Sasraya News

Wednesday, April 23, 2025

Travelog : মুরুগুমা পাহাড়ের এক রাত্তির 

Listen

‘… প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণি ঢেউ খেলে গেছে দিগন্তে, বনানী তার আঁচল মেলে রেখেছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে, সেই সবুজ শাড়ির জায়গায় জায়গায় ক্ষীণ নদী রেখা পাড়ের মতন…’ লিখেছেন : ধরিত্রী গোস্বামী 

 

ই প্রখর গ্রীষ্মে ভ্রমণ? তা-ও পুরুলিয়ার মত নিষ্করুণ রুখু লাল মাটির দেশে? কিন্তু মনের  রেলগাড়িটা যখন তখন কুউউউউ করে ডাক দিয়ে আমাকে অস্থির করে তোলে, রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সে টান মারে সজোরে তখন আমি আর ঘরের ছায়ায় আটকে থাকতে পারি না, বেরিয়ে আমায় পড়তেই হয়। বিশেষ কাজে গিয়েছিলাম পুরুলিয়ার আড়শায় সিধু কানু মিশনে। সেই দিন আবার ২৫০ কিমি উজিয়ে খড়্গপুরে ফেরা সম্ভব নয়, তাই নেটে খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গিয়েছিল মুরুগুমা ড্যামের পাশে বন পলাশি ইকো ট্যুরিজিমের সন্ধান, আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলুম একটা কটেজ। যদিও এখন একেবারেই অফ সিজন, পর্যটকের ভিড় একেবারেই নেই। আর তাই অভিজ্ঞতাও হোল বেশ অভূতপূর্ব। 

 

 

মিশনের কাজ মিটিয়ে সেখান থেকে আমরা চলে গেলুম কিছুটা পশ্চিমে সরে ঝাড়খণ্ড সীমান্ত লাগোয়া বেগুনকোদর বলে জায়গায়। পুরুলিয়া জেলার এই জায়গাটার নাম কিছুদিন আগেই জেনেছি, ভারতীয় রেলে  ভূতের উপদ্রব নিয়ে একটা লেখা লিখতে গিয়ে। বেগুনকোদর হোল ভারতবর্ষের সব থেকে কুখ্যাত ভূতুড়ে   রেল স্টেশন, যেটা ভূতের ভয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০০৯ অব্দি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল, একটি দুর্ঘটনার পর থেকে। যাক সে কথা। এখন জায়গাটায় এতটাই জমজমাট লোকবসতি আর বাড়িঘর গড়ে ঊঠেছে যে ভূতেরা সেখান থেকে নির্ঘাত পালিয়ে বেঁচেছে। তেনাদের টিকিও আর দেখা মেলে না, স্থানীয় মানুষজন তেমনি জানাল। 

 

_____________________________________________

চুপ করে শুনছিলাম ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে তাল মেলানো গানের সুরে যা ভেসে আসছিল দূরের কোন গ্রামের বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান থেকে। স্মৃতির মণিকোঠায় এই একটি সন্ধ্যার ছবি অনেকদিনের জন্য অমলিন ক্যানভাসে আঁকা হয়ে রয়ে গেল।

_____________________________________________

 

এই ঝালদা, বেগুনকোদর এলাকাগুলি আসলে অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশ এলাকা, যেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণি ঢেউ খেলে গেছে দিগন্তে, বনানী তার আঁচল মেলে রেখেছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে, সেই সবুজ শাড়ির জায়গায় জায়গায় ক্ষীণ নদী রেখা পাড়ের মতন, রুক্ষ্য লাল মাটির বুকে খেজুর তাল বাবলা গাছেরা এক অন্যরকমের উদাসী ছবি এঁকে রাখে যেখানে গেলে মনটা নিজে নিজেই  গেয়ে ওঠে গান।

“নদীর ধারে শিমুলের ফুল/
নানা পাখির বাসা রে/ নানা পাখির বাসা/
সকালে ফুটিবে ফুল/ মনে ছিল আশা রে/
এমন ছিল আশা” 

মুরুগুমা ড্যামের আশেপাশের ভূপ্রকৃতি অপূর্ব। পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক জলাধার, সাহারাজোর নদীর বুকে ড্যাম এই রুক্ষ্য এলাকায় কৃষিকাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এই প্রচণ্ড গ্রীষ্মে ড্যামে যা জল ছিল, বর্ষায় তার বহুগুণ বেশি জল পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরণা হয়ে নেমে আসে অবশ্যই। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট আদিবাসী গ্রামে সাঁওতাল এবং কুড়মি সমাজের মানুষের পাশাপাশি আছে মাহাতো এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের বসবাস। লোকবসতি খুবই কম, সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এলে গা ছমছম করতে বাধ্য। আমরা ছাড়া সেই রাত্রে আর কোনও অতিথি ছিল না ইকো রিসোর্টে। তবে কর্মচারীরা অভয় দিল, তারা সব থাকবে। ফলে সেই নির্জন সন্ধ্যাকে একান্ত করে উপভোগ করতে কোথাও বাধা রইল না। সেদিন ছিল স্নান যাত্রার পূর্ণ তিথি। পূর্ণিমার মস্ত চাঁদ যখন পাহাড়ের মাথা থেকে ঝাঁপ মেরে আকাশের কোলে লাফিয়ে পড়ল তখন দূরের বনে আকুল হয়ে ডেকে উঠল পাপিয়া আর এক ঝলক পাহাড়িয়া বাতাস ছুটে এসে ভালবাসার রুমাল বুলিয়ে মুছে দিল সারাদিনের ক্লেদ আর ঘাম। তৃপ্ত মনটা এলিয়ে বসলুম বন পলাশির বারান্দায়, চা আর পকোড়া সহযোগে  আমাদের আড্ডা জমে উঠলেও থেকে থেকেই সবাই চুপ করে শুনছিলাম ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে তাল মেলানো গানের সুরে যা ভেসে আসছিল দূরের কোন গ্রামের বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান থেকে। স্মৃতির মণিকোঠায় এই একটি সন্ধ্যার ছবি অনেকদিনের জন্য অমলিন ক্যানভাসে আঁকা হয়ে রয়ে গেল।

 

 

পরের দিন ফেরার জন্য অন্য পথ ধরলুম। ড্যামের গা বেয়ে যে নতুন পিচের রাস্তা ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে উঠে গেছে তা ধরে উঠে গেলুম অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায়। আঁকাবাঁকা পাকদণ্ডী বেয়ে চলেইছি, জনমানব কোনখানে নেই, বহুক্ষণ বাদে হয়ত মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে দুলে দুলে হেঁটে গেল এক আদিবাসী দম্পতি, তখন মনে হয় ইতিহাসের পাতা সরিয়ে কি কোন প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এসে পড়লুম? নির্জন পাহাড় আর প্রকৃতি – মাঝখানে কোনও আর আগল নেই। আর যদিও মাথার ওপরে মধ্য জুনের আগুন ঝরা আকাশ, তবু পাহাড় ঢাকা বনের আড়ালে আড়ালে যে ছায়াঢাকা পথ সেখানে কোথাও উষ্ণতা নেই, তাপ নেই- যেন অদৃশ্য কোনও বাতানুকূল যন্ত্র কোথাও বসানো আছে। আর সেই প্রাকৃতিক বাতানুকূল যন্ত্রটির নাম- অরণ্য। অযোধ্যা হিল টপ হয়ে সিরকাবাদের পথ ধরে এবার আমাদের ঘরের দিকে ফেরা। ছবি : লেখক 

আরও পড়ুন : North Bengal tour : উত্তরবঙ্গের আনাচে-কানাচে

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment