Sasraya News

Thursday, June 19, 2025

Travel story By Dharitri Goswami

Listen

হাটে-বাজারে 

ধ রি ত্রী  গো স্বা মী 

প্রথমবার আমেরিকা যাই ২০০৫ সালে। সেই প্রথম কোন শপিং মল দেখলাম, ওয়াল্মার্ট। দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছিল, এক ছাদের তলায় এত কিছু? হ্যাংলার মত বেশ কিছু ডলার খসিয়ে কেনাকাটা করেছিলাম। তারপরে পরেই আমাদের দেশেও ঢুকতে আরম্ভ করল বিগবাজার, স্পেনসর। এখন আর লিখে শেষ করা যাবে না। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বেড়ানো ঘোরা প্রেম খাওয়া সবই বলতে গেলে মল কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। কিন্তু ‘খোলা বাজার’ আর ‘বাজার অর্থনীতির’ উদ্ভাবনের বহু যুগ আগেই আমাদের দেশেও যে মল ছিল, সে খবর ক’জনা রাখে? আর যে সে মল নয়, হিরে জহরত পান্নার মল। চলুন দেখেনি।

 

প্রবল প্রতাপশালী মহারাজ কৃষ্ণ দেবরায়ের রাজ্য বিজয়নগরের রাজধানির যে ধ্বংস্তুপ আজ হাম্পি শহরের চারিপাশে ছড়িয়ে আছে, সেখানে গেলে নজর কাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সারি সারি পাথর নির্মিত দোকান ঘর। দোতলা সেই সব কাঠামো রয়েছে প্রতিটা মন্দির এবং ধর্মীয় স্থানের লাগোয়া। বিদেশি আক্রমণ এবং প্রকৃতির অত্যাচারে বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এই অংশগুলির শক্তিশালী কাঠামো, পাথরের ছাদ এবং মেজে, দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, দোতলায় একই প্রকারের সারি সারি দোকানঘর— দেখতে বিস্ময় হার মানে। এত বড় বড় আয়তনের বাজারে কি বেচা কেনা হত? কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় বাজারের পুরানো নামগুলি পড়লে। ‘পান সুপারির’ বাজার। ‘সোনা রুপার’ বাজার। ইতিহাস ঘাঁটলে জানতে পারি সেই সময়ের বিজয়নগর রাজ্যের অর্থনীতির কথা। 
বিজয়নগর রাজ্য ছিল দারুণ সম্পদশালী। দেশ বিদেশ থেকে জল এবং স্থল পথে বণিকেরা নানান সামগ্রী নিয়ে এখানে ব্যবসা করতে আসত। তারা কেউ আসত ঘোড়ার বা উটের ক্যারাভান নিয়ে, কেউ আসত সমুদ্র পোতে জাহাজের বহর নিয়ে। রাজ্যের উপকূল বরাবর ৩০০টি বন্দর ছিল জানতে পারি। 

 

আমরা অনেকেই জানি না ইংরেজির “market” শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল আজ থেকে ৬ শতক আগের এই বাজারগুলিতে। কানাড়া ভাষায় বাজারকে বলা হয় ‘মারুকাট্টে, marukatte‘ এই শব্দ থেকেই ইংরাজিতে market শব্দটির অন্রভুক্তি। সেই যুগেও এইভাবে সংগঠিত খুচরা বাজারের ধারণা আমাদের আধুনিকতার ঔদ্ধত্যে সজোর ধাক্কা দেয় বৈকি। 
প্রতিটা বাজারের সঙ্গে দোকান ঘর ছাড়াও বড় বড় পাথরের দাঁড়ি পাল্লা, বণিকদের বিশ্রামের জন্য জায়গা,সরাইখানা, তাদের স্নানের জন্য তৈরি পুষ্করিণী লক্ষ্য করলাম।
সাধারণত সপ্তাহের একেক দিন একেকটি বাজার বসত। রাজ্যবাসী তাদের প্রয়োজন মত কেনাবেচা ত করতই, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে এই বাজারগুলি ছিল প্রধান ভরসা। এই রাজ্যে চাষ আবাদের দারুণ উন্নতি হওয়ার ফলে শস্য, ফলমূল সবজি, ফুল বিশেষ করে আতর বানাবার জন্য গোলাপ, পান এবং সুপারি, বস্ত্র সামগ্রী ইত্যাদি ছিল কেনাবেচার মূল উপকরণ। তবে চমক লাগে সোনা রূপার বাজার দেখে। বিরূপাক্ষ মন্দিরের পরবেশ পথের দুপাশে টানা দ্বিতল এই বাজারটিতে মূলত হিরে জহরত সোনা কেনা বেচা হত একেবারে ওজন দরে। ৭১৭ মিটার দৈর্ঘ্যের বাজারটি দেখতে দেখতে শুধু ভাবছিলাম কি সম্পদশালী ছিল দেশটা সেইকালে। আর আজ কোথায় এসে পৌঁছেছি। 

শরদিন্দু বাবুর লেখা ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাস পড়েছিলাম সেই কোন স্বপ্ন দেখা মেয়েবেলাতে। তারপর হাম্পিও দেখেছি। কিন্তু এই মাঝবয়সে কি স্বপ্নের চোখে নতুন রঙের প্রলেপ পড়ল? সব ঘোরার শেষে তুঙ্গভদ্রার পারে বসে ঝুপড়ি দোকানে চা খেতে খেতে চোখের সামনে এক দৃশ্যের অবতারণা করালাম।
জমজমাট বাজারে থিক থিক করছে ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়। দাঁড়ি পাল্লায় ওজন হচ্ছে হিরা মাণিক। ঘোড়ায় চড়ে সতর্ক প্রহরা দিচ্ছে কিছু রাজপুরুষ। সুবেশী কন্যেরা গলায় চুলে মালি ফুলের মালা জড়িয়ে মন্দিরে চলেছে পূজার থালি হাতে। বিশ্রামরত বিদেশী বণিকের দল আড় চোখে দেখছে মেয়েদের। এগুতে সাহস পাচ্ছে না, তাহলে বিষম শাস্তি। রাজবাড়ি থেকে লোক এসেছে, রাজার আদেশ রানিমার জন্য একটা হাঁসের ডিমের সাইজের পান্না কিনে নিয়ে যেতে। ইবন বাতুতা সদ্য এসেছেন রাজ্যে, ঘুরে ঘুরে দেখছেন সব, বিস্ময়ে তার চোখের পলক পড়ছে না। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। তুঙ্গভদ্রার জলে আবির রঙের ছায়া পড়ল। বাজারে জ্বলে উঠল শয়ে শয়ে মশাল। ক্লান্ত বণিকেরা এবার বিশ্রাম ঘরের সন্ধানে চলল। তখন হঠাৎ সমবেত নুপুরের ঝঙ্কার বেজে উঠল বাজারের প্রান্তে। দল বেঁধে দেবদাসীরা চলেছে সান্ধ্য আরতির আসরে। মহারাজা মন্দিরে আসবেন, বেজে উঠল ভেরী। ধূপ চন্দন আতরের গন্ধে বাতাস ম ম করছে। বাজারের জমজমাট আনাচে কানাচে ক্রেতা বণিকদের সঙ্গে দর কষাকষি করছে সুসজ্জিতা বারবনিতারা। এমন সময়ে নদীর পারে বসে কে যেন গেয়ে উঠেছে গীতগোবিন্দের এক কলি। 
“কেশব ধ্রতা কচ্চা রূপা জয় জগদীশ ও হরে।”

 

লেখা পাঠান 👉 স্থানীয় সংবাদ, স্বরচিত গল্প, স্বরচিত কবিতা, স্বরচিত প্রবন্ধ, স্বরচিত ভ্রমণ, স্বরচিত উপন্যাস। e-mail id : sasrayanews@gmail.com

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment