



গদ্য🦋
ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিবর্তন, পৌরাণিক ইতিবৃত্ত, সাহিত্য দর্শনের নানা স্মারক, প্রত্নতাত্ত্বিক আহরণ প্রভৃতি যা সম্পূর্ণ করে সমাজবৃত্তকে-তা সবই ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম সমাজতাত্ত্বিক হলেন এ.আর দেশাই, যোগেন্দ্র সিংহ, সতীশ সবেরওয়াল। লিখেছেন : অন্তরা বিশ্বাস
সমাজতত্ত্বের ভাবনা
ভারতবর্ষে নতুন মনে হলেও সমাজ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ভারতে সেই সুদূর অতীতকাল থেকে চলে আসছে তার নিজেস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে, ভারতীয় দর্শনের অভিব্যক্তিতে। সমাজ যদি মানবজাতির এক ধারণা সম্ভূত ক্ষেত্র হিসাবে ধরা হয় তবে যাঁরা মনুষ্যত্বের বাণী প্রচার করেছেন তাঁদের তত্ত্বকে কি মনুষ্যত্ব নির্ভর সমাজতত্ত্ব বলে আখ্যা দেওয়া যায় না? ধর্ম, মনুষ্যত্ব, জীবন, দর্শন, সমাজ ভাবনার বিচিত্র অভিব্যক্তি ছড়িয়ে আছে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, মনুসংহিতা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র,শংকরাচার্যের দর্শন, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এর মতো আরও অনেক রচনায়। বৈচিত্র্যের ভিতর ঐক্যের পীঠস্থানে এই ভারত বর্ষে সনাতন আধ্যাত্মিকতার উৎপাদনকেই মনুষ্য জীবনের বেঁচে থাকার মূল সূত্র হিসাবে ধরা হত। কিন্তু ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনার পর সমাজ চেতনার পরিবর্তন হল। রাজতন্ত্রের সমাধির পর সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক মানবিক সব দিকেই একটা অস্থির আলোড়ন সৃষ্টি হল। ভারতের সমাজ ভাবনায় ধর্ম নির্ভর মনুষ্যত্বের ঐতিহ্য ভেঙ্গে পড়ল। “ভারতের ললাট তখন পরাধীনতার কলঙ্ক কালিমালিপ্ত। জনসাধারণের ভবিষ্যত তখন অন্ধকারময়… প্রেম, পবিত্রতা, নিঃস্বার্থপরতা, প্রভৃতি ধর্মের উচ্চ আদর্শ গুলো তখন জীবনে রূপায়িত না হইয়া কতকগুলি প্রাণহীন আচার অনুষ্ঠান মাত্রে পর্যবসিত ।”
ভারতের এই ঘোর অমানিশার অন্ধকার কাটানোর জন্য স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, কেশবচন্দ্র, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান, দাদাভাই নৌরজী এমন অনেক সমাজ সংস্কারক নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এদেরই হাত ধরে ইতিকর্তব্য চিন্তাধারার মাধ্যমে সমাজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, আন্তঃমানবিক সম্পর্কের সঠিক দিশা নির্ধারিত হয়। এদের সেই অর্থে সমাজতত্ত্ববিদ হয়ত বলা যায় না। ভারত বর্ষে সমাজ তত্ত্বের উদ্ভব বিষয়টা ঘিরে নানা ধরনের আলোচনার মধ্যে অনেকেই বলে থাকে আগে সমাজতত্ত্বের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। অধ্যাপক এম এন শ্রীনিবাস এবং এম এন পানিনি ভারতে সমাজ তত্ত্বের উদ্ভব এবং বিকাশকে তিনটে পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায় (১৭৭৩-১৯০০), (ভিত্তিমূলক) দ্বিতীয় পর্যায় (১৯০১-১৯৫০), (পেশাদারীকরণ), তৃতীয় পর্যায় (১৯৫০ থেকে আজ পর্যন্ত)।
ভারতীয় সমাজ পর্যালোচনার ক্ষেত্রে যে সব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়, তাহল ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য প্রভৃতির বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশ সংলগ্ন দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থা আর তার উপাদানগুলো সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গি। এই বিষয়ে একটা গুরুত্ব পূর্ণ উজ্জ্বল দিক হল এই যে সংস্কৃত নিষ্ঠ ভারতীয় সমাজবোধ জগত সংস্কারকে এক অখণ্ড সমগ্র হিসাবে ধরে নিয়ে জগত সংসারের ঘটনা বিষয়কে অনিবার্যভাবেই পরস্পর নির্ভরশীল বলে গণ্য করে আসছে। সংস্কৃত ধর্ম কথাটা এই তাৎপর্যই বহন করে আর তার মূল কথা এই যে ব্যক্তিমানুষ ও সমষ্টি গত সমাজ যে সকল ধ্যান ধারণা ও আচরণ গত রীতিনীতি অনুসরণ করে জীবন নির্বাহ করবে তাতে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক এই উভয় দিকই উপস্থিত থাকবে। ভারতীয় সংস্কৃতি সভ্যতা ও দর্শনের মূল সুর ধ্বনিত হয় সেই বৈদিক যুগের ঋষিদের প্রাজ্ঞ উচ্চারণে। বেদ মানে জ্ঞান কিন্তু সেই জ্ঞান ছিল উচ্চমার্গের। শুধুমাত্র জাগতিক ও বস্তুতান্ত্রিক জ্ঞান সাধনা নয়, পরমার্থ চেতনা সেই জ্ঞানের আসল স্বরূপ। প্রাচীন বৈদিক শিক্ষার গভীরতম তাৎপর্য ছিল একটা বিশিষ্ট ও বিরাটতম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবন মৃত্যু সমস্যা ইহলোক, পরলোকের সমস্যা বস্তুগত ও নৈতিক জীবন চর্চার শিক্ষা, জৈবিক ও আধ্যাত্মিক দিকের শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে দার্শনিক ও বস্তুগত নির্দেশ নির্দেশিত করা। ভারততাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সামাজিক গতিশীলতা বিষয়টা অনুধাবন আর তার দিক নির্দেশ। ভারতের একদল কৃতী সমাজতাত্ত্বিক তাঁদের বিভিন্ন রচনায় ভারতের সমাজ পরিবর্তন, উন্নয়ন, ও প্রগতি সম্পর্কে দিক নির্দেশ দিয়েছেন। বস্তুত ভারতবর্ষ ছিল এক সময় কু-সংস্কার ও রক্ষণশীলতায় বন্দী তারপর বিভিন্ন শাসক ও শেষে ইংরেজের দ্বারা প্রায় দুশো বছর শৃঙ্খলিত। তারপর পাশ্চত্য সভ্যতার স্পর্শে, আধুনিকতার অনুসরণে সমাজ কাঠামোয় কী ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ও তার বিচিত্র অভিমুখ – সেটার বিশ্লেষণ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ভারতীয় বর্ণাশ্রম প্রথার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সামাজিক একীকরণের চিত্রটা প্রকট হয়। সেই প্রথার প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক সচলতার সৃষ্টি। এই দু’টোই এক্ষেত্রে আলোচ্য হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন এম. এন শ্রানিবাস আর এ. আর দেশাই, এস.সি দুবে, রামকৃষ্ণ মুখার্জী, যোগিন্দর সিং প্রমুখ সমাজতাত্ত্বিকগণ।
ভারততাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় সমাজ বিশ্লেষণের যে মূল সূত্রগলো প্রতিষ্টিত হয়, তাতে ভারতের ঐতিহ্যে মানবিক ধর্মই ছিল মূল সুর। এমন সমাজ দর্শন অতুলনীয়। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি বাস্তব জগৎকে উপযোগী করে তোলার বিশেষত্বও ছিল এর মধ্যে। ভারতীয় সমাজ অধ্যয়নে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনার যে সকল উপাদান হিসেবে যে সকল বিষয় অধিক চর্চিত, সেগুলির মধ্যে গ্রামভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, সামাজিক শ্রেণী, স্বনির্ভর গ্রাম্য অর্থনীতি, ব্রিটিশ পূর্ববর্তী ভারতীয় সমাজ, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে সামাজিক পরিবর্তন,কৃষক বিদ্রোহ, জাত ব্যবস্থা প্রভৃতি।
প্রাচীন মুনিঋষির ভারতে যে জীবন ও সমাজ দর্শনের সৃষ্টি তার অনেকদিন ধরে আবিষ্ট করে রেখেছে ভারতীয় সংস্কৃতি আর রক্ষণশীল ঐতিহ্যকে তার ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে মূল্যবান সম্পদ। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের ভারতীয় সমাজের জাত ব্যবস্থার পরিবর্তন, পরিবার সংগঠনের পরিবর্তন, গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তর, কুসংস্কার থেকে বিজ্ঞান মনস্কতা, ঐতিহ্যের উপর আধুনিকতা ও পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রভৃতি একাধিক জরুরি বিষয়গুলো সম্পর্কে গভীরতা প্রদান করে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি, বিকাশ আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নের পথ দেখায়। পাশাপাশি ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিবর্তন, পৌরাণিক ইতিবৃত্ত, সাহিত্য দর্শনের নানা স্মারক, প্রত্নতাত্ত্বিক আহরণ প্রভৃতি যা সম্পূর্ণ করে সমাজবৃত্তকে-তা সবই ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম সমাজতাত্ত্বিক হলেন এ.আর দেশাই, যোগেন্দ্র সিংহ, সতীশ সবেরওয়াল।
ভারতীয় সমাজ অধ্যয়নে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল তার হল কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজতত্ত্ব বিদ ড: ডি.এন মজুমদার যেমন উল্লেখ করেন যে : Man, Area, Resource, Cooperation এই চারটি বিষয় নিয়েই পারস্পরিক সম্পর্ক উপর সমাজের কার্য আর কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভারত বর্ষে কার্ল মার্কসীয় বিশ্লেষণে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটে ১৯৪৩ সালে। ভারতবর্ষের ইতিহাস বিচিত্র। মার্কসীয় দর্শনকে সামনে রেখে বলা যায় ভারতবর্ষেও ক্রীতদাস প্রথা ছিল। শোষণ আর অত্যাচার ছিল। অবশেষে হল সামন্ততন্ত্রের উন্মেষ। সেখানেও সেই একই চিত্র-সামন্ত প্রভুদের শোষণ আর অত্যাচার। শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় সামন্ত প্রভুরা হয়ে গেলেন শিল্পপতি।শোষিত কৃষক হল শোষিত মজুর। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিকদের যাঁদের মার্কসীয় দর্শন অনুপ্রানিত করেছে তারা সমাজকে সেই দৃষ্টি ভঙ্গির প্রেক্ষাপটে বিচার করেছেন। বিশ্লেষণ করেছেন। ভারতবর্ষের পটভূমিকায় মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আরও পড়ুন : Motivation : PEARLS OF WISDOM TO BOOST YOUR MOTIVATION
যদিও অতি সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মার্কসবাদী শাসনের অবসান, সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি, মার্কসীয় তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় সমাজ তন্ত্রের ভবিষ্যত দিক নির্দেশনার অসম্পূর্ণতার জন্য সমাজতাত্ত্বিক গণ একে বিচ্যুতই ধরেছেন।
আবার Sub alter perspective দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি দেখা যায় তবে পুঁজিবাদী যন্ত্র সভ্যতার নিচে চাপা পড়া বিস্মৃত, অবহেলিত, পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী যাদের জীবন যন্ত্রণা, নিপীড়ন, হতাশা বঞ্চনা, ব্যর্থতা ও পরাজয় ভরা। এই মানুষ গুলোর ইতিহাসই তলা থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল উপাদান। সত্তরের দশকে ভারতবর্ষে এই Sub alter studies র সূত্রপাত বলা চলে। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত রণজিৎ গুহ তাঁর Elementary Aspect of Peasant Insurgency in Colonial India বইতে উল্লেখ করেছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে শতবর্ষাধিক কৃষক বিদ্রোহের উল্টোদিকের ইতিহাস। Sub alter studies এর প্রবক্তা ও সমর্থকরা এটা বুঝেছিলেন যে, বিদ্রোহী কৃষক এক স্বকীয় সৃজনশীল ও বিশিষ্ট চৈতন্যের অধিকারী। তাকে পাথেয় করেই ঐতিহাসিকের উচিত উচ্চবর্গের উপর কীভাবে নিম্ন বর্গকে স্থাপন করা যায়। সেই প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে অনুশীলন করা। তবে এটাও ঠিক নিম্নবর্গের ইতিহাসের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ইতিহাসের সামগ্রিকতা অর্জন সম্ভব নয়। কারণ নিম্নবর্গ গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারবে না। তার ইতিহাস অনিবার্য ভাবে আংশিক, অসংলগ্ন আর অসম্পূর্ণ।
আসলে সমাজতত্ত্ব বিষয়টা এতটাই বিস্তৃত যেখানে তাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে আমাদের ভারতবর্ষে আলোচনা করা হয়। বিবিধের মাঝে মিলনের ঐক্যের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারাই সবচেয়ে বেশি গ্রহণ যোগ্য।
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : American Indian Folktale : আমেরিকান ইন্ডিয়ান লোককাহিনী
