Sasraya News

Saturday, February 15, 2025

Buddhadeb Bhatacharjee : পশ্চিম বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

Listen

বুদ্ধদেব বাবু একজন সত্যিকারের কমিউনিস্ট হয়েও তাঁর মধ্যে ছিল কবিসত্বা। তাঁর রচিত বহু নাটক বহু প্রশংসা পেয়েছে। তিনি অনেক গ্রন্থের অনুবাদও করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে মার্কসবাদীরা বুর্জোয়া কবিরূপে আখ্যা দিলেও জনগণের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ যাঁরা করেছিলেন তাদের অন্যতম তিনি। লিখেছেন : বীর চৌধুরী 

 

 

পাম অ্যাভেনিউ থেকে পিস ওয়ার্ল্ড যাওয়ার সময়।

 

 

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee)  ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে উত্তর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নেপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য যাজকত্ত্বে প্রবেশ না করে সারস্বত গ্রন্থাগার যা পারিবারিক প্রকাশনা হিন্দু ধর্মীয় সামগ্রী বিক্রি করতেন। পিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতিতীর্থ সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। তিনি পুরোহিত দর্পণ নামে পুরোহিত ম্যানুয়াল রচনা করেছিলেন যা পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দু পুরোহিতদের কাছে আজও জনপ্রিয়। নেপাল চন্দ্র ভট্টাচার্যের খুড়তুতো ভাই ছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। বুদ্ধদেব বাবুর স্ত্রীর নাম মীরা ভট্টাচার্য। তাঁর এক সন্তান সুচেতন ভট্টাচার্য বর্তমান।

শৈলেন্দ্র সরকার থেকে স্কুলের গণ্ডি পার করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে (সম্মান) বিষয়ে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ডিগ্রী লাভ করার পর দমদমের আদর্শ শঙ্খ বিদ্যামন্দির স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও কমিউনিজমের নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।

তিনি ১৯৬৬ সালে CPIM -এ যোগদান করেন এবং খাদ্য আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ভিয়েতনামের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে DYFI এর রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যান। ১৯৭২ সালে CPIM রাজ্য কমিটিতে নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের জন্য বিধায়ক নির্বাচিত হন কাশিপুর বেলগাছিয়া কেন্দ্র থেকে এবং মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে কাশিপুর কেন্দ্র থেকে পরাজিত হবার পর ১৯৮৭ সালে তিনি যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০১১ সাল পর্যন্ত একটানা নির্বাচিত হতে থাকেন। ১৯৮৭ সালে তথ্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবে পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তথ্য ও সংস্কৃতি এবং নগর উন্নয়ন ও পৌর বিষয়ক দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মন্ত্রীসভাকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য “চোরের মন্ত্রিসভা” মন্তব্য করে সেই মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করেছিলেন। বেশ কিছু মাস মনোমালিন্য চলার পর আবারও তিনি মমন্ত্রীসভায় ফিরে আসেন।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর স্বাস্থ্য জনিত অবনতির কারণে স্বরাষ্ট্র এবং পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি প্রথম পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।২০০০ সাল ৬ নভেম্বর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পদত্যাগের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০১ সাল এবং ২০০৬ সাল মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বামফ্রন্ট সরকারের বিজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

বুদ্ধদেব বাবু তার কাকা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পথ অনুসরণ করেছিলেন। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর ভীষণ কদর। তিনি নাটক এবং ফিল্ম দেখতে ভালবাসতেন।চিরাচরিত বামফ্রন্টের পুঁজিবাদ বিরোধী নীতি বিরোধিতা করে বুদ্ধদেব বাবু উন্মুক্ত নীতির জন্য সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে “ব্রান্ডবুদ্ধ” নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি তাঁর চিন্তাশক্তি থেকে অনুভব করেছিলেন শুধু কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন একটা রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না তাই দরকার শিল্পের।তার রাজ্যে শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে বাইরে কাজে যাবে তা তিনি মানতে পারতেন না। তাই তিনি শিল্পায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং তার নেতৃত্বেই আইটি এবং পরিষেবা খাতে উল্লেখযোগ্যভাবে বিনিয়োগ হয়েছিল। ফলস্বরূপ ২০০৬ সালে নির্বাচনে ২৯৪ টি আসনের মধ্যে ২৩৫টি আসন জয়লাভ করেন।

বুদ্ধদেব বাবুর গৃহীত উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলির মধ্যে হল, টাটা ন্যানো চারচাকা গাড়ি কারখানা হুগলির সিঙ্গুরে, শালবনীতে জিন্দালদের ইস্পাত কারখানা, নয়াচরে রাসায়নিক কেন্দ্র। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ নীতিকে কেন্দ্র করে টাটা ন্যানো কারখানা এবং নয়াচরের রাসায়নিক কেন্দ্র যা নন্দীগ্রাম আন্দোলন বলে পরিচিত বিরোধীদের (তৃণমূল কংগ্রেস এবং জাতীয় কংগ্রেস) প্রবল চাপ এবং বামফ্রন্টের শরীকী  চাপে রূপায়ণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

২০০৭ সাল ১৫ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানো ঘটনায় বুদ্ধদেব বাবুকে ভীষণ সমালোচনার সামনে পড়তে হয় এবং উনি ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এছাড়াও বুদ্ধদেব বাবুর মুখ্যমন্ত্রীত্বে উল্লেখযোগ্য হিংসাত্মক ঘটনা ছোট আঙারিয়া গণহত্যা, নেতাই হত্যা, ধানতলা, শিলদায় মাওবাদী হামলা, লালগড় আন্দোলন এবং জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত মানুষের মৃত্যু মিছিল যা বামফ্রন্ট সরকারের ভীতকে নাড়িয়ে দেয়।

বুদ্ধদেব বাবু একজন সত্যি করে কমিউনিস্ট হয়েও তাঁর মধ্যে ছিল কবিসত্বা। তাঁর রচিত বহু নাটক বহু প্রশংসা পেয়েছে। তিনি অনেক গ্রন্থের অনুবাদও করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে মার্কসবাদীরা বুর্জোয়া কবিরূপে আখ্যা দিলেও জনগণের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ যাঁরা করেছিলেন তাদের অন্যতম তিনি। ভালবাসতেন কবিতা, আবৃত্তি ও বই পড়তে। একবার বইমেলা আগুনে ভস্মীভূত হলে, তিনি সরকারি সাহায্যে সমস্ত বইমেলাকে আবার প্রাণবন্ত করে তোলেন যা সমস্ত বইপ্রেমীদের কাছে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে।

তিনি ছিলেন একজন সৎ ও নির্ভীক মানুষ। সর্বদা সত্যের ওপর ভর করেই তিনি এগিয়ে গেছেন। তিনি জানতেন “সত্য পথে চলা খুব কঠিন কিন্তু সত্য ছাড়া বাঁচার কোন উপায় নাই।” তাইতো তিনি শেষবার মিডিয়াতে সাক্ষাৎ দেবার সময় অকপটে তার সরকারের এবং দলের গৃহীত কিছু কিছু সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল তা স্বীকার করেছিলেন। বরাবরই তিনি সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে চোখে মোটা কালো চশমা, হাতে সিগারেট তার ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। বুদ্ধদেব বাবুর করা উক্তি এখনও পর্যন্ত মানুষের মনে দাগ কেটে রয়েছে –

“বামফ্রন্টের বিকল্প একমাত্র উন্নত বামফ্রন্ট”

“কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ”

“আমরা চাই শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তের উন্নয়ন। তবেই দেশ এগোতে পারবে।”

“আমরা ২৩৫ ওরা ৩০।কি করবে ওরা?”

“এ লড়াই লড়তে হবে এ লড়াই জিততে হবে।”

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে তার বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মুখ্য সচিব ও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মনীশ গুপ্তর কাছে পরাজিত হন এবং দীর্ঘ ৩৪ বছর বামফ্রন্ট শাসনের পতন ঘটে। ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ২০২৪ সাল ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার ৮০ বছর বয়সে দীর্ঘস্থায়ী পালমোনারি রোগে ভোগার পরে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে কলকাতার নিজের পাম অ্যাভেনিউয়ের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আপনি অমৃত লোকে খুব ভালো থাকুন এই কামনাই করি। আপনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

ছবি : সংগৃহীত 

আরও খবর : Buddhadeb Bhatacharjee : বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-এর শেষযাত্রায় মানুষের ঢল রাজপথে

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment