Sasraya News

Thursday, May 22, 2025

Sasraya News | Sunday’s Literature Special | Issue 48 | 19 January 2025

Listen

🍂সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে… 

 

 

মাতৃসান্নিধ্যে

রাজেন্দ্রনাথ দত্ত

 

 

মার মাতৃ-সংযোগের উৎস হলেন আশু মহারাজ (স্বামী স্বস্বরূপানন্দ — পূর্বাশ্রমে আশুতোষ অপূর্য)। তিনি অনেক দিন আগেই মায়ের কৃপা লাভ করেছিলেন, ব্রহ্মচর্য সংস্কার নিয়েছিলেন।… একদিন [আশু মহারাজ] বললেনঃ “রাজেন, মা আমায় সন্ন্যাস দেবেন বলেছেন। আমি সন্ন্যাস নিতে জয়রামবাটী যাব। তুই যাবি আমার সঙ্গে? মাকে দর্শন করে আসবি!” সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।… যখন জয়রামবাটীতে মায়ের বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। দূর থেকে দেখলাম পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একটি বৃদ্ধা। মাথায় ঘোমটা। আশু মহারাজ বললেনঃ “ঐ যে মা দাঁড়িয়ে আছেন। বোধহয় আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন।”

মা মধুমাখা কণ্ঠে বললেনঃ “তোর নাম কি, বাবা?” বললাম: “রাজেন্দ্রনাথ দত্ত।”…মা বললেনঃ “বাঃ! বেশ নাম। আমি কিন্তু তোকে রাজন (রাজেন নয়) বলে ডাকব। আজ দীক্ষা নিবি?” ‘দীক্ষা’ কি জিনিস কিছুই জানি না। একবার মায়ের মুখের দিকে, আর একবার আশু মহারাজের মুখের দিকে তাকাই। আশু মহারাজ বললেনঃ “তোর ভাগ্য ভাল রাজেন! এ সৌভাগ্য কজনের হয়?” সেদিন আশু মহারাজকে সন্ন্যাস-সংস্কার-সহ গৈরিক বস্ত্র দানের পর মা আমাকে দীক্ষা দিলেন।

কলকাতা থেকে মা মাঝে মাঝে কোয়ালপাড়া মঠে বা জয়রামবাটীতে আসতেন। যখনই মা আসতেন, তখনই আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কখনো চিঠি পাঠাতেন, আবার কখনো লোক পাঠাতেন। আর আমি শত কাজ ফেলে রেখেও মায়ের আহ্বানে চলে যেতাম হয় কোয়ালপাড়া মঠে নতুবা জয়রামবাটীতে মায়ের বাড়িতে।

মা আমার অন্তর্যামী ছিলেন। যিনি জগতের মা, তিনি অন্তর্যামী হবেন, সে আর আশ্চর্য কী? ষড়ৈশ্বর্যময়ী মহাশক্তি মহামায়া। এসেছিলেন এই বাঁকুড়া জেলার মাটিতে এক গ্রাম্য দরিদ্র ব্রাহ্মাণের কন্যা হয়ে। বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। সরলতার প্রতিমূর্তি! গ্রামের মেয়েরা যেমন দোক্তা খায়, মা তেমনই দোক্তা খেতেন। আমি যতবার মাকে দর্শন করতে গেছি, ততবারই বাঁকুড়া থেকে দোক্তা নিয়ে গেছি। বাঁকুড়ার নগেন দত্তের মা তখন দোক্তা তৈরি করত। সেই দোক্তা খেতে ভারী ভালবাসতেন মা। দোক্তার প্যাকেটগুলো আঁচলে রেখে দুটি হাত আমার মাথায় রেখে মা আশীর্বাদ করতেন। তখন তাঁর চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারতাম ভারী খুশি হয়েছেন। প্রত্যেকবারই বলতেনঃ “কত দোক্তা এনেছিস, রাজন! আমার দু-তিন মাস চলে যাবে। তা বেশ করেছিস। এখন একটা গান শোনা দেখি, বাবা!”

প্রথমেই ধরতাম একটা শ্যামাসঙ্গীত। শ্যামাসঙ্গীত শুনতে শুনতে মা এমন তন্ময় হয়ে যেতেন, মনে হতো গানের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছেন। তখন ঠিক বুঝতে পারতাম না, এখন বুঝতে পারি — যাঁর গান, তিনি নিজেই শুনছেন তো, তাই গানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। শ্যামাসঙ্গীত শেষ হলে বলতেনঃ “এখন একটা ঠাকুরের গান শোনা তো বাবা!” আমি ঠাকুরের গান গাইতে শুরু করলেই মায়ের দুচোখ দিয়ে গঙ্গার ধারা বইত।

একবার এক বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল। মা কলকাতা থেকে দেশে এসেছেন। মায়ের জন্মতিথি পড়েছে। এদিকে সাধু, গৃহী ভক্ত সকলে মিলে মায়ের আবির্ভাব তিথিপূজার আয়োজন করছেন। আমি লোকমুখে সে-খবর পেলাম। কিন্তু মঠ থেকে কোন নিমন্ত্রণ এল না। মা-ও লোক পাঠালেন না অন্যবারের মতো। মনে ভারী অভিমান হলো। ভাবলাম, থাকগে — এবার আর যাব না মাকে দর্শন করতে। অনেক বড় বড় ভক্ত পেয়ে মা নিশ্চয় ভুলে গেছেন আমার মতো সামান্য ভক্তকে।

তখন পৌষ মাস। দারুণ শীত পড়েছে। সেদিন একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। গভীর রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, মা এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে যেন বলছেনঃ “রাজন, তোর গান না শুনলে আমার তৃপ্তি হয় না রে!” ব্যাস। এই কথা বলেই তিনি যেন কোথায় অন্তর্ধান করলেন। ঘুম ভেঙে গেল। রাত তখন দুটো। আমার অভিমানও কোথায় উধাও হয়ে গেল। মনে হলো, মা স্বয়ং এসে নিমন্ত্রণ করে গেলেন। আমাকে যেতেই হবে জয়রামবাটীতে, মায়ের আবির্ভাব-তিথিতে তাঁকে প্রণাম করতে, তাঁকে গান শোনাতে। খুব ভোরে উঠেই রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। একটু বেলা বাড়লে বাজারে গিয়ে দোক্তা কিনে আনলাম মায়ের জন্য। এগারোটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে রওনা হলাম গাড়ি ধরার জন্য। ঠিক বারোটায় ট্রেন। বেলা একটার সময় পৌঁছে গেলাম বিষ্ণুপুর স্টেশনে। বিষ্ণুপুর থেকে হাঁটতে শুরু করলাম জয়রামবাটী অভিমুখে। তখন বাস ছিল না, অন্য যানবাহনও ছিল না। আমি পায়ে হেঁটেই চলেছি মাতৃদর্শনে।

শীতকালের বেলা ছোট। জয়রামবাটী পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ, গলায় কম্ফর্টার আর সর্বাঙ্গে শাল জড়িয়ে আমি যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে জয়রামবাটীতে মায়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম, তখন হঠাৎ আমায় দেখে চেনার কোন উপায় ছিল না যে আমি রাজেন দত্ত। মা বসে আছেন একটি চৌকিতে পূর্বদিকে মুখ করে। সামনে-পিছনে, আশে-পাশে একদল ভক্ত মেয়ে-পুরুষ। এবার মঠে পৌঁছেই মাকে প্রণাম করলাম না, এমনকি মায়ের সামনে গিয়েও দাঁড়ালাম না। মাথায় এক দুর্বৃদ্ধি এসেছিল — মাকে পরীক্ষা করব। শুধু তাই নয়, গত রাত্রে মাকে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটা নিছক আমার মনের বিকার কি-না, তাও পরীক্ষা করব। আরো দশজন লোকের সঙ্গে আমি মায়ের পিছনের দিকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে বসলাম। সেখান থেকে শুনতে পেলাম, একজন ভক্ত বলছেনঃ “একটা গান হলে ভাল হতো।” একজন সাধু বললেনঃ “কে আর গাইবে? রাজন দত্ত থাকলে গাইত।”

মা বলে উঠলেনঃ “রাজন এসেছে। পিছনে বসে আছে। ডেকে নিয়ে এসো। গান গাইবে।” মায়ের কাটা কাটা কথাগুলো আমার কানে এক-একটা তীরের মতো এসে বিঁধতে লাগল। আমি একদিকে যেমন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম, তেমনই আর একদিকে লজ্জায় মরে যেতে লাগলাম। কেউ আমাকে ডাকার আগেই ছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম মায়ের সামনে। দুটি পায়ে হাত বুলিয়ে প্রণাম করে হাত জোড় করে বললামঃ “আমায় ক্ষমা করো মা।” মায়ের সঙ্গে আমি তুমি করেই কথা বলতাম। আমার চিবুকে হাত দিয়ে মিষ্টি হাসি হেসে মা বললেনঃ “কই, দোক্তা দে।”

আবার মাথায় দুর্বুদ্ধি। বলে ফেললামঃ “এবার তাড়াতাড়িতে দোক্তা আনতে ভুলে গেছি।” কৌতুকভরা দুটি চোখে মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “তোর বাঁ দিকের পকেটে দোক্তা আছে, দে বাবা দে!”

আমার সর্বাঙ্গ তখন কাঁপছে। একবার মনে হচ্ছে, কী মূর্খ আমি! কার সঙ্গে ছলনা করছি? আবার মনে হচ্ছে, আমি ধন্য। স্বয়ং জগন্মাতা আমার সঙ্গে লীলা করছেন। বাঁ দিকের পকেট থেকে দোক্তার প্যাকেটগুলো কম্পিত হাতে বের করে মায়ের হাতে দিলাম। মা খুশি হয়ে বললেনঃ “বেঁচে থাক, বাবা। নে একটা গান শোনা দেখি।”

🍁ঋণ :: প্রবন্ধ : মাতৃসান্নিধ্যে | রাজেন্দ্রনাথ দত্ত
মূলগ্রন্থ : শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে— চতুর্থ খণ্ড
সঙ্কলক ও সম্পাদক : স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ
পৃ.: ১১০৪-১১০৯

 

 

 

🍂মহামিলনের কথা

 

 

 

চিত্ত সমাধান কতকটা শুষ্ক কাঠে আগুন জ্বালানোর মত। ভিজা কাঠ হইতে জল শুকাইয়া গেলে যেমন ধক্ ধক্ করিয়া আগুন জ্বলিতে থাকে, তদ্রূপ উপাসনার ঐকান্তিকতায় বাসনা-কামনার রস যখন চিত্ত হইতে কমিয়া যায়, তখন চিত্ত হালকা হইয়া পড়ে। সেই অবস্থাকে চিত্ত-সমাধান বা ভাবশুদ্ধি বলে। এরূপ অবস্থায় কাহারো ভাবোম্মাদনা জন্মে। এক পরমার্থ সত্তার আশ্রয়ে ইহা বিশেষ বিশেষ ভাবাবেশ উপলক্ষ করিয়া উদিত হয়। উহার পরের ভূমি ভাব-সমাধান। যেমন পোড়ানো কাঠকয়লা; একই সত্তার এক অখণ্ড ভাবের তম্ময়তায় শরীর অবশ হইয়া পড়িয়া থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা সাধক জড়ভাবে কাটাইয়া দেয় অথচ অন্তরের গুহায় ভাবপ্রবাহ অক্ষুন্ন চালিতে থাকে। ইহার পরিপক্ক অবস্থায় কখনো কখনো এক সত্তার আশ্রয়ে একটি অখণ্ড ভাবের তরঙ্গ ভিতর বাহির একাকার করিয়া খেলিতে থাকে। ইহাকে ভাব-সমাধান বলে। যেমন একটি আধারে আয়তনের অধিক জল ঢালিতে গেলে তাহা পূর্ণ হইয়া অতিরিক্ত জল উপচাইয়া পড়িয়া যায়, তেমনি এক অখণ্ড ভাবের দ্যেতনায় চিত্ত ছাপিয়া তাহার ভাবাবেগ বিশ্বময় বিরাট স্বরূপে বিগলিত হইয়া পড়ে। তৃতীয় ভূমিটার নাম ব্যক্ত-সমাধান। যেমন জ্বলন্ত কয়লাগুলি। ভিতরে বাহিরে একাকার অগ্নিদীপ্তি। জীব এই অবস্থায় এক সত্তাতে স্থির ভাবে বিরাজ করে। পূর্ণ-সমাধান অবস্থায় সাধকের সগুণ নির্গুণের দ্বন্ধ চলিয়া যায়। যেমন জ্বলন্ত কয়লার ভস্মেও আগুন। সাধক এই অবস্থায় এক অনির্বচনীয় ভাবে স্থির হইয়া যায়। অন্তরে বাহিরে কোনও ভেদাভেদ থাকে না,-“শান্তং বিমদ্বৈতম্” অবস্থা। সকল ভাবের স্পন্দন এই অবস্থায় অস্তমিত হইয়া পড়ে।” -শ্রীশ্রী আনন্দময়ী মা

 

 

🍂গল্প

 

______________________________________________

বাড়ির জন্য মন কেমন করছে তার। অবশেষে ওকে স্বপন বাবু দেশের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন। দেশের বাড়িতে এসে আবার জখু লাগামছাড়া স্বাধীনতা ভোগ করতে লাগল। আদুরী ওকে কিছুতেই বাগে‌ আনতে পারছে না এমতাবস্থায় দু’বছর কাটল। জখু তখন গ্রামের লোকের পরিভাষায় একটু ডাগর অর্থাৎ সেয়ানা হয়ে উঠেছে। সেয়ানা মেয়ে বিবাহ যোগ্যা। জখুর সম্বন্ধ আসা শুরু হল। কিন্তু জখু ওর মা’কে সাফ কথা জানিয়ে দেয় বিয়েতে ওর মত নেই।

________________________________

 

দ্বিচারিণী

হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

তারাপীঠ শশ্মানে চিতার লকলকে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে জখুর দেহ। ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠছে। ছোটো কর্তা ডুকরে কেঁদে উঠল। কাকতালীয় ভাবে মন্দিরের কোনো বিপনী থেকে ভেসে আসছে সংগীত। “চিতাতেই সব শেষ…চিতাতেই সব শেষ”।

বীরভূম জেলার নিরিশা গ্রামে ছিল আদুরীর বাস। সে ছিল এ গাঁয়ের মেয়ে। আদুরীর যখন বয়স দশ তখন ওর বিবাহ হয় পাশের মেটেরা গ্রামে। ওখানে দারিদ্র্যের সংসারে নিত্য অভাব লেগে থাকত। এরমধ্যে কোনো এক বসন্তের দিনে তার কোলে জন্ম নিল এক মেয়ে। নাম জখু। বাপ, মায়ে আদর করে মাঝেমধ্যে জখা নামেও ডাকত। আদুরীর বর সন্তোষ। ভাগে জমি চাষ করত। এক বর্ষার দিনে মাঠে ধান পুঁততে গিয়ে বাজ পড়ে মৃত্যু হয় তার। আদুরীর বয়স তখন খুব বেশি হলে চোদ্দ। আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ ছিল না। ফলে বাপের বাড়ির গ্রামে মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসতে হল। এখানে এসে শুরু হল আদুরীর সংগ্রাম। বাঁচার লড়াই যে কত কঠিন তা সে টের পেয়েছিল মর্মে মর্মে। অভাব অনটনের সংসারে বাড়তি মা, মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ির ভাই, ভাজদের সঙ্গে ছিল নিত্য বিরোধ। সবকিছুর মধ্যে থেকেও আদুরী জখুকে বুকে করে আগলে রেখে ছিল। জখুর সব আদর আবদার এরই মধ্যে মেটাতে চেষ্টা করত। এরজন্য আদুরীকে চরম পরিশ্রম করতে হয়েছে। কখনও চাষের কাজ, কখনও মনিবের বাড়িতে গৃহকর্মের কাজ, কখনও গোবর কুড়িয়ে এনে ঘুঁটে তৈরি করে বিক্রি করা এ সবকিছুই করত। কিন্তু প্রথমেই বলেছি, আদুরী ঠিক হুঁশিয়ার মেয়েমানুষ ছিল না ফলে সকলেই তাকে ঠকিয়ে নিয়েছে এই সুযোগে। তবে ও ভীষণভাবে চাইত তার মেয়ে যেন এমনটা না হয়। সে যেন আর পাঁচজন মেয়ের মত চালাক-চতুর হতে পারে।

—- “হ্যাটে আদুরী আজ জখু স্কুলে যাই নাই তুই জানিস কিছু হাঁ রে” গৌতম মাস্টার বললেন।
—-হেই, দেখো দিকি ছেলে ইস্কুলে যাই নাই। সক্কাল সক্কাল খাইয়ে, বই বগলে ইস্কুলে পাঠাইলাম বিশ্বাস কর মাস্টার।মেয়েটো মানুষ হবে না গো।
— গৌতম মণ্ডল এ গ্রামের প্রাইমারীর শিক্ষক।সে তার ছাত্রছাত্রীদের খুব খোঁজ খবর রাখেন। তিনি যতদূর জখুকে লক্ষ্য করেছেন তাতে তার ধারণা হয়েছে মেয়েটি বুদ্ধিমতী। ঠিকমত গাইড করতে পারলে ভালো হবে। আসলে তখন আশির দশকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাস্টারমশাইদের বেশ একটা নীতি ছিল। তখন সবে সবে বর্গাদারী প্রথা চালু হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজিও উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বটে তথাপি যেটুকু বাকি ছিল সেও মানুষ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

—- আদুরী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বাড়ি ফিরল। এসেই দেখছে জখু ডাঙ্গুলী খেলছে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। উঠোনের ধান সেদ্ধ করার আধপোড়া চেলাকাঠে হাতে করে মারতে শুরু করল। আশেপাশের লোকজন ছাড়িয়ে নিয়ে গেল জখুকে। তখনও আদুরী চিৎকার করে বলেছে, “আজ বেড়িয়েই শ্যাষ করিন দিবো। পাপ জন্মাইছে প্যাটে”।

—- মর, মর হতভাগী বাপ খেয়েও শান্তি হয়নি, মা’টোকে খেয়ে লে কেনে? এরপর শান্তি হবে তুর। জখু ছুটে গিয়ে মাকে চেপে ধরে‌। আদুরীর তখন চোখের জলে বুক ভেসে যায়।
—- ওই গ্রামেরই মুখুর্জে বাড়ির ছোটো ছেলে এসেছে গ্রামের বাড়িতে। বছরে দুবার বাপ মায়ের ভিটেতে ওরা নিয়ম করে আসে। গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষ শ্যাম মোড়ল। ওর বাড়িতেই কাজ করে আদুরী। ওই প্রথম প্রস্তাব দিল আদুরীকে।
—- “মুখুর্জে বাড়ির ছোটোছেলে একটা ছোটো মেয়ে চাইছে ওর ছোটো বিটিটো’কে দেখাশোনার জন্য। শহরে থাকে, বড় অফিসার বটে। কাজ‌ কিছুই নাই , ছেলেটোকো ধরে রাখা। জখুকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়ে দে ক্যানে? গেরামে থাকলে মাঠে খেলে খেলে বেড়াবে, নষ্ট হয়ে যেতে কতক্ষণ। তু’এক কাজ কর আজই কথাটো তোল”।
—- আদুরী সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরবাড়ির ছামুতে এসে হাঁক দিল, “ঠাকরুন রইছ হা, আমি এলাম, কিছু বলার লেগে।
—- স্বপ্না দেবী বেরিয়ে এলেন। “কিছু বলবে, কী বলবে ?”
—- হাত কচলাতে কচলাতে আদুরী বলে উঠল, “আমার জখা’টোকে লাও ক্যানে, তোমার ছোটো বিটিটো’কে দেখবে, প্যাট ভরে দু’টি খেতে দেবে মায়না চাইনা’কো। ”
ছোটো কর্তা ঘরের ভিতর থেকে সব শুনছিল হঠাৎ বলে উঠল, “না, না বিনে পয়সায় কাজ করতে হবে না ওকে আমি খাওয়া-দাওয়া সহ মাস গেলে হাতে একশো টাকা দেবো”। তখন আশি সাল সে হিসেবে একশো টাকা যেন মেঘ না চাইতেই জল। ভীষণ খুশি হল আদুরী এও বলে গেল, “তোমরা খুব ভালো মানুষজি গো গোটা গাঁয়ের লোক তোমাদের গোট্টা পরিবারের সুখ্যাতি করে”।

পরেরদিন একটা কানির ( ন্যাকড়ার) থলেতে দু’টি জামা আর দু’খানা ইজের দিয়ে জখুকে দিয়ে গেল ওর মা। বীরভূম থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার দুরত্ব তো নেহাত কম নয়। দু’জনেই চোখের জল সামলাতে পারল না। উভয়েই উভয়কে জড়িয়ে কান্নাকাটি করতে লাগল। এদিকে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল এবার যেতে হবে। জখু প্রথম জীবনে নিরিশা গাঁ ছেড়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে এসে উপস্থিত হল। শহর দেখতে দেখতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল মেয়েটির। এত্ত বড় ব্রীজ। ব্রীজ পার হতে হতে মুখার্জী পরিবারের বড় মেয়ে বলে উঠল, “এই দ্যাখ জখুদিদি এটা গঙ্গা নদী”। জখুর সঙ্গে তার ইতিমধ্যে বড় ভাব হয়ে গেছে। জখুর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো হবে সে। জখু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গঙ্গার দিকে। এর আগে ও- কখনও গঙ্গা নদী দেখেনি।
জখু মনে মনে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল… পুপসি তাকে জিজ্ঞাসা করল কী বলছিস? তুই এতবড় নদী দেখেছিস? জখু তখন খুব ক্ষীণ গলায় বলল, “আমাদের ওই খানটোতেও গঙ্গা রইছে ছোটো লাইনের টেরেনে চেপে যেতে হয়”। স্বপন মুখার্জী তখন বলে উঠল, “ঠিক বলেছিস কাটোয়া লাইনে উধ্যানপুরের গঙ্গা। মনে মনে এও ভাবলেন মেয়েটি তো বেশ বুদ্ধিমতী”।

কিছুদিনের মধ্যেই জখু এই পরিবারের একজন হয়ে উঠল। কিন্তু সন্ধ্যা বেলা‌ হলে জখু ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু পুপসি এসময়টা ওর সঙ্গে গল্প করতে চায়, ওকে ওর পড়াগুলো বোঝাতে চায় কিন্তু সম্ভব হয় না।
একদিন বিকেলের পর জখুকে নিয়ে পারিবারিক এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন সকলে মিলে। এমন সময় জখু গাড়ি থেকে নেমে স্বপন বাবুর ছোটো মেয়েটাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে সামনে বসে থাকা কুকুরের গায়ে পড়ে গেল।

কিন্তু স্বপন বাবুর খটকা লাগল। এত আলোর মধ্যেও দেখতে না পাওয়া! এরপর চোখ দেখালেন বাচ্চাটির‌। জানা গেল মেয়েটি রাতকানা রোগে আক্রান্ত। এরপর ওষুধ, সঠিক খাওয়াদাওয়ার পর সে রোগ থেকে মুক্তি পেল জখু। কিন্তু মাস তিনেক থাকার পর জখু আর থাকতে চাইল না এখানে। আসলে শহরের বাঁধাধরা জীবনে হাঁফিয়ে উঠল সে। খোলা মাঠ নেই, খোলা আকাশ নেই, বাঁধনছাড়া আনন্দ নেই। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে তার। অবশেষে ওকে স্বপন বাবু দেশের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন। দেশের বাড়িতে এসে আবার জখু লাগামছাড়া স্বাধীনতা ভোগ করতে লাগল। আদুরী ওকে কিছুতেই বাগে‌ আনতে পারছে না এমতাবস্থায় দু’বছর কাটল। জখু তখন গ্রামের লোকের পরিভাষায় একটু ডাগর অর্থাৎ সেয়ানা হয়ে উঠেছে। সেয়ানা মেয়ে বিবাহ যোগ্যা। জখুর সম্বন্ধ আসা শুরু হল। কিন্তু জখু ওর মা’কে সাফ কথা জানিয়ে দেয় বিয়েতে ওর মত নেই। এমতাবস্থায় বাড়ির কাছের গ্রাম দেড়পুরে ওর বিবাহের পাকা বন্দোবস্ত হয়।

শ্বশুর ঘরে কোনও অভিভাবক নেই। দুই ভাই একজন ভবানন্দ, অপরজন সদানন্দ। বাড়িতে মেয়েছেলে বলতে কেউ নেই। জখু যেদিন বিয়ে করে গেল, সেদিন পাড়ার খুড়িমারা বরণ করে নিলেন। জখুর মনে শান্তি নেই। খুব বিরক্তি সবেতেই। জখু তিনমাস যাবৎ শহরে থেকেছে কাজেই নিজেকে কিছুটা বিলেত ফেরত ভাবে মনে মনে। দিন যায়, মাস যায়, বছর পার হয় জখু সন্তানসম্ভবা হয়। এমতাবস্থায় আদুরী এসে ওকে নিয়ে যায়। তার বক্তব্য ছিল কতকটা এরকম : “বাড়িতে মহিলা নাই কো, হঠাৎ শরীর খারাপ হলে কেউ দেখার নাই কো। তোমরা দু’ভাই-এ মাঠে থাকবে”। কেউ আর আপত্তি জানায়নি। জখু নিজের গাঁয়ে ফিরে আসে। এরপর জখুর একটি ছেলে হয় নাম উজ্জ্বল। উজ্জ্বল যখন ছ’মাসের ছেলে তখন জখু আবার শ্বশুরবাড়ির দেশে ফিরে আসে। কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে বিরাটা হৈচৈ পড়ে গেল আশেপাশের সব গ্রামে। সকলের এক কথা, “এ কী ব্যাভিচার? এসব চলতে দেওয়া যাবে না। আর মেয়ে ছেলেরা কী শিক্ষা পাবে? কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি জখুর পরিবার বনাম গ্রামের লোকজন। দশের সভা ডাকা হল। সভায় উপস্থিত সকলেই বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি। একজন বললেন, “লেখো অপরাধ – এক পরিবারের দুই ভাইয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া”। গ্রামের সকলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে! এ যেন এক বিশাল চমক! এরপর অপরাধীদের ডাকা হল। ভবানন্দ, সদানন্দ এবং জখু।
প্রথমেই ভবানন্দকে জিজ্ঞাসা করা হল, “তুমি কি জানো তোমার স্ত্রী দ্বিচারিতা করেছে?” ভবানন্দ গোবেচারা টাইপের মানুষ মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল”। কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলে উঠল, “আপনারা যা বেচার দেবেন তাই হবে। বলে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। এরপর সদানন্দের পালা।
—- সদানন্দ তুমি কি জানো এই নারী তোমার দাদার স্ত্রী। সম্পর্কে তোমার বৌদি। তাহলে তোমার এত নীচ প্রবৃত্তি কেন হল?” সদানন্দের মাথায় তখন জখুর ভূত চেপে বসে আছে। সকলের সামনে সে বলে উঠল, “ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। দরকার হলে বিষ খাবো, গলায় দড়ি দেবো, রেলে মাথা… তবু ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না”।

জখুর ডাক পড়ল এবার। তুই কি চাইছিস বল? জখুর মনেও তখন সদার জন্য অগাধ ভালোবাসা আবার ভবানন্দের ময়াও (মায়া) সে ত্যাগ করতে পারবে না। তাতে না কী অধর্ম হয়।
সালিশি সভায় ঠিক হল জখুকে সদানন্দকে বিয়ে করতে হবে এবং এই গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে নিজের গ্রামে গিয়ে দুই পুরুষের সঙ্গে সংসার করতে হবে। তিনজনেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। অগত্যা দেড় পুরের যেটুকু জমিজমা ছিল বিক্রি করে নিরিশা গাঁয়ের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেল। এরপর সদার সঙ্গে বিবাহের পর জখুর আরও একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করল। যার নাম কাজল। প্রথম প্রথম গাঁয়ের লোকজনেও খুব বাজে রসিকতা করত এসব নিয়ে। জখুকে সব হজম করতে হয়েছে। কিন্তু তবুও জখু দমেনি। লড়াইটা সহজ ছিল না। এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে গ্রাম্য পরিবেশে এইরকম একটা সম্পর্ক দাঁড় করিয়ে রাখা খুব সহজ ছিল না। অনেক অপমান, অনেক উপহাস, অনেক মন্দ কথা, অনেক নোংরা কথা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু নিয়তির কী আশ্চর্য উপহাস। এ গ্রামের বামুন বাড়ির সমস্ত অসহায় বুড়ো বুড়িরা নিরলস সেবা নিয়েছে জখুর। তাঁদের শেষ যাত্রায় জখু ছিল একমাত্র নির্ভীক সঙ্গী। এই মুহূর্তগুলো মনে পড়লে বোঝা যায় জখু ছিল এক অনন্য সত্তা। যেখানে নারী স্বাধীনতা, নারী নিরাপত্তা, নারী পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে এতকিছু সেই সময় দাঁড়িয়ে জখু যেন এক স্বাধীন নারী সত্তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ইতিমধ্যে জখু একটু একটু করে নিজের সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছে। বিঘা ক’য়েক জমি, বাড়ি ভর্তি হাঁস, মুরগি, ছাগল। স্যালোর জলে চাষের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। মাটির দোতলা বাড়ি তুলেছে। স্বচ্ছলতার চিহ্ন‌ বড় স্পষ্ট ওর সংসারে আজ। এসব করতে গিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে ওকে। এমনকি চোলাই মদ পর্যন্ত তৈরি করা শিখেছে। গোপনে গোপনে বিক্রি করে লাভ করেছে। হঠাৎ একদিন দেশের বাড়িতে গিয়ে স্বপন বাবু শুনলেন‌ ভবানন্দ মারা গেছে।
সেবার কালিপূজোয় গিয়ে দেখা গেল জখুর মাথায় সিঁদুর নেই হাতে শাঁখা পলা নেই। কী শ্রীহীন চেহারা! কিন্তু জখু যে দেখতে সুন্দর এমনটাও নয়। তবুও এয়ো স্ত্রীর যে রূপটুকু থাকে সেটুকুও নেই। কিন্তু সদানন্দ তো বেঁচে আছে, তাহলে ওর মাথায় সিঁদুর নেই কেন এ প্রশ্ন সকলের। তাহলে ও কী… না সদানন্দের সঙ্গে ওর সাঙাত হয়েছিল। এটা একটা সামঝোতা। কী আশ্চর্য, সমাজের নিয়মকানুন। যদিও এও ঠিক অতি নিম্নমধ্যবিত্তের সংসারে এসব নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা চলে না। তবুও মানুষের মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়। যাহোক এরমধ্যে জখু অনেক তীর্থক্ষেত্র ঘুরে এসেছে। কখনও সদাইকে সঙ্গে নিয়ে তো কখনও একা গ্রামের মানুষদের সঙ্গে বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে দেখেছে সে। আসলে ইতিমধ্যে ওর দুটো ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে তাদের সন্তানসন্ততি নিয়ে এখন ওর ভরা সংসার। আদুরীও মারা গেছে বহুবছর হল। এখন গৃহকর্ত্রী বলতে জখু। সেও আজকাল আর কাউকে পরোয়া করে না। তবে স্বপন বাবুর বাড়ির সকলকেই সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। এখানে সেই ছোট্টবেলা থেকেই যেন এক আজন্মের অধিকার পেয়ে গেছে সে।

সেবার কী কারণে যেন স্বপন বাবু আর তার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। হঠাৎ শুনলেন জখু খুব অসুস্থ। ওরা দু’জনেই জখুকে মালপাড়ায় দেখতে যাবেন মনস্থির করলেন। কিন্তু পিতা, মাতার মত ভালোবাসা ছিল জখুর ওদের প্রতি। কাকা, কাকীমা এসেছে কানে শোনা মাত্রই খুব কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে এল। জখুকে দেখে স্বপন বাবু খুব বকাবকি করলেন, “তুই কেন এলি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে। আমরা তো যাচ্ছিলাম তোকে দেখতে।” জখু প্রণাম করতে করতে বলল, “কাকা এই ধুতিটা আর নামাবলী’ টা তোমার জন্য এনেছি আর কাকীমা তোমার জন্য এই ঘটি’টা।” মনে মনে খুশি হলেও কপট রাগ দেখিয়ে দুজনেই বলে উঠলেন, “এসব কেন কিনেছিস? ভালো করে ডাক্তার দেখা”। যদি কোনো সমস্যা হয় জানাতে ভুলবি না। আসলে স্বপন বাবুরা ওকে সন্তান স্নেহে দেখেন। ওর কষ্ট যেন খুব কষ্ট দিচ্ছিল ওদের। স্বপন বাবু বললেন, “টাকা পয়সার দরকার হলে যেন তাকে জানানো হয়”। জখু সেই সহাস্য মুখখানি নিয়ে বলল, “বেশ গো”।
এর মাস দু’য়েক পর একদিন দুপুরে স্বপন বাবুর ফোনটা বেজেই চলেছে। কানে কম শোনেন স্বপন বাবু, দৌড়ে এসে তার স্ত্রী ফোনটা ধরে। ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় কাজল খবর দিল মা আর নেই ঠাকুমা। কী উত্তর দেবে ভাবতে না ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল।

জখুর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তারাপীঠ শশ্মানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এসময় মনে পড়ে গেল ছোটো কর্তা সদানন্দের সব পুরোনো কথা। সংসারের অভাবে, অশান্তিতে, বিপদে জখু সবসময় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জখু যেন ওর কাছে দুর্গার এক রূপ। মনে পড়ে যাচ্ছে ওর সঙ্গে ঝগড়া করার দিনগুলো, ভালোবাসার দিনগুলোর কথা…! চলে গেল জখু। কিন্তু জখু শুধু একজন সাধারণ নারী ছিল না এই সাধারণ সংসারে সে ছিল এক স্বাধীনচেতা মানবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন লিখেছিলেন এ দেশের মেয়েদের স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকা দরকার। জোর করে মন্ত্র পড়ে বেঁধে দেওয়া দু’টো মানুষের দাম্পত্য সবসময় সুখের হয় না। বিবাহ নামক এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। তখন হয়ত তিনি ভাবতেই পারেননি এমন একটা সাধারণ নীচ জাতির মেয়ের এমন একটা মেরুদণ্ড থাকতে পারে। যে গোটা সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল নিজের মত করে বাঁচতে জানতে হয়। জখুদের মত মেয়েরা কোনো নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়ে না। ওরা শুধু নিঃশব্দে বিপ্লবের জন্ম দিয়ে যায়। একে আমাদের সমাজ দ্বিচারিণী আখ্যা দেবে হয়ত কিন্তু এই নির্লজ্জ সমাজে যে প্রতিনিয়ত দ্বিচারিতা চলছে সেখানে জখু এক ভিন্ন স্বাধীন সত্তা বলেই মনে হয়। জখুর মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বপন বাবুর বড় মেয়ে পুপসি বড় ভেঙে পড়েছিল। ওর সঙ্গে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল মেয়েটির। ছোটোবেলায় দুটোতে একসঙ্গে গুঁড়ো দুধ চুরি করে খাওয়া, কিভাবে গাছে উঠতে হয় সে শিক্ষাও জখু দিয়েছিল। ওর আজ বারবার মনে পড়ছে জখুর একটা কথা। একদিন কী দুষ্টুমি বুদ্ধি মাথায় এল জখুকে নিয়ে এক ছুটে পুকুর পাড়ে। জখুর কাছে আবদার এক্ষুনি সাঁতার শেখাতে হবে। জখুও তখন ছোটো, পুপসি আরও ছোট্ট। কিন্তু জখু এক ধাক্কায় পুপসি’কে পুকুরে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, “বুনটি হাত, পা নাড়াও, জল খাও, হাঁপু কাটতে কাটতে সাঁতার শিখে যাবে”। জখু যখন চলে গেল তখন পুপসি বেশ পরিণত। এখন এ বেলায় বারবার মনে পড়ছে কথাটা। কী বড় দর্শন! ওর কথায়, কত অবলীলায় বলে দিয়েছিল জখু। সংসারে মানুষের অবস্থানটাও ঠিক সাঁতার কাটার মতন। ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়েই তো শেখা জাগতিক সমস্তকিছু। জখু সমাজের চোখে নোংরা মেয়ে হলেও প্রকৃত মানুষের দৃষ্টিতে ও এক অতি মানবী….।🍁

 

 

🍂ফিরেপড়া | ল্প

 

_____________________________________________

মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছলছল করছে দেখে নিখিল চুপ করে থাকে। দরদের চেয়ে ছোঁয়াচে কিছুই নেই এ জগতে। নিখিলের মনটাও খারাপ হয়ে যায়। দেশের সমস্ত দরদ পুঞ্জীভূত করে ঢাললেও এ আগুন নিভবে না ক্ষুধার, অন্নের বদলে বরং সমিধে পরিণত হয়ে যাবে। ভিক্ষা দেওয়ার মতো অস্বাভাবিক পাপ যদি আজও পুণ্য হয়ে থাকে, জীবনধারণের অন্নে মানুষের দাবি জন্মাবে কিসে? রূঢ় বাস্তব নিয়মকে উল্টে মধুর আধ্যাত্মিক নীতি করা যায়, কিন্তু সেটা হয় অনিয়ম।

_____________________________________________

 

 

 

কে বাঁচায়, কে বাঁচে!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

সেদিন আপিস যাবার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখল-অনাহারে মৃত্যু! এতদিন শুধু শুনে আর পড়ে এসেছিল ফুটপাথে মৃত্যুর কথা, আজ চোখে পড়ল প্রথম। ফুটপাথে হাঁটা তার বেশি প্রয়োজন হয় না। নইলে দর্শনটা অনেক আগেই ঘটে যেত সন্দেহ নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু-পা হেঁটেই সে ট্রামে ওঠে, নামে গিয়ে প্রায় আপিসেরই দরজায়। বাড়িটাও তার শহরের এমন এক নিরিবিলি অঞ্চলে যে সে পাড়ায় ফুটপাথও বেশি নেই, লোকে মরতেও যায় না বেশি। চাকর ও ছোট ভাই তার বাজার ও কেনাকাটা করে।

কয়েক মিনিটে মৃত্যুঞ্জয়ের সুস্থ শরীরটা অসুস্থ হয়ে গেল। মনে আঘাত পেলে মৃত্যুঞ্জয়ের শরীরে তার প্রতিক্রিয়া হয়, মানসিক বেদনাবোধের সঙ্গে চলতে থাকে শারীরিক কষ্টবোধ। আপিসে পৌঁছে নিজের ছোট কুঠরিতে ঢুকে সে যখন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল, তখন সে রীতিমতো কাবু হয়ে পড়েছে। একটু বসেই তাই উঠে গেল কলঘরে। দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে পেট ভরে যতকিছু খেয়ে এসেছিল ভাজা, ডাল, তরকারি, মাছ, দই আর ভাত, প্রায় সব বমি করে উগরে দিল।

পাশের কুঠরি থেকে নিখিল যখন খবর নিতে এল, কলঘর থেকে ফিরে মৃত্যুঞ্জয় কাঁচের গ্লাসে জল পান করছে। গ্লাসটা খালি করে নামিয়ে রেখে সে শূন্যদৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল।

আপিসে সে আর নিখিল প্রায় সমপদস্থ। মাইনে দুজনের সমান, একটা বাড়তি দায়িত্বের জন্য মৃত্যুঞ্জয় পঞ্চাশ টাকা বেশি পায়। নিখিল রোগা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং একটু আলসে প্রকৃতির লোক। মৃত্যুঞ্জয়ের দু-বছর আগে বিয়ে করে আট বছরে সে মোটে দুটি সন্তানের পিতা হয়েছে। সংসারে তার নাকি মন নেই। অবসর জীবনটা সে বই পড়ে আর একটা চিন্তাজগৎ গড়ে তুলে কাটিয়ে দিতে চায়।

অন্য সকলের মতো মৃত্যুঞ্জয়কে সেও খুব পছন্দ করে। হয়তো মৃদু একটু অবজ্ঞার সঙ্গে ভালোও বাসে। মৃত্যুঞ্জয় শুধু নিরীহ শান্ত দরদী ভালোমানুষ বলে নয়, সৎ ও সরল বলেও নয়, মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে পচা ঐতিহ্য-আদর্শবাদের কল্পনা-তাপস বলে। মৃত্যুঞ্জয় দুর্বলচিত্ত ভাবপ্রবণ আদর্শবাদী হলে কোনো কথা ছিল না, দুটো খোঁচা দিয়ে খেপিয়ে তুললেই তার মনে পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার বেরিয়ে এসে তাকে অবজ্ঞেয় করে দিত। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শ্লথ, নিস্তেজ নয়। শক্তির একটা উৎস আছে তার মধ্যে, অব্যয়কে শব্দরূপ দেবার চেষ্টায় যে শক্তি বহু ক্ষয় হয়ে গেছে মানুষের জগতে তারই একটা অংশ। নিখিল পর্যন্ত তাই মাঝে মাঝে কাবু হয়ে যায় মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। মৃদু ঈর্ষার সঙ্গে সে তখন ভাবে যে নিখিল না হয়ে মৃত্যুঞ্জয় হলে মন্দ ছিল না।

মৃত্যুঞ্জয়ের রকম দেখেই নিখিল অনুমান করতে পারল, বড় একটা সমস্যার সঙ্গে তার সংঘর্ষ হয়েছে এবং শার্শিতে-আটকানো মৌমাছির মতো সে মাথা খুঁড়ছে সেই স্বচ্ছ সমস্যার অকারণ অর্থহীন অনুচিত কাঠিন্যে।

কী হল হে তোমার? নিখিল সন্তর্পণে প্রশ্ন করলে।

মরে গেল! না খেয়ে মরে গেল! আনমনে অর্ধভাষণে যেন আর্তনাদ করে উঠল মৃত্যুঞ্জয়।

আরো কয়েকটি প্রশ্ন করে নিখিলের মনে হল, মৃত্যুঞ্জয়ের ভিতরটা সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর মতো সাধারণ সহজবোধ্য ব্যাপারটা সে ধারণা করতে পারছে না। সেটা আশ্চর্য নয়। সে একসঙ্গে পাহাড়প্রমাণ মালমশলা ঢোকাবার চেষ্টা করছে তার ক্ষুদ্র ধারণাশক্তির থলিটিতে। ফুটপাথের ওই বীভৎসতা ক্ষুধা অথবা মৃত্যুর রূপ? না-খেয়ে মরা, কী ও কেমন? কত কষ্ট হয় না-খেয়ে মরতে, কী রকম কষ্ট? ক্ষুধার যাতনা বেশি, না মৃত্যুযন্ত্রণা বেশি–ভয়ঙ্কর?

অথচ নিখিল প্রশ্ন করলে সে জবাবে বলল অন্য কথা-ভাবছি, আমি বেঁচে থাকতে যে-লোকটা না-খেয়ে মরে গেল, এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কী? জেনেশুনেও এতকাল চার বেলা করে খেয়েছি পেট ভরে। যথেষ্ট রিলিফওয়ার্ক হচ্ছে না লোকের অভাবে, আর এদিকে ভেবে পাই না কী করে সময় কাটাব। ধিক, শত ধিক আমাকে।

মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছলছল করছে দেখে নিখিল চুপ করে থাকে। দরদের চেয়ে ছোঁয়াচে কিছুই নেই এ জগতে। নিখিলের মনটাও খারাপ হয়ে যায়। দেশের সমস্ত দরদ পুঞ্জীভূত করে ঢাললেও এ আগুন নিভবে না ক্ষুধার, অন্নের বদলে বরং সমিধে পরিণত হয়ে যাবে। ভিক্ষা দেওয়ার মতো অস্বাভাবিক পাপ যদি আজও পুণ্য হয়ে থাকে, জীবনধারণের অন্নে মানুষের দাবি জন্মাবে কিসে? রূঢ় বাস্তব নিয়মকে উল্টে মধুর আধ্যাত্মিক নীতি করা যায়, কিন্তু সেটা হয় অনিয়ম। চিতার আগুনে যত কোটি মড়াই এ পর্যন্ত পোড়ানো হয়ে থাক, পৃথিবীর সমস্ত জ্যান্ত মানুষগুলোকে চিতায় তুলে দিলে আগুন তাদেরও পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।

বিক্ষুব্ধ চিত্তে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে নিখিল সংবাদপত্রটি তুলে নিল। চোখ বুলিয়ে যেতে যেতে নজরে পড়ল, ভালোভাবে সাতির ব্যবস্থা করে গোটা কুড়ি মৃতদেহকে স্বর্গে পাঠানো হয়নি বলে একস্থানে তীক্ষ্ণধার হা-হুঁতাশভরা মন্তব্য। করা হয়েছে।

কদিন পরেই মাইনের তারিখ এল। নিখিলকে প্রতিমাসে তিন জায়গায় কিছু কিছু টাকা পাঠাতে হয়। মানিঅর্ডারের ফর্ম আনিয়ে কলম ধরে সে ভেবে ঠিক করবার চেষ্টা করছে তিনটি সাহায্য এবার পাঁচ টাকা করে কমিয়ে দেবে কি না। মৃত্যুঞ্জয় ঘরে এসে বসল। সেদিনের পর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ বিষণ্ণ গম্ভীর হয়ে আছে। নিখিলের সঙ্গেও বেশি কথা বলেনি।

একটা কাজ করে দিতে হবে ভাই। মৃত্যুঞ্জয় একতাড়া নোট নিখিলের সামনে রাখল।–টাকাটা কোনো রিলিফ ফান্ডে দিয়ে আসতে হবে।

আমি কেন?

আমি পারব না।

নিখিল ধীরে ধীরে টাকাটা গুনল।

সমস্ত মাইনেটা?

হ্যাঁ।

বাড়িতে তোর ন-জন লোক। মাইনের টাকায় মাস চলে না। প্রতিমাসে ধার করছিস।

তা হোক। আমায় কিছু একটা করতেই হবে ভাই। রাতে ঘুম হয় না, খেতে বসলে খেতে পারি না। এক বেলা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আমার আর টুনুর মার একবেলার ভাত বিলিয়ে দি।

নিখিল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জ্বর হলে যেমন দেখায়, মৃত্যুঞ্জয়ের গোলগাল মুখখানা তেমনি থমথম করছে। ভেতরে সে পুড়ছে সন্দেহ নেই।

টুনুর মার যা স্বাস্থ্য, একবেলা খেয়ে দিন পনের-কুড়ি টিকতে পারবে।

মন্তব্য শুনে মৃত্যুঞ্জয় ঝাঁপিয়ে উঠল। আমি কী করব? কত বলেছি, কত বুঝিয়েছি, কথা শুনবে না। আমি না খেলে উনিও খাবেন না। এ অন্যায় নয়? অত্যাচার নয়? মরে তো মরবে না-খেয়ে।

নিখিল ভেবেছিল বন্ধুকে বুঝিয়ে বলবে, এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না। যে অন্ন পাওয়া যাচ্ছে সে অন্ন তো পেটে যাবেই কারো-না-কারো। যে রিলিফ চলছে তা শুধু একজনের বদলে আর একজনকে খাওয়ানো। এতে শুধু আড়ালে যারা মরছে তাদের মরতে দিয়ে চোখের সামনে যারা মরছে তাদের কয়েকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করার সান্ত্বনা। কিন্তু এসব কোনো কথাই সে বলতে পারল না, গলায় আটকে গেল।

সে শুধু বলল, ভুরিভোজনটা অন্যায়, কিন্তু না-খেয়ে মরাটা উচিত নয় ভাই। আমি কেটেছেটে যতদূর সম্ভব খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বেঁচে থাকতে যতটুকু দরকার খাই এবং দেশের সমস্ত লোক মরে গেলেও যদি সেইটুকু সংগ্রহ করার ক্ষমতা আমার থাকে, কাউকে না দিয়ে নিজেই আমি তা খাব। নীতিধর্মের দিক থেকে বলছি না, সমাজধর্মের দিক থেকে বিচার করলে দশজনকে খুন করার চেয়ে নিজেকে না-খাইয়ে মারা বড় পাপ।

ওটা পাশবিক স্বার্থপরতা।

কিন্তু যারা না-খেয়ে মরছে তাদের যদি এই স্বার্থপরতা থাকত? এক কাপ অখাদ্য গ্রুয়েল দেওয়ার বদলে তাদের যদি স্বার্থপর করে তোলা হত? অন্ন থাকতে বাংলায় না-খেয়ে কেউ মরত না। তা সে অন্ন হাজার মাইল দূরেই থাক আর একত্রিশটা তালা লাগানো গুদামেই থাক।

তুই পাগল নিখিল। বদ্ধ পাগল। বলে মৃত্যুঞ্জয় উঠে গেল।

তারপর, দিন দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল মৃত্যুঞ্জয়। দেরি করে আপিসে আসে, কাজে ভুল করে, চুপ করে বসে ভাবে, এক সময় বেরিয়ে যায়। বাড়িতে তাকে পাওয়া যায় না। শহরের আদি অন্তহীন ফুটপাথ ধরে সে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। ডাস্টবিনের ধারে, গাছের নিচে খোলা ফুটপাথে যারা পড়ে থাকে, অনেক রাত্রে। দোকান বন্ধ হলে যারা হামাগুড়ি দিয়ে সামনের রোয়াকে উঠে একটু ভালো আশ্রয় খোঁজে, ভোর চারটে থেকে যারা লাইন দিয়ে বসে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয় তাদের লক্ষ্য করে। পাড়ায় পাড়ায় লঙ্গরখানা খুঁজে বার করে অন্নপ্রার্থীর ভিড় দেখে। প্রথম প্রথম সে এইসব নরনারীর যতজনের সঙ্গে সম্ভব আলাপ করত, এখন সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। সকলে এক কথাই বলে। ভাষা ও বলার ভঙ্গি পর্যন্ত তাদের এক ধাঁচের। নেশায় আচ্ছন্ন অর্ধচেতন মানুষের প্যানপ্যানানির মতো ঝিমানো সুরে সেই এক ভাগ্যের কথা, দুঃখের কাহিনী। কারো বুকে নালিশ নেই, কারো মনে প্রতিবাদ নেই। কোথা থেকে কীভাবে কেমন করে সব ওলটপালট হয়ে গেল তারা জানেনি, বোঝেনি, কিন্তু মেনে নিয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির অবস্থা শোচনীয়। টুনুর মা বিছানা নিয়েছে, বিছানায় পড়ে থেকেই সে বাড়ির ছেলেবুড়ো সকলকে তাগিদ দিয়ে দিয়ে স্বামীর খোঁজে বার বার বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু এই বিরাট শহরের কোথায় আগন্তুক মানুষের কোন। জঞ্জালের মধ্যে তাকে তারা খুঁজে বার করবে! কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে তারা ফিরে আসে, টুনুর মাকে মিথ্যা করে বলে যে মৃত্যুঞ্জয় আসছে–খানিক পরেই আসছে। খবর দিয়ে বাড়ির সকলে কেউ গম্ভীর, কেউ কাদাঁদ মুখ করে বসে থাকে, ছেলেমেয়েগুলো অনাদরে অবহেলায় ক্ষুধার জ্বালায় চেঁচিয়ে কাঁদে।

নিখিলকে বারবার আসতে হয়। টুনুর মা তাকে সকাতর অনুরোধ জানায়, সে যেন একটু নজর রাখে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে, একটু যেন সে সঙ্গে থাকে তার।

নিখিল বলে, আপনি যদি সুস্থ হয়ে উঠে ঘরের দিকে তাকান তাহলে যতক্ষণ পারি সঙ্গে থাকব, নইলে নয়।

টুনুর মা বলে, উঠতে পারলে আমিই তো ওর সঙ্গে ঘুরতাম ঠাকুরপো।

ঘুরতেন?

নিশ্চয়। ওঁর সঙ্গে থেকে থেকে আমিও অনেকটা ওঁর মতো হয়ে গেছি। উনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন, আমারও মনে হচ্ছে যেন পাগল হয়ে যাব। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য সত্যি আমার ভাবনা হয় না। কেবলি মনে পড়ে ফুটপাথের ওই লোকগুলোর কথা। আমাকে দু-তিন দিন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে টুনুর মা আবার বলে, আচ্ছা, কিছুই কি করা যায় না? এই ভাবনাতেই ওঁর মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেমন একটা ধারণা জন্মেছে, যথাসর্বস্ব দান করলেও কিছুই ভালো করতে পারবেন না। দারুণ একটা হতাশা জেগেছে ওঁর মনে। একেবারে মুষড়ে যাচ্ছেন দিন-কে-দিন।

নিখিল শোনে আর তার মুখ কালি হয়ে যায়।

মৃত্যুঞ্জয় আপিসে যায় না। নিখিল চেষ্টা করে তার ছুটির ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছে। আপিসের ছুটির পর সে মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে যায়–মৃত্যুঞ্জয়ের ঘোরাফেরার স্থানগুলো এখন অনেকটা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেও মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে কাটিয়ে দেয়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে তাকে উল্টো কথা শোনায়, নিজের আগেকার যুক্তিতর্কগুলো নিজেই খণ্ড খণ্ড করে দেয়। মৃত্যুঞ্জয় শোনে কিন্তু তার চোখ দেখেই টের পাওয়া যায় যে কথার মানে সে আর বুঝতে পারছে না, তার অভিজ্ঞতার কাছে কথার মারপ্যাঁচ অর্থহীন হয়ে গেছে। ক্রমে ক্রমে নিখিলকে হাল ছেড়ে দিতে হয়।

তারপর মৃত্যুঞ্জয়ের গা থেকে ধূলিমলিন সিল্কের জামা অদৃশ্য হয়ে যায়। পরনের ধুতির বদলে আসে ছেঁড়া ন্যাকড়া, গায়ে তার মাটি জমা হয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। দাড়িতে মুখ ঢেকে যায়। ছোট একটি মগ হাতে আরো দশজনের সঙ্গে সে পড়ে থাকে ফুটপাথে আর কাড়াকাড়ি মারামারি করে লঙ্গরখানার খিঁচুড়ি খায়। বলে, গাঁ থেকে এইছি। খেতে পাই নে বাবা। আমায় খেতে দাও। 🍁

 

 

 

🍂ফিরে পড়া | গল্প

 

 

_____________________________________________

ও, বুঝেচি। এক বউ থাকতে আবার বিয়ে করার জন্যে আপনি পরিমলবাবুর ওপর প্রসন্ন নন? তাই না? কিন্তু কী দুঃখে যে উনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে বাধ্য হয়েচেন তা কি আপনার জানা আছে?’

_____________________________________________

 

স্বামীসুখ

শিবরাম চক্রবর্তী

 

 

তুন বইটার প্রথম ম্যাটিনি শো-দর্শকের অভাব নেই। সুরমাও অসংখ্য দর্শকের একজন, তবু শ্রোতার অভাব মেয়েদের যেমন পীড়িত করে এমন আর কিছু না। সুরমা উশখুশ করে। পাশের মহিলাটির সঙ্গে খাতির জমিয়ে পরস্পরের কণ্ঠ এবং কর্ণের অভাব মোচন করলে হয়তো মন্দ হয় না।
‘আপনি বুঝি ছবির খুব ভক্ত? প্রথম ম্যাটিনিতেই ছবি দেখতে এসেছেন?’ সুরমা শুরু করে। এ ছাড়া আর কী বলেই-বা শুরু করা যায়!
‘হ্যাঁ, প্রথম ম্যাটিনিতেই এলাম।’ মহিলাটি বলেন। এ ছাড়াই-বা তাঁর বলবার আর কী ছিল?
‘আমিও এলাম।’ সুরমা গড়িয়ে চলে- আলাপের ধাপে ধাপে অবলীলাক্রমে। কলার খোসায় প্রথম পদার্পণের পর আর পিছলে চলে যাবার কোনো বাধা হয় না। -‘পরিমলবাবু কেমন করেন, তাই দেখতেই এলাম আরও।’
‘ওঃ! পরিমলবাবু?’ মহিলাটির কথায় ঈষৎ একটু চমকানিই ছিল যেন -‘হ্যাঁ, পরিমলবাবু তো এই বইয়ে আছেন বটে।’
‘কেন আপনি কি তার অভিনয় দেখতেই আসেননি।’ সুরমা অবাক হয় -‘অমন প্রেমের অভিনয় আর কেউ করতে পারেন নাকি?’
‘প্রেমের অভিনয়? হ্যাঁ-অভিনয়ই বটে। ঠোঁটের কোণে একটুকরো বাকা হাসি ক্ষণিকের জন্যে যেন খেলা করে।
‘এদেশের স্ক্রিনে ওঁর মতো পারফেক্ট লাভার আর কই? বলুন আপনি!’ নিজের প্রশংসায় অপরপক্ষ থেকে তেমন সায় না এলেও সুরমার উৎসাহ দমতে চায় না। এমনকী, আলোকোজ্জ্বল ঘরের সাদা ছায়াপটের ওপরেই পরিমলবাবুর অনাবিল প্রেমের দু-একটি দৃশ্য তার চোখের ওপর যেন ভাসতে থাকে।
‘পারফেক্ট লাভারদের আমি নাম করতে চাইনে।’ মহিলাটি মুচকি হেসে বলেন।
‘আপনি বুঝি কোনো সিনেমাস্টার?’ সংশয়ের খোঁচায় সুরমার চাহনি শানানো।
‘না না!’ মহিলাটি হাসেন। ‘তোমার ধারণা ভুল। সিনেমার ত্রিসীমানায় আমি নেই। তবে কিনা-আদত কথা এই-আদর্শ প্রেমিকদের ঠিকানা তোমার মতো ছেলেমানুষের কাছে ব্যক্ত করাটা কি ঠিক হবে?’
‘ব্যক্ত করার আপনার প্রয়োজন নেই। কারা পারফেক্ট লাভার জানি আমরা। ছবিতে দেখেই টের পাই।’ সুরমা যেন উসকে ওঠে- ‘পরিমলবাবু সত্যি একজন প্রথম শ্রেণির প্রেমিক-কি সিনেমার পর্দায়, আর কি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে।’
‘বটে, এতদূর অবধি তুমি জান?’ তাঁর ঠোঁটে বক্র হাসি!
‘কে’না জানে? বাংলাদেশের জানে না কে?’ সুরমা সিনেমা-ফ্যশান হিসেবে অতুলনীয়া-ভারি জোর ওর হাওয়া। ‘আপনি দেখছি আমার পরিমলবাবুলে মনে মনে অপছন্দ করেন। কেন করেন জানতে পারি কি?’
‘তোমার পরিমলবাবু? তার মানে মলবাবু সম্প্রতি যাঁকে-‘
‘না না না!’ সুরমা বাধা দিয়ে ওঠে- ‘আপনার ধারণাও ভুল। আমি বলছিলাম আমাদের পরিমলবাবু।’
‘ভালো কথাই বলছিলে। তা, তোমাদের পরিমলবাবুকে আমি অপছন্দ করিনে, কিন্তু পছন্দই-বা কেন করতে যাব বলো তো?’
‘ও, বুঝেচি। এক বউ থাকতে আবার বিয়ে করার জন্যে আপনি পরিমলবাবুর ওপর প্রসন্ন নন? তাই না? কিন্তু কী দুঃখে যে উনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে বাধ্য হয়েচেন তা কি আপনার জানা আছে?’
‘কী দুঃখে? না, জানি না তো!’
‘সেকী? আমরা সবাই জানি যে! খবরের কাগজের মারফতে বাংলা দেশের সক্কলে জানে।’
‘কী, শুনি তো? বিস্তর কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সংসার- খবরের কাগজ পড়ার ফুরসত পাইনে! শুনি তো-কী?’ মহিলার কণ্ঠস্বরে এবার কৌতূহলই অকৃত্রিম।
‘ওঁর বউ পাগল। বদ্ধ পাগল। বহুদিন থেকেহা’ চাপা গলায় সুরমা জানায় -‘কিন্তু ওঁর কী ভয়ংকর ভালোবাসা ভেবে দেখুন! তেমন বউকেও এতদিন ধরে অম্লানবদনে সেবা-শুশ্রূষা করে এসেছেন।’
‘বদ্ধপাগল?’ মহিলাটির বড়ো বড়ো চোখ আরও বড়ো হয়ে ওঠে।
‘এক্কেবারে। তা না হলে কখনো অমন স্বামীর গলা টিপে মারতে যায়? তাই তো গেছল। আর তাইতেই তো উনি, পাগল বউকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যেই তার চোখের সামনে থেকে সরে এসেছেন। কত বড়ো বেদনা নিয়ে যে সরেছেন তা উনিই জানেন। কেন, খবরের কাগজে সবই তো বেরিয়ে গেছে।’
‘বদ্ধপাগল!’- যন্ত্রচালিতের মতো মহিলাটি পুনরুক্তি করেন, তাঁর চোখ তেমনি বিস্ফারিত। কথাটা যেন কিছুতেই তাঁর মাথায় ঢুকতে চায় না।
‘এক নম্বরের। তা না হলে অমন চমৎকার স্বামী পেয়ে-কীরকম লম্বা-চওড়া সুশ্রী চেহারা, দেখেছেন তো?’
‘তোমার কি বিশ্বাস হয়, ওর বউ ওর গলা টিপতে গেছল?’
‘কেন হবে না? পাগলে কি না পারে! আর গেছল মানে? -খেপে গিয়ে এমন টেপা টিপে ধরেছিল যে আরেকটু হলেই ওঁর বারোটা বেজে যেত!’
ওই লম্বা-চওড়া চেহারার কাছে? একটা মেয়ে পারবে কেন, পেরে উঠবে কেন, হলই-বা পাগল? আমার মনে হয় তুমি উলটো শুনেচ। উনিই হয়তো ওঁর বউয়ের গলা টিপে প্রায় সাবাড় করে এনেছিলেন, সেইটাই ঠিক হবে। তাই হওয়াই সম্ভব। ভয়ংকর প্রেমিকরা তর্কে পরাস্ত হলে তাদের হাতের কাছে ওই একটিমাত্র যুক্তি থাকে কিনা! আর বাবা, ওই হাত, ওই সব আঙুল কারও গলায় যদি চেপে বসে’-মনশ্চক্ষে দৃশ্যটি কল্পনা করতেই মহিলাটি শিউরে ওঠেন।
‘বুঝেছি, পরিমলবাবুর ওপরে আপনি হাড়ে চটা। যাকে দেখতে পারিনে তার চলন বাঁকা!’ সুরমা গড়গড় করে বলে-বলতে বলতে রাগে গরগর করে- ‘বুঝেচি।’
সিনেমা শুরু হতে আর দেরি নেই। শেষ বারের ওয়ার্নিং বেল পড়ে গেল। মহিলাটি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমি এই এলাম বলে।’
সুরমা উত্তর না দিয়েই সরে গেল। কোনো উচ্চবাচ্য না করেই কে পরিষ্কার করে দেয়। মহিলাটির প্রতি তার ভাব চটে গেছে, কাজেই অভাবের জন্যে তেমন কাতরতা তার হয় না।
মহিলাটি কিন্তু আর ফেরেন না। সিনেমার সম্মুখ হল দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় চকিতের জন্যে একটু দাঁড়ান-না, চারিধারে শোভমানা তারকাদের ছবির দিকে তাকিয়ে নয়-প্রমাণ আয়নাটার সামনেই দাঁড়ান একটু। চকিতের জন্যে কাঁধের শাড়িটা সরিয়ে গলার ধারটা আয়নার ভেতরে দেখে নেন। সুন্দর সুডৌল গ্রীবা-অন্তত, কিছুদিন আগে অবধি সুন্দর সুডৌলই ছিল। কিন্তু দেখা যায় সেখানে চেপে-বসা বিকৃত আঙুলের দাগ… আর, সে-দাগ এখনও মেলায়নি বুঝি!🍁

 

 

🍂বিতা 

 

 

 

 

কুন্তল দাশগুপ্ত –র দু’টি কবিতা

লগ্নমিতি

তুমি যে তখন স্বর্গের এক ফোঁটা।
আমার তখন নিশ্বাসে নিকোটিন।
উপড়ে এসেছি কৈশোর বাঁধা খোঁটা।
তুমুল ছিল সে বৈশাখ-পোড়া দিন।
যন্ত্রণা ছাড়া দেবার ছিল না কিছু।
মেঘবতী তুমি টলটলে ছিলে জলে।
গনগনে মরু ভাবেইনি আগুপিছু,
পুরো শুষেছিল তৃষ্ণা মেটানো ছলে।
বুলেট-বাহন মাদকতা দূরগামী।
নিভৃত ব্যথায় আজও কী তৃপ্ত কায়!
কেন পুরোটাই এগোলে বেদনাকামী?
লগ্নমিতির অঙ্ক মেলানো দায়।
যন্ত্রণা গুলো ডুবে ভেসে থাকা চর।
মগজে ফুটছে কালবৈশাখী ঝড়।

 

 

 

 

ডাকবাক্সে নিখোঁজ চিঠি

মেলা খেলায় যেতে, জেতে পরিবাহকেরা।
বাসে কী আবাসে একদর।
ধরাধরি হয়, নয় দরাদরি।
গৃহগ্রাফির লেখচিত্রটা এক্স অ্যাক্সিসের সমান্তরালে।
বাড়াবাড়ি ডাঁয়ে-বাঁয়ে অসমান হলে—
ডাকবাক্সে নিখোঁজ চিঠি পেতে—
মেঘ-পিওনের ব্যাগ ডাকে…
ফোসলায় হাওয়া হতে।
মাথামেটিক্সের উত্তরমালা ছিঁড়ে ছড়ায়, গড়ায় ক্রমে সুদক্ষিণায়।
নিখোঁজ-চিঠি-দুঃখ ধ’রে ঝুলে থাকে—
শূন্যগর্ভ ডাকের বাক্স।

 

 

 

 

তন্বী মুখোপাধ্যায় –র দু’টি কবিতা

অলকাপুরী

মাটি মহাশূন্যে জন্মানোর অধিকারে একটু একটু করে বিরল শিলা জৈব কোমরে পুতুল, বালিকার খেলাঘরে
সঞ্চার চুপ কখন কীভাবে দৈব-

যা দিই তোমাকে নিসর্গ প্রকৃতি ফিরে তা করুণা হবে বিশেষ সাদরে শিল্পীর অন্বয় তথা কর্ষণের স্মৃতি
বিভোর অলক্ষ্যে রাখে স্বাগত মধুরে

জীবনের কতো স্বাদ শক্তি স্বাতন্ত্র্য
আরও ঘোর অশ্রুবিন্দু হয়ত মৃঢ়তা
আলো বর্ণে কচি পর্ণে প্রীতির মন্ত্র
নক্ষত্র আগুন দিকে দিকে
ভূমিজ বলয়ে ঘর-বাঁধা।

 

 

 

সংকল্প

প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে মেনাবো সংকল্প-
পাবো শুধু ফেরত দেবো না কিছু তা কি ঠিক হয়?
গোলাপে রক্ত দিয়ে ফোটানো আজ আর যাবে না
আজ কিছু মরসুমী ফুলে যদি শীত মন দেয়-
সংকল্পের সঙ্গে সঙ্গে মেলাবো সাধনা
দিতে হলে সব ভরে দিতে হবে দৃষ্টিকটু শূন্যতা অবধি
প্রবল হিংসাজুরে জর্জর যন্ত্রণা, মহতের বাণী সে অন্ধ কানে তো নেবে না-
দুর্ভাগ্যের ভয় ভুলে ইতিহাস নিয়তির সন্ধিতে সুর দিতে পারি

ভরানোর দানের ডালনায় নিজেকে পূর্ণ করে নেওয়া যায়-
অনেক ধামতি আছে, অযথা ভ্রান্তি,
অন্তর সাধনা মানে সঙ্গে ভাবনা
তাকে বলি রূপকধা করে, তার রূপ দিই যার তরে
অনুভূতি দিয়ে আত্মশক্তি প্রয়োজন

সংকল্পের সঙ্গে সঙ্গে মেলাবো নিরীক্ষা
হয়তো বা দেওয়াই দর্শন ও সিন্ধি লোকের বিশ্বাস নেই সমাজ অস্থিত,
তখন তাদের প্রার্থনার সঙ্গেও যোগ দিতে যদি পারি
দেখে নেবো কতখানি এই বোধ শ্রুত হয়- যদি ভাগ করি-

 

 

 

 

মিতা দাস-র কবিতা 

স্বৈরশাসক

শুনেছি যে
ভালো দিন এসেছে!
ভালো দিনের অপেক্ষায়
মজনু, সুখিয়া ও ইন্তেজার মারা গেছে

চকচকে লাল গালিচা মাড়িয়ে
চকচকে জুতা
উজ্জ্বল মুখ
ঠোঁট ঝলমলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে
একটি উজ্জ্বল হাসিমুখ নিয়ে…
তাহলে আর ভ্রমিত কেন
আমরা ভালো সময়ে নেই!

স্বৈরশাসক কোথাও যাননি
বার-বার আসে
উজ্জ্বল মুখ নিয়ে
ভক্তদের ভুলিয়ে রাখার জন্যে।

 

 

 

আবদুস সালাম-এবিতা 

মানবতা কাঁদে

মানবতার অপমান কি ধর্মের অঙ্গ? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধোঁয়ায় ঝাপসা হয় সংস্কৃতির উঠোন

সত্যকে অসত্যের জলে ডুবিয়ে মজা দ্যাখে ভ্রান্ত মানুষ
লুণ্ঠিত হয় মানবতা- গা শিউরে ওঠে

অবিশ্বাসকে তুমি বিশ্বাস ভাবতেই পারো ক্ষতি নেই
আদিম মানুষের অঙ্গ ধোয়া জল অমৃত; খেতে তো কেউ নিষেধ করে নি
আপনার বিশ্বাস নিয়েই আপনি থাকুন

দাও অসত্যকের সত্য বলার আদেশ , বুলডোজার চালিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার আদেশ
আমাদের ভয় তো সেখানেই

ভয় পায় তোমাদের মর্মান্তিক হাহাকার বিছিয়ে রাজ ধর্ম শেখানোর কৌশলকে
মানবতার দুয়ারে তালা মারে ধর্ম মানুষ
বিধ্বস্ত পাড়ায় ফেনীত হয় কলরব

টুকরো টুকরো হাহাকার ছড়িয়ে রেখেছো পথে
হাত দিয়েছো খাবারের থালায়
হাত দিয়েছো পোশাকে
পাড়ায় পাড়ায় ধ্বনিত হচ্ছে গ্রাম ছাড়বার নির্ভেজাল নির্দেশ
মৃত্যু আমাদের পাহারা দিচ্ছে রোজ

মৃত্যুর কিনারায় শুনি বিশ্বাস হারানোর গান
মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে দেখি ভ্রান্ত আরাধনার মঞ্চ;
অসংলগ্ন নির্দেশ
মানবতার মাঠে মুখ থুবড়ে পড়ে শান্তির পায়রা
ধর্ম নিয়ে অধর্মের খেলায় সব মত্ত প্রতিবেশী মানুষ
ধর্ম পুরুষ রক্ত হোলি খেলতে বেশি ভালোবাসেন

প্রচ্ছন্ন মদত জোগায় আমাদের বিনম্র ভগবান
ভুলতে বলো এটা আমাদের দেশ নয়
ধর্ম মানুষ ইতর হয় ধর্মের সুড়সুড়িতে

মানবতা কেঁদে মরে

 

 

 

 

ফাল্গুনী চক্রবর্তী-এবিতা

প্রেম ফাইল

আরও সরে এসো
কাছাকাছি
দ্রুত হউক নিঃশ্বাসের স্তব
যে ঘরে বসে আমি তোমার
এখানে কোন খেলাঘর নেই…
পোর্ট্রেট সাজাই রোজ নেই কোন মুছে ফেলা চলচিত্রের বাড়ি
আছে শুধু বাস্তব আর
কল্পনার হানাহানিতে
স্বপ্নের বিশাল সরাইখানা নিরালা রাখতে পারি না
গর্জনের রাজপাট
বিজলীর বারি বারি খসে পড়ব আঙিনায়।
খোলামাঠের মাদুর বিছানো সবুজ ঘাসে
তারপর ঝকঝকে নীলের ছাউনিতে
নূতন পোষাকীয় অঙ্গীকার
আমরা কিছুই ভাবব না
ডুবে যাব প্রেমে
মায়ায় যতনে রাখা
পলকের পাণশালায়…

 

 

 

 

মমতা রায় চৌধুরী-র কবিতা 

আগামীর হাতছানি

দম্ভ অহংকারে আজ আকাশচুম্বী করেছ যারা
ভেবে দেখো একদিন বিলীন হবে তারা
মহাকালের স্রোতে।
অত্যাচারে অত্যাচারে অন্যায়ের ঘেরাটোপে
একদিন বারুদের স্তুপ উঠবে জ্বলে
মেহনতী মানুষের প্রতিরোধে,
ইতিউতি ঝলসে উঠবে গোটা দেশে
সেদিন এই তুচ্ছ মানুষই থাকবে জাতির পাশে
কৃষকের ফসলেরা আবার উঁকি দেবে মাঠে
নবান্নের ঘ্রাণ পৌঁছে দেবে প্রতি পরতে পরতে
শ্রমিকের শ্রম বিফলে যাবে না হাতে হাত মিলে
হিংসা-দ্বেষ বিভেদ ভুলে মেতে উঠবে আগামীর দেশ

 

 

 

 

নীলম সামন্ত-র কবিতা 

“রাজা তোর কাপড় কোথায়”

 

‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’

ভেবেছিলাম এভাবেই জিজ্ঞেস করি
নম্র গলায়
সফেন বারো হাতে তিনি উপচে পড়ছেন রাজপথে
আলতো ভারে চাপা পড়ছে
ইস্কুল ফেরত মেয়েটির মুখ,

পৃথিবী আজ উল্লাসরত ময়ূর, মুখ থেকে ঝুলে পড়ছে ফণাধর সাপ

খাদ্য-খাদকের নিখুঁত বিন্যাস- রাজার প্রধান নীতি
তাই পা বাঁচিয়ে রক্ত ঠেলে দিলেন জনস্রোতে
ঘোষণা করলেন খাবার বিলির খবর

কেউ শুনল খাবার, কেউ খবর

তারা জানে অথবা জানে না,
রক্তের সাথে লেগে আছে দগদগে যোনী
কারা যেন কেটে ফেলেছিল দিন দুপুরে—

পূজার অর্ঘ্য

কিংবা ছেঁড়া স্তন দিয়ে
দুর্গাপূজার ফিতে কাটার হুড়োহুড়ি;

হাসি মুখে এই সবই হাত মিলিয়ে দেখতে যাচ্ছে
রাজ্যের কলাকুশলীবৃন্দ…

ভাগ্যিস আপনি নিঃসন্তান
খেতে বসে মনে করার মতো কেউ নেই
নইলে অভুক্তের মা হবার দায়ে বুকের দুধে ভিজে যেত লজ্জা
সেদিন কেউ বলত না,
“রাজা তোর কাপড় কোথায়?”

 

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১১

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ১১।

 

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

এগারো.

গ্রামের মানুষ পুলিশের অপেক্ষা করতে লাগলো

তালের গাছে উঠতে প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগতো, পরে একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। এখন তরতর করে উঠতে পারি। কোমরে দড়ির সঙ্গে একটি হুঁক বাঁধা থাকে। তাতে ঝোলানো থাকে একটি বড় মাটির ভাঁড়। তাতে একটি ধারালো পাতলা দা নিয়ে দু’বেলা গাছে উঠতে হয়। তালগাছের মাথায় বাহুতে ঝোলানো আছে প্রায় দশ-বারোটি ছোট ভাঁড়। প্রতিটি ভাঁড়ে তালের মোচা লাগানো আছে। মোচার আগের দিকে পাতলা করে ছাঁট দিলেই ফোঁটায় ফোঁটায় রস জমা হয় ভাঁড়ে। গ্রীষ্মকালে যা রোদের ঝাঁজ সেইসব রস পেকে গিয়ে পাকা তাড়িতে পরিণত হয়। শন্ শন্ শব্দে সেগুলোর ভুড়ভুড়ি ওঠে। কীরকম ঝাঁজালো তেতো তেতো স্বাদ। খেলে শরীর ঝিমঝিম করে। এক ধরনের নেশা লাগে। আরাম বোধ হয়। গাঁয়ের মুঠে-মজুর, জেলে-কামার-ছুতোর, ঘরামি-রাখাল-বাগাল দুপুরবেলায় কাজ ছেড়ে সবাই আসে এই তাড়ি পান করতে। গাছতলায় এসে বসে। সঙ্গে থাকে চাল-কলাই ভাজা, চপ-পেঁয়াজি অথবা চানাচুর। এক এক গ্লাস তাড়ির দাম কুড়ি পয়সা। একটা কাপড়ে ছেঁকে ছেঁকে তাদেরকে ঢেলে দিই। একেক জনে দশ থেকে বিশ গ্লাস পর্যন্ত পান করে। প্রতিদিন সেইসব খুচরো পয়সা গুনে গুনে দেখি পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকা পর্যন্ত হয়। সেই টাকা দিয়েই কিনে আনি চাল-ডাল সবজিপাতি। দুপুর গড়িয়ে যায় রান্না হতে। সন্ধ্যা নাগাদ স্নান করে খেতে বসি।
সমস্ত গ্রীষ্মকাল জুড়েই আর কোনো কাজ থাকতো না। পাঁচ কেজি গমের রিলিফে মাটি কাটার কাজও করতে হতো। কিন্তু সেই কাজও পর্যাপ্ত ছিল না। কয়েকদিন চলার পর বন্ধ হয়ে যেত। কোনো বছর হয়তো হতোই না। তখন বাবা ঘরের কাছে থাকা একটি বাঁজা তালের গাছে একটা খাঁজওয়ালা বাঁশ বেঁধে তাড়ি পেতে দিত। বাবার অনুপস্থিতিতে আমাকেই এই কাজটি করতে হতো। এটাই ছিল আমাদের জীবিকার একমাত্র পথ। সমস্ত গ্রীষ্মকাল এবং বর্ষা নামার পরও কিছুদিন এটা চলতো। ভাঁড়ে প্রথম প্রথম মিষ্টি রস নামানো হতো। সেগুলো পঁচিশ পয়সা গ্লাস। পরে পাক ধরলে সেগুলোর দাম হতো কুড়ি পয়সা। শুধু বিক্রি করাই নয়, পেটের জ্বালায় আমাকেও খেতে হতো ওইসব পাকা তাড়ি খদ্দেরদের সঙ্গে বসেই। এমনি একজন খদ্দের ছিল সাবির। তার বাড়ি ছিল হাজারপুরে। একদুপুর পর্যন্ত মাছ ধরে একটা মাছ রেখে আর সব মাছ বিক্রি করে দিত। তাড়ি খেতে আসতো সঙ্গে নিয়ে সেই মাছটি। সেই মাছটি ভালো করে ভেজে নিয়ে দু’জনে খেতে বসতাম। সাবিরের সঙ্গে আমার নানা রকম কথাবার্তা হতো।
—তুমি তো লেখাপড়া করেছো, তবু আমাদের সঙ্গে বসে তাড়ি খাও, মনের কথা বলো এটা আমার খুব ভালো লাগে।
—তাড়ি তো আমিই বিক্রি করি, পেটের টানে সবকিছুই করতে হয়। আর সব মানুষই সমান, শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে কি কোনো তফাত আছে? মানুষ ভালো কিনা সেটাই দেখার।
—কিন্তু আমি তো অনেক জায়গা যাই, সেখানে আমরা অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ বলে অনেকেই ঘৃণা করে। ভালো করে কথাও বলে না।
—ওরকম মানুষ অনেক আছে, আমি নিজেকে কোনোদিন শিক্ষিত বলে দাবি করি না। মূলত আমরা গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ এটাই আমাদের শেষ পরিচয়।
—আচ্ছা সাবির ভাই আমরা তাড়ি কেন খাই? তাড়ি খাওয়াতো হারাম তাই না!
—তাড়ি না খেলে কাজ করতে পারি না। রোদে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। শরীর আর চলে না। তখন তাড়ি খেলে বেশ কিছুক্ষণ ফুর্তি লাগে। আবার কাজ করার শক্তিও ফিরে পাই।
— ঠিকই বলেছো। বেঁচে থাকার জন্যই তাড়ি খেতে হয়। তবে সুদ তো খাও না, চুরি করেও খাও না। পয়সা দিয়েই খাও। আমিও মেহনত করি দু’বেলা প্রাণ হাতে করে গাছে উঠে তাড়ি পেড়ে আনি।
—একাজটাও তো কঠিন কাজ। কষ্ট না করলে তো বসে বসে খাবার জুটবে না। আমরা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ।
— সাবির ভাই, শুনেছি তুমি হাত দেখতেও পারো!
— কে বললো এই কথা?
—শুনেছি তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকদের মুখে।
—তাহলে নিশ্চয়ই আমার শালা বলেছে।
— হ্যাঁ তোমার শালার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ও তো ট্রাক্টর চালায়!
—হ্যাঁ ও ট্রাক্টর চালায়। আসলে আমরা ফকিরি সম্প্রদায়ের মানুষ। বিবাহ সূত্রে আমি শ্বশুর বাড়িতে থাকি। কিছু কিছু হাত দেখার বিষয়ে আমি শিখেছি। তবে বাইরে কারো দেখতে চাই না।
—শুধু আমারটা একবার দেখবে?
— দাও, ডান হাতখানা দেখি।
সাবির ভাই সেদিন ডান হাতখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছিল। বলেছিল, ‘কী জানতে চাও?’
আমি বলেছিলাম, চাকরি-বাকরি পাবো কিনা এবং বিয়েশাদী কবে নাগাদ হবে।
আমার প্রশ্ন শুনে সাবির ভাই হেসে উঠেছিল। লাইটারে একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দিয়ে বলেছিল, ‘চাকরি হবে দেরিতে, বিয়েও হবে খুব দেরিতে।’
আমি বলেছিলাম, বিয়ে সামাজিকভাবে হবে না প্রেম করে হবে?
সাবির ভাই আরো একবার হেসে উঠেছিল। বিড়িতে আরেকবার জোর টান দিয়ে বলেছিল, ‘প্রেম ভেঙে যাবে, বিয়ে হবে সামাজিকভাবেই।’
ওর কথা শুনে অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল রুমার মুখটি। তবে চাকরি পাবো কথাটি শুনে আশ্বস্ত বোধও করেছিলাম। শেষ বেলায় জানতে চেয়েছিলাম, তা কত বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি পেতে পারি?
উত্তরে সাবির ভাই মনে মনে কী একটা হিসেব করে বলেছিল, ‘তা পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর তো হবেই!’
সাবির ভাই আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু তার কথা যে অব্যর্থ ছিল তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। একদিনের অসুস্থতার মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে পঞ্চাশ বছরও বয়স হয়নি। তার ছেলে-মেয়েগুলো খুব একটা বড়ও হয়নি। মাছ ধরাই তার জীবিকা ছিল। আবার হয়তো তার ছেলে-মেয়েদের ফকিরি ব্যবসাতেই নামতে হবে। সংসারের নির্মম নিয়ম কিছুতেই লঙ্ঘন করা যায় না। সাবির ভাই নিজেও জানতো সে কথা। একদিন কথায় কথায় বলেছিল, ‘আজ আছি কাল নাই, আজ একসঙ্গে বসে খাচ্ছি, কালকে কোথায় থাকবো ঠিক নেই। দুনিয়াটা আমাদের কাছে একটা খেলাঘর মাত্র।’
আজও তার কথাগুলি স্মরণে আসে। মূর্খ হলেও বড় কঠিন বাস্তব কথা জানতো সে।
আমি তাড়ি খেলেও বাবা কোনোদিন এক চুমুকও খায়নি। বরং আমাকেও নিষেধ করেছে। কিন্তু এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছি তা না খেয়েও পারিনি। বেঁচে থাকাটাই লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় টিউশনি পড়ানোর পর পাশের গাঁয়ে এক সহপাঠীর বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ বসতাম। তার নাম ছিল সুজয় ভাণ্ডারী। ধান-জমি চাষবাস ও বউ-ছেলে নিয়ে তার সংসার। মধ্যবিত্ত গেরস্থ বলা চলে। বেশিদূর লেখাপড়া সে করেনি। ওই হাইস্কুলের গণ্ডিই সে পার হয়নি। তার বাড়ি গেলে সে মাঝে মাঝেই আসতে দেয় না। বলে, ‘এসেছিস তখন রাতের খাবারটা খেয়েই যাবি।’
এভাবেই রাতের খাবার খেতে খেতে বেশ কয়েক বছরই কেটে যাচ্ছে। দুর্গাপুজোয় টিউশনিও বন্ধ থাকে তখন তার বাড়িতেই জমে আড্ডা। গরম গরম লুচি ভেজে দেয় ওর বউ। কখনো আলোর দম, কখনো কষা মাংস। কখনো সুজয় তার এক সুমুন্দীকে বলে আনিয়ে নেয় দেশি মদও। সেদিন খানাপিনা ভরপুর হয়ে যায়। অনেক রাতে বাড়ি ফিরি টলতে টলতে। একবার দুর্গাপুজোর ক’টা দিন খুব আনন্দে কাটলেও দশমীর দিন অন্যরকম হয়ে গেল। সুজয়ের পাশের বাড়িতেই আমাদের খানাপিনার আসর বসেছে। বাইরে ঠাকুর ভাসানের প্রস্তুতি চলছে। ঢোলের তাল উঠছে বারবার। বাঁশির সুরের লহরি চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বীভৎস একটি কান্নার রোল কানে ভেসে এলো। শোনা গেল চেঁচামেচিও। ঢোল ও বাঁশির শব্দকে ছাপিয়ে গেল। পড়িমরি করে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, তুষার লেটের বাড়ির চালাই দাউ দাউ করে আগুনের শিষ উঠছে। আগুনের ভিতর থেকে একটা কঁকিয়ে ওঠার আওয়াজ। থেকে থেকে গোঁঙানির শব্দ। সবাই হতচকিত হয়ে ছুটছে। আগুন নিভিয়ে দেখা গেল, মাছ পোড়ার মতো অর্ধ দগ্ধ হয়ে বাড়ির বউটি পুড়ে গেছে। আট মাসের গর্ভবতী। লেপকাঁথা নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ছুটে পালাবার সামর্থ্য হয়নি।
বউটি ছিল এক ব্রাহ্মণ কন্যা। যার সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সে ছিল তুষার লেটের ছেলে মান্তু লেট। ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে ভালোবাসার বিয়েকে কিছুতেই তুষার মেনে নিতে পারেনি। তাই দশমীর দিন সবাই যখন ঠাকুর ভাসানের কাজে ব্যস্ত সেই সুযোগে তাকে শেষ করে দেওয়ার প্ল্যান। সারা গ্রাম খুঁজে তখন আর তুষারকে পাওয়া গেল না। লাশের কী গতি হবে তা পুলিশ এসে ঠিক করবে। গ্রামের মানুষ পুলিশের অপেক্ষা করতে লাগলো।
সেদিন আর সুজয় ভাণ্ডারীর বাড়িতে আমার খাওয়া-দাওয়া হলো না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। জলজ্যান্ত একটি আঠেরো বছরের মেয়ের বীভৎস মৃত্যু দেখে বাড়ি ফিরে এলাম। সারারাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। (চলবে)🍁

 

 

🍂ফিরেপড়া | কবিতা 

 

 

 

 

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী –র কবিতা 

তুমি দেখে নিয়ো

একে একে বানিয়ে তুলব সব, তুমি দেখে নিয়ো।
বাড়িঘর, খেতখামার,
উঠোনে লাউয়ের মাচা, জানলার পাশে
লতানে জুঁইয়ের ঝাড়–
একে একে সমস্ত বানাবো, তুমি
দেখে নিয়ো

দক্ষিণে পুকুর থাকলে ভাল হয়, তুমি বলেছিলে।
অবশ্য থাকবে।
পুকুরে হাঁসের স্নান দেখতে চাও, সে আর এমন
কী বেশী কথা,
সাদা ও বাদামী হাঁস ছেড়ে দেব।

যা চাও সমস্ত হবে,
একই সঙ্গে হয়ত হবে না, কিন্তু
একে-একে হবে।
ভালবাসা থাকলে সব হয়।

দেখো, সব হবে।
যা-কিছু বানানো যায়, আমি সব
দুই হাতে
দিনে-দিনে বানিয়ে তুলব, তুমি দেখে নিয়ো।

 

 

 

 

আলোক সরকার র কবিতা 

একদিন

একদিন আর কোনো দুঃখই পাবো না। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসে
দামি ইজিচেয়ারের ভিতরে নিজেকে সঁপে দিয়ে
বেয়ারার হাতে ঠাণ্ডা জল খাবো। একদিন অত্যন্ত কৌতুক বলে মনে হবে
এই সব- কবিতা, বিনিদ্র রাত্রি, শিল্পের গভীর গভীরতম মানে।
যেমন কুড়িবছরের প্রেম বহুদিন পরে ফিরে এসে
চুলের ভিতরে হাত রাখলেও শুধু মাত্র মমতা ঘনায়,
কোনো উত্তেজনা নয়, শিহরণ নয়, সেই রকম সহজ আঙুলে
একদিন প্রিয় কবিতার বই খুলে পড়বো। একদিন আর কোনো
দুঃখই পাবো না-অন্ধকারে একটি সবুজ পাতা ঝরে গিয়েছিলো ব’লে!

 

 

 

 

হুমায়ুন আহমেদ-র কবিতা 

আমি খুব অল্প কিছু চাই

আমাকে ভালবাসতে হবে না,
ভালবাসি বলতে হবে না
মাঝে মাঝে গভীর আবেগ
নিয়ে আমার ঠোঁট
দুটো ছুঁয়ে দিতে হবে না
কিংবা আমার জন্য রাত
জাগা পাখিও
হতে হবে না।
অন্য সবার মত আমার
সাথে রুটিন মেনে দেখা
করতে হবে না, কিংবা বিকেল বেলায় ফুচকাও
খেতে হবে না, এত
অসীম সংখ্যক “না”এর ভিড়ে
শুধু মাত্র একটা কাজ
করতে হবে আমি যখন
প্রতিদিন এক বার “ভালবাসি” বলব
তুমি প্রতিবার
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে একটু
খানি আদর মাখা
গলায় বলবে “পাগলি”।

 

 

 

 

নবারুণ ভট্টাচার্য –র কবিতা 

কিছু একটা পুড়ছে

কিছু একটা পুড়ছে
আড়ালে, বেরেতে, তোষকের তলায়, শ্মশানে
কিছু একটা পুড়েছেই
আমি ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি
বিড়ি ধরিয়েছে কেউ
কেউ উবু হয়ে ফুঁ দিচ্ছে উনুনে
কেউ চিতায় তুলে দিয়েছে
আন্ত্রিক রোগে মৃত শীর্ণতম শিশু
ওলট পালট খাচ্ছে জ্বলন্ত পাখি
কোথাও গ্যাসের সিলিণ্ডার ফেটেছে
কোথাও কয়লাখনিতে, বাজির কারখানায় আগুন
কিছু একটা পুড়ছে
চার কোনা ধরে গেছে
জ্বলন্ত মশারি নেমে আসছে ঘুমের মধ্যে
কিছু একটা পুড়ছে
ক্ষুধায় পুড়ছে নাড়ি, অন্ত্রেরা
ভালোবাসায় পুড়ছে যুবক
পুড়ছে কামনার শরীর, তুষ, মোবিলে ভেজানো তুলো
কিছু একটা পুড়ছেই
হল্‌কা এসে লাগছে আঁচের
ইমারত, মূল্যবোধ, টাঙানো বিশাল ছবি
প্রতিশ্রুতি, টেলিভিশন, দুপ্তপ্রাপ্য বই
কিছু একটা পুড়ছে
আমি হাতড়ে হাতড়ে দেখছি কী পুড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে
কী ছুঁয়ে হাতে ফোস্কা পড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে, গনগন করছে
চুপ করে পুড়ছে, মুখ বুজে পুড়ছে
ঝড় যদি ওঠে তাহলে কিন্তু দপ করে জ্বলে উঠবে
কিছু একটা পুড়ছে বলছি
দমকলের গাড়ি, নাভিকুণ্ডল, সূর্য
কিছু একটা পুড়ছে
প্রকাশ্যে, চোখের ওপর
মানুষের মধ্যে
স্বদেশ!

 

 

 

 

নবনীতা দেবসেন –র কবিতা 

পাণিগ্রহণ

কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে
এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।
শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত
স্বজন। এই হাত, এই নাও হাত।

এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতক্ষণ
কাছাকাছি আছো, অস্পৃষ্ট রেখো না।
ভয় করে, মনে হয়, এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়।

যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল,
যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী।

 

 

🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ১১

 

প্রকৃত শিক্ষকের কর্তব্য, বিদ্যার প্রতি ছাত্রকে আকৃষ্ট করা এবং উদ্বুদ্ধ করা। এ দায়িত্বটি তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন। প্রকৃত শিক্ষকের কাজ ছাত্রদের মনকে বৃহতের দিকে প্রবাহিত করা, তাদেরকে অমৃত মন্ত্রের স্বাদ দেয়া, সত্য ও সুন্দরের ধ্যানে তাদের উদ্বুদ্ধ করা, অজ্ঞানতা দূর করে সত্যের হিরন্ময় পাত্র তাদের সামনে উন্মোচিত করা। ছাত্র ছাত্রীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল সংযোজকের সম্পর্ক। তিনি ছাত্রদের গবেষণাকার্যে উৎসাহিত করেছেন প্রতিনিয়ত। নবীন গবেষকদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন।…
রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১১।

 

 

ভাষাবিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুল হাই

রেহানা বীথি 

 

 

 

 

পর্ব ১১

বিলেত থেকে ভাষাবিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা করে তিনি বাংলা ভাষার ভাষাতত্ত্ব নিয়ে কিছু কিছু প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এই প্রবন্ধগুলো তাঁর “সাহিত্য ও সংস্কৃতি” (১৯৫৪) এবং “তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা” (১৯৫৯) গ্রন্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবেই তিনি ভাষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর বই লেখার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পরে ১৯৬০ সাল থেকে তিনি তাঁর আলোচনা পুরোপুরি বাংলা ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্বের ওপর নিবদ্ধ রাখেন। এই সময় থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক মোট তিনটি গ্রন্থ বেরিয়েছে। এছাড়াও বহু প্রবন্ধ অমুদ্রিত অবস্থায় রয়েছে এবং পূর্ণশ্লোক রায় ও লীলা রায় সহযোগে ওয়াশিংটন থেকে ‘Bengali Language Hand Book’ (1966) প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ে তিনি ‘Dacca Dialect’ নামে একটি অধ্যায় লিখেছেন। তিনটি বইয়ের মধ্যে দুটি বই ইংরেজিতে এবং একটি বই বাংলা ভাষায়। “A Phonetic and Phonological Study of Nasals and Nasalization in Bengali” বইটি এই সিরিজের প্রথম বই(১৯৬০)। তারপর W.J. Ball-এর সঙ্গে ” The Sound Structure of English and Bengali” (1961) এবং সর্বশেষ বেরোয় “ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব” (১৯৬৪)। ভাষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত তাঁর প্রতিটি বই, কি ইংরেজি কি বাংলা পণ্ডিত সমাজের ভূয়সী প্রশংসায় ধন্য হয়েছে। জাপানের ধ্বনিতাত্ত্বিক সেইজো আওইয়াগি হাই সাহেবের ভক্ত ছিলেন। তিনি খুব ভালো বাংলা জানতেন। দু’জনের মধ্যে চিঠিপত্রেরও আদান প্রদান হতো। ধ্বনিবিজ্ঞান সংক্রান্ত বাংলা বইটি তাঁর এত ভালো লেগেছিল যে হাই সাহেবকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “বইটি অভিনব, ধ্বনিবিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্বের মূলতত্ত্ব চমৎকারভাবে রচনা করা হয়েছে বলে এই বই নিশ্চিতরূপে আমার কাছে এক অত্যাবশ্যক সারগ্রন্থ হিসেবে থাকবে।” (৪ মে ১৯৬৫)

হাই সাহেব নিজস্ব বিজ্ঞান চর্চার মধ্যেই মগ্ন থাকেননি। প্রকৃত শিক্ষকের কর্তব্য, বিদ্যার প্রতি ছাত্রকে আকৃষ্ট করা এবং উদ্বুদ্ধ করা। এ দায়িত্বটি তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন। প্রকৃত শিক্ষকের কাজ ছাত্রদের মনকে বৃহতের দিকে প্রবাহিত করা, তাদেরকে অমৃত মন্ত্রের স্বাদ দেয়া, সত্য ও সুন্দরের ধ্যানে তাদের উদ্বুদ্ধ করা, অজ্ঞানতা দূর করে সত্যের হিরন্ময় পাত্র তাদের সামনে উন্মোচিত করা। ছাত্র ছাত্রীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল সংযোজকের সম্পর্ক। তিনি ছাত্রদের গবেষণাকার্যে উৎসাহিত করেছেন প্রতিনিয়ত। নবীন গবেষকদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবনে মোট ২০টি গবেষণা কাজ পরিচালনা করেছিলেন তিনি। তারমধ্যে চার জনের ফলাফল জীবিতাবস্থায় দেখে গেছেন। তাঁরা হলেন…
নীলিমা ইব্রাহীম – ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক ও বাঙালী সমাজ (১৯৫৯)

আনিসুজ্জামান – ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালী মুসলমানের চিন্তাধারা(১৭৫৭-১৯১৮) [“মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য” নামে প্রকাশিত ১৯৬৪] – ১৯৬২

গোলাম সাকলায়েন- বাংলা মর্সীয়া সাহিত্য (১৯৬২)

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান – আধুনিক বাংলা কাব্য হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক (১৮৫৭- ১৯২০), ১৯৬৯।

এছাড়া আরও অনেকের গবেষণা নির্দেশক ছিলেন, আকস্মিক মৃত্যুতে তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি- পরে তাঁরা পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন।

তিনি শুধু গবেষণা কাজ ও গ্রন্থ রচনাতেই উৎসাহ দেননি, বই ছাপা না থাকলে গ্রন্থের পরিমার্জনা ও পুনঃপ্রকাশের জন্য অনেককে বার বার তাগাদা দিয়েছেন। সেই তাগাদার কথা তাঁর অবর্তমানে, বই প্রকাশ হওয়ার পর অনেকে স্মরণ করেছেন। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ড. কাজী আব্দুল মান্নান ‘ আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশকালে(১৯৬৯) তাঁর কথা স্মরণ করে বইয়ের শেষাংশে বলেছেন : “সর্বশেষে বেদনা ভারাক্রান্ত চিত্তে স্মরণ করি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম আব্দুল হাই সাহেবকে। পরিবর্তিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার জন্য তাঁর তাগাদা এবং উৎসাহের সীমা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে এই মহান শিক্ষকের আদেশ ও উপদেশ শিরোধার্য করেই আমি দ্বিতীয় সংস্করণের কাজে হাত দিয়েছিলাম। এই বই প্রকাশিত হয়েছে দেখলে বোধকরি তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।” (অক্টোবর ১৯৬৯)
এই জাতীয় আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মোটকথা সাহিত্যের গঠনশীল তাঁর নিজের যেমন ঔৎসুক্য ও নিষ্ঠা ছিল, তেমনি অপরের গবেষণাকার্যেও সমান উৎসাহ ছিল। তথ্য সংগ্রহের নির্দেশদানে ফাঁক বা ফাঁকি ছিল না কোনও।

তিনি নানাবিধ সাহিত্য সভায়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতি, প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। তাঁকে বাদ দিয়ে ঢাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হতো। তিনি দেশ- বিদেশের একাধিক সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হল:

১. বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য।
২. বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহক সমিতির (Executive Council) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যক্ষরূপে পদাধিকারবলে সদস্য।
৩. কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালন সভার (Governing Body) এবং কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য।
৪. কেন্দ্রীয় লেখক সংঘ(Central Write’s Guild) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য উক্ত সংস্থার কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য।
৫. ভারতবর্ষের Linguistic Society of India সংস্থার আজীবন সদস্য।
৬. ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেসন্স- এর উদ্যোগে বাংলা বিশ্বকোষ (Encyclopaedia) সম্পাদনায় উপদেষ্টা সমিতির (Advisory Commitee) সদস্য।
৭. পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য।

৮. District Gazetteer -র প্রণয়নে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
৯. আন্তর্জাতিক P.E.N. ক্লাবের সদস্য।
১০. লাহোরের Linguistic Research Group of Pakistan সংস্থার সদস্য।
১১. East Pakistan School Text Book Board -এর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
১২. পাকিস্তানের আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের( Inter University Board of Pakistan) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে প্রতিনিধিত্ব(১৯৬৬)।
১৩. দাউদ ও আদমজী সাহিত্য পুরস্কারের উপদেষ্টা সমিতির সদস্য।
১৪. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞান বিভাগের উন্নয়ন কমিটির সদস্য।
১৫. পদাধিকার বলে ঢাকা মিউজিয়াম কমিটির সদস্য।
১৬. Linguistic Society of America সংস্থার সদস্য।
আন্তর্জাতিক সম্মেলিত ও সেমিনারে তিনি বহুবার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কয়েকটির কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। যেমন :
১. লন্ডনে অনুষ্ঠিত (১৯৫২, ১-৬ সেপ্টেম্বর) International Congress of Linguistics এ অংশগ্রহণ।
২. ১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘International Seminar of the P.E.N. club’ – এ পাকিস্তান প্রতিনিধিরূপে যোগদা।
৩. নতুন দিল্লীতে ৫ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর নবম সাধারণ সম্মেলনে পাকিস্তানের সদস্যরূপে যোগদান।
৪. অক্টোবর ১৯৫৭ সালে আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত Autumn School of Linguistics- এ Faculty সদস্যরূপে যোগদান।
৫. মে ১৯৫৮ সালে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে Summer School of Linguistics এ যোগদা।
৬. জানুয়ারি ১৯৬৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ভাষাবিদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন।
৭. জুলাই ১৯৬৪ সালে সোয়াতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ।
৮. জুন ১৯৬৫ সালে মারীতে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সমালোচনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ।
৯. ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর ১৯৬৭ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত এশিয়া মহাদেশের ভাষাসমূহের আধুনিকীকরণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে (International Seminar of the Modernisation of Asian Language) পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধিরূপে যোগদান। (চলবে)

 

 

🍁অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়, সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনীলেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

🍁সম্পাদকীয় ঋণ : সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে, মহামিলনের কথা, ফিরেপড়া গল্প ও ফিরেপড়া কবিতা বিভাগের লেখাগুলি আন্তর্জাল থেকে সংকলিত।

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment