



জাতি সংঘের ভুটান (Bhutan) উন্নয়নে চোডেন কাজ করেছেন। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে যার নাম ভুটানের লোককথা।তিনি রঙের গল্প বইতে নারী মনের গোপন খবর রেখেছেন। চোখের সামনে নগরজীবনের বিকাশ তিনি তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। তাঁর দাওয়া লেখাতে যে প্রতিকূল জীবনের কথা বলেছেন যা পাঠক বিষাদের রসে উপভোগ করেছে। তবে তিনিও সমালোচনার উর্ধ্বে নন। তাঁর বিরুদ্ধে মুখ্য অভিযোগ, কেন তিনি মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে মাধ্যম করলেন? তন্ময় কবিরাজ
ভুটান ভায়া কুনজং
সবুজ ডুয়ার্সের ধারে নদী। নদীর পাশেই মেঘে ঢাকা পাহাড়। মেঘ পিয়নকে প্রশ্ন করতেই উত্তর এল, “ওটা পাহাড়ে মোড়া দেশ ভুটান।” (Bhutan) ১৯৬০ সালের পর থেকেই সে দেশের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আগে নেপালের ভাষাই ছিল ভুটানের প্রধান ভাষা। ১৯৬২সাল নাগাদ ভুটানের প্রথম সংবাদপত্র কুয়েলসেল কলিংপংয়ের মান্ডিং প্রেস থেকে প্রকাশিত হত। ১৯৭০সালেও গৌরীশংকর উপাধ্যেয়ের ড্রুকলোসাল পত্রিকার প্রকাশ করলে ভুটানে নেপালি ভাষায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তারপর থেকেই ভুটানে ভাষাগত পরিস্থিতি ক্রমশ গরম হতে শুরু করে। ১৯৮৭সালে তা চরম আকার ধারণ করে। ভুটান সরকার নির্দেশ জারি করে, সব নেপালি বই পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ভুটান বিভিন্ন সময়ে নানান রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়। ভুটান সাহিত্যে যেমন রয়েছে ধর্ম, তেমনই রয়েছে লোককথার প্রভাব। তবে ভুটান তার সাহিত্যের এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেও তাদের বিকাশ কিন্তু আশানুরূপ নয়। বৌদ্ধ দার্শনিক দাশু সংগে ওয়াংয়েহুং তাই ভুটান সাহিত্যের বিকাশে হতাশা প্রকাশ করেছেন। “ভুটান ইতিহাস” বইয়ের লেখক ফুন্টসো আরও এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছেন, ভুটানের শিক্ষা প্রকৃত বিকাশে অন্তরায়, প্রচলিত ইংরেজি ভাষাও দুর্বল।ভুটানে প্রায় ১৮টি ভাষা রয়েছে। তাঁর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিব্বতের ধ্রুপদী শাখার অন্তর্গত দজোংখা। ভুটান এত বেশি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মের মধ্য আবদ্ধ ছিল যে তার লিখিত রূপ দেবার কেউ চেষ্টা করেনি।অন্যদিকে, প্রতিবেশী নেপালের মত ভুটানে ভানুভক্ত, পুদিয়াল, বালা কৃষ্ণ শামাদের আবির্ভাব ঘটেনি, যাঁরা ভাষায় পাশাপাশি জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটাবে।
ভুটানের ইতিহাস পুরনো। কোচবিহারের রাজা সংগলাদিপ ভুটান শাসন করেছেন। তিব্বত থেকে বৌদ্ধরা দলে দলে ভুটানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ভারত ও ভুটানের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৪৯সালে। যদিও ভারত-চীন যুদ্ধ ও ডোকালাম সমস্যার পরে সম্পর্কে অবনতি হয়। তিক্ততা আরও বাড়ে যখন ভুটান ভারতের অনুরোধ উপেক্ষা করে পর্যটনে অতিরিক্ত কর বসায়। তবে ১৯৫২সালে জিগমে দরজি ওয়াংয়েছুক ক্ষমতায় আসার পরে তিনি ভুটানকে নিজের মতো করে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। দাসত্ব প্রথার অবলুপ্তি থেকে চীন প্রভাব – সব কিছুতেই তিনি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন। ভুটানের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ আরও উন্নত হয় জিগমে শিংয়ে ওয়াঙ্গেছুকর সময়ে।তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান, ক্ষমতার বিকেন্দ্রকরণও করেন।
অস্থির ভুটানের সাহিত্যে মুখ্য কাণ্ডারী কুনজং চোডেন। বলা হয়, তিনিই ভুটানের প্রথম মহিলা উপন্যাসিক। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ভুটানের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সমাজ জীবন। প্রাথমিক শিক্ষার পরেই তিনি দিল্লী চলে আসেন। দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজ থেকেই মনোবিজ্ঞানে ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে তিনি অবশ্য সমাজ বিজ্ঞানেও ডিগ্রী লাভ করেছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস সার্কেল অফ কর্মাতে তিনি পনেরো বছর বয়সী সোমোর জীবনের গল্প বলেছেন। সোমোর মা মারা গেলে সে ঘর ছেড়ে দেয়। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অভিজ্ঞতা মানুষকে পরিনত করে তোলে। পাশাপাশি উপন্যাসে স্থান পেয়েছেন লিঙ্গ বৈষম্য, যৌনতার অধিকারের মত প্রশ্নগুলোও। আলোচ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে উত্তর ভারতের প্রতিফলন। অন্যদিকে তাঁর ইয়াতির গল্পের চোডেন অলৌকিক মনোবিজ্ঞানের গল্প লিখেছেন।তিনি তাঁর শিক্ষা দিয়ে সমাজ ও তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভাবনাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। সমাজে যে শিক্ষার দরকার সে কথা তিনি অনুভব করেছিলেন। ২০১২ সালে তিনি থিম্পুতে রিয়াং বুকস নামে প্রকাশনা চালু করেন। জাতি সংঘে ভুটানে উন্নয়নে চোডেন কাজ করেছেন। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে যার নাম ভুটানের লোককথা।তিনি রঙের গল্প বইতে নারী মনের গোপন খবর রেখেছেন। চোখের সামনে নগরজীবনের বিকাশ তিনি তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। তাঁর দাওয়া লেখাতে যে প্রতিকূল জীবনের কথা বলেছেন যা পাঠক বিষাদের রসে উপভোগ করেছে। তবে তিনিও সমালোচনার উর্ধ্বে নন। তাঁর বিরুদ্ধে মুখ্য অভিযোগ, কেন তিনি মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে মাধ্যম করলেন? তিনি সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিজের মতো করে কারণ তিনি ইংরেজিতে সাবলীল। সমালোচনা যাই হোক, প্রাচীণ ভুটানের লোককথার উপর তাঁর গভীর আগ্রহ। তাই সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে, মানুষকে জানতে তিনি যত্ন করে লিখে গেছেন। তিনি বলতেন, তিনি লোক সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান। এমনকি, তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রর মধ্যে তিনি হারিয়ে যান, খুঁজে পান মৌলিক ভুটান। চোডেন মনে করতেন, দেশের ইতিহাসকে অতিরঞ্জিত করার দরকার নেই। যদিও বর্তমান সময়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে ইতিহাসকে নিজের মতো করে ব্যাখা করার চেষ্টা করছে। তথাপি ইতিহাসের একটা নিজস্ব মানদণ্ড থাকা উচিৎ।
চোডেন বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাসকে তুলে ধরতে হবে। ইতিহাস না জানলে দেশকে ভালবাসা যাবে না। তাই তিনি মিউজিয়াম তৈরি করার কথা ভাবেন। তিনি শিশুদের জন্যও বই লেখেন। তিনি মনে করেন, শিশুদের বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার দরকার নেই। বরং ব্যাখা এমন হওয়া উচিত যাতে তাঁরা বুঝতে পারে। চোডেন বলতেন, ভাল লেখক হবার আগে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। কারণ, অভিজ্ঞতাই লেখার সাহস দেবে। তিনি নতুন প্রজন্মকে মানুষের সঙ্গে আরও মিশতে বলেন।সামাজিক জীবন খুব দরকার। একটা মানুষ আর একটা মানুষকে অনেক অনেক কিছু দিতে পারে। অভিজ্ঞতা না থাকলে বিশ্বাস জন্মাবে না। তিনি লোক সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করতেন তাই সেগুলো তাঁর লেখায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
চোডেন এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “সারা জীবন ধরেই শিক্ষা চলবে। তার মধ্যেই বাছাই করা অধ্যায়গুলো নিজের কাছে রাখতে হবে। জীবনে চলার পথে আমি শিখেছি ভদ্রতা, চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা অর্জন করেছি যা আমাকে লিখতে সাহায্য করেছে। আমার মনে হয়, লেখা খুব শক্ত কাজ যদি ওগুলো সঙ্গে না থাকে।”
ছবি : প্রতীকী
আরও পড়ুন : Wayanad Landslide : বাঁচিয়েছেন ১০০ জনের প্রাণ! তারপর…
