Sasraya News

Thursday, May 15, 2025

Sasraya News, Sunday’s Literature Special | 6th April 2025, Issue 59 | সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ৬ এপ্রিল ২০২৫, সংখ্যা ৫৯

Listen

সম্পাদকীয় 

ম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে আজ একটু অন্য বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বসেছি। তার মুল কারণ এই আজকের দিনটি আমাদের এক বিশেষ আকর্ষণের দিন বলেই উল্লেখ। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই দিনটি আনন্দ উপভোগ করেছি। “রামায়ণ” -এর রামচন্দ্রের জন্ম তিথিকে ঘিরে আনন্দের উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। যদিও রাম নবমীর তাৎপর্য এবং ধর্মীয় গুরুত্ব বলতে গেলে বলা হয় যে, রাম নবমী হল সনাতন হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, যা প্রতি বছর চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে উদযাপিত হয়। এই দিনটি শ্রী রামচন্দ্রের জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়। শ্রী রামচন্দ্র, যে হিন্দু মহাকাব্য “রামায়ণ”-এর প্রধান চরিত্র, ছিলেন অযোধ্যার রাজা এবং ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। রাম নবমী শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি হিন্দু ধর্মের নীতির প্রতীকও।

 

 

শ্রী রামচন্দ্রের জন্ম কথা না বললে রাম নবমীর বিষয় সমন্ধে আমাদের অনেক কিছুই অজানা রয়ে যাবে।
রাম নবমী উৎসবের মূল ভিত্তি হল শ্রী রামচন্দ্রের জন্মের ঘটনা। “রামায়ণ”-এর উপন্যাস অনুযায়ী, রাজা দশরথের কনিষ্ঠ স্ত্রী কৌশল্যার গর্ভে শ্রী রামের জন্ম হয়। রাম ছিলেন রাজা দশরথের প্রথম পুত্র এবং তাঁর জন্মের মাধ্যমে অযোধ্যার রাজ্য আবার শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। ভগবান রাম চিরকাল সত্য, ন্যায়, এবং ধর্মের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তাঁর জন্মের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী থেকে দুষ্ট শক্তি বা অশুভ শক্তির উৎখাত করা এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা।

রাম নবমী উৎসবের মাহাত্ম উপলক্ষ্যে ধনী গরীব বলে কোনও উল্লেখ নেই। এখানে ‘সকলের তরে সকলে আমরা…’ এখানেই রামের আদর্শের কথা প্রকাশ করতে পারি। রাম নবমী উৎসবের ইতিহাস বহু পুরনো। পুরাণ ও মহাকাব্য অনুযায়ী, রাম নবমী প্রথমবার উদযাপিত হয়েছিল অযোধ্যায়, যেখানে শ্রী রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত উত্তর ভারত, রাম নবমী ব্যাপকভাবে পালন করা হয়। যুগে যুগে, এই দিনটি শ্রী রামের জন্মকে স্মরণ করার জন্য বিশেষ ধরনের পূজা, ভজন, কীর্তণ এবং মন্দিরে সমবেত হওয়ার মাধ্যমে উদযাপিত হয়ে আসছে। শ্রী রামের শৌর্য, সাহসিকতা এবং তার ন্যায়নিষ্ঠ জীবন পদ্ধতি মানুষের জীবনে অনুপ্রেরণা প্রদান করে। রাম নবমী উপলক্ষ্যে, বিশেষ করে উত্তর ভারতের অযোধ্যা, মথুরা, এবং উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রামায়ণ পাঠ, রামকৃষ্ণ রামায়ণ শ্রবণ, এবং রাম ভজনের আয়োজনও হয়। রাম নবমী উদযাপন করা আমাদের কাছে এক বিশেষ ভক্তির উদাহরণ। বলতে পারি যে, রাম নবমী উপলক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিশেষভাবে বিভিন্ন ধরণের আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। এটি মূলত একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক গুরুত্ব। সাধারণত, রাম নবমী উপলক্ষ্যে ভক্তরা দিনটি উপবাস করে পবিত্রতা বজায় রাখেন, এবং শ্রী রামের জন্মকথা শোনেন। মন্দিরগুলিতে এই দিনটি উপলক্ষ্যে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শ্রী রামের মূর্তি স্নান করানো হয় এবং মিষ্টান্ন প্রদান করা হয়।

 

 

বিভিন্ন স্থানে রাম নবমী মিছিলে পরিণত হয়, যেখানে ভক্তরা রামচন্দ্রের চরিত্রে এমন কি সঙ্কটমোচন মহাবলী শ্রী হনুমান সাজে এবং “জয় শ্রী রাম” ধ্বনিতে শোভাযাত্রা বের করে থাকে। এই শোভাযাত্রাগুলি সাধারণত ভক্তদের মধ্যে একত্রিত হওয়ার এবং শ্রী রামের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যদিও এখানে কোনও ধর্ম বিষয় উল্লেখ থাকে না রাম সকলের জন্য আদৰ্শ চরিত্র। বলা যায়, সনাতনী হিন্দু, মুসলিম খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্ম বলে কোনও বিষয় এখানে থাকে না। সকলে মিলেই যদি রামের আদৰ্শ এবং তার দর্শন উপলব্ধি করতে পারে তাহলে কোনও রূপ সন্ত্রাস সৃষ্টি হতে পারে না। কিছু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ কায়েম করবার উদ্দেশ্যেই এই রাম নামকে না মানার জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। সাধারণ মানুষ এই পৃথিবীতে যদি রাম আদৰ্শ মান্যতা দেয় তাহলে এই পৃথিবী নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে। জনমত নির্বিশেষে আমাদের জীবন চরিত্রকে এক অমূল্য ভালোবাসার রূপে পাওয়া যাবে।
যদিও রাম নবমীর তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত হল রাম জন্মের গুরুত্ব। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাম নবমী শুধুমাত্র শ্রী রামের জন্মের দিন নয়, বরং এটি সনাতন ধর্মের নৈতিক আদর্শ ও জীবনের শুদ্ধতার একটি প্রতীক। শ্রী রাম তাঁর জীবনে বহু কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কখনও ন্যায়ের পথে চলা থেকে বিচ্যুত হননি। রামের জীবন-ব্যবস্থা সবার জন্য আদর্শ, যেখানে তিনি বাবার আদেশ, স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততা, এবং নিজের ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রেখেছেন।
বিশেষ করে রাম নবমীর দিনটি ন্যায়, সত্য, এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠার আদর্শকে সামনে রেখে উদযাপিত হয়। এটি সনাতন সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে, জীবনে যদি ন্যায় ও সত্যের পথে চলা হয়, তাহলে সমস্ত দুঃখ এবং বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। এই দিনটি সমাজে ধর্মীয় শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার প্রতি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

 

 

রাম নবমী সমাজের প্রতীক ও উজ্জ্বল আলোকিত অভুত্থান। সংস্কার ও সম্বন্ধন ভালোবাসার দর্শন।
রাম নবমী শুধু ধর্মীয় মহিমার চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান মানুষের ঐক্যবদ্ধতা। এটি একটি সামাজিক ঐক্য ও সংহতির উৎসব। বিশেষ করে মন্দিরে এবং পাড়ায় পাড়ায় যখন ভক্তরা একত্রিত হয়ে পূজা করেন, তখন সেটি সামাজিক সম্পর্ক এবং বন্ধুত্বের এক অনন্য উদাহরণ। এই দিনে ভক্তরা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয় এবং একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়। অথবা, অনেক স্থানে রাম নবমী উপলক্ষ্যে দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ এবং দান করা হয়, যা সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মধ্যে সহানুভূতি এবং সাহায্যের মনোভাব সৃষ্টি করে। একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন প্রদান রাম নবমী উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। রাম নবমী শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি শ্রী রামের জীবনের আদর্শের প্রতি এক বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন। এটি আমাদের শেখায় যে, সত্য ও ন্যায়ের পথ অবলম্বন করলে মানুষের জীবনে শান্তি এবং সুখ আসতে বাধ্য। এই দিনটি মানুষের মধ্যে ধর্ম, নৈতিকতা, এবং সামাজিক সহানুভূতির বোধ জাগিয়ে তোলে। সুতরাং, রাম নবমী শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় দিন নয়, এটি মানবতার জন্য একটি মহানতম দিন, জীবনের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার একটি অমূল্য সুযোগ।

সকল পাঠক-পাঠিকা, আমাদের সাংবাদিক, কর্মীবৃন্দ  এবং আমাদের পত্রিকার সমস্ত লেখক-লেখিকা সকলকেই আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা অভিনন্দন ও ভালোবাসা জানাই।🍁

 

 

🍂মহামিলনের কথা 

হর-পার্বতীর সংসারে উমা, রমা, শ্যামা এবং সীতারাম

 

শ্রীশ্রীঠাকুর তখন আকাশ-ব্রহ্ম। এইভাবে ঠাকুরকে পেয়ে মায়ের আনন্দের সীমা রইল না। বাসন মাজার পর ওই চাতালে ঠাকুর একটি চৌকির উপর কম্বলে আসন করে বসতেন আর মামাবাবু (মামাজী) হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুললিত সুরে রামবন্দনা পাঠ করতেন। বাবারা ঠাকুরের ডানদিকে ও মায়েরা ঠাকুরের বামদিকটায় বসতো। পাঠ হয়ে যাওয়ার পর সবাইকে পাঁচ মিনিট মৌন থাকতে হোত তখন কেউ গুরু জপ, কেউ ইষ্ট নাম জপ করত। সেই সময় চাঁদের আলো ছিটকে পড়ত ঠাকুরের সর্বাঙ্গে। ঠাকুরকে মনে হত স্বয়ং শিব। স্বয়ং শ্বেতবস্ত্র পরিহিত জটাজুটোধারী শান্ত স্নিগ্ধ দিগ্বিদিগন্ত ভেদ করে শিবলোক হতে আমাদের কাছে বসে আছেন। কি সুন্দর শোভা বিকিরন হতো বোঝান যায় না। তারপর প্রার্থনা হতো। ঠাকুর নিজেই প্রার্থনা করাতেন, বলতেন ‘অসৎ হইতে মোরে লয়ে চল সতে।’ আলোচনায় : কিঙ্করী রমা (সঞ্চিতা সোম)

 

দ্বিতীয়বার পুষ্কর চাতুর্মাস্য (১৩৭৪ সাল) 

 

শ্রীশ্রীঠাকুর কেদার-বদ্রী ভ্রমণ করে ফিরলেন। সেখান থেকে চাক্রাতা হয়ে এলেন দিল্লী। উপরাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি এলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চ্যবন সাহেব এলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রার্থনা, এ সংকটে রাজকুলে রক্ষা কর হরি। মন্ত্রী জয় সুখলাল হাতি, জগজীবন রাম, ত্রিগুণা সেন সবাই এলেন ঠাকুরের কাছে। ছ’দিন দিল্লীতে অবস্থান করলেন। দিল্লী থেকে চললেন পুষ্কর। ভরতপুর কুঞ্জ। বহু নতুন নতুন ভক্ত এলেন। চাল, ডাল, অর্থ আসতে লাগল শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাণ্ডারে। পুষ্করে আশ্রমের জন্যে জমি সংগ্রহ হয়েছিল। সেখানেই ঠাকুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। পরমগুরুমা হেমাঙ্গিনী দেবী, কন্যা কুটাইমাকে নিয়ে চলে এলেন পুষ্করে। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী মোহনলাল সুখাড়িয়া এলেন। রাজ্যপাল হুকুম সিং এসেছিলেন। সবাইকে ‘সনাতন শাস্ত্রম্’ উপহার দেওয়া হল। রাজস্থানের বিভিন্ন স্থানে প্রচারের উদ্দেশ্যে জয়পুরে গেলেন। গোবিন্দ মন্দিরে সমস্ত পন্ডিতেরা স্বাগত জানালেন। ঠাকুর সকলকে শাস্ত্রপথ গ্রহণে আহ্বান জানাচ্ছেন। তার উত্তরে পন্ডিত এবং ধর্মানুরাগী ব্যাক্তিরা বলছেন আপনার কৃপা হলে আমরা অবশ্যই সফল হব। উত্তরে ঠাকুর বলছেন, উদ্দেশ্য মহৎ হলে, সেবাবোধ যদি চিত্তে থাকে, তাহলে সর্ব্বশক্তিমান উপর থেকে কৃপা করবেনই করবেন। পুষ্করে আবার ফিরে আসেন। এবারে আবার এলেন এক জার্মান দম্পতি। যোগী সত্যমূর্তিও আবার এলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে।

 

সেবার পুষ্করে মায়েরা রাত্রি জেগে হরিবাসর করেছিলেন। ছোট বড় সব মায়েরা ছিল এবং এত ভাল নাম হয়েছিল যে আকাশ বাতাসও যেন নামময় হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরটি আমার আর স্থির থাকতে পারলেন না। ভোর বেলায় আস্তে আস্তে করে মায়েদের কাছে এসেছেন কিন্তু মায়েরা ঢুলু ঢুলু অবস্থায় ছিল। ঠাকুরকে দেখে প্রত্যেকেরই আনন্দের সীমা রইল না। মায়ের হাতে হারমোনিয়াম ছিল। শান্তিদি মায়ের হাতে ধূপকাঠি ধরিয়ে দিলেন এবং মা ঠাকুরকে আরতি করলেন। এ যে কি আনন্দ বলার মত নয়। আর সকাল হতেই বাবারা বলছেন মায়েদের নাম এত ভাল হয়েছে যে বাবারা হেরে গেছেন, ঠাকুর নিজেই বলেছিলেন ব্যারাকপুরের মায়েরা নামের ডাকসাইটে।

 

পুষ্করের লীলার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলা থেকেও অসংখ্য ভক্তেরা পুষ্করে যেতে চাইছে। সে এক অদ্ভুত টান। কেউ যাচ্ছে পুজোর টানে, কেউ বা যাচ্ছে যজ্ঞের টানে আবার কেউ স্বয়ং যজ্ঞেশ্বরের টানে। সতীসংঘের মায়েরা এসে পুষ্করের গল্প বলে। আর মা (চিনুরানীদেবী) সেই গল্প শোনে। ভাসতে ভাসতে পুষ্করে চলে যায়। মানসে সেবা করে। প্রসাদ প্রায়। তবু মন ভরে কই? একদিন মা বাবাকে পুষ্করে যাবার কথা বলল। বাবা কিছুই বলতে পারছেন না। চুপ করে আছেন। ভেতরটা চাইছে যাই টিকিট কেটে আনি। কিন্তু মুখ ফুটে অসুবিধেটা বলতে পারছেন না। শেষে বলেই ফেললেন, কী করে যাব, হাতে তো টাকা নেই। কীভাবে যাব?

আসলে বাবা, প্রত্যেকবারই যখন ঠাকুরের কাছে যেতেন তখন এক মাসের মাহিনাটা দিয়ে দিতেন। তবু বাবার কাছে মনে হতো এটা কম দেওয়া হল। আর একটু দিতে পারলে ভাল হত। সেই শুনে মা বললেন, ‘ঠিক আছে আমার আর্মলেট জোড়াটা বাধা দিয়ে দাও। আর পুষ্করে চল। ওখানে তো জলের অভাব, তুমি জল তুলবে আর আমি বাসন মাজবো’, আমরা সবাই মিলে চললাম পুষ্কর, কু ঝিক্ ঝিক্। সে কি আনন্দ! ঠাকুর তো মা-কে দেখেই বললেন, ‘এই যা, বাসন মাজগে যা, তোর জন্যে বাসনগুলো কাঁদছে।
প্রসঙ্গক্রমে আর একটা কথা বলে নিই, শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করার ইচ্ছে সব ভক্তের মনেই খেলা করত। উথালি পাথালি করতো। যাদের করেছে তারাই জানে উথালি পাথালিটা কি জিনিস। পাথেয়, নেই তো কি হয়েছে? থালা বাটি বন্ধক দাও, চল ঠাকুরের কাছে। তিনি যে অন্তর্যামি। ফেরার সময় ঠাকুর শ্রীকোষ থেকে তাদের টাকা দিয়ে বলতেন, ‘আবার এস’। আমরা সবাই বাবাকে বলেছিলাম আমাদের পুজোয় জামা কাপড় দিতে হবে না! কেমন যেন হাঁক পাঁক করত ভেতরটা। ঠাকুরকে না দেখে থাকা যেতনা। ঐ তো বয়েস, তখন আমরা কি বুঝি, কিছুই বুঝি না। শুধু বুঝি ঠাকুর আমাদের ভালোবাসে, আমরাও ঠাকুরকে ভালোবাসি।

আশ্রমে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুরের কি আনন্দ! চোখে না দেখলে বোঝা যায়না। ঠাকুর মা-কে বলছেন তোর জন্য ‘বাসন কাঁদছে’ আর বৃন্দাদিকে বলছেন তোর সাথী এসে গেছে তোর কষ্ট কমল। আর বাবাকে বললেন আজ থেকে তুই বাবাদের সাথে জল তুলবি। অন্তর্যামী ঠাকুরটি সব জানতে পারেন। বাবা ও মায়ের চোখের জল অঝোরে ঝরতে থাকল। ঠাকুর এইভাবে বাবা মার সঙ্গে সবসময় লীলা করতেন এবং ঠাকুরের এত ভালবাসা যে কল্পনাও করা যায় না। ওখানে বড় বড় ওল আর ডুমুর বাংলা থেকে যেতো। সেইগুলো কাটতে সবাই ভয় পেতো। তবে ভয় পাবারই কথা। ওল কাটতে গেলে হাত ভীষণ চুলকাত। তখন কুটাইদিকে মা বললেন ‘আমি এইগুলো কেটে দেবো?’ উত্তর কুটাই দি বললেন, ‘তাহলে তো ভালই হয়। তারপর থেকে মা ওলগুলো কাটতে আরম্ভ করলেন। ঠাকুর হঠাৎ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন, মা জানে না। তখন কুটাইদি বলে উঠলেন ‘দ্যাখো চিনু, তোমার পাশে কে দাঁড়িয়ে আছেন’? মা পাশ ফিরে দেখলেন ঠাকুর স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছেন। খুব হাসছেন আর বলছেন ‘বাঙালের মেয়ে তো’! মায়ের খুবই আনন্দ! প্রনাম করলেন, ঠাকুর বললেন, ‘দ্যাখো পায়ে হাত দিও না তাহলে হাত ধুতে হবে’। এরপর থেকে ওলের ডালনা ও ডুমুরের তরকারী রান্না করে ঠাকুরকে দেওয়া হোত।

সেবার পুষ্করে মায়েরা রাত্রি জেগে হরিবাসর করেছিলেন। ছোট বড় সব মায়েরা ছিল এবং এত ভাল নাম হয়েছিল যে আকাশ বাতাসও যেন নামময় হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরটি আমার আর স্থির থাকতে পারলেন না। ভোর বেলায় আস্তে আস্তে করে মায়েদের কাছে এসেছেন কিন্তু মায়েরা ঢুলু ঢুলু অবস্থায় ছিল। ঠাকুরকে দেখে প্রত্যেকেরই আনন্দের সীমা রইল না। মায়ের হাতে হারমোনিয়াম ছিল। শান্তিদি মায়ের হাতে ধূপকাঠি ধরিয়ে দিলেন এবং মা ঠাকুরকে আরতি করলেন। এ যে কি আনন্দ বলার মত নয়। আর সকাল হতেই বাবারা বলছেন মায়েদের নাম এত ভাল হয়েছে যে বাবারা হেরে গেছেন, ঠাকুর নিজেই বলেছিলেন ব্যারাকপুরের মায়েরা নামের ডাকসাইটে।
পুষ্করে একদিন সব বাবারা জল তুলছেন ঠাকুর একটা বেদীতে বসে দেখছেন, প্রথমে বাবাকে না দেখতে পেয়ে বলছেন হ্যাঁরে বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন, তারপর দেখতে পেয়ে বলছেন, না দেখতে পেয়েছি। এইভাবে সর্বদাই ঠাকুর বাবা-মা কে নজরে নজরে রাখতেন। অনেকক্ষণ ধরে ঠাকুর পা ঝুলিয়ে বসে আছেন, মা ভাবলেন ঠাকুরের কষ্ট হচ্ছে। এই ভেবে চরণ দুখানি ধরে নিজের কোলে তুলে রাখলেন, বেশ কিছুক্ষণ ঠাকুরের কোন হেলদোল নেই। তারপর মা চরনের ধূলি চোখে মুখে ও মাথায় দিলেন ও আমাদের মাথাতেও দিয়ে দিলেন। মা বলেছিলেন, শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপাদৃষ্টি থাকা দরকার। কৃপা দৃষ্টিতে কি হয় — প্রশ্ন করেছিলাম। মা বললেন, তিনি যে পতিতপাবন। বিষয় কীটের দংশনে আমরা সব পতিত। তিনি অধমতারন, তিনি দীনবন্ধু। তিনি আমাদের উদ্ধার করবেন। দেখছিস্ না আমাদের উদ্ধার করার জন্যেই তিনি তার চরণ দু’খানি আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মা, ঠাকুরের কাছে গেলে দেখেছি লক্ষ্য করে, ভেতরে কোন দুঃখ থাকেনা। মা হেসে বললেন, ওরে পাগলী মেয়ে আমার, এ কথা শুনলে, ঠাকুর কি বলবে, জানিস? বলবে, তাহলে এ’র কাছেই থাক্ চিরকাল। তবে ঠাকুরের মূল কথাটা হল সুখ দুঃখ ঈশ্বরের দু’খানি চরণ। দু’টিকেই সমভাবে বরণ করে নিতে হবে।

 

 

রাতের জ্যোছনায় শ্রীশ্রীঠাকুর যেন স্বয়ং রাধারানী আবার দিনের সূর্যে নীলাকাশ, তখন তিনিই কৃষ্ণ। পুষ্করের মাধুর্যটাই এমন যে প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ না হয়ে কেউ থাকতে পারবে না। আশ্বিনের শরতের আকাশ শ্রীশ্রীঠাকুরের উপস্থিতিতে এমন এক আকাশ ভাবনা এনে দেয় যে ঠিক ভাষায় প্রকাশ যায় না। আসলে এই অনুভবগুলো বোঝাবুঝির বস্তু নয়, সব আস্বাদনের বস্তু। শ্রীশ্রীঠাকুর তখন আকাশ-ব্রহ্ম। এইভাবে ঠাকুরকে পেয়ে মায়ের আনন্দের সীমা রইল না। বাসন মাজার পর ওই চাতালে ঠাকুর একটি চৌকির উপর কম্বলে আসন করে বসতেন আর মামাবাবু (মামাজী) হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুললিত সুরে রামবন্দনা পাঠ করতেন। বাবারা ঠাকুরের ডানদিকে ও মায়েরা ঠাকুরের বামদিকটায় বসতো। পাঠ হয়ে যাওয়ার পর সবাইকে পাঁচ মিনিট মৌন থাকতে হোত তখন কেউ গুরু জপ, কেউ ইষ্ট নাম জপ করত। সেই সময় চাঁদের আলো ছিটকে পড়ত ঠাকুরের সর্বাঙ্গে। ঠাকুরকে মনে হত স্বয়ং শিব। স্বয়ং শ্বেতবস্ত্র পরিহিত জটাজুটোধারী শান্ত স্নিগ্ধ দিগ্বিদিগন্ত ভেদ করে শিবলোক হতে আমাদের কাছে বসে আছেন। কি সুন্দর শোভা বিকিরন হতো বোঝান যায় না। তারপর প্রার্থনা হতো। ঠাকুর নিজেই প্রার্থনা করাতেন, বলতেন ‘অসৎ হইতে মোরে লয়ে চল সতে।’
সেবারও দুর্গাপূজাতে আমরা ঠাকুরের কাছ থেকে কাপড় পেয়েছিলাম। স্মৃতি হিসাবে ওইগুলো এখনও রাখা আছে।

এবার কলকাতায় ফিরে এলাম। মহামিলন মঠে একবার রাখীপূর্নিমার দিন সব সতীসঙ্ঘের মায়েদের নিয়ে উৎসব হয়েছিল। হঠাৎ ঠাকুরের মঞ্চ থেকে ব্যারাকপুর সতীসঙ্ঘের পরিচারিকার ডাক পড়ল। মা ঠাকুরের মঞ্চে উঠে প্রথম রাখী দিয়ে তৈরী মালাটা পরিয়েছিলেন ঠাকুরকে। তারপর একের পর এক সবাই ঠাকুরের হাতে রাখী পরিয়ে দিতে লাগলেন। এতে দুই হাত ভরে গিয়ে রাখী ঠাকুরের কাঁধ অবধি পৌঁছে যায়, দেখার মতো দৃশ্য। স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করলেন সবাই।
শুধু কি তাই! মা’কে “সুধার ধারা” পড়তে দেওয়া হয়েছিল। মায়ের মুখে ঠাকুরের বই পড়া খুবই ভাল হয়েছিল। মা তো কেঁদেই সারা।—🍁
[বানান অপরিবর্তিত ]

 

 

 

🍂ফিরেপড়া | প্রন্ধ

 

মানুষের উপলব্ধিতেই মানুষ আপন জীবসীমা অতিক্রম ক’রে মানবসীমায় উত্তীর্ণ হয়। সেই মানুষের উপলব্ধি সর্বত্র সমান নয় ও অনেক স্থলে বিকৃত ব’লেই সব মানুষ আজও মানুষ হয়নি। কিন্তু তাঁর আকর্ষণ নিয়ত মানুষের অন্তর থেকে কাজ করছে বলেই আত্মপ্রকাশের প্রত্যাশায় ও প্রয়াসে মানুষ কোথাও সীমাকে স্বীকার করছে না।

 

মানুষের ধর্ম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

 

মানুষের একটা দিক আছে যেখানে বিষয়বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে। সেইখানে আপন ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়।

কিন্তু মানুষের আর-একটা দিক আছে যা এই ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে যাকে বলি ক্ষতি তাই লাভ, যাকে বলি মৃত্যু সেই অমরতা। সেখানে বর্তমান কালের জন্যে বস্তু সংগ্রহ করার চেয়ে অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করার মূল্য বেশি। সেখানে জ্ঞান উপস্থিত-প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে যায়, কর্ম স্বার্থের প্রবর্তনাকে অস্বীকার করে। সেখানে আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।

স্বার্থ আমাদের যে-সব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীবপ্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।

কোন্‌ মানুষের ধর্ম। এতে কার পাই পরিচয়। এ তো সাধারণ মানুষের ধর্ম নয়, তা হলে এর জন্যে সাধনা করতে হ’ত না।

আমাদের অন্তরে এমন কে আছেন যিনি মানব অথচ যিনি ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম ক’রে “সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’। তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। তাঁরই আকর্ষণে মানুষের চিন্তায় ভাবে কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব। মহাত্মারা সহজে তাঁকে অনুভব করেন সকল মানুষের মধ্যে, তাঁর প্রেমে সহজে জীবন উৎসর্গ করেন। সেই মানুষের উপলব্ধিতেই মানুষ আপন জীবসীমা অতিক্রম ক’রে মানবসীমায় উত্তীর্ণ হয়। সেই মানুষের উপলব্ধি সর্বত্র সমান নয় ও অনেক স্থলে বিকৃত ব’লেই সব মানুষ আজও মানুষ হয়নি। কিন্তু তাঁর আকর্ষণ নিয়ত মানুষের অন্তর থেকে কাজ করছে বলেই আত্মপ্রকাশের প্রত্যাশায় ও প্রয়াসে মানুষ কোথাও সীমাকে স্বীকার করছে না। সেই মানবকেই মানুষ নানা নামে পূজা করেছে, তাঁকেই বলেছে “এষ দেবো বিশ্বকর্মা মহাত্মা’। সকল মানবের ঐক্যের মধ্যে নিজের বিচ্ছিন্নতাকে পেরিয়ে তাঁকে পাবে আশা ক’রে তাঁর উদ্দেশে প্রার্থনা জানিয়েছে–

স দেবঃ
স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তু।
সেই মানব, সেই দেবতা, য একঃ, যিনি এক, তাঁর কথাই আমার এই বক্তৃতাগুলিতে আলোচনা করেছি।🍁

শান্তিনিকেতন
১৮ মাঘ, ১৩৩৯

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ২১ 

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ২১। 

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

 

একুশ.

একমাত্র বাংলা কবিতাই পারে সব দুঃখ সইতে

বি-এড ট্রেনিং করার সময়ই পাটনা ইউনিভার্সিটি থেকে ড. ললিতা সান্যাল এর চিঠি পাই। তিনি তখন ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ডিপার্টমেন্টের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। এম এ পাস করার সময়েই আমাকে বলেছিলেন এই ইউনিভার্সিটিতেই পার্ট টাইম লেকচারার হিসেবে জয়েন করতে। প্রায় দু-বছর কেটে গেছে। ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। সেই বিজ্ঞপ্তির খবর জানিয়েই আমাকে চিঠি লিখেছেন। তিনশো নাম্বারের preliminary test দিয়ে পাশ করলে তবেই পিএইচডি করার ছাড়পত্র মিলবে। ফরম ফিলাপ করা এক হাঙ্গামার ব্যাপার তার জন্য খরচও আছে। কী করবো ভাবতে ভাবতেই একদিন ইউনিভার্সিটিতে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম। একা অত দূরে রাস্তা ট্রেন জার্নি করে যাওয়া এবং ফিরে আসা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল। একজনকে সেদিন কাছে পেয়েছিলাম মুজিবুর রহমান নামে আবার এক অতি পরিচিত এবং বিশ্বস্ত ছেলেকে। মুজিবুর রহমানের বাবা ছিলেন ট্রেনের ড্রাইভার। তারা থাকতেন রামপুরহাট রেল কোয়ার্টারে। সেই সময় রামপুরহাটে টিউশানি পড়াতে এসেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। মুজিবুর উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কোনো একটা কাজের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তারা দুই ভাই আর এক দিদি এবং মা ও বাবা এই পাঁচ জনের সংসার। বাবার চাকরির অন্তিমকাল আসন্ন। রেল কোয়ার্টার ছাড়তে হবে, কিন্তু তার আগে যে কোনো একটা কাজ হলেই সংসারকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব এটাই সে বুঝতে চেয়েছিল। দিদি ইতিহাস অনার্স নিয়ে পাস করেও আর উচ্চশিক্ষার দিকে যেতে পারেনি। একটা সৎ ছেলেও পাইনি তার বিয়ে দেওয়ার জন্য। মুজিবুর তখন রামপুরহাট পাঁচমাথায় আমার সঙ্গেই বসে তার জীবনের নানা হিসাবপত্র ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলতো। সাহিত্যের প্রতিও ছিল তার অসম্ভব টান। তাকে নিয়ে যাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য হলো তখনও পর্যন্ত রেলে তার টিকিট লাগতো না। শুধু আমার টিকিট হলেই এবং ফরম ফিলাপের খরচটুকু জোগাড় করতে পারলেই কাজটি করে আসা যাবে। মুজিবুর আমার প্রস্তাব পেয়ে ভীষণ উৎসাহিত হয়েছিল। দু’জনেই জানালার ধারে বসে সারারাত গল্প করতে করতে পৌঁছেছিলাম পাটনায়। হিন্দি বলতে ও লিখতে তার অসুবিধা ছিল না। সুতরাং সেদিন ফরম নিয়ে ফিলাপ করে আবার রাত্রে ট্রেন ধরে আমরা রামপুরহাটে ফিরতে পেরেছিলাম।

 

মৃদুলাদি কেঁদে ফেলেছিল। আমিও থাকতে পারিনি। শেষবারের মতো তার দিকে চেয়েও দেখিনি। হনহন করে বেরিয়ে এসেছিলাম কলেজের গেট দিয়ে। জানালার ধারে বাসের সিট নিয়ে সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলাম। গোপন করেছিলাম সব দুঃখগুলি। কাকে দেবো এই দুঃখের ভার? কে সইবে আমার এই দুঃখ? একমাত্র বাংলা কবিতাই পারে সব দুঃখ সইতে সব অশ্রু শোষণ করতে।

 

সকালবেলায় এখানে পৌঁছে মুজিবুর একরকম জোর করেই তার বাড়ি নিয়ে গেছিল। ছোট্ট একটা রেল কোয়ার্টারের কামরায় তারা থাকতো। তাই কামরার সম্মুখেই টিনের শেড দিয়ে একটা পড়ার ঘর তৈরি করেছিল মুজিবুর। ঘরের চারিপাশেই ছিল তার আঁকা ছবি। প্রতিটি ছবির নিচেই লিখেছিল ছোট ছোট কবিতা। সব দেখেই আমার মনে হয়েছিল যেন কোনো কিশোর কবির একটি জাদুঘরে প্রবেশ করলাম। “তুমি তো বেশ প্রতিভাধর, আমি তো ভাবতেই পারিনি এতখানি তুমি করেছো!” বিস্মিত হয়ে মজিবুরকে একথা বলেছিলাম। মুজিবুর বিনয়ে অবনত হয়ে বলেছিল, “দাদা, আপনার কাছ থেকেই প্রেরণা পেয়েছি, তাই লেখার চেষ্টা করি মাত্র। আমরা কী নিয়ে বেঁচে থাকবো? এই লেখা-আঁকার মধ্যদিয়েই জীবনকে দেখতে শিখি!”
মজিবুরের মা বলেছিলেন, “পাগল ছেলে বাবা, পড়াশুনা ছেড়ে এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আগে তো পড়াশোনাটা দরকার তাই না?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম, এটা একশোভাগ সত্যি।
তারপর সেদিন সকালবেলায় পাউরুটির টোস্ট এবং চা খেয়েই তার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, “পরে আবার আসবো, তোমার আঁকা ছবি ও ছড়ায় আমি মুগ্ধ। একটা ছোট্ট টিনের ঘরটিকে তুমি মিউজিয়ামে পরিণত করেছো!”
হ্যাঁ, তারপরেও বেশ কয়েকবার গেছি। মুজিবুরের সঙ্গে বসে চা খেয়েছি, মুড়ি খেয়েছি। বি-এ পড়া ছেড়েই মুজিবুর কিছুদিন সেলসম্যানের কাজেও ঢুকেছে, কিন্তু সেটাও তার ভালো লাগেনি। দূরে কোথাও পালিয়ে গেলে হয়তো কাজ পাওয়া যেতে পারে এ কথা সে বারবার বলেছে। আর এমনি সময় হঠাৎ একদিন সে হারিয়ে যায়। কোথায় যায়, কিভাবে যায় তা কেহ-ই জানতে পারেনি। তার শোকে দুঃখে শূন্যতায় সংসারটি প্রায় ধ্বংসের মুখে। এখন তারা কোথায় আছে, আদৌ আছে কিনা সে খবর আর কেহ-ই বলতে পারে না।

 

 

সময়ের স্রোতে কোথায় হারিয়ে গেছে মুজিবুরের সেই তৈরি করা ছোট্ট মিউজিয়ামটি।
সেইসময়ের নজির আহমদ নামে আরও একজন শিক্ষক আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি লিখতেন ছোটদের জন্য ছোটগল্প। বিড়াল, পাখি, শেয়াল, কাঠবেড়ালি, বাদুড়, চামচিকে ইত্যাদি ছিল তার গল্পের চরিত্র। লেখার সঙ্গে সঙ্গে আঁকার হাতও ছিল অসম্ভব সুন্দর। সৌখিন বিদেশি ফুলের চারা এনে তিনি ছাদের উপর টবে লাগাতেন। পুরো ছাদটাকেই মনে হতো একটা ফুলের বাগান। সকালবেলা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম তার বাড়ির উদ্দেশ্যে। দরজায় টোকা দিলেই খুলে দিতেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতাম ছাদে। দুই চোখ যেমন জুড়িয়ে যেত নানা রঙের ফুলের শোভায়, তেমনি সুগন্ধে মোহিত হয়ে যেতাম। তিনি নিজের হাতেই চা করে আনতেন আর দু’টি বাটিতে মুড়ি ও আলু ভাজা। শীতের রোদ গায়ে মেখে সেই ছাদের উপরেই শুনতাম তার লেখা নতুন গল্প। একদিন বললেন, “একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি, বইটি প্রকাশ করবো।”
জানতে চাইলাম, “কোন বইটা?”
তিনি বললেন, “ওই যে “শেয়াল ও এক হাঁসের ছানা’!”
আমি বললাম, “ভারি মজার গল্প, শিশুদের জন্য এটি খুবই উপযোগী হবে।”
তারপর সেই পাণ্ডুলিপিটি এনে দেখালেন। প্রায় প্রতিটি গল্পেরই একটা থিম নিয়ে ছবি এঁকেছেন নিজের হাতেই। ছবিগুলি রংও করেছেন। আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগলাম প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে। তারপর বললাম, “বেশ খরচও আছে বইটা ছাপতে।”
তিনি জানালেন, “তাতে আটকাবে না, আর চাকরি বেশিদিন নেই। সুতরাং একটা বই তো ছাপিয়ে নেওয়া যাবে!”
কিন্তু পরবর্তীকালে সেই বই আর ছাপানো হয়নি। কেন হয়নি সে কথা আমরা জানতে পারিনি, কিন্তু কিছুটা আভাস পেয়েছিলাম, নজির সাহেবের ভীষণ মনখারাপ দেখে। তার স্ত্রী নাকি তাকে শাসিয়ে বলেছিলেন, “টাকাগুলো পানিতে ফেললে বাড়িতে তার ঠাঁই হবে না।”
অনেক করেই নাকি তাকে বোঝানো হয়েছিল যে, বই ছাপানো শুধু টাকা নষ্ট করা। ওসব ছাইপাঁশ ছাপিয়েই বা কী হবে?

স্ত্রীর অবাধ্য হবার কোনো উপায়ই ছিল না তার। তাই বই আর ছাপানো হয়নি। কোথায় হারিয়ে গেছে পাণ্ডুলিপিগুলি কেউ তার খোঁজও জানে না।

নজির আহমেদকে স্মৃতির দোকানগুলিতে এখনো দেখতে পাই। রামপুরহাট শহরের এপ্রান্তে ওপ্রান্তে কোথাও না কোথাও তার সঙ্গে বসে চা খেয়ে আমাদের বহুদিন কেটেছে। সহজ সরল মানুষটি সংসারের চাপে পড়ে সাহিত্যের পথে যেতে পারেননি। দু-একটি লেখা কোথাও না কোথাও প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সেসব সংগ্রহ করে রাখেননি। কেননা তার সন্তানদের মধ্যে কেহই সাহিত্যমনস্ক ছিল না।

বি-এড কলেজ থেকে ফিরে এসে আবার আমাকে টিউশানিই করতে হয়েছে। মৃদুলাদিকে ছেড়ে আসতে অনেকটাই কষ্ট পেয়েছি। হঠাৎ তার বাবার মৃত্যু মাঝখানে তাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। কারো উপর ভরসা করার মতো আর কেউ ছিল না। তাই সে আমাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার জীবন ছিল স্রোতের জলে ভেসে আসা এক টুকরো শুকনো কাঠের মতো। এই কাঠ কোনো নৌকার উপযুক্ত নয়। আবার কোনো কাজে লাগাবার মতোও এর মধ্যে কোনো সারসত্তা নেই। নিজেকে কখনোই উপযুক্ত করে তুলতে পারিনি। সর্বদা দোটানার মধ্যে থেকে এক দ্বান্দ্বিকতা আমাকে গ্রাস করেছে। তাই মালদহ থেকে ফিরে আসার সময় দুই চোখ অশ্রু সজল হয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। মৃদুলাকে সান্ত্বনা দেবার মতো কিছুই ছিল না।
—তুমি পারবে না একসঙ্গে জীবন কাটাতে?
—খুব ইচ্ছে করে একসঙ্গে তুমুল জীবন কাটাই, কিন্তু তবুও মনের মধ্যে একটা বিক্ষুব্ধ মন জেগে ওঠে। তাই এ কাজে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
—আমার আর কেউ রইল না! চোখের সামনে সব পথই রুদ্ধ। হাওয়াতে যেন আর অক্সিজেন নেই, শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়!
—আমিও অসহায় তোমাকে বোঝাতে পারবো না!
—তবুও তো তুমি পুরুষ মানুষ! আমি তো নারী! নারী কতখানি অসহায় তোমার থেকেও তা নিশ্চয়ই তুমি জানো!
—তা বেশ জানি, কিন্তু এমন অবস্থার মধ্যে থেকে বিপ্লব করার মতো সামর্থ্য নেই। যদি একজনেরও কোনো কাজ জুটতো, তাহলে হয়তো জীবনের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হতো। ভবিষ্যতের কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। চারিদিকে যেন অন্ধকার নেমে আসছে।
—তাহলে রাস্তা কি আমরা পাব না?
—নিশ্চয়ই পাবে এটা আমার বিশ্বাস হয়তো আরো ধৈর্যের প্রয়োজন আছে আমাদের।
মৃদুলাদি কেঁদে ফেলেছিল। আমিও থাকতে পারিনি। শেষবারের মতো তার দিকে চেয়েও দেখিনি। হনহন করে বেরিয়ে এসেছিলাম কলেজের গেট দিয়ে। জানালার ধারে বাসের সিট নিয়ে সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলাম। গোপন করেছিলাম সব দুঃখগুলি। কাকে দেবো এই দুঃখের ভার? কে সইবে আমার এই দুঃখ? একমাত্র বাংলা কবিতাই পারে সব দুঃখ সইতে সব অশ্রু শোষণ করতে। মনে মনে একটা কবিতার কয়েকটি পংক্তি শুধু মাথায় ঘুর ঘুর করছিল—
“নাও দুঃখ নাও
নাও অশ্রু নাও
শূন্য হৃদয় আজ আকাশের মতো
নক্ষত্র নেই, চন্দ্র নেই,বিষণ্ণ মেঘের ভেলা ভাসে
বিষাদের কবিতারা সে ভেলায় যায়” 🍁(চলবে)

 

🍂কবিতা 

 

স্বপন কুমার দত্ত-এর একটি কবিতা 

 

 

প্লিজ মলেষ্ট মি

বিশ্বাস করুন স্যর,
আমার কোনও অবৈধ উইদি নেই।
তাই যদি টাকাগুলো দেন…

না না— আপনাকে দেবদাস হতে বলছিনে
এ-এ-একটু সরে দাঁড়ান
ডাল লেপ্টে বক্সিং গ্লাভসটা নিয়ে নিন
নাকি—
না। না। না। না। আমি একটা থ্রী নট থ্রী নেবল
ইউ ভেস্টাল স্যালোনি
একটা পোস্টার-
আরে পোস্টারটা খুঁজতে গিয়ে একি একটা স্লিভলেস ব্রাউজ
ব্লাউজের নেই হাতে বিয়ার মগ
আহ হা হা—

আহ, এই রকমই— এই রকমই মানুষ
ব্যাপার-স্যাপার এই রকমই
নিজেকে তেল করি— করি না
প্রতারণা করা আমার রূপ, আমার ঔদ্ধত্য

হ্যাঁ, হ্যাঁ— ধরা যাক, ধরা যাক…
এই মুহূর্তে মরণ নাচছে, আবহ থেমে যাচ্ছে,
আমি হাঁফাচ্ছি

কেননা, শেষ পর্যন্ত তো আমারই গায়ে সবাই হাত দেবে

কেননা, আমি সত্য অসভ্য
তার চেয়েও বড় সত্যি ছোট লোক,
হাত দেবেই, কারণ আমার সবই আছে, কিন্তু সবই ধূসর অন্ধকার, বিবর্ণ…

কেননা আমি আসলে ওই দূরের একটা অতি খচ্চর মালের প্রতিধ্বনি
তাই ডান্ডাবারি ভালবাসতে চায় আমাকে

 

 

 

বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ

 

 

মানুষের জানালায় 

একটি প্রজাপতি কেবল সামনের জানালার গ্রিলে
বসছে আর উড়ে যাচ্ছে যখনই ওর ফটো তুলতে উদ্যত হচ্ছি
ফটো তোলার কেন এই আপত্তি ওর
তার সঙ্গত কারণ এখনও সে উল্লেখ করেনি
হতে পারে মানুষ বিষয়ে সঠিক কোন ধারণা নেই ওর
কিংবা মানুষকে বিশ্বাস করার কোন হেতু
এখনও সে খুঁজেই পায়নি

অই অদ্ভুত প্রজাপতির ডানা ক্রমশ আমাকে
মোহগ্রস্ত করে তোলে, কখন যে আবার সে
আমার জানালার গ্রিলে এসে বসে, এই প্রতীক্ষায়
আমার সকাল বিকেল সব পার হয়ে যায়

একটি প্রজাপতিও মানুষকে আর কোনভাবে ভরসা করতে পারছে না
এই সত্যটুকু
বুঝতে আমার
বহু সময় অতিবাহিত হয়ে যায়!

 

 

শিমুল এত ঝরছ কেন

শিমুল এত ঝরছ কেন মাটির ওপর
ফেটে যাচ্ছে তোমার শরীর, মাংস, নাড়িভুঁড়ি সব
রাস্তার ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছে, তুমি রক্তাক্ত ও বিপর্যস্ত
শিমুল এত ঝরছ কেন মাটির ওপর!

কার ওপর তোমার এত অভিমান
কার ওপর তোমার এই অমানুষিক ক্রোধ
নিজেকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছ কোন অভিমানে!

মাটির ওপর কিই বা আছে, মায়ের আদর
তোমার ঝরার পথে যদি একটি চাদর বিছানো থাকতো
তবে হয়ত এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমাদের সামনে আসত না শিমুল!

তোমার রক্তাক্ত ঝরে যাবার দিকে
একটি একা জারুল গাছ সাক্ষী
তুমি কি এটা অস্বীকার করতে পারো শিমুল?

 

 

নতুন করে

নেইতো নতুন করে পাওয়ার কিছু
নতুন করে হারাবারও হয়ত তেমন কিছু নেই আর
ভালোবাসা কবে হাঁটু ভেঙে বন্দি হয়ে আছে
বন্ধ ঘরের ভিতর

বন্ধ ঘরের ভিতর নেই কোন হাওয়া
তোমার প্রশ্রয় পাওয়া একটি বেড়ালও নেই আশেপাশে
নেইতো তেমন কোন আশা, ঢেউ কোলাহল
নয়তো তোমাকে পেছন ফিরে দেখা নতুন কৌতুহল
সন্ধ্যাবেলা তোমার একান্ত পিছুপিছু
গড়িয়াহাট পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার প্রচেষ্টা
বাস্তবোচিত হবে কি কখনো!

 

 

মুক্তি

কবিতায় মুক্তি খোঁজা
সেকি এক বিভ্রমের জাল
শস্যখেতে ধরে রাখা কৃষকের হাল
এক গ্লাস মদ জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠলে কখনো
কি করবে জনডিসে
যদি এ জীবনে
একটু বেসামাল না হওয়া যায়
মাতাল কবির এই প্রশ্নে
চাঁদ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে!

 

 

মাথার ভিতর 

মাথার মধ্যে গর্জন করে না কোনোই মেঘ
মাথার মধ্যে নেই কোন আর গভীর সংকেত
শুধু ক্লান্ত বুড়ো ঘোড়ার মতন
শুধুমাত্র ঘাস চিবিয়ে চলবে এই জীবনযাপন
আর কতদিন!

নেই কোন আগ্নুৎপাত, নেই কোন অবাধ বর্ষণ
শুধু এই মন, অনাথ এখন!

মাথার ভিতর একসময় শুধু ছিলে তুমিই
এখন কথায় কথায় তোমার
মুখঝামটাই শুনে চলি।

 

 

গোলাম কবির-এর কবিতাগুচ্ছ

 

 

আত্মখননের সেই রাতে

সেদিন বৃষ্টি ঝরছিল অঝোরে
মনে হচ্ছিল এমন সৃষ্টিছাড়া বৃষ্টির
একটুও কমার কোনও সম্ভাবনা নেই!
অথচ হৃদ উঠোন একদম খটখটে চৌচির
চৈত্রের ন্যাড়া ফসলের মাঠের মতো!

আত্মখননের সেই রাতে শোকের তীব্রতায়
আমিও ভিজতে চাচ্ছিলাম প্রবল বর্ষার দুপুরে
সবুজ মাঠের বুকে ফুটবল খেলায় রত
দুরন্ত বালকের মতো অথচ
কোনও এক অদৃশ্য বাধার পাহাড় যেন
দাঁড়িয়ে ছিল চীনের প্রাচীরের মতো,
আমাকে একটুও ভিজতে দিচ্ছিল না!

 

 

আমার সামনে শুধু পড়ে আছে
পিথাগোরাসের উপপাদ্যটাই 

 

অন্ধ এক পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা!
আমার চারপাশে চেয়ে দেখি অনন্তকাল
প্রবহমান নদীর স্রোতরেখা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে
সভ্যতার ছেঁড়া পাল তোলা নুহের কিস্তি!
সেখানে আছেন সত্যের মতো বদমাশকে
ভালোবেসে একগুঁয়ে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও
এবং সক্রেটিসের সাথে মিছিলে সামিল
আরো কত কত মহাজ্ঞানী গুণীজন!

তারপর আসে নিবিড় রাত!
আসে কখনও চন্দ্রদহনে পুড়ে যাওয়া
হৃদয়ের ছাইয়ে ভাসতে থাকা স্বপ্নে পাওয়া
সোনালি ভোরের হাওয়ায় উড়তে থাকা
দীঘল কালো চুলের অরণ্যে সমৃদ্ধ
কোনো এক প্রিয়ার ঠোঁটের পাশে
নিরীহ বসে থাকা একটা
অনিন্দ্য সুন্দর কালো তিল!

কখনও আসে প্রখর রোদে পুড়ে
ছাই হয়ে যাওয়া ম্লানমুখী কোনও
এক কর্মজীবি নারী হেঁটে চলছেন
ধীরে ধীরে তাঁর নিজস্ব ঠিকানায়!
তাঁর চোখে স্বপ্নের ভাত-ঘুমে দেখি
সন্তানের মুখে তুলে ধরছেন
রুপোলি ইলিশের ঝোল মাখা ভাতের নলা,
তিনি সেই মুহূর্তে তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া
বন্যার জলকে কিছুতেই লুকোতে পারছেন না,
আহা সাধের ইলিশের সোয়াদ!
ভোলা কী যায়, কতদিন যেন তা
স্বপ্নের ভাতঘুমে মুখেই লেগে থাকে।

তারপর আর কিছু মনে নেই!
ঘুম নেই চোখে, তাই স্বপ্ন নেই!
আমার সামনে শুধু পড়ে আছে
পিথাগোরাসের উপপাদ্যটাই!

 

 

পৌরাণিক পাথর

বুকের ওপর একটা পৌরাণিক পাথর
চেপে বসে আছে যেন তৃতীয় বিশ্বের
কোনও এক স্বৈরাচারী একনায়ক!

এই যে এত ঝড় বয়ে যায়,
হৃদয়ে মেঘ জমে প্রবল বর্ষণে
বন্যায় সব তলিয়ে যায়
কিন্তু পাথর সরে না একচুলও!
বসে আছে একদমই থিতু হয়ে!

একবার খুব চেষ্টা করলাম সরানোর জন্য
কিন্তু সে তখন আরও গভীর ভাবে
বুকের ওপর মন্ত্রের মতো স্থির
বসে থাকল যেন ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধ!

 

 

তোমার কথা বলা

যখন তুমি কথা বলো মনে হয়
সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে
দ্রুতগামী ট্রেনের ওপর বসে থেকে
চেয়ে দ্যাখা অপসৃয়মান রেলসেতুর মতো!

 

 

মমিকৃত লাশ

নিজেকেই নিজে ছুঁয়ে দেখি এখনও
বেঁচে আছি নাকি মরে বেঁচে গেছি!

কাফনের শুভ্রতা নাকি বেদনার
নীল অতল জলরাশি কতোটা গ্রাস করেছে
আমার হৃদয় ভেবে ভেবে
রাত হারায় দিনের আলোর উদ্ভাসে!

এক-একবার নিজেকে চিমটি কেটে দেখি
ব্যথা পাচ্ছি কী না, কই পাচ্ছি না তো!

মনে হল, এটা কিছুই নয় আমার বেদনার
অতলে তলিয়ে যাওয়া এই হৃদয়ের চেয়ে!

বিশ্বাস না হলে এই আমাকে একটু ছুঁয়ে দ্যাখ!
হয়ত তখন তোমার মনে হবে
এটা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার নমুনা খুঁড়ে
খুঁজে পাওয়া কোনো অজ্ঞাত মানুষের মমিকৃত লাশ!

 

 

রমাপ্রসাদ দাস-এর একটি কবিতা

 

 

আমার একটা তুমি ছিল

আমার একটা তুমি ছিল,আর পিছে ছিল কুঁড়ে ঘর আর লণ্ঠন, চাল ফুঁড়ে বৃষ্টিতে মেঝে ভেসে যায়, উঠোনে ছিল শেফালিকা, বারান্দায় বেয়ে ওঠা মাধবীলতা,বর্ষায় তার কি রূপ ফুলে ফুলে, মিষ্টি গন্ধে গন্ধে মাতোয়ারা, দিন রাত ঝরে পড়ে,মুঠো করে নিই যত ধুলায় ঠিক তত, একটাই আকাশ আর মেঘ শত শত, সাদা মেঘ কালো মেঘে মিশে যায়, কৃষ্ণ পক্ষে গাছে গাছে জোনাকির আলো, আকাশে তখন তারাদের খুনসুটি,মাঝে মাঝে আসে কালবৈশাখী, এই বুঝি উড়ে যায় কুঁড়েঘর, ঝড় থেমে যায় থেকে যায় হৃদকম্পন, তবুও এ যন্ত্রণায় দুঃখ নেই,সুখের অনুভূতি কত যে দামি, প্রকৃতির অমোঘ বাঁধনে বেঁচে থাকে শেফালী মাধবীরা, এমন ঘরে তাকে নিয়ে আসার সাহস হয় না, অন্য কিছু নয়,তাকে বলাই হয়নি, আমার সাধ্যের উঠোন ঘরের কথা, সে যেমন মনের মধ্যে বেড়ে উঠছে উঠুক, অন্য কিছু বললে জীবনের হত পরাজয়, যে উৎফুল্লতায় মাধবী শাখা গেছে চালাঘর বেয়ে, তাকে বাঁচাতে চাই মাটি, আর মালি,সে হতেই পারে এই সংসারের মালি, মনে হয় স্বার্থ বিয়ান এর প্রচেষ্টায় আছে সেই নারী, নূতন করে এবার হয়তো বাঁচা সম্ভব তাকে জড়িয়ে, ভাঙ্গা দেয়ালের গচ্ছিত ভালোবাসায়

 

 

 

 

মমতা রায় চৌধুরী-এর একটি কবিতা

 

 

খুঁজে ফিরি 

আজও নির্জন পথে খুঁজে ফিরি তোমাকে
পায়ের ছাপ রেখে যাওয়া পথে দেখি খুঁজে খুঁজে
হাঁটি অদ্ভুত স্নিগ্ধতা মেখে মাছরাঙা পাখির উদাস দৃষ্টিতে
মেঠো পথে যেতে যেতে ছুঁয়ে দেখি সবুজ ধানের শীষ
হয়ত বা রেখে গেছো টিয়া পাখির পালকের রঙ
আল পথ ধরে হেঁটে যাই তোমার ফেলে যাওয়া
মুগ্ধতার স্মৃতি গুমরে ওঠে আজও মনে প্রাণে
এভাবে আমি হেঁটে চলেছি নির্জনতায়
কখনও বা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত, হেমন্তের ধূসরতা কেমন আপন করে নিয়েছি হৃদি মন।
বসন্তের ঢেউ কখনও কখনও এসে জানান দিয়ে যায়
পলাশ শিমুল আজও রঙিন হয় শুধু আমি থাকি নির্জনতায়
এভাবেই জীবন বিজনে অন্ধকার নেমে আসে ঠোঁটে
তবুও তোমাকে খোঁজার অবিরাম চেষ্টা
‘জরায়ুর নাড়ি-ছিঁড়ে’ অন্ধকার সরিয়ে সূর্যমুখী ভোরের আলোর নিশানা
আমি আজও হেঁটে চলি আর খুঁজে ফিরি তোমাকে

 

 

বৃন্দাবন দাস-এর একটি কবিতা 

 

ওরা মানুষ হোক

‘মানুষ বড় কাঁদছে’
খুব সস্তার কথা বলেছিলেন তিনি
আজ থাকলে বলতেন
মানুষ তুমি খুন হওয়ার জন্য তৈরি থেকো

‘সবার উপরে মানুষ সত্য’
তাহার উপর নেতা দালাল চামচি
তাহার উপর বলাৎকারের বলী
রঞ্জিত হয়ে আছে সংকল্পের ডেরা

মানুষ কোনোকালে সত্যি কাঁদে না
মানুষ কোনোকালে সত্যি মরে না
মানুষ কোনোকালে সত্যি ভিক্ষা চায় না
কোনোকালে রুগ্ন হাত পেতে দাঁড়ায় না দরজায়

ভিক্ষার ঝুলি কতকগুলো নুলো খ্যাবলার
পথ জুড়ে পড়ে থাকে অন্ধ স্তাবকের দল

মানুষ ক্ষমা জানে
মানুষ প্রার্থনা জানায়—
ওরা মানুষ হোক
শুধু মানুষের মতো হাত-পা নিয়ে নয়—

 

সাহানাজ ইয়াসমিন মুনমুন-এর একটি কবিতা 

 

 

মহাজন

শোষকের নাম ভারী, বড় তিনি মহাজন
রণে বনে জঙ্গলে কঠোর তাঁর অনুশাসন!
বিঘের পর বিঘে জমি করলো দখল
ভিটে মাটি হারা ওরা পরিযায়ী তখন!

বহু কষ্টে কিনেছিল জমি হারাধন
কেঁদে কেঁদে ধরলো পা, বাঁচাও মহাজন!
এই নে লাথি খা মুখ পোড়া, যা দূর হ…
প্রাণে বেঁচে আছিস, খোয়াবি কি তা শেষে?

তুললে আওয়াজ মরবি সবে
বলি,,বোধটা তোদের হবে কবে?
দেখলি না,কি মারটা মারলো সেদিন?
মহাজনের সাগরেদ ওরা গুটি কয়েক মিলে!

ওরে, জোর যার মুল্লুক তার
ভাব এবার, প্রাণটা বাঁচে কেমন করে?
গর্ত খুঁড়ে কুমির এনেছিস
ভাবিসনি কাজ করার আগে?

 

 

বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর একটি কবিতা

 

 

 

ইচ্ছে জীবন

চেয়েছিলাম— বাকিটা, পাখি-জীবন হোক…

সুদৃশ্য আকাশের বুকে উড়াল এঁকে, গড়ে তুলবো
স্মৃতির শহর
পড়ে রইলাম একা, নির্লিপ্ত
বুকের ডান পাশ ছুঁয়ে বয়ে গেল তুঙ্গভদ্রা কিংবা শতদ্রু
অখণ্ড জনকেলিতে লেখা হলো না, দীর্ঘ রোমাঞ্চকর
যাত্রার গল্প

আলপথে দাঁড়িয়ে থাকা সন্তানেরা আজও খোঁজে
ধ্রুবতারার নিশানার চিহ্ন
জীবনটা বেমালুম পড়ে রইলো, নক্ষত্রের অন্ধকারে
পাখিগুলো উড়তে উড়তে একদিন পশ্চিমা বাগানে
খুঁজে নিয়েছে— পরম তপস্যার নীড়…

অথচ একা আমি, হাল ভাঙা নাবিক
সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে লিখে যাচ্ছি, ইচ্ছে জীবন

 

 

তারক মণ্ডল-এর একটি কবিতা 

 

 

স্বপ্নের পথ

অন্ধকার ঘরের কোণে বুনেছি স্বপ্ন আমি
অপেক্ষায়, অবসানে দিন গুনেছি জানি।

হতাশার ছায়ায় ঢেকেছিল মন,
সাফল্যের আশায় ছিল যতক্ষণ।

দেখেছি সময় বদলায় বলে ,
অবিরাম পরিশ্রমে স্বপ্ন দোলে।

অধৈর্য হলে থেমে যাবে পথ,
ধৈর্যের আলোয় মিলবে শক্তির রথ।

পরিশ্রম, সাধনা—নেই তার শেষে,
প্রত্যেক ভুল শেখায় আগামির দেশে।

তাই তো বলি, হাল ছেড়ো না ভাই,
স্বপ্নের দুয়ার খুলবেই এক দিন, তাই!

 

 

🍂ধারাবাহিক দ্য | পর্ব ১৯

 

ভাষার আলোচনা— তা যে কোনও উপভাষারই হোক না কেন, তা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কারণ একটি উপভাষার আলোচনা হলেও তাতে ভাষা মাত্রেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। একটি উপভাষার তথা ভাষা মহাসমুদ্র। কোথায় যে সূচনা আর কোথায় যে শেষ, তা আবিষ্কারকরা সহজসাধ্য নয়। সেজন্যে Descriptive Linguistics বা বর্ণনাত্মক ভাষা-বিজ্ঞানের সাহায্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট বিভাগে ভাষার বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিভাগগুলো যে ভাষার মধ্যেই বর্তমান তা নয়। সহজ ও সুশৃঙ্খলভাবে একটি ভাষার সামগ্রিক বর্ণনা করার জন্যে ভাষাতাত্ত্বিকেরা ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology), ব্যাকরণ ( Grammar ), এবং বাগর্থ-বিজ্ঞান (Semantics) প্রভৃতি ক’য়েকটি শাখায় ভাষার বর্ণনাত্মক বিজ্ঞানকে বিভক্ত করে থাকেন। একটি ভাষার সামগ্রিক রূপের পরিচয় দেওয়ার জন্যে এ ভাগগুলো ভাষাতাত্ত্বিকদেরই সৃষ্টি।
রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১৯।

 

 

ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই

রেহানা বীথি 

 

 

১৯.

ভাষাতত্ত্ব : ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব

১৯৫২-৫২ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণা করতে বিষয়টির ব্যাপ্তি ও জটিলতায় বিস্মিত হন প্রফেসর আব্দুল হাই। তখন থেকেই বাংলা ভাষার যাবতীয় ধ্বনিতাত্ত্বিক সমস্যাসংক্রান্ত একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করার ইচ্ছে মনের মধ্যে পোষণ করলেও সময়স্বল্পতা ছিল প্রকট। পরবর্তীতে বিষয়টির দুরূহতার কারণে বাংলার ‘নাসিক্যধ্বনি ও নাসিক্যিভবন’—জাত একটি সমস্যাই শেষ পর্যন্ত বেছে নেন তিনি।

দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনার্স এবং এমএ শ্রেণীর পাঠ্য তালিকায় ধ্বনিতত্ত্বের পঠন-পাঠনের কিছু ব্যবস্থা থাকায় উক্ত বিষয়ে পাঠদানকালে এ ভাষার যাবতীয় ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা করতে গিয়ে তিনি বেদনাবিদ্ধ হয়ে পড়েন। মন হয়ে পড়েন অস্থির। তাঁর মনের সেই অস্থিরতা থেকে এই গ্রন্থের সূত্রপাত হয় এবং ‘সাহিত্য-পত্রিকা’য় ধারাবাহিকভাবে এ সম্পর্কিত প্রবন্ধসমূহ লিখতে থাকেন। এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহের মার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ হল এই গ্রন্থ ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’।

“বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব-বিষয়ক যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে সুশৃঙ্খল আলোচনার এটিই বোধহয় প্রথম প্রয়াস” — ভূমিকায় প্রফেসর হাই এমনটিই বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “ইউরোপ এবং আমেরিকায় ধ্বনি-বিজ্ঞানের আলোচনা যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে সে আলোকে বাংলা ভাষার যাবতীয় ধ্বনিতত্ত্বঘটিক সমস্যা সম্পর্কে আমি সব কথা যে বলতে পেরেছি এমন দাবী করি না, কারণ কোনও গবেষকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। বাংলা ধ্বনিগুণ ও ধ্বনিতরঙ্গের অধ্যায়টি ছাড়া অন্যান্য অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস। ধ্বনিতরঙ্গের স্বরূপ উদঘাটন করে বাংলায় স্বতন্ত্র অর্থবোধক ধ্বনিতরঙ্গের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য (type) -র সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং তাদের আরোহণ ও অবরোহণ ইত্যাদি প্রশ্নের চুলচেরা স্বরূপ উদঘাটনে কতটুক সাফল্য লাভ করেছি, তা ভবিষ্যৎ গবেষকরাই বলতে পারবেন।”

পাক-ভারত উপমহাদেশে আড়াই হাজার বছর পূর্বে যাস্ক্, পাণিনি ও পতঞ্জলি প্রমুখ ধ্বনিবিজ্ঞানী ভাষাধ্বনির চুলচেরা চুলচেরা আলোচনার সূত্রপাত করলেও দীর্ঘকাল পরে ইউরোপ আমেরিকায় প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই ভাষাতত্ত্বঘটিত বর্ণনাত্মক এ বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি ও বিস্তার সাধিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ বিজ্ঞান উন্নতির চরম সীমায় আসন লাভ করেনি। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ গবেষকগণ এ সম্পর্কে আরও জটিল ও দুরূহ তত্ত্বের অবতারণা করবেন এবং তার যথাযথ মীমাংসাও করবেন, সে বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এ বিষয়ে তাঁদের কৌতূহল উদ্রেক করার আশায় পূর্বসূরী দেশী ও বিদেশী পণ্ডিতদের পদানুসরণ করে তিনি এই গবেষণাগ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেন।

বাংলা ভাষার যাবতীয় উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক আলোচনা করতে পারলে এ-ভাষার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যেত। কিন্তু কারও একার পক্ষে তা সম্ভব নয়, সেকথা প্রফেসর হাই বিনয়ের সাথেই স্বীকার করেছেন। বাংলা ভাষার চলিত উপভাষা ছাড়া সম্পর্কে যেহেতু তাঁর জ্ঞান ছিল না, সেহেতু এ-গ্রন্থে আলোচিত সমস্যার বর্ণনায় তিনি চলিত উপভাষাকেই উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
তিনি মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাল্যকালে রাজশাহী শহরে প্রতিপালিত হন। স্কুল জীবনও সেখানেই অতিবাহিত করেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষালাভ করেন ঢাকা শহরে। দেশ ভাগের আগে অধ্যাপনার কারণে বহুদিন কাটান কৃষ্ণনগরে। কোলকাতা এবং তার পাশ্ববর্তী কৃষ্ণনগর ও নবদ্বীপ অঞ্চলের যে উপভাষা প্রফেসর হাই-এর সেই সময়েও শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেরই মুখের ভাষা এবং সাহিত্যের ভাষা, তাঁর শিক্ষা-দীক্ষায় চলিত ভাষাটি তিনি যেভাবে আয়ত্ব করেছিলেন, এ গ্রন্থে ধ্বনি-বিচারের জন্যে তাই-ই প্রধান উপকরণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন উপভাষার সামান্য ব্যবহার করেছেন তিনি। একটি মানুষের মুখের ভাষার মাধ্যমে একটি উপভাষার বর্ণনা করা বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের আধুনিক পদ্ধতি। এই আলোচনায় তিনি সে পদ্ধতিই গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তাঁর এই গ্রন্থটিকে বাংলা ভাষায় চলিত (Standard colloquial) উপভাষার বর্ণনা হিসেবেই গ্রহণ করা যেতে পারে।

ভাষার আলোচনা— তা যে কোনও উপভাষারই হোক না কেন, তা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কারণ একটি উপভাষার আলোচনা হলেও তাতে ভাষা মাত্রেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। একটি উপভাষার তথা ভাষা মহাসমুদ্র। কোথায় যে সূচনা আর কোথায় যে শেষ, তা আবিষ্কারকরা সহজসাধ্য নয়। সেজন্যে Descriptive Linguistics বা বর্ণনাত্মক ভাষা-বিজ্ঞানের সাহায্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট বিভাগে ভাষার বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিভাগগুলো যে ভাষার মধ্যেই বর্তমান তা নয়। সহজ ও সুশৃঙ্খলভাবে একটি ভাষার সামগ্রিক বর্ণনা করার জন্যে ভাষাতাত্ত্বিকেরা ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology), ব্যাকরণ ( Grammar ), এবং বাগর্থ-বিজ্ঞান (Semantics) প্রভৃতি ক’য়েকটি শাখায় ভাষার বর্ণনাত্মক বিজ্ঞানকে বিভক্ত করে থাকেন। একটি ভাষার সামগ্রিক রূপের পরিচয় দেওয়ার জন্যে এ ভাগগুলো ভাষাতাত্ত্বিকদেরই সৃষ্টি। এদের যে কোনও একটির সাহায্যে একটি ভাষার পূর্ণ বিবরণ দেওয়া যায় না; তার জন্য প্রয়োজন হয়, পৃথকভাবে পরস্পর সমন্বিত এ ভাগগুলোর সব ক’টির পৃথক প্রয়োগ। সুতরাং বলা চলে, এ বিভাগগুলোর প্রত্যেকটিই বর্ণনাত্মক ভাষা-বিজ্ঞানের পর্যায়ক্রমিক স্তর গঠনে সহায়তা করেছে। এদের মধ্যে ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) এবং ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology) বর্ণনাভিত্তিক ভাষা-বিজ্ঞানের প্রথম দু’টি স্তর হিসেবে পরবর্তী স্তরগুলোর ভিত্তি রচনা করে। বর্ণনাত্মক ভাষা-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাহায্যে একটি ভাষার পূর্ণ পরিচয় দিতে হলে, তার প্রাথমিক স্তর দুটোর বিশ্লেষণ অপরিহার্য। প্রফেসর হাই এ গ্রন্থে বাংলা ভাষা বিশ্লেষণের প্রাথমিক কাজ — অর্থাৎ সিঁড়ির প্রথম দুটো ধাপ নির্মানেরই প্রয়াস পেয়েছিলেন।

কোনও ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণনার সুবিধার জন্য কোনও কোনও ভাষাতাত্ত্বিক প্রথমে একটি শৃঙ্খলা বা ছক ঠিক করে নেয়ার পক্ষপাতী। তার কারণ, তাঁদের মতে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো বা ছকের মধ্যে ফেলে ভাষা বিশেষের ধ্বনিরূপের বর্ণনা করা অনেক ক্ষেত্রে সহজ হয়ে ওঠে। প্রফেসর হাই তাঁর ‘Nasals and Nasalization in Bengali’ গ্রন্থটিতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের প্রাক্তন অধ্যাপক জনাব জন রুপার্ট ফার্থ প্রবর্তিত এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু এ গ্রন্থে তা হুবহু অনুসরণ করেননি। পূর্ব নির্ধারিত পদ্ধতির মধ্যে ফেলে ভাষার ধ্বনিবিচারে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেত, ধ্বনির অবস্থানগত ও ব্যবহারিক রূপ থেকে এক একটি সমস্যা বিচার করে তিনি মনে করেছেন এখানে সেধরনের সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এ.মার্টিনের ‘Phonology As Functional Phonetics’ এর ধ্বনির ব্যবহার ও অবস্থান হয়েছে প্রফেসর হাই-এর মূল অবলম্বন।

ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) এবং ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology) -এর মধ্যে কোথায় মিল এবং কোথায় গরমিল রয়েছে সে সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যাপকতর অর্থে ধ্বনিবিজ্ঞান এবং ধ্বনিতত্ত্বের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই— বিভিন্ন নামে একই বিষয়ের তারা ওপিঠ-ওপিঠ মাত্র। কিন্তু সূক্ষ্মতর অর্থে তাদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বাক- প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে ধ্বনির গঠন ও শ্রুতি বিষয়ক যাবতীয় বর্ণনাই সংকীর্ণতর অর্থে Phonetics – এর বিষয়ভুক্ত; অর্থাৎ ধ্বনির গঠন, উচ্চারণঘটিত বর্ণনা, ধ্বনির শ্রুতি এবং ধ্বনির শুদ্ধ ও অশুদ্ধ উচ্চারণ সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন এ বিজ্ঞানের প্রাথমিক কাজ। সেজন্যে ভাষার ধ্বনিদেহের প্রাথমিক সোপান নির্ণয়ের ব্যাপারটিও Phonetics- এর আওতাভুক্ত। এর সাহায্যে ভাষার ধ্বনিসমষ্টির উচ্চারণ পরীক্ষা করে উক্ত ভাষার স্বতন্ত্র অর্থবোধক বিভিন্ন ধ্বনিমূলের আবিষ্কার এবং সেগুলোর অবস্থান(Distribution) ও যাবতীয় ব্যবহার বিধির বর্ণনা Phonetics -এর পরবর্তী পর্যায় Phonology -এর আওতাভুক্ত করেছেন প্রফেসর হাই।

আমেরিকার ধ্বনিতাত্ত্বিকেরা Phonology নামটির প্রতি খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। তাঁরা এই তত্ত্বটির নামকরণ করতে চান Phonemics. এ দুইয়ে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। বিভিন্ন পরিবেশে একটি ভাষার একটি ধ্বনির সম্ভাব্য সকল প্রকার উচ্চারণ-পার্থক্য বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার পর স্বতন্ত্র অর্থবোধক মূলধ্বনি নির্ণয় এবং তাদের লেখন পদ্ধতি আবিষ্কার আমেরিকার ধ্বনি বিজ্ঞানীদের মতে Phonemics -এর আওতাভুক্ত। ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ Phonology-র সীমা এর চেয়েও ব্যাপকতর বলে মনে করেন। একটি ভাষার একটি মূলধ্বনি স্থাপন ও নির্ণয়কল্পে তার যাবতীয় উচ্চারণ বৈচিত্র বিচার করা ছাড়া, সমগ্র ভাষায় ধ্বনিটির অবস্থা, বিচিত্র রকমের ব্যবহারের ফলে তার নানারকম পরিবর্তন লাভ, বাকস্রোতে অতিরিক্তি ধ্বনিমূল (Secondary Phoneme) সৃষ্টিতে তার দানের পরিমাণ প্রভৃতি তথ্যের আবিষ্কারও Phonology -র বিচার সাপেক্ষ। Phonetics এবং Phonology মূলত এভাবে একার্থ বোধক হয়েও সূক্ষ্মতর অর্থে ইউরোপীয় ধ্বনিবিজ্ঞানীদের কাছে পৃথক হয়ে গেছে। সেজন্য বাংলায় Phonetics কে ধ্বনির উচ্চারণ ও শ্রুতিঘটিত জ্ঞান বা ধ্বনিবিজ্ঞান এবং Phonology কে ধ্বনির ব্যবহারবিধি বিচার তথা ধ্বনিতত্ত্ব নামে অভিহিত করেছেন শ্রদ্ধেয় হাই সাহেব। বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে যে কোনও ভাষার ধ্বনি-দেহের সার্বিক বিচারে এ দুটো পরস্পরের পরিপূরক। “ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব” গ্রন্থে প্রতিটি বাংলা ধ্বনির অবস্থান ও ব্যবহার জনিত বিবিধ সমস্যা পরীক্ষা করে তাদের যথার্থ ধ্বনিতাত্ত্বিক স্বরূপ উদঘাটনই ছিল প্রফেসর আব্দুল হাই- এর লক্ষ্য।

তিনি বলেছেন, কোনও ভাষার ধ্বনি বিচার করতে হলে, বিশেষভাবে সে ভাষার (বিশেষত তার যে কোনও একটি উপভাষার) যাবতীয় ধ্বনি বিশ্লেষণ অপরিহার্য। এ কারণে সবার আগে প্রয়োজন হয় বাকপ্রত্যঙ্গের বর্ণনা করে তার কোন কোনটির সাহায্যে উক্ত ভাষার কি কি ধ্বনি গঠিত হয় এবং বাক্য ও শব্দের বিভিন্ন পরিবেশে তারা কিভাবে ব্যবহৃত হয়, তার বিচার করে দেখা। এই গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায় এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয়েছে। মোট দশটি অধ্যায়ের মাধ্যমে প্রফেসর হাই সমস্ত বিষয়গুলোকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। অধ্যায়গুলো হল :

প্রথম অধ্যায় – বাক্-প্রত্যঙ্গ,
দ্বিতীয় অধ্যায় – বাংলা স্বরধ্বনি,
তৃতীয় অধ্যায় – বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনি,
চতুর্থ অধ্যায় – বাংলার সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি,
পঞ্চম অধ্যায়- ধ্বনির অবস্থান,
ষষ্ঠ অধ্যায় – বাংলা শব্দ ও অক্ষর ভাগ,
সপ্তম অধ্যায়- বাংলা বাক্-প্রবাহ,
অষ্টম অধ্যায়- ধ্বনিগুণ,
নবম অধ্যায়- ধ্বনিতরঙ্গ এবং
দশম অধ্যায় – বাংলা লিপি ও বানান সমস্যা।

পাক-ভারত উপমহাদেশে যাস্ক্, পাণিনি ও পতঞ্জলি প্রমুখ ধ্বনিবিদই ধ্বনিবিজ্ঞানের উদগাতা ছিলেন। প্রফেসর হাই -এর সময়ের আড়াই থেকে তিন হাজার বছর পূর্বে তাঁরা সংস্কৃত ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে পাণিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তাঁর মত এত বড় ধ্বনিবিদ পৃথিবীতে আজও কেউ জন্মগ্রহণ করেছেন কি না সন্দেহ। আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ভাষাতাত্ত্বিক ব্লুমফিল্ডের মতে পাণিনির ব্যাকরণ ‘অষ্টাধ্যায়ী’ মানুষের বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পাণিনি পশ্চিম পাকিস্তানের (প্রাক্তন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের) মার্দান জেলার সোয়াবী তহসিলের অন্তর্গত সালাতুর (আধুনিক লাহুর) গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। এ বিজ্ঞান সাধনায় ইউরোপের লন্ডন স্কুলে হাতেখড়ি হলেও এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ পদ্ধতির ব্যাপারে পণিনিকেই আদর্শ হিসেবে মেনেছিলেন প্রফেসর হাই।
সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং নক্সা ও ছবির মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে তুলে ধরা এই বইটি তাই আজও অদ্বিতীয় আমাদের কাছে। ড. অমলেন্দু বসু এই বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন :
“তাঁর বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞান আমাদের ভাষায় অভূতপূর্ব গ্রন্থ। আমার মনে হয় না আগামী পঞ্চাশ বৎসরেও আব্দুল হাই-এর এই গ্রন্থ কোনো ক্রমেও ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।” (অধ্যাপক আব্দুল হাই- কম্পাস – ২৮ জুন ১৯৬৯ – ১৩ই আষাঢ় – ষষ্ঠ বর্ষ ২২শ সংখ্যা, পৃ ৫১৬) 🍁 (শেষাংশ পরবর্তী সংখ্যায়)

 

 

🍂গল্প
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জেনারেশনে সম্পর্কের রঙ বদল। কোথাও লোভ, প্রতারণা, উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে দৌঁড়চ্ছে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা। সম্পর্কের ভেতর নিখুঁত ‘প্রেম’-এর উপস্থিতির সন্ধান করেছেন, দর্পনা গঙ্গোপাধ্যায়। আজকের রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এ রইল শ্রীমতী গঙ্গোপাধ্যায়-এর ভিন্নস্বাদের গল্প, ‘আইবুড়ো’-এর প্রথম তিনটি পর্ব।

আইবুড়ো

দর্পনা গঙ্গোপাধ্যায়

 

 

এক.

সুহানা শ্রমনা সাহেলি তিন বন্ধু, তিনজনেই লেখাপড়া শেষ করে যে যার কাজে লিপ্ত রয়েছে।
সুহাস নামক এক জনৈক ব্যক্তি সুমনার অফিসে কাজ করে। শ্রমনার সুহাসের সঙ্গে মাখো মাখো প্রেম উদ্বেলিত। অফিস ট্যুরে দু’জনে অনেক এনজয় করেছে।

সুহাসের পরিবার থেকে পাত্রী হিসেবে সোহানাকে পছন্দ করেছে। সুহাস দুজনের সঙ্গেই সমান্তরাল প্রেম চালাতে শুরু করে,— সোহানার অফিসে সহেলী চাকরি করে, একদিন এক পার্টিতে সোহানা, সুহাসকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়, — সেখানে সহেলীকে দেখে সুহাস গদগদ হয়ে পড়ে। সুহানার চোখে যা খুবই খারাপ দেখায়। এরপর থেকে সুহানা সুহাসকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
সুহাস তখন অফিসের শ্রমনাকে সময় দিতে এতই ব্যস্ত যে সোহানার দিকে লক্ষ্য দিতে ভুলেই যায়। মাঝে মাঝে সহেলীকে ফোন করলে সহেলী কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত এক পাত্রকে বিয়ে করে স্ট্যাটাসে ছবি ছাড়তে শুরু করে। সুহাস আবারও সুহানার দিকে তাকায়। শ্রমনা জানায় সে বসকে এ মাসেই বিয়ে করেছে।
বেচারা সুহাস!
এখন অবশিষ্ট সুহানা
রাতে আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ সুহানা কে বলে, একবার শোনো— আমি রাস্তায় তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি!
সুহানা মাকে বলে বেরিয়ে বলল, রাস্তায় কেন?
বাড়িতেই তো আসতে পারতে— সুহাস বলল, এই স্কুটারটা কিনলাম তোমার জন্য—
সংসার করার ইচ্ছা আছে তো? চলো। আর দেরি নয়, —
সোহানা বলল, — ভাবছি!🍁

 

 

 

দুই. 

অনিন্দ্য বাবু অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্টে সরকারি চাকরি করতেন। এখন রিটায়ার। রিটায়ার করে প্রচুর টাকার মালিক। তবুও তার আশ মেটেনা,—
এখন তিনি শেয়ারের টাকা খাটিয়ে বছরে লাখ পাঁচেক আয় করেন।
অনিন্দ্যবাবু স্ত্রী আদরে এক তো তো মহিলা। খেয়ে পরে মেখে ঘুমিয়ে দিনাতিপাত করেন। রান্নাবান্না সংসার ধর্মে তার মন খুব কম।

আনন্দ বাবুর ছেলে অর্ণব।
অর্ণব আ বিগ জিরো
অনিন্দ্য বাবু, অর্ণবের পেছনে লেখাপড়া গান-বাজনা শেখানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন টাকাও খরচ করেছেন কিন্তু মাথামোটা একগুঁয়ের রাগী জেদি ছেলে কোথাও কোনও ভালো ফল করতে পারেনি।

অনিন্দ্যবাবু তাকে বোম্বে পাঠিয়ে সঙ্গীতে নাম করানোর চেষ্টা করেন। অবশেষে একটা সিনেমার সাইড সিনে অভিনয় করে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসেন।
এরপর তাকে ব্যাঙ্গালোরে আইটি সেক্টরে কাজ করার জন্য লোকজন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেন কিন্তু এবারও সে নিজের খরচটুকু চালাতেও অক্ষম হয়ে ফিরে আসে।

অগত্যা বাড়িতে বসেই শেয়ার মার্কেটে টাকা খাটানো কাজে নিযুক্ত করে অর্ণবের বাবা, কিন্তু সে এমনি একটি শেয়ার কিনে বসল যে লশ খেয়ে গেল,
আর তো টাকা নেই! তাই শেয়ার কেনা বন্ধ।
ছোটবেলায় অর্ণব একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু মেজাজ আর জেদের জন্য মাত্র কিছু বছরের মধ্যে সে অন্য বিয়ে করে নেয়। অর্ণব কে ছেড়ে—
অবশেষে এক গ্লাসের বন্ধু দীনু অর্ণবের জন্য একটি পাত্রী দেখে দেয়।
মেয়েটি অর্ণবের হাটুর বয়সী।
তার পরিবার ভারী অভাবী, তাই তার মা ভাবল ঠিক আছে, বাবার টাকা তো আছে একটু মানিয়ে গুনিয়ে চললে অসুবিধা হবে না।
অভাবী ছোট মেয়েটি তবুও অর্ণবকে বাজিয়ে দেখতে চাইলো,—
অর্ণব প্রতিবারই ফেল করতে লাগলো। মেয়েটি কিছুতেই অর্ণবকে বিশ্বাস আর ভরসা করতে পারল না। অর্ণব শেষে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও মেয়েটি কিছুতেই ক্ষমা করতে রাজি হল না।
প্রতিবারই ঝগড়া হলে বলে তুমি অন্য ছেলে দেখে বিয়ে করে নাও অভাবী মেয়েটি অভাবী হওয়ায় কেউই তাকে পছন্দ করতে পারে না, তাই বারবারই অর্ণবকে ক্ষমা করে দেয়।
আবার কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করে। এবার একটি পাত্র রাজি হয়ে এগিয়ে এল বিয়ে করতে, সঙ্গে আরো দু’টি পাত্র—
গরিব দুঃস্থ মেয়েটি একটা খোলা জানালা পেয়ে গেল।
কে জানে আগামী কেমন হবে—

 

 

 

 

তিন.

রুপম ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র পুত্র। বাড়ি, গাড়ি, দোকান, জমি-জমা কোনও কিছুরই তার অভাব নেই। এই আবহে সে বেশ বেড়ে উঠেছে। যথা সময়ে কুসুমকলি প্রেমিকাও জুটে গেল।মোটরবাইক ছুটিয়ে প্রেম প্রগাঢ় হল ক্রমে।
কুসুমকলি অভাবী ঘরের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট,— রুপমের অর্থে সে বলিষ্ঠ হয়ে লেখাপড়া চালাতে লাগলো,—
ধীরে ধীরে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক গ্রাজুয়েশন Masters, B.ed এসব করে নেট, সেট পরীক্ষায় বসতে শুরু করে।
অপরদিকে রুপমের পকেট কেটে শাড়ি গয়না লেখাপড়ার বিপুল ব্যয় সবই চালিয়ে যায়।
অবশেষে সে একটা কলেজে প্রফেসারিও পায়। রুপম কুসুম কলির সার্থকতাকে নিজের সফলতা ভেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। ওদিকে প্রফেসারি পাওয়ার পর রুপমের সঙ্গে মেলামেশা একেবারেই কমিয়ে ফেলে কুসুম কলি।
কারণ হিসেবে বলে সে খুবই ব্যস্ত। তাছাড়া তার সঙ্গে সে ঘোরাঘুরি করলে তার ছাত্রছাত্রীরা তাকে অমান্য করবে।
রুপম বলে ঠিকই তো!
চলো আমরা বিয়ে করে নিই— আর অপেক্ষা কিসের?
কুসুম কলি জানায়, এসময় সে বিয়ে করতে পারবে না।
তার হায়ার স্টাডি অর্থাৎ পিএইচডি করতে হবে।
রুপম বলে সে তো অনেক বছর লেগে যাবে।
কুসুম কলি বলে সে তো লাগবেই। রুপম চুপ করে যায়—
এদিকে রুপমের বাড়ির লোক বিয়ের জন্য অন্য মেয়ে দেখতে থাকে, রুপম কুসুম কলিকে ছাড়তে পারে না তাই তার গল্প সব মেয়েকেই বলতে থাকে, সব মেয়েই তার গল্প শুনে তাকে বিয়ে করতে নাকচ করে দেয়।
এভাবেই দীর্ঘ ১৩ বছর পর কুসুম কলি একজন প্রফেসরকে রূপমকে লুকিয়ে বিয়ে করে নেয়।
রুপম জীবন থেকে ১৩ বছর হারিয়ে বাড়ির জিনিসপত্র উত্তেজিত হয়ে ভাঙচুর করতে থাকে,—
প্রতিবেশীরা তাকে পাগলা রূপম বলে।

 

 

🍂দু’টি গদ্য

 

অমিত পাল

পৈশাচিক উল্লাস

 

 

ছাগলটা আমাকে দেখেই ছুট দিল৷ যেমনটা বাঘকে দেখে হরিণ ছুট দেয় ঠিক তেমনটা৷ আমার কাতর আবেদনেও সে সাড়া দিল না৷ মনে হল আমি যেন তার কাছে অনেক দিনের অপরিচিত৷ আমি তাকে জোরপূর্বক ধরতে যাইনি৷ স্নেহের আদরটুকুই করতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু কে কি বোঝে, হায়!
পাশের ভাঙা দালানটা থেকে দেশী চোলাই মদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে-বাতাসে৷ বুঝলাম, ছাগলটা সেখান থেকেই পালিয়ে এসেছে৷
ক’য়েকজন এগিয়ে এল আমার কাছে হঠাৎ৷ খোঁজ নিল ছাগলটার ব্যপারে৷ আমি দিইনি৷

মায়ায় ভরে উঠল এই দৃশ্যে৷ তাদের মুখে সক্রিয় হয়ে উঠেছে উন্মাদনার উল্লাস আর পৈশাচিক হিংস্রতার কুটিল হাসি…🍁

 

 

ঐ শিশু কোকিলটি 

 

আমার ঘরের জানালার বাইরে পেঁপে গাছের পল্লব অন্তরালে এই অপ্রত্যাশিতভাবে আগমন নিছক কল্পনা নয়৷
একটি শিশু কোকিল আসল৷ বসল হাতির মতো দাঁত বের করা পেঁপেগাছের পাতাযুক্ত ঐ ডালটায়৷ তার চোখে আবেগ মিশ্রিত— তা আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি৷
গাছে তখনও সবুজ সবুজ কাঁচা পেঁপে নিছক খেতে আসেনি সে৷ আমি হঠাৎ মনকে সংযত করতে পারলাম না৷ আমি নিজেও যেন কোকিলকণ্ঠী হয়ে সকালের রাগ মিশ্রিত পাখির ডাক তুললাম…
সে বিস্মৃত হয়ে চেয়ে দেখল চারিদিক৷ ঘাড়টা ঘুরছে তো ঘুরছে বারবার৷ চারিদিকে শুধু একরাশ চাহনি ফেলছে…
কেন তার এমন বিস্ময়? এর সঠিক উত্তর আমি দিতে পারব না৷ হয়তো বহু প্রাচীন কিছু খুঁজছে…🍁

 

 

সম্পাদক : দেবব্রত সরকার | কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকার | অঙ্কন : প্রীতি দেবআন্তর্জালিক 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

 

সম্পাদকীয় ঋণ : ফিরে পড়া : প্রবন্ধ, মহামিলনের কথা বিভাগের লেখা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত।

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment