



কবিতায় আবদ্ধ মন…
মমতা রায়চৌধুরী
হঠাৎই কবিতা নিয়ে কিছু কথা মনের ভেতরে আঁকি-বুকি কাটে। কবিতা নিয়ে অনেক কথাই মনে জমা হয়ে আছে তবে আমি সংক্ষিপ্ত আকারে তার প্রকাশ করছি। প্রথমেই আসি কবিতা বলতে আমরা কি বুঝি? কবিতা, কাব্য, পদ্য হচ্ছে শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিম্বা অনিবার্য ভাবাবেগের বাক্য বিন্যাস যা একজন কবির আবেগ ,অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে চিত্রকল্পের সাহায্যে আন্দোলিত সৃষ্টির উদাহরণ।(অন্তর্জাল)
আবার যদি ইংরেজিতে বলি,
What is poem?
A poem is a piece of writing that uses imaginative words to share ideas, emotions or a story with the reader. (অন্তর্জাল)
প্রকৃত কবিতাশিল্পীরা জানেন কবিতা কতটা আত্মিক ভাবগভীরতায় আচ্ছন্ন। তাই যখন মন খারাপের বারান্দায় বসে দু’চোখে জল মনে বিষন্নতা তখন শুধু কবিতাকেই আঁকড়ে বেঁচে থাকা ।হয়তো অনেকে এর নাম শুনে নাক সিটকাবেন আবার অনেকে জিজ্ঞেস করেন- তুমি কি কর?
তখন যদি শুধু বলি আমি কবিতা লিখি ।
আবার ও অবাক প্রশ্ন
তুমি কি কর?
আমি কবিতা লিখি।
তখন বোঝা-ই যায় ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার যেন বিস্ময়ের অব্দি থাকে না। কবিতা আবার কারোর অবলম্বন হতে পারে নাকি? তাঁরা আসলে শুনতে চাইছিলেন শিক্ষিকা, না ডাক্তার, না ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কিছু যার সঙ্গে অর্থ জড়িত থাকে। কিন্তু প্রকৃত যারা কবি সাহিত্যিক তাঁরা কিন্তুএসব তোয়াক্কা করেন না আসলে মনের আনন্দে হৃদয়ের ভাবলোকের ভাবোচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটাতেই তাঁরা ব্যস্ত। অনেকের মনে হতে পারে তাতে কিবা মানুষের এসে গেল। মানুষের কাছে তার কি গভীর তাৎপর্য ধরা পড়বে?
কেউ হয়ত বলবেন না, পড়ে না। আবার কেউ বলবেন হয়ত বা পড়ে কিন্তু আমি বলি কবিতা এমন একটা শিল্প যার মধ্যে দিয়ে দেশ কাল অতিক্রম করে চলে যায় তার প্রসারিত রূপ। যদি বলি কেন? তাহলে তার উত্তরে বলব কবিতা রচনার মধ্যে দিয়ে যুগে যুগে কত বিপ্লব না ঘটিয়েছেন কবিরা। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন সবই যেন চেতনার গভীরে গিয়ে দাগ কাটে। এইতো মন খারাপের বারান্দায় বসি যখন মনে হাজারো প্রশ্ন, এক বিষন্ন যন্ত্রণা যখন অক্টোপাসের মত আঁকড়ে ধরে তখন শুধু কবিতাকে ভালোবেসেই যেন মনকে সতেজ করে তুলতে পারি। কবিতার মধ্যে দিয়েই বিষন্নতাকে ভুলে যাওয়া যায় কবিতার মধ্যে দিয়েই আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরে উঠা যায়। কবিতার মধ্যে দিয়েই প্রেমে পড়া যায়, কবিতার মধ্যে দিয়েই অন্যকে আকর্ষণ করা যায়, কবিতার মধ্যে দিয়েই অনেক বিনি সুতোয় মালা গাঁথা যায়। তাই তো এরকম কবি সাহিত্যিকদের হাতের থেকে মনের অনবদ্য রূপ বেরিয়ে এসেছে অজস্র ধারায়। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি ,জীবনানন্দ দাশ আরও অসংখ্য কবি।
তাই কবিতাকে অস্বীকার করার স্পর্ধা আমার নেই ।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়তো কবিতার অনেক রূপান্তর ঘটেছে। কিন্তু কবিতা যে কখনো কখনো কোনো বিশ্বাসের ভিতে ফাটল ধরাতে পারে বহুদিনের অভ্যাসকে এক নিমিষে নাড়িয়ে দিতে পারে সেটা কিন্তু আমরা স্বীকার করে নিতেই পারি।
কবিতা কখনো কখনো হয়ে ওঠে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের জীবনের আনন্দের বিশ্ববিধানে এক আস্থাবান চিত্তবৃত্তি।
এইজন্য কবিতারও নানা প্রকারভেদ রয়েছে তবে আমি আধুনিক বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর আধুনিক কবিতার সংজ্ঞার মধ্যে দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছি।
“…. এই আধুনিক কবিতা এমন কোন পদার্থ নয় যাকে কোন একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায় ।একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা ,সংশয়ের ,ক্লান্তির সন্ধানের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিষয়ের জাগরণ ,জীবনের আনন্দ , বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য , অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখীতা সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন ভিন্ন কবিতা নয় কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।”
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বলেছেন কাজটা সহজ নয়। কারণ পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে? তার মতে নদী যেমন বাঁক নেয় সাহিত্য ও তেমনি গতি বদলায় ।সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডারন। বাংলায় বলা যাক আধুনিকতা। এই আধুনিকতাটা সময় নিয়ে নয় মর্জি নিয়ে।”
(রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক কাব্য সাহিত্যের পথে)
আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা যাই হোক না কেন কবিতা যে সবকিছুকে পেরিয়ে গিয়ে রক্ত চক্ষু কোন শাসক কেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে সেটা বলা যেতেই পারে। শাসকরা কবিতাকেও ভয় পায়। তাই যদি না হতো তাহলে কোমরের দড়ি বেঁধে কবিকে নিয়ে যাওয়া হতো না বিচার স্থানে ।শাস্তি দিলেই কি তাঁর কবিতার কণ্ঠ কে থামিয়ে রাখা যায় না। তাঁর সৃষ্টিকে রেখে যায়।
তাই কখনো দেখি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় ফুটে ওঠে ”বলেছিলুম কিনা আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না।” কিংবা কখনো দেখি স্বাধীনতার স্বাদ যখন প্রত্যেকের হৃদয়ে পরাধীনতার শৃংখল মোচনে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় উঠে আসে বাণীরূপ নিয়ে “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়” কিংবা যদি দেখি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হিংস্র রূপ আমরা জোটবদ্ধ হই কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় “আমাদের ডান পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানির বাঁধ
…
আমরাও তবে এইভাবে
এই মুহূর্তে মরে যাব নাকি?
.…
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”
কিংবা সাম্রাজ্যবাদী শাসকের নগ্ন চেহারা যখন ধরা পড়ে তখনও আমরা মানবিক হই মানবিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মধ্যে-
”দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে
বলো ক্ষমা করো-
হিংস্র প্রলাপের এর মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”
যুগে যুগে এই ভাবেই কবিরা কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁরা তাদের সেই মর্ম বাণীকে শুনিয়ে সকলকে যেমন সচেতন করেন তেমনি আবার অনুপ্রাণিত ও করেন ।
আবার মানবতার অবমাননা দেখে যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীর ক্লান্ত রূপ দেখে কবি জয় গোস্বামীর কণ্ঠে তাই শোনা যায়
“বর্ম খুলে দেখো আদুর গায়ে
….
রক্তমুছি শুধু গানের গায়ে ।”
আবার কখনো কখনো স্বদেশপ্রেমীকে উদ্বুদ্ধ হতে বলি কবির ভাষাতেই।
কবির ভাষাতেই যান্ত্রিকতার আবিলতা ঘুচাতে মন প্রাণ ছুটে চলে যায় আবার সেই পল্লী বাংলার
উঠানে
“যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে
….
ফুরায় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা।”
এ যেন শৈশব জীবনের কথা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মনে করিয়ে দেন আবহমান কবিতার মধ্যে দিয়ে।
আবার যখন ভাষার জন্য মন প্রাণ কেঁদে ওঠে ভাষাকে রক্তাক্ত হতে দেখি তখন আবার কবির ভাষাতেই ফুটে ওঠে
“আমার দুঃখিনী বর্ণমালা…।(শামসুর রহমান)
কখনো বা অমর একুশ সম্পর্কে আমার কবিতার
ফুটে ওঠে
“২১ মানে রক্ত ঝরা দুখিনী বর্ণমালা
একুশ মানে রক্তাক্ত পদদলিত মাতৃভাষা।
২১ মানে দগদগে ঘা মায়ের দিনলিপি
২১ মানে প্রতিরোধ প্রতিবাদে গর্জে উঠি।”
কখনো বা বর্তমান যুব সংকটকে দেখা যায় কবিতার আলোকে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়
“বিকেলের বারান্দার থেকে সব জীর্ণ নরনারী
চেয়ে আছে পড়ন্ত রোদের পাড়ে সূর্যের দিকে
খন্ডহীন মন্ডলের মতো বেলোয়ারি ।”
(বিভিন্ন কোরাস, সাতটি তারার তিমির)
আবার রোমান্টিক কাব্য প্রেমের বর্ণনায় কোনও কোনও কবির থাকে উচ্ছ্বাস কিন্তু আমরা কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্যে দেখি তার অনুপস্থিতি যে প্রেম তিনি পাননি যে প্রেম শেষ হয়ে গেছে যা আর কোনদিনও ফিরে আসবে না জীবনানন্দ সেই অচরিতার্থ প্রেমের কবি। তাই আমরা দেখি প্রিয়ার মৃত্যুতেও যদি অনন্ত বিচ্ছেদ আসে তবু কবির কাছে সেই শূন্যতাকে শূন্য মনে হয়নি তাই কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়
“তবু শূন্য শূন্য নয়
ব্যথা ময়
অগ্নি বাষ্পে, পূর্ণ সে গগন
একা একা সে অগ্নিতে
দীপ্ত গীতে
সৃষ্টি করি স্বপ্নের ভুবন। “(পূর্ণতা, পূরবী)
এখানে আশ্চর্য হই গভীর শূন্যতা বোধের মধ্যেও কেমন ভাবে নতুন করে কবিতার জন্ম নেয় আর এই ভাবেই আমাদের বাঁচা মরা এইভাবেই আমাদের জেগে ওঠা যদি সত্যি কারের কবিতাকে ভালবেসে যাই। আজ বসন্তের দ্বারে বসে তাই আপন ছন্দে লিখতে ইচ্ছে করে”
“পড়ন্ত বিকেলে পাতা ঝরা বসন্তে
মনটা হু হু করে কিংশুকের বনে
আবির আর রঙের ছটায় তোমার মুখে
দুচোখ জুড়ে আলপনা আঁকে ভালোবাসার সুখ।”
তাই বসন্তে মন হুহু করে ওঠে তখনও কবিতাকে ই বেছে নিই ভালোবেসে ।
কবিতাকে আঁকড়ে ধরে ই অমরত্ব লাভ করা যায়।
এই ভাবেই যুগে যুগে কবিরা তা শেলি হন বা জন কিটস বা রবীন্দ্র নজরুল, জীবনানন্দ বা অন্যান্য কবিরা তাঁদের কবিতার মধ্যে দিয়ে অমরত্বের জয়গান করেছেন।
তাই কবিতাকে ভালোবেসে কবিতা দিবসে প্রাণ ভরা শ্রদ্ধা ভালোবাসার মর্ম গাঁথা রচনা করি।”
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব
