Sasraya News

Wednesday, April 23, 2025

Ram Mohammad Singh Azad : রাম মহম্মদ সিং আজাদ

Listen

🍁প্রবন্ধ 
সাঁজোয়া সেই যানে সৈন্যরা প্রবল পাহারায় ব্যস্ত। যাতে কেউ বাইরে বের হতে না পারে। জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ার, ভিড়কে ছত্রভঙ্গ হওয়ার জন্য সতর্ক না করেই, মূল পথ অবরুদ্ধ করেন। তিনি সৈন্যদের সরু পথের সামনে ভিড়ের ঘন অংশের দিকে গুলি চালনার নির্দেশ দেন। আতঙ্কিত জনতা বাগ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টাকরে। লিখলেন : অমিয় আদক 

 

তেরোই মার্চ ঊনিশশো ঊনচল্লিশ। বই হাতে আজাদ (Ram Mohammad Singh Azad) প্রবেশ করেন ক্যাক্সটন সভাগৃহে। বসার আসন পান সুবিধামত। মাইকেল ও’ডায়ারের বক্তৃতা চলতে থাকে। তাঁর বক্তব্যের ধন্যবাদ সূচক বাক্যটি শেষ হওয়ার সাথেই আজাদের রিভলবার পরপর দু’বার গর্জে ওঠে। বুলেট দু’টির একটি ডায়ারের হৃৎপিণ্ড এবং ডান ফুসফুস ভেদকরে বেরিয়ে যায়। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন। তাঁর নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় গুলিতে আহত স্যার লুই ডেন, লরেন্স ডান্ডাস, জেটল্যান্ডের দ্বিতীয় মার্কেস, চার্লস কোচরান-বেলি, দ্বিতীয় ব্যারন ল্যামিংটন। গুলি করার অব্যবহিত পরই আজাদ গ্রেফতার। পয়লা এপ্রিল ঊনিশশো চল্লিশ। তিনি ডায়ার হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। তাঁর অবরুদ্ধ অবস্থান ব্রিক্সটন কারাগার। সেখানে তাঁর পরিচয় “রাম মোহাম্মদ সিং আজাদ”। নামের প্রথম তিনটি শব্দ পাঞ্জাবের তিনটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় (হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ) প্রতিফলিত। শেষ শব্দ “আজাদ”। আক্ষরিক অর্থে “মুক্ত”। শেষের শব্দে তাঁর ব্রিটিশরাজ বিরোধী মনোভাব প্রকটিত।
বিচারের প্রতিবাদে আজাদের চলে টানা বিয়াল্লিশ দিন অনশন। কারাগার কর্তৃপক্ষ জোরকরে তাঁর অনশন ভঙ্গকরে ঊনিশশো চল্লিশ সালের চৌঠা জুন। সেই দিনেই তাঁর বিচার শুরু। বিচারালয় সেন্ট্রাল ক্রিমিনাল কোর্ট ওল্ড বেইলি। বিচারপতি অ্যাটকিনসন। আজাদের প্রতিনিধিত্ব করেন ভি. কে. কৃষ্ণমেনন ও সেন্ট জন হাচিনসন। জি.বি. ম্যাকক্লুর প্রসিকিউটিং ব্যারিস্টার। তাঁর অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জিজ্ঞাসার উত্তরে আজাদ বলেন, ‘আমি এটা করেছি, কারণ তাঁর প্রতি আমার ক্ষোভ ছিল। এই মৃত্যু তাঁর প্রাপ্য। তিনিই প্রকৃত অপরাধী। আমার অনেক দেশবাসীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। তাই আমি তাঁকে মৃত্যুই দিয়েছি। একুশ বছর ধরে আমি প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি খুশি। আমি কাজটি করেছি। আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা। দেশের জন্য মরছি। আমি প্রতিবাদ করেছি। এটা আমার কর্তব্য।’
তারপরেও আত্মপক্ষ সমর্থনে এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক জ্বালাময়ী ভাষণ চলে। ভাষণ চলাকালে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হলেও ব্রিটিশ বিরোধী বক্তৃতা চলতেই থাকে। বিচারে আজাদ মাইকেল ও’ডায়ার হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত। ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত। বিচারক আসামীর বক্তব্যকে প্রকাশ্যে প্রকাশিত না করার নির্দেশ দেন। সেই ঘোষণার পর তিনি বিচারকের টেবিলের দিকে ঘৃণা সূচক থুতু নিক্ষেপ করেন। কারারক্ষীরা তাঁকে জোরকরে বিচার কক্ষের বাইরে আনেন। তারপর কারাগারে নিয়ে যান।
ফাঁসির ধার্য্য তারিখ একত্রিশে জুলাই, ঊনিশশো চল্লিশ। ফাঁসির দড়িকে চুমু দিয়ে আজাদ বলেন, ‘আমি গর্বিত, আমি দেশের মানুষের আত্মার শান্তিদানের জন্য আত্মবলি দিচ্ছি।’ ফাঁসুড়ে আলবার্ট পিয়ের পয়েন্ট পেন্টনভিল আজাদকে ফাঁসিতে ঝোলান। তাঁর পিতৃদত্ত নাম কিন্তু রাম মহম্মদ সিং আজাদ নয়।

অবিভক্ত ভারত। পশ্চিম ভারতের অন্যতম শহর লাহোর। লাহোর থেকে একশো ত্রিশ কিমি দক্ষিণের অখ্যাত গ্রাম পিলবাদ। সেই গ্রামের বাসিন্দা তেহাল সিং। তিনি পেশায় নিম্নদক্ষ স্বল্প বেতনের দিন মজুর। তাঁর স্ত্রী নারাইন কৌর। তাঁদের কনিষ্ঠ পুত্র। নাম শের সিং। তার জন্মসাল আঠারোশো নিরানব্বই। তারিখ ছাব্বিশে ডিসেম্বর। শের সিংএর জন্ম সময়ে তার দাদা সাধু সিং মাত্র দু’বছরের। সেই শের সিং মাত্র তিন বছর। তাদের মা নারাইন কৌর অন্যভুবনে পাড়ি দেন। দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে কঠিন সমস্যায় পড়েন তেহাল শিং। তেহাল শিং তখন নিলোয়াল গ্রামে পাঞ্জাব ক্যানাল খননের কাজে। বাধ্য হয়েই শিশুপুত্রদের আনেন সেখানে মজুরদের কলোনিতে। সেখানেই দুই বালক ক্যানেলের কাদায় খেলে। দিনশেষে বাবা হাতপুড়িয়ে রান্না করেন। সারা দিনের উপোসী তিনজন এক সাথেই খান। সেখানের চাকরিও তেহাল সিংএর বরাতে সয়নি। অল্প কিছুদিনের বেকারত্ব। তারপর রেলের পয়েন্টম্যানের চাকরি জোটে। আসেন উপালি গ্রামের রেলস্টেশনে। সেখানেই সুখে দুখে কাটে প্রায় চার বছর।

ঊনিশশো সাত সালের অক্টোবর মাস। তখন শের সিংএর বয়স আট ছুঁইছুঁই। তাদের বাবা দুইভাইকে নিয়ে হাঁটা পথে বেরিয়ে পড়েন। গন্তব্য অমৃতসর। পথে রামবাগ হাসপাতালের অদূরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। রামবাগ হাসপাতালেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাদের কাকার উপর দুই ভাইয়ের দায়িত্ব চাপায় হাসপাতাল। অনাথ দুই ভাইকে সাময়িক আশ্রয় দেন কাকা। কিছুদিন পর তিনিও নিজেকে দুই ভাতিজার দায়িত্ব পালনে অক্ষম ভাবেন। অনাথ দুই ভাই সাধু সিং এবং শের সিংএর ঠিকানা পাল্টায়। তাদের আশ্রয় জোটে অমৃতসরের সেন্ট্রাল খালসার এতিম খানায়।
এতিম খানার নিয়ম অনুসারে তাদের দীক্ষার ব্যবস্থা। এতিম খানার রেজিস্টারে উল্লেখিত তারিখ আটাশে অক্টোবর ঊনিশশো সাত। দীক্ষান্তে নতুন নামকরণ। বড়োভাই সাধু সিংএর পরিবর্তিত নাম মুক্তা। ছোটভাই শের সিংএর নতুন নাম উধম। মুক্তা শব্দের অর্থ ‘যে পুনরুত্থান থেকে পলাতক’ বা ‘মুক্ত’। উধম শব্দের ‘উত্থান’। এতিম খানায় তার স্নেহমাখা নাম ‘উদে’। সেই সম্বোধনকে বালক কখনই তাচ্ছিল্য ভাবেনা। লেখাপড়া, এতিম খানার কিছু হাতেরকাজ ইত্যাদির মধ্যেই কখন গড়িয়ে যায় সাড়ে আট বছর। দুই কিশোর খেয়াল করতেই পারেনা।

সালটা ঊনিশশো সতেরো। পারিবারিক সম্পর্কের একমাত্র জীবিত বাঁধন দাদা মুক্তা। মুক্তাও এক অজানা রোগে আকস্মিক ভাবে মাটির মায়া ছাড়েন।  তখন উধম সিং পারিবারিক সম্পর্কশূন্য এক পরিপূর্ণ কিশোর। সাময়িক মানসিক ভাবে ভেঙেপড়ে উধম। অল্পকালের মধ্যেই বন্ধুদের চেষ্টায় মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল।

উধমের বয়স তখন সেনাবাহিনীতে প্রবেশের সর্বনিম্ন বয়সেরও কম। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য সেনা অফিসারকে অনুরোধ করেন উধম। অনুরোধের পর সেনাবাহিনীতে সাধারণ মজুর হিসাবে যোগদানের অনুমতি মেলে। সেই চাকরিও ভালো লাগেনা। কয়েক মাস পরেই চাকরি ছাড়েন।
আরব সাগরের উপকূল থেকে বসরা পর্যন্ত মাঠ-রেলপথ পুনরুদ্ধারের কাজ। সেই কাজে যোগদেন দ্বাত্রিংশ শিখ অগ্রগামীদের দলে। সেখানেও সর্বনিম্ন পদ মর্য্যাদার শ্রমিক। কর্তৃত্বের সাথে দ্বন্দ্ব। ছ’মাসের মধ্যেই অমৃতসর ফিরে আসেন। ঊনিশশো আঠেরো সালে আবার সেনাবাহিনীতে। সেনাবাহিনীর কাজে তাঁর প্রথম গন্তব্য বসরা। সেখান থেকে বাগদাদ। কাঠমিস্ত্রি হিসাবে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, যানবাহনের সাধারণ রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এক বছর কাটে দুই কর্মস্থলে। ঊনিশশো ঊনিশ সালে ফিরে আসেন অমৃতসরের এতিমখানায়। তাঁর পুরানো আশ্রয়ে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের দ্বারা পাঞ্জাবে রেল, টেলিগ্রাফ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত। সেই কারণে পাঞ্জাবের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি। ঊনিশশো ঊনিশ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের আগেই একটি আন্দোলনের আভাস পায় ব্রিটিশ প্রশাসন। পাঞ্জাবের ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট-গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার একটা সংগঠিত বিপ্লবের আভাস অনুমান করেন।

ঊনিশশো ঊনিশ সালের দশই এপ্রিল একটি বিক্ষোভ প্রদর্শিত অমৃতসরে। ডেপুটি কমিশনার মাইলস আরভিংয়ের বাসভবন ঘিরে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই জনপ্রিয় নেতা সত্য পাল এবং সৈফুদ্দিন কিচলুর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ। তাঁরা দু’জনেই গান্ধীজির নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রবক্তা। একটি সামরিক পিকেট জনতার ভিড়ের উপর গুলি চালায়। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। বেশ কয়েকটি সহিংস ঘটনা ঘটায়। তারই প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা ব্রিটিশ ব্যাংকে আগুন লাগায়। কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিককে হত্যা করে। দু’জন ব্রিটিশ মহিলা লাঞ্ছিত। মার্সেলা শেরউড, একজন বয়স্কা ইংরেজ মহিলা ধর্মপ্রচারক। তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ছশো ভারতীয় শিশু। তাদের নিরাপত্তার তাগিদেই তিনি স্কুল বন্ধকরেন। সেই বাচ্চাদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য পথে নামেন। সেদিন এগারোই এপ্রিল। একটি সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি জনতার হাতে ধরাপড়েন। জনতা তাঁকে না জেনে সাধারন ইংরেজ মহিলা ভেবেই আক্রমণ করে। তাঁকে কিছু স্থানীয় মানুষ উদ্ধার করেন।

বারোই এপ্রিল অমৃতসর শহর শান্ত। পাঞ্জাবের অন্যান্য অংশে সহিংসতা অব্যাহত। রেললাইন কাটাপড়ে। টেলিগ্রাফ পোস্ট উৎপাটিত। সরকারি ভবনে আগুন লাগায় বিপ্লবীরা। তিনজন ইউরোপীয়কে হত্যাকরে। তেরোই এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার পাঞ্জাবের বেশিরভাগ অংশ সামরিক আইনের অধীনে রাখে। আইনটি সমাবেশের স্বাধীনতা সহ বেশ কিছু নাগরিক স্বাধীনতাকে সীমিত করে। চারজনের বেশি লোকের জমায়েত নিষিদ্ধ।

সেদিন সন্ধ্যায়, অমৃতসরের হরতাল নেতৃবৃন্দের হিন্দু কলেজ ধব খতিকানে একটি সভা। সভায়, সইফুদ্দিন কিচলুর একজন সহযোগী, হান্স রাজের ঘোষণা, ‘পরের দিন বৈকাল সাড়ে চারটায় জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি প্রকাশ্য প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই সমাবেশের দায়িত্বে থাকবেন মুহাম্মদ বশির। সভাপতিত্ব করবেন কংগ্রেস পার্টির একজন প্রবীণ ও সম্মানিত নেতা কানহ্যালাল ভাটিয়া।’ তেরোই এপ্রিল ঊনিশশো ঊনিশ সকাল ন’টা। সকাল ন’টায়, ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী উৎসব। জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ার, অমৃতসরের ভারপ্রাপ্ত সামরিক কমান্ডার। শহরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে শহরের মধ্য দিয়ে আগিয়ে আসেন। অমৃতসর প্রবেশের জন্য একটি ‘পাস ব্যবস্থা’ ঘোষণা করেন। সেইদিন রাত আটটায় কারফিউ বিষয়েও ঘোষণা করেন। একত্র সমাবেশ, সর্বপ্রকার মিছিল নিষিদ্ধ করেন। ঘোষণাটি ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি এবং পাঞ্জাবিতে জানানো হয়। উৎসবের মেজাজে থাকায় খুব কম লোকই এই ঘোষণায় মনোযোগ দেন। ইতিমধ্যে, স্থানীয় পুলিশ ভিড়ের মধ্যে ঘুরে জালিয়ানওয়ালাবাগে পরিকল্পিত প্রতিবাদের আঁচ পায়। বিক্ষোভ সমাবেশ কিভাবে বানচাল করাযায় সেই পরিকল্পনায় ও’ডায়ার ব্যস্ত।

তেরই এপ্রিলের মধ্য বিকেল। কয়েক হাজার ভারতীয় অমৃতসরের হরমিন্দর সাহিবের কাছে জালিয়ানওয়ালাবাগে (বাগান) সমবেত। উপস্থিত অনেকেই আগে স্বর্ণমন্দিরে উপাসনা সেরেছেন। বাড়ি ফেরার পথে প্রবিষ্ট শান্তিপূর্ন সমাবেশে। জালিয়ানয়ালাবাগ ছয় একর একটি খোলা এলাকা। ঈষৎ আয়তাকার। দশ ফুট উচ্চতার প্রাচীর বেষ্টিত। পাঁচটি সরু প্রবেশদ্বার থাকলেও প্রধান পথের দিকের প্রবেশদ্বার সাধারণত খোলা থাকে। বাকিরা তালাবন্ধ। বছরের বেশিরভাগ সময় এটি স্থানীয় সভা এবং বিনোদনের ক্ষেত্র হিসাবেই ব্যবহৃত। এখানে আছে একটি বিশ ফুট ব্যাসের পানীয় জলের কূপ।

সেদিন অমৃতসরের মানুষ বেশির ভাগই স্বর্ণমন্দিরের তীর্থযাত্রী। অমৃতসরের ঘোড়া এবং গবাদিপশু ক্রয়বিক্রয়ের বৈশাখি মেলাতেও প্রচুর মানুষ। পুলিশ সেদিন বেলা দু’টোয় মেলা বন্ধকরে। তাই অনেক মানুষ জালিয়ানওয়ালাবাগে। এতিমখানা থেকে যুবক উধম সিং এবং তার যুবক বন্ধুরা ছোট কিন্তু এক মহৎ কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত। তাদের কাজ সমবেত তৃষ্ণার্ত মানুষদের মধ্যে ঠাণ্ডা পানীয় জল বিতরন। ভিড়ের মধ্যেই তাদের কাজ চলমান। সেদিন সাড়ে চারটায় নির্ধারিত সভা শুরু হওয়ার কথা। সভা শুরুর এক ঘন্টা পরে, মাইকেল ও’ডায়ার পঞ্চাশ জন সৈন্যের একটি দল নিয়ে হাজির জালিয়ানয়ালাবাগে। মেশিনগানে সজ্জিত দুটি সাঁজোয়া গাড়িও উপস্থিত। সরু প্রবেশপথ দিয়ে সেই যানবাহন প্রবেশ অসম্ভব। সাঁজোয়া সেই যানে সৈন্যরা প্রবল পাহারায় ব্যস্ত। যাতে কেউ বাইরে বের হতে না পারে। জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ার, ভিড়কে ছত্রভঙ্গ হওয়ার জন্য সতর্ক না করেই, মূল পথ অবরুদ্ধ করেন। তিনি সৈন্যদের সরু পথের সামনে ভিড়ের ঘন অংশের দিকে গুলি চালনার নির্দেশ দেন। আতঙ্কিত জনতা বাগ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টাকরে। প্রায় দশ মিনিট ধরে অবিচ্ছিন্ন ভাবে গুলিবর্ষন। পুরুষ, নারী, বয়স্ক মানুষ ও শিশুসহ নিরস্ত্র অসহায় নাগরিকদের নিধন যজ্ঞ চলতে থাকে। অসহায় ক্রন্দনে আকাশ বাতাস মুখরিত। বন্দুকের গুলি নিক্ষেপ থামে না। অনেকেই প্রাণ রক্ষার তাগিদে কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনশো ঊনআশি জন সমাবেশ স্থলেই প্রাণ হারান। বারোশোর বেশি মানুষ আহত। গুরুতর আহতের সংখ্যা একশো বিরানব্বই।
গোলাবারুদ সরবরাহ প্রায় শেষ হলেই গুলি নিক্ষেপ থামে। সেখানেই তিনি বলেন, “এই গুলিবর্ষন সভাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য নয়। অবাধ্যতার শাস্তি দেওয়ার জন্য।” ঘটনাটি অমৃতসর গণহত্যা বা জালিয়ানয়ালা গণহত্যা নামে পরিচিতি পায়। গুলি থেকে সরাসরি প্রাণহানি। সরু গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় পদদলিত হয়ে অনেক মৃত্যু। গুলি থেকে বাঁচতে বাগের স্বল্প জলের কূপটিতে ঝাঁপ দেন অনেকেই। সেই কূপ থেকেই একশো কুড়িটি মৃতদেহ তোলাহয়। জেনারেল ও’ডায়ার সেদিন স্বাভাবিক সময়ের আগেই কারফিউ ঘোষণা করেন। তাই, আহতদের তুলে আনা সম্ভব হয়নি। তেমন আহতদের মধ্যেও অনেকেই মারাযান। সংবাদ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। গনবিক্ষোভ দাঙ্গার চেহারা নেয়। এই গনহত্যা জাতীয় জীবনে পরাধীন ভারতবাসীকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সুসংবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা সঞ্চার করে। এই জঘন্য ঘটনা প্রথম এশীয় এবং ভারতীয় নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অত্যন্ত মর্মাহত করে। তিনি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। সারা দেশে স্বাধীনতাকামী মানুষ এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখর। ব্রিটিশ রাজের প্রতি ভারতীয় জনগণের বিশ্বাস তলানিতে ঠেকে। অকার্যকর ভিত্তিহীন তদন্ত, জেনারেল ও’ডায়ারের জন্য প্রাথমিক প্রশংসা, ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। যা ভারতবাসীদের উনিশশো কুড়ি থেকে বাইশ সালের অসহযোগ আন্দোলনের দিকে অগ্রবর্তি হতে প্রেরণা দেয়।

তেরোই এপ্রিলের সেই হৃদয় বিদারক ঘটনা যুবক উধম সিংকে (Udham Singh) বিপ্লবী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করে। আগেই তিনি ভগৎ সিং এবং তার বিপ্লবী গোষ্ঠীর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ঊনিশশো চব্বিশ সালে, উধম সিং গদর পার্টির সদস্য। ঔপনিবেশিক শাসন উৎখাত করার জন্য বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের সংগঠন গদর পার্টি। তিনি ভগৎ সিংএর নির্দেশে গদর পার্টির কাজে কানাডায় যান। ঊনিশশো সাতাশ সালে তিনি ভগৎ সিংয়ের আদেশে ভারতে ফিরে আসেন। পঁচিশজন সহযোগীর পাশাপাশি রিভলবার এবং গোলাবারুদ থাকে তাঁর সাথে। লাইসেন্সবিহীন অস্ত্র রাখার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার। রিভলবার, গোলাবারুদ এবং “গদর-ই-গুঞ্জ” (বাঙলা ভাষায় অর্থ, বিদ্রোহের কণ্ঠস্বর) নামে নিষিদ্ধ গদর পার্টির একটি পত্রিকার কপি তাঁর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। তাঁর বিচার চলে। ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থা তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
ঊনিশশো একত্রিশ সালে মুক্তি পান। মুক্তির পরেও উধম সিংএর গতিবিধিতে পাঞ্জাব পুলিশের নিয়মিত নজরদারি। সেই নজরদারি এড়িয়ে চলেযান কাশ্মীর। সেখান থেকেই পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে জার্মানি পলায়ন। ঊনিশশো চৌত্রিশ সালে লন্ডন পৌঁছান। সেখানে প্রকৌশলী হিসাবে চাকুরি জোগাড় করেন। লণ্ডনে থাকার সময়েই তিনি ঘৃণ্য নরঘাতক জেনারেল ও’ডায়ারকে হত্যার মনস্থ করেন। সম্পূর্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগেই তা সম্পন্ন করার চেষ্টায় থাকেন। ইংল্যান্ডে অবস্থান কালে উধম সিং কভেন্ট্রিতে ইন্ডিয়ান ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত।। তাদের সভাতেও যোগদেন।

উধম সিং খবর পান মাইকেল ও’ডায়ারের সভার তারিখ তেরই মার্চ ঊনিশশো চল্লিশ। সভাস্থল ক্যাক্সটন হল। সভার উদ্যোক্তা ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন এবং সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটি। তিনি প্রস্তুত। আগেই কেনা থাকে একটি রিভলবার। মোটা বইয়ের পাতা কাটেন রিভলবারের মাপে। বইতে ভরেন আগ্নেয়াস্ত্র। সভাকক্ষে ঢোকেন রাম মহম্মদ সিং আজাদ পরিচয়ে। ভারত ইতিহাসে চির ভাস্বর উধম সিংএর আত্মত্যাগ।

ছবি : আন্তর্জালিক 

আরও পড়ুন :Article : সেকালের সেইসব চিঠিপত্র

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment