Sasraya News

Thursday, May 22, 2025

Walt Whitman : ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতায় আমেরিকান রাষ্ট্রভাবনা ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য অধ্যাত্মবাদের মেলবন্ধন 

Listen

🦋গদ্য 
কী আছে এই ক’য়েকটি পংক্তিতে? আছে তাঁর শ্রবণক্ষমতা, সমস্ত যুদ্ধ, প্রহসন, প্রতিকূলতা পেরিয়েও রাষ্ট্রের জয়ধ্বনি, যেখানে তিনি একটি নির্জীব ভূখণ্ড নয়, একটি বিবর্ধিত দেশ-স্মারক নয়, বরং তার মানুষগুলোর গান শুনতে পাচ্ছেন। যেখানে কবিতার মধ্যে দিয়ে ধনী, গরীব, স্রোতের প্রতিকূলে থাকা মানুষগুলোর কথা উঠে আসছে। লিখেছেন : শ্রীতন্বী চক্রবর্তী

 

য়াল্ট হুইটম্যানের (Walt Whitman) কবিতার সাথে আমার প্রথম পরিচয় শ্রেণীকক্ষে মার্কিন কবিতা পড়ানোর অনেক আগেই, কারণ বহু স্কুলের পাঠ্যবইতেই মার্কিন কবিতা আলোচনার একটি অনস্বীকার্য অংশ হিসেবে থাকে লেখক, দার্শনিক, চিন্তক এবং শিল্পী হুইটম্যানকে জানা। হুইটম্যানের কবিতা নিয়ে তারপর অনেক পড়াশোনা করেছি, বারবার ভাবতে চেয়েছি, ‘হুইটম্যান মিন্স আমেরিকা’, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ভাবনাটা অতিরঞ্জিত, বা অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক কিনা। কারণ কখনো কখনো সেই মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকালের মাঝেও তাঁর কবিতার যে বিশাল ব্যাপ্তি, তা কেবলমাত্র হয়তো মার্কিনি রাষ্ট্রচিন্তাভাবনা প্রনয়ণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বরাবরই তাঁর সাহসী, ভবিষ্যদ্বাণীমূলক কণ্ঠ, তাঁর সর্বাত্মক সহানুভূতির জন্য এবং সর্বোপরি তাঁর স্বমহিম কাব্যসৃজনের উদযাপনের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন, এমনকি যাতে ভারতীয় পাঠকগণ সহজেই গীতার সামগ্রিক পর্যালোচনা ও উপনিষদের সাদৃশ্যগুলিও তাঁর কবিতার মাধ্যমে এক বিশাল স্বীকৃতি হিসেবে দেখতে পারতেন। তবে এই সাদৃশ্যগুলি খাঁটি কাকতালীয় কিনা, বা হুইটম্যানের পক্ষ থেকে ভারতীয় উৎসগুলিতে প্রকৃত গীতার দিকে ইঙ্গিত করছে কিনা তা সবচেয়ে শ্রমসাধ্য গবেষণা সত্ত্বেও অনিশ্চিত রয়েছে। কাজেই এটা বলা যেতেই পারে যে হুইটম্যানের লেখা বহুমাত্রিক। ভারতীয় পাঠকরা বছরের পর বছর ধরে হুইটম্যানের কবিতাগুলিতে ভারতীয় দর্শনের পঞ্চম চেতনা দেখে এসেছেন।

প্রফেসর ভি.কে. চারি তাঁর বই Whitman in the Light of Vedantic Mysticism- এ লিখেছেন:

“Whitman, like Emerson, shared in the Romantic tradition of Coleridge and the German idealists, and his concern with the problems of consciousness was part of the contemporary Romantic concern with the human mind and its operations through the creative imagination.” (Chari, 20)

হুইটম্যানের লেখনী, আরেক আমেরিকান দার্শনিক, প্রভাষক এবং abolitionist রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসনের মতোই রোমান্টিসিজম, জার্মান ভাববাদ, প্রকৃতি এবং অতীন্দ্রিয়বাদের পরিভাষাগুলিকে নিয়েই গঠিত, এবং মানুষের মননের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আত্মিক সংস্করণটিকে একটি অকপট আলোচনার ছায়ায় নিয়ে আসে। একের মধ্যেই অনেকগুলি অস্তিত্ব দৃশ্যমান, আবার গোটা একটি জাতি, দেশ, কাল, সবকিছু নির্বিশেষে সেই অনেকগুলি চেতনাই সামগ্রিকভাবে একটি স্বতন্ত্র জায়গায় এসে একই কেন্দ্রের অভিমুখী হয়। বলা যেতে পারে, তাঁর কবিতায় কনভার্জেন্স এবং ডাইভার্জেন্স, এই দু’টিই সমানভাবে চলতে থাকে। যেমন, ‘Song of Myself’ কবিতার প্রথম স্তবকে হুইটম্যান বলছেন,

“I celebrate myself, and sing myself,
And what I assume you shall assume,
For every atom belonging to me as good belongs to you.”
এই উদযাপন কিসের? আকাশ, বাতাস, আমেরিকার মাটির গন্ধ, স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো গরমকালের সকাল, নিজের সত্ত্বার প্রত্যেকটি আকাঙ্খিত অণু-পরমাণুর শক্তির মধ্যে দিয়ে আমি-তুমি একটি চূড়ান্ত চিহ্ন বহন করা, এ তো মাটির উদ্ভাস, এটিই তো দেশের কেন্দ্রিক এবং প্রান্তিক প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে দিয়ে নিজের কাব্যগানকে আবিষ্কার করা।

“A child said What is the grass? fetching it to me with full hands;
How could I answer the child? I do not know what it is any
more than he.

I guess it must be the flag of my disposition, out of hopeful green
stuff woven.”

ব্লেকের কবিতায় ‘ইনোসেন্স’, সারল্যের প্রতিশ্রুতি, একটি শিশুর কৌতূহল, প্রশ্নের প্রহসন নয়, সেই কৌতূহলের নিরসন-ঠিক এভাবেই হুইটম্যানের শিশুটিও শুধুমাত্র একমুঠো ঘাসের সংজ্ঞা খুঁজতে আসে, জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হয় ‘হোয়াট ইস দ্য গ্রাস’? কবি শত চেষ্টাতেও এই প্রশ্নের উত্তর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতলে খুঁজে পান না। তিনি ঠিক ততটাই জানেন, যতটা জানে সেই ছোট্ট শিশুটি, তাঁর অন্তরাত্মা তখন তাঁর প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও দেয়- হয়তো সেই ঘাসই তাঁর স্বভাবের বিন্যাস, প্রতীক, সবুজের বুনোটে আশার পতাকা। তাঁর কবিতার গণতান্ত্রিক সত্ত্বায় রয়েছে ভবিষ্যৎ আমেরিকার ছবি, যেখানে রাষ্ট্রের গান শোনাতে জন্ম নেবে আরো অনেক চারণকবি। ঠিক যেমন তিনি জনসাধারণের গান শুনিয়েছেন তাঁর ‘I hear America Singing’ কবিতায়-

“I hear America singing, the varied carols I hear,
Those of mechanics, each one singing his as it should be blithe and strong,
The carpenter singing his as he measures his plank or beam,
The mason singing his as he makes ready for work, or leaves off work”

কি আছে এই কয়েকটি পংক্তিতে? আছে তাঁর শ্রবণক্ষমতা, সমস্ত যুদ্ধ, প্রহসন, প্রতিকূলতা পেরিয়েও রাষ্ট্রের জয়ধ্বনি, যেখানে তিনি একটি নির্জীব ভূখণ্ড নয়, একটি বিবর্ধিত দেশ-স্মারক নয়, বরং তার মানুষগুলোর গান শুনতে পাচ্ছেন। যেখানে কবিতার মধ্যে দিয়ে ধনী, গরীব, স্রোতের প্রতিকূলে থাকা মানুষগুলোর কথা উঠে আসছে। যন্ত্রী, কাঠমিস্ত্রি, মাঝি, রাজমিস্ত্রি, মুচি এবং কাঠুরে, সকলেই একযোগে, নতুন কর্মোদ্যোমে তাদের মহিমান্বিত দেশমাতৃকার আরাধনা করছে- “Singing with open mouths their strong melodious songs.” এমন গান যা সুরেলা কিন্তু শক্তিশালী।
প্রসঙ্গত, আমরা যদি আমেরিকার ঐতিহাসিক আলোচনায় যাই তাহলে দেখি আমেরিকা প্রায় ৮০ বছর ধরে একটি জাতি হলেও এটি তখনও অসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, সংবিধান — এগুলি ছিল রাজনৈতিক দলিল, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য তাদের নকশায় যা কিনা বাস্তববাদী। আমেরিকার যে অভাব ছিল তা এমারসন যা বলেছিলেন: আমেরিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, শুধু অভাব ছিলো স্পিরিট বা আত্মার। এই ‘ইভোকেশন অফ দি আমেরিকান স্পিরিট’- সেটাই আমরা হুইটম্যানের লেখাতে পাই।

একটি এক, অবিনশ্বর আত্মা যা কিনা প্রত্যেকটি মানুষের চিহ্ন বহন করবে এবং বৃহত্তরভাবে ভাবতে গেলে, যেটি হয়ে উঠবে আমেরিকার একমাত্র পরিচয়। তিনি কবিতার মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান নি, একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে আত্মার সামগ্রিক বিকাশ ঘটছেনা। আমেরিকান ট্রান্সসেন্ডেন্টালিজ্মের আগে পর্যন্ত যা হয়েছে তা কেবলই একটি আনন্দিত, আত্মতুষ্ট, করুণাময়, অলস, একক আত্মার বর্ণনা। তাতে সমগ্র আমেরিকা নেই। হুইটম্যান আত্মা হিসেবে অনুমান করেন যে এটি সূক্ষ্ম, সজাগ, রাষ্ট্রের সংবেদনশীলতার একটি চিত্র। এটি পুরুষ বা মহিলা উভয়ই বলে মনে হয় না। না এটি আত্মার কোনও ধর্মীয় ধারণার সাথে জড়িত। তাঁর কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন এটি সম্ভবত পৃথিবীতে অপ্রত্যাশিতভাবে উত্থিত হওয়ার পক্ষে খুব দুর্বল, তবে যা স্বয়ং তা কেবল আত্মাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে আরও বেশি কিছুতে সফল হয়। যেমন, আব্রাহাম লিঙ্কনের মৃত্যুর সাথে অনিবার্যভাবে জড়িত একটি কবিতা ‘When Lilacs last in the Dooryard Bloom’d’-এ তিনি লিখছেন:

“Over the tree-tops I float thee a song,
Over the rising and sinking waves, over the myriad fields and the prairies wide,
Over the dense-pack’d cities all and the teeming wharves and ways,
I float this carol with joy, with joy to thee O death.”

লাইলাক ফুলের বেগুনি গুচ্ছ, আকাশ থেকে খসে পড়া সবথেকে উজ্জ্বল তারাটি, এবং একটি নিরীহ পাখির নিরন্তর, করুণ বিষাদগাথা, এই সবের মধ্যে দিয়েই মৃত্যুকে জয় করে আগামীর আলোর দিকে রাষ্ট্র ধাবমান। লিঙ্কনকে হারানোর বিহ্বলতা রয়েছে, মৃত্যুকে আবাহন করার সাথে সাথেই রয়েছে জীবনের এক অবিস্মরণীয় জয়গান, যা তিনি অগণ্য মাঠ, ঘাট, শহুরে বাস্তবতা, প্রেয়ারিল্যান্ড, ওহিও, ম্যানহাটান আর মিসৌরি ছাড়িয়েও ছড়িয়ে দিচ্ছেন দূর আকাশে। এইযে অনন্তের কিনারায়, মহাশুন্যতার দিকে তিনি সমস্ত গভীর দুঃখ, গোটা একটি জাতির ক্লেদাক্ত অনুভূতিগুলি ছেড়ে ভাসিয়ে দিচ্ছেন এক অপার বিস্ময়ে, তা তো এক কাব্যিক বিস্ফোরণের সৃষ্টি করতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদেও তো আমরা অনেকাংশে এই অনুভূতির প্রকাশ ঘটতে দেখি। ‘ব্রিঙ্ক অফ ইটার্নিটি’-তে তো এইরকম একটি অমোঘ সূত্রই গীতাঞ্জলির কবি রেখে গিয়েছেন:

“I stand under the golden canopy of thine evening sky
and I lift my eager eyes to thy face.

I have come to the brink of eternity from which nothing can vanish
—-no hope, no happiness, no vision of a face seen through tears.”

এক সর্বজ্ঞ,সর্বশক্তিমান অস্তিত্বের কাছে দাঁড়িয়ে কবি নিজেকে নির্দ্বিধায় সমর্পণ করছেন। সোনালী আকাশের সামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন, সেই অনন্ত, মহাকালের প্রতীক্ষায়, যেখানে কোনো নিজ স্বার্থ, নিজের বিলাপ, নিজের সুখ বলতে আর কিছু নেই। এই অনন্তের বুকেই সব নিমজ্জিত, ‘নাথিং ক্যান ভ্যানিশ’, এখান থেকে আর কোনোকিছুরই অবলুপ্তি হবেনা। একইভাবে, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে, গীতা, বেদান্তর অন্তর্নিহিত কিছু অর্থের মতোই ”When Lilacs last in the Dooryard Bloom’d- এ হুইটম্যান অনুভব করেন:

“Prais’d be the fathomless universe,
For life and joy, and for objects and knowledge curious”

এই সেই অতল, সেই অনন্ত যেখান থেকে কোনোকিছুই অন্তর্হিত হয়না। জীবন, আনন্দ, বস্তু, জ্ঞান সবকিছুর অস্তিত্বকে স্বীকার করেই তাই হুইটম্যান সেই অনন্তের বন্দনা করেন।হুইটম্যানের কবিতায় সবচেয়ে ছোট্ট অঙ্কুরটি দেখায় সত্যিকারের অর্থে আত্মার কোনও মৃত্যু নেই। তাঁর কবিতা পোয়েটিক নাকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রফেটিক বা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তাই নিয়েও বিস্তর আলোচনা রয়েছে। প্রকৃতির সান্ন্যিধ্যলাভ, মাটি, দেশ, পরিবেশ, শিকড়কে জানা, এই সমষ্টিগুলির মধ্যে যে নিগূঢ়তা এ তাঁর একান্ত উপলব্ধি, এ নিয়ে তিনি নিজের কাব্যিক সত্ত্বাকে গড়ে তুলেছেন। এই সামগ্রিক চিত্রগুলি আবার একইধারে আকর্ষণীয় আবার ভীষণভাবেই বৈপরীত্যমূলকও বটে। হুইটম্যানের কবিতায় সবচেয়ে ছোট্ট অঙ্কুরটি দেখায় সত্যিকারের অর্থে আত্মার কোনও মৃত্যু নেই। তাঁর কবিতা পোয়েটিক নাকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রফেটিক বা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তাই নিয়েও বিস্তর আলোচনা রয়েছে। প্রকৃতির সান্ন্যিধ্যলাভ, মাটি, দেশ, পরিবেশ, শিকড়কে জানা, এই সমষ্টিগুলির মধ্যে যে নিগূঢ়তা এ তাঁর একান্ত উপলব্ধি, এ নিয়ে তিনি নিজের কাব্যিক সত্ত্বাকে গড়ে তুলেছেন। এই সামগ্রিক চিত্রগুলি আবার একইধারে আকর্ষণীয় আবার ভীষণভাবেই বৈপরীত্যমূলকও বটে। তাঁর কবিতায় রয়েছে স্বজ্ঞালব্ধ জ্ঞান, ইন্টুইটিভ স্পিরিট, বৈপরীত্যের মধ্যেও একতা, বাস্তব এবং কল্পনার অনতিরঞ্জিত একটি পার্সেপশন বা প্রত্যক্ষকরণ। একটি রাষ্ট্র বা দেশের উর্দ্ধে গিয়ে তাই তিনি সগৌরবে ‘Passage to India’-তে বলেন:
“Europe to Asia, Africa join’d, and they to the new world,
The lands, geographies, dancing before you,
Holding a festival garland,
As brides and bride grooms hand in hand.”
হুইটম্যানের কবিতা ভাবায়, দ্বন্দ্বের মধ্যেও তাই অভিন্নতা খুঁজতে শেখায়।

তথ্যঋণ: V.K. Chari, Whitman in the Light of Vedantic Mysticism

ছবি ঋণ : আন্তর্জালিক 

 

আরও পড়ুন : Sasraya News | Sunday Literature Special | 14 July 2024 | Issue 24 | সাশ্রয় নিউজ | রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৪ জুলাই ২০২৪ | সংখ্যা ২৪

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment