Sasraya News

Wednesday, March 12, 2025

Siraj ud daulah : এক বছরের নবাব

Listen

উমিচাঁদের বাড়ি চড়াও হল ইংরেজরা। মহিলারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হল। ওদিকে কলকাতা খালি করে পালাচ্ছে চাকরবাকর আর তাদের দিশি মনিবরা। গোবিন্দরাম, রতন সরকার, শোভারাম তখনও অবশ্য পড়ে আছে মাটি কামড়ে। যুগল অবশ্য নড়াচড়ার ব্যাপারে উদ্যম দেখায়নি। খবর এল নবাব হুগলি পেরিয়েছেন। হইচই পড়ে গেল ইংরেজ অন্তঃপুরে। লিখেছেন : বৈদূর্য্য সরকার

 

ছবি : সংগৃহীত

 

লিবর্দির নয়নের মণি নাতি সিরাজ। আলিবর্দি আর নানীজানের আদরে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। নানারকম নেশা আর মেয়েমানুষে তার আগ্রহ অতিমাত্রায়। সুন্দরীদের জন্যে খরচে কার্পন্য করে না সে। দাদুর থেকে আদায় করেছে হীরাঝিল প্রাসাদ। সেখানে সুরা আর নারী নিয়ে মোসাহেব পরিবৃত হয়ে বসে সিরাজ। তার শরীরে দুর্বিনীত ভাব আর মনে যুদ্ধবাজ যৌবন। এর আগে নবাবের পাশে থেকে বহু যুদ্ধে অংশ নিয়েছে সিরাজ। তাই কোনও ব্যাপারে এতটুকু নড়চড় হলেই মৃত্যদণ্ড। খেলার ছলে নেয় সে মৃত্যুকে।
যদিও হীরাঝিলে বসে সিরাজ বুঝতে পারে, আগামীতে তার মসনদে বসার ব্যাপারে বাগড়া দিচ্ছে নবাবের বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম ও জামাই নোয়াজিস। ঢাকার নবাব নোয়াজিস হিন্দু মুসলিম সবাইকে অকাতরে দানধ্যান করছেন। টাকা জোগাচ্ছে ঢাকায় থাকা তার প্রতিনিধি রাজবল্লভ। আর তাদের সঙ্গে আছে ইংরেজ কোম্পানি। তারা এদেশে বিনা শুল্কে ব্যবসা করছে। অথচ ফরাসি ওলন্দাজ দিনেমাররা শুল্ক দিচ্ছে যথেষ্ট। ইংরেজদের নামে দাদুকে বহুবার বলেছে সিরাজ, নবাব গা করেননি। আলিবর্দির শেষ অবস্থা মনে করা হলেও তিনি অশক্ত হয়ে বেঁচে থাকলেন কিছুদিন। বরং হঠাৎ মারা গেল নোয়াজেস।
মৃত্যুর আগে আলিবর্দি পড়লেন মহা সমস্যায়। সিংহাসনে বসাবেন কাকে? থাকার মধ্যে আছে কেবল মেজো মেয়ের ছেলে শওকত জঙ্গ। জামাইরা মৃত। আর সিরাজ এখনও অবিবেচক। তার ওপর প্রজা থেকে আমীর ওমরাহ্‌রা হাড়ে চটা। সিরাজ ওদিকে ব্যস্ত হয়ে উঠছে, তাকে সিংহাসনে বসাতে দেরি হচ্ছে কেন! দাদু তাকে বিহারের নবাবী দিলেও সেখানে রাজা জানকীরাম আসল শাসক। জানকীরামকে সবক শেখাতে সিরাজ ছুটেছিল পূর্নিয়ার দিকে। খবর পেয়ে নবাব উড়িষ্যা থেকে ফিরে এলেন মুর্শিদাবাদে। তার চিঠি পৌঁছল সিরাজের কাছে। কিন্তু সিরাজ মানতে চায় না দাদুর উপদেশ। পূর্ণিয়া জয় করতে গিয়ে সিরাজ বন্দী হল জানকীরামের হাতে। আলিবর্দি গিয়ে পৌঁছলেন সেখানে। বহু উপদেশের পর নাছোড় সিরাজের জেদাজেদিতে বাধ্য হয়ে নবাব ঘোষনা করলেন— সিরাজই তার উত্তরাধিকারী।
তারপর সিরাজ প্রথম এল হুগলিতে। মহারাজা নন্দকুমার আছে এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত। ফরাসি আর দিনেমাররা উপঢৌকন নিয়ে এল সিরাজের সামনে। সবার শেষে এল ইংরেজরা। কিন্তু তাতে মন গলল না সিরাজের।
মুর্শিদাবাদে ফিরে ঘসেটি বেগমের প্রণয়ী হোসেন কুলীকে হত্যা করল সিরাজ। সে যে তার নানীজানের কথায়, লোকে জানল না। তবে রাজবল্লভ ভয় পেল। তার সাথেও ঘসেটি বেগমের মাখামাখি খুব। রাজবল্লভ সম্ভ্রান্ত লোকজনকে খেপাতে লাগল সিরাজের বিরুদ্ধে। তার ওপর ইংরেজরা তো আছেই। কুশলী রাজবল্লভ ছেলে কৃষ্ণবল্লভকে টাকাপয়সা ধনসম্পত্তি দিয়ে ঢাকা থেকে পাঠিয়ে দিলেন ইংরেজদের আশ্রয়ে কলকাতায়। তবে নিজে বাঁচতে পারলেন না সিরাজের হাত থেকে। সিরাজ তাকে বন্দী করল টাকা তছরুপের ব্যাপারে। যদিও সে টাকা উদ্ধার করা গেল না। সেসব কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ল কৃষ্ণবল্লভ।
দীর্ঘ রোগভোগের পর আলিবর্দি কবরে গেলেন। চারদিকে শোকের মধ্যে সিংহাসনে বসল সিরাজ। তরুণ নবাবের লাবণ্যময় মুখে তখন জটিল রাজনীতির অঙ্ক। প্রথমেই যেটা করলেন, রাজদরবারে নিজের লোকেদের বসালেন। আর কলকাতার ইংরেজদের বাড়বাড়ন্ত থামানোর প্যাঁচ কষতে লাগলেন।
কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান ওয়াটসের ডাক পড়ল দরবারে, কৈফিয়েত চাওয়া হল কলকাতার দুর্গ তৈরির ব্যাপারে। নবাব সঠিক উত্তর পেলেন না। তার চিঠির জবাব এল না কলকাতা থেকে। নবাব লোক পাঠালেন কলকাতায়। দাবী— কেল্লা নির্মাণ বন্ধ করা, মারাঠাদের জন্যে কাটা খাত বোজানো এবং কৃষ্ণবল্লভকে নবাবের হাতে প্রত্যার্পন। চর নারান সিংহ এসে উঠল বণিক উমিচাঁদের বাড়ি। উমিচাঁদ শিখ হলেও বাংলার বুকে ইংরেজদের দালালি করে বহু টাকা করেছে। রাজকীয় তার হাবভাব। তার প্রাসাদ সৈনিকরা পাহাড়া দেয়। দেশি লোকেদের মুখের কথায় সে রাজার সম্মানই পেয়ে থাকে।

 

——-

সিরাজ যুদ্ধ জয় করে মেতে উঠলেন উদারতার খেলায়। মুক্তি দিলেন বন্দীদের। মানিকচাঁদ পেল দুর্গের ভার। ষাট পয়ষট্টি জন নজরবন্দী হয়ে থাকল দুর্গে। তবে মিলল না ইংরেজদের কোনও টাকাপয়সা বা সম্পত্তির হদিস। বিরক্ত নবাব সেনাদের আদেশ দিলেন যথেচ্ছ ভাঙচুরের। ইংরেজদের কলকাতা ছেড়ে যেতে বলা হল। কলকাতার নাম পালটে সিরাজ দাদুর নামে আলিনগর রাখল। তারপর নবাব ফিরে গেলেন মুর্শিদাবাদের দিকে।

——-

নারান সিংহের আনা চিঠি নিয়ে উমিচাঁদ ইংরেজদের কাছে পৌঁছল। ওদিকে নারান সিংহ ছদ্মবেশে শহরে ঘুরতে গিয়ে ধরা পড়েছে ইংরেজদের হাতে। নবাব ততদিনে প্রস্তুতি নিয়েছেন পূর্ণিয়া যাওয়ার।
রাজমহলে নবাবের পায়ে গিয়ে পড়ল নারান সিংহ। নবাবের দূতকে অপমান! তার মানে স্বয়ং নবাবকেই অগ্রাহ্য করা। রাতারাতি পথ পাল্টাল নবাবী ফৌজ। কাশিমবাজারে পৌঁছল তারা। ইংরেজদের দুর্গে তখন সাজোসাজো রব। সামান্য ক’টি সেনা নিয়ে তারা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করল। তবে যুদ্ধ হল না তখন। নবাব আদেশ দিলেন দুর্গ ভেঙে ফেলার। কুঠির গোমস্তা ওয়াটস পড়ল মহা ফাঁপরে। শেষপর্যন্ত সে নবাবের মুচলেখায় সই করতে বাধ্য হল। তাতে লেখা আছে, পেরিনের দুর্গ ভাঙতে হবে। আত্মগোপন করে থাকা নবাবের কর্মচারীদের ফেরত পাঠাতে হবে। আর ব্যবসার জন্যে শুল্ক দিতে হবে। নবাবের ইচ্ছেতে কাশিমবাজার কুঠিও দখল করা হল। এরপর সিরাজ ঘোষনা করল, কলকাতা দখল করতে হবে। প্রবীণরা আপত্তি করলেও কারও কথায় কর্ণপাত করল না সিরাজ।

 

ছবি : সংগৃহীত

 

তিরিশ হাজার সেনা কামান বন্দুক নিয়ে নবাব চলল কলকাতার দিকে। ঘোর গরমের দিনে কলকাতায় হুলস্থূল পড়ে গেল আক্রমণের খবরে। মাত্র শ’তিনের সৈন্য সেখানে। ক’য়েকজন গোরা সৈন্য বাকিরা অধিকাংশ অনভিজ্ঞ। জাহাজি গোরাদের নিয়ে ভরা হল সৈন্যদল। ফরাসি ডাচদের থেকে কোনও সাহায্য এল না নবাবের ভয়ে। মাদ্রাজে খবর দিয়েও সৈন্য আসার কোনও ব্যবস্থা হয়ে উঠল না। শেষপর্যন্ত গর্ভনর ড্রেক কামান সাজাল আর দুর্গে মাসদুয়েকের খাবার জমা করা হল।
কেল্লার অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ক’য়েকটা কামান বসানো হল। পেরিনের বাগানের সামনে নির্মীয়মান দুর্গে কামান বসিয়ে জনা পঁচিশ সৈন্য নিয়ে পাহারায় বসল পিকার্ড।
খানিকটা প্রস্তুতি সেরে ইংরেজরা প্রতি আক্রমণের রাস্তায় হাঁটল। ভাগীরথীর পশ্চিম কিনারে নবাবের থানা দুর্গ আক্রমণ করল তারা। দখল হল থানা দুর্গ। তবে দু’দিনের মধ্যেই হুগলি থেকে ধেয়ে এল নবাবের সেনারা। প্রাণভয়ে পালাল ইংরেজরা।
নানা রটনার কারণে ইংরেজরা খড়্গহস্ত হয়ে উঠল দু’জনের ওপর। উমিচাঁদ আর রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণবল্লভ। দু’জনকে আটক করা হল দুর্গে। উমিচাঁদের বাড়ি চড়াও হল ইংরেজরা। মহিলারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হল। ওদিকে কলকাতা খালি করে পালাচ্ছে চাকর-বাকর আর তাদের দিশি মনিবরা। গোবিন্দরাম, রতন সরকার, শোভারাম তখনও অবশ্য পড়ে আছে মাটি কামড়ে। যুগল অবশ্য নড়াচড়ার ব্যাপারে উদ্যম দেখায়নি।
খবর এল নবাব হুগলি পেরিয়েছেন। হইচই পড়ে গেল ইংরেজ অন্তঃপুরে। শেষপর্যন্ত বরানগরে এসে থামলেন নবাব। মীরজাফর সৈন্য নিয়ে এগোলেন চিৎপুরে খালের কাছে। কিন্তু সেই সরু সাঁকো দিয়ে হাতি ঘোড়া কামান পেরোবে না। রাত কাটাতে হল সেখানে। তার মধ্যেই পেরিন পয়েন্ট থেকে ইংরেজরা আক্রমণ করে বসল পিকার্ডের নেতৃত্বে। নবাবের ফৌজ পালাল পায়রাডাঙার দিকে। উমিচাঁদের বিশ্বস্ত জগন্নাথ সিংহ নবাবকে পথ দেখাল মারাঠা খাল পেরিয়ে শিয়ালদহের দিক দিয়ে। নবাব আশ্রয় নিলেন হালসিবাগানে উমিচাঁদের বাড়িতে। সৈন্যরা বড়বাজার পৌঁছে বাড়িঘর দোকানপাটে লুঠপাট শুরু করে দিল। ইংরেজরা লালবাজারের দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করল। কিন্তু তাদের কামানের গোলাবর্ষনে ভাঙা পড়তে লাগল বড় বড় বাড়িগুলো। গুলিতে মরতে লাগল নিজেদের লোকেরাই। ফলে পালাতে লাগল ইংরেজরা। দুর্গের মধ্যে ঢুকে গেল সৈন্যরা। নারীদের পাঠিয়ে দেওয়া হল ভাগীরথীতে রাখা জাহাজে করে। গর্ভনর ড্রেক পলাতক, সেনাপতি মিনসিনও পালাল অন্ধকারে নদী বেয়ে। নেতা বলতে আছে হলওয়েল। পরাজয়ের সম্ভবনায় সবাই ততক্ষণে চুপ মেরে গেছে। নবাবী সৈন্যরা দুর্গ ঘেরাও করে এগোতে গিয়ে কিছু মরল। তারপর ইংরেজরা মরতে লাগল পটাপট। শেষপর্যন্ত হলওয়েল বন্দী উমিচাঁদকে খাড়া করে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করল। শান্তি পতাকা উড়ল কিন্তু ততক্ষণে ভেঙে পড়া দুর্গদ্বার দিয়ে নবাবের সৈন্যরা ঢুকে পড়েছে দুর্গে। হলওয়েল অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য হল।
সিরাজ যুদ্ধ জয় করে মেতে উঠলেন উদারতার খেলায়। মুক্তি দিলেন বন্দীদের। মানিকচাঁদ পেল দুর্গের ভার। ষাট পয়ষট্টি জন নজরবন্দী হয়ে থাকল দুর্গে। তবে মিলল না ইংরেজদের কোনও টাকাপয়সা বা সম্পত্তির হদিস। বিরক্ত নবাব সেনাদের আদেশ দিলেন যথেচ্ছ ভাঙচুরের। ইংরেজদের কলকাতা ছেড়ে যেতে বলা হল। কলকাতার নাম পালটে সিরাজ দাদুর নামে আলিনগর রাখল। তারপর নবাব ফিরে গেলেন মুর্শিদাবাদের দিকে।
ইংরেজরা তখন চলেছে ফলতার পথে। তাড়া খেয়ে বনবাদাড় পেরিয়ে ইংরেজরা উদ্বাস্তুর মতো কোনওরকমে পৌঁছল সেখানে। কাছাকাছি দোকানপাটের সুবিধে নেই। ডাচরা কাছাকাছি আছে আর আছে একটা ভাঙাচোরা মাটির কেল্লা। সংলগ্ন কতকগুলো গুদামঘরে রাত্রিবাস। তবে ফরাসি ডাচরাও বিশেষ সাহায্য করতে ভরসা পাচ্ছে না। ইংরেজদের নিজেদের মধ্যে চলছে দোষারোপ আর পাল্টা দোষারোপের পালা।
তার মধ্যেই অবশ্য উমিচাঁদের আশাব্যাঞ্জক চিঠি এসে পৌঁছল। জগৎশেঠের সাথে গোপনে যোগাযোগ হতে লাগল। মানিকচাঁদও বশীভূত হল উমিচাঁদের প্রভাবে।
ওদিকে বিজয়ী নবাব ফিরে যেতে মতিঝিলে উঠেছে নাচগান নেশার তুফান। তার মধ্যে হলওয়েল মুক্তি পেল। বিধ্বস্ত হলওয়েল গিয়ে পৌঁছল ফলতায়। দিল্লিতে বাদশাকে চিঠি পাঠালেন গর্বিত সিরাজ— এত বড় যুদ্ধ-বিজয় এর আগে কেউ দেখেনি এই মুলুকে।
ক্লাইভ ততদিনে মাদ্রাজ থেকে যুদ্ধজাহাজ ও সৈন্যসহ এসে পৌঁছেছে, চিঠি-চাপাটিতে বোমাবাজি শুরু করেছে। সে চিঠি মাণিকচাঁদের হাতে পড়ল। চিঠির বয়ান পড়ে নবাবের সামনে তা রাখার সাহস হয় না মানিকচাঁদের।
শেষপর্যন্ত সসৈন্যে কলকাতার দিকে যাত্রা করল ক্লাইভ। মাঝে বজবজে নামল স্থলবাহিনী। মানিকচাঁদ সেনা নিয়ে যাত্রা করল বজবজের দিকে। যদিও ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনীর তখন অন্যরূপ। বজবজের কেল্লা হাতে এসে গেল সহজে, ক্লাইভ এগোলেন কলকাতার দিকে। তবে যাওয়ার সময় বজবজের কেল্লাটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেলেন। মেটেবুরেজের দুর্গ, তারপর থানা দুর্গ দখল করে কামানগুলো অধিকার করল ইংরেজরা।
অবশেষে কলকাতায় ঢুকে পড়ল ক্লাইভের সৈন্যরা। গর্ভনর হয়ে বসল ড্রেক সাহেব। ফলতায় শুরু হয়ে গেল আনন্দ উৎসব। কলকাতায় দল বেঁধে ফিরে আসতে লাগল সাহেবরা। মেরামত করে আবার আশ্রয় নেওয়া গেল কেল্লায়। শুধু ক্লাইভ বরানগরে থেকে গেলেন একটা ছোটখাটো সেনাচৌকি করে।
ওয়াটসনের সম্মতিতে এবার ক্লাইভের পরিকল্পনা পাল্টা হামলার। কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ করেছে নবাব, তার জবাব দিতে চলেছে যুদ্ধজাহাজ ব্রিজওয়াটার। তার বিরাট চেহারা দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ। কিলপ্যাট্রিকের নেতৃত্বে হুগলির দেশি মহাজনদের জাহাজে ফায়ারিং শুরু করল ইংরেজরা। আশপাশে কিছুক্ষণের মধ্যে যেন একটা হুলস্থূল কাণ্ড বেঁধে গেল। বহু লোক আর্তনাদ করে ভূমিসজ্জা নিল। হুগলির সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা নন্দকুমার বুঝল, তার অধীনস্ত সৈন্যদের দিয়ে এদের আটকানো যাবে না। পালালেন তিনি। প্রতিরোধ নেই দেখে জাহাজ থেকে সেনারা নেমে এসে আক্রমণ করল হুগলি বন্দর। সবকিছু ধূলিস্মাৎ করে তারা এগোল ব্যান্ডেলের দিকে। ততক্ষণে নবাবের শস্যভাণ্ডার লুঠ হয়ে গেছে। আগুণ জ্বলতে লাগল অঞ্চলটায়।
নবাবও চুপ করে বসে থাকলেন না। হুগলি আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে ঘোড়সওয়ার পদাতিক হাতি কামান নিয়ে নামলেন পথে। ততদিনে ক্লাইভ কলকাতার সীমা বাড়িয়ে নিয়েছে, পাহারা বসিয়েছে সীমান্তে। বাঁশবেরিয়ায় পাশাপাশি নৌকা বেঁধে সেতু তৈরি করে নদী পেরোলো নবাবের ফৌজ। এরপর শুরু হবে চিৎপুরের রাস্তা। উমিচাঁদের থেকে খবর পেয়ে বারাসাত দিয়ে ঘুরে গেল সেনাদল।
ক্লাইভ তার মুন্সি নবকৃষ্ণ সহ তিনজনকে নবাবের শিবিরে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিল। তাদের আটক করা হলে রাতের অন্ধকারে তারা কোনওক্রমে পালিয়ে আসে। তার বিশ্বস্ত নবকিসেনের মুখে নবাবের শিবিরের খবর পেয়ে ক্লাইভ একটা দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করল। রাতের অন্ধকারে নবাবের শিবির আক্রমণ। শুনে অন্যরা চমকে উঠলেও ক্লাইভের দৃঢ় প্রত্যয়ের সামনে ওজর আপত্তি টিকল না কারও।
পাঁচশো গোরা সৈন্যের সঙ্গে জাহাজি সৈন্য আর দিশি সৈন্য নিয়ে দল গড়ে কামান বন্দুক নিয়ে চললেন রবার্ট ক্লাইভ। রাতের অন্ধকার চিরে নিস্তব্ধতা ভেঙে হালসিবাগানে আছড়ে পড়ল ইংরেজরা। তোপের আওয়াজ আগুণ ঝলকে ক’ঘন্টার মধ্যে নেমে এল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। নবাবের সেনারা একটু সামলে নিয়ে পাল্টা লড়াই শুরু করল বটে কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। যদিও ধূর্ত মোহনলাল তার আগেই নবাবকে সরিয়ে দিয়েছিল শিবির থেকে। গোলাগুলি চালাতে চালাতে ক্লাইভের সৈন্যরা সরে এল মারাটা ডিচের দিকে। বাধ্য হয়ে পরের দিন নবাব সন্ধি করতে বাধ্য হলেন ইংরেজদের সঙ্গে।
ইংরেজরা মুর্শিদাবাদে আর কাশিমবাজারে থাকা ফরাসিদের ছাড়ল না সহজে। বরং নবাবের ওপর চাপ বাড়াতে লাগল, তাদের ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে। নবাবের মনে হল, সন্ধির শর্তে তার স্বাধীনতা যেন ক্রমে বিকিয়ে যাচ্ছে ইংরেজদের কাছে।
জগৎশেঠের কুঠিতে তখন মাঝেমাঝেই বসছে জোর মন্ত্রণাসভা। ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নবাবের বহু আমাত্য। সেখানে লুকিয়ে আসছে ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠির নেতা ওয়াটস। ইংরেজরা চিঠির পর চিঠি লিখে খেপিয়ে তুলেছে নবাবকে। ফরাসিদের তাড়ানোর জন্যেই তাদের চাপ বাড়ছে ক্রমশ।
কাশিমবাজারের কুঠি ঘিরে তখন মাটির দেওয়াল তুলেছিল ফরাসিরা। বাধ্য হয়ে তাও ভেঙে দিতে হল নবাবকে। তবে ফরাসিদের ইংরেজদের হাতে না দিয়ে বরং তিনি পাটনার দিকে তাদের পাঠিয়ে দিলেন। আকাশ বাতাসে যেন একটা দমবন্ধ ভাব। নবাবের মসনদ কি সুরক্ষিত?
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, সম্মুখ সমরের পরিস্থিতি। তবে সিরাজের জায়গায় কে বসবে, সেই লোক ঠিক করে উঠতে পারেনি বিরোধী শিবির। মীরজাফর প্রথমে রাজী হয়নি। তার বদলে ইয়ার লতিফের কাছে প্রস্তাব গেল। ক্লাইভের মনে হচ্ছে ইয়ার লতিফকে মসনদে বসানো সুবিধের নয়। তার বিশেষ কোনও প্রভাব নেই জনতার ওপর। আরাটুনের ওপর ভার পড়ল মীরজাফরের সঙ্গে কথা বলার। মীরজাফর এখন নবাবের চক্ষুশূল। প্রমাণ না পেলেও নবাব জেনে গেছেন মীরজাফর জগৎশেঠ আর রায়দুর্লভ হাত মিলিয়েছে ক্লাইভের সঙ্গে। মীরজাফর যদিও নবাব হতে চান না। ওতে অনেক ঝামেলা। তার থেকে কোনও একটা পদ আঁকড়ে থেকে জীবনটা সুখভোগে কাটিয়ে দিলেই হল। তবে মীরজাফরের জীবন আর ঠিক কতদিন সেটাতেই সন্দেহ। প্রতিমুহূর্তে ভয়, গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে নবাব না তার সাধের প্রানপাখি খাঁচাছাড়া করেন।
ঠিক এই অবস্থায় আরাটুন পৌঁছল মীরজাফরের কাছে। একদিকে মৃত্যুভয়, অন্যদিকে নবাবের মসনদ! দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মীরজাফর যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। রাজি হয়ে গেলেন ইংরেজদের প্রস্তাবে।
ওদিকে উমিচাঁদ লাভের অঙ্ক নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে দরাদরি শুরু করেছে। তবে মীরজাফর তাকে বিশ্বাস করে না। ক্লাইভেরও বিশ্বাস নেই তার ওপর। এর মধ্যেই মারাঠাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এল, মিলেমিশে সিরাজকে আক্রমণ করার। ইংরেজরা সত্যি মিথ্যে জানে না মারাঠাদের ব্যাপারে। সে চিঠি নবাবকে পাঠিয়ে বিশ্বাস অর্জন করল ইংরেজরা। পলাশি থেকে সৈন্যসমাবেশ তুলে নিলেন নিশ্চিন্ত নবাব।
ইতিমধ্যে পাটনা থেকে ফরাসি সিনফ্রে এসে জানিয়েছে, নবাবের বিরুদ্ধে জোর ষড়যন্ত্র চলছে। নবাবের অনুগামীরাও তা মানে। মীরজাফরকে নজরবন্দী করল নবাব।

 

ছবি : সংগৃহীত

 

ইতিমধ্যে মীরজাফরের নামে সন্ধিপত্র তৈরি করেছে কোম্পানি। তিনি নবাব হলে ইংরেজদের এতদিনের যাবতীয় ক্ষতিপূরণ করবেন।
জগৎশেঠের বাড়িতে জমিদাররা যোগ দিল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এসে জানাল, মুসলমান শাসকের অপসারণ চাই যে কোনও মূল্যে। ইংরেজদের নবাবের বিরুদ্ধে একঝুড়ি অভিযোগ। তার বোঝাপড়া করতে সসৈন্যে ক্লাইভ চললেন কাশিমবাজারের পথে। খবর পেয়ে মীরজাফরকে সিরাজ বরখাস্ত করলেন। ততদিনে ওয়াটস পালিয়েছে।
সিরাজের মনে হল যুদ্ধ অনিবার্য। সিরাজ মীরজাফরের বাড়ি ছুটলেন তাকে দলে টানতে। তার নানীজান তার স্বাভাবিক নারীর বুদ্ধিতে এই উপদেশ দিয়েছিলেন। নয়ত গঙ্গার দু’ধারে মুখোমুখি দুই প্রাসাদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
জাফরাগঞ্জের প্রাসাদে সেনাপতি হিসেবে ফিরে এসে মীরজাফর কোরান ছুঁয়ে শপথ নিলেন বিধর্মীদের সঙ্গে যোগ না দেওয়ার। তাতেই নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন নবাব। ততদিনে চন্দননগরে ইংরেজ সৈন্যরা এসে গেছে। দু’চারদিন পর অজয়ের পাড়ে কাসাইয়ে পূর্ব পরিকল্পনামতো দুর্গ দখল করল ইংরেজরা। ঘোর বর্ষার মধ্যে সে দুর্গ জয়ের পর শস্যভাণ্ডার এসে গেল ইংরেজদের হাতে। এখন সব কিছু মীরজাফরের ওপর।
ঘোর বর্ষায় মুখোমুখি হল দুই বাহিনী। রাজধানী থেকে পনের ক্রোশ দূরে পলাশির প্রান্তর। শোনা যায়, এখানে অনেক পলাশ গাছ ছিল একসময়। এখন তৈরি হয়েছে নবাবের আমবাগান। নবাব শিবির করেছেন একদিকে, শিকার বাড়ির দিকে আছে ইংরেজরা। এই শিকার বাড়িতে কত মনোরম সময় কাটিয়েছে কিশোর সিরাজ, আজ সেসব মনে নেই তার।
সকালবেলা ইংরেজদের লক্ষ্য করে কামান দাগতে লাগল নবাবের কামানচিরা। ক’য়েকজন গোড়া সৈন্য মরল । ক্লাইভ গুটিয়ে নিল সেনা। পিছু হটা ইংরেজদের ওপর অবিশ্রাম তোপ চালাতে লাগল নবাবের বাহিনী। উত্তর দিল ইংরেজরাও। ক্লাইভ ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এতো যুদ্ধের কথা তো হয়নি। বোঝা গেল, মীরমদন আর মোহনলালের সেনারা লড়ছে। তারা হারলেই যুদ্ধ শেষ।
মীরমদনের একার দাপটেই ক্লাইভের মনে ভয় ঢূকেছে। তবে তাকে স্বস্তি দিয়ে বৃষ্টি নামল তারপর। মুষলধারে বৃষ্টিতে মীরমদনের বারুদ ভিজে একসা। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামতে তলোয়ার হাতে তেড়ে এল মীরমদন। তবে ইংরেজদের বারুদ বৃষ্টিতে ভেজেনি, ঢাকা দেওয়া ছিল ভালভাবে। তারা এবার খুশি মনে কামান দাগতে শুরু করল। মীরমদনের ঊরুতে আছড়ে পড়ল গোলার আঘাত।
মৃত মীরমদনের জায়গা নিল মোহনলাল। সিরাজ তখন পড়েছেন মহাভাবনায়। মীরজাফরের সামনে মুকুট খুলে সাহায্য প্রার্থনা করতে লেগে গেলেন। সেই সুযোগে এখনকার মতো যুদ্ধে বিরতির কথা বলে বলে মীরজাফর তার লুকানো তাসটি খেলে দিলেন। মোহনলাল জানে আর কিছুক্ষণ যুদ্ধ চালাতে পারলে ইংরেজদের দফারফা হবে। তবু উদভ্রান্ত নবাব মীরজাফরের কথাকেই গুরুত্ব দিল। ফরাসিদের সঙ্গে তখন লড়াই করছে কিলপ্যাট্রিক। ক্লাইভ এসে যোগ দিল তার সঙ্গে। মোহনলালের বাহিনীও ততক্ষণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। মীরজাফর ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন মধ্যরাতে শিবির আক্রমণ করতে। রায়দুর্লভ সিরাজকে বুদ্ধি দিলেন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালানোর। তাই করলেন সিরাজ। যদিও সেনারা লড়েছিল কিছুক্ষণ তারপর সব ঠাণ্ডা। রাজধানীতে ফিরে মন্ত্রণাসভা বসাল সিরাজ। রত্নভাণ্ডার খুলে সৈন্য সংগ্রহে নামলেন নবাব। যে জীবনে তলোয়ার ধরেনি সেও সেই সুযোগে টাকাপয়সা নিয়ে গেল। কিন্তু কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না শেষপর্যন্ত। সিরাজ বুঝে গেলেন, মুর্শিদাবাদ ছাড়তে হবে এই দণ্ডে। নিজের আগে অন্তঃপুরের লোকজনকে প্রচুর সম্পদ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায়। নিজে ঘুরপথে এগোতে লাগলেন রাজমহলের দিকে।
ওদিকে নতুন নবাব হিসেবে মীরজাফরকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে ইংরেজরা। তার অধীনস্থ সেনারা সিরাজকে খুঁজতে বেরিয়েছে ততক্ষণে। সিরাজের কোষাধ্যক্ষ ধরা পড়ে গেছে। মীরজাফর জানে, সিরাজ পাটনায় পৌঁছলে সাহায্য পাবে সেখান থেকে। তাই তাকে আটকানোই এখন মূল লক্ষ্য ইংরেজদের।
রাস্তায় চলছে তল্লাশি, সামন্ত রাজাদের জানানো হয়েছে সব খবর। সিরাজের জেনানারা আর মনিমুক্তা বোঝাই পঞ্চাশটা হাতি ধরা পড়ল পথে। মোহনলাল ভগবানগোলার দিকে রওনা হয়েছিল, তাকে ধরতেও লোক ছুটেছে।
তিনদিন বাদে দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিপুল জনতার মাঝখান দিয়ে সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করল জয়ী ক্লাইভ। সেদিনই মীরজাফর মসনদে বসল বটে কিন্তু ইংরেজদের দেওয়ার জন্যে দু’কোটি টাকা তার কাছে নেই। শেষপর্যন্ত মনিমুক্ত ও নগদে কিছু দেওয়া হল । বাকি টাকা ধীরে ধীরে শুধবে মীরজাফর।
সিরাজ পথে পথে ঘুরছে ছদ্মবেশে, দীনহীন অবস্থায়। মহানন্দার চড়ায় আটকাল তার নৌকা। সিরাজ অন্নজলের জন্যে জনবসতির দিকে এগোল। সিরাজের বিখ্যাত পাদুকা দেখে তাকে চিনে ফেলে সেখানকার এক ফকির। সিরাজ আগে নাকি একে অপমান করেছিল। সিরাজকে ধরিয়ে দিল সেই দানসা ফকির। অপসারিত নবাবকে বন্দী করল মীরকাশিম। তার সৈন্যদল সামান্য দূরে রাজমহলেই অপেক্ষা করছিল। মীরকাশিমের মন কিন্তু নবাবের অনুনয়ে গলল না।
ক’দিনের মধ্যে বন্দী সিরাজকে আনা হল হাত পা বেঁধে। মধ্যরাতে তাকে নিয়ে আসা হল নতুন নবাব মীরজাফরের সামনে। অবস্থা দেখে বিচলিত হল মীরজাফর। হয়ত সিরাজকে হত্যা করতে চাননি, তার থেকে কারাবাস ভাল। মীরনের হাতে দেওয়া হল ক’য়েদির দেখভালের ভার। গুপ্তঘাতকের সন্ধানে বেরিয়ে মীরন তার খুঁজে পেয়েছে মহম্মদী বেগকে। আলিবর্দির অন্নে প্রতিপালিত সে। সেই শেষপর্যন্ত হত্যা করতে এল তরুণ সিরাজকে। পরেরদিন বহুলোকের তলোয়ারের কোপের দাগ মাখা সিরাজের মৃতদেহ পথে পথে ঘুরল হাতির পিঠে চড়ে।

ছবি : সংগৃহীত 

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 2 March 2025, Issue 54| সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২ মার্চ ২০২৫ | সংখ্যা ৫৪

 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment