



সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে…
‘এই কলিতে শুধু সত্যের আঁট থাকলেই ভগবান লাভ হয়।’ -শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী
🍂প্রচ্ছদ কথা
করুণাময়ী শ্রীশ্রী মা সারদার জন্ম বৃত্তান্ত ও জীবনী
ভারতের আদর্শ মহিয়সী রমণীর মধ্যে অন্যতম, যিনি ভালোবাসা দিয়ে জগতকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি হলেন শ্রীশ্রী মা সারদা দেবী। উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাধনসঙ্গিনী ও পত্নী ছিলেন এই মহীয়সী নারী। তাঁরা উভয়েই অবিচ্ছিন্ন ব্রহ্মচর্য পালন করে অতিবাহিত করেছিলেন তাঁদের সম্পূর্ণ জীবদ্দশা। মা সারদা তাঁর সমগ্র জীবন স্বামী এবং তাঁর আধ্যাত্মিক সন্তানদের প্রতি সেবায় ও আত্মত্যাগে উৎসর্গ করেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যগণ সারদা মাকে মাতৃ আসনে বসিয়েছিলেন এবং গুরুর প্রয়াণে পরবর্তীকালে মায়ের কাছে ছুটে এসেছিলেন উপদেশ এবং উৎসাহ লাভ করার আশা নিয়ে। সারদা মা তাঁর জীবদ্দশায় এবং জীবন -পরবর্তীকালে ও তাঁর ভক্তদের কাছে মহাশক্তির আধার হিসেবে পূজিত হয়ে এসেছেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘ জননী সারদা মাকে তাঁর ভক্তরা শ্রী শ্রীমা নামে অভিহিত করে থাকতেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : হিন্দু পঞ্জিকার হিসাবে, অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে , (বাংলা ১২৬০ সনের ৮ পৌষ ) এবং ইংরেজি তারিখ হিসাবে ১৮৫৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার জয়রামবাটীর এক গরীব ব্রাহ্মণ পরিবারে সারদা দেবী জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী ছিলেন অতীব ধর্মপরায়ণ দম্পতি। জ্যেষ্ঠা কন্যা সারদা দেবী ছিলেন তাদের প্রথম সন্তান।জন্ম পরবর্তী নাম রাখা হয়েছিল “ক্ষেমঙ্করী” এবং পরে সেই নামটি পরিবর্তন করে রাখা হয় “সারদামণি”। কথিত আছে, সারদা দেবীর জন্ম -পূর্ববর্তী সময়ে রামচন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরী উভয়েই দিব্যদর্শনে মহাশক্তিকে তাঁদের কন্যারূপে জন্ম নিতে দেখেছিলেন।
শৈশব : অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন ছোট্ট সারদামনি । বাল্যকালে তিনি ঘরের নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম করার সাথে সাথে ভাইদের দেখাশোনা ও করতেন। পোষা গোরুদের আহারের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে, ক্ষেতের কাজ এবং প্রয়োজনে ধান কুড়ানোর কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষালাভ করেননি সারদা দেবী আক্ষরিক অর্থে তবে ছেলেবেলায় মাঝে মধ্যে ভাইদের সাথে পাঠশালায় যাওয়ার সুবাদে কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল তাঁর। তবে পরবর্তী জীবনে কামারপুকুরে বসবাসকরাকালীন শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী দেবীর কাছে মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেছিলেন বলে জানা যায়। বাল্যকালে তাঁর গ্রামে আয়োজিত যাত্রাপালার আসর থেকে বেশ কিছু পৌরাণিক আখ্যান ও শ্লোক আত্মস্থ করেছিলেন।কথিত আছে যে, শৈশবে পুতুলখেলার সময় লক্ষ্মী ও কালীর মূর্তি গড়ে খেলাচ্ছলে পূজা করতেন সারদামণি। সেই সময় তাঁর বিবিধ দিব্য দর্শন ও অভিজ্ঞতা হয়ে থাকত। ছোটবেলা থেকেই মহামায়ার ধ্যানে রত থাকতেন তিনি।
বিবাহ : মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ২৩ বছরের যুবক, ধর্মপ্রাণ রামকৃষ্ণ পরমহংসে দেবের সাথে সারদামণি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কঠোর ব্রহ্মচর্য অনুশীলনরত শ্রীরামকৃষ্ণের মা ও দাদারা মনে করেছিলেন যে বিবাহ পরবর্তী জীবনে তাঁর সাংসারিক ক্ষেত্রে মন বসবে। তবে নাবালিকা সারদা দেবী বিবাহের পরবর্তী বেশ কিছুকাল পিতামাতার তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাবর্তন করলে প্রায় ন বছর পর, চোদ্দো বছর বয়স্কা সারদা দেবী প্রথমবার তাঁর স্বামী দর্শন হেতু কামারপুকুরে আসেন। সেই সময়কালে সারদা দেবী তিন মাস শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বাস করেন এবং তখন থেকেই ধ্যান ও অধ্যাত্মিক জীবনের প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি লাভ করেন শ্রী রামকৃষ্ণের কাছ থেকে। সারদা দেবীর যখন আঠারো বছর বয়স তখন তিনি অবগত হয়েছিলেন যে তার স্বামী পাগল হয়ে গেছেন। তাঁর এ কথাও কর্ণগোচর হয়েছিল যে তাঁর স্বামী একজন মহান সন্তে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন। এই ঘটনার পর সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং পায়ে হেঁটে দক্ষিণেশ্বরে আসতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং কথিত আছে যে সেই সময়ে মা কালীরূপি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক নারী দিব্যদর্শন দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলার আশ্বাস দেন।
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে থাকাকালীন : ১৮৭২ সালে দক্ষিণেশ্বরে আসার পর সারদা দেবী তার সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতই এক মহান আধ্যাত্মিক গুরু। ১৮৮৫ সাল অবধি সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নহবতের একতলার একটি ছোটো ঘরে বাস করেছিলেন।
এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন এবং তাঁর পত্নী সারদাদেবীকে কালীর আসনে বসিয়ে পুষ্প ও উপাচার সহযোগ পূজা করেন। কারণ শ্রী রামকৃষ্ণ মনে করতেন অন্য সব নারীর মতন তাঁর স্ত্রী সারদামণিও দেবীর অবতার এবং এই কারণ বশত তাঁদের দাম্পত্য জীবনেও ছিল এক শুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রীকে সম্মানের একটি উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। সারদা দেবীকেই মনে করা হয় তার প্রথম শিষ্য।শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী ও শিক্ষা দান করেন। তিনি তাকে মন্ত্রশিক্ষা সহ মানুষকে দীক্ষিত করে আধ্যাত্মিক পথে সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে পারার শিক্ষাও প্রদান করেছিলেন। জীবনের অন্তিম লগ্নে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ গলার ক্যানসারে আক্রান্ত তখন সারদা দেবীই স্বামীর সেবা এবং তাঁর শিষ্যদের জন্য রন্ধনকার্যে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন।
কথিত আছে, ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর বৈধব্যের বেশে সারদা দেবী, স্বামীর দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে বলেছিলেন যে তিনি মারা যাননি, কেবল এক ঘর থেকে আর এক ঘরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর শ্রীরামকৃষ্ণ কর্তৃক অঙ্কুরিত ধর্ম আন্দোলনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন স্ত্রী সারদা দেবী।
তীর্থযাত্রা : শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের দুই সপ্তাহ পর তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে সারদা দেবী উত্তর ভারতে তীর্থ পর্যটনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। অযোধ্যা,কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির, ও কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন দর্শন করেন তারা। কথিত আছে, এই বৃন্দাবনেই সারদা দেবী নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেছিলেন এবং এই বৃন্দাবন থেকেই গুরুমাতা রূপে তাঁর আধ্যাত্মিক নবজীবনের সূত্রপাত ঘটে থাকে। সেই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের তিনি মন্ত্রদীক্ষা দান করেছিলেন। এই সময়কাল থেকেই শ্রীশ্রীমা রূপে তার স্বত্ত্বার শুভ সূচনা ঘটে। তাঁর মধ্যে যে ঐশ্বরিক আধ্যাত্মিক স্বত্ত্বা টি ছিল তার কারণে যাঁরাই সান্নিধ্যে এসেছিলেন তাঁরাই মা সারদা মাতৃসুলভ গুণটি আবিষ্কৃত করতে পারতেন।
কলকাতায় থাকাকালীন : তীর্থযাত্রার শেষে সারদা দেবী একাকি কিছু মাস বহু দুঃখ কষ্টের মধ্যে কামারপুকুরে অতিবাহিত করেছিলেন। ১৮৮৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ শীষ্যরা মা সারদাকে কলকাতায় নিয়ে এসে থাকার বন্দোবস্ত করে দেন এবং পরবর্তীকালে কলকাতার বাগবাজারে তাঁর জন্য স্থায়ী বাসভবনও নির্মাণ করানো হয় যা ‘মায়ের বাটী’ নামে পরিচিত। সেই স্থানে সারদা দেবী তাঁর জীবনের দীর্ঘতম সময় পার করেছিলেন। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত এই বাড়িতে মায়ের দর্শন, উপদেশ ও দীক্ষালাভের উদ্দেশ্যে জমায়েত হতেন। তাঁর মাতৃসুলভ ব্যবহার সকলের মনে এক পরম শান্তি জোগাত।শিষ্য ও ভক্তদের তিনি মনে করতেন নিজের আধ্যাত্মিক সন্তান।
মা সারদা ও শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলন : মা সারদা রামকৃষ্ণ সংঘে ও ভক্তসমাজে সর্বাধিক শ্রদ্ধার আসনে উপনীত হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে মা সারদা রামকৃষ্ণ আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কথিত আছে যে কয়েকজন শিষ্য মায়ের দর্শন লাভের পর আধ্যাত্মিক অনুভূতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন অবার কেউ কেউ তার সাক্ষাৎ দর্শনের আগেই দেবী রূপে তার দর্শন প্রাপ্তি করেছিলেন। আবার কেউ কেউ স্বপ্নে তাঁর থেকে দীক্ষা ও লাভ করেছেন বলে কথিত আছে যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহান নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ চন্দ্র ঘোষ।
জীবনের অন্তিম লগ্ন : ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে মা সারদা জয়রামবাটীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন যেখানে তিনি এক বছর কাটান। জয়রামবাটীতে অবস্থানরত শেষ তিন মাস মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে এবং ১৯২০ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। পরবর্তী পাঁচ মাস তিনি রোগযন্ত্রণায় অত্যন্ত কষ্টসহকারে জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯২০ সালের ২০ জুলাই রাত দেড়টায় কলকাতার উদ্বোধন ভবনে মাতৃ প্রতীম এই মহীয়সী রমণীর মহাপ্রয়াণ ঘটে। বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। এই স্থানটিতেই বর্তমানে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যমণ্ডিত শ্রীমা সারদা দেবীর সমাধিমন্দির।
উপসংহার : শ্রীশ্রী মা ছিলেন সকলের মা ; এই বিশ্বজগতের মা। স্বামী বিবেকানন্দ সারদা দেবীকে, জীবন্ত দুর্গা বলে অভিহিত করেছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা তাঁকে ‘সংঘ জননী’ বলে জানতেন। কুসংস্কার ও শিক্ষার অভাবে বিভ্রান্ত ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও চেতনা ফিরিয়ে আনার কাজে যখন স্বামী বিবেকানন্দ আসমুদ্রহিমাচল পদব্রজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন সারদা দেবী ছিলেন তাঁর একমাত্র প্রেরণা। যেভাবে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্তমণ্ডলী তাঁকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করতেন ঠিক তেমনিভাবে সারদা দেবীও মমতাময়ী বিশ্বজননীর মতন সকলের দেখাশোনা করতেন, সকলের মঙ্গল কামনা করতেন। তাঁর কাছে জাতপাতের কোনও ভেদাভেদ ছিল না। মায়ের যেমন কোনও বিকল্প হয় না তেমনি মাতৃসম শ্রী শ্রীমায়ের কোনো তুলনা নেই এই ধরিত্রীতে।🍁
[ঋণ : বংকোটস ]
🍁কবিতা
বিশ্বজিৎ মণ্ডল -এর দু’টি কবিতা
গর্ভগৃহ
মন্দির ছেড়ে নেমে আসে পাষণ্ড পুরোহিত
দেবস্থানে খেলা করে ঈর্ষার রং
এখানেই কারা যেন রেখে গেছে, করোতোয়া অন্ধকার
প্রতিদিন রাত্রি ভেঙে নেমে আসে, একা কালপুরুষ
সারাটা মাঠ জুড়ে ছড়ানো ফসলের লাশ
স্তন্যদানে ব্যস্ত মায়ের চোখে, গাজা কিংবা ইসরাইলের
যুদ্ধের আগুন
অবশেষে আরও কিছু মৃত্যু…
ওখানেই আত্মগোপনে কারা যেন লিখে গেছে
একান্ত গর্ভগৃহ…
বধ্যভূমির কাব্য
সকালে মাঠে নামতেই দেখি, পড়ে আছে চাপ চাপ
ফসল বিয়ানোর রক্ত
কখনো কাহানে নামিনি, উদ্ধত লাঙল কাঁধে
চষে দেখিনি, মাটির মিহিন শরীর
অথচ আমার শরীর জুড়ে বেড়ে ওঠে ,ভুঁড়ি কামড়ি লতা
অস্পৃশ্য দাগ বলে দেয়, আমিও একদিন
জমিন-চষা চাষার ছেলে ছিলাম
এখন সারাটা মাঠ ভরে আছে, অবিনাশী শকুনে
রাশ রাশ লাশে জমে ওঠে, বধ্যভূমির অন্ধকার
ইদানিং চাষ ভুলে গেছি…
অস্ত্রে অস্ত্রে সাজাই, আমাদের নক্ষত্র সংসার
ঋদ্ধি কথা থাক, বরং
স্মৃতির ওয়ারড্রবে তুলে রাখি, ফুল বিনিময়ের দিন
পরাণ মাঝি
চাঁদ উঠেছিল
উত্তুরে হাওয়া খেলছিল বুকে ; প্রেমিকার নরম হাতের রন্ধন শিল্পের মতো। শরীর উঠছিল কেঁপে কেঁপে…
তারপর আপেল বনে কত খুনসুটি ; উপত্যকা জুড়ে সাদা ঢাকা। নীচে ডাললেক। পানসি বাইতে বাইতে গরম হচ্ছিল শিরা-উপশিরা…
হঠাৎ খসে পড়ল নক্ষত্র ; সুমিত্র সে ; পরম পবিত্র
ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে কত স্বপ্ন কুমারী এসে ; লেপের তলায় নিয়ে যায় ডেকে।
বন্ধ চোখে তখন চাঁদ উঠছিল শীতল বিছানা জুড়ে-
সুধীর দাস-এর দু’টি কবিতা
আমার পৃথিবীতে
মাছরাঙ্গা রোদ ঠিকড়ে পড়ে বুকে
অচল পৃথিবী ঘাই মারে
নিউটনের বলয়।
আমার পৃথিবীতে প্রতিদিন অমাবস্যা
ভোরের সূর্য ঢেকে থাকে শ্রাবণের অন্ধকারে
বেদুইন পাখির মত নীড় হারা স্বপ্নগুলো
কচি কচি লাউয়ের ডগার মত ছিঁড়ে ফেলি
রক্তাক্ত বুকের পাঁজরে
তলপেটে ক্ষুধার্ত শকুন আঁচড় কাটে
মুখে রক্ত বমি আসে
মায়াবী জোছনার ফসলের মাঠে কৃষকের মুখে শুকনো হাসি
অন্নহীন ভূখাপেট কাঁদে চোখের জলে।
কথা দাও দেখা হলে
“কথা দাও দেখা হলে কানে ফুল গুঁজে দেবে”
হাতে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোবাসা চেয়ে নেবে
বুকে বুকে বুক রেখে
আকাশের নীল দেখে
চোখে চোখে চেয়ে আপন করে নেবে ভেবে।
কথা দাও দেখা হলে অভিমান যাবে ভুলে
মায়া দিয়ে ছায়া দিয়ে দুই হাতে নেবে তুলে
বুকের সব জমানো কথা
ভালোবাসার কত নীরবতা
সাগরের ঢেউ এনে সবকিছু বলবে খুলে।
মগ্ন রয়েছি তোমার ভালোবাসা পাবো বুকে
কাছে এলে ডানা মেলে দুজনে থাকবো সুখে
নিশিদিন পাশাপাশি
মিশে যাবো কাছাকাছি
মনের সব লাজুক লতা বাধাকে দাড়াবো রুখে।
যে কথা হয়নি বলা বলবো সব কাছে এলে
পাখির মত আকাশে জীবনের ডানা মেলে
হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে ভেসে
আকাশের নীলে মেশে মেশে
সুখের ঠিকানা খুঁজবো তোমাকে বুকে পেলে।
(কবিতার প্রথম লাইনটির সূত্র ঋণ: বিপাশা আইচ এর টাইমলাইন থেকে নেয়া।)
🍁ফিরে পড়া : গল্প /১
_____________________________________________
প্রায় আধঘন্টা বাদে আমার সুযোগ এল। ঠিকঠাক খুচরো পয়সা পকেটে আছে আগেই দেখে নিয়েছিলাম। কানেকশান হবার পর এনগেজড টোন পেলাম। তবু ফোন ছাড়লাম না। পর পর তিনবার চেষ্টা করলাম। একই অবস্থা। তখন টেলিফোন অফিসে লাইন ধরে জিজ্ঞেস করলাম, এই নাম্বারটার কী অবস্থা দেখুন তো। দূরভাষিণী জানালেন, ওই নাম্বার এখন আউট অব অর্ডার হয়ে আছে।
_____________________________________________
নীরার অসুখ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ডালহৌসি স্কোয়ারে ট্রাম থেকে নেমে সবেমাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছি, হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কীসের যেন একটা শোরগোল শুনতে পাচ্ছিলাম। তাকিয়ে দেখলাম দূরাগত একটা মিছিল। এ পাড়া থেকে কি একশো চুয়াল্লিশ ধারা উঠে গেছে? সারাবছরই তো থাকে। উঠে যায়নি। অবিলম্বে পুলিশ এসে মিছিলের গতি রোধ করল। উত্তেজনা ও গোলমাল বাড়ল। তারপরই হুড়োহুড়ি। লোকজন ছুটোছুটি করছে চারদিকে। ঠিক যেন ভিড়ের মধ্যে একটা পাগলা ষাঁড়কে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ধাবমান লোকগুলির কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই।
আমি গড্ডলিকা প্রবাহে গা না মিশিয়ে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গাড়ি-বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। কলেজজীবন থেকেই পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার-গ্যাস চালানো এত বেশিবার দেখেছি যে এইসব গোলমালের চরিত্র বুঝতে আমার ভুল হয় না। লাঠি টিয়ার-গ্যাসের অবস্থায় এখনো আসেনি।
লোকজনের ছুটোছুটি ক্রমশ বাড়ছিল। তার ফলে লেগে গেল একটা বিশ্রী ট্রাফিক জ্যাম। কতক্ষণে এর জট ছাড়বে কে জানে। এর ওপর আবার আকস্মিকভাবে আরম্ভ হয়ে গেল বৃষ্টি। রীতিমতন জোরে।
বৃষ্টি আসার ফলে লোকজনের ছুটোছুটি, মিছিল ও পুলিশের তাণ্ডব সবই অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেল। বর্ষার তেজি বৃষ্টি অন্য কিছু সহ্য করে না। কয়েক মিনিট পরে আর সব কিছুই শান্ত, শুধু বৃষ্টিরই প্রবল প্রতাপ দেখা গেল।
আমি তখন আমার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম! যতদূর সম্ভব অন্যান্য গাড়ি-বারান্দাগুলোর তলা দিয়ে যাওয়া যায়। পুরোটা রাস্তায় সেরকম সুযোগ নেই, বেশ ভিজতে হল আমাকে। বুক পকেটটা শুধু চেপে রইলাম সিগারেট দেশলাই আর সামান্য যা টাকাপয়সা আছে তা যেন না ভেজে।
বেশিদূর নয়, আমার যাবার কথা রাজভবনের পশ্চিমদিকের গেটের সামনে। নীরা ওখানে আসবে, ঠিক সাড়ে চারটের সময়। আমার মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে।
সিংহমূর্তির কাছেই একটা গাছতলায় দাঁড়ালাম। নীরা এখনো আসেনি। নীরা কোনোদিন দেরি করে না।
কিন্তু সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বিরাট গাড়ির লাইন পড়েছে। ট্রাফিক জ্যাম ছড়িয়ে পড়েছে এদিকেও। এর মধ্যে নীরা আসবে কী করে? ট্রাম বাস সব অচল। নীরা যদি ট্যাক্সি নিয়েও থাকে, তবু এই জ্যাম ভেদ করে ট্যাক্সি আসতে পারবে না। ওরা আসতেও চায় না।
ভীষণ রাগ হল আমার। ঠিক এই সময়ে কি ট্রাফিক জ্যাম না হলে চলছিল না? এদিকে বৃষ্টির বিরাম নেই।
বৃষ্টির সময় গাছতলায় আশ্রয় নেওয়া খুব সুবিধের ব্যাপার নয়। প্রথম প্রথম জলের হাত থেকে বাঁচা যায়। তারপর গাছ নিজেই মাথা ঝাঁকিয়ে জল ঝাড়তে থাকে।
আর একটা সিগারেট ধরাবার জন্য পকেট থেকে সিগারেট দেশলাই বার করলাম। সিগারেট ভেজেনি বটে কিন্তু দেশলাইটা নেতিয়ে গেছে। কয়েকটা কাঠি নিয়ে জ্বালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম বার বার। ছাল-চামড়া শুধু উঠে আসে!
আমার পাশে আরও কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজনের মাথায় ছাতা। তবু তিনি আশ্রয় নিয়েছেন গাছের নীচে। তাঁর মুখে জ্বলন্ত সিগারেট।
খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলুম, আপনার কাছে দেশলাই আছে?
লোকটি আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। নিজের মুখ থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
হয় ওঁর কাছে দেশলাই নেই অথবা উনি কাঠি খরচ করতে চান না।
সাবধানে ওঁর সিগারেটটা ধরে আমি আমারটা জ্বালিয়ে নিলাম। তারপর ওঁরটা ফেরত দেবার জন্য হাত বাড়িয়ে আমি বললাম, ধন্যবাদ।
আমার ধন্যবাদের উত্তরে উনি বললেন, ফেলে দিন।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওঁর সিগারেটটা মাত্র আধখানা পুড়েছে, উনি ফেরত নিতে চাইছেন না কেন? আমরা তো আরও অনেক দূর পর্যন্ত টানি।
আমি আবার বললাম, এই নিন।
উনি একইরকম গলায় বললেন, দরকার নেই ফেলে দিন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। আমার মুখখানা অপমানে কালি হয়ে গেল। এর মানে কি? আমি কি অচ্ছুৎ? আমার ছোঁয়া সিগারেট উনি স্পর্শ করবেন না? তাহলে দিতে গেলেন কেন? আমি তো সিগারেটের আগুন চাইনি। আর যদি ফেলতেই হয়, আমার কাছ থেকে নিয়েও তো নিজে ফেলতে পারতেন।
অথচ এই নিয়ে তর্ক করাও যায় না। অভদ্র লোকদের এই একটা সুবিধে, ভদ্রলোকেরা তাদের চ্যালেঞ্জ করে না। তারা নিজেরাই সহ্য করে যান। আমি মনে মনে গজরাতে লাগলুম।
পাঁচটা বেজে গেল, নীরা এখনও এল না। ট্রাফিক জ্যামের জট ছেড়ে গেছে, বৃষ্টির তেজ একটু কম। নীরা তো কোনোদিন এত দেরি করে না।
সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। আর কোনো সন্দেহ নেই যে নীরা আজ আর আসতে পারবে না। নিশ্চয়ই আকস্মিক কোনো অনিবার্য কারণে আটকে গেছে। আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি গাছতলা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু আমি কারুর কাছে দেশলাই চাইব না।
সবে মাত্র পা বাড়িয়েছি, এই সময় পটাং করে আমার একটা চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। চামড়ার চটি জলে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছিল।
এখন এই ছেঁড়া-চটি নিয়ে আমি কী করি। রাজভবনের সামনে মুচি খুঁজে পাওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার। অথচ ছেঁড়া-চটি ঘষটে ঘষটে হাঁটাও একটা অসম্ভব ব্যাপার। চটি-জোড়া পুরোনো, ফেলে দিলেও ক্ষতি নেই—কিন্তু খালি পায়ে হাঁটার মতন মনের জোর নেই।
অগত্যা সেই চটি টেনে টেনেই হাঁটতে লাগলুম। অত্যন্ত বিশ্রী লাগছে। চটি ছিঁড়ে গেলে মানুষের সমস্ত ব্যক্তিত্ব চলে যায়।
খানিকটা এগোতেই কার্জনপার্কের মোড়ের কাছে দড়াম করে জোর একটা শব্দ হল। চোখ তুলে সেদিকে তাকালাম। না তাকালেই ভালো হত। একটা লরি ধাক্কা মেরেছে একটা টেম্পোকে। টেম্পো থেকে একটা লোক ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। গল-গল করে রক্ত বেরুচ্ছে।
এতকাল কলকাতায় আছি, কিন্তু আমি নিজের চোখে কখনও কোনো দুর্ঘটনা দেখিনি। আজই প্রথম। আজ বিকেল থেকে পর পর একটার পর একটা খারাপ ঘটনা ঘটছে কেন? পৃথিবীর যন্ত্রপাতিতে কি কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে? হঠাৎ আমার মনে হল, নীরার নিশ্চয়ই কোনো অসুখ হয়েছে। সেই জন্যই আসতে পারেনি। কালকেও নীরাকে পরিপূর্ণ সুস্থ দেখেছি, আজ তার অসুখ হবার কোনো কারণই নেই। তবু আমার ওই কথাই মনে হল—সেইজন্যই আজ আমি একটার পর একটা কু-চিহ্ন দেখছি। এইসব ঘটনার সঙ্গে নীরার অসুখের নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে। এই জগৎ তো মায়ার প্রতিবাস, আমার মনের অবস্থা অনুযায়ীই সব কিছু ঘটে থাকে।
নীরার অসুখ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার এক্ষুনি জানা দরকার। ওদের বাড়িতে সাধারণত আমি টেলিফোন করি না, আজ করতে হবে।
কোথায় টেলিফোন? ট্রাম গুমটিতে। ছেঁড়া-চটি পায়ে দিয়েই ছুটলাম সেই দিকে। তিন-চারজন আগে থেকেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে। মেয়েরা টেলিফোন করতে অনেক সময় লাগায়। আমার ইচ্ছে হল, এদের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করে বলি, আমাকে একটু আগে সুযোগ দিন, পৃথিবীর সমস্ত কাজের চেয়েও আমার কাজটা বেশি জরুরি।
কিন্তু এ কথা মুখে বলা যায় না। নীরস মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম সবার পেছনে। মেয়েটি যথারীতি বহুক্ষণ সময় লাগাল। ও যেন কার সঙ্গে ঝগড়া করছে। তাতো করবেই। আজ এই মুহূর্তে, পৃথিবীতে কেউ সুখে নেই।
প্রায় আধঘন্টা বাদে আমার সুযোগ এল। ঠিকঠাক খুচরো পয়সা পকেটে আছে আগেই দেখে নিয়েছিলাম। কানেকশান হবার পর এনগেজড টোন পেলাম। তবু ফোন ছাড়লাম না। পর পর তিনবার চেষ্টা করলাম। একই অবস্থা। তখন টেলিফোন অফিসে লাইন ধরে জিজ্ঞেস করলাম, এই নাম্বারটার কী অবস্থা দেখুন তো। দূরভাষিণী জানালেন, ওই নাম্বার এখন আউট অব অর্ডার হয়ে আছে।
খুব একটা আশ্চর্য হবার মতন ব্যাপার কিছু নয়। আজ বিকেল থেকে পর পর যা ঘটছে, তার সঙ্গে বেশ মিল আছে।
এরপর আমি একটা কাজই করতে পারি। পা ঘষটে ঘষটে চলে এলাম ধর্মতলার মোড়ে। সন্ধের পর কলকাতার রাস্তায় মুচি পাওয়া অসম্ভব—ঈশ্বর এরকম নিয়ম করেছেন। সুতরাং, আমি আমার পুরনো চটি-জোড়া ফেলে দিয়ে ফুটপাথ থেকে একজোড়া রবারের চটি কিনে নিলাম। তারপর মিনিবাস ধরে দ্রুত নীরার বাড়িতে।
দরজা খুলল চাকর। কোনো দ্বিধা না করে জিজ্ঞেস করলাম, দিদিমণি আছে?
অন্য দিন হলে নীরার বাবার সঙ্গে প্রথমে কথা বলতাম, একটা কোনো জরুরি প্রসঙ্গ বানিয়ে নিতে হত। আজ আর ওরকম অছিলা খোঁজার কোনো মানে হয় না।
চাকরটি বলল, দিদিমণি ওপরে শুয়ে আছেন।
অসুখ করেছে?
না এমনিই শুয়ে আছেন।
খবর দাও, বলো, সুনীলবাবু দেখা করতে এসেছেন। চাকরটি ওপরে চলে গেল। আমি বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগলাম। বসতেও ইচ্ছে করল না। টেবিলে অনেক পত্র-পত্রিকা পড়ে আছে, ছুঁয়েও দেখলাম না।
চাকর একটু পরে এসে বললো, দিদিমণির জ্বর হয়েছে।
আমার প্রচণ্ড চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, আমি আগেই বলেছিলাম না?
খুব শান্তভাবে বললাম, আমি একবার ওপরে যাব। দিদিমণির বাবা কিংবা মাকে একটু বলে এসো আমার কথা।
বলেছি, আপনি আসুন।
চাকরটির আগে আগেই আমি সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে এলাম। নীরার ঘর আমি চিনি। তিনতলায় সিঁড়ির পাশেই।
নীরা শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, গায়ে একটা পাতলা নীল চাদর, চোখ বোজা। ওর মা শিয়রের কাছে বসে কপালে জলপটি দিচ্ছেন।
নীরার মা আমাকে দেখে সামান্য একটু অবাক হলেন, কথায় তা প্রকাশ করলেন না অবশ্য। বললেন, ওই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসো।
আমাকে বলতেই হল যে নীরার বিশেষ বন্ধু স্নিগ্ধা, যে আমার মাসতুতো বোন, সে নীরাকে একটা খবর দিতে বলেছিল, আমি এ পাড়ায় এসেছিলাম অন্য কাজে, এসে শুনলাম, নীরার অসুখ।
ওর মা বললেন, দ্যাখো দেখি, হঠাৎ কী রকম জ্বর। দুপুরেও ভালো ছিল।
কী হয়েছে?
বুঝতে পারছি না তো। টেম্পারেচার একশো ডিগ্রি।
ডাক্তার এসেছিলেন?
রথীনকে তো খবর পাঠিয়েছি। ন-টার সময় আসবে বলেছে। টেলিফোনটা আবার আজকে খারাপ। ওর বাবাও এখনও অফিস থেকে ফেরেননি।
কথাবার্তা শুনে নীরা চোখ মেলে একবার তাকাল। ঘোলাটে দৃষ্টি। আমাকে চিনতে পারল কি না কে জানে।
আমি চেয়ারে বসে নীরার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো ওষুধ-টোষুধ আনতে হবে? আমি এনে দিতে পারি?
না। রথীন এসে দেখুক।
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম , উনি কি একবারও ঘর ছেড়ে উঠে যাবেন না?
আজকালকার মায়েরা তেমন অবুঝ নন। একটু বাদেই উনি বললেন, তুমি একটু বসো। আমি একটু গরম দুধ নিয়ে আসি, যদি খায়।
উনি ঘর থেকে চলে যাওয়া মাত্রই আমি উঠে গিয়ে দরজার কাছে উঁকি মেরে দেখলাম, উনি একতলার রান্নাঘরেই যাচ্ছেন কিনা। উনি তাই-ই গেলেন। তাহলে ফিরতে অন্তত দু-মিনিট তো লাগবেই।
নীরার শিয়রের কাছে এসে আমি ওর কপালে হাত দিলাম। কপালটা যেন পুড়ে যাচ্ছে একেবারে।
নীরা চোখ মেলে তাকাল আবার। তারপর অস্পষ্ট গলায় বলল, আমি আজ যেতে পারিনি।
ও কথা এখন থাক। তোমার কষ্ট হচ্ছে?
আমার মন খারাপ লাগছে খুব।
ছিঃ এখন মন খারাপ করে না। হঠাৎ অসুখ বাধালে কী করে?
আমার তো অসুখ হয়নি, আমার মন খারাপ।
লক্ষ্মীটি এখন মন খারাপ করো না।
নীরা আমার হাতটা টেনে নিজের চোখের ওপর রাখল। আমি ভালো লাগায় বিভোর হয়ে গেলাম। আবার ভয়ও করতে লাগল। ওর মা এক্ষুনি এসে পড়বেন না তো?
নীরা বলল, তুমি যেও না।
আমি হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে এসে বসলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর মা এসে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। উত্তেজনায় আমি কাঁপছি।
ডাক্তার না-আসা পর্যন্ত আমি বসেই রইলাম সেই ঘরে। এর আগেই নীরার বাবা এলেন, দু-চারটে কথা বললেন আমার সঙ্গে। আমি জানি, ওঁরা তো আমাকে জোর করে চলে যেতে বলবেন না।
ডাক্তার এল সাড়ে ন-টায়। ওদের কিরকম আত্মীয়। নীরার সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলেন। নীরার জ্বর তখনও একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে মনে হয়।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তোর হঠাৎ কী হল?
নীরা বলল, আমার কিছু ভালো লাগছে না।
কোথায় ব্যথা?
নীরার সেই একই উত্তর, আমার কিছু ভালো লাগছে না।
ওরা কেউ জানে না, শুধু আমি জানি, নীরা কখনও অসুখের কথা আলোচনা করতে ভালোবাসে না। কোনোদিন ও শরীরের কোনো ব্যাপার নিয়েই অভিযোগ করেনি। কিংবা আমার সামনে করে না।
ডাক্তার নীরার বুক-পিঠ পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, জ্বর তো একশো পাঁচের কম নয় মনে হচ্ছে। কোনো রকম ভাইরাস ইনফেকশান মনে হচ্ছে। রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। আজ তো হবে না! কাল সকালেই পাঠিয়ে দেব।
তার পরদিন থেকে কলকাতা শহরে কি তুলকালাম কাণ্ড। আগের দিনের ঘটনার জেরে ছাত্র ধর্মঘট। পুলিশের সঙ্গে আবার মারামারি। ট্রাম বাস পুড়ল। কলকাতা শহরটা বিকল হয়ে গেল।
আমি বিকেলে দৌড়তে দৌড়তে গেলাম নীরার কাছে। নীরার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। কোনো কথা বলতে পারছে না, প্রায় অজ্ঞানের মতন অবস্থা। এদিকে রক্ত পরীক্ষার কোনো ফলাফল তখনও আসেনি।
বিষণ্ণ মনে বেরিয়ে এলাম নীরাদের বাড়ি থেকে। রাস্তাঘাট ফাঁকা থমথমে। যে কয়েকজন লোককে দেখা গেল, সকলের মুখ থমথমে। মাঝে মাঝে হিংস্র চেহারায় পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে।
আমি তো জানি, কলকাতার এই অবস্থা তো শুধু নীরার জন্যই। নীরার অসুখ ঠিক না করলে এই শহর রসাতলে যাবে।
পরদিনও নীরার ঠিক সেই একই রকম অবস্থা। ডাক্তাররা কিছু বলতে পারছেন না। আমি তীব্রভাবে মনে মনে বলতে লাগলুম, আপনারা করছেন কী? আপনারা কি কলকাতা শহরটাকে ভালোবাসেন না? ওকে সারিয়ে না তুললে যে এই শহরটা ধবংস হয়ে যাবে। হঠাৎ ভূমিকম্পে সবকিছু ভেঙে পড়তেও পারে!
সেদিন কলকাতার সাত জায়গায় ট্রামে বাসে আগুন লেগেছে, পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে অনেক জায়গায়। আমি একটু ফাঁকা ঘর পেয়ে অচেতন নীরার কপালে হাত দিয়ে বললাম, নীরা, ভালো হয়ে ওঠ। তোমাকে ভালো হয়ে উঠতেই হবে। তুমি এতগুলো মানুষের কথা ভাব।
পরদিন কলকাতায় কারফিউ জারি হবে কিনা এরকম জল্পনাকল্পনা চলছিল, কেউ কেউ বলছে, আর্মিকে ডেকে আনা হবে। কিন্তু সেদিনই রক্ত পরীক্ষার ফল পাওয়া গেল, জানা গেল ভাইরাস। ঠিক ইনজেকশন দেবার পরই নীরার জ্ঞান ফিরে এল।
এক ঘন্টা বাদে ওর মুখের রংটা দেখাল অনেক স্বাভাবিক।
আমি জিজ্ঞেস করলাম নীরা, এখন কেমন আছ?
নীরা সামান্য হেসে বলল, আমার মন ভালো হয়ে গেছে।
সেদিন বাইরে এসে দেখলাম, চমৎকার ফুরফুরে হাওয়া বইছে। রাস্তায় অনেক বেশি লোকজন। কয়েকজন পুলিশের মুখেও হাসি।
পরদিন সকাল থেকে কলকাতা একেবারে স্বাভাবিক।🍁
🍂ফিরে পড়া : গল্প /দুই
______________________________________________
কুঞ্জ ঠাকুর রাজি হয় নি। গোড়ায় তখনও রস ছিল। আশা কুহকিনী। জল একটা পেলেই আবার ঝাড় ছাড়বে। সারা দিনমান চোখ আকাশে। কোথাও গুড়গুড় শব্দ হলে বের হয়ে দেখা, মেঘ উঠছে। হবে হবে। তারপর ছিটে-ফোঁটা হয়ে কোথায় যে মেঘেরা সব উড়ে যায়। চোখ জ্বলে। জল হয় না। গোড়া ভেজে না। আর পালানের মার শাসানি—দশ কেজি গম কম কিসে। কে দেয়! ঘরে গরুবাছুরও নেই যে খাওয়াবে। আকাল আসছে–বোঝ না বুড়ো।
______________________________________________
আবাদ
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
খরা বড় খরা চলছে হে! মানুষটা বিড়বিড় করে বকছিল।
খরায় মাঠঘাঠ সব শেষ। সুমার মাঠে কোথাও একদানা শস্য ফলে নি। জমির পর জমি তামাটে রঙ ধরে আছে। শুধু খড় আর খড়। একটা ফড়িং পর্যন্ত উড়ছে না। পোকামাকড় সব অদৃশ্য। মাঠ উরাট থাকলে যা হয়—আগাছায় ভর্তি হয়ে আছে—দুটো একটা সাদা ফুল, কোথাও ইতস্তত সাদা বক উড়ে বেড়াচ্ছে।
বুড়ো মানুষটা গাছের গোড়া খুঁটে কী দেখল। মুখ ব্যাজার। শুধু যে ধুলোবালি ওড়ে!–হা কপাল তোমার রস নাই হে। গর্ভে তোমার রস নাই।
আকাশ আদিগন্ত সেই মতো বিস্তৃত। গাছপালা সেই মতো দাঁড়িয়ে। পাকা সড়কে সেই মতো বাস যায়। শুধু মানুষজন সুস্থির নেই। বুড়ো মানুষটা নিজের জমির মধ্যে দাঁড়িয়ে। তার গরুবাছুর গেল। আবাদ গেল। বালির-ঘাটের পাইকার বেচু মণ্ডল কিনে নিল সব। এখন তার জমির খড়ে নজর। শুয়োরটা বলে কি না, গাছ তো সব ন্যাড়া হয়ে গেল ঠাউরদা।
মুখে তার কঠিন হাসি খেলে গেল।—কিছু বুঝি না মনে করে। অরে, কুঞ্জ ঠাকুর সব বোঝে। তোর মতিগতি সব বোঝে। কেবল মরে পড়ে আছে তাই।
না শুকায় নি। ন্যাড়া হয় নি। দেখ না জল হল বলে। জল হলেই ঝাড় খেলবে। আবাদ হবে; ঠিক হবে। তুই চোখ দিস না। তোর চোখ ভাল না। নজর বড় খারাপ। সব ভাগাড় হয়ে যায়।
এ-সব যেন সেই কবেকার কথা!
তরাসে বুক কাঁপে কুঞ্জ ঠাকুরের।—ও পালান লাফাস না। ফড়িং যে কটা আছে থাক। পিছু নিস না ভাই। আবার জল হলে ওরা ওড়াউড়ি করবে।
যেন এইসব কীটপতঙ্গ বেঁচে থাকলে, ডাকাডাকি করলে সামনের বছরটা এমন অজন্মা যাবে না। এরা জমির লক্ষ্মী। প্রকৃতির জীব, তারে হেলাফেলা করতে নেই। বেচুর কামড়ের জ্বালায় মরছে, তার উপর নতুন উপদ্রব দেখা দিলে সব যাবে। চামারের মতো ফাঁক পেলেই বেচু লাল সড়ক থেকে নেমে আসে। হাতে শানানো গোপন অস্ত্র। ফাঁক পেলেই তার ছালচামড়া খুলে নেবে।
অ ঠাউরদা আছেন নি! আমি বেচু—
আমি থাকব না কেনরে! আমি বেচু! তা কি চাস! ঘুরঘুর কেন!
একখান কথা আমার।
কী কথা!
পাঁচ কেজি গম। ভেবে দেখেন, পাঁচ কেজি। মাঠ খড় হয়ে আছে। আর মায়া বাড়িয়ে কি হবে ঠাউরদা। পাঁচ কেজি গম কম কথা না। পরে গরুতেও খাবে না। সব ন্যাড়া হয়ে যাবে।
আমার আবাদ আমি বুঝি না! এই করে কুঞ্জ ঠাকুর ঠেকিয়ে রেখেছিল বেচুকে। কিন্তু কালান্তক যমের মতো দাঁড়িয়ে বেচু। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই বেচু। হা হা করে হাসে। তিড়িং তিড়িং করে নাচে। কী মজা! অকাল আসছে, কী মজা! জমিতে এখন খড় তারপর ন্যাড়া। গরুতেও মুখ দেবে না। পাঁচ কেজি গমও যাবে। খড়ও যাবে।
কুঞ্জ ঠাকুর ভয় পেলেই ডাকে—ও পালান, দূরে যাস না। রোষে পড়ে যাবি।
—আমি যাইনি দাদু।
—তুই কোথায়?
—এই ত। পালান জমির মাঝখানে ভোঁস করে ভেসে ওঠে।
তা ঠাউরদা আপনে বুড়া মানুষ কী বলব—ঠকাতে পারি না। বামুন মানুষরে ঠকাতে নাই ঠাউরদা। রাজি হয়ে যান। তবে গরুবাছুর জলের দরে দিছেন যখন আর পাঁচ কেজি। বলেই হাঁকার, ও পালানের মা আমি উঠছি। তোমার শ্বউর রাজি না। পালান দ্যাখ তোর মা কোথায়—ডাক।
পালানের মা তো এক পায়ে খাড়া। না ডাকতেই গলা হাওয়ায় ভেসে আসে, অ বেচুদাদা ডাকছ!
হ্যাঁ দেখ না, ঠাউরদা মাথা পাতছে না।
না পাতবে, মরবে। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললে মরণ হয় বুড়ো বোঝে না।
বাড়ির আমগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে বেচু এমন কত কথা বলে গেছে। কুঞ্জ ঠাকুর রাজি হয় নি। গোড়ায় তখনও রস ছিল। আশা কুহকিনী। জল একটা পেলেই আবার ঝাড় ছাড়বে। সারা দিনমান চোখ আকাশে। কোথাও গুড়গুড় শব্দ হলে বের হয়ে দেখা, মেঘ উঠছে। হবে হবে। তারপর ছিটে-ফোঁটা হয়ে কোথায় যে মেঘেরা সব উড়ে যায়। চোখ জ্বলে। জল হয় না। গোড়া ভেজে না। আর পালানের মার শাসানি—দশ কেজি গম কম কিসে। কে দেয়! ঘরে গরুবাছুরও নেই যে খাওয়াবে। আকাল আসছে–বোঝ না বুড়ো।
হারামজাদি তোর বাপের জমি, তোর স্বোয়ামীর জমি—জমি আমার। আমি বুঝব। আবাদ ঠিক হবে। জল হবে। এই হবে হবে করে বেচুকে সে ঘোরাচ্ছিল। ঘোরাবার ইচ্ছে ছিল না। সাফ বলে দিতে পারত, হবে না। কিন্তু দিনকাল খারাপ। আকাল আসছে। মানুষ খেতে পাবে না, না খেয়ে মরে যাবে—না হলে বেচুর ইতরামির জবাব সে দিতে পারত। ঘোরাঘুরির ফাঁকে বেচুর আসল টান যে কিসে যেদিন ধরতে পারল—কথা না দিয়ে পারল না। ছল-ছুতো করে আসা—দশ কেজি গমে রাজি হয়ে গেলে ছলছুতো খুঁজে পাবে না। কী জানি, নালে যদি সব যায়। যদি সত্যি বেচু তার বাড়িটাকে ভাগাড় বানিয়ে ফেলে! চামার মানুষ পারে না, হেন কাজ নেই। ধর্ম নাই। কেবল লাল সড়ক থেকে নেমে আসা, ডাকা—অ ঠাউরদা কিছু ঠিক করলেন! দশ কেজি গম কম কথা না। পালান কইরে, তর মারে ডাক। এক গেলাস ঠাণ্ডা জল দিতে ক’ তর মারে। সেই কখন বের হয়েছি।
কালান্তক যমের মতো বেচু নেচেই যাচ্ছে। চারপাশে বেচু। হাত তুলে পা তুলে লাফাচ্ছে। পরনে লুঙ্গি, হাফ শার্ট গায়ে, হাতে লাঠি। পায়ে বুট জুতো। গায়ে শ্বেতী রোগ আছে বলে কালো সাদা ভূতের মতো, যেন দাঁত বের করে নাচছে আর পাচনের খেলা দেখাচ্ছে। পাঁচ আঙুলে পাঁচখান আংটি—সোনা রুপো তামা লোহা মিলে সব ক’খান রোদের ঝিলিকে ঝলসে উঠছে। বেচু লুঙ্গি তুলে—
অ বেচু লুঙ্গিটা শালো নামিয়ে বোস। পালানের মা জল দিতে আসছে।
—পালানরে পালান।
—ডাকছ কেন!
—ওখানে কী করছিস।
এই দ্যাখ, বলে কুঞ্জ ঠাকুরের নাতি পালান একটা মরা ব্যাং তুলে দেখাল।
—ছিঃ ছিঃ পালান। ফেলে দে।
আবার পালান একটা মরা গঙ্গাফড়িং তুলে দেখাল।
কুঞ্জ ঠাকুর ভেবে পায় না, পালান কেন সব মরা কীটপতঙ্গ খুঁজে বেড়াচ্ছে। পালানও কি বোঝে আকাল আসছে!
কোন পাপে কারে খায় কে জানে! গালে কতকালের যেন বাসি দাড়ি, বগলে ছেঁড়া ছাতা আর একখান লাঠি সম্বল করে সে আর দু-খণ্ড ভুঁইয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শেষ দেখা । আবাদের শেষ দেখা। সত্যি উরাট হয়ে গেছে জমি। শীত আসছে। বড় ঠাণ্ডা। কনকনে ঠাণ্ডায় হাত পা কেমন স্থবির হয়ে যাবে তার। চামারটা আবার কী অজুহাতে আসবে কে জানে!
গন্ধ শুঁকে টের পায় বেচু।
তা বেচু জল ভালই হল। বীজধান চাই। এসব ভাল সময়কার কথা। বাছুরটা বাগি দিলে ফিরে আসত। কিন্তু হাত ফাঁকা। আবাদে কত লাগে বল!
তা ঠাউরদা আবাদ ঠিকঠাক হলে এক গণ্ডা বাছুর কিনে নিতে পাবেন। এই বেচুই আপনেরে দিয়ে যাবে। তবে একখান কথা ঠাউরদা—লালন পালন বলে কথা। কষ্ট হয় বুঝি! বাছুরটা আর পালানটাই আপনের সম্বল। কী করবেন, আবাদ বলে কথা। মা লক্ষ্মীরে আর উপোস রাখা চলে না।
তুমি বড় বুঝদার মানুষ হে! তা কপালখানা যার এ-রকমের তার ভাগাড় তুমি টের পাবে না ত কে পাবে! আর বিশটা টাকা ধরে দাও বেচু!
ও পালান, তর মারে ডাক দিহি। ঠাউরদা বিশ টাকা বেশি চায়। কোথা থেকে দি। আমার ত বেচাকেনা করার কথা। আর কবি য্যান এক গেলাস ঠাণ্ডা জল দেয়।
থাক থাক বেচু। ঠাণ্ডা জলের আর দরকার নাই। তোমার কথাখানাই থাকল। পালান যা ত ভাই বেচুর জন্য ঠাণ্ডা জল আন এক গেলাস।
দাঁত বের করে কী হাসছে দেখ বেচু!
—ও দাদু কার সঙ্গে কথা বলছিস?
—না ত, কথা বলছি না ত!
—কে দাঁত বের করে হাসছে।
—কই, কেউ না তো।
কুঞ্জঠাকুর হাঁটছে। গাছগুলি নুয়ে নুয়ে দেখছে। আর তাকাবে না কোনোদিকে। তাকালেই বেচু! পালানটা পর্যন্ত ধরে ফেলেছে, বেচুর সঙ্গে সে অহরহ কথা কয়। মাড়ির একটা দাঁত বেচুর আলগা। কে করেছিল সে জানে না। কথা বললে গাল তার নড়ানড়ি করে। দাঁতটা ঝুলে পড়েছে। আর একটা দাঁত ঝুলে পড়লেই—হা হা আমি বেচু, আকাল আসছে, কী মজা!
বেচু তোমার দাঁত কে আলগা করে দিল।
পালানের মা ঠাণ্ডা জল।
দাঁত তোমার থাক। টাকাটা।
লপ্তে লপ্তে দিয়ে যাবে।
একসঙ্গে হবে না!
দিলেই ত পেটে। সব খেয়ে ফেলবেন। পালানের মা তোমার শ্বউর সব টাকা এক লগে চায়।
না না—সব না। বেঁচু দাদা ওটার কী হল।
হবে। তবে আগাম চায়।
আগাম! আগাম কিসের বেচু?
কুঞ্জঠাকুরের চোখ উপরে উঠে গেছিল বেচু আর পালানের মার কথা শুনে।
তা বেচু লপ্তে লপ্তেই দিও। বামুন মানুষকে ঠকিও না। পালানের বাপটা বেঁচে থাকলে…। বাকিটুকু বলতে সাহস পায়নি। আসলে বলতে চেয়েছিল কুঞ্জঠাকুর—দাঁত তোমার ভেঙে দিত।
আপনে ঠাউরদা ভাইবেন না। বেচুর কথার দাম আছে! কোন শুয়োরের বাচ্চা আছে বলবে বেচু কথা ঠিক রাখে না। কোন শর্মা আছে লাল সড়কে, বলবে বেচু বেইমান। ঠগবাজ। বাপ জন খাটত। বিবেক ছিল না মানুষটার। বুদ্ধি কম। পুত্র তার পাইকার মানুষ। দারোগাবাবু দেখলে পর্যন্ত হাসে।
দারোগাবাবুর হাসার পর আর কথা নাই। কুঞ্জঠাকুর গোয়ালে ঢুকে বাছুরটা বের করে আনছে। গরুটা আগেই নিয়ে গেছে বেচু। বাছুরটা ঘাড় শক্ত করে রেখেছে। গোয়াল থেকে টেনে বের করা যাচ্ছে না। বেচু লুঙ্গি কোমরে খিচে ছুটে গেল এবং হ্যাঁচকা টান মারতেই হড়হড় করে বাছুরটা বের হয়ে এল। পালান তখন খেপে গিয়ে বেচুকে ঢিল ছুঁড়ে দিয়েছিল। ঘাড় তেড়া করে বলেছিল, শালা!
কী কু-কথা মুখে! কত মানি মানুষ বেচুদা। পালানের মা ছুটে এসেছিল। পালান মাকে দেখেই ছুট। তারে আর পায় কে! ঝোপ জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেছিল সে।
—দাদু!
—হুঁ!
হুঁশ ফেরে মানুষটার। সে তার উরাট জমিতে বসে পড়ে। হাঁটুতে বল পায় না। আকাল আসছে শুনেই শরীরটা কেমন তার দুবলা হয়ে গেল। চোখের সামনে বল ভরসা এই ভুঁইটুকু। বছরকার খোরাকি টানাটানি করে হয়ে যায়। খরা দেখা দিতেই সে কেমন একটা তরাসের মধ্যে পড়ে গেল। ভাবনা তার, নাতিটার কী হবে।
সে বসে থাকে। আর উঠতে ইচ্ছে হয় না। গাছগুলি থেকে মরা মরা গন্ধ উঠছে। সে নাক টানলে গন্ধটা পায়। গাছের গুঁড়ি শুঁকে বুঝল, সব শেষ। হাত দিয়ে গাছের গোড়ায় শেষবারের মতো কী খোঁজে। না নেই। ধুলোবালি ওড়ে শুধু তারপর কেমন আবাল মানুষের মতো হাউহাউ করে তার কান্না পায়।—হ্যাঁ আমার সোনার ধানরে!
পালান লাফিয়ে বেড়াচ্ছে জমিতে। পরনে ইজের। খালি গা। রোদ ঝলকাচ্ছে। উত্তুরে হাওয়া পালানকে কাবু করতে পারে না। জমিতে এলেই সে বোঝে, এটা তার দাদুর জমি। বাবা তাকে কাঁধে করে নিয়ে আসত। নিড়ান দেবার সময় সে আগাছা তুলে নিয়ে জমা করত আলে। মাথায় করে নিয়ে আসত এক থালা ভাত। বাপ দাদু নাতি খেত উবু হয়ে। সেই বাবাটার যে কী হল! আর সে বাবাকে দেখে না। কবেকার কথা যেন। বাবা জমি নিয়ে কত কথা বলত। জমি মানুষের বল ভরসা, বলত। বাপ না থাকায় দাদুর যে কী হল, কোথাও গেলেই কেবল ডাকে—হা পালান দূরে যাস না। রোষে পড়ে যাবি। সেই দাদুটা জমিতে বসে হাউহাউ করে কাঁদছে! সে ছুটে গেল দাদুর কাছে। দেখল, দাদু উবু হয়ে জমিতে পড়ে আছে। গাছের গুঁড়ি মুঠো করে ধরা।
সে ডাকল, দাদু, ও দাদু। ওঠ। ওঠ না দাদু!
পালানের ডাকে কুঞ্জঠাকুর স্থির থাকতে পারে না। উঠে বসে। তাকায়।
—পালান। আমাকে ডাকছিস! ভয় পেয়ে গেছিলি নারে!
পালান বড় বড় চোখে দাদুকে শুধু দেখে।
—পাশে বস। পালান দাদুকে জড়িয়ে ধরে পাশে বসল। বলল, তুই কাঁদছিস! আমি বুঝি!
কী বুঝিস?
বাবা নেই বলে তুই কাঁদছিস!
ধুস, তুই আছিস না! একটা বছর বেঁচে থাকতে পারবি না! একটা বছর! তারপর আবার বিড়বিড় করে বকতে থাকে—বেচু তুই আমার বাড়িটায় ঘুঘু চরাতে চাস। ভাগাড় বানাতে চাস। বুঝি। পালানের মাকে বার করে নেবার তালে আছ। সব খালি করে দেবে! আমার পালান আছে না! গাছেরও গাছ থাকে। বীজেরও বীজ! গাছ বড় হয়, বাড়ে। ফুল ফোটে—ফল ধরে।
—কী বলছিস দাদু—বুঝি না।
—তোর মা কখন ফিরবে বলে গেছে রে?
—তোকে বলেনি কিছু?
—না। আমাকে বলবে কেন! আমি ত একটা মরা গাছ।
—ফিরতে রাত হবে।
—রাত করে ফেরাটা ভাল?
পালান বলল, দাদু ওঠ। বাড়ি যাব। খিদা পেয়েছে।
তারপরই মনে হয় বুড়ো মানুষটার; তার মাথা খারাব হয়ে যাবে নাত! পালান এ-সবের কী বোঝে! রাত করে ফিরলে কী হয় সে জানবে কী করে। রেলগাড়ি চড়ে যায় আসে। লেট থাকে গাড়ি—রাত হতেই পারে। বেচু পালানের মাকেও বেচাকেনাতে লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তরাসে পড়ে গেলে যা হয়, সে ভাবে, আসলে কলকাঠি নাড়ে বেচু। আবাদের নাম করে গরুবাছুর গেল, জমির খড় গেল। পালানের মাটা না আবার হাতছাড়া হয়ে যায়! মুখরা মেয়ের সঙ্গে সে পেরে ওঠে না। বললেই, এক কথা—খাবে কী! ইজ্জত ধুয়ে খাবে! সবাই লেগে পড়েছে। কিন্তু বউ তোর শরীর বড় না তোর পালান বড়—আমি যে কিছু বুঝি না!
—ও দাদু বলছি না খিদে পেয়েছে। খাব। চল বাড়ি যাই।
—বাড়ি যাবি। খাবি! তোর মা আর কী বলেছে রে!
—কী বলবে?
—এই না মানে বেচুটা, বেচুটা কোথায় এখন কে জানে—পালানরে….।
পালান কিছুই বোঝে না। দাদুটা তাকে কেন যে কেবল ভয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। আর ভয় পেলেই তার এক কথা—আমার মা আছে জান!
—ঐ এক কথা তোর ব্যাটা! গাছের সঙ্গে কথা পাখির সঙ্গে কথা—আমার মা আছে জান! জানব কিরে ব্যাটা। মা আমারও ছিল।
—তোমার মা আছে?
—আছে না! মানুষের মা না থাকলে চলে?
—কই কোথায়? দেখাও।
বুড়ো মানুষটা থাবড়া মারল ভুঁইয়ে।—আমার জননী। তারপরই কেমন পাগলের মতো পালানকে দু-হাত বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, ব্যাটা আসলে তুই ভয় পেলেই কথাটা বলিস। আমার মা আছে। কেন আমি আছি না। গাছেরও গাছ থাকে–আমি আছি না।
কী যে বকবক করতে পারে দাদু।—এই ওঠ যাব। খিদা লেগেছে। সে হাত ধরে দাদুকে টানতে থাকে।
সে হা হা করে হাসল।—জননীর কোল। বড় শক্তরে তোলা। টান দেখি। মুরদ কত দেখি। পারলি না। বলেই কুঞ্জঠাকুর মরা ধান গাছের ভেতর পা দু-খানি ছড়িয়ে দিল।
পালানের চোখ গেল তখন জমির দিকে। একটা বাছুর নেমে আসছে। জমিতে মুখ দেবে। গাছগুলো মুড়িয়ে খেতে কতক্ষণ। সে জানে বাছুরটা তাদের শত্রুপক্ষ। আবাদ লেগে যেতেই দাদু তাকে জমিটায় পাহারা বসিয়ে দিয়েছিল। সব সময় সতর্ক নজর, গরু ছাগলে সব না খায়। দাদুর কী তরাসও পালান যা, দেখগে জমিতে গরু বাছুর পড়ল কি না। গাছ বড় হচ্ছে, সবার লোভ। মানুষের লোভ। গরু-বাছুরের লোভ। পাখ-পাখালির লোভ। দাদুর হাঁক পেলেই সে ছুটত। হাতে মরা ডাল, সামনে যা কিছু পেত, হাতে নিয়ে ছুটত।
দূর থেকেই ঢিল ছুঁড়তে থাকল পালান। এগিয়ে যাচ্ছে, আর ঢিল ছুঁড়ছে। ভ্রূক্ষেপ নেই। ইজের খুলে গেল ছুটতে গিয়ে। ইজেরটা বগলে নিয়ে আবার ছুটল। বাছুরটার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন কিছু বোঝে না মতো পালানকে একবার মুখ তুলে দেখল। পালান বুঝল, ব্যাটা বড় ধুরন্ধর। ল্যাজ মুচড়ে না দিলে নড়বে না। পালাবে না। সে প্রথমে হাতে থাবড়া মারল বাছুরটার পিঠে। নড়ছে না। কী বেহায়া রে বাবা, বলছি না, যা। আমাদের জমি। আমাদের ধানগাছ। যা। যাবি না। বলেই সে লেজে মোচড় লাগাল। মোচড় খেয়ে বাছুরটা লেজ তুলে পালাল ঠিক, কিন্তু পালান লাথি খেয়ে পড়ে গেল। লাগে নি। সে উঠে দাঁড়াল। ইজেরটা দিয়ে মুখ মুছে তাকাল জমিটার দিকে। দাদুকে দেখতে পেল না। সে যে কত কাজের দাদুটা দেখল না। সে যে কত সাহসী দাদুটা বুঝল না।—আমি ভয় পাই! দাদুটা না কী! আমি ভয় পাব কেন, আমার মা আছে না। ভয় তোর! তোর মা নেই। গাছের মা নেই। পাখি প্রজাপতির মা নেই। তা সে বলে! একা থাকলে বলে। মা নেই বাড়ি, দাদু গেছে হাটে তখন তার তো গাছ পাখি প্রজাপতি একমাত্র সঙ্গী। এরা তার সঙ্গে কথা বলে। সেও বলে। গাছ একা দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে কেউ খাওয়ায় না। পাখি উড়ে বেড়ায়, কেউ তারে খেতে দেয় না। ফড়িং প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়—কেউ তারে সঙ্গ দেয় না। তার কষ্ট হয়। সে বলে তোমাদের কেউ নেই না।
গাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। পালান কান পেতে শোনে। গাছে উঠে ডালে বসে থাকলে হাওয়ায় কারা যেন বলাবলি করে।–পালানটা আমাদের ডাল ভেঙে দেয়। পাতা ছিঁড়ে নেয়। ওকে আসকারা দিও না। বড় খারাপ পালান। ওর কান মুচড়ে দাও।—হুঁ কান মুচড়ে দেবে না! জান না, আমার মা আছে। তোমাদের মা আছে! মাকে বলে দেব। কিংবা তার এটাও হয়, কতদিন দেখে একটা গাছ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বড় একা!—তোমার মা নেই! এমন প্রশ্ন করে সে। নিজেই আবার কি ভেবে বলে, আমার মা আছে। মা বেথুয়াডহরি গেছে। বেলাবেলিতে ফিরে আসবে। আমার জন্য পানিফল আনে—জান!
বুড়ো মানুষটা দেখতে পায়, তার নাতির চারপাশে সব মরা ধানগাছ হাওয়ায় দুলছে। যেন তারা বেঁচে আছে মতো নাতিটাকে ছলনা করতে চায়। ওরে পালান, এরা আর গাছ না। খড়। পালান বড় বড় চোখে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে। খড়ের ভিতর উবু হয়ে আছে বলে পালান তাকে দেখতে পাচ্ছে না। পালান বোঝে না, তার পাহারার কাজ শেষ হয়ে গেছে। জমি উরাট হয়ে আছে। হাঁরে পালান সব জ্বলে পুড়ে গেল। সে থুথু ছিটায়। মুখে পোকামাকড় ঢুকে গেলে যেমনটা হয়ে থাকে। সে হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট থেকে লালা মোছে। থুথুর সঙ্গে ওক উঠে আসে। —ছেনালির ছলনার অন্ত নাই গ! কাকে বলে বোঝা যায় না। বেচু না প্রকৃতিকে বোঝা যায় না। উরাট জমি না পুত্র-বধূকে বোঝা যায় না।—তোর খেতায় আগুন। আমার আবাল নাতিটা কিছু বোঝে না। থু থু। তারপরই ফের থাবড়া মারে ভুঁইয়ে—এই আমার জননী তুই। পেটে থাবড়া মারে।—গর্ভের রস লুকিয়ে রাখতে পারলি না! তুই না জননী! তারপর সে গাছের ফাঁকে মাথা তুলে দেয়। চারপাশটা দেখে। উরাট জমিতে দূরে দূরে ঘোরাফেরা করে মানুষজন। হা-হুতাশ সম্বল সবার। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। কনকনে উত্তরে হাওয়া শুধু ক’দিন থেকে প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে। আকাশ ঘোলা-ঘোলা। ঘূর্ণিঝড় ওঠে। খড়কুটো ভেসে যায়। বৃষ্টি আসে না।
তা বেচু তুমি নিতে পার। গরু বাছুর নিয়েছে, এও নিয়ে যাও। তোমার হক। দশ কেজি গম, তাই দিও। পালানের মা যখন রাজি আমিও রাজি। সেই রাত থাকতে বের হয়ে গেছে গাড়ি ধরতে। বেলাবেলিতে ফিরে আসার কথা। কোনদিন আসে, কোনদিন আসে না। বড় তরাস লাগে। একা না হয়ে যাই বেচু! দূরে বসে সুতো নাড়ানাড়ি চলছে তোমার!
বেচু, তোর ত মাগ ছেলে আছে বাছা। রেগে গেলে তুই তুকারি করার স্বভাব। নাকি মাথাটাই গণ্ডগোল। বয়স হয়ে গেলে স্মৃতিভ্রংশ হয়। এ বয়েসে সে এতটা বুড়ো হয়ে গেল কেন! সংশয়, অভাব, অন্নচিন্তা, না গাছেরও গাছ থাকে, বীজেরও বীজ—আসলে পালানের কথা ভেবে মাথা খারাব হয়ে যাচ্ছে। সে এটা বোঝে। চোখ ড্যাপড্যাপ করে নাতিটার। বড় বড় চোখে নিশিদিন পৃথিবীটাকে দেখছে। সে আকাল বোঝে না। উরাট বোঝে না। খাওয়া ছাড়া আর কিছু প্রত্যাশা করার আছে সে জানে না। সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো মানুষটার কেন জানি মনে হয় গরু বাছুরের জীবনের মতো এক জীবন পালানের। পালানকেও না বেচু এক হাটে কিনে অন্য হাটে বিক্রি করতে যায়! বেচু না পারে হেন কাজ নেই। তা বেচু তুমি কেন চোখ দাও বাছা। অভাবের কথা বল, কোন সংসারে না আছে। কোন সংসার না জ্বলছে! পালানের মার সঙ্গে কথা বলার সময় এত অ্যাকটিন কেন বাছা! চাঁদের মেয়ের পালাগান আমার উঠোনে—ঘর ছাড়া করার তালে আছ! জন-মজুরের বেটা তুই, তোর এত বাড়!
বুড়ো মানুষটা বিড়বিড় করে বকে আর গাছ উপড়ায়। যত ক্রোধ এখন এই জমির খড়ে। —বেটারা সব মরে গেলি! কত কষ্ট করে তোদের রুয়েছি। তোরা জমিতে লেগে যাবি কত আশা! তার চোখে জল দেখা দেয়। সে তবু দু হাতে গাছগুলো ওপড়ায়। থামে না। কেবল পাগলের মতো যত পারছে তুলে ফেলছে। বেচুকে দেবার আগে যতটা পারে উপড়ে ফেলে দেবে। না হয় পুড়িয়ে দেবে। দশ কেজি গম! আমার আবাদের দাম নেই। আমার খাটনির দাম নেই। জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় গেল, জল নেই ঝড় নেই। শাবনে জল এল ঝড় এল। মাটি ভিজল। চপর চপর বৃষ্টির ফোঁটায় সেও ভিজল। ত্যানাকানি পরে দিনমান জমির কাদান রোয়া সব। হায় আশা কুহকিনী! পালানের মা তুই ঘরের বার হলি, ফিরবি ত!
সহসা কেমন সব কথা থমকে গেল তার। মাথার উপর দিয়ে একটা শকুন উড়ে গেল! পালানটা কোথায়! না আছে। জমির মধ্যে উবু হয়ে বসে আছে। কোন কীট-পতঙ্গ ধরার তালে আছে। এ-সময়টাতে শকুন আসারই কথা। প্রকৃতির খ্যাপামি টের পেয়ে গেছে। তা অখাদ্য কু-খাদ্য খেয়ে মড়ক লাগতেই পারে। সকালে গম ভাজাভুজি তবু পেটে যাচ্ছে। রাতে এক মুষ্টি অন্ন। এই করে বাঁচা। সামনের মাসগুলিতে কী হবে কে জানে বাপ! খকখক করে কাশল দু বার। দম নিল। টানছে, ওপড়াচ্ছে। দশ কেজি গমে সবটা আবাদ তোর গরু বাছুরে খাবে! খাওয়াচ্ছি। সুতা নাড়ানাড়ি তোমার সব বের করব। আমার পালান আছে না।—ও পালান, পালানরে!
—দাদু আমি এখানে। ডাকছ কেন!
—দূরে যাস না। রোষে পড়ে যাবি।
পালান জানে দাদু তার অহরহ কথা বলে। দাদুর কোন কথাই সে ঠিক বুঝতে পারে না। কেবল বলল, রোষ কী দাদু!
—দেখছিস না, শকুন উড়ছে!
—কোথায়!
বুড়ো মানুষটা মাথা তুলে দেখল শকুনটা নেই। কোথায় উড়ে চলে গেছে।
—কোথায় শকুন দাদু!
—উতো তোর আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।
পালান বলল, যা মিছে কথা! সে আবার ফড়িংটার পেছনে মনোযোগ দিল। ধরতে পারছে না। উবু হয়ে বসে আছে। যেন টের না পায় কোন মনুষ্যের অপোগণ্ড বসে আছে একটা মরা গাছ হয়ে। গাছ ভেবে বসলেই খপ করে ধরে ফেলবে। তারপর ল্যাজে সুতোটা বেঁধে উড়িয়ে দেবে হাওয়ায়।
খাবলা মেরে ওপড়াচ্ছে আর সেই মতো বকবক করছে।–পুড়িয়ে দেব। তবু শালা বেচুর গরু বাছুরের পেটে যেতে দেব না। কপালে লেখা থাকে। না’লে লায়েক বেটারে কালে খাবে কেন! কপালে লেখা থাকে সব। গরু বাছুর গেছে, আবাদ গেছে। খড় সার। সেও খাবে বেচুর গরু বাছুরে। আর থাকল, পালান আর তার মা। মাকে নিয়ে সুতো নাড়ানাড়ি চলছে। কখন যায়! থাকল সে আর পালান। গাছ আর বীজ।
সে তেমনি পাগলের মতো গাছগুলি উপড়াচ্ছে। কেমন হুঁশ নেই মতো। মাঝে মাঝে, হাঁক শুধু, পালান, পালানরে।
শেষবারের হাঁকে পালানের কোন সাড়া পাওয়া গেল না। সে ফের ডাকল, পালান, পালানরে!
সাড়া দিচ্ছে না।
গাছের ফাঁকে মাথা তুলে দিতেই দেখল, আলে দুটো পাখি কী খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। পালান পাখি দুটোর খাওয়া দেখতে দেখতে ভারি নিবিষ্ট হয়ে গেছে। তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। পালান তার ছোট্ট গণেশ ঠাকুর। ইজের কোলে নিয়ে বসে আছে। কোমরে একটা ফুটো তামার পয়সা। হাত পা রোগা, পেটটা সার পালানের। ঘাসের মধ্যে তার দু-খানি পা।
পালানের কী তার বাবার কথা মনে পড়েছে! বাবা মা। এক জোড়া পাখি। বাবা মা ছাড়া আর কী হবে! কী দেখছে এত মগ্ন হয়ে! কেমন নেশাতে পেয়েছে তাকে। গালে হাত। কিংবা কোন তুকতাক করে কেউ বসিয়ে দিয়ে গেছে পালানকে। বাহ্যজ্ঞান শূন্য।
সে ডাকল, এই পালান, কি দেখছিস?
কোন সাড়া নেই।
বুক ধড়াস করে ওঠে। কোন অশুভ প্রভাবে পড়ে যায়নি ত!
—পালান শুনতে পাস না।
পালান ওপরে চোখ তুলে তাকাল। সে তার দাদুকে দেখতে পেল না। দাদুটা কোথায়!
—ও দাদু, দাদু আমাকে ডাকছিস!
—আমি ডাকছি।
পালান ছুটে গেল। দেখল, দাদু খড়ের জঙ্গলের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
—কী করছিস দাদু!
—হাত লাগা না ব্যাটা।
সে বুঝতে পারছে না কিছু। দাদু গাছগুলো উপড়ে ফেলছে কেন! বলছে কেন, হাত লাগা না ব্যাটা। খড়ের ডাঁই হয়ে আছে পাশটা। দাদু কথা বলার চেয়ে গাছগুলো উপড়ে ফেলা বেশি দরকারি কাজ মনে করছে।
—ও মা, সব তুই তুলে ফেলছিস। মা বকবে।
—হাত লাগা, হাত লাগা। মা মা করবি না।
—মাকে বলে দেব দেখিস।
হঠাৎ বুড়ো মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল। চোখ লাল। কেমন ক্ষেপে গেছে। বলল, চউপ শালা। একদম মার কথা মুখে আনবি না। মুখে আনলেই গলা টিপে ধরব।
—আমি সালা! না তুই সালা! পালান বগলে ইজের নিয়ে তেড়ে গেল।
তারপর দাদুর হাঁটুর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা গোঁজ করে বলল, জান আমার মা আছে।
—তোর মা তবে সত্যি আছে! বুড়ো মানুষটা পাশে উবু হয়ে বসল।
—হ্যাঁ আছে ত!
—তোর মা যদি আর না ফেরে?
—ফিরবে না কেন! মা আমার ফিরবে না কেন দাদু?
বুড়ো মানুষটা দেখল, পালানের চোখ ছলছল করছে। জলে ভার হয়ে আসছে। সে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, না এমনি বললাম। আসবে না কেন। ঠিক আসবে। আকাল আসছে, উড়ে যাবে ভয়ে বলছি, না না আসবে। গাছেরও গাছ থাকে, বীজেরও বীজ। গাছ বড় হয়। ফুল ফোটে। ফল ধরে।
পালান দাদুর কথা কিছুই বোঝে না। দাদু যে কী সব অহরহ বলে! সে বোঝে না বলেই তাকিয়ে থাকে। এক হাতের বগলে ইজের, অন্য হাত কোমরে। যেন দাদুটা তার দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। সে এক হাতে দাদুর গলা জড়িয়ে বলল, ডর লাগে দাদু!
—ডর লাগে ক্যান রে?
—তুই আমার কী দেখিস।
—কী দেখব! দেখি তোর চোখ মুখ।
আসলে বুড়ো মানুষটার মনে হয় পালানের বাপও তার দিকে ভয় পেলে এমনিভাবে তাকিয়ে থাকত। মরে হেজে ছিল একজন, তাও শেষে চলে গেল। তার কপালে কিছু সয় না।
বুড়ো মানুষটা বলল, আয় কাঁধে নি। বলে হাত বাড়াল!
—দাদু ওরে রক্ত রে!
—কোথায়!
—তোর হাতে!
গাছ উপড়াতে গিয়ে টানাটানিতে রক্তপাত। তার কোন হুঁশ ছিল না তবে! সে চোখের সামনে হাত দুটো নিয়ে দেখল—জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। কেটে গেছে। কিছুই টের পায়নি! হাত ঠাণ্ডায় অবশ।
বুড়ো মানুষটা বলল, ও কিছু না।
হাত জ্বলছিল না। ঘাসে রক্ত মুছতে পারে—তবে লাগবে। ঘাসের খোঁচা লেগে ক্ষত আরও বড় হবে। হাত বরফের মতো ঠাণ্ডা। সে পালানের দু-গালে হাত দুটো উষ্ণতার জন্য চেপে রাখল কিছুক্ষণ। অসাড় হাত দুটোতে বল সঞ্চার হচ্ছে। সে বলল, আয় এবার তোকে কাঁধে তুলে নিতে পারি কিনা দেখি।
পালান প্রথমে তার ইজেরটা দাদুকে দিল ধরতে। তারপর সে হাঁটুর উপর উঠে দাদুর কাঁধে ঠ্যাং গলিয়ে দিল। ওঠার মুখে বুড়ো মানুষটা বলল, ভাল করে ধরিস, বলে সে তার লাঠি ভর করে উঠে দাঁড়াল। বলল, আকাল আসছে জানিস?
আকাল কী পালান বোঝে না। মার মুখে শুনেছে, আকাল আসছে। দাদু বলছে, আকাল আসছে। আকাল কী রকম দেখতে—রাক্ষস না ডাইনি। ভূত পেত্নী যদি হয়! সে বলল, দাদু আকালে মানুষ খায়।
বুড়ো মানুষটি হেঁটে যাচ্ছে। কাঁধে তার পালান। নিচে তার দু-খণ্ড ভুঁই। সে বলল, হ্যাঁ খায়।
—গরু বাছুর খায়?
—হ্যাঁ খায়।
—বেচু শালাকে খায়?
—না, খায় না।
এ-কেমন কথা? আকালে মানুষ খায়, গরু বাছুর খায়, বেচু শালাকে খায় না। ভারি তাজ্জব হয়ে গেল পালান। বলল, বেচু মানুষ না দাদু?
—বেচু মানুষ না। অপদেবতা।
—অপদেবতা কি দাদু?
—অপদেবতা হল গে, অপদেবতা হ……. ল….. গে….—কিসের সঙ্গে তুলনা করবে বুড়ো মানুষটা ঠিক বুঝতে পারল না।
পালান দু-হাত এক করে বন্দুক ছুঁড়ছে মতো বলল, আমারে একটা বন্দুক দিবা।
—তা দেব নে। কিন্তু ভিতরে অস্বস্তি, নাতিকে ঠিক আকাল কী বুঝাতে পারছে না। আকাল হল অপদেবতা, এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু অপদেবতাটা কী! শেষে অনেক ভেবে বলল, মনে নেই মলিনের মারে অপদেবতা ভর করল! ছিটালে বসে থাকত। ওঁয়া ওঁয়া করত। ঘরে ঢুকতে চাইত না! তারপরই বলল, ভয় ধরছে না ত শুনে! ভয় থেকে তরাস। তরাসে পড়ে দু-মাসেই সে কেমন জবুথবু হয়ে গেল। তার দাবনা দুবলা হয়ে গেল। হাঁটতে গেলে হাঁটু ভেঙে আসে। মানুষজন দেখলেই এক কথা তার—কি জমি উরাট, না শ্যালো আছে? ডিপ টিউকল আছে কিনা—না আবাদ তার মতো শুখা মাঠে মারা গেল! কেবল শ্যালোর মালিকরাই চুটিয়ে আবাদ করেছে। বেচুই খবর দিয়ে গেছে সব। সে এবারে রাখি করবে। রাখি, হলগে রক্ষণ, যারে কয় সংরক্ষণ। কার্ড মিলে গেছে তার—দারোগাবাবু যারে দেখলে হাসে, তার আর কার্ড মিলতে কতক্ষণ!
আর তখনই পালান সহসা চিৎকার করে উঠল, দাদু ওরে ব্বাস—কী একটা উড়ে আসছে রে দাদু। দ্যাখ দ্যাখ।
কাঁধের উপর আছে পালান। সে জমিতে দাঁড়িয়ে। নাতিকে নিয়ে বের হয়েছিল—ঘরে থাকলেই খাব খাব করে। এই ঘুরে ফিরে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা। জমিতে নেমে মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। নাতিকে কাঁধে নিতেই কোথা থেকে শক্তি সঞ্চার হচ্ছে—আর তখনই কী না কী উড়ে আসছে! বিশাল অতিকায় কিছু ঘাড়ে পালান লাফাচ্ছে—ও দাদু ওটা কি উড়ে আসছে রে। ওরে বাব্বা—
ঘাড়ে পালান। হাতে লাঠি। সে ঠুকে ঠুকে হাঁটছিল। কিছু একটা তবে উড়ে আসছে। বাতাসে সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছিল। কোথায় কোনদিকে—পালান ঘাড়ে বলে উপরের দিকে তাকাতে পারছে না।—কৈ দেখছি না ত!
—ঐ দ্যাখ!
সে পালানকে ঘাড় থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। উত্তরের আকাশ থেকে আর একটা শকুন নেমে আসছে।
সে বিড়বিড় করে বকল, এই হলগে আকালের চেহারা। তেনারা নেমে আসছেন। এতক্ষণ সে কী যে হাবিজাবি কথা বলে পালানকে আকাল বুঝিয়েছে। গাছের মাথায় বসে থাকবে। ঘাড় কাত করে দেখবে কিংবা বাতাসে পাখা মেলে দেবে উচ্ছিষ্টের লোভে। প্রকৃতির যা কিছু উচ্ছিষ্ট ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে। তারপর আবার বাতাসে পাখা মেলে দেবে।
—ঐ দেখ আর একটা দাদু। কত্ত বড়!
—শকুন। শকুন দেখিস নি! ভয় পেয়ে গেলি। ধুস, ওঠ কাঁধে।
পালান কাঁধে উঠতে চাইল না। বুড়ো মানুষটার দু হাঁটু জড়িয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে থাকল। উত্তরের আকাশ থেকে উড়ে আসছে তারা। এদিকে ভেসে আসছে। পালান দেখছে। বুড়ো মানুষটাও দেখছে। অতিকায় ডানা মেলে ঠিক মাথার উপর ভেসে বেড়াতে থাকল। পালান ভয়ে বুড়ো মানুষটার দু হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে দিল।
শকুনের ওড়াওড়ি দেখে তারও কেমন ভয় ধরে গেল।—তালে কি মরা গন্ধ উঠছে তার শরীর থেকে! সেও কি আর একটা খড়ের জমি! বেচুর গরু বাছুরে খাবে বলে মাথার উপর ভাসছে! সে দ্রুত পা ফেলতে থাকল। নালে মাথার উপর ওগুলো ওড়াউড়ি করছে কেন! সে পালানের হাত ধরে ছুটতে থাকল।—পালান আয়। শিগগির আয়। সব বেচুর কম্ম। ঠিক ছেড়ে দিয়েছে। আবাদ বলে কথা। আয় আয়। আমি না হয় খড়ের জমি—তুই। তোর ঝাড় হবে। তুই বাড়বি। বড় হবি। গাছেরও গাছ থাকে। বীজেরও বীজ । গাছ বড় হয়, ফুল ফোটে। আয়। তাড়াতাড়ি আয়। ফল ধরে—বীজ হয়। আয়। তাড়াতাড়ি করে কররে ব্যাটা। বীজ উড়ে না গেলে গাছ তারে ছাড়ে কী করে! সে পালানকে আড়াল করে পাগলের মতো আকালের কাছ থেকে ছুটে পালাতে থাকল। 🍁
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ৭
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ ‘একটি বিষণ্ণরাতের তারা’ উপন্যাসের পর্ব ৭।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
৭
স্বপ্নে এক বিরাট অজগর আমাকে গিলতে এলো
কলেজ ম্যাগাজিনে লেখা চাইলেই মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। শুধু নিজের নামেই নয়, রুমার নামেও একটি কবিতা লিখে দিলাম। জীবনের প্রথম প্রেম কত স্বপ্ন নিয়েই না উপস্থিত হয়। আর কবিতাও আসতে থাকে তখন বারবার। রুমাকে কিছুই বলতে পারিনি, শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি অনেকক্ষণ ধরেই।
—কী হলো অমন করে তাকাচ্ছ কেন?
—তাকাতে খুব ভালো লাগছে। ওই চোখের তারায় হারিয়ে যেতে মন চাইছে।
—পাগলামি করছো না তো?
—পাগল তো হয়ে গেছি, তাই পাগলামি করলেও কিছু মনে করো না!
—খুব ভালো শিখেছো দেখছি! যে ছেলেটি কথা বলতে পারতো না, তারও কত কথা আছে ভেতরে আজ তা বুঝলাম।
—কথা তো বলতেই হবে,কথাতেই তো কবিতা হয়!
যে কথাটি চাইছি বলতে
তা এখনো হয়নি বলা।
যে পথ দিয়ে চাইছি চলতে
তা এখনো হয়নি চলা।
—বাহ চমৎকার বললে! এটাই তো একটা কবিতা হয়ে গেল!
—তোমার কাছেও শুনতে চাই কবিতা। তুমি তো একদিন বলেছিলে, ‘আমিও লিখেছি’!
—তোমার মতো লিখতে পারি না। তবু তোমাকে দেখাবো একদিন।
কিন্তু রুমা আর কবিতা তখনকার মতো দেখাতে পারেনি। কলেজ ম্যাগাজিনে ওর নামে যে কবিতাটি দিয়েছিলাম, সেই কবিতাটিও প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতার পাশে দিয়েছিল একটি একতারা বাজানো বাউলের ছবি। প্রথম সারপ্রাইজ হিসেবে পত্রিকাটা খুলেই রুমা অবাক হয়ে গেছিল। ‘এ কবিতা তো আমি লিখিনি’ তা বললেও কেউ বিশ্বাস করেনি। তখন ও নিজেই বলেছিল, এটা তোমারই কাজ। কবিতাটি ছিল এরকম:
আজ বাগানে ফুল ফুটেছে
এসেছে নতুন পাখি।
আজ বাগানে তাই বসন্ত
দু’চোখ মেলেই দেখি।
উড়ছে আঁচল হাওয়ায়
দুলছে আমার বেণী
হৃদয় হতে নামছে ঢেউ
সুরের ঝর্ণাখানি।
তুমি তবে বাউল হও
আমিও বাউলানি
রাঙামাটির ধুলোপথে
লেখা হবে প্রেমের কাহিনি।
কবিতাটির নাম ছিল ‘বসন্তবাউল’। তখন ক্লাসে প্রথম পাঠ করছি চণ্ডীদাসের পদাবলী। শিহরন জাগছে মনে, হৃদয়ে। রাধার হৃদয়ের ব্যথা অনুভব করতে শিখেছি। রুমা-ই কখন হয়ে উঠেছে রাধা। যাই হোক কবিতাটি পড়ে রুমার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছিল। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কী যেন ভেবেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুশিই হয়েছিল। সেই দিনই বাসস্ট্যান্ডে এসে একটি নতুন মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খাইয়েছিল রুমা। আমি বলেছিলাম, কবিতা লেখার জন্য কি মিষ্টি দিচ্ছ?
রুমা বলেছিল, কবিতা লেখার জন্য নয়, কবিতাটি ভালো লাগার জন্য। কবির হৃদয়ে এক বাউলের দেখা পেলাম। সেই বাউলকে কি না ভালোবেসে পারি?
আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, আমি তো এই বাউলানিকেই খুঁজছিলাম এতদিন। প্রতিটি বাউলেরই একজন সাধন সঙ্গিনী দরকার হয়।
রুমা বলেছিল, আমি কি সেই সাধন সঙ্গিনী হতে পারবো?
আমিও হাসতে হাসতে বলেছিলাম, চেষ্টা করলে সবই পারো! এই জন্য শুধু দরকার একটি মন। মন যখন যা ইচ্ছে করে, তখন তা হয়। মন পাখি হয়। মন ফুল হয়। আবার মন বজ্র হয়। আগুন হয়। পাথরও হয়।
রুমা বলেছিল, তুমি কত ভালো করে সব বলতে পারো, আমি কিছুই পারি না। আজ তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেবো!
তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে রুমা আলতো করে আমার গালে তার ঠোঁট দুটি ছুঁইয়ে দিয়েছিল। প্রথম চুম্বনের শিহরনটুকু আজও ভুলতে পারিনি। অনেক কবিতায় মিশে গেছিল সেই চুম্বনের শিহরন। সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে নিজেকে এক পূর্ণতর প্রেমিক বলে মনে হয়েছিল। ছাত্রজীবনের একটা নতুন অধ্যায়। কবিতা জীবনেরও একটা বড় প্রাপ্তি।
ক্লাসের অনেক বই-ই আমি কিনতে পারিনি, সেসব বইগুলি সবই রুমার কাছে পেতাম। টিউশনি পড়তে পারিনি, কিন্তু রুমার লেখা নোটসগুলি সবই পেয়েছিলাম। এক একটি নোটসের খাতায় এক একটি কবিতা লিখে রুমাকে উপহার দিতাম। সব কবিতাগুলিতেই রুমার ছিল ভীষণ কৌতূহল। কোনোটাতে তার রূপের বর্ণনা, কোনোটাতে তার উদাসীন হওয়ার চিত্র। কোনো কোনোটাতে নিছক প্রেমের নিবেদন। প্রেম যে এত কবিতা লেখাতে পারে, ঝর্ণাধারার মতো এত শব্দ বেরিয়ে আসতে পারে তা সেই দিনই উপলব্ধি করেছিলাম। অভাব এবং কষ্টকে উপেক্ষা করার একমাত্র শক্তি ছিল প্রেম। আর এই প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করা, প্রাচুর্যমণ্ডিত করা, আবেগঘন শব্দের ইমারতে পরিণত করা সম্ভব যে কবিতায় তা বলাই বাহুল্য। রুমাদের অবস্থা ভালো ছিল। টাকা-পয়সারও অভাব ছিল না। তাই বেশিরভাগ সময়েই সেই মেটাতো আমাদের খাওয়া-দাওয়ার বিল। বাংলা নববর্ষে পান আঁকা গ্রিটিংস কার্ড সে-ই আমাকে দিয়েছিল। তার ভিতরে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিল ‘আমার স্বপ্নের মুকুল হোক তোমার হৃদয়’।
সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো প্রথম প্রেম জীবনে ভোলার ছিল না, তা কোনোদিন ভুলতেও চাইনি। দুটি বছর নানা লুকোচুরির মধ্য দিয়েই কেটে গেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে আমরা যে যার বাড়িতে অবস্থান করছিলাম, কিন্তু সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। রুমা তখন সপ্তাহে একটি করেই চিঠি লিখতো। প্রতিটি চিঠির সঙ্গেই লিখে দিতো একটি কবিতা। আবার কবিতাটি নানা ছবিতে অলংকরণও করতো। ওর হাতের লেখাও ছিল চমৎকার। একবার একটি চিঠিতে লিখেছিল, ‘তোমাকে না দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে না। সারাদিন শুধু কাজের ফাঁকে ফাঁকে তোমার মুখটি মনে পড়ছে। কী যে টান তা মুখে বলে বোঝাতে পারবো না। একদিন এসো না দুজনে বাসস্ট্যান্ডে দেখা করি আর ওই মিষ্টির দোকানে গিয়ে বসি! না শুধু কথা বলার জন্য নয়, তোমাকে দেখার জন্যও।’
চিঠির উত্তরে ওকে লিখেছিলাম, আমি তো কাজের জন্য অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে এখন আর দেখা করতে পারবো না। আবার যদি ফিরে আসি, তাহলে নিশ্চয়ই দেখা হবে। তুমি মন খারাপ করো না।
সেই সময়টায় আমি মুম্বাই শহরে কাজ করতে গিয়েছিলাম নিছক শ্রমিক হিসেবেই, কিন্তু রুমাকে তা বলতে পারিনি। বাড়িতে প্রচণ্ড অভাব ছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর হয়তো পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবারই আশঙ্কা। তাই পরীক্ষার পরপরই আরো কয়েকজন যুবকের সঙ্গে আমিও রওনা দিই। অন্তত দুই মাস কাজ করে যদি কিছু অর্থ উপার্জন করা যায় তাহলে আবার পড়া শুরু করা যাবে। জীবনটা যে এক বিন্দুও সুখের ছিল না, সেখানে স্বপ্ন ও প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখা যে কত কষ্টকর তা কাউকে জানতে দিইনি।
দুই মাস যাবত দাঁতে দাঁত চিপে নীরবে সব কষ্ট সহ্য করে বালি ও সিমেন্টের ভার বয়ে কাজ করে গেছি। শুধু বাড়িতে চিঠি লিখেছি—আমি ভালো আছি এবং কাজ করে চলেছি। কিছু টাকা উপার্জন হলেই বাড়ি ফিরে আসবো। কিন্তু রুমাকে আর চিঠি লিখতে পারিনি। সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে পূর্বের কত কথা মনে পড়েছে তার। একদিন সে নিজের হাতে আমাকে একটা চকোলেট খাইয়ে দিয়েছিল। একদিন একটা সুন্দর কলম উপহার দিয়ে বলেছিল, ‘এই কলম দিয়েই একটা কবিতা লিখে আনবে!’ হ্যাঁ, তার কথা রেখেছিলাম। সেই কলমেই লিখেছিলাম—
এখন কিছুই চাইছি না আর
একটি শুধু প্রিয় মুখ
ওই মুখেতেই আমার সকাল
ওই মুখেতেই সর্বসুখ।
মাথার ওপর থাকুক আকাশ
পায়ের নিচে সবুজ ঘাস
তাকে নিয়েই ধন্য জীবন
সেই তো আমার অভিলাষ।
আবারও সে খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু মুম্বাই শহরে কর্মক্লান্ত জীবনে তার কথা ভেবে ভেবেই পার করেছি প্রতিটি রাত। নিজের এই ছেঁড়াখোঁড়া জীবনের সঙ্গে তাকে কিভাবে মেলাবো? যে জীবন কপর্দক শূন্য, শ্রমিক বৃত্তি নিয়ে দেশ-দেশান্তরে দিন কাটায় সেই জীবনে স্বপ্ন কি মানায়? মনে বারবার সেই প্রশ্ন আমাকে বিদ্ধ করেছে। তাই বারবার ভুলে যাবার চেষ্টা করেছি আর তখনই আরো গভীরভাবে তাকে মনে পড়েছে। একদিন ভোর বেলায় একটি স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি একটি বিশাল আকৃতির অজগর সাপ আমাকে গিলতে আসছে। আমি পড়ি মরি করে ছুটে পালাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই পালাতে পারছি না। সাপটিও এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। বিকট চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে। দেখি সারা শরীর ঘর্মাক্ত। বুকের স্পন্দন বেড়ে গেছে তীব্র ভাবে। চটের বিছানায় উঠে বসে স্বপ্নটি বিচার করছি, এটা কি সত্যই স্বপ্ন না বাস্তব? মনে হলো এইমাত্রই যেন এরকম একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। (চলবে) 🍁
🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ৭
ইংরেজদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওয়ারেন হেস্টিংস -এর নেতৃত্বে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির যাবতীয় খরচ ওয়ারেন হেস্টিংসই বহন করত। পরবর্তীকালে অবশ্য কোম্পানি সরকার মাদ্রসাটির কর্তৃত্বভার সরাসরি গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের সুবিধার্থে মুসলমান সম্প্রদায়ের আনুগত্য লাভে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’-কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজ পর্ব ৭।
ভাষাবিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই
রেহানা বীথি
একটা সময় পর্যন্ত তো মুসলমানদের লেখাপড়া মক্তব অব্দিই সীমাবদ্ধ ছিল। ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা পদ্ধতিকে এড়িয়েই চলত তারা। তবে শহর কিংবা গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে লেখাপড়া শেখার আগ্রহ ছিল লক্ষ্যণীয়। মুসলমানদের মধ্যে লেখাপড়া বিষয়ে, বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহের মূল কারণ ছিল ক্ষমতা। মুসলমানদের কাছ থেকে যেহেতু তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল, সেহেতু তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাও ছিল একরকম ঘৃণার বস্তু। কিন্তু এর ফলে ক্ষতি হয়েছিল মুসলমানদেরই। কিছুটা দেরিতে হলেও এ সত্যটি তারা অনুধাবন করতে পারে। আর পেরে তারাও আগ্রহী হয়ে ওঠে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে এসেছিল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে তারা অনুমোদন নিয়ে এসেছিল এদেশে। যেহেতু ব্যবসাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাই তারা ভারতবর্ষের শিক্ষা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। মুঘল আমলে রাজ দরবারের ভাষা ছিল ফার্সি। ফার্সি জানা মানুষ সে সমাজে মুন্সি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ইংরেজদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওয়ারেন হেস্টিংস -এর নেতৃত্বে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির যাবতীয় খরচ ওয়ারেন হেস্টিংসই বহন করত। পরবর্তীকালে অবশ্য কোম্পানি সরকার মাদ্রসাটির কর্তৃত্বভার সরাসরি গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের সুবিধার্থে মুসলমান সম্প্রদায়ের আনুগত্য লাভে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল।
১৮ শতকের শেষের দিকে এদেশের শাসকবর্গ বাংলার নবাব, স্থানীয় জমিদাররা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আর এসময়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থা বা পদ্ধতি ছিল তা ছিল টোল ভিত্তিক। এখানে সাধারণত হিন্দু ছেলে মেয়েরা হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করত। মুসলমান ধর্মের জন্য ছিল মাদ্রাসা, যেখানে আরবি ও ধর্মীয় শিক্ষা লাভের পাশাপাশি তারা ফার্সি ভাষাও শিখতো। এছাড়াও ছিল মক্তব যা মসজিদের পাশে গড়ে উঠত। এখানে সাধারণত শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হতো। আর এসব বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজে যারা আর্থিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হতো। আর সমাজে ধনাঢ্য বা বিত্তশালীরা বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখে সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতেন। ইংরেজ গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংয়ের নেতৃত্বে নারী শিক্ষার জন্য বেথুন কলেজ ইংরেজি শিক্ষার বাহন হয়। এসময় ইংরেজি জানা শিক্ষিত ব্যক্তিদের সরাসরি চাকরি লাভের পথ প্রশস্ত হলে হিন্দুদের ভাগ্য খুলে যায়।
কারণ প্রথম থেকেই হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাটাকেও সহজভাবে গ্রহণ করে। অপরদিকে ইংরেজদের প্রতি আপোষহীন মনোভাবের কারণে তাদের শিক্ষাকেও উপেক্ষা করে আসছিল মুসলমানরা। যে কারণে তারা হিন্দুদের তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে অনেকটাই। মুসলমান আমলে যোগ্যতা অনুসারে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়। ফলে এ দুই সম্প্রদায়ের উন্নয়ন সমানভাবে হয়নি। ইংরেজিতে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের ধ্যান ধারণা ছিল পশ্চাৎমুখী, তারা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। আর সেসময় মাদ্রাসায় যেসব বিষয় শিক্ষা দেওয়া হতো তার পরিধি ছিল সীমাবদ্ধ এবং যুগের সঙ্গে চাহিদার সঙ্গতি ছিল না। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইউরোপীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবাদী চিন্তা এসবের সংস্পর্শে এসে যুগের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়, যা মুসলমান সম্প্রদায় পারেনি। ঠেকে শেখা যাকে বলে। মুসলমানরা যে সবদিক থেকেই অনেকটা পিছিয়ে যাচ্ছিল এটা তারা অবস্থাদৃষ্টে মেনে নেয়। আর নিজেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ যে ইংরেজি শিক্ষা বর্জন এটা তারা অনুধাবন করে ভালোভাবেই। তারা ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয় অবশেষে। তবে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ হয়নি সেভাবে। স্যার সৈয়দ আহম্মদের নেতৃত্বে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধের চেতনা বিকাশ লাভ করে। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রচেষ্টা পায় মুসলমানরা।
এরকম একটা সময়েই জন্ম নেন প্রফেসর আব্দুল হাই। মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর থানার মরিচা গ্রামে ১৯১৯ সালের ২৬ নভেম্বর বুধবার রাত দশটায় এক বর্ধিষ্ণু মুসলিম পরিবারে আবুল বাশার মুহম্মদ হাই সাহেবের জন্ম হয়। প্রবেশিকার সার্টিফিকেটে অবশ্য তাঁর জন্ম তারিখ ২ মার্চ ১৯১৯। তাঁর পিতার নাম আব্দুল গণি, মাতার নাম ময়মুন্নেসা খাতুন। (চলবে)🍁
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
🍁সম্পাদকীয় ঋণ : শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী সম্পর্কিত লেখাগুলি, ফিরে পড়া বিভাগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গল্প আন্তর্জাল থেকে সংকলিত।

2 thoughts on “Saraya News Sunday’s Literature Special | 22nd December 2024 | Issue 44 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪৪”