিল, সেই ওয়াম্প্যানোগ সমাজে মেয়েরা ছিল মুক্ত, শিক্ষিতা, সঠিক অর্থে গৃহকর্ত্রী! তাহলে সভ্যতার ঝান্ডা চতুর্দিকে প্রোথিত করার দাবি যারা করে, তাদের সমাজে মেয়েদের এই হাল কেন?
৩.
পায়োনিয়র ভিলেজ থেকে বেরিয়েই সামনে চকচকে নীল আটলান্টিক মহাসাগর। তার বুকে সারি সারি নৌকা ভেসে আছে। বিমান আর কাকলি কিছুক্ষণ একটা বেঞ্চে বসে সেই দৃশ্য উপভোগ করল চা, কুকিজ আর চিপস সহযোগে। তারপর হাঁটা লাগাল শহরের হৃদয় বরাবর। রাস্তায় নানা রকম পোশাকে নানা বয়সের লোকজনের ঢল নেমেছে। বসত বাড়িগুলোর জানলায় কোথাও কঙ্কাল, কোথাও বা নান, স্ক্রিম, অ্যানাবেলের মতো কুখ্যাত ভূতের মুভির ভয়ঙ্কর চরিত্ররা উঁকি মারছে। সালেম শহরের বাড়িগুলো পুরনো ধাঁচের। কিছু কিছু বাড়ির রং পুরো কালো বা অদ্ভুত সবুজ। পায়ের দফারফা করে যখন উইচ ট্রায়াল মেমোরিয়ালের কাছাকাছি ওরা এলো তখন ভিড় বেড়েছে ভালোই। ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে নানা শহর থেকে প্রায় দু’শ লোককে ধরে আনা হয় জাদুবিদ্যা অনুশীলনের অভিযোগে। তারপর বছরের বিভিন্ন সময়ে শুনানি আর বিচারে, বা বিচারের নামে প্রহসনে, মোট ঊনিশ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয় এইখানে। একজনকে অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্যে। পনেরো জন মহিলা আর পাঁচ ব্যক্তির নামাঙ্কিত পাথরে আজও গ্রথিত আছে করুণ সে ইতিহাস। মেমোরিয়ালের একপাশে বিশাল কবরস্থান। সেখানে প্রি-বুকিং ছাড়া ঢোকা যায় না।
উল্টোদিকে বেশ খানিকটা হাঁটা দিয়ে পৌঁছনো গেল আপাদমস্তক কালো এক উইচ হাউসে। শুধুমাত্র ছবি তোলার জন্য সেখানে লম্বা লাইন। ওই ফুটপাতেই কিছুটা এগিয়ে পড়ে ‘রোপস ম্যানসন’। এখানে সেই ‘হোকাস পোকাস’ মুভির বেশিরভাগের চিত্রায়ন হয়েছিল। বাড়ি ঘিরে রয়েছে এক অতিকায় সুন্দর বাগান। পরপর আরও কয়েকটা দর্শনীয় স্থান দেখে নিয়ে ফেরার পথ ধরল ওরা। ততক্ষণে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে গোছা গোছা স্ক্রিম, হ্যালোউইন, দ্য নান, কাউন্ট ড্রাকুলা, পাম্পকিন-হেডরা। আবার ফ্ল্যাশ, স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান, স্টার ওয়ারসদেরও ছড়াছড়ি। কালো পোশাক আর পয়েন্টেড হ্যাটে কম বয়সীরা ভরিয়ে রেখেছে সালেমের পথঘাট। খুব আফসোস হচ্ছে কাকলির। একটা উইচ হ্যাট কেন যে আগেভাগে কিনে রাখেনি! অন্ততঃ বুদ্ধি করে যদি কালো গাউনটা পরে আসত!
৪.
গাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। সারাদিনের হাঁটাহাঁটিতে পা আর চলছে না। এদিকে পায়োনিয়র ভিলেজ সেজে উঠেছে আলোয়। যেখানে সকালে আরামে ঢুকে পড়া সম্ভব হয়েছিল সেখানে সন্ধের মরা আলোয় দাঁড়াতে হলো অ্যানাকোন্ডার মতো বিরাট এক লাইনে। উসখুস করে বিমান,
“বলছি ভিতরে কী আবার যেতেই হবে? অনেক তো ঘুরলাম!”
“উফ! এর থেকে লম্বা লাইন দিয়ে আমরা শ্রীভূমির ঠাকুর দেখেছি, মনে নেই?”
সেই বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা বিমান আর মনে করতেও চায় না। পাক্কা দেড় ঘন্টা লাইন দিয়েছিল সেবার। সামনে কেবল মাথা আর মাথা! দু’জনে যখন ঠিক করল ঠাকুর দেখে আর কাজ নেই, ফেরা যাক, তখন পিছনে ফিরে দেখে ফেরারও আর রাস্তা নেই। কেবল মাথা আর মাথা! সেই তুলনায় এই লাইন তুচ্ছ এবং চলমান।
কাকলি ঠিকই বলেছিল। রাতে পায়োনিয়র ভিলেজের চেহারাই পাল্টে গেছে। তবে গা ছমছমে কোনও ব্যাপার নেই। চারিদিকে নিবু নিবু আলো। বাড়িগুলোর পাশে দৈতদানবরা কলড্রন হাতে দাঁড়িয়ে। সামনে গেলে একটা করে ‘স্পুকি গিফট’ হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। ওরা পেল প্লাস্টিকের আরশোলা আর মৌমাছি। একটা বাড়ির পাশে সকালে চেয়ার পাতা ছিল। তাতে রাখা ছিল সাদা রঙের সুন্দর এক পোশাক। এখন সেই চেয়ারে ওই পোশাক পরে বসে আছে এক ম্যমি। সে হাতে তুলে দিল ডেথ সাইনওয়ালা ছেঁড়া ট্যারো কার্ড। একটু দূরে এক বাগানে এক ডালা রক্তরঙা ফলের মাঝে, ওয়াইন রঙের গাউনে বসে মুখ ঢাকা ভয়ঙ্কর পেত্নী এক আঙুলের ইশারায় সকলকে কাছে ডাকছে। ভুল করেও কাছে গেলে ঘোমটা তুলে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন করে দেখিয়ে দিচ্ছে পোড়া মুখ। কিছু বাচ্চা তো ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেলল। বেচারা! সকালে যেখানে রান্না হচ্ছিল সেখানে টর্চ জ্বালিয়ে জোরে জোরে ভূতের গল্প পড়ে শোনাচ্ছেন একজন। ছোট্ট ছোট্ট বাড়িগুলোয় হাতে হারিকেন নিয়ে গাইড করছে জাদুকরীরা। তারাও নানা রকম ভয়ের গল্প জুড়েছে। পাইরেটের পোষাক পরা এক কঙ্কাল ঝোপের ধারে বসে দুলে দুলে বাজাচ্ছে অধুনা গিটার। কালো তাবুর মধ্যে সাদা গ্লোবের সামনে ঢুলুঢুলু চোখে বসে আছে সুন্দরী মিস্টিক, যে নাকি ভূত ভবিষ্যৎ সব বলে দেবে পয়সা পেলেই। সকালে দড়ি ফেলে আটকে রাখা নিষিদ্ধ জায়গাগুলোয় এখন খাবার-দাবার, হ্যান্ডমেড জুয়েলারি এন্ড ক্রাফট, মিস্টিক এসেন্স, লিকার, খেলনা ইত্যাদির দোকান। সব মিলিয়ে বেশ একটা মেলা মেলা ভাব। ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও।
“তাহলে ঘোরা শেষ? আসছে বছর আবার হবে নাকি?”
“না! অতদিন অপেক্ষা করাব না তোমাকে। মাঝে এসে মিউজিয়ামগুলোয় একবার ঘুরে যাব কেমন?”
“সে হবে ‘খন! শোনো, মেলায় এসে না খেলে ঠাকুর পাপ দেয়। দু’টো বার্গার প্যাক করিয়ে নিচ্ছি।”
মাথা নেড়ে সায় দেয় কাকলি। দিনটা ভালোই কাটল। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। ভীষণ ক্লান্ত। সেই কোন সকালে ব্রাঞ্চ সেরে বেরিয়েছে। মাঝে চা-বিস্কুট খেলেও আপাতত খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি হজম হওয়ার অবস্থাই বটে! দেশের মেলা হলে কত কী পাওয়া যেত! জিলিপি, পাঁপড়, ফুচকা! জিভে জল এসে গেল কাকলির। স্পুকি বার্গারের প্যাকেট হাতে দু’জনে পায়োনিয়র ভিলেজকে বিদায় জানিয়ে ফাইনালি হাঁটা দিল গাড়ির উদ্দেশ্যে। পার্কিং কাছেই। কাকলি ভাগ্যিস বুদ্ধি করে এখানে পার্কিং করতে বলেছিল। নইলে ‘নাইট ফেয়ার’ দেখে আবারও আধঘন্টা হাঁটার হিম্মত হতো না কারুরই। মনে মনে কাকলির প্রশংসা করে বিমান। তারপর আরামে বার্গারে কামড় বসিয়ে বলে,
“যাই বলো কলি, ভিড় আছে মানছি। তাও উৎসবের ভিড় বলে মনে হচ্ছে না। এমন ভিড় আমাদের ধর্মতলা বা গড়িয়াহাটে নিত্য পাবে।”
ফিক করে হেসে ফেলে কাকলি। কথাটা ভুল নয়। অ্যানুয়াল ফিজিক্যাল চেক-আপের সময় আমেরিকান ডাক্তার যখন শুনেছিলেন কাকলি কলকাতায় থাকে, তখন চমকে উঠে বলেছিলেন,
“আই হ্যাভ বিন দেয়ার ইন কলকাতা মেট্রো ওয়ান্স! আই থট আই কুড নেভার কাম আউট! সো ক্রাউডি!”🍁
🍂কবিতা
অমিত কাশ্যপ
নবীনচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়
দক্ষিণায়নের রোদে ভেসে যাচ্ছে শ্রেণিকক্ষ
বার্ষিক পরীক্ষা এখনো অনেক দেরি
রবীনবাবু ইতিহাস পড়ান, বণিকবাবু ভূগোল
একজন অতীত, অন্যজন পৃথিবীর চিত্র
ভিন্নধর্মী, বন্ধুত্বে হরিহর আত্মা
বাংলা স্যার নলিনীবাবু অনুপস্থিত হতে
এলেন পড়াতে বণিকবাবু, অদ্ভুত প্রশ্নের মুখে-
কোন লেখকের লেখা পড়ে কান্না পায়
নীরব ক্লাসে ঘরে তখন সাবালক রোদ
এ ওর মুখ দেখি, দেখি বণিকবাবুর মুখ
ভারী চশমা টেবিলে, ধ্যানমগ্ন, গম্ভীর গলা
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী পড়নি কেউ
দুর্গার চলে যাওয়া, সেই ঝড়ের রাতের কথা
মন্ত্রমুগ্ধর মতো বলে চললেন সেই মর্মস্পর্শি কাহিনি
আমরা সেদিন ভেতরে ভেতরে কেঁদেছিলাম
আজও বোধহয় সে কান্না থামেনি, উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু
নিশ্চিতিপুর সেই গ্রামের ঐতিহ্যে বতর্মান
তারক মণ্ডল
ভালোবাসার হাত ছানি
নয়ন ধূলি গগন চূড়ায়
মগন তোমার নেশায়
আলোর ধুলি চলতে শেখায়
তোমার ওই মন চুড়িটার পেশায়…
আছে আলো, আছে বাতাস
আছে তোমার, খোলা চুলের সুভাষ
ভালোবাসার হাত ছানিটাই,তোমার মনেই নিবাস…
সুহাসিনী মুখটি তোমার
মুগ্ধ তোমার হাসি
মনটা আমার উত্তাল পাতাল
আমি তোমায় ভালোবাসি….
টিম টিমেটি জ্বলছে আলো,
আমার মনের ঘরের কোণে
বলছে ডেকে হাতছানিটা, আমি আছি আজও তোমার মনে
অমিত গোলুই
ট্রেন
ট্রেন চলে গেছে।
ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে
চিপসের প্যাকেট, কলার খোসা, চায়ের কাপ।
এগুলো হয়তো সকাল থেকেই পড়ে আছে
কিন্তু ঘনঘন ট্রেনের যাওয়া আসার ফলে
মানুষের ভিড়ে চাপা পড়ে গিয়েছিল।
এখন দুপুরে ট্রেন কম
মানুষের ভিড়ও কম বলেই
এত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্ল্যাটফর্মে বসে বসে
আমি ট্রেনের যাওয়া আসা নয়
যেন নদীর পারে বসে দেখছি জোয়ার-ভাটা।
সুদীপ্তা মণ্ডল
পুড়ছি
আজন্ম পুড়িয়ে আসছো তোমরা,
আমাদের শরীর ও মন।
মধ্যযুগীয় বর্বরতায় জীবন্ত ছুঁড়ে দিয়েছো আমাদের চিতার আগুনে
কি অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দাউ দাউ জ্বলে পুড়ে ছাই উত্তরাধিকারের দাবি
আর তোমরা সতীত্বের পরতে মুড়ে দিয়েছো নির্মম সত্যকে
আমাদের দেবী বানিয়ে নিজেরা পরেছো মহানুভবতার নির্মোক,
বোঝোনি সম্পত্তিতে নয় সংসারে আমাদের বাঁধা যায় ভালবাসায় ,মায়ার বাঁধনে আর মাতৃত্বে।
রামমোহন, বিদ্যাসাগরের যুগ পেরিয়ে এসেছি আমরা বহু বছর আগেই সতীরা মুক্তি পেয়েছে দেবীত্বের খাঁচা থেকে
চিতার আগুন রূপ নিয়েছে কেরোসিন পেট্রোল ডিজেলে
তোমরা ,আমাদের মেরেও পোড়াচ্ছ আবার জ্বালিয়ে দিচ্ছো জীবন্ত।
আত্মহত্যা বলে দিব্যি নিজেদের বাঁচিয়ে চলেছো দিনের পর দিন
আইনের চোখে সাদা কাপড় বাঁধা তাই…।
শরীরের পোড়া দাগ চোখে দেখা যায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দিকে দিকে
নিঃশব্দে পুড়ছে যে আমাদের মন
পোড়া মনের খোঁজ পেতে চেয়েছো কোনদিন তোমাদের আধুনিক বর্বরতা আর পৌরুষত্বের অহংকারে প্রকাশ্যে অ্যাসিড ছুঁড়ে পুড়িয়ে মারছো আমাদের
আধ পোড়া নিজেদের দেখে আঁতকে উঠেছি নিজেরাই ঘৃণায় ফিরিয়ে নিয়েছি মুখ তোমাদের কামনা লালসার ভোগ্য বস্তু হয়ে থাকবো আর কতদিন?
এই হল তোমাদের প্রতি আমাদের বার্তা আমরা, তোমাদের যৌনতার স্বাদ মেটাবার উপকরণ নয় আমরা এই দেশের এক প্রথম শ্রেণীর নাগরিক ঠিক যেমন তোমরা ও।
কণিকা বিশ্বাস
অপ্রেম
আকাশে একফালি ঝুলন্ত চাঁদ
গাছের পাতার মতো,
নক্ষত্ররা বসে আছে দীপ জ্বালিয়ে
কিছুটা জ্বলন্ত বিষন্ন মন ওদের.
কোল জাপটে স্বস্তির আশ্রয় খোঁজে।
সত্যিকারের একটা প্রেম খুঁজতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাস অতলান্ত অপ্রেমের ভেতর ডুবে আছে।
সুমিত্রা পাল
স্থির চিত্রে জীবন
আলো-আঁধারের সন্ধিক্ষণে
প্রবহমান জীবন একটু থমকে দাঁড়ায়
যেন এক স্থির চিত্র!
এই স্থির চিত্রের পটভূমিকায়
অপসারিত কিছু ছিন্ন মুহূর্ত
সহসা যেন হয়ে ওঠে মনসামঙ্গল কাব্য
লখিন্দরের শব হয়ে ভেসে বেড়ায়
বেহুলার কান্নানদীতে।
হৃদয়ের গহন প্রান্তে চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে
যতই পরিব্যপ্ত থাকুক অনন্ত আকাশ,
স্নিগ্ধ সান্নিধ্য
আর স্পর্শ উপচারের মন্ত্র…
মাঝে মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাতে
সবকিছু হয়ে যায় কেমন এলোমেলো
শুধু দূরে, অনেক দূরে, তুলসী মঞ্চে
নির্বিকার জ্বলে যায়
নিস্তরঙ্গ গৃহস্থ দেউটিখানি।
লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল
অনন্তের দিকে চলে যাওয়া মুহূর্তগুলো অনন্ত থেকে বেরিয়ে আসে না এখনও
বেতাল কোরাস আর দুষিত রোদের ভিতর থেকে ছাই ওড়ে জলের দিকে। যেখানে অনর্গল জল ঝরলেও তার স্থায়িত্ব নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা হয় না; গড়িয়ে পড়ে, হারিয়ে যায়।
সে কী তখন আমার সঙ্গী হতে পারে?
তখন মেঘ, তখন পঞ্চান্ন বছর বয়সী কোনো অতীত দাঁড়িয়ে পথ আটকায়, জিজ্ঞেস করে ভালো আছো তো?
আসলে এভাবে কেউ ফিরে আসবে সে তো আমিও ভাবিনি। সিজোফ্রেনিক বোধের ধাক্কায় কাঁপা কাঁপা নক্ষত্রের শ্বাস প্রশ্বাসের স্তর সম্পর্কে তখন তুমিও কি অন্যান্য ঋতুর পাশে ত্রয়োদশ ঋতু হবে?
এখনো লতাগুলো জড়িয়ে আছে পথের ধার। আবার জিজ্ঞেস করে, চিনতে পারলে না তো? অথবা প্রশ্ন আসে, মনে আছে?
তখন ছিল গোড়ালি ডোবা কাদা, পিচ্ছিল সৌন্দর্যের উপর সামাজিক মিথক্রিয়ায় রাজনীতির কোন পূর্বাভাস মেলেনি আজও। অনন্তের দিকে চলে যাওয়া মুহূর্তগুলো অনন্ত থেকে বেরিয়ে আসে না এখনো। তখন তার দিকে সে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার অহংকারগুলো তুমি উন্মোচন করতে পারবে? চোখ মুখ সর্ব অঙ্গের মতো অগ্রাহ্য করতে পারবে রোদ ও হাওয়ার আলুথালু শূন্য?
ফুলের মতো তোমার রক্তের গন্ধ, তোমাকেই স্মরণ করছি আত্মগত বিচ্ছুরণ।
পৃথিবীর পরিধি ছাড়িয়ে জোয়ার আসে কপালেশ্বরীতে।
অমরেশ বিশ্বাস
সত্যবাদী সম্প্রদায়
এ জগতের মিথ্যাচার নেই বললেই
অন্য সাজানো কথা বড্ড গায়ে লাগে
সাজানো কথা বলে উল্লেখ করা কঠিন।
মন্ত্রের সাধনায় ভুক্তভোগীদের সহজে
সুন্দরতায়, কারচুপির চূড়া ছুঁয়ে
ঝুড়ি ঝুড়ি গল্পে ডুবে মারা যায়।
সত্য মর্যাদার অধিকারের দাবিতে
ফানুসের মাথায় চড়ে কোন্দল যাত্রাপথে
প্রভাবিত হলে নিস্তার পায়না কেউ।
সব মিথ্যা অসৎ আর অন্যায়
মনে হয় হাস্যকর দাবি সকলের জন্য
ব্যর্থ হোক পৃথিবীর বুকে সবখানে।
মোহিত ব্যাপারী
যত্ন আহ্লাদে
মাঠে মাঠে ভোরের পাখি ডাকে।
শিশির ভেজা ফসলের ক্ষেত।
আলপথে হেঁটে যাই কাদা মাখা পায়।
পিছনে পড়ে থাকে সবুজ পথের রেখা।
নরম মাটির বুকে লকলকে ফসলের ডগা।
হেলেসাপ এঁকে বেঁকে চলে যেথাসেথা।
ভরপুর যৌবন যার পুঁইশাক ডাটা।
ঘন কালো সবুজ সেথা পুঁইশাক মাচা।
কৃষকের আদর যত্নের ছোয়ায়
তারা আহ্লাদে আটখানা।
সোনার থালায় রোদ উঠেছে কি অপরূপ,
মন ভোলানো শোভা।
ঘাসের আগায় লক্ষ লক্ষ জলের বিন্দু।
সবুজ ধানের ক্ষেত, মাথায় সোনার মুকুট পরা।
দীপঙ্কর সরকার
একাকী নির্জন
একাকী নির্জন আমি চেয়ে দেখি আলোক লতা
জড়িয়ে গাছ মেঘের সামিল, সুদূর অতীত ফিরে
এল ওই নিঝুম সন্ধ্যা ঘরে ঘরে শঙ্খ প্রদীপ। ঝি
ঝি ডাক একটানা করুণ সঙ্গীত গীত হয় কিছুটা
নান্দনিক।
ফিরে চলে মন যেখানে শৈশব গেঁয়ো আলপথ
একটানা হেঁটে চলা হাটুরে লোকজন গৃহাভিমুখ।
দু-এক টুকরো কুশল বিনিময় নিয়মমাফিক, ইহার
অধিক বাহুল্যমাত্র লোক দেখানো প্রয়োজন হীন
সমধিক।
তালে গোলে ভুলে যাই কার সাথে কী সম্পর্ক ছিল
মনেও পড়ে না এই পড়ন্ত বেলায়, কথায় কথায় বয়ে
যায় বেলা একাকী নির্জন আমি চেয়ে দেখি সুদূর
অতীত, সবটা স্মরণে আসে না স্মৃতি ভ্রম হয় বুঝি
ক্ষণ মাত্র সাময়িক।
পার্থসারথি মহাপাত্র
আক্ষেপের যোগফল
যৌবনের দুঃখ বার্ধক্যের দুঃখ এক নয়
বিরহের দুঃখ, বেকারত্বের দুঃখ,
হতাশায় জেগে উঠা মানসিক অবসাদ
সব অতিক্রম করে এসেছে এ জীবন।
যৌবনের সতেজ ফুরফুরে স্নায়ু
বার্ধক্যের ভৌত তরঙ্গ অনুভবে অক্ষম
হয়তো অনেকেই জানেন না
বার্ধক্য হল একরাশ আক্ষেপের যোগফল।
দুর্বোধ্য কাব্যগ্রন্থের মত ধুলো মেখে
বার্ধক্য পড়ে থাকে
বই তাকের কোন এক কোণায়।
রঞ্জনা রায়
মন ছোটে অজানায়
সম্পর্কের মাঝে ধুলো জমে
চন্দন কাঠ জীর্ণ হয়
দুটো শালিকের অবান্তর কিচিমিচি ।
মন দেওয়া নেওয়ার নৌকাটি টলমল
বানে ভেসে যায় উত্তাল রাতবাসর
সহজিয়া মৃদুল খেলায় চাপা দীর্ঘশ্বাস
একাকী তারা কাঁদে অজানা অন্ধকার।
দুদিনের এক্কাদোক্কা, দুদিনের মনস্তাপ
পায়রার সাদা ডানায় মেঘের অঙ্গীকার।
তোমাকে পাবো বলে গড়েছি বালিঘর
জ্যোৎস্নার টিপছাপে ওঠে যে শুধুই ঝড়।
তার ছেঁড়া দোতারায় সুরগুলি থমকায়
মন আজ নিরুপায় –
মন ছোটে অজানায়!
অশোক কুমার রায়
বেশ আছি
ঘরে এখন অসুস্থ সময়ের বসবাস।
নিরাময়ের কি প্রয়োজন
বেশ আছি।
ঘরে ঘরে জন্ম নেয়
আগ্নেয়গিরির মত সারমেয় জলাতঙ্ক।
ওদের হাত ধরে জমে রত্ন ভান্ডারের পাহাড়।
বেশ আছি।
সময় অসুস্থ তাতে কি।
নপুংসকরা পুরুষ নয় বলে
এই সময় অন্ধকারে গা ঢেকে
দিব্যি সময় পার করি।
বেশ আছি।
পিন্টু কর্মকার
ঈশ্বর সব জানে
যারা একজনকে ক্ষমতার তেল দিয়ে-
আরেকজনের দিকে ছোড়ে অনুরণিত হিংসার আগুন,
তারা শব্দের কৌশলে ঢাকতে চায় আত্ম-ত্রুটি,
অমানুষও তো মানুষ হয়ে যায় সমর্থনে ;
কিন্ত ঈশ্বর সব জানে…
ঋতম পাল
দশপ্রহরণধারিনী
‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’,
মা আসবে বলে।
নীল আকাশে মেঘেরা খেলে,
আগমনীর সুরে, তালে।
মাঠে, মাঠে কাশের দোলায়,
গাছে, গাছে শিউলির মেলায়;
ঘরের মেয়ে উমা আসে পাঁচটি দিনের তরে,
অসহায়ের সহায় হও মা;
আলো করে থাকো তুমি প্রতিটা ঘরে ঘরে।
নানা রূপে এসো তুমি, তুমি যে সিংহবাহিনী,
দশটি হাতে দূর করো মা সকল অন্ধকার;
তুমি যে দশপ্রহরণধারিনী।
প্রদীপ কুণ্ডু
দিন পাল্টায়
বাদল মেঘ ওই মাদল বাজায়
কাঁপে দক্ষিণ কোণ,
আজ বুঝি তার মন খারাপে
ভিজবে সারাক্ষণ।
টাপুর টুপুর বৃষ্টি ফোঁটায়
আবেগ ঝরে তার,
ক্লান্তি ভরা দুঃখের দিনে
সঙ্গী নদীর পাড়।
ঝাপসা চোখে জমাট বাঁধে
অতীত দুঃখ শোক,
বিচার বুদ্ধি নষ্ট করে
মরীচিকার ঝোঁক।
মরণ ফাঁদে লাফ দেয় তাই
পিপীলিকার পাল,
শাওন শেষে ভুলে যায় মন
আসে শরৎকাল।
সুনন্দ অধিকারী
কাঠের প্যাঁচা
এমন দিনে তোমার জন্য
প্যাঁচা কিনেছিলাম একটা।
মেঘভারে পূর্ণ আকাশ সেদিনও
ঠিক এমনই পোয়াতি ছিল।
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালে আজ দেখছি
সেই দিনটা ‘রথযাত্রা’ ছিল।
সে ছিল কাঠের প্যাঁচা,
তাই তার পক্ষে অসম্ভব ছিল উড়াল দেওয়া
অথচ কী অদ্ভুত
সেদিন সে উড়েছিল…!
কিন্তু কালের যাত্রায় একদা চকচকে যা!
অজান্তে কখন মলিন হয়ে যায় তা —
আবার ঝকমকে হয়ে ওঠে
হঠাৎই মলিন হয়ে যাওয়া জিনিস কোনো।
ক্যালেন্ডার বলছে আজও ঠিক এমনই সে’দিন;
বাদলধারা কিছু বলে যেতে চাইছে কানে কানে..!
ওদিকে জগন্নাথও চলেছেন মাসির বাড়ি…
সুদ পেতে কিছু; আসল অতিরিক্ত।
সাধারণত খোঁজে যা অতি সাধারণ জীবনও কোনো।
দেবাশিস ঘোষ
মিহি রোদ ও জলের গতি বিষয়ে
মিহি রোদ উদযাপন আমাদের একান্ত সম্পদ
অথচ বাঁধানো ছবির অন্যপিঠে
জলের মতো চলাচল করে স্বর্গ ও নরক
কারণ সূর্য আর যাবতীয় গ্রহ বা নক্ষত্র
স্থির নয় কেউ
বিস্ময়ের অন্য নাম জীবনের ঝিঁকিয়ে ওঠা রূপ
তুমি ঠিক ততটাই তুমি যতটা চলতে পারে জল
মিহি রোদ, কমলা রঙের কিছু মুহূর্ত
এবং টুংটাং হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ
কতদূর চলে যেতে পারে! কতদূর!
পুরোনো চিঠির ঝাঁপি, হলদেটে খবর কাগজ
এদের বুকের ভিতর শব্দ বাজে তিরতির
একসময় রোদ্দুর ম্লান হয়ে আসে
চোখ আর চেনেনা আলোর ফোঁয়ারা
চলে যায় জল, উন্মোচনে
মিহি রোদ ফ্যাকাশে এখন
হুহু হাওয়া ছুটে আসে
ধুলোবালি ধুলোবালি, ছোপ ধরা অ্যলবাম
উজ্জ্বলতা শেষ হওয়া নিভন্ত অক্ষর
মাথার ওপর রোজ সূর্য ঘুরে যায়
রোকসানা রহমান
হাতের মুঠোয় একটা আকাশ
তুমি করজোড়ে প্রার্থনা কর নারীর দেহে গোলাপের সৌরভ
আর চোখের আবর্তে রচনা কর কাল্পনিক প্রার্থনার ইতিহাস।
তুমি পঞ্চইন্দ্রিয়ের সীমানা অতিক্রম করে মিলিত হও রজনীর সাথে।
আর তখনই সূর্য্য উন্মুক্ত করে দেয় দিনের আলো
লালসালু কোটরে জড়িয়ে।
আমি শুনি তোমার ককণ্ঠস্বর
আকাশের ছায়াপথ থেকে নেমে আসা এক বৃক্ষ,
মৃত্তিকা দিয়ে গড়া সে বৃক্ষের উপরে অধিষ্ঠিত সাধনার পোশাক
সেখানে আগুনের উত্তাপ।
অনায়াসে গেঁথে নিয়েছো হাতের মুঠোয়
একটা আকাশ।
ডালিয়া মুখার্জী
রাত্রি আর তুমি
মেঘলা সকালে তোমায় খুঁজি,
কদম ফুলের গন্ধে,
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
বলতেই পারো হৃদয়ের উত্তাপে।
নিঃশব্দে বয়ে চলা সময়ের চোরাবালির ফাঁকে
রাতের আকাশে পেয়েও
ছুঁইনি তোমায়
যদি অচ্ছুৎ হও।
বৃষ্টি ভেজা শরীর নেয়নি অধরের মধু সিঞ্চিত ভালোবাসা,
যদি অচ্ছুৎ হও।
তবে রাতের আকাশে
দিয়েছি চিঠি,
স্নিগ্ধ প্রলেপে দুহাত ভরে
দিও গন্ধ গোলাপের চুম্বন,
বিনিময়ে সর্বস্ব আমার।
দীপান্বিতা রায় সরকার
রোদের খবর
পাখির চোখ এফোঁড় ওফোঁড়
কোথায় সে ধ্রুবক বাণ?
সে বোধ আর জাগলো কোথায়!
যেখানে সব আয়ুষ্মান।
এই যে ভীষণ ক্রান্তিকালে,
ফুরায় আয়ু ঘনায় ঘুম।
বরফ কঠিন জমাট ঘৃণায়
যুগলবন্দী এ মরসুম।
তোমার কখন সময় হবে?
রোদ লেফাফায় খবর দাও
আমাদের শৈত্য শহর
প্রবল শীতে কম্পমান।
আমারা শুধুই ক্ষয় দেখেছি,
ঘুণ পোকাদের ঘর দেখেছি বৃক্ষমূলে,
শুদ্ধ সহজ, আবার কবে? নতুন করে
সবুজ পাতার উপত্যকা আমার হবে?
গোলাম কবির
পড় মানুষ, মানুষকে
পড় মানুষ, মানুষকে!
খুঁজে দ্যাখো তার ভেতরে
লুকিয়ে থাকা মনুষ্যত্বকে!
পর্যবেক্ষণ করতে থাকো তার ভেতরের
মান অভিমান, হিংসা বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা
এবং প্রেম ও ভালোবাসা!
পড় মানুষ, মানুষকে!
পড়তে থাকো মানুষের ভেতরের
মানুষটা কাঁদে কীনা অন্যের দুঃখে,
তার হৃদয় ত্রয়োদশী জ্যোৎস্না রাতের
মতো স্নিগ্ধ কোমল হাসিতে ভরে
ওঠে কীনা অন্যের সুখ দেখে!
পড় মানুষ, মানুষকে!
আমৃত্যু পড়তে থাকো!
পড়তে থাকো তার ভেতরে
কতোটুকু মানুষ আর কতোটুকু পশুত্ব
সুনিপুণতায় লুকিয়ে রাখতে পারে
অথবা তার ভেতরে আদৌ কোনো
মানুষের হৃদয় আছে নাকি নিকৃষ্ট জীব
বাস করে যার হৃদয় বলতে কিছু নেই!
বলতে গেলে পৃথিবীতে সবকিছুই সহজ
জলের মতো কেবল মানুষ ছাড়া! আহ্!
প্যাপিরাসের বুকে লেখা প্রাচীন মানুষদের
লেখারও পাঠোদ্ধার এখন সহজ হয়ে গেছে
বিশেষজ্ঞ মানুষের কাছে, কেবল মানুষের হৃদয়ই দূর্বোধ্য থেকে গেলো মানুষের কাছে!
গীতা চক্রবর্তী
ব্যথার মর্মরে
সেই উৎকণ্ঠার ভোর হবার অপেক্ষা পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো ,
কোথায় যেন ভাগ হলো প্রথমে সব পেয়ে গেছি মনে করে রেডিও শোনা ছেড়ে ই দিলে।
আগের মতো করে ভাবছে কেন?
মাঝের যে দীর্ঘ সময় তুমি ভীষণই ব্যস্ত হয়ে ছিলে,
কত জল বয়ে গেছে অন্তঃসলিলা দিয়ে,
যুদ্ধের আঁচ এসে লেগেছে অপরাহ্নের আলোয় মাখা মেহগনির গায়ে।
বুঝে না বুঝে অনেক ব্যঙ্গের উপমায় খোদাই করে দিলে তার গায়ে।
কতটুকুই বোঝো জীবনের একপাশে থেকে অন্যদিক কি একসাথে দেখা যায় বলো,
পৃথিবী যে গোল।
তাকে ঘুরে দেখতে আমাদের আর থাকা হয় না।
তার আগেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাই,
মাঝখানে রেখে যাই শুনতে না চাওয়া বিষাদের গান, যেটা বারবার করে বাজিয়ে যাও।
বাকিটা তারামণ্ডল দেখার মতো মিথ্যার আকাশ।
তবুও আমরা সেসব পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ব্যথার মর্মরে।
🍂গল্প
বাঁচতে তো হবে
মিঠুন চক্রবর্তী
এক.
‘উফ্ আজ কানের পর্দা ফেটে যাবে দেখছি’ টেবিলে আমার চায়ের কাপটা নামাতে নামাতে বলল মিতা। দুপুরে একটা মিছিল বেরিয়েছিল, বিকেল হতে না হতে এখন আবার আর একটা মিছিল। সকালেই দাসপাড়ায় একটা ইয়াং ছেলে মার্ডার হয়ে গেছে। ছেলেটা পার্টি-টার্টি করত কিনা শুনিনি কোনওদিন। তবে আগের মিছিল এবং এখনকার মিছিল উভয়ের দাবী ছেলেটা তাদের দলের ছিল। পরিকল্পনা করে তাকে খুন করা হয়েছে। এই খুনের দায়ভার ছুঁড়ে দিচ্ছে এক দল অন্য দলের দিকে।যাইহোক, এসব এখন আমাদের তেমন আর নাড়া দেয় না। জানি দু’দিন এসব হবে তারপর সব থেমে যাবে। এই দু’দিন একটু বাইরে বেরনোটা ঝুঁকির আছে। পুলিশ, সংবাদ মাধ্যম, নানান কথা বার্তা। তারচেয়ে বাড়িতেই এই দুদিন বেশ নিরাপদ। বাজার পত্তর যা করা আছে দু’দিন গিন্নী ঠিক চালিয়ে নেবে। মেয়েটারও দু’দিন কলেজ যাওয়ার দরকার নেই।গরম চায়ে চুমুক দিয়ে মিতাকে বললাম, ‘শুনছো, রাস্তার দিকের জানালাটা বন্ধ করে দাও, চিৎকারটা একটু হলেও কম ঘরে ঢুকবে।
আজকাল হামেশায় আমাদের এই শহরে খুন, ধর্ষণ, দাদাগিরি হয়েই থাকে। বিশ্বাস করুন আর তেমন কোনও অসুবিধা হয় না। আসলে যে প্রেমের মধ্যে ডুবে থাকে সে একটু আঘাত পেলেই দুমড়ে-মুচড়ে যায়, আর যে ঘেন্নার মধ্যে থাকে তাকে কেউ ভালবেসে ডাকলে আশ্চর্য হয়। আমাদের এই শহরে এসব নিয়েই দিন চলে যায়। সন্ধে নেমেছে। বাইরের রাস্তা থেকে দ্রুতগামী সব গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে আসছে। আমার হাতে বেশ ক’য়েকটা বিজ্ঞাপনের ছবির অর্ডার জমা হয়ে ছিল। ক’দিনের মধ্যেই এঁকে দিতে হবে। এর থেকে বেশ কিছু রোজগার হয়, আর জীবনবীমার গোল্ড মেডেলিস্ট এজেন্ট হিসেবেও বেশ ভালোই ইনকাম করি। একবার তো চারচাকার ভুতও মাথায় চেপেছিল। পরে অনাবশ্যক ভেবে সে ভুত ঝেড়ে ফেলি। অবশ্য আন ম্যারেড লাইফে আঁকা নিয়ে খুব স্বপ্ন দেখতাম। ভ্যান্ গগ, রামকিঙ্কর না হলেও একটু বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছে মনে পুষে রেখেছিলাম। সে ইচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। এখন বাড়তি কিছু রোজগারের জন্য বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকি। এই দু’দিনে কাজ অনেকটা এগিয়ে রাখা যাবে ভেবে একটা ছবি নিয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ ঝিমলির ডাকে মাথা তুলে চেয়ে দেখি, ঝিমলি ভেজানো দরজা ঠেলে আমার রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে অ্যানড্রয়েড মোবাইলটা। বললাম, ‘বল্, কী বলবি?’
‘বাবা, দেখো খবরে বেরিয়েছে, ছেলেটার ছবিও দিয়েছে।’ শুকনো মুখে কথাগুলো বলতে বলতে ঝিমলি আমার কাছে এগিয়ে এসে মোবাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে ই-নিউজে বেরনো একটা ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল, ‘চিনতে পারছ?’
‘হ্যাঁ। মুখটা তো খুব চেনা চেনা…’
‘সেই দাসপাড়ার একটা গলিতে আমাকে যখন দু’টো নোংরা ছেলে ইভটিজিং করছিল তখন তো এই শ্যামলদা-ই প্রতিবাদ করে ওদের তাড়িয়ে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।’
‘মনে পড়েছে রে, আমাদের বাড়িতে এসে আমার ড্রইং রুমে ঢুকে আমার আঁকা ক’য়েকটা ছবি দেখে বলেছিল, আমিও ছবি আঁকতে ভালবাসি।’
‘হ্যাঁ বাবা, তুমি ওকে একটা ক্যানভাস আর রংগুলো দিয়ে বলেছিলে, একটা ছবি আঁকতে ‘
‘সেই ছবি আমি আজও আমার ফাইলে যত্ন করে রেখেছি। লাল, হলুদ আর কালো রঙে কী আশ্চর্য এক ছবি। যে ছবির প্রতিটি রেখা প্রতিটি রঙের আঁচড় প্রতিবাদের কথা বলে, আলোর কথা বলে।’
সন্ধ্যা ছাড়িয়ে এখন রাত্রি নেমেছে। তবু ঘরে বাইরে অজস্র চোখ ধাঁধানো আলোয় বোঝার উপায় নেই। বাইরে অন্য দিনের তুলনায় লোকাল লোকের সংখ্যা একটু কম হলেও অন্য দিনের মতোই নিয়ম মাফিক মানুষ আর যন্ত্রের হুল্লোড়। আমি ছেলেটার ছবি দেখে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেও, মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ঝিমলিকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলাম, ‘চিনিস না তুই ওই ছেলেটাকে, আমাদের বাড়িতে ও কখনও আসেনি।’
ঝিমলি কিছুটা হতচকিত হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘যা, তোর মাকে খাবার বাড়তে বল। এমন রোজ কত হবে। ওসব নিয়ে ভাবিস না।’
দুই.
‘টি কালচার অ্যান্ড স্ন্যাকস্’ -এর বাইরেটা বাগানের মতো সাজানো। সিমেন্ট দিয়েই বানানো গাছের গুঁড়ির মতো চেয়ার – টেবিল। নতুন কোনও ক্লায়েন্ট পেলে এখানেই নিয়ে এসে বসাই। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বোঝাই জীবনবিমার প্রয়োজনীয়তা। আজ বেশ টাকাওয়ালা এক লোককে পেয়েছি। যদি কোনওভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটা বড়ো অঙ্কের পলিসি করাতে পারি, তাহলে এই সকালটাতে মন একদম ফুরফুরে হয়ে যাবে। যাইহোক, চেষ্টা করা যাক। ঘন্টা দেড়েক বকবক করার পর মিস্টার ব্যানার্জী পরের মাসে একটা পলিসি করবেন বলে রাখলেন। এমন অনেকেই বলেন, এর মধ্যে কেউ কেউ করেন আবার কেউ কেউ করেন না। তবুও, এখন বেশ কিছুদিন রাস্তায় দেখা হলে চা টা খাইয়ে একটু খাতির যত্ন করতে হবে। একটা পলিসি করিয়ে নিতে পারলেই সব খরচ লাভ সমেত পকেটে ঢুকে পড়বে। চায়ের বিলটা মিটিয়ে রাস্তায় পা দিলাম। আজ রোদটা খুব চড়া। সকাল দশটাতেই মাথা ঝিমঝিম করছে। কাল বাড়িতে গিন্নীর নারায়ণ পুজোর ব্যাপার আছে। গিন্নীর করে দেওয়া ফর্দ অনুযায়ী কিছু জিনিস কিনে বাড়ি ফিরতে হবে। দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে বাম দিকের একটা দেয়ালে চোখে পড়ল ভোটের দেয়াল লিখন। সামনেই তো ভোট।দেওয়ালে বড়ো করে ক’দিন আগেই খুন হয়ে যাওয়া সেই ছেলেটার ছবি। তার ঠিক নীচে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘আমাদের দলের একনিষ্ঠ, পরোপকারী, প্রতিবাদী যুবক শ্যামল রায়ের খুনের প্রতিবাদে গাছ চিহ্নে ভোট দিয়ে আমাদের প্রার্থী অরুন সেন-কে বিপুল ভোটে জয়ী করুন। যাইহোক এই তল্লাটে একটাও গাছ না থাকলেও গাছের ছবি দেখলাম। এখান থেকে কয়েকপা এগিয়েই ডান দিকের একটা দেওয়াল দেখে আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম ওই একই কথা শুধু দল, চিহ্ন আর প্রার্থী আলাদা। আচ্ছা, ছেলেটার খুনি কী গ্রেপ্তার হয়েছে?’ নিজের মনেই প্রশ্নটা উঁকি মারল। নাহ্, হয়নি, হলে তো নিশ্চয় জানতে পারতাম। ওসব এখন ধামাচাপা পড়ে গেছে। দোকানে জিনিসপত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি ফিরছি এমন সময় চার পাঁচজন ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্য থেকে একজন খুব নরম গলায় বলল,’ কাকু ভাল আছেন?’
আমিও এক চিলতে হেসে ঘাড় নাড়িয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ বাবা খুব ভাল আছি।’
‘সামনেই তো ভোট কাকু, যদিও জানি আপনি আমাদেরই দেবেন, তবুও একটু মনে করিয়ে দিলাম আর কি…’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা আমি তো তোমাদেরই দিই। তোমরা তো জানো আমি মনে প্রাণে…’
তিন চার মিনিট ওদের সঙ্গে কথা বলে এগিয়ে যেতে লাগলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি প্রায় পৌঁছে গিয়েছি। রাস্তার দিকের ব্যালকনিতে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে ঝিমলি। হয়তো আমারই অপেক্ষায়।
এমন সময় আবার চার পাঁচজন ছেলে দেখলাম রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আমাকে দেখে আমার কাছে এসে সেই আগের ছেলেটার মতোই নরম সুরে বলল, ‘কাকু ভাল আছেন? আপনাদের বাড়িই যাচ্ছিলাম। এখানেই দেখা পেয়ে ভাল হল।’
তাদের সঙ্গেও দু’তিন মিনিট একই রকম কথোপকথন শেষে যখন বাড়ির দিকে এগোতে যাব হঠাৎ ঝিমলি ব্যালকনি থেকে চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা ওই দু’টো ছেলেই, ওই দু’টো…’
আমি কিছু না শোনার ভান করে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ঝিমলিকে ডাকলাম।
‘বাবা ওদের মধ্যে নীল জামা আর সবুজ টি শার্ট পরা ছেলে দু’টোই আমাকে সেদিন…’
‘কে বলেছে তোকে মনে রাখতে?’ গর্জে উঠলাম আমি। ঝিমলি চুপ করে গেল। আমি মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে ভাবলাম, ওই ছেলে দুটো ভাগ্যিস, ব্যালকনিতে ওকে দেখেনি।
বাড়িতে আজ পুজো। একটু পরেই পুরোহিত মশায় এসে পড়বেন। গিন্নী সকাল সাতটাতেই বাথরুমে স্নান করতে ঢুকে পড়েছে। ঝিমলি তার পড়ার ঘরে। এখন ঝিমলি মাঝে মধ্যেই ওর পড়ার রুমে দরজা দিয়ে বসে থাকে। বাইরে বেরলে দেখি চোখ লাল হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলে, পড়ছিলাম। এমন সময় বাইরে একটা চিৎকার শুনে কৌতুহলে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি, যে বোবা ছেলেটাক প্রায়ই রাস্তায় এখানে সেখানে ধুলো মাখা গায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম তাকে ক’য়েকজন ছেলে মিলে খুব পেটাচ্ছে। ছেলেগুলোর মধ্যে সেই দু’টো ছেলেও আছে। একটু দাঁড়িয়ে সবার চাপা আলোচনা শুনে বুঝলাম ওই বোবা ছেলেটা নাকি ওদের দু’জনের হাত ধরে জামা ধরে টেনে বিরক্ত করছিল।ছেলেটা কিছু বোঝাতে চাইছিল পথচলতি অন্যান্য লোকেদের। পুরোহিত মশায় এসে পড়তেই তাঁকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম। পুজো শুরু হয়েছে। পুরো ঘর ধুপের গন্ধ আর মন্ত্রোচ্চারণে ভরে গেছে। বাইরের চিৎকারটা বোবা ছেলেটার মতোই আস্তে আস্তে স্তব্ধ হয়ে গেছে।পুজো শেষ হলে পুরোহিত মশায়কে পিছনের দরজা দেখিয়ে বললাম ‘এই রাস্তা দিয়ে চুপিচুপি বাড়ি চলে যান, বাঁচতে তো হবে।’ 🍁
🍁গল্প
ফাগুন বিকেলে
জয়ন্ত দত্ত
অফিস ফেরার পথে প্রদীপ্ত অফিস গেটের শিমুল গাছটার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। কাছ থেকে গাছটিকে তার খুব চেনা মনে হয়। কিন্তু অফিসে তার কেবিনের নীলাভ কাঁচের ভিতর থেকে সম্পূর্ণ গাছটা যেন ভীষণ রকম অচেনা। মাথা ভর্তি একঝাঁক রাঙা ফুল। এই ফাগুনের বিকেলে একটু হালকা হাওয়া দিলেই ঝর ঝর করে মোটা ফুল গুলো মাটির মধ্যে আছড়ে পড়ে। একটা ফুল হাতে নিয়ে প্রদীপ্ত অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করল। কি সুন্দর পাপড়িগুলো। এতো রঙ কোথায় পায় এরা? প্রদীপ্তর মনটা আজ ভীষণ রকম খারাপ। আজ তিনদিন হয়ে গেল ইন্দ্রানীর সঙ্গে কোনও কথা নেই।
কেন বলবে কথা?
কথায় কথায় অশান্তি ইন্দ্রানীর এ এক বদ অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথায় কিছু না অফিস কামাই করে তার সঙ্গে নাকি রবীন্দ্রভারতীর ক্যাম্পাসে রং খেলতে যেতে হবে! বাঙালির এ এক আদিখ্যেতা! একমাস আগে থেকে রং মেখে সং সেজে ভুত হচ্ছে। আর ঝামেলা হচ্ছে এসব কর্পোরেট সেক্টরের সংসার গুলোতে! সে যে যাই করুক, অন্তত ইন্দ্রানীর তো বোঝা উচিত যে প্রদীপ্ত ইচ্ছে করলেই ছুটি নিতে পারে না। তাও যদি কোম্পানী শোনে এই কারণ তাহলে তো ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে!
এসব আর ইন্দ্রানী বুঝে কি করবে! এখনও তো পড়াশোনার জগতে আছে তাই বুঝতে পারছে না। রং মেখে সং সেজে বন্ধুদের সঙ্গে গায়ে ঢলে আবার ফটো আপলোড করা হয়েছে! যত্ত সব নাটক। ওই বাউন্ডুলে হার হাভাতে ছ্যাঁচড়াগুলোকে দেখলে আরও বেশি গা পিত্তি জ্বালা করে! ওদের সঙ্গে মিশেই ও-আরও গোল্লায় যাচ্ছে। যাকগে যাক! আদরে মানুষ বাঁদর হয়। এই সাত বছরে তাকে অনেক বোঝানো হয়েছে। আর নয়। এবার ঠেকে বুঝুক। এর নাম প্রদীপ্ত। কথা বলবে না তো বলবেই না। দোষ তো সে করেনি। বরং ও দোষ করে উল্টো রাগ দেখাচ্ছে। এই তিনদিনে একটা মেসেজ পর্যন্ত করেনি! যাকগে যাক। রাত পোহালেই দোল। এই দোলে প্রদীপ্ত মরে গেলেও আর রং খেলবে না! অন্তত ইন্দ্রানীর থেকে তো রং নেবেই না। কোনও মতেই না!
ভাবতে ভাবতেই মেসেঞ্জারে টুং করে মেসেজ এলো প্রীতির
“Happy Holi In Advance”
মাস দু’য়েক হল প্রীতির সঙ্গে প্রদীপ্তর পরিচয়। প্রথমটা ফেসবুক দিয়ে শুরু হলেও বিষয় এখন হোয়াটসঅ্যাপের দোর গোড়ায়। মেয়েটি একটু ন্যাকা হলেও মানুষ হিসাবে মন্দ নয়। বেশ তো হয় এই দোলে যদি ওর হাত থেকে রং নেওয়া যায়। কেনও যাবে না? আলবাত যাবে। ইন্দ্রাণী যদি প্রথম রং অন্য কারোর হাত থেকে নিতে পারে তাহলে সে কেন পারবে না?
প্রীতির বাড়ি প্রদীপ্তর অফিসের কাছেই। পায়ে হাঁটা মাত্র পনের মিনিটের পথ। খেজুরে আলাপের প্রথম প্রথম প্রদীপ্তকে প্রীতি ক’য়েকবার তাঁর বাড়িতে আসার কথা বলেছিল। ফাঁকা বাড়িতে প্রদীপ্তকে প্রীতি কেন ডেকেছে সেকথা প্রদীপ্তর অজানা নয়। কিন্তু বিষয় অন্য জায়গায়। এই সাতবছরে ইন্দ্রাণী ছাড়া প্রদীপ্ত একঘরে নগ্ন অবস্থায় আর অন্য কারো সাথে কাটায়নি।
কিন্তু আজ? আজ কাটালে ক্ষতি কি? তার ইচ্ছের কতটুকু দাম দেয় ইন্দ্রাণী? তার সুবিধা অসুবিধা কতটুকু বোঝে? ছেলেমানুষি বলে তার জেদ আর কতদিন সহ্য করবে প্রদীপ্ত? সেও তো একটা মানুষ। তারও তো ইচ্ছে হয় তার মতো করে শান্ত হাতে মাথায় কেউ বিলি কেটে দিক। ইন্দ্রাণীকে প্রদীপ্তর হঠাৎ খুব উগ্র বলে মনে হলো। বিছানায় বড্ড ছটফট করে আজকাল। ছটফটানি সবসময় ভাল লাগেনা । কখনোও কখনও মন চায় একটু শান্তির আশ্রয়।
এই মেঘলা ফাগুনের বিকেলে প্রদীপ্তর সারা শরীরে কেমন একটা নেশার ঢেউ বয়ে গেল। মনে হল আর পনেরো মিনিট হাঁটলেই সে খুঁজে পাবে একফালি শান্তির আশ্রয়।
ভাবা মাত্রই কাজ। শুধু একটা ফোন কল। প্রীতির সম্মতি। তারপরেই পনের মিনিটের হাঁটা পথ। পথটা প্রদীপ্তর অফিসের পিছন দিক থেকে অনেকটা ইউ টার্নের মতো। অফিসের পিছনে এতো নিটোল একটা পুকুর আছে এর আগে কখনো প্রদীপ্ত জানতই না। পুকুর ঘেরা সারি সারি শিমুল গাছ। চারিদিকে ঘাসে ঘেরা পুকুরের কালচে জলে লাল শিমুলে ভরে আছে। প্রদীপ্তর বুটের তলায় দু’চারটে শিমুল থেঁতলে গেল। প্রদীপ্ত সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। এ যেন এক দ্বিধায় ভরা অভিসার। বার বার ইন্দ্রানীর মুখটা প্রদীপ্তর চোখে ভেসে উঠল। সামান্য অন্যায়ের সাজা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না ওর জন্য? সাজা কে কাকে দিচ্ছে? প্রদীপ্ত ইন্দ্রাণীকে? নাকি প্রদীপ্ত নিজেকে? কে করবে এর বিচার? কি হবে এসব ভেবে?
প্রদীপ্ত এগিয়ে চলল প্রীতির সন্ধানে। শেষে নেতাজী সংঘের খেলার মাঠ পেরিয়ে প্রথম দুটো বাড়ির পরে তিনতলা বাড়িটার একদম উপর তলায় গটগট করে উঠে গেল প্রদীপ্ত। একটা হাফ প্যান্ট পড়া ফর্সা রঙের মেয়ে দরজা খুলে দিল-
-ঘরে এসো।
এই তবে প্রীতি! ছিপছিপে গড়ন। প্রত্যক্ষ দর্শনের সঙ্গে ছবির সামান্য একটু মিল। বাকি সবটাই অমিল। ফটোগুলো নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কৌশলে এডিট করা। ঘরটার মধ্যে বেশ একটা আলো আঁধারি ব্যাপার আছে। এসিটা সম্ভবত একটু আগে বাড়ানো হয়েছে। নরম গদির ওপর মখমলে চাদর। সম্পূর্ণ ঘরটা একটা অদ্ভুত সুগন্ধিতে ভরে আছে। প্রীতি যেন সম্পূর্ণ সমাগমে বাসর সাজিয়ে বসেছে।
ওয়াশ রুমে গিয়ে প্রদীপ্ত সামান্য একটু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসল। নাটকীয় ভঙ্গিতে এক গ্লাস সরবত প্রদীপ্তর মুখের সামনে ধরে প্রীতি বলল,
‘এই নিন স্যর।’
প্রদীপ্ত অনিচ্ছাকৃত ভাবে দাঁতটা একটু বের করল। যেন প্রীতির এই অসহ্য রকমের ভঙ্গিমা প্রদীপ্তর ভীষণ ভাল লেগেছে। ইন্দ্রাণী প্রীতির চেয়ে অনেক কম স্মার্ট। কিন্তু এমন ন্যাকামি সে কোনও দিনই করে না। এরপর টেবিলে গ্লাসটা রেখে প্রীতি একেবারে প্রদীপ্তর কাছে ঘেঁষে বসল।
-‘বলো এবার’।
এই এক অসহ্য কথা। যার কিছু বলার নেই, সেই বলে- ‘বলো এবার’। একথা ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে শুনে শুনে প্রদীপ্তর কান পচে গেছে। চিরাচরিত প্রথা মেনে প্রদীপ্তও বলল,
‘তুমিই বলো। আমি শুনি।’
নরম বাঁশকাঠির মতো আঙুল প্রদীপ্তর বুকে বোলাতে বোলাতে প্রীতি হিম গলায় বলল,
‘কি শুনতে চাও তুমি?’
বলতে বলতে একটা বোতাম, দু’টো বোতাম; খপাত করে প্রীতির হাতটা প্রদীপ্ত চেপে ধরল।
দাঁড়াও। এতো তাড়া কীসের?’
সত্যি কি তাড়া প্রদীপ্তর নেই? তাকে তো বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু কিসের জন্য আটকালো সেটা প্রদীপ্ত নিজেও জানেনা। প্রীতি বেশ পাকা। এই ঘরটায় যে হামেশাই নিত্য নতুন বীর্যপাত হয়, সেকথা বুঝতে প্রদীপ্তর বাকি রইল না। প্রদীপ্তর বুকটা হুহু করে উঠল। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ইন্দ্রানীকে। সে এখন কোথায়? এই সময় তো ওর উল্টোডাঙায় টিউশন থাকার কথা। বিকেলে কিছু খেয়েছে মেয়েটা? কি সব হিজিবিজি ভাবছে প্রদীপ্ত। পরিবেশটা অসহ্য লাগলো। মনে হলো সে একটা বদ্ধ গুহায় আটকে গেছে। এখান থেকে আর বেড়ানোর পথ নেই। ঘরটা কেমন গুমোট হয়ে আসছে। গন্ধটা আর ভালো লাগছে না। এখন পালাবে কি করে? প্রীতি মনে মনে কি ভাববে? ছি! ছি!
প্রদীপ্তর পৌরষে আঘাত লাগলো। সে অনেকটা জোর করেই প্রীতির বুকটা খামছে ধরল। তারপর বিছানায় ঠেসে ধরে ওর মুখটা দুহাতে চেপে ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট ঢোকাতেই বিকট একটা স্টামাক এম্পটির গন্ধে প্রদীপ্তর গা টা গুলিয়ে উঠলো। মুখের গন্ধ ঘরের আতরকেও হার মানালো। প্রদীপ্ত উঠে বসলো। অস্থির করছে তার শরীরটা। এর আগে ইন্দ্রানীর মুখে বহুবার স্টমাক এম্পটির গন্ধ পেয়েছে। কই সে গন্ধ তো এতো খারাপ নয়। বরং অনেক ভালো। ইন্দ্রানীর গায়েও একটা চেনা গন্ধ আছে। সেই গন্ধটাকে প্রদীপ্ত প্রীতির শরীরে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো।কোথায় সেই শরীর? কোথায় সেই ফিলিংস? প্রদীপ্তর মন হঠাৎ ভয়, লজ্জা, অনুশোচনায় ভরে উঠল। প্রীতি হাত বাড়িয়ে গদির তলা থেকে কন্ডোমের প্যাকেট টা প্রদীপ্তর হাতে গুঁজে দিলো। কিন্তু প্রদীপ্ত কিসে পড়াবে এই বস্তুটি? কিছুই তো দাঁড়ায় নি! নিছক এই অভিনয়ে অন্তর থেকে এখনো কোনো ডাক আসেনি। আর আসবে বলেও মনে হয়না।প্রদীপ্ত মনে মনে ভাবলো এই সাতবছরে ইন্দ্রানী তার অভ্যাস হয়ে গেছে। আগে এভাবে কখনো নিজেকে বাজিয়ে দেখা হয়নি। তাই প্রদীপ্ত জানতোনা যে ওর নিজের বলে আর কিছু নেই। যা ছিল, যতটুকু ছিল তা সবটাই আজ ইমদ্রানীর হয়ে গেছে। তাই এই মুহূর্তে তার এখান থেকে চলে যাওয়ায় শ্রেয়। সে একই সাথে তিন জনের সাথে অন্যায় করছে। প্রীতি, ইন্দ্রানী এবং অবশ্যই নিজের সাথেও।
প্রদীপ্ত বিছানা ছেড়ে সটান উঠে দাঁড়াল। তারপর প্রীতিকে সংশয়ের সাথে বলল,
-সরি! আমাকে এবার বাড়ি যেতে হবে।
-হঠাৎ কি হল? এনি প্রবলেম?
– আসলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে বাড়িতে একটা ইমপর্টেন্ট কাজ আছে। হঠাৎ মনে পড়লো।
– ওহ্ তাই বলি, তোমাকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন! আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো ক্লান্ত। না না ইটস্ ওকে। তুমি সাবধানে যাও। আবার অন্য কোনো দিন দেখা হবে।
আর কখনো এই নগ্ন ঘরে প্রীতির সাথে প্রদীপ্তর দেখা হবে না একথা প্রদীপ্ত ঢের জানে। তবুও প্রীতির এই ব্যবহারে প্রদীপ্ত বেশ খুশি হলো। আর যাই হোক মানুষটা সত্যিই ভালো। বেরোনোর সময় প্রদীপ্ত প্রীতিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শেষ উষ্ণতা টুকু দিলো।
পথে বেড়িয়ে প্রদীপ্ত দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিলো। সে সত্যিই ইন্দ্রানী কে মনে প্রাণে ভালোবাসে। ইন্দ্রানীও তাকে কম কিছু বাসেনা। মেয়েটা নিছক ছেলেমানুষ। একটু পাগলের মতো সময় চায়। সত্যি বলতে প্রদীপ্ত প্রয়োজনের থেকে মাঝে মাঝে একটু বেশিই ব্যস্ততা দেখায়। ইন্দ্রানী না হয় ছেলেমানুষ। কিন্তু চার বছরের বড়ো হয়ে প্রদীপ্ত এটা কি করলো। আজ তার কি মতিভ্রম হল? পাগল একটা! প্রদীপ্ত নিজের মাথায় নিজেই একটা চাঁটি মেরে সরাসরি ইন্দ্রানীকে ফোন করল।
সামান্য একটু বাজতেই ওপার থেকে ভারি গলায়
– ” হ্যালো”।
যেন, চাতকের মতো ওপার থেকে কেউ একজন অধীর আগ্রহে এই ফোনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
প্রদীপ্ত: আমি কোনো অন্যায় করলে তুমি আমাকে যাই শাস্তি দাও না কেন, আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে নাতো ইন্দ্র?
ইন্দ্রানী: তিন দিন কথা না বলে পাগল হয়ে গেছ?
প্রদীপ্ত: পাগল না, বলো নোংরা হয়ে গেছি।
ইন্দ্রানী: বেশ করেছ। যাই করোনা কেন, এইযে আমাকে ফোন করেছ, সব কিছু এই মুহূর্ত থেকে সাফ হয়ে গেছে। আরে বাবা নোংরা হোক আর পরিস্কার,মানুষটাতো আমার।
প্রদীপ্ত: জানতে চাইবেনা? কি নোংরামি করেছি?
ইন্দ্রানী: সম্পর্ক কোনো কৈফিয়তে চলেনা বাবু। সম্পর্ক চলে বিশ্বাস আর ভালোবাসায়।
প্রদীপ্তর বুকটা গর্বে ভরে উঠলো। যাকে ছেলেমানুষ বলে নিজের ম্যাচিওরিটির বড়াই করতো, আজ সেই মেয়েটিই তার কান ধরে সম্পর্কের কঠিন কথাটা শিখিয়ে দিলো। প্রদীপ্তকে ফোনের ওপার থেকে অনেক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে ইন্দ্রানী বলে উঠল,
– কি হলো? আর কিছু বলবে না?
প্রদীপ্ত: ইন্দ্র, আমাকে রং দেবেনা?
ইন্দ্রানী: নিশ্চয়ই দেব। কাল সকালেই তোমার বাড়ি যাবো।
প্রদীপ্ত: কাল নয় আজ, এখুনি।
ইন্দ্রানী: তুমি এখন কোথায়?
প্রদীপ্ত: সেক্টর ফাইভ কলেজ মোড়।
ইন্দ্রানী: দাঁড়াও আমি পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
প্রদীপ্ত: জলদি এসো। আমি দাঁড়িয়ে আছি।
আর হ্যাঁ। একটু রাঙা দেখে রং এনো। রংটা যেন শিমুলের মতো হয়। রাঙা….
ইন্দ্রানী ফোনটা ওপার থেকে কেটে দিল। প্রদীপ্ত অপেক্ষা রত প্রেমিকের মতো ভ্যাপারের হলুদ আলোর নীচে দাঁড়িয়ে রইলো। একটু পরেই ভালোবাসার মানুষ এসে তার দুগালে রাঙিয়ে দেবে শিমুল রঙা আবির। মনে পড়ে গেল তার প্রতিজ্ঞার কথা। সে চেয়েছিল এই বছরে ইন্দ্রানীর হাত থেকে কোনো মতেই আবির নেবেনা। প্রদীপ্ত মনে মনে মিচকি হেসে মাথাটা নিচু করে নিল। সল্টলেকের এই কর্পোরেট বিল্ডিং গুলোও আজ যেন কেমন প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে। দুর থেকে প্রদীপ্তর অফিসের কাছের শিমুল গাছটাকে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে আবছা হয়ে গেলেও মাথার লাল আভা টুকু নিখুঁত হাসিতে ভরিয়ে রেখেছে। এ যেন বিরাট কংক্রিটের মাঝে সাক্ষাত নন্দিনী।
ফুর ফুর করে হাওয়া বইছে। প্রদীপ্ত মিটি মিটি হাসছে আর কি যেন একটা ভাবছে। কি জানি!
প্রদীপ্ত হয়তো সেকথা নিজেও জানে না…🍁
🍁প্রবন্ধ
বিদ্যাসাগর
অভিজিৎ দত্ত
২০২০ সালে বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হল। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা কি অনুভব করতে পারবো-উনবিংশ শতকে যে সমস্ত মহাপুরুষ এই বঙ্গ দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও সমাজ সংস্কার করতে গিয়েছিলেন তারা কি নিদারুণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন?সমাজসংস্কার করতে গিয়ে তাদের কি বিরূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?লড়াইটা কিন্ত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে নয়,আমাদের দেশীয় কুসংস্কার, কু-প্রথা ও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে।বিদ্যাসাগর মহাশয়কে চেনা, জানা এত সহজ ব্যাপার নয় ।একজন মনীষীকে জানতে হলে ভাল করে তার কর্মকান্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে।বর্তমান প্রজন্মের অনেকে ভাল করে পাঠ্যপুস্তক পর্যন্ত পড়ে না, তারা রেফারেন্স বই কি পড়বে? অথচ এইসব মনীষীদের সম্পর্কে জানা খুবই দরকার। নিজেদের দেশের সভ্যতা,সংস্কৃতি সম্পর্কে ভাল করে না জানলে প্রকৃত দেশবাসী হয়ে উঠা যায় কি?আজকাল মাঝে-মধ্যেই সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ ইত্যাদি শব্দগুলো আলোচনায় ঘুরেফিরে বেড়ায়। কিন্ত এইসব বাদ এর মোকাবিলা কি করে করা যাবে সেগুলো বলা যায় কি?এর জন্যই দরকার মনীষীদের নিয়ে আলোচনা।এ ক কথায় মনীষীচর্চা। আমাদের দেশের সিনেমা,খেলা ইত্যাদি নিয়ে যেরূপ আবেগ তৈরি হতে দেখা যায়,মনীষীচর্চাই সেইরূপ আবেগ দেখা যায় না।এর মানে কি মনীষীদের নিয়ে আলোচনা করার দরকার নেই?তাঁরা ব্যাকডেটেড হয়ে গিয়েছেন? কিন্ত অতীতের মধ্যেই তো বর্তমানের বীজ পোঁতা থাকে আর বর্তমানের মধ্যেই ভবিষ্যতের। অতীত হচ্ছে গাছের শিকড়।কাজেই অতীতের ঘটনাবলী সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত না হলে ভবিষ্যত কি করে ভাল হবে?এইখানেই আসে মনীষীচর্চার গুরুত্ব। মনীষীদের নিয়ে যত চর্চা হবে তত তাঁদের জীবন কাহিনী ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আমরা পরিচিত হতে পারবো এবং ততোই দেশের প্রতি প্রগাড় প্রেম ও শ্রদ্ধার জন্ম নেবে।জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম স্বাভাবিকভাবেই অন্তরে জেগে উঠবে।কিন্ত এই দায়িত্ব নেবে কে?এক্ষেত্রে আমাদের সকলকেই দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন : বাড়িতে বাবা-মা,স্কুলে -শিক্ষক-শিক্ষিকা, ক্লাবের ক্ষেত্রে সভাপতি ও সম্পাদক, প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিরা।মনীষীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।ঘরে,ঘরে যে বর্ণপরিচয় ছাড়া আমাদের অক্ষর জ্ঞান হয় না,তার স্রষ্টা বিদ্যাসাগর মহাশয়।শুধু তাই নয় ,ইংরেজ আমলেও কি করে কি করে মাথা উঁচু করে চলা যায় তাও বিদ্যাসাগর দেখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। শিক্ষা বিস্তারই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল না,তিনি বিধবা মেয়েদের দুঃখ, যন্ত্রণা গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি ধর্ম বা ভগবান বিশ্বাস করতেন না কিন্ত বিধবাবিবাহের প্রয়োজনে ধর্মগ্রন্থ নিয়ে চর্চা করেছিলেন। পরাশর সংহিতার, সাহায্যে তৎকালীন ধর্মপ্রচারক ও সমাজপতিদের বিরুদ্ধে লড়ে বিধবাবিবাহ প্রর্বতন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে তাঁকে কি পরিমান চাপ বা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল তা এ প্রজন্ম অনুভব করতে পারবে না।এই কাজের জন্য তাঁর প্রাণ সংশয় পর্যন্ত ঘটতে চলেছিল। কিন্ত তিনি এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে শেষ না দেখে ছাড়তেন না ।বিদ্যাসাগর একটা জায়গাই বলেছিলেন বিধবা বিবাহ প্রর্বতন তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ।বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন-প্রাচীন ঋষির ন্যায় প্রতিভা ও প্রজ্ঞা, একজন ইংরেজ এর মত কর্মশক্তি, আর হৃদয় হচ্ছে বাঙালি মা এর অনুরূপ। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছিলেন, অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ছোট জিনিসকে বড় দেখায় কিন্ত বিদ্যাসাগরের জীবন চরিত বাদ দিয়ে অন্যদের কর্মকান্ড যদি বিচার করা হয় তাহলে তা শুধুই ছোট দেখাবে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-দয়া নহে,বিদ্যা নহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, অক্ষয় মনুষ্যত্বের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই মন্তব্য যথার্থ ও ঐতিহাসিক। জীবনের মূল্য আয়ুতে নহে, কল্যাণ কর্মে – শাস্ত্রের এই কথাটি যে কতটা সত্য বিদ্যাসাগরের জীবনে তা প্রতীয়মান হয়।অথচ বিদ্যাসাগর মহাশয় এর শেষ জীবন খুব কষ্টে কেটেছিল। তার মত মানুষের সঙ্গে যে অন্যদের মিল হবে না সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি শেষ জীবনে তার স্ত্রী,ছেলে,বাবা,মায়ের সাথে বনিবনা হতো না।তিনি নিজের ছেলেকে তাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছিলেন। এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর তীব্র মতবিরোধ হয় ও তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।তার নিজের জামাই সূর্যকুমার অধিকারীকে (যিনি মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন) কলেজ ফান্ডের তিন বা চার হাজার টাকা গরমিলের জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করেন ও বরখাস্ত করেন।বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনে এমন বহু ঘটনা আছে। এই মহৎ চরিত্রের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে কিভাবে ঘরে ও বাইরে সংগ্রাম করতে হয়।তিনি বলেছিলেন-এদেশের উদ্ধার হতে বহু বিলম্ব আছে। নতুন মানুষের চাষ করতে পারলে তবে এদেশের ভাল হবে।উক্তিটি যথার্থ। তাই বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্ম বার্ষিকীতে তার জীবন ও কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ ও দেশবাসীর জন্য কিছু ভাল কাজ করতে পারলে,তার আদর্শে চলতে পারলে, সেটাই হবে তার প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। 🍁
🍁অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক।
🍂কভার ডিজাইন : দেবব্রত সরকার
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
