



ভারতে শিক্ষার অন্যতম প্রদর্শক সাবিত্রীবাই ফুলে। তৎকালীন প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতরে থেকেও সমাজকে শিক্ষার আলোর দিকে নিয়ে গিয়েছেন। শিক্ষার গাছ তলায় নিয়ে এসেছেন নারীদের। তেমনি লিখেছেন দু’টি অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ। বিশ্ব কবিতা দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ সেই মহীয়সীকে। লিখলেন : বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
সাবিত্রীবাই ফুলেঃ এক উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভ
কিছুদিন আগেই আমরা পেরিয়ে এলাম ৫ সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবস। অনেক কথা পড়লাম ফেসবুকে, ট্যুইটারে এবং সংবাদপত্রে। কিন্তু কোথাও সাবিত্রীবাই ফুলের জন্য একটি লাইনও বরাদ্দ হল না। কোনও মিডিয়াতেই উচ্চারিত হল না তাঁর নাম। এই উদাসীনতায় তাঁর চিরজাগ্রত ছবি বিন্দুমাত্র অনুজ্জ্বল হয়নি। যে পথের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আজ প্রান্তিক দলিত মেয়েরা দুর্গ বিজয় করছেন- সাহিত্যে, শিল্পে বিজ্ঞানে এবং সমাজচেতনায় নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন, ম্লান হয়ে যায়নি সেই পথের রেখাও। আজ থেকে প্রায় ১৯০ বছর আগে জন্মে যে রাস্তা তিনি তৈরি করে গেছেন কেউ মনে রাখুক বা না রাখুক ইতিহাস তাঁকে উজ্জ্বল অক্ষরে লিখে রাখবে।
_____________________________________________
১৮৪৮ সালে সতের বছরের একটা মেয়ে পুণেতে ভিদে ওয়াদা নামে একটা স্কুল খুলে ফেললেন মেয়েদের জন্য। ভারতের বুকে রচিত হল এক আলোর ইতিহাস। তখনও কলকাতায় বেথুন সাহেবের স্কুল তৈরি হয়নি। তখনও বিদ্যাসাগরের জেলায় জেলায় বালিকা বিদ্যালয় একটি ধারণামাত্র।
_____________________________________________
১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার নয়গাঁও গ্রামে আরোও পাঁচটা মেয়ের মতোই খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল সাবিত্রীর। তাঁর মায়ের নাম লক্ষ্মী, বাবার নাম খান্দোজি নেভেশে পাতিল। তাঁরা জাতিতে মালি সম্প্রদায়ের।বাবা মায়ের বড়চেয়ে বড় সন্তান তার উপর মেয়ে, তাই সেই সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে খুব অল্প বয়সেই তাঁর (মাত্র নয় বছর) বিয়ে হয়ে যায়। নিম্ন বর্গীয় মেয়ে ফলে তার জন্য শিক্ষার দুয়ার ছিল অবরুদ্ধ। বিয়ের আগে অক্ষর পরিচয়টুকুও তার কপালে জোটেনি। আরও দশজন মেয়ের মতো রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘরের মধ্যে যাতায়াত করতে করতে কেটে যেতে পারত তাঁর জীবন। কাটেনি, তার কারণ তাঁর স্বামী তেরো বছরের জ্যোতিরাও ফুলে মানুষটি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া।বিয়ের ক’ য়েকদিন পরেই সাবিত্রীকে দেখে তিনি বুঝতে পারেন এই মেয়েটিই পারবে অনেককিছু বদলে দিতে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন – তুমি পড়তে চাও?
লাজুক নম্র মেয়েটির উত্তর – খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু মেয়েরা লেখাপড়া করলে ঘরে পাপ ঢুকবে না তো। হো হো করে হেসে উঠলেন জ্যোতিরাও- এত ভয়? এসো এক একটি অক্ষর লিখতে শেখো, দেখবে কেমন আলো বেরুচ্ছে তাদের গা থেকে। সব ভয় চলে যাবে।
কথাগুলো মিথ্যে বলেননি জ্যোতিরাও, সাবিত্রী তা বুঝতে পারলেন ধীরে ধীরে। নানা বিষয়ে দু’জনে আলোচনা করতেন। ক’য়েক বছরের মধ্যেই জ্যোতিরাও এর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হল যে সাবিত্রীই পারবে তার নিজের অর্জিত শিক্ষা দিয়ে প্রতিবেশী সমস্ত মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে। এবং তার মাধ্যমেই সম্ভব হবে ভারতের নারী জাগরণ। তাই তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি স্ত্রীকে শিক্ষকতার পাঠ দিতেও শুরু করলেন।এ হল সেই সময়ের কথা যখন ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলেনি, কিন্তু সাবিত্রীর মনে জ্বলে উঠেছিল চেতনার আগুন- মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে, দলিত অনগ্রসর, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মেয়েকে। অর্ধেক আকাশকে মেঘে ঢেকে রেখে আলোর স্বপ্ন দেখা যায় না। অবশেষে ১৮৪৮ সালে সতের বছরের একটা মেয়ে পুণেতে ভিদে ওয়াদা নামে একটা স্কুল খুলে ফেললেন মেয়েদের জন্য। ভারতের বুকে রচিত হল এক আলোর ইতিহাস। তখনও কলকাতায় বেথুন সাহেবের স্কুল তৈরি হয়নি। তখনও বিদ্যাসাগরের জেলায় জেলায় বালিকা বিদ্যালয় একটি ধারণামাত্র।
বাড়িতে দেখা গেল অসন্তোষ। ঘরের বউ লেখাপড়া করছে, লেখাপড়া শেখাচ্ছে, ছিঃ! সমাজে মুখ দেখানো যাবে না।এ তো তুমুল অন্যায়। এ তো ঘোরতর পাপ। এই পাপেই এখনও নাতি নাতনির মুখ দেখা হল না। বার করে দাও এই পাপী অলক্ষ্মী বউকে। বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হল তাঁদের।কিন্তু দমে গেলেন না এই দম্পত্তি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিলেন বন্ধু উসমান শেখের ঘরে। ১৮৫১ সালে আবার একটি স্কুল খোলা হল, সাবিত্রী হলেন তার প্রধান শিক্ষিকা। ছোটজাতের মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মাতিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। শুরু হল আক্রমণ। কদর্য ভাষার পাশাপাশি কাদা পাথর গোবর ছুঁড়তে লাগল জনতা। অগত্যা কী আর করবেন সাবিত্রী, স্কুলে আসার পথে বাড়তি শাড়ি নিতেন ব্যাগে। কত কাদা ছুঁড়বে ছুঁড়ুক।শাড়ি বদলে নিলেই তো হল। তাছাড়া ওগুলো কাদা গোবর নয়, সম্মানের ফুলমালা, সাদরে গলায় পরে নিয়েছিলেন তিনি। এভাবে ১৮ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন দলিত নিম্নবর্গীয় পিছিয়ে পড়া মেয়েদের শিক্ষাবিস্তারের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। শুধু শিক্ষা নয়, শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ষিতা এবং অসহায় মহিলাদের কথা তিনি ভেবেছেন সারাজীবন। তাদের জন্য সেবাকেন্দ্র স্থাপন করেছেন,মেয়েদের আর্থিক স্বচ্ছলতার দিকে নজর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি।আজ থেকে ১৯০ বছর আগে জগদ্দল পাথরের মতো স্থবির সমাজকে ধাক্কা দিয়েছিলেন তিনি , এ তো কম কথা ছিল না। জাতপাত, ধর্ম ও লিঙ্গভিত্তিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রথম নামই তো সাবিত্রীবাই ফুলে। গর্ভবতী হয়ে পড়া ব্রাহ্মণ বিধবাদের জন্য তাঁর দুয়ার ছিল উন্মুক্ত। এরকম ৩৫ টি মহিলা ও তাদের শিশুদের দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। ১৮৭৪ সালে এরকমই এক ব্রাহ্মণ বিধবার গর্ভজাত সন্তানকে দত্তক নেন এই দম্পতি। এই ছেলের নাম দেন যশোবন্ত রাও। পরে তিনি তাঁর পুত্রের বিয়েও দিয়েছিলেন অসবর্ণে, সেই সময়ের ভারতবর্ষে যা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী’র চুল কেটে দেওয়ার যে রেওয়াজ ছিল তিমিরাচ্ছন্ন ভারতবর্ষে এর বিরুদ্ধে তিনি ধর্মঘট ডেকেছিলেন। মেয়েদের উপর যাবতীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে সম অধিকারের দাবি নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন “সংশোধক সমাজ”।
মানুষের কথা এভাবে যাঁরা ভাবেন তাদের তো শিল্পীমন থাকবেই। সাবিত্রীরও ছিল। কবি হিসেবেও তিনি তাঁর নিজস্ব প্রকরণ তুলে ধরেছিলেন দু’টি কাব্যগ্রন্থে “ কাব্য ফুলে” ( ১৮৫৪) এবং “ বভন কাশি সুবোধ রত্নকর” (১৮৯২)এ।
সাবিত্রীবাই এক আলোকস্তম্ভের নাম। যেখানে অন্ধকার যেখানে কুসংস্কার যেখানে নিপীড়ন সেখানেই তাঁর উজ্জ্বল হাতের স্পর্শ। তাঁর সুচেতনার বিদ্যুৎআভায় তিনি জ্বেলে দিয়েছেন শিক্ষা এবং প্রগতির মশাল। কাজ শুধু কাজই ছিল তাঁর সাধনা। তাই ১৮৯৭ সালে যখন প্লেগ মহামারীর আকার নিল মহারাষ্ট্রে শুধু নয় সারা ভারতে। তখন তিনি তাঁর চিকিৎসক পুত্র যশোবন্ত রাওকে নিয়ে বিউবনিক প্লেগ রোগীদের সেবায় পুণে শহরের একপ্রান্তে গড়ে তোলেন ক্লিনিক। সেখানে মানুষের সেবায় কেটেছে তাঁদের প্রতিটি প্রহর। পাণ্ডুরং গাইকোয়াড়ের ছেলে প্লেগে আক্রান্ত হয়েছে শুনে তিনি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি, নিজের স্বাস্থ্যসুরক্ষার কোন রকম তোয়াক্কা না করেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে আসেন নিজের প্লেগ ক্লিনিকে। মানবসেবার এই আকুলতা তাঁকেও ক্ষমা করল না। তিনি প্লেগে আক্রান্ত হলেন। ১৮৯৭ সালের ১০ মার্গ রাত নটায় পৃথিবী ছাড়লেন তিনি। বেঁচে থাকতে কম সম্মান পাননি তিনি। পণ্ডিতা রমাবাই, আনন্দীবেন যোশী প্রমুখ সেকালের শিক্ষিত নারীরা তাঁকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ১০১ বছর পর ১৯৯৮ সালে তাঁর নামে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে পুণে ইউনিভার্সিটির নতুন নামকরণ হয় ‘সাবিত্রীবাই ফুলে ইউনিভার্সিটি’। তাঁকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এ-তো তাঁর কাজের সাপেক্ষে কিছুই নয়।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় প্রায় দুশো বছর আগে তমসাচ্ছন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে এক দলিত পরিবারের মেয়ে এবং বধু তাঁর জীবন ও কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন শিক্ষা শুধু আলোর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ ও উচ্চবর্ণের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এই আলোক অর্জনের লড়াইতে নারীর অবদানকে ভুললে চলবে না। তাঁর লেখা একটি কবিতায় কবি সাবিত্রীবাই ফুলে সেই কবে উচ্চারণ করেছেন – Go, get Education. শিক্ষা তো অনন্ত জিজ্ঞাসা। মানুষের জিজ্ঞাসা আর লড়াই যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন অমর হয়ে হয়ে থাকবেন সাবিত্রীবাই ফুলে। 🦋 ছবি : আন্তর্জালিক
🌞সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, গদ্য, ভ্রমণ কাহিনী, পুস্তক আলোচনা, উপন্যাস…। ই-মেল : editor.sasrayanews@gmail.com
