



সম্পাদকীয়🌱
জঙ্গলের ভেতরে একটা গাছ। অজস্র ফল। অজস্র বীজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে যাচ্ছে। বেড়ে চলেছে। অনেক গাছের মৃত্যুও ঘটছে। এটা আমরা প্রত্যক্ষভাবেই দেখতে পাই। যদি পরোক্ষভাবে তাকাই তাহলে দেখতে পাব মানব জন্মের ইতিবৃত্ত।
ঋষি-মুণিরা মনকে বসিভূত করে ঈশ্বর সাধনায় লিপ্ত হওয়ার ঘটনা কঁথিত। তাঁরা মনকে সাধনায় লিপ্ত করতে পেরেছে। অথচ তাঁরাও মনকে বাঁধতে পারেনি। আমাদের দৃশ্যায়মান কিছু মুহূর্ত বাঁধা যায় জীবনচরিত্রে। যেমন কেউ দোষ করলে সেই এলাকার নীতি অনুসারে শাস্তি দেওয়া হয়। বলতে পারি, শরীরকে গাছে বেঁধে প্রহার বা খাঁচায় বন্দী বা প্রশাসন মহলের হাতে তুলে দেওয়া। উল্টোদিকে যদি কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা একে-অপরকে মন দেওয়া-নেওয়ার কাজ করে এই বিষয়টি পরিবার জানতে পারলে বলপূর্বক সেই ছেলে বা সেই মেয়েটিকে অন্যত্র বিবাহ সম্প্রদান করা হয়। অথবা কোনও ছাত্র বা ছাত্রীকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে অত্যাধিক চাপ সৃষ্টি করে অন্য সাবজেক্টে মনোনিবেশ করানো। অথবা সমাজের কোনও বৃহত্তর কাজ করতে গিয়ে সেখানে বলপূর্বক আচার-ব্যবহার করা। এগুলো সবই নীতি সাপেক্ষ এবং শারীরিক বিষয়।
কিন্তু জীবনের শরীর বিষয়ক সমস্ত কর্মকে অকর্মকে বাঁধা গেলেও মানুষ কখনও-ই মনকে বাঁধতে পারেনি। বলা যেতে পারে, পৃথিবীতে সমস্ত কিছুর বন্ধন ঘটলেও মনের বন্ধন ঘটেনা (স্ত্রী ও পুরুষের ভেতর বিবাহ হয় কিন্তু মন আলাদা। প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম হয় কিন্তু মন আলাদা ইত্যাদি)। আজ পর্যন্ত তার এমন কোনও দৃশ্যায়মান হয়নি। মন অর্থাৎ চিত্ত সকলের একমাত্র সত্ত্বা যার পূর্ণ অধিকার একমাত্র তারই। এই অধিকারে কখনও-ই কেউ থাবা বসাতে পারে না। বা বেঁধে-আঁটকাতে পারে না। মন এক অদৃশ্যমান শক্তি হয়েও দৃশ্যায়িত হচ্ছে। ইচ্ছে এবং দৃষ্টির মাধ্যম রূপে কাজ করা। তাহলে দেখা যায়, একজন ব্যক্তির শরীরকে বাঁধা গেলেও তাঁর মনকে কখনও-ই বাঁধতে পারে না। সে- মুহূর্তে বন্ধন কেটে পৌঁছে যেতে পারে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে অথবা এই পৃথিবীর বিস্তৃতি জুড়ে। 🦋
কবিতা /এক
মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়
ফসিল
সমস্ত আকাশ ঘিরে কালো মেঘের দাপাদাপি…
সাংঘাতিক অন্ধকার চাঁদকে শাসন করে
চাঁদের শরীর ছিড়ে নীল নখে জ্যোৎস্না কেড়ে নেয় জলের শালুক জলে মুখ লুকায় কিচ্ছুটি বলে না।
সব স্বপ্ন ঝরে যায় দৌড়ে যায় নিষ্ঠুর বাতাস।
কবি কি ঘুমিয়ে গেছে কবিতার স্বপ্ন দেখে দেখে?
তার মেঘ নীলাঞ্জন মেঘ প্রেমের কবিতা ভুলে
হননের স্পৃহা নিয়ে চাঁদের যৌবন ছিঁড়ে সাত টুকরো করে
আক্রোশ মেটায়
ভয়ঙ্কর থাবা তার শানিত নখর
দেখতে দেখতে চমকে ওঠে বিবশা রজনী।
মেঘ তুই নীল বিষ উগরে দিস উপড়ে নিস ঘরের ছাউনি কি সুখ উদ্বাস্তু করে লুট করে অধরা মাধুরী?
লতায় পাতায় ঝড়ো হাওয়া শাসন তর্জনী বিদ্যুতের খেলা
নদী স্রোত ক্রমশঃ উত্তাল প্রতিবাদী ঢেউয়ে ঢেউয়ে নীরবতা ভাঙে, ব্রেইল অক্ষর থেকে উঠে আসে কান্নার জননী
মেঘ তুই দাঁড়াবি কোথায়?
কেন আক্রমণ এই কেন নির্যাতন?
ধর্ষিতা চাঁদের দেশে তারাদের মিলিত মিছিল।
মহাপরাক্রান্ত মেঘ, মেঘের শিবির কালান্তক অন্ধকারে
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ভাষাহীন এখন ফসিল।
গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
পূণ্যবান আলো
কোনো কোনো মানুষের চোখের গভীরে থাকা
মায়াবী আলোর পাশে
অন্ধকার নিঃশব্দে খেলা করে
প্রতিরোধের অসহ সময় কখনো
স্ববিরোধ নিয়ে এলে
অপরিণত ভাবনাও
দীর্ন হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়
অন্তিম গোধূলি শেষ হয়ে এলে
ব্যক্তিগত বোঝাপড়া
কেমন দুর্বল মনে হয়
যারা আজ তার কোনো কিছুকেই
নিজের মতো ভাবে না
হাতের তালুতে রাখে না কোনো
বোঝাপড়ার আগুন
তারাও একে একে সংশয়ী হয়ে
পুণ্যবান মেলামেশা দূরে ঠেলে দেয়
একটি মায়াবী আলোও হয়ত কোনোদিন
সবাইকে হাস্যময় করে তুলতে পারে
অন্ধকার থেকে খুঁজে আনি
অন্ধকার থেকে তাকে খুঁজে আনি
ভয় পেয়ে সে কোনো পথ খুঁজে পায়নি
তার হাত স্পর্শ করে বুঝি
মৃত্যুর শীতল এখনো তাকে
ছেড়ে যায়নি
প্রথম ভাগের পাতা কতটা পালটে দেয় জীবন
সে কথা বোঝার আগেই
অন্ধকার তাকে বহুদুরে টেনে নিয়ে গেছে
রোদ্দুর কি ঠিক আগের মতই সবকিছুর
উষ্ণতা চাইছে
জটিল কিছুই নয়
পরিবর্ত হাওয়ায় দাঁড়ালে
শরীর শীতল হতে পারে
তাতেও কোনো লাভ নেই লোকসান নেই
কিন্তু সামান্য স্যাঁতসেঁতে ভাবটা কাটানোর জন্যেও রোদ্দুরের বড় প্রয়োজন
তবু তো তাকে খুঁজে এনেছি
বলেছি কিছুই যদি ভালো না লাগে তবে
আর এক অন্ধকার ঘর দিতে পারি তোমাকে যে
খানে সারাদিন কোনো
রোদ্দুরও যাবে না
মনোনীতা চক্রবর্তী
গুজারিশ
শেষ পর্যন্ত তোমাকেই চাই
আমার জ্বলন্ত চিতায় সামগান গাইতে গাইতেও তোমাকেই চাই শুধু তোমাকেই চাই…
রাত্রি ঝলসে যেভাবে সূর্য বুকে ধরে মেঘ
তন্বী শরীরে ভেজা সাদা যেভাবে মাটি ভেজায়… শতচ্ছিন্ন শোক নিয়েও গঙ্গা হাসে যেভাবে,
সেভাবেই তোমাকেই চাই শুধু তোমাকে চাই…
একটার পর একটা সুখ পিষে পা
যেভাবে ঘাস মাড়ায়… সেভাবেই মাড়িয়ো যত খুশি… তবু, খুদ-কুড়ো ভেবে যত্নে বেঁধে নেবো আঁচলে নীরবে… একটার পর একটা যন্ত্রণা চোখে ধরবো
দিও দিও দিও তাবৎ আঘাত যত খুশি… তবু, একবিন্দুও জল আসবেই না
এপারে কখনোই… চেনা লোককে দেখব কবির মত অচেনার ভঙ্গীতে
পাড় ভাঙতে ভাঙতে নদী- হাউ হাউ করে কাঁদে যেভাবে…
মাটি লাঙলকে বুকে যা খুশি করতে দেয় যেভাবে সেভাবেই তোমাকে চাই শুধু তোমাকেই চাই…
বই নিয়ে/এক
আড্ডা দুপুর সান্ধ্য মজলিস এবং নৈঃশব্দ্য তাড়িত প্রেরণা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
কবি রবীন্দ্র গুহ প্রচল রীতির বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসী স্পর্ধায় মোচন করেছেন তার অবিকৃত অভিজ্ঞতা। আঁতাতবিহীন ভিন্নতাই তাঁর রীতি ও প্রকরণ। নিম সাহিত্যের প্রাণপুরুষ তাঁর দ্রোহময় অগ্নিতাপে তাই পরিশুদ্ধ করেন কবিতার মগ্নচৈতন্যের ভাষাভিত্তিক ঘরবাড়ি। ‘জীবনকে জানা মানেই জীবনের প্রতি প্রখর আকর্ষণ নয়’ চিরকালীন ক্ষুধা, কামনা এবং নির্বেদ শূন্যতার এক অমোঘ অলাতচক্রের ভেতর মানুষের প্রতিদিনের আবর্তন অথবা জীবনের তমসাময় জাড্যের ভেতর যে মহতী অসহায়তা তার উপর আকর্ষণ থাক বা না থাক শিল্পময় উন্মোচন জরুরি। এই নির্যাতনের প্রদাহ অথবা চারপাশে ‘পোশাকের তলায়. লুকানো হত্যাকারী মুখোশ’ যেখানে আপোষকামী আমিত্বের ছায়ায়, ফ্রেমে, মুখ, কপাল জুড়ে ঘাম, ব্লগ খুললেই নিজের প্রতি ঘৃণা, নিজের বিরুদ্ধে বিরোধিতা, (নিজের চেহারার রহস্য)
সৃষ্টি, অনুভূতি এবং মানব শরীরের যাবতীয় প্রবাহ অবলম্বিত হয়েই কি কবিতা তৈরি হবে না কি সে খুঁজে নেবে ভিন্নতর মোচড়, নিদ্রাভঙ্গের পর মহাশূন্যের ভোজসভা?
“ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ল আজ মহাশূন্যে ভোজসভা। অনুভব করলাম আমার হাত দুখানি বেজায় লম্বা তথা পা দুটি যুগপৎ ভারি ও দীর্ঘ সর্বাঙ্গ অসমবয়সি।” (মায়া ক্যালেন্ডার)
নৈশব্দের প্রজাপতি বুকের রহস্যভুমিতে সুখের স্থাপত্য ভেঙে চলে ক্রমাগত, যেখানে ভয়প্রবন শরীর তৃষ্ণা নিয়ে নাচে, চোখের চোহদ্দিতে জমাট বাঁধে জীবনের দন্তময় রক্ত। এই নিজস্ব বেদনা অভিমান এবং কখনও কখনও জীবনবিমুখতাও কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে-
”এই রক্তই যাবতীয় হিংসার কারণ জীবনের নিমার্ণে
দুঃখের জলরঙে আঁকা স্তনচিত্র শোষণ চায় দুঃখের জন্য
প্রতিবাদ ছুঁড়তে ছুঁড়তে যে যুবক বাসগৃহ ছাড়ল এখন সে
পথশ্রমে ক্লান্ত কপাল জুড়ে ভস্মের তিলক সারারাত-
সারারাত ক্রোধ জ্বলছে রোমকূপে
একঘেয়ে পুরানো হয়েছে ছদ্মবেশ” (নিজস্ব বেদনা আছে)
এই বেদনাবোধ থেকেই কেশ আলোকিত করে কেউ সামনে দাঁড়াবে, স্বপ্ন থেকে নেমে মানুষের মতো, অথচ স্বপ্ন নয়-
“প্রত্যেকের হাতে বর্শা, কারো হাতে ফুল নেই
ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘাড় উঁচু উটের মতন, ঠোঁটে থু থু শব্দ (নৈঃশব্দ্য তাড়িত প্রেরণা)
১১২ টি কবিতা দিয়ে সাজানো সাড়ে আট ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থ শব্দে ছন্দে বন্ধাহীন। উদ্দামতাই তাঁর স্পন্দনের রহস্য। কবিতার আন্তর্জাতিক ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে তাঁর নিজস্ব প্রাকরণিক কৌশল এবং ভাষার দাঢ্যতা। ঐতিহ্যের নির্মাণ বিনির্মাণের ভেতর দিয়ে শৈলীবিজ্ঞানের উপুর্যপরি উদ্ভাসন কবি রবীন্দ্র গুহের সত্তায় বিচিত্র বিভঙ্গে নিয়ে এসেছে গঠনগত রূপকৌশল এবং বহুবিধ কৌণিকতা। অবগাহনের স্বপ্ন নিয়ে পাঠক ছুঁয়ে থাকেন তাঁর কবিতার উপকূলভূমি। এক অদ্ভুত গতিস্রোতের উদ্দামতা সরিয়ে বোধি এবং চেতনার এক আলোকবিন্দুর অনুসন্ধানই হয়ে ওঠে বিশ্বাসঘন নিশ্চিত প্রাপ্তি। তাঁর কবিতার কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরতে বড় লোভ হয় ১. নিজস্ব বিলাস নিয়ে বর্ণময় আছি, শেষ কবে দুঃখের কথা বলেছি টেলিফোনে মনেই পড়ে না। আত্মায় ছড়ানো মেঘবিদ্যুৎকাচ। আত্মায় গোটা শীতের শ্মশান। ছেঁড়া পালকের স্তুপ। ছত্রাকার প্রেমিকার হাঁটাচলার ছাপ। (দুঃখবিলাসিতার বর্ণবিন্দু)
২. শরীর ক্রমশ উদোমখোলা নষ্ট পশু হয়ে যাচ্ছে, মৃত্যুর বিকল্প শূন্যতা বলে যাকে মনে হয়েছিল খুশিয়ালী আত্মার ক্ষুধা, আঃ কী শীতল সোনাজল (মৃত্যুর বিনয় বেতান্ত) ৩. যে মানুষ আত্মহত্যায় ক্ষিপ্ত তার কথা ভাবো-মৃত্যু বদলে দেয় পোশাক, বদলায় না বুকের জলছাপ (বিশাল চরাচর চুষে)
৪. স্বপ্ন মনে থেকে যায়, অসম্পূর্ণ থেকে যায় শীতকালীন চিত্র, চাঁদ নক্ষত্র গল্পের পাখিরা (দাঁড়িয়ে আছি ছায়াটাকে দেখবো বলে)
শব্দের জ্যামিতিক বিন্যাসে কবি রবীন্দ্র গুহ তৈরি করেন জীবনের উদ্ভিন্ন উদ্ভাস। শব্দব্যবহারের মৌলিকতা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহুবিধ শব্দের উদ্ধার তাঁর কবিতায় প্রোথিত। কথা বলার সপ্রতিভ ভঙ্গিমা, দৃশ্যগত আকুতি নাকি ব্যতিক্রমী আন্তরিক অনুভব রবীন্দ্র গুহের অন্তর্নিহিত স্বরূপ ঠিক কোথায় তা নিরূপণ করা সহজসাধ্য নয় বরং বলা চলে… তাঁর কবিতার নিজস্ব লোকাস ই তাঁর বিশ্বজনীন আলো অন্ধকারের মর্মধ্বনি। বস্তুবিশ্বের প্রত্যক্ষ বাস্তবতা থেকেই তিনি প্রবেশ করেন চেতনার নিউক্লিয়াসে। সেখানে ছদ্মভাস্কর্যের কোন স্থান নেই। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ তাৎপর্যপূর্ণ। পরিচ্ছন্ন মুদ্রণ এবং বাঁধাই বইটির শিল্পরূপকে মহিমান্বিত করেছে।
‘লিখি অন্ধকার, লিখি অবিশ্বাসিনী অক্ষয়ের ডাক
সমস্ত রয়েছে তবু সমস্ত গিয়েছে ভেসে স্রোতে’
লিখি অন্ধকার, কবি কি অন্ধকার লিখবেন? লিখি অবিশ্বাসিনী অক্ষয়ের ডাক। যে অক্ষয়ের উপর বিশ্বাস নেই কবি কেন সেই অক্ষরমালা তুলে নেবেন হাতে? এই লাইনগুলি পড়ে থমকে যেতেই হয় প্রথমে। কিন্তু পরের লাইনগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে
পরিষ্কার হয়ে যায় সবকিছু-” লিখি অন্ধকার, রক্তক্ষরণ… লিখি নিরক্ষর নিশ্চেতন সাদা পৃষ্ঠায়” হ্যাঁ কবি অন্ধকারও লিখবেন, আরোপিত আলোর বৃত্তের বাইরে সাদা কালো সবকিছুই লিখবেন। রক্তক্ষরণ লিখবেন যা জমতে জমতে কালচে হয়ে আসবে একসময়ে। ঠিক অন্ধকারের মতো। শাদা পাতার উপর অন্ধকার থাবা বসালে তা পরিস্ফুট হয়ে উঠবে সহজেই। কিন্তু অবিশ্বাসিনী অক্ষর কেন? এই অক্ষরগুলো একদিন ছিল, এখন হাত ফসকে চলে গেছে দুরবর্তী সময়েরর দিকে। কিছুতেই বিশ্বাস হয়না তারা একদিন সাদা খাতার উপর প্রতিবিম্ব রেখেছিল নিজস্ব অনুচিন্তার। ‘সমস্ত রয়েছে তবু সমস্ত গিয়েছে ভেসে বোতে।’
কবি প্রভাত মিশ্রের ‘পুরানো আখরগুলি’ তাঁর ১৯৭০ থেকে ২০১৬ অবধি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ এবং পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা থেকে নির্বাচিত কবিতার সমগ্র। হাওয়ারাতের কথা, পোকামাকড়দের দেশে, সাজানো সকাল, জলজননী, আড্ডা দুপুরে সান্ধ্য মজলিশ, ভোরে একদিন এবং অন্তসূর্যের মেয়ে আভা কাব্যগ্রন্থগুলি থেকে নির্বাচিত হয়েছে অধিকাংশ কবিতা তবু তার পাশাপাশি রয়েছে অনেক অগ্রন্থিত কবিতাও। কবিতাগুলি পড়তে পড়তে আমার মনে হল কবি প্রভাত মিশ্রের কবিতা শুধু চোখ দিয়ে পড়বার নয়। স্পর্শ, দৃশ্য, গন্ধ এবং শ্রুতিময় রূপের এক অনন্য সৃজনসস্তার তিনি উজাড় করে দিয়েছেন-
‘যা গিয়েছে কাল চৈত্রে তার জন্য ভাবো কেন বসে মিছে?
আমার কঠিন হাত ছুঁয়েছে পাহাড়চূড়া, ভেঙে দেবে মেঘ ও
মমতা।’ (এই পদ্য, জীবন প্রণালী)
জীবন এবং সময় যখন ক্রমেই জটিল আবর্তের দিকে চলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষের অন্তরাসায়নিক সম্পর্ক। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে পরিবর্তিত এই সমীকরণই খুঁজতে চেয়েছেন কবি।
কী কী কারণে ঠিক মানুষের সাথে মানুষের যুদ্ধ হয় প্রতিদিন কী
কী কারণে ঠিক মানুষ মিথ্যা বলে জীবনযাপনে
‘ভাবি’ (কী কী কারণে)
যে জল জীবন দেয় সেই জলের হালুম শুনতে পান কবি। এ শুধু জলের ক্ষেত্রে নয় বন্যার বিধ্বংসী রূপের ক্ষেত্রে নয়। আজকের বদলে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষিতেও অমোঘ সত্য। চরিত্রের দ্বৈতসত্তা শুধু নয় মানবিক চরিত্রের বহুরূপতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চোখের সামনে যে মানুষটি স্বজনের অভিনয় করছে নিখুঁতভাবে সেই আবার হালুম করে উঠছে হিংস্রতায়। মেঘ জমে যাচ্ছে এভাবেই চৈতন্যপথের প্রত্যেক বাঁকে, কৌণিকতায়। ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু।
‘নিরাভরণ সারল্য এবং কেবল গল্পের দিকে তাকাতে তাকাতে আকাশে প্রবল মেঘ তুমি দেখলে যা কিছু, ঢেকে গেল সব’ (ভূতের গল্প) ধ্বংস এবং ধ্বস্ত সময়ের ভেতর এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আত্মপরিচয়, সংবেদনশীল চেতনা এবং মানবতাঋদ্ধ আড়ম্বর থেকে উত্তরণের চিন্তাবীজ “তুমি ধ্বংস থেকে উঠে এসো, হে বালক, ধ্বংস তোমাকে যে গান শেখাবে, সেই গান অবশেষে টিপে ধরবে গলা” (উঠে এসো) 🦋
গল্প
হাঁড়ি
দেবাশ্রিতা চৌধুরী
ভাতের হাঁড়ি উঠানের দুমুইখ্যা চুলায় বসিয়ে ঢাকা দিয়ে পাতার জ্বাল দিচ্ছে মলিনা। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে ভেসে যায় গলা বুক। আয়লায় ঘরদোর সমান কইরা দিলে পর বড়ো কষ্ট কইরা খুঁজতে খুঁজতে এই চরের উপর আইয়া বাস করছিল।টুকটুক কইরা ছনের চাল বাঁশের বেড়ার দুইটা চালা তুলেছে। চরের জমিতে ফসল হয় ভালো, যা বোয় তাইই লকলকিয়ে ওঠে,ফসল দেয়। এই কয় বছরে নান্টুও কষ্টে-সৃষ্টে একটা নাওয়ের মালিক হয়েছে।
_____________________________________________
নান্টুর খালি নৌকা ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে একবার কাছে আসে আবার সরে যায়। চারিদিকে অন্ধকার, চিৎকার, কান্নাকাটি মলিনাকে কোনও কিছুই স্পর্শ করে না।
_____________________________________________
জলে জলে সকাল থেকে মাছ ধরে ওপারে নিয়ে বিক্রি করে চাল,নুন তেল নিয়ে বিকাল বিকাল ফিরে আসে।মলিনার একটা গোলাপী শাড়ির খুব শখ। নান্টু বলেছে খরচ বাঁচিয়ে এনে দেবে। ভগবান বাচ্চা কাচ্চা দেয় নাই তো আমি কী করুম, পাতার জ্বালে কান্না লুকায় মলিনা। পাশের বাড়ির কমলা বৌদি বলে ‘অ মলিনা তুই কার সাথে কথা কস্? মলিনা তোর ভাতের ডেগ খান খুব সোন্দর রে!’ মলিনা ঠিক করে হেসে বলে, ‘আইন্যা দিল কাইল। আসনের সময় হইছে তাই ভাত চাপাই। বৌদি গো কি বলে তুফান আইব? আমার ঘরের মানুষটা এখনও ঘরে আসলো না যে!’ কমলার মুখ শুকিয়ে যায়। ‘মলিনা রে ভাবগতিক ভালো দেখাইতেছে না। এ কেমন শব্দ?’ মলিনা ভাতের ফ্যান ঝরিয়ে নদীর পারে এসে দাঁড়িয়েছে, কমলা বলে, ‘আমাগো খবর তো কেউ রাখে না রে,চরের মানুষ মরলো কি বাঁচলো সেকথা কে জানে?
দু’জনের কথার মাঝখানে অন্ধকারে সহস্র কালনাগিনী ফনা তুলে যেন ছোবল দিতে এগিয়ে আসে। আগুনরঙা বিদ্যুত ঝলসে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। কমলা চিৎকার করে মলিনা নদীর ধারে থাকিস না। ভেতরে আয়। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির দমকেও মলিনা নদীর কাছে থেকে একচুলও নড়ে না। বিদ্যুতের আলোয় দেখে নান্টুর খালি নৌকা ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে একবার কাছে আসে আবার সরে যায়। চারিদিকে অন্ধকার, চিৎকার, কান্নাকাটি মলিনাকে কোনও কিছুই স্পর্শ করে না। নান্টু তাকে যে নরক থেকে এনে সংসার পেতেছে, আবার সেখানে ফিরে যেতে হবে নাকি পোড়া পেটের জন্য!
চর ভেসে যায় অসহায় মানুষের হাহাকারে। সাপ আর মানুষেরা একসঙ্গে আশ্রয় খোঁজে একটু মাথা গুঁজে রাতটা কাটিয়ে দেওয়ার। নদীর উত্তাল জলে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ভর দিয়ে মলিনা এগিয়ে চলেছে নান্টুকে খুঁজে আনতে, আনবেই। জলের নিচে তলিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত হাঁড়ি হাতছাড়া হয়নি।🦋
কবিতা /২
গৌতম রায়
প্রতিবারই ভক্তাফুল কুড়োই
সুচিতা সরকার
আমার প্রথমা বলে কিছু নেই
আমি কারোর প্রথম প্রেম নই।
আমি কারোর প্রথম স্পর্শও নই।
আমি কারোর সেই প্রথম গন্ধ নই,
যে বার বার স্মৃতিতে ফিরে আসে।
আমি সেই প্রথম চোখ নই
যার দিকে চেয়ে কারোর আনকোরা
স্বপ্নগুলো পেখম মেলেছে।
সময়ের জলভ্রমরীতে আটকে থাকা
আমি হিসেবের বাইরে রাখা দুটো হাত।
নুইয়ে পরা মাথার জন্য
আমি সেই অপেক্ষনীয় কাঁধ।
নতুন স্বপ্ন দেখার দৌড়ে,
আমি সেই অপ্রত্যাশিত সুপ্তি।
আমি শেষের কবিতা,
প্রথমা বলে আমার কিছু নেই।
মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
সময়
কিছুটা সময় ধার করতে চাই অনন্তের কাছে
যার উপর দাবি হবে কেবল আমার…
অনায়াসে চলমান কাজ থামিয়ে হয়তো চেয়ে থাকব নীল পাখিটার দিকে
ঝোড়ো হাওয়ায় যখন বাদামী পাতা মাটির কোলে ঝরে পড়বে,
তখন তার সাক্ষী থাকব শুধু আমি…
সূর্য ওঠা আর অস্ত যাওয়ার রঙ ঠিক কতটা আলাদা
তা তো আজও জানা হলো না!
জীবন অস্তমিত হওয়ার আগে একবার
পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখে যেতে চাই উপত্যকার সোনা রঙ
নদীর উৎসমুখ থেকে ছন্দ মিলিয়ে বয়ে যেতে চাই মোহনায়
তারপর? আরও কিছু চাই বৈকি!
গভীর রাতের তারা হয়ে ফুটতে চাই…
ক্লান্ত যে মানুষটা সারাদিনের শেষে যুদ্ধ হেরে একটিবার আকাশপানে তাকাবে,
তাকে কানে কানে বলতে চাই জীবন বড় সুন্দর!
শুধু একটু সময় ধার করে নিতে হয় জীবিত থাকার জন্য।
ফাল্গুনী চক্রবর্তী
জিপলাইনিং
শিলং-এর আকাশে
ব্রকলীর মত বসেছে
মেঘের হাট
কুয়াশার ভেতর ঢুকে পড়ছি
গাড়ির আয়নায় টপটপ
আর ঝিরঝিরির মাঠ
রাস্তায় পাইনের সমান্তরালেরা
ঝাপসা হয়ে আছে রংমিনারে অফুরাণ সময়
করোনার সীটব্যাল্টে
ফাঁকা রাস্তা আর তালাবন্ধ রেঁস্তোরায়
তোমার প্রকৃতি আরও
নিখুত হয়ে
চোখের মণি কাড়ে
একটি সমুদ্র সফেনএ
নীল হয়ে নামে ইচ্ছের টুকরি
সন্ধ্যার থালায় সাজানো
আগামী কালের রোস্টেড্ রোদ
বানীব্রত
বহ্নিশিখা
বারুদের স্তুপে বহ্নিশিখা হও
দাবানল ছড়িয়ে দাও দিকে দিকে
পুড়িয়ে দাও মিথ্যের মুখোশ…
জ্বলে উঠুক সত্যের বাতি
কালের অন্ধকার সরিয়ে
মুখ ঢাকুক লজ্জারা
পোড়া বারুদের ছাইয়ে
ধর্ষিত হোক অহঙ্কার
তবুও যদি সত্য ও শান্তি ফেরে
লেলিহান শিখার হাত ধরে
শুষ্কতায় সজিবতা
আসমুদ্র জলরাশির মতো ভেসে যাওয়া প্রেম
বক্ষ বিভাজিকায় উৎসারিত, তরঙ্গিত জলধারায়
বয়ে যাওয়া ক্ষণে একবার জড়িয়ে নাও
মরুতটের শুকনো বালুরাজিকে।
ভিজিয়ে দাও স্নেহের আলিঙ্গনে,
উষ্ণ ঠোঁটের লাস্যময়ী লাভায়
কাজল কালো মনমোহিনী রুপে,
বেঁধো মায়া ডোরে,কাঙাল ভালোবাসায়
শুষ্ক বনানীর দাবানল শান্ত হোক
বজ্র কঠিন পাহাড় হোক বৃষ্টিস্নাত
মাধবীলতা ফুটুক ভেজা পাঁচিলের গায়ে
কুহুতান উঠুক গোধুলি বেলায়,
একতারার সুরে
হাল ছাড়া নৌকোরা বাঁধা পড়ুক নদীতটে
কোন এক উজানে।
পরাণ মাঝি
কে আমাকে হারায়
পদার্থ কিম্বা অপদার্থ সবটাই আমি এবং বলতে পারো আমি অর্থহীনও বটে
পরমার্থের পথে পথে করি ফেরি। তাই বলতে পারো ব্যর্থ
শক্ত সামর্থ্য
রাতে দিনে খুঁজে ফিরি জীবনের সত্য
বর্ণমালার মালা গেঁথে গেঁথে পরাই কবিতার গলায়
বলো দেখি জননী – কে আমাকে হারায়?
শামরুজ জবা
ভুল প্রেম
কত প্রাণ দেখলাম এ ধরায়
কত বিরহে, কত আনন্দে
কত বসন্তে- বৈশাখে- বরষায়,
সুখে-দুঃখে কত হাস্য- লাস্য উপমায়!
এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক-
স্বপ্নে-গন্ধে অপরূপ মধুরিমায়।
প্রেমিক যে জন বেসেছে ভাল
দেখেছি দিনশেষে-
চোখে তার ঘন রাতের কালো
কখনো আবার বিপুলা অশ্রু রাশি রাশি,
কখনো অকারণ জীবনের বলিদান;
আস্থা- অহম রুগ্ন- শীর্ণ পরবাসী-
কোন এক অচেনা মোহনায়
জানিনা এর শেষ কখন কোথায়।
কখনো অজান্তে-
ঋষিবর প্রেমিকের অবুঝ চোখের জলে
আমার দুটি চোখ ভেসেছে ব্যথায়
জ্বলেছে বুনো আগুন কোমল বুকের তলে।
ভেবেছি একা-কোন সে মোহ মায়ায়
নিরন্তর ভাসা এই ভালবাসায়!
মাঝে মাঝে মনে হয়-
বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,
বহু দিবসের সুখে- দুঃখে আঁকা
এই প্রেম প্রেম খেলার করি প্রতিবাদ;
আবার ভাবি গোপনে নিরালায়-
কেন মিছে এত ক্রোধ, এত দ্রোহ?
যার যা আছে থাক না তা থাক-
ধীর পায়ে নেমে আসা শুদ্ধতায়।
আজ বলি আপনার মনে একা-
থেমে যাক ভুল প্রেম, ব্যথা- ক্রন্দন
সত্যালোকে ভরে থাক জীবন
ছিঁড়ে যাক মরীচিকাময় মিছে বন্ধন।
ডালিয়া মুখার্জী
ফিরে আসা
ছেড়ে যাওয়া সহজ নয়…
ফিরে আসি বারবার…
হারিয়ে ফেলেছি জানি…
তবু ফিরে পাওয়ার আশা আর একবার…
মন খারাপের রাতগুলো একলাই কাটে…
স্মৃতিগুলো কষ্ট দেয়…
স্বপ্নগুলো লাগাম ছাড়া…
একই পথে হাঁটে…
মেঘ জমে মনের কোণে…
বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়…
আবেগগুলো লুকোনো থাকে…
প্রকাশ পায় না ভাষায়…
দোদুল পার্থ
প্রথমা–
আমি সন্ধ্যার আকাশে ঘরেফেরা কাকের চঞ্চুতে এক টুকরো খড়কুটো-
গোধূলির খসেপড়া একখণ্ড ক্লান্ত ছায়া,
দ্বিধার ভেতর জেগে ওঠা আমি সেই পরাজিত মুখ, বীজের অঙ্কুরে অমাক্রোধ।
প্রথমা, যদি ডাকো যৌবনের প্রিয় নাম ধরে-
তবে শেষবার আমি মুখোমুখি দাঁড়াবো তোমার।
চেয়ে দেখো,
পরিত্যক্ত নগরীর শেষ অন্ধকারের আমি সেই প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষ-
চৈত্রের তিতির পাখির মতো তৃষ্ণার্ত আহত গোলাপ,
রাতের নিঃসঙ্গ পাখির মতো একা, বড় একা,
আমাকে দু’দণ্ড প্রচ্ছন্ন ভালোবাসা দাও।
শিরিন আক্তার
তোমার সন্তান
খুব মনে পড়ে সেই সব দিনগুলো
যে দিনগুলোতে তুমি অপেক্ষায় ছিলে,
তোমার সন্তান এই বুঝি এলো ঘরে
সেই কখন মেয়েটা গিয়েছে কলেজে
কেন এখনো ফিরে না মন যায় পুড়ে।
কিছু খেয়ে যা মা ! রোগ বাঁধাস না!
তোর অসুস্থতা দেখে সইতে পারি না!
মারে! সাবধানে যাস! গিয়েই জানাস!
পিছু পিছু ঘুরে ঘুরে মা!কেউ বলে না!
মাগো! এ মনে লেগেছে মায়া চেয়ে ক্ষুধা
একটু এসে দাওগো মা অমিয় সুধা!
চারিপাশ শূন্য মোর লাগে একা একা
তুমি ছাড়া কেউ আর দেয়না ভরসা।
এই রিক্ত ধরা তলে নাই ভালোবাসা
তামাশায় ব্যথা দেয় স্বার্থের দুনিয়া,
মা বিহনে পৃথিবীতে নিজের কেউ না।
মনি জামান
হাঁটি হাঁটি পা পা
গত বছর যে মেয়েটি জন্মেছে সে আজ
কতটা হাঁটতে শিখলো,
হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু
করে আগাই পৃথিবী।
মোমিকৃত সভ্যতার আঁচলে হাঁটছে
একটা ভয়ঙ্কর প্লাবন,
ভাসাবে নিরন্তর হিসেবটা কারো জানা
নেই।
দেওয়ালটার বয়স হলো বালু সিমেন্ট
খসে পড়েছে ঝর ঝর করে,
কথা ও সুর করে গীতিকার, অহীর
কিতাব কণ্ঠে তার নবুয়ত।
নিরিবিচ্ছিন্ন একটা হাসি সেঁটে আছে
ঐ ঝুলান্ত পূর্ব পুরুষের ছবিটায়,
ইতিহাস সমাপ্তি নির্মেঘে বজ্রপাত।
এসেছে সে সঙ্গম আলিঙ্গনে জানালা
ছুঁয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ রাত,
হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় যেন অন্ধ চোখে পূর্ণিমা।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু
এগোই পৃথিবী,গত বছর যে মেয়েটি
জন্মেছে সে আজ কতটা হাঁটতে শিখলো।
সামরিন শিরিন
অবিরত ট্রেন
সারারাত মাথার ভেতরে এক ট্রেন চলে।
ঝমঝম -ঝিকঝিক-ঝিকঝিক!
সে ট্রেন কোথায় যায়,
কোথায় শেষ থেমে যাবে
কিচ্ছু জানি না!
জানতে চাই
জানা হয় না।
শুধু অবিরত চলতে থাকে
ঝমঝম -ঝিকঝিক -ঝিকঝিক…
মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ হুইসেল,
আমাদের জীবনে হঠাৎ কিছু রোগ, শোক বা
থেমে পড়ার মতো।
কনকনে বেদনার মতো!
সারারাত এক অদ্ভুত ট্রেন ছুটতে থাকে!
সেই ঘুনঘুনে শব্দটা ভারি নেশাতুর,
সম্মোহনী!
ঝিকঝিক-ঝিকঝিক…
একসময় ভীষণ ঝিমিয়ে তোলে
একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।
জেসমিন ইসলাম
সময়ের স্মৃতি
আজ বড় একা মনে হয়
কথা ছিল…।
এই সাগরের তট ধরে
গোধূলি নীলিমার চিবুক ছুঁয়ে
হেঁটে যাব দূর বহুদূর
আমি ঠিকই হাঁটছি আনমনে…।
একলা বসে ভাবছি অনেক কথা
পুরনো দিনের সোনালী স্মৃতির
কান্না-হাসি ব্যথা
মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে সুখ
ফেলে আসা ক্ষণগুলো মুহূর্তে
হৃদয়ে ভীড় করে।
তাই তো আজও স্বপ্নগুলো খুঁজি
যাঁরা আছে আজও জীবনের সাথে
ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে
তারা আজ গেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
অজানা কোন ঝড়ে….।
অবুঝ অশ্রু কণায়
কিছু সাজানো নাটক কিছু কঠিন বাস্তব
সময়ের স্রোতে বড় অচেনা
পুরোনো স্মৃতিটা তবু বেঁচে থাকে…এই মনে ।
এখনো ভালবাসি নদীর পারে সূর্যাস্তে
প্রথম দেখা মানুষটাকে
আজও মনে মনে খুঁজি অবচেতন মনে
প্রথম প্রেমের আনন্দময় মুহূর্তগুলো
কষ্ট দেয়…।
লুকিয়ে দেখা করার অস্থিরতা আর ভয়
পোস্ট মাস্টারের প্রতিক্ষায় সময় গোনা
আজ ও বিভোর থাকি সুখ স্মৃতির বাগিচায়।
বেদনাময় স্মৃতিগুলো মনে পড়ে আনমনে
অকারণে এক মুঠো ভালবাসা আজও খুঁজি
হঠাৎ শীতল দমকা হাওয়া
শিহরণ জাগায় হারিয়ে খুঁজি নতুন করে।
কিছু অপূর্ণতা-
কিছু সহজ অংক, কিছু যেন গোঁজামিল
পুরোনো স্মৃতিটা তবু বেঁচে থাকে
এ-মনে!
এম. এ. করিম
হাফ ডজন প্রেম
করেছি প্রেম হাফ ডজন
আমি এক মহাজন
নয় কভু রাজা
প্রেম প্রেম খেলা করে
পাই শুধু মজা,
প্রথম প্রেম দোলা দিল
মাধ্যমিকের বেঞ্চ এ
ভাব বিনিময় হতো মোদের
বি এস সি অংকে প্রাইভেটে,
মাঝ খানের প্রেম গুলো
আসা আর যাওয়া
চটপচি পুচকা দোকানে খাওয়া
হাসাহাসি আর কত গান গাওয়া,
শেষের প্রেম টা বড়ই করুন
মেয়ের চেহারা কি দারুন
দেখে যেন মনে হয় তাহারে
কাজল এর গোডাউন
এমন ভিষন কালো সে-
বলত কথা হেসে হেসে
কলেজের বাদাম তলার নিচে
বিকেলের আড্ডাতে।
সীমা সোম বিশ্বাস
আগ্নেয়গিরি
বহুদিন পর আজ হিসাব মিলাতে বসে
মনে হলো তোমার দেওয়া সম্পদ
যেখানে গচ্ছিত আছে,
তা শুধুই শব্দ আর ছবির বুননে
কিছু মায়ার খেলা…
আমি তোমাকে দিতে পেরেছি
ভোরের তুলসীর সুবাস,
দিয়েছি এক চিলতে শীতের মিষ্টি রৌদ্র,
ভরা চৈত্রের উষ্ণতা, যে উষ্ণতায়
তোমার শ্বেতচন্দনও গলে গলে পড়েছে। আবার কখনো দিয়েছি নীলকণ্ঠ
পাখি আর ফুলের বাগানের
শান্ত স্নিগ্ধ হাওয়া,
তোমার উত্তপ্ত হওয়া শরীরও
শীতল অনুভব করেছে কিংবা
গভীর রাত্রে একাকিত্বে উথাল-পাথাল হওয়া তোমার সমুদ্র গর্জনকেও
করেছি শান্ত !
তারপর তারপর তুমি অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেলে
নাকি নিজেকে আড়াল করলে জানি না?
ভালোবাসার আশায় দীর্ঘ পথ
অপেক্ষা করতে করতে
আজ বুকের মাঝে ব্যথা জমে জমে
হয়তো একদিন আগ্নেয়গিরি বেরোবে
তবু কেন যে মাঝে মাঝে
তোমার ওমে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে
যেখানে এক মনে তুমি বেহালা বাজাবে যে তারের স্বরে কবিতা আর আমি
কখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাব,
আর আমার আগ্নেয়গিরি তোমার বজ্রপাতের…।
বই নিয়ে /২
ক্যামেলিয়া ও অজ্ঞাতবাসের শেষ পর্ব
শাশ্বত পাঠক

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
🌞সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী… ই-মেল : sasrayanews@gmail.com
