মেধা পাল ★ সাশ্রয় নিউজ ডেস্ক, কলকাতা : টলিউডে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। অভিজ্ঞ শিল্পীদের একাংশ মনে করেন, আজকের নবীন প্রজন্মের ধৈর্য কম, পরিশ্রমের মানসিকতাও কমে যাচ্ছে। জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৈত্রেয়ী মিত্র (Maitreyee Mitra) সেই ধারণাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। তাঁর মতে, দোষ ছোটদের নয়, তাদের তৈরি করার দায়িত্ব ছিল সিনিয়রদের ওপর। আর হয়ত সেই দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করা হয়নি।
অভিনয়ের জগতে দীর্ঘদিন ধরে নিজের জায়গা তৈরি করেছেন মৈত্রেয়ী। কিন্তু তাঁর যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল একেবারে হাতে-কলমে শেখার মধ্য দিয়ে। কোনও ইনস্টিটিউট নয়, তাঁর শিক্ষক ছিলেন মঞ্চ ও পর্দার বিশিষ্ট অভিনেতারা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় (Pijush Ganguly), ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (Bhaskar Banerjee) -এর মতো মানুষজন। সেই সময়কার অভিজ্ঞতা এখনও তাঁর মনে দাগ কেটে আছে।অভিনেত্রীর কথায়, “চিত্রনাট্য হাতে পেলেই আজও পীযূষদার কথা মনে পড়ে। প্রতিটা দৃশ্যে, প্রতিটা সংলাপে তিনি যেভাবে নিখুঁত ভাবে আমাদের গাইড করতেন, সেটা ভাবলেই এখনও শেখার ইচ্ছে জেগে ওঠে।”
মৈত্রেয়ীর মতে, এখনকার দিনে সেই আদানপ্রদান বা পারস্পরিক শেখার পরিবেশটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। একদিকে প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া, আর অন্যদিকে দ্রুত সফল হওয়ার মানসিকতা, এই সব মিলিয়ে অনেক সময়েই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে যে ‘দেওয়া-নেওয়া’ সম্পর্ক থাকা উচিত, সেটা আর দেখা যায় না।
তিনি খোলাখুলি বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম কী রকম, সেই আলোচনায় না গিয়ে আমি মনে করি, আমরাই হয়ত উপযুক্ত সিনিয়র হতে পারিনি। আমাদের সিনিয়ররা অনেক উপযুক্ত ছিলেন বলেই আমাদের তৈরি করতে পেরেছিলেন। আমরা নই বলে পারছি না।’ তাঁর এই বক্তব্যে স্পষ্ট এক আত্মসমালোচনার সুর। যেখানে তিনি দোষারোপ না করে, দায়িত্ব নিচ্ছেন নিজ প্রজন্মের সীমাবদ্ধতার।
অভিনয় জগতের সিনিয়র অভিনেতাদের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গি বিরল বললে ভুল হবে না। কারণ বেশিরভাগ সময়েই শোনা যায় অভিযোগ, ‘নতুনরা শোনে না’, ‘তাদের মধ্যে বিনয় নেই’, ‘ধৈর্য নেই’ ইত্যাদি। কিন্তু মৈত্রেয়ী একেবারে বিপরীতভাবে বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁর মতে, একজন সিনিয়র শিল্পীর কাজ শুধু অভিনয় শেখানো নয়, এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যাতে জুনিয়ররা স্বচ্ছন্দে শিখতে পারে, ভুল করতে পারে, এবং নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। সেই জায়গায় হয়ত আজকের সিনিয়র প্রজন্ম কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে।অভিনেত্রীর এই কথায় প্রতিফলিত হয়েছে এক গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে সিনিয়ররা জুনিয়রদের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নয়, ‘সহযাত্রী’ হিসেবে দেখেন।
এই মুহূর্তে মৈত্রেয়ীকে দেখা যাচ্ছে জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘শোলক সারি -তে (Sholok Sari)। সেখানে তিনি অভিনয় করছেন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে, যা দর্শকদের মন ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু টেলিভিশনের ব্যস্ত সময়সূচীর মধ্যেও তিনি ভোলেননি তাঁর অভিনয়ের মূল শিক্ষাগুলো। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যত অভিজ্ঞই হই না কেন, প্রতিটা নতুন চরিত্র মানে নতুন শেখা। যদি সেই শেখার মনোভাবটাই হারিয়ে ফেলি, তাহলে শিল্পী হিসেবে বেঁচে থাকাই বৃথা।’ এই কথাতেই যেন ধরা পড়ে মৈত্রেয়ীর পুরো দর্শন।মঞ্চ থেকে পর্দা, দুই জায়গাতেই সফল এই অভিনেত্রী বিশ্বাস করেন, অভিনয় শুধুই টেকনিক নয়, এটি একটি মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া। নিজের চরিত্রে ডুবে যাওয়ার আগে তিনি খুঁজে দেখেন তার মানবিক দিকটি। আর সেই শেখার চর্চা এখনও তাঁর মধ্যে একই রকম সক্রিয়।
এই সময়ের অনেক তরুণ শিল্পীরাই তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। কারণ তাঁর মন্তব্যে কোনও রাগ নেই, নেই অভিযোগের সুর, আছে এক ধরণের আত্মসমালোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা। অনেকেই মনে করেন, টলিউডের পরিমণ্ডলে এমন স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা বিরল। বিশেষ করে যখন প্রজন্মের ব্যবধান নিয়ে প্রায়ই দেখা যায় বিতর্ক। কেউ বলেন নতুনরা খুব তাড়াতাড়ি বিখ্যাত হতে চায়, কেউ বলেন পুরোনোরা জায়গা ছাড়তে চান না। কিন্তু মৈত্রেয়ীর কথায় আছে ভারসাম্য, যেখানে দোষ-গুণের বিচার না করে তিনি খুঁজে নিচ্ছেন উন্নতির সম্ভাবনা।
তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু অভিনয়ের জগতে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ যে কোনও কর্মক্ষেত্রেই প্রজন্মের মধ্যে বোঝাপড়া, সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছাড়া টিমওয়ার্ক সম্ভব নয়। তাই মৈত্রেয়ীর এই মন্তব্য শুধু বিনোদন দুনিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে এক সামাজিক বার্তাও দেয়, ‘সমালোচনার চেয়ে সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ অনেক বেশি ফলপ্রসূ।’ অভিনেত্রীর এই কথাতেই যেন লুকিয়ে আছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বড় শিক্ষা, একজন শিল্পীকে বড় করে তোলে কেবল প্রতিভা নয়, তাঁর মানবিকতা, বিনয় এবং শেখার ইচ্ছাও।
ছবি : সংগৃহীত




