



রীতা বিশ্বাস পান্ডে : সিজফায়ার (Ceasefire) মানে হল যুদ্ধবিরতি বা অস্ত্রবিরতি। এটি একটি অস্থায়ী চুক্তি যেখানে যুদ্ধরত পক্ষগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা অনির্দিষ্টকালের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে সম্মত হয়।
সিজফায়ার হলে কি হয়?
সিজফায়ার কার্যকর হলে সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ঘটে। যথাক্রমে
সামরিক কার্যক্রম বন্ধ: উভয় পক্ষই গুলি চালানো, বোমা হামলা, স্থল আক্রমণ, বিমান হামলা, নৌ অভিযান– সব ধরনের সামরিক কার্যক্রম বন্ধ রাখে।
মানবিক সহায়তা: যুদ্ধবিরতির সময় প্রায়শই মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়, যাতে তারা খাদ্য, ওষুধ, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতে পারে।
আলোচনার সুযোগ: যুদ্ধবিরতি একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করে যা যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসার এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে সাহায্য করে।
বন্দী বিনিময়: অনেক সময় যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে যুদ্ধবন্দীদের বিনিময় বা মুক্তি দেওয়া হয়।
মানুষের ভোগান্তি হ্রাস: সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর যুদ্ধের প্রভাব কমে আসে, তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।
এটার গুরুত্ব কতটুকু?
সিজফায়ারের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন—
জীবন রক্ষা: এটি তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের জীবন বাঁচায় এবং হতাহতের সংখ্যা কমায়।
মানবিক সঙ্কট মোকাবিলা: যুদ্ধবিরতি মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়, যা মানবিক সঙ্কট মোকাবিলায় অপরিহার্য।
শান্তি প্রক্রিয়া শুরু: এটি একটি বৃহত্তর শান্তি প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করে। যুদ্ধবিরতি ছাড়া শান্তি আলোচনা শুরু করা প্রায় অসম্ভব।
কূটনৈতিক সমাধান: এটি যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে কূটনৈতিক উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ দেয়।
স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা: যদিও সিজফায়ার একটি অস্থায়ী পদক্ষেপ, এটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভিত্তি তৈরি করে।
ভারত-পাকিস্তানের সিজফায়ার কতটা যৌক্তিকতা নিয়ে কাজ করতে পারে?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিজফায়ার একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জটিল বিষয়। তাদের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ এবং সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তানের সিজফায়ারের কার্যকারিতা নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল। যেমন—
উভয় পক্ষের সদিচ্ছা: সিজফায়ার তখনই কার্যকর হবে যখন উভয় পক্ষই আন্তরিকভাবে এটি মেনে চলতে আগ্রহী হবে। যদি এক পক্ষ যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করতে চায় বা অন্য পক্ষকে উস্কানি দেয়, তাহলে সিজফায়ার ভেঙে যাবে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা: ভারতের প্রধান উদ্বেগ হল পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যকলাপ। যদি পাকিস্তান এই গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভারতের পক্ষে সিজফায়ার বজায় রাখা কঠিন হতে পারে।
লাইন অফ কন্ট্রোল (LoC) এর স্থিতিশীলতা: LoC-তে প্রায়শই গোলাগুলি ও অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। এই অঞ্চলকে স্থিতিশীল রাখা এবং যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন রোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক চাপ ও পর্যবেক্ষণ: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং কোনও নিরপেক্ষ সংস্থার পর্যবেক্ষণ সিজফায়ার মেনে চলতে উভয় পক্ষকে সাহায্য করতে পারে।
আস্থা তৈরি: দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। সিজফায়ার সেই আস্থার প্রথম ধাপ হতে পারে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অতীতেও বহুবার সিজফায়ার চুক্তি হয়েছে, যার মধ্যে ২০০৩ সালের সিজফায়ার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। তবে, কাশ্মীর পরিস্থিতি এবং সন্ত্রাসবাদের কারণে এই চুক্তিগুলো বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়েও (১০ মে ২০২৫) ভারত ও পাকিস্তান সামরিক অভিযান বন্ধের বিষয়ে সম্মত হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে, এই ধরনের যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নির্ভর করবে দুই দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং ভবিষ্যতে কার্যকর পদক্ষেপের ওপর।
সংক্ষেপে : ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সিজফায়ার একটি জটিল তবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এটি যুদ্ধ বন্ধ করে জীবন বাঁচানোর এবং আলোচনার পথ খুলে দেওয়ার প্রথম ধাপ। তবে, এর দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা উভয় পক্ষের সদিচ্ছা, আস্থা তৈরি এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
ছবি : প্রতীকী
