সাশ্রয় নিউজ, কুর্নুল, অন্ধ্রপ্রদেশ : অন্ধ্রপ্রদেশের (Andhra Pradesh) কুর্নুল (Kurnool) জেলার চিন্না টেকুর (Chinna Tekur) গ্রামের কাছে শুক্রবার ভোরে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। হায়দ্রাবাদ (Hyderabad) থেকে বেঙ্গালুরু (Bengaluru)গামী একটি বেসরকারি বাস হঠাৎ আগুনে জ্বলে ছাই হয়ে যায়। ঘটনায় অন্তত ২০ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুই শিশু এবং একজন মোটর সাইকেল আরোহীও রয়েছেন।স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ভোর প্রায় তিনটের দিকে ঘটনাটি ঘটে, যখন কাবেরী ট্রাভেলস (Kaveri Travels)-এর ওই স্লিপার বাসটি হাইওয়েতে একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনার তীব্রতায় বাইকটি বাসের নিচে আটকে পড়ে এবং বাসের জ্বালানি ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাসে, যাত্রীরা ঘুমন্ত অবস্থাতেই ভেতরে আটকএ পড়েন।
কুর্নুল জেলা কালেক্টর এ. সিরি (A. Siree) জানিয়েছেন, বাসে মোট ৪১ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ২১ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। “এখনও পর্যন্ত ১১ জনের মৃতদেহ শনাক্ত করা গিয়েছে। বাকিদের পরিচয় জানতে ডিএনএ পরীক্ষা চলছে,” বলে তিনি সংবাদ সংস্থা পিটিআই:কে(PTI) জানান। উল্লেখ্য, থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন বাসের দুই চালক। পুলিশ জানিয়েছে, “দু’জনেই আগুন লাগার পরপরই গাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এবং প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে।”
বেঁচে যাওয়া যাত্রী জয়ন্ত কুশওয়াহা (Jayanth Kushwaha) ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলির কথা স্মরণ করে বলেন, “রাত আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙে দেখি আগুনে ঘেরা বাস। দরজা বন্ধ ছিল, বাইরে বেরোনোর কোনও উপায় ছিল না। আমরা চিৎকার করে সবাইকে জাগালাম, তারপর জানালা ভেঙে ঝাঁপ দিলাম। মাত্র কয়েকজনই বাঁচতে পেরেছিল।” আরেকজন যাত্রী অশ্বিন (Ashwin) বলেন, “আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল যে মনে হচ্ছিল পুরো বাসটাই বিস্ফোরিত হবে। আমি চালকের ঠিক পেছনে বসেছিলাম, জানালা ভেঙে লাফ দিয়ে কোনও মতে প্রাণ বাঁচিয়েছি।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্থানীয় গ্রামবাসীরা প্রথমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁদেরই কেউ কেউ বলেন, “আমরা আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের চিৎকার শুনছিলাম। দমকল আসার আগেই অনেকে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উদ্ধারকাজে।” পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় দমকলের চারটি ইঞ্জিন এবং পুলিশ। অন্যদিকে, অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী মান্দিপল্লি রামপ্রসাদ রেড্ডি (Mandipalli Ramprasad Reddy) বলেছেন, “আমরা নিহতদের পরিবারের জন্য ৫ লক্ষ টাকা এবং আহতদের জন্য ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছি। বর্তমানে উদ্ধারকাজে ১৬টি দল কাজ করছে।” প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) এক্স (X)-এ পোস্ট করে লিখেছেন, “অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় তহবিল (PMNRF) থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।” রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু (Droupadi Murmu) এক বিবৃতিতে বলেন, “অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুলে মর্মান্তিক বাস অগ্নিকাণ্ডে বহু প্রাণহানি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি শোকাহত পরিবারগুলির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।” উপরাষ্ট্রপতি সিপি রাধাকৃষ্ণ (C.P. Radhakrishnan) তাঁর বার্তায় লেখেন, “এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা জাতিকে শোকাহত করেছে। নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।” কর্ণাটকের উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার (D.K. Shivakumar) বলেন, “এই ঘটনা আমাদের সকলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। প্রতিটি রাজ্যের উচিত আন্তঃরাজ্য বাস চলাচলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা।”
অন্যদিকে, তেলেঙ্গানার পরিবহনমন্ত্রী পুন্নম প্রভাকর গৌড় (Ponnam Prabhakar Goud) ঘোষণা করেছেন, “অযোগ্য বা অনুমোদনবিহীন বাস যদি চলাচল করে, তা অবিলম্বে জব্দ করা হবে। নাগরিকদের জীবন নিয়ে খেলা চলতে পারে না।” এই ঘটনার পর তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার যৌথভাবে নিহতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে অনুদান ঘোষণা করেছে। আহতদের দেওয়া হবে ২ লক্ষ টাকা। তেলেঙ্গানা সরকার হেল্পলাইন চালু করেছে যাতে পরিবাররা মৃত ও আহতদের বিষয়ে তথ্য জানতে পারেন। বেঙ্গালুরু আইটি কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন (Greater Bengaluru IT Association) এই মর্মান্তিক ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “প্রতিটি আন্তঃনগর যাত্রায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। সরকারি সংস্থাগুলিকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।” পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত গতি ও অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রী এন রমেশ (N. Ramesh) দুই চালকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছেন। তদন্তে জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনার সময় বাসের দরজা শর্ট সার্কিটের কারণে আটকে গিয়েছিল, ফলে অনেকে পালাতে পারেননি। স্থানীয় এক পুলিশ কর্তা বলেন, “মোটরসাইকেলটি বাসের নিচে চাপা পড়ার পরই জ্বালানি ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়। আগুনের শিখা কয়েক সেকেণ্ডে পুরো বাসটিকে গ্রাস করে নেয়।”
ঘটনার পর কুর্নুলের রাস্তাজুড়ে শোকের ছায়া। ধ্বংসাবশেষের পাশে পড়ে থাকা পোড়া ব্যাগ, জুতো আর মোবাইল ফোন, প্রতিটি সাক্ষী যেন একেকটি নিঃশব্দ আর্তনাদ। প্রশাসনের তরফে দগ্ধ দেহ শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা চলছে। এই দুর্ঘটনা আবারও তুলে ধরল দেশের সড়ক পরিবহনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা। স্লিপার বাসে নিয়মিত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা ও গতি নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি কতটা বাধ্যতামূলক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নতুন করে। কুর্নুলের এই দুর্ঘটনা এক দুঃস্বপ্নের হয়ে থাকবে দক্ষিণ ভারতের পরিবহন ব্যবস্থার ইতিহাসে। রাতের ঘুম থেকে জেগে ওঠা যাত্রীদের শেষ মুহূর্তের আতঙ্ক আর চিৎকার যেন গোটা দেশকে সতর্ক করে দিচ্ছে, নিরাপত্তাই এখন সবচেয়ে বড় প্রার্থনা।
ছবি : সংগৃহীত




