



সম্পাদকীয়
মনে হয়, আর কত দিন। আর কত রাত।
সময়ের সাথে সাথে ভেঙে পড়ে ছাত।
তিনি আমাদের একটুকরো ছাত ছিলেন। অভিভাবক। লিটিল ম্যাগের আবেগ দিয়ে তিনি ভালোবাসতেন সকলের সঙ্গে পথ চলতে। সকলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে যেতেন অনায়াসেই। কোন অহংকার তাঁর দেখিনি। নিজেকে কবি নয় বরং বাউল বলেই মনে করেছেন।
যদি এই ভাবে বলি
যে ভাবে চলে যায়, চলে যেতে হয়, বড্ড গোপনে। এই বুঝি সেই গোপন পথ। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এই পথের সন্ধান শুরু হয়ে যায়। ব্যথা আমাদের নিত্য সময়ের সঙ্গী। সুখ খুঁজতে খুঁজতে ব্যথাদেরই আদর করতে শিখে যায় ।
আসলে বাউল হতে গিয়ে কোথাও যেন আমরা ব্যথার। স্থানে পৌঁছে যায়। বাউল হতে পারিনা। কিন্তু তিনি হয়েছিলেন। ব্যথাদের টপকে যাবার বুঝি পোশাক তিনি নিয়ে নিতে শিখে ছিলেনেন। শরীরের আদ্যোপান্ত যত্ন সহকারে বিজ্ঞান আর সাহিত্যকে মিশিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কথায় ভাষায় লেখায় পরিধানে এমন কি পরিচয়েও। এমন মানুষ খুব কম দেখা যায়। মানে দেখিইনি। ভালোবাসার রঙে আঁকা একটা বাউল মন কবিতার মত শুভ্র । নিত্য নতুন শব্দ দিয়েই তিনি অনেক খেলা খেলেছেন…
আজ খেলা খেলতে খেলতে মায়ার জগৎ ত্যাগ করে দেহ রাখলেন। মন ও মনন রেখে দিলেন মানুষে মানুষে।
ভালোবাসতেন আপামর জনগণকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, ভালো থেকে খারাপ সব্বাইকে তিনি ভালোবাসতেন। যেমন রসিক ঠিক তেমনই সহজ। কঠিনতা কখনোই লক্ষ্য করা যায়নি। আসলেই তিনি নিজেকে বাউল বলেই চিনিয়ে রেখে গেলেন আপামর বাঙালির কাছে।
কবি বাউল আস্ত মানুষ ভালো থাকবেন ভালো থাকার দেশে।
এক দুই তিন করে ওই চলে যায়
ভালোবাসা এই আছে এই আর নাই। 🍁
🍂কবি অরুণকুমার চক্রবর্তী স্মরণ
তৈমুর খান
লালপাহাড়ির বৈরাগী
লালপাহাড়ির দেশে দেখা হয়েছিল
মহুয়ার মাতাল করা নেশায়
কত যে সুরের উচ্ছ্বাসে ভিজে ভিজে
ভেসেছিলাম সুরের প্লাবনে
বাউল আমাদের দীক্ষা দিয়েছিল
রাঙামাটির সেই পথে পথে
ঘরেও নয়, পারেও নয় অন্তরে অন্তরে
আমরা বৈরাগী হয়ে ঘুরেছিলাম জ্যোৎস্নায়
দেহে নয়, গৃহে নয় সমস্ত ভূমণ্ডলে
তোমার সেই ব্রহ্মময় আলোর সন্ধিধান
ফিরেছিলে সংগোপনে একাকী ভ্রমণে
জেনেছিলে এজীবন যেতে চায় ব্রহ্মজীবনে
লালপাহাড়ির দেশ শুধুই রূপক
রূপের আড়ালে সেই অরূপের গান
প্রতিটি জীবের অভিসারে আজও গীত হয়
তুমিও সাধক তাই নশ্বরের জগতে এত অভিমান!
দেবাশিস সাহা
ঋষিবাউল কবি অরুণকুমার চক্রবর্তী
বেমানান পৃথিবী থেকে অভিমান মেখে
লাল পাহাড়ের দেশে কেন চলে গেলে অরুণ দা
এই স্বার্থপর দেশে তুমি কি একা হয়ে গেছিলে
লজেন্সে ভালোবাসা মাখিয়ে এগিয়ে দিতে হাত
সেই হাত ধরবার মানুষ আজ বড্ড কম
বাউল জীবন ঋষিবেশ আখড়া জুড়ে নেশার বাস
তুমি, হ্যাঁ তুমিই বলার হিম্মত রাখো
নেশা আমার চাকর – বাকর
মহুয়া আজও দাঁড়িয়ে স্টেশনের পাশে
কে তাঁকে বলবে
‘ইখান তুকে মানাইছে না রে’
হঠাৎ করে চলে গেলে
এটা তুমি ঠিক কাজ করলে না অরুণদা…
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক
লাল পাহাড়ির কবি
চির নবীন লাল পাহাড়ির কবি
এদেশ ছেড়ে কোথায় তুই যাবি?
শিমুল পলাশ ডাকছে তোকে আয়
রাঙা পথে শুধু শিশির ঝরে যায়।
ওই দূরেতে ডাকছে নদীর ঢেউ
ঢেউয়ের সুরে অপেক্ষাতে কেউ।
সেই সুরেতে মূর্চ্ছনা যে দারুণ
আয় রে কবি, আয় রে আয় অরুণ।
রাঙা মাটি, শিমুল পলাশ ফুল
এই কবি তুই করিস না পথ ভুল।
চির নবীন লাল পাহাড়ির কবি
এদেশ ছেড়ে কোথায় তুই যাবি?
পরাণ মাঝি
অরুণালোক
হারিয়ে গেল
হারিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেল কবিতা বাউল
কোনো এক সোনালি সকালে সে দিয়েছিল মন খুলে ডাক
সে ডাক আজ ও বাতাসে ভাসে, কর্ণকুহর কাঁপায়
হেলে দুলে সারাদিন রাত আমরা কাটিয়েছি পংক্তি প্রসবার প্রসাদের সুবাসে
তারপর – লাল পাহাড়ির দেশে গল্পে গল্পে কখন যে পৌঁছে গেছি তা কেবল তুমি আর আমি জানি কবিয়াল
আর কে জানে বলো – সেদিনের সে কবিতা গানের হদিশ
বড় মন খারাপের দিন গো কবি ভাই
আজ অরুণদা থেকেও নাই
বাণীব্রত
অরুণ আলো
অরুণ আলো নিভে গেলো
রাতের আঁধারে,
লাল পাহাড়ির দেশে তুমি
চললে সব ফেলে।
স্মৃতি গুলো থাকলো পরে
আমাদের মনের মাঝে,
পরপারে ভালো থেকো
তোমার প্রিয় বাউল সাজে।।
স্বপন কুমার ধর
আনমনে
একটু স্পর্শ, মিষ্টি হাসি, আর-
আধফোঁটা মুখ নিঃসৃত শব্দগুলো,
বদলে দিয়েছিল আমাকে,
ভুলিয়ে দিয়েছিল, প্রিয়াহীনের
অদৃশৃ যন্ত্রণা, আবছা হচ্ছিল স্মৃতি।
ডেকে সে ছাড়াতো শয্যা,
হয়তো বলতে চাইত-
“ওঠো খেয়ে নাও”, “বেরোতে হবে”,
কর্ম জীবনের দৈনিক রুটিনে।
ভরসা যোগাত, আশ্বস্ত করত,
জীবনের প্রতি ক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেই, তার দর্শনে
দুর হত সমস্ত ক্লান্তি, চিন্তা,অবসন্নতা।
পাশে এসে বসে শোনাত,
সারাদিনের অভিযোগ,অনুযোগ, আর –
শেষে চলত তার মান-অভিমান,
ভাঙ্গানোর পালা, আদরের পালা।
এমনি করেই কাটছিল,আনন্দের দিনগুলি,
আর চলছিল অতীত বিয়োগ যন্ত্রণার উপর প্রলেপ।
হঠাৎ একদিন নিয়তির ডাকে অকালে,
সে ও, কন্যা ও চলে গেল,
আর আমি হয়ে পড়লাম, একা
সম্পূর্ণ একা,প্রকৃত একা, আর-
আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাদের
নিজেরই আনমনে, অজানা জগতে,
যদি একটিবার, অন্তত একটিবার,
স্ব-বিলীন এর আগে, কোথাও দেখা পাই!
বাদল বর্মন
প্রিয় বাউল কবি অরুণ চক্রবর্তী স্মরণে
হৃদয় গহনে নামটি তোমার আছে লেখা,
যুগে যুগে দিনে দিনে আবার হোক তোমার আমার দেখা ।
আমার প্রিয় বাউল সাধক জানাই তোমার চরণে, শতকোটি প্রণাম ও বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদনে।
বাংলা ভাষা কে করেছো সম্মান সমৃদ্ধি, মানব প্রেমে বেঁধে ছিলে বাউল কবিতা গানে,
প্রেমের জোয়ারে ভরিয়ে দিয়ে ছিলে মানব দরদী ও মরমী প্রাণে।
তোমার প্রয়াণে আজ আমার হৃদয় মরুভূমি মরীচিকা হয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে কাঁদে,
সাহিত্যের অঙ্গনে ,হৃদয়ের রঙ্গনে তোমার মহিমায় মহিমান্বিত রাধা যে রাঁধে ।
বাংলা সাহিত্যে অমোঘ সৃষ্টি এক সীমাহীন সমুদ্র রস: স্রোত, বিরাট অবদান ।
শিশুসুলভ আচরণে তোমার লেখনীর জাদু কাঠি ও মিষ্টি কন্ঠের মাধুর্যতা বাঙালী ফিরে পেয়েছে প্রাণ ।
বাংলার স্থল বাংলার জল বাংলার শস্য শ্যামল সবুজায়ন ।
অনবদ্য চিরাচরিত বাউল সাধক রূপে অলংকৃত করেছিলে বাংলার সিংহাসন ।
গৈরিক বেশে বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়া সহ এই নবান্নের দেশে ।
মায়া মমতা স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছো বিলিয়ে হেসে হেসে।
কখনো বাংলার মাঠ ঘাট কখনো বাংলার নদী নালা ।
প্রাণের সুখে পরমানন্দে প্রবাদে অবাধে সুধাতে তুমি বুকের জ্বালা ।
বাঙালী জাতির কাছে তুমি এক হিতৈষী হৃদয়, মহামানব, উদার মনের বাউল কবি।
তোমার প্রয়াণে,তোমার পরশে,হৃদয় হরষে, এ বুকে সঁপেছি তোমার ছবি ।
ওগো আমার প্রিয় বাউল সাধক অরুণ কবি!২!
মমতা রায় চৌধুরী
মনে পড়ছে বারবার
আজ কবি তোমায় পড়ছে মনে ভীষণভাবে
বিষাদ দেহে ভাসিয়ে তরি চলে গেলে অনেক দূরে
আমরা রইলাম অনাদরে অবহেলার পাত্ররূপে
কেমন করে ভুলি কবি তোমার ওই উদার বাউল মাখা আকাশটাকে
বৃষ্টি হয়ে ঝরে ছিলে
পলাশ শিমুল ফুল কুড়িয়ে
রাঙ্গামাটির লাল পাহাড়ির দেশে
উদাসী বাউল মন বিলিয়েছিলে
আজ শুধুই চোখের জলে ভাসছে হৃদয়
কথাগুলো সব হারিয়ে যাচ্ছে ওই লাল পাহাড়ীর মনের কাছে
বলেছিলে, ‘দূরত্ব কিছু নয়, শুধু দুইটি মনের মাঝে দাঁড়িয়ে পরে আকাশ’
আজ দেখছি আকাশটাকেও পারলে ছুঁতে, পারবো না আজ তোমায় ছুঁতে…
আমাদের চাহিদাগুলো আজ লম্বা হচ্ছে লম্বা হচ্ছে শুধুই তোমার পরশ পেতে।
ভালো থাকুন কবি না ফেরার ওই তারার দেশে
ওখান থেকেই পরশ মাখা হাতখানি রাখুন আমাদের মাথে।
সানি সরকার
কবির ঘর
কবির ঘরে সুগন্ধি উড়ছে
চারদিকে হাসির দুলুনি
কবি এখন চুপচাপ ডিভানের ওপর…
দেখছেন
নির্জনের ভেতর কী তোলপাড় বিষণ্ণ কলরব…
🍂গদ্য /২
সীমা সোম বিশ্বাস
কাকাবাবুর স্মরণে
(জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত আপনভোলা কবি অরুণ চক্রবর্তী’কে মনে রেখে)
‘জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কবি অরুণ চক্রবর্তী আজ আর আমাদের মধ্যে নেই’ এ কথাটা ভাবলেই বুকের পাঁজরে একটা ব্যথা বাজে !বেশ কিছু বছর ধরে সাহিত্যের অঙ্গনে তার সাথে ওঠা বসা। আমরা যারা তার সাথে সাহিত্য জীবনে কিছু না কিছু সময় কাটিয়েছি তারা অনেকেই জানি যে, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কৃতি ছাত্র অরুণ চক্রবর্তী শৈশব থেকেই কলম চাষি ছিলেন। এরকমই চলতে চলতে একদিন শ্রীরামপুর স্টেশনে মহুয়া গাছের গন্ধে বিভোর হয়ে তিনি যখন পাশেই গাছটিকে লক্ষ্য করেন তাঁর মনে হয়েছিল, এই গাছ ইট, কাঠ, পাথরের দেশে কেন? এই কাজ তো জঙ্গলমহলে থাকার কথা, এই গাছ তো লাল পাহাড়ি অঞ্চলে থাকার কথা। কবি নিজের মুখেই সে কথা বলেছেন। তার মনে হয়েছিল আদিবাসী মুখগুলোর কথা, লাল মাটির মানুষগুলোর সহজিয়া জীবন যাপনের কথা। এই ভাবনা থেকেই তার কলম থেকে উৎসাহিত হয়েছিল “লাল পাহাড়ির দেশে যা, হিতাক তুকে মানাইছে নারে…” ১৯৭২ লেখা এই কবিতাটি শ্রদ্ধেয় ভি বালসরার হাত ধরে গানে রূপ পায়। এরপর সুভাষ চক্রবর্তী গানটিতে সুরারোপ করেন এবং পরবর্তীকালে ‘বাংলা ব্যান্ড ভূমি’ এ গান গেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেন। ২০২১শে নভেম্বরে গানটির ৫০ বছর পূর্ণ হয়। যে-কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বলতে গেলে আবাল -বৃদ্ধ -বণিতা সকলের কণ্ঠে এই গানটি একবার বেজে ওঠে। ৫০ বছর পরেও এই গানটির জনপ্রিয়তা এক বিন্দুও কমেনি, বরং আরো আরো বেড়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, কবির সাথে মাটির টান ছিল, গাছেদের বন্ধন ছিল। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন,” …গাছের পিরিত ভগবানের দান
ও পিরিত পাইছে মোদের প্রাণ… পিরিত লিব পিরিত দিব ,মানুষ মরতে নাই দিব…”
এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। কবির মৃত্যু হয় না কখনো…! তার গাছের প্রতি টান, তার জঙ্গলমহলের প্রতি টান এতটাই আত্মার টান যে, শেষ মুহূর্তে কলকাতায় ‘জঙ্গলমহলের উৎসব’ থেকেই ফিরে না ফেরার দেশে গেছেন। এরকম এক জাতীয় স্তরের কবির সাথে আমার কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতি-
আজ এই মুহূর্তে কাকাবাবুর চলে যাওয়া সংবাদটি দেখলাম কিন্তু শেষ দেখা হলো না !যখন সবটা জানতে পারলাম তখন চুঁচুড়ায় তাঁর ‘সোনাঝুড়ি’-তে গিয়ে দেখার সময় ছিল না! শুধু মনে পড়ছে কিছু সম্পর্ক চিরকাল রয়ে যায়। হ্যাঁ, কাকাবাবুর সাথে সাহিত্যের আঙ্গিনা পেরিয়ে আমাদের সম্পর্ক যেন পরিবারের একজন হয়ে যাওয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে কতবার এসেছেন এবং আরও কতবার অন্য অনুষ্ঠানে আমি তার সাথে স্টেজ শেয়ার করেছি। দেখা হলেই, “ডান হাতটা বাড়িয়ে ঘাড়ের কাছে নিয়ে ভালো আছিস তো? বাড়ির সবাই ভালো? মা ভালো আছেন? দাদা ভালো আছেন?” খোঁজ নিতেন। কারণ আমাদের বাড়িতে এসেও কাকাবাবু সবার সাথে এক হয়ে গেছিলেন পরিবারের একজনের মতো। কিছু মধুর স্মৃতির ছবি আর কথা থেকে যাবে চিরকাল মনের কোণে। বেশ ক’য়েক বছর আগে আমাদের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে মঞ্চে তার গলার উত্তরীয় খুলে আমার মা-কে পরিয়ে দিতে দিতে বলেন, “মা তো মা! প্রণাম জানাই।” তারপরে আমার বাড়ির চলন্তিকার অনুষ্ঠানেও এসেছেন। দুপুরবেলায় একটু খাওয়া দাওয়ার পর কাকাবাবুকে বিশ্রাম নিতে বললাম। কাকাবাবু ঘরে শোয়ার সময় বললেন, তুই গুছিয়ে নে। পাঁচটার আগে আমাকে ডাকবি আমি ঠিক উঠে যাব। “চার ঘন্টার অনুষ্ঠান শুধু নয়, তারপরেও পরিবারের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ির বাচ্চাদের বই দিয়ে গেছিলেন। আর মাস চারেক আগে আমি আর বনি কাকাবাবুর সাথে, তাকে নিয়ে লেখা একটা বই দিয়ে গেছিলেন… এভাবে টুকরো টুকরো কত স্মৃতি না লুকিয়ে আছে কাকাবাবুর সাথে। আর চকলেট সে তো আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবার জন্যই ছিল কাকাবাবুর ঝোলা ভর্তি… সাহিত্য জগতে অনেক মানুষ দেখেছি সমালোচক নিন্দুক কিন্তু কাকাবাবুর মত মানুষ এখনো একটাও দেখিনি এতগুলো বছর আলাপ হয়েছে কখনো কারো নামে কোন সমালোচনা , নিন্দে করতেও আমি দেখিনি, আমি শুনিনি। এরকম এক মাটির, এরকম ভালো মানুষ অচিন দেশে নয়, লাল পাহাড়ির দেশে গিয়েই ভালো থাকুন কাকাবাবু, শান্তিতে থাকুন! আবারও কখনো কোনদিন যদি আমরা সাহিত্যের জগতে আসি যেন এরকম নির্ভেজাল কাকাবাবু হয়ে আপনার সাথে আবারও আলাপ হয়।
আভূমি প্রণাম জানাই। 🍁
🍂গদ্য
অবশেষে শেষ ঠিকানা, লাল পাহাড়ির দেশে পাড়ি দিলেন কবি…
হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কবির কখনও মৃত্যু হয় না, তাঁরা পৃথিবীতে আসেন, সৃষ্টি করেন এবং সেই সৃষ্টি একসময় অমরত্ব লাভ করে। কিন্তু সেদিন এই জাগতিক সংসারে তাঁকে আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
শ্রীরামপুরের একটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মহুয়া গাছের নিদারুণ কষ্ট একমাত্র কবিমন উপলদ্ধি করতে পেরেছিল সেদিন…! কতশত লোক দেখেছেন কিন্তু গাছের ও যে ব্যথা আছে এবং কিছু গাছ কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় থাকলে যেন বেশি রূপ খোলে… ঠিক যেমন সাঁঝের বেলা তুলসীপাতার প্রদীপ, যজ্ঞের ওম, মায়ের কোলে শিশু ঠিক একইভাবেই সমুদ্রের ধারে ঝাউ আর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জঙ্গলে ঠিক তেমনটি হল মহুয়া।
মহুয়ার এক অপূর্ব মাদকতা আছে। যেখানে শুধুমাত্র জঙ্গলের আদিবাসীদের যেন একচ্ছত্র আধিপত্য। মহুয়ার সঙ্গে মাদল, হাঁড়িয়া আর আদিবাসীর মেয়ে মরদের নিবিড় বন্ধন। সেইখানে একমাত্র মহুয়াকে মানায়। এ শুধুমাত্র কবিই অনুভব করতে পারেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার , শিবপুর থেকে পাস করে হিন্দুস্তান মোটরস এ চাকুরি। কিন্তু লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছিলেন বরাবরই। লোকসংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। হঠাৎ মন কেমন করে ওঠে ওই মহুয়া গাছটির জন্য।লিখে ফেলেছিলেন ” লাল পাহাড়ির দেশে যা….” । অরুণ বাবুর এই লেখায় সুরারোপ করেছিলেন বাঁকুড়ার ঝুমুর গানের স্রষ্টা সুভাষ চক্রবর্তী। তিনি ঝুমুর, টুসু, ভাদু গানের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন স্বভাবতই সে লেখা তাঁকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়।এই সুরে মিউজিক দিলেন ভি. বালসারা। অদ্ভুতভাবে সেই সুরের মাদকতা মহুয়ার নেশার মত ছড়িয়ে পড়েছিল।
তাঁর পোশাকের মধ্যেও যেন সহজিয়া সুর ভেসে উঠত… । ঘুরে বেড়াতেন জঙ্গলে, পাহাড়ে , সমুদ্রের কাছাকাছি… বন্ধুদের তালিকায় ছিলেন সহজিয়া মেঠো মানুষগুলো। ঝোলায় থাকত চকোলেট। হাত পাতলেই মিলত স্নেহ আর উপরি হিসাবে চকোলেট। তাঁর সঙ্গে আত্মার টান থেকেই লিখে ফেললাম এতখানি। না, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় শুধু ফেসবুকেই। আমার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের। আসলে সবকাজ যে নিয়মমাফিক করতে হবে এমনটা নয়। কিছু ভালো মানুষের জয়গান গাইতে ভালোই লাগে।
মহুয়ার জন্য যেমন জঙ্গল উপযুক্ত, লাল পাহাড়িই হল ওর সঠিক অবস্থান। ঠিক তেমনভাবে বলতে ইচ্ছে করছে এই প্রাণহীন শহুরে ইতিকথার রাজত্ব ছেড়ে আপনিও বোধহয় নিজের সঠিক বাসস্থান খুঁজে নিয়েছেন। ভালো থাকুন চিরশান্তির দেশে।🍂
🍁ধারাবাহিক উপন্যাস / পর্ব ৩
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই আজ পাঠদের জন্য পেশ করা হল তৃতীয় পর্ব।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
তিন.
গানের আসর
গাঁয়ে সত্যপীরের গানের আসর বসেছে। হিরণ বাদশার পালা। যিনি মূল গায়েন তিনি ঘাগরা জাতীয় এক ধরনের পোশাক পরেছেন। হাতে একটা ঘোড়ার বালাজির মতো বিরাট ঝাণ্ডা। কাহিনির সব কথাগুলো তিনি সুর করে বলছেন, আর একটি ধুয়ো ধরে নিচ্ছে তার সাকরেদরা। ঢোল তবলা আর হারমোনিয়াম সহযোগে গানের আয়োজন। একটা ফাঁকা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। হ্যাজাকের আলো জ্বালানো হয়েছে। চারিপাশে বসেছে দর্শক। নিঃসন্তান রাজা খুব মনের দুঃখে আছেন। কেননা তার কোনো উত্তরসূরী নেই। রানি বন্ধ্যা। সন্তানের জন্য একে একে তিনটি বিয়ে করেছেন, কিন্তু কারোর পেটেই সন্তান আসেনি। একদিন এক দরবেশ ফকির এসে দরজায় উপস্থিত হলো।
—রাজা, তোর মনের দুঃখ আমি জানি। সেই দুঃখ দূর করার জন্যই আজ আমি তোর কাছে এসেছি।
—কে তুমি? কোথা থেকে আসছো?
—আমি এক দরবেশ। আমি বহু দূরে এক জঙ্গলে থাকি।
—কেন এসেছ বল, কী তোমার উদ্দেশ্য?
—তোর মনে কোনো সুখ নেই, বারো বছর কেটে গেল তবু তুই সন্তানহীন। একে একে তিন রানি, কিন্তু কেউ তারা তোকে সন্তান দিতে পারেনি। আমি সব জানি রাজা!
—তুমি পারবে আমাকে সন্তান দিতে? পারবে দরবেশ আমাকে সন্তান দিতে?
—পারবো বলেই তো এসেছি রাজা, অত ব্যাকুল হচ্ছিস কেন? শুধু একটা শর্ত আছে!
—কী সেই শর্ত দরবেশ? সন্তানের বদলে তুমি যা চাইবে আমি হাসিমুখে তাই দিতে প্রস্তুত! বলো দরবেশ, বলো!
—শোন তবে বলি, তোর ছোট রানির সন্তান হবে, একমাত্র সে-ই মা হতে পারবে। আমি যে জরিবুটি তোকে দিয়ে যাব সেইটি শুক্রবার গোসল করে পবিত্র অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে খেতে হবে। কিন্তু সন্তান হলে এই শর্তটি পালন করতে হবে!
—বলো দরবেশ, কী সেই শর্ত!আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব এই আমার প্রতিজ্ঞা।
—সন্তানের বারো বছর বয়স হলে তাকে আমার সঙ্গে বনবাসে দিতে হবে। বারো বছর সে আমার সঙ্গে ফকিরি শিখবে। তারপর সে যদি ফিরে আসতে চায় তাহলে আসতে পারে।
—এই শর্ত দরবেশ! অবশ্যই আমি পালন করব। সন্তান বারো বছর হলে অবশ্যই তাকে আমি ছেড়ে দেবো তোমার সাথে।
মূল গায়েনের সঙ্গে একজন সাকরেদ এই নাটকীয় কথোপকথন করলেন।তারপর শুরু হলো গানের ধুয়ো—
“আই দেখে যা রাজার বাড়ি
চাঁদ এসে খায় গড়াগড়ি”
অর্থাৎ সন্তান হওয়ার সাংবাদে সারা রাজ্যে আনন্দের হিল্লোল লাগলো। যথাসময়ে দরবেশের দেওয়া জরিবুটি সেবন করে ছোট রানি গর্ভবতী হলেন। তিন মাস গর্ভাবস্থা থেকেই নানা রকম অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। গর্ভাবস্থায় শিশুর মঙ্গল কামনায় প্রচলিত নানা সংস্কারের এবং ক্রিয়াকর্মের বর্ণনা দিতে লাগলেন মূল গায়েন। সাত মাসে পড়লে ষোড়শোপাচারে সাধভক্ষণেরও ছন্দোবদ্ধ চমৎকার বর্ণনাও দিলেন।তাদের বর্ণনার কিছুটা অংশ এইরকম:
প্রথম দু মাসেতে হয় কানাকানি
তৃতীয় মাসেতে হয় জানাজানি।
চতুর্থ মাসেতে গর্ভ ধীরে ধীরে বাড়ে
পঞ্চম মাসেতে স্পষ্ট সবাই বুঝতে পারে।
ষষ্ঠ মাসে কন্যার পা হয় ভারী
সপ্তম মাসেতে সাধ খেতে চায় নারী।
অষ্টম মাসেতে তার চলতে হয় ভয়
নবম মাসেতে কন্যা বিশ্রামে রয়।
এইরূপে দশ মাস হয় দশ দিন
আঁতুড় ঘরেতে ধাইমার কাটে সারাদিন।
গায়েন এবং দোহারীর বাজনার বোলের সঙ্গে অপূর্ব নাচের মেলবন্ধনে গান জমে ওঠে। বারো-তেরো বছরের বালকেরও ঘুম ছুটে যায়। নারী-পুরুষ সবাই তাকিয়ে থাকে কাহিনির পরিণতি দিকে। রাজপুত্রের জন্ম, শিক্ষা, শিকার করা সবকিছুই চলতে থাকে। এভাবেই কখন চলে আসে বারো বছর। বাড়ির লোকেরা পূর্বের দেওয়া শর্ত ভুলে যায়। এদিকে দরবেশও এসে উপস্থিত হয়। দরবেশ এসে দরজায় দাঁড়িয়ে আহ্বান করে:
—ভুলে গিয়েছিস আমার কথা? আজ বালকের বারো বছর পূর্ণ হয়ে গেল। আজ আমার সঙ্গে তাকে পাঠানোর পালা। এসো বালক!
—ভুলে গিয়েছি দরবেশ, আমরা কী নিয়ে থাকবো তবে?
—তা জানি না, কাঁদলেও আমি শুনবো না,যা কথা দিয়েছিস তা রাখতে হবে।
—তবে দাঁড়াও দরবেশ, আজই বালকের বিয়ে দিব। জানবো আমাদের বউ আছে, তখন ঠিক একদিন বালক ফিরে আসবে।
—কিন্তু আমার সময় নেই। তিন ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে!
রাজা দ্রুত তার পাশের রাজ্যের রাজাকে রাজপুত্রের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন আর সব কথা খুলে বললেন। রাজা রাজি হলেন। গায়েন তখন গাইলেন—
বেছে বেছে তোলো মালি
লাল গোলাপের ফুল
বাগান যেন না হয় খালি….
তিন ঘণ্টার মধ্যেই তাদের বিয়ে হয়ে গেল। ঘোড়ায় চড়ে রাজকন্যা-রাজকুমার ফিরে এলো ঘরে। কিন্তু তাদের বাসর হলো না। চোখের জলে বিদায় হলো স্বামীর। নতুন বউ খুব কান্নাকাটি করে বলল: আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো বারো বছর। আমি বাইরে কোথাও মুখ দেখাবো না।
সেই রাজকুমারের নামই হিরণ বাদশা।
দরবেশের সঙ্গে জঙ্গলের কুঁড়েঘরে বহু কষ্টে তার দিন কাটতে লাগলো। পাতার বিছানায় ঘুমালো, গাছের ফলমূল খেলো, কখনো কখনো ভিক্ষেও করতে হলো। সেই সঙ্গে পেতে লাগলো ফকিরি শিক্ষা। অলৌকিক কিছু ক্ষমতারও অধিকারী হলো। ছয় বছর কেটে যাবার পর তখন সে ভরপুর যুবক। তার সদ্য বিবাহিতা ছেড়ে আসা বউ এর কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। একদিন দরবেশকে বলল:
—আজ আমাকে একবার যেতে দাও, শুধু আমার বউকে দেখা করে আসবো, দেরি করবো না।
—কিন্তু কেউ যদি দেখতে পায় তোমার যাওয়া, তাহলে এত দিনের পাওয়া বিদ্যা তুমি সব ভুলে যাবে।
—কেউ দেখতে পাবে না, কেউ জানতেও পারবে না। আমি গভীর রাতে যাব।
বহু কষ্টে দরবেশকে রাজি করে একটি উড়ন্ত চাদরে চেপে সে গভীর রাতে রাজকুমারীর ঘরের দরজায় এসো উপস্থিত হলো। রাজকুমারী কিছুতেই দরজা খোলে না। অবশেষে তার দেওয়া একটি আংটি সে দরজার ফাঁক দিয়ে রাজকুমারীর কাছে পাঠায়। সেটিই ছিল তাদের বিবাহের চিহ্ন। রাজকুমারী দেখে চিনতে পারে এবং দরজা খুলে দেয়। রাজকুমার রাজকুমারী সঙ্গে মিলিত হয়। কিছুক্ষণের অতিথি মাত্র সে। তাই আবারও চোখের জলে বিদায় নিয়ে এই অলৌকিক চাদরে চেপে চলে আসে তার পূর্বের ঠিকানায়। এদিকে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাজকুমারী একটি ফুটফুটে সন্তানের জন্ম দেয়। রাজকুমারীর পেটে সন্তান! কেমন করে সম্ভব? রাজকুমার তো বনবাসে? রাজকুমারীকে বারবার জেরা করেও কার জন্মানো সন্তান বলাতে পারে না। কারণ রাজকুমার যে এসেছিল তা বলতে বারণ। সুতরাং চারিদিকে এই কলঙ্ক রটে যায়। রাজা নিজের পুত্রবধূ হলেও তাকে ক্ষমা করে না। কোলের সন্তানসহ শাস্তি স্বরূপ তাকে বনবাসে পাঠানো হয়। কাঁদতে কাঁদতে কোলের সন্তান নিয়ে এক কাঠুরিয়ার আশ্রয়ে রাজকুমারী দিন কাটতে থাকে। এদিকে সন্তানও বড় হয়। এভাবেই ছয় বছর অতিক্রান্ত হলে একদিন দেখা হয়ে যায় তার স্বামী হিরণ বাদশার সঙ্গে। রাজকন্যা তাকে সব কথা খুলে বলে। এদিকে তারও সময়সীমা শেষ হয়ে আসে । তখন দুজনেই একসঙ্গে ফিরে আসে রাজসভায়। সব ভুল ভাঙিয়ে দেয় মানুষের এবং সুখে রাজত্ব করতে লাগে।
এই অপূর্ব ছন্দোবদ্ধ কাহিনি সুরে নাচে নাটকীয় ভঙ্গিতে তখন পরিবেশিত হচ্ছে। মনের মধ্যে একটা শিহরন খেলে যাচ্ছে। এ পাড়ায় সত্যপীর তো ও পাড়ায় মা মনসার গান। সপ্তডিঙ্গা মধুকর ডুবে গেলেও চাঁদ সওদাগর কিছুতেই পুজো করবেন না। এদিকে সনকার কান্নায় গোটা রাজ্যের লোক কাঁদছেন। বেহুলা কলার ভেলায় লাশ নিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছেন কৈলাসে। তারপর শিবের বর নিয়ে সবাইকে জীবিত করে রাজ্যে ফিরছেন। সেই আসরেও বাবার সঙ্গে সারারাত বসে আছি। কখন বেহুলা ফিরবে তারই প্রতীক্ষা করছি। লোহার বাসর ঘরে কেনই বা বিশ্বকর্মা একটা ফুটো রেখে গেলেন? মনের মধ্যে বারবার প্রশ্ন জাগছে।
সেই শিশুবেলায় বাবার ঘাড়ে চেপে তখন একবার গিয়েছিলাম লক্ষ্মীনারায়ণপুর চারণ কবি গুমানি দেওয়ানের কবিগান শুনতে। সারারাত ধরে কবিগান। সুরের লহরী বহুদূর ছড়িয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পাকা গোঁফওয়ালা দীর্ঘ দেহী মানুষটি একটা পা চেয়ারে রেখে (একটা পা খোঁড়া ছিল বলে) এক পা মাটিতে নামিয়ে নেচে নেচে বলে চলেছেন—
গান করিতে এলাম আমি লক্ষ্মীনারায়ণপুর
চারিদিকে দেখছি রে ভাই বাঁদরে ভরপুর।
মানুষ কোথায় থাকেরে ভাই,মানুষ কোথায় আছে?
বাঁদরগুলি দেখছি সব চেপে বসেছে গাছে।
নিচে আছে ওপরে আছে কত বাঁদর ভাই
বাঁদরগুলি দেখতে আবার মানুষের মতো হয়।
এরকমই গান গাইতে গাইতেই একটা হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল। যেহেতু টিকিট কেটে গান, যেহেতু অনেকেই ভালো টাকা পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে চেয়ারে বসে গান শুনছেন। যারা টিকিট কাটতে পারেননি, তারা গাছে উঠে ডালে বসে গান শুনছেন। কবিয়াল গুমানি তাদের সবাইকেই বাঁদর বলে সম্মোধন করলেন। বাঁদরেরা সাধারণত গাছের ডালে বা উঁচু জায়গায় বসে। এখানে গাছ ও চেয়ার দুটোই উঁচু এবং দুটোই কাঠ। তাই তারা ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। কবিগানের মাঝখানেই গোলমাল বাধিয়ে দিলেন। পরে কবিয়াল নিজেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, তখন সবাই শান্ত হলেন। সেদিন বাবার ঘাড়ে চেপেই বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাদের কথাই জানতে চাইছিলাম।
—বাবা, কবিয়াল কী করে হয়?
—অনেক বই পড়ে। সব শাস্ত্র পড়তে হয়।
—আর সত্যপীরের গান করে যে, সে কোথা থেকে পায় এত গল্প?
—ওই যে সব পুরনো কেতাব, আমাদের বাড়িতেও আছে কয়েকটা।
—আর ওই মনসামঙ্গল এর গান কোথা থেকে শেখে?
—মনসামঙ্গলেরও বই আছে। ও পাড়ার প্রবোধ ব্যানার্জি দাদার কাছে আছে।
—আমি আরেকটু বড় হলে দেখবে সব বইগুলো কিনে আনবো। তারপর পড়ে পড়ে দেখব।
আমাদের গ্রাম থেকে লক্ষ্মীনারায়ণপুর অনেকটা দূর। রাস্তার মাঝখানে ব্রহ্মাণী নদী। বাবার ঘাড়ে চেপে আসতে আসতেই অনেকটা বেলা উঠে গেছে। গুমানি দেওয়ানের মুখখানা চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে নদীতে বালি খুঁড়ে বাবা জল পান করতে লাগলো। আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম একটা পানকৌড়ি কিভাবে ডুব মেরে মেরে একটা করে মাছ গিলে খাচ্ছে। (চলবে)
ছবি : ডালিয়া চক্রবর্তী, সোমা বিশ্বাস ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
