



🍁ফিচার
এখন তথ্যপ্রযুক্তির রমারমা। কিন্তু এই ক’য়েক বছর আগেও ছিল চিঠিপত্রের মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদান। চিঠিতে প্রিয়জনের কুশল সংবাদ জানার জন্য ছিল অপর প্রিয়জনের প্রতীক্ষা। কখন আসবে ডাকহরকরা? প্রসঙ্গত, চিঠিপত্রকে ভাষা প্রকাশের শক্ত স্তম্ভ হিসেবেই সমালোচকরা দেখেন। লিখেছেন : পিনাকী চৌধুরী
অতীতের একসময় সুন্দর হাতের লেখায় সমৃদ্ধ, ভাষার লালিত্যে উজ্জ্বল চিঠির জন্য আপামর বাঙালি অপেক্ষা করে থাকতেন। শহরের আনাচে কানাচে সসম্মানে বিরাজমান ছিল লাল ডাকবাক্সগুলো। কিন্তু সেসব আজ অতীত!
এটা একবিংশ শতাব্দীর চরম ব্যস্ততার যুগ! আর তাই মানুষের হাতে সময় পাওয়ার ‘সময়’ কম! তাই বোধহয় ইন্টারনেটেই আস্থা রাখছি আমরা। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র থেকে শুরু করে সরকারি চিঠি, কিংবা সামাজিক চিঠিপত্র, এসবই এখন পুরোদস্তুর ইন্টারনেট কেন্দ্রিক। তাই ক্রমশই হাতে লেখা চিঠির সংখ্যা বেশ কমে গিয়েছে।
পৃথিবীতে ঠিক কবে প্রথম চিঠিটা কবে, কে লিখেছিলেন, সে বিষয়ে সঠিক হদিস না পাওয়া গেলেও পৃথিবীর প্রথম প্রেমপত্র কে কাকে লিখেছিলেন, সেই বিষয়ে জানা যায়। খ্রীস্টপূর্ব ২২০০ সালে ব্যাবিলনিয়াতে প্রেমিক ‘গিমিল’ একখণ্ড ইঁটের ওপর তাঁর ভালবাসার কথা খোদাই করে প্রেমিকা ‘কাসবুয়ার’ এর কাছে প্রেরণ করেছিলেন। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবচেয়ে প্রাচীন চিঠিটি হল ৩৩০০ বছর আগে পাথরে খোদাইকৃত একটি চিঠি। যা কিনা মিশরের রাজসভা থেকে ইজরায়েলে প্রেরণ করা হয়েছিল।
এদিকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অতীতে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। ১৯২৮ সালে জওহরলাল নেহেরু জাতীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত। অধিকাংশ সময়ই তিনি তখন এলাহাবাদে থাকতেন। তখন তাঁর একমাত্র কন্যা দশ বছরের ইন্দিরা নিঃসঙ্গ শৈশবকাল অতিবাহিত করছে! চিঠিপত্রের মাধ্যমে জওহরলাল নেহেরু মেয়েকে কিছুটা সাহচর্য এবং সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
প্রসঙ্গত, ১৯২৯ সালে এরকমই ৩১ টি চিঠির সংকলন করে ১১৯ পাতার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ‘Letters from a father to his daughter’ শিরোনামে। পাশাপাশি এসব চিঠিতে জওহরলাল নেহেরুর সমকালীন রাজনীতি সম্পর্কে ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে। বিখ্যাত হিন্দি ঔপন্যাসিক মুন্সি প্রেম চাঁদ এই বইটি হিন্দিতে অনুবাদ করেন ‘পিতাকে পত্র পুত্রীকে নাম’ শিরোনামে। পরবর্তী সময়ে ‘কল্যানীয়াসু ইন্দু’ শিরোনামে বইটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
উপমহাদেশীয় প্রাচীন তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, বহুকাল আগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মূলত সংবাদ আদান প্রদানের জন্য পাঠানো হত কাসিদ বা ডাকবাহককে। তবে দূরবর্তী স্থানে খবর পাঠানোর জন্য পায়রা বা কবুতরের পায়ে চিরকুট বেঁধে দেওয়া হত। যা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যেত। সম্রাট চেঙ্গিজ খাঁ তাঁর অধিকৃত রাজ্যগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখতে এই কবুতরের সাহায্য নিতেন।
অন্যদিকে, সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র- সবেতেই প্রাধান্য পেয়েছে চিঠিপত্র। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবদ্দশায় নিরলস কাব্য সাধনার শত ব্যস্ততার মধ্যেও অবিশ্রান্ত চিঠি লিখতেন। তাঁর প্রকাশিত চিঠির সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। বস্তুতঃ বিশ্বকবির আবেগ, অনুভূতি, প্রেম অপ্রেম, অতিশয় ও স্পর্শচেতন ভাষা সেইসব চিঠিতে স্থান পেয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ তো পুরোটাই চিঠির আকারে। চিঠি লিখতেন বরেণ্য সত্যজিৎ রায়। অযুত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি তাঁর কাছে আসা যাবতীয় চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার পত্র লিখে পাঠাতেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর নিজস্ব স্টাইলে এবং প্রকাশ ভঙ্গিমায় চিঠিপত্র লিখতেন। এরকমই একজন ছিলেন শান্তিনিকেতনের নীলাঞ্জনা সেন। নীলাঞ্জনা দেবীর যখন মাত্র উনিশ বছর বয়স, তখন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয়। তারপর থেকে সত্যজিৎ রায় নীলাঞ্জনা দেবীকে ৫২ টি চিঠি লিখেছিলেন। সেইসব চিঠির বিষয়বস্তুও ছিল বেশ উপভোগ্য। তদানীন্তন সময়ে কলকাতায় লোডশেডিং হলে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজে ব্যাঘাত ঘটে, সেই বিষয়েও পত্র লেখক আলোকপাত করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানকারী ভারতীয় সৈন্যদের চিঠি থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সৈন্যদের অসহয়তা এবং যন্ত্রণার কথা জানতে পারা যায়।
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : Book Review : শমীক সেন এর কাব্যগ্রন্থ কৃপা
