Sasraya News

Saturday, February 8, 2025

Post Editorial : সময়ের থেকে বেরিয়ে মানুষের ঘরে রাজনীতি

Listen

সময়ের থেকে বেরিয়ে মানুষের ঘরে রাজনীতি

মমতা রায়চৌধুরী 

 

‘চরেইবেতি..।’ জীবনের এই অমোঘ সত্যকে ভিত্তি করেই মানুষ জন্মের মুহূর্ত থেকেই অবিরাম গতিতে এগিয়ে চলতে থাকে মৃত্যুর দিকে। পৃথিবীও তার আপন কক্ষপথে ছুটে চলে। নদীও তার উৎসভূমি থেকে শুরু করে পাহাড় বাধা অতিক্রম করে সাগরে বিলীন হয়। আসলে এরা বোঝে থামা মানেই অস্তিত্বের বিনাশ। থমকে না গিয়ে শাশ্বত সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াই জীবন। তাই চলার গতি বন্ধ করে নয়,  গতিশীল জীবন নদীর স্রোতের মতোই সন্মুখপ্রবাহী। সময়ের গতি স্তব্ধ হয় না। ছন্দ মেনে তালে তালে সে একটার পর একটা বাধা পার হয়।

 

 

সময় এমন একটা বিষয় যা কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। সময় এতটাই মূল্যবান, সময়ে সমস্ত কিছুই করে নিলে সময়ের মূল্য যেমন দেওয়া হয় তেমনি নিজের প্রতিও। এই দায়িত্ববোধটুকু বোধহয় প্রত্যেকের থাকা উচিৎ। সময়ের থেকে যখন আমরা বেরিয়ে যাই তখন জীবনটা একটু অন্যরকম, কিছুটা এলোমেলো, বেসামাল অন্য খাতে প্রবাহিত হয়। হয়ত সেই চেতনাটুকুই আমাদের থাকে না, এজন্যই আমরা বেসামাল, এজন্যই হয়ত আমাদের মনুষত্ববোধ, আমাদের বিবেকবোধ অনেক সময় কাজ করে না।  ।তা-ই তো যেটা মানুষের জন্য করা দরকার, মানুষের জন্য ভাবা দরকার, সেসব না করে মানুষকে নিয়েই আমরা রাজনীতি করে ফেলি। আজকের দিনে ভোট-ব্যাঙ্কটা-ই হচ্ছে আসল! তার জন্য মানুষের সমস্ত আবেগ অনুভূতিকে নিংড়ে নেওয়া যায়। এই যে এত প্রতিশ্রুতি এত মানুষকে প্রত্যাশায় রেখে তাঁদের আবেগগুলোকে নিয়ে খেলা, কত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নষ্ট করে দেওয়া সেখানেই তো সময় থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। তাই যদি না হবে আজকের সময়ের রাজনীতি এতটাই ভণ্ড যে ভবিষ্যৎ জীবনের সমাজের রাষ্ট্রের যাঁরা কর্ণধার তাঁদেরকে তাঁদের জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে একটুও বিবেকে বাঁধে না। আজ তাঁদেরকে রাস্তায় দাঁড়াতে হয় চাকরির জন্য। সেই মূল্যটা পায় না অথচ তাঁদের ঘরে হয়ত পিতা-মাতা রয়েছেন, হয়ত আরও কিছু পারিবারিক অবলম্বন তাঁকে কাঁধে তুলে নিতে হবে কিন্তু সেই কাঁধকে আগেই ভেঙে দেয়া হয়। স্পষ্টতই তাঁদের ইমোশনগুলোকে নিয়ে খেলা করা হয়। একটা সুখী সংসার গড়ে উঠতে পারে, কত স্বপ্ন কত আশা আকাঙ্ক্ষা সব ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, এই সময়ের মানুষের ঘরে যখন এই রাজনীতি ঢুকে যায়!

আজ যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা-ভরসা সেই বিচার ব্যবস্থাও যেন কেমন একটা প্রশ্ন চিহ্নে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের, যাঁদের থেকে আমরা কিছু প্রত্যাশা করব, যাঁদের জন্য আমরা নিজের মেরুদণ্ডকে আরও সোজা রাখতে পারব,  যাঁদের জন্য আমরা সৎ পথে চালিত হতে পারব। যে চারা গাছটাকে বাঁচিয়ে তাকে মহীরুহ পরিণত করে তার পল্লবিত শাখা-প্রশাখায় ফুল ফলে পরিপূর্ণ করে দিয়ে আরও মানুষকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে আজ তাকে সমূলে উৎপাটন করা হচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ শিক্ষা ব্যবস্থাও আজ রাজনীতির শিকার। যে শিক্ষা মানুষকে চেতনা দেয় আলোর পথ দেখায়, সেই শিক্ষাকে আজ গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে। নইলে নির্বাচনের নামে স্কুলে বাহিনী মোতায়নের ব্যবস্থা সত্যি ভাবতে অবাক লাগে সবকিছুকেই যেন স্কুলগুলোকেই মুখপাত্র হিসেবে রাখা হয়। তাছাড়া বর্তমান ছাত্র রাজনীতি যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় স্কুল কলেজে তার অধিকার কায়েম করছে তাতে ছাত্ররা যে শুধু তাঁদের মূল লক্ষ্য জ্ঞান অর্জনের পথ তথা আত্মবিকাশের পথ থেকে কেবল দূরে সরে যাচ্ছে তাই না, দেশের উন্নয়নের সহায়ক যে বিশুদ্ধ রাজনীতি সে সম্পর্কে তাত্ত্বিক শিক্ষাহীনতার ফলে নীতিহীন ভ্রান্ত রাজনীতির আত্মঘাতী দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে দেশের যুবশক্তিকে ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অথচ স্বাধীনতা পূর্ব যুগে এই ছাত্র আন্দোলনে মানুষের সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সেদিন ছাত্রদের অন্তরে ছিল দেশের প্রতি একরাশ গভীর ভালোবাসা, তাঁদের সামনে ছিল এক আলোকময় ভবিষ্যতের স্পষ্ট লক্ষ্য। আজ সমগ্র জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, বর্তমান যুগের ছাত্র রাজনীতি তার পূর্ববর্তীদের লক্ষ্যের সম্পূর্ণ বিপথগামী। বর্তমান ছাত্র রাজনীতি তার শিক্ষার সুব্যবস্থা, পঠন-পাঠনের উন্নতি, শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ, উচ্চতর শিক্ষা গবেষণার পরিকাঠামো প্রভৃতি দাবি আদায়ের মঞ্চ নয়। বর্তমানে তা হল শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিভিন্ন দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্র-ছায়া রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের কর্মশালা। এবং শ্রদ্ধাহীন শিষ্টাচারহীন, সৌজন্যহীন, দাম্ভিক নেতাদের পেশি প্রদর্শনের মঞ্চ। আর এই জন্যই আমরা দেখি সময়ের স্রোত থেকে বেরিয়ে এসে তুচ্ছ কারনে কখনও কখনও তাণ্ডব, ভাঙচুর, শিক্ষক, অধ্যাপক-অধ্যক্ষকে প্রহার,  শিক্ষিকার মান-সম্মানহানি, প্রতিবাদী কণ্ঠকে হুমকি দিয়ে দরকার হলে হত্যা করে স্তব্ধ করে দেওয়া। এ-কেমন রাজনীতি? আবার যাই নির্বাচনের সময় আসার আগে কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বাহিনী মোতায়ন করা হয়! এ দিকে ফিরে দেখলে দেখা যায় যে, নির্বাচনে বাহিনীদের থাকার জন্য অনেকদিন আগে থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ জেলাগুলিতে তো অনেক কমিউনিটি হল রয়েছে, স্টেডিয়াম রয়েছে, কলকাতাতেও রয়েছে সরকারি বিল্ডিং, অনায়াসে সেখানে রাখা যেতে পারে।  কিন্তু না, স্কুলকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের সিলেবাস শেষ হবে কী করে সে কথা ভাবনার প্রয়োজনও নেই! শিক্ষার তো এই বেহাল দশা আবার শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও শিক্ষা বহির্ভূত নানা কাজে লাগানো হয়। এ-কথা ভাবার সময় এসেছে সময়ে সব না করলে তার পরিণতি কী হবে। আসলে এর মধ্যে দিয়েও এটাই হয়ত ভাবা হয়, মানুষের অত্যন্ত কাছাকাছি আসা আর শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হয়ত সেই সম্পর্কের জেরেই সেখানেও অনায়াসে বেশ কায়দা করে এ রাজনীতিকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। আবার কোথাও কোথাও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দেখা যায় সাধারণ মানুষকে আচ্ছে দিনের স্লোগান দিয়ে তাদের ভাবাবেগকে তৈরি করা। আমরা তো দেখতে পাই,  সাধারণ মানুষের রুটি রোজগারে যেখানে হিমশিম খেতে হয়। সেখানে এই আচ্ছে দিনের রাজত্বে যখন সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে যায় পেট্রোল ডিজেল পড়ে থাকে আরও অনেক অনেক চড়া মূল্যের দাবিতে। আবার কখনও কখনও দেখা যায়, মা-বোনদের বেআব্রুকে ইস্যু করে রাজনীতি করা। মণিপুরে ধর্ষিতাদের লাইন দিয়ে উলঙ্গ করে হাঁটানো লজ্জায় মাথা হেঁট হতে হয় আমাদের, আবার কখনও বা সন্দেশখালিতে। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে রাজনীতিবিদদের শুধু পাখির চোখ। কাকে কখন ইস্যু করে ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানো যায়।এই তো আমাদের বাড়ির কাছে যে রাস্তাঘাটগুলো বেহাল অবস্থা হয়ত বেহাল অবস্থাটাকে সামাল দেবার জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে কিন্তু সেই রাস্তাটা যার জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তার প্রতি কতটুকু যত্নের সঙ্গে সততার সঙ্গে কাজটি করা হয়, সেটাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় ১৮ মাসে বছরে। যে কাজটা হয়ত এক মাসে হতে পারত সেই সময়ের থেকে বেরিয়ে এসে তাকে একটা অন্য খাতে প্রবাহিত করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেই চেতনার থেকে বেরিয়ে এসে কাজের দীর্ঘসূত্রিতা,  আর্থিক লেনদেন সবই সময় থেকে বেরিয়ে। মানুষের আবেগগুলোকে নিয়ে মানুষের ঘরে তালা বন্ধ করে দেওয়া- এটাই ভবিতব্য বোধ হয়! এসব ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। আমরা কী পারি না, একটা সুন্দর বিবেকবোধ উপহার দিতে? আমরা কী পারি না মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি এসে তার অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিতে? আমরা কী পারি না একে অপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি নেবার? আমরা কী পারি না কবির কথায়, ‘মানুষ বড় অসহায় তার পাশে এসে দাঁড়াও…’

ভালোবেসে। “মানুষ বড়ো কাঁদছে। তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।” অথবা যদি এমন হয় রাজা তোর কাপড় কোথায়?” সেই ছেলটির মত যত ভণ্ডামি আছে তাদের মুখোশগুলোকে খুলে দিয়ে একজন সত্যিকারের সামাজিক দায়বদ্ধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠা।

 

সত্যিকারের সামাজিক দায়বদ্ধ সম্পন্ন মানুষ হতে গেলে মানবিকবোধ সম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু আজ আমাদের মানবিক বোধের বড়ই অভাব। আর সেটা স্পষ্ট হয়। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ কখনও মানুষের হৃদয়গ্রাহী হতে পারে না। যুদ্ধ থেকে তাই দূরে সরে আসাই বাঞ্ছনীয়। জিজু ধান এই পৃথিবীতে তাই অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে তুলে মানুষকে গানের বর্ম ধারণ করতে বলা ভালো এই প্রসঙ্গে জয় গোস্বামীর লেখা কবিতার লাইনটা মনে পড়ে। “আমি এখন হাজার হাতে পায়ে এগিয়ে আসি/ হাত নাড়িয়ে বুলে তাড়াই
…. অস্ত্র ফ্যালো ,অস্ত্র রাখো গানের দুটি পায়ে।”
এই ভাবনায় উন্নীত হতে হবে নইলে তো প্যালেস্টাইনে শিশুদের উপর যে নিগ্রহ চলতেই থাকবে কিছু কিছু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই অমানবিক ক্রিয়াকর্ম সত্যিই লজ্জা জনম সময়ের থেকে বেরিয়ে এসে আমরা এভাবেই হয়ত হারিয়ে যাইও অমানবিকতায়। কোভিদ কণ্ঠে তাই কখনও আমরা বলতে শুনি সেই বীভৎস অমানবিকতার যুদ্ধ অভিযান দেখে কবি যখন বলে ওঠেন “আমার ডান পাশে বারুদে ভরা বিষাক্ত বাতাস,
রক্তাক্ত শরীর আমার বাঁ পাশে
ছিন্ন ভিন্ন লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৃত্যু উপতাকা।” সত্যি তখন কষ্ট হয়। তবুও আমরা আশাবাদী, আমরা সময়কে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের মানবিক জয়গানে মেতে উঠব। তাই তো কবি কণ্ঠে ভেসে ওঠে সেই সুর “তবু ভালবাসা এঁকে চিরন্তন পথ চলা…
দু ‘চোখ ভরে সুন্দর পৃথিবীর গন্ধ নিতে।” -প্রতীকী ছবি এবং সংগৃহীত 

 

আরও পড়ুন : Suvendu Adhikari : মমতাকে টিপ্পনী শুভেন্দুর

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment