



সম্পাদকীয়
অনেক কিছু ভাবা হয় কিন্তু সফল হয় কতটুকু! অনেক কিছু ভাবা না হলে যে যতটুকু সফল হবার তার চেয়ে অনেক কিছু কমে যেত। হা হা হা।
ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তির উপাদান ও উদাহরণ প্রয়োজন। না হলেও সফলতার মূল্য কমে যায়।
দায়িত্ব যখন কষ্টে রূপান্তর ঘটে তখন সেটা দায়িত্ব পালন নয় দায়িত্ব পরিহাসে রূপায়িত্ব হয়। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি আর চাইনা এটা মানেই নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী বোধ করা। নিজেকে এই অবহেলার পাত্র তৈরি করলে আপনার দ্বারা আগামীর দিনগুলোতে যে সমস্ত প্রাণ উপকৃত হবে তাদেরও কষ্ট। ফলে সেই পাপ নিজের কাছেই ফিরে আসে। তাই কখনওই মাঝ পথ থেকেই সম্পাপ্তি ঘোষণা না করে শেষ দিন পর্যন্ত টিকে থাকার ব্রত পালন করতে হয়। নিজ কারণে নয় অন্যদের উপকারের জন্য।
এই জন্যই ভগবান আমাদের নির্দিষ্ট আয়ুকাল মেপে রেখেছেন। কারণ। আমরা যখন হেরে যাবার বিশ্বাস গ্রহণ করি অথচ আমার জন্য কোন প্রাণ যে জিতে যাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না তা তো দেখা যায় না। কারও দ্বারা অপকার হলে বা ক্ষতি হলে জানব আরও ভালো কিছুর জন্যই ক্ষতি হয়েছে। ভগবান বিশেষ বিশেষ প্রাণ ও মনকে চিহ্নিত করেন। তাই তো এতো আকাশ এতো বায়ু এতো আগুন এত জল এত মাটি (এত নদী এতো প্রাণী এত কীট এতো পতঙ্গ) সবার প্রয়োজন আছে বৈকি। আমাকে একদিন আমার এক বন্ধু বলল ঐ আমাজনের জঙ্গলে… অজানা প্রাণীর বেঁচে থাকার কারণ কি? আমি তার উত্তরে বললাম তোমার বেঁচে থাকার কারণ কি? বন্ধু বলল, মা-বাবা, আত্মীয়, পরিজন সমাজ সংস্কার আন্দোলন যোগ বিয়োগ সব আছে ওদের কি আছে! আমি দুইগাল হেসে বললাম, ওদেরও তো সব কিছুই আছে। ওর জন্মের জন্যই হয়ত পৃথিবীর গুরুত্ব আরও অপরিসীম হয়ে উঠেছে। বন্ধু বলল কেন? আমি বললাম তুমি তো বিজ্ঞান বিশ্বাস করো। তাহলে বুঝেই নাও জীববিদ্যার বিষয়। হাহাহা। ভগবান যা সৃষ্টি করেছেন তার মহৎ উদ্দেশ্য আছে এই পৃথিবীতে। এই যে মনের প্রশ্ন আবিষ্কার করেছ এটাও তো হত না? এটাও তো একটা সৃষ্টির উৎস। বন্ধু বলল – কেন? আমি হেসে বললাম, আরে তুমি প্রশ্ন না করলে এই শব্দ ব্রহ্মে তা কি এই সময়ে সৃষ্টি হত? তখন সে হেসে ফেলে বলল এটা ঠিক। আমি তাকে বুঝি দেবার চেষ্টা করেছি মাত্র। ভরহীন ভাবে যাদুর মত কাজ করে যাচ্ছে রহস্যে ঘেরা পৃথিবীর বন্ধন।🍁
🍂মহামিলনের কথা
ত্রৈলঙ্গস্বামীজী ও দীননাথ ন্যায়রত্নের মহামিলন
একদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে কাশীর বিখ্যাত দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে দীননাথ ন্যায়রত্ন ধ্যান করছেন। হঠাৎ জল থেকে উঠে এলেন কাশীর সচল শিব ত্রৈলঙ্গস্বামী। দীননাথের উপস্থ নিজ কপালে ঘষে তারপর এক কোশা গঙ্গাজল সেই উপস্থে ঢেলে দিয়ে ত্রৈলঙ্গস্বামী সানন্দে বললেন “গঙ্গোদকং। দীননাথ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
এরপর ত্রৈলঙ্গস্বামী সাগ্রহে দীননাথের হাত ধরে কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে চললেন। স্বয়ং কাশীর সচল শিব একজন মহাপুরুষকে হাতে ধরে বিশ্বনাথের মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে তাঁর বিশাল গুণমুগ্ধ কাশীর ভক্ত জনগণের অনেকে তাঁদের পেছনে পেছনে চললো। প্রায় পাঁচশো লোক। বিশ্বনাথের মন্দিরে প্রবেশ করবার কিছু পূর্বে সহসা দু’টো বিশাল ষাঁড় এসে বিশ্বনাথের গলির পথ আটকে দাঁড়ালো। সব লোক আটকে গেল। নির্বিঘ্নে ত্রৈলঙ্গস্বামী ও দীননাথ ন্যায়রত্ন বিশ্বনাথের মন্দিরে প্রবেশ করলেন। সাথে সাথে এক অলৌকিক ব্যাপার ঘটলো। মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে গেল। দিব্য অলৌকিক ভাবে পূজো করে সেখান থেকে চলে গেলেন তাঁরা। 🍁
🍁ফিরেপড়া | প্রবন্ধ
বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীটাই যে আমাদের ব্যর্থতার কারণ, অভ্যাসগত অন্ধ মমতার মোহে সেটা আমরা কিছুতেই মনে ভাবিতে পারি না। ঘুরিয়া ফিরিয়া নূতন বিশ্ববিদ্যালয় গড়িবার বেলাতেও প্রণালী বদল করিবার কথা মনেই আসে না; তাই, নূতনের ঢালাই করিতেছি সেই পুরাতনের ছাঁচে। নূতনের জন্য ইচ্ছা খুবই হইতেছে অথচ ভরসা কিছুই হইতেছে না। কেননা ঐটেই যে রোগ, এতদিনের শিক্ষা-বোঝার চাপে সেই ভরসাটাই যে সমূলে মরিয়াছে।
অসন্তোষের কারণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভারতবর্ষের নানা স্থানেই নূতন নূতন বিশ্ববিদ্যালয়-স্থাপনের চেষ্টা চলিতেছে। ইহাতে বুঝা যায়, শিক্ষা সম্বন্ধে আমাদের মনে একটা অসন্তোষ জন্মিয়াছে। কেন সেই অসন্তোষ? দুইটি কারণ আছে; একটা বাহিরে, একটা ভিতরের।
সকলেই জানেন, আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার যখন প্রথম পত্তন হইয়াছিল তখন তাহার লক্ষ্য ছিল এই যে, ব্রিটিশ ভারতের রাজ্যশাসন ও বাণিজ্যচালনর জন্য ইংরেজি-জানা দেশি কর্মচারী গড়িয়া তোলা। অনেকদিন হইতেই সেই গড়নের কাজ চলিতেছে। যতকাল ছাত্রসংখ্যা অল্প ছিল ততকাল প্রয়োজনের সঙ্গে আয়োজনের সামঞ্জস্য ছিল; কাজেই সে দিক হইতে কোনো পক্ষে অসন্তোষের কোনো কারণ ঘটে নাই। যখন হইতে ছাত্রের পরিমাণ অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে তখন হইতেই এই শিক্ষাব্যবস্থার একটা প্রধান উদ্দেশ্য অধিকাংশ ছাত্রেরই পক্ষে ব্যর্থ হইতেছে। যদি আমাদের দেশের শিক্ষায় ছাত্রদিগকে চাকরি ছাড়া অন্যান্য জীবিকার সংস্থানে পটু করিয়া তুলিত তাহা হইলে এই সম্বন্ধে নালিশের কথা থাকিত না। কিন্তু পটু না করিয়া সর্বপ্রকারে অপটুই করিতেছে, এ কথা আমরা নিজের প্রতি তাকাইলে বুঝিতে পারি।
এই তো গেল বাহিরের দিকের নালিশ। ভিতরের দিকের নালিশ এই যে, এত কাল ধরিয়া ইংরেজের স্কুলে পড়িতেছি, কিন্তু ছাত্রদশা তো কোনোমতেই ঘুচিল না। বিদ্যা বাহির হইতেই কেবল জমা করিলাম, ভিতর বইতে কিছু তো দিলাম না। কলসে কেবলই জল ভরিতে থাকিব, অথচ সে জল কোনোদিনই যথেষ্ট পরিমাণে দান-পানের উপযোগী ভরা হইবে না, এ যে বিষম বিপত্তি। ভয়ে ভয়ে ইংরেজের ডাক্তার ছাত্র পুঁথি মিলাইয়া ডাক্তারি করিয়া চলিল, কিন্তু শারীরবিদ্যায় বা চিকিৎসাশাস্ত্রে একটা-কোনো নূতন তত্ত্ব বা তথ্য যোগ করিল না। ইংরেজের এঞ্জিনিয়ার ছাত্র সতর্কতার সহিত পুঁথি মিলাইয়া এঞ্জিনিয়ারি করিয়া পেন্সন লইতেছে, কিন্তু যন্ত্রতত্ত্বে বা যন্ত্র-উদ্ভাবনায় মনে রাখিবার মতো কিছুই করিতেছে না। শিক্ষার এই শক্তিহীনতা আমরা স্পষ্টই বুঝিতেছি। আমাদের শিক্ষাকে আমাদের বাহন করিলাম না, শিক্ষাকে আমরা বহন করিয়াই চলিলাম, ইহারই পরম দুঃখ গোচরে অগোচরে আমাদের মনের মধ্যে জমিয়া উঠিতেছে।
অথচ, বুদ্ধির এই কৃশতা নির্জীবতা যে আমাদের প্রকৃতিগত নয় তার বর্তমান প্রমাণ: জগদীশ বসু, প্রফুল্ল রায়, ব্রজেন্দ্র শীল। আমাদের শিক্ষার একান্তদীনতা ও পরবশতা সত্ত্বেও ইঁহাদের বুদ্ধি ও বিদ্যা বিশ্বজ্ঞানের মহাকাশে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছে। আর, অতীতকালের একটা মস্ত প্রমাণ এই যে, আমাদের প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র নানা শাখায় প্রশাখায়, নানা পরীক্ষায় ও উদ্ভাবনায় বিচিত্র বৃহৎ ও প্রাণবান হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু পরের-ইস্কুলে-শেখা চিকিৎসাবিদ্যায় আজ আমাদের এত ক্ষীণতা ও ভীরুতা কেন!
ইহার প্রধান কারণ, ভাণ্ডারঘর যেমন করিয়া আহার্য দ্রব্য সঞ্চয় করে আমরা তেমনি করিয়াই শিক্ষা সঞ্চয় করিতেছি, দেহ যেমন করিয়া আহার্য গ্রহণ করে তেমন করিয়া নহে। ভাণ্ডারঘর যাহা-কিছু পায় হিসাব মিলাইয়া সাবধানে তাহার প্রত্যেক কণাটিকে রাখিবার চেষ্টা করে। দেহ যাহা পায় তাহা রাখিবার জন্য নহে, তাহাকে অঙ্গীকৃত করিবার জন্য। তাহা গোরুর গাড়ির মতো ভাড়া খাটিয়া বাহিরে বহন করিবার জন্য নহে, তাহাকে অন্তরে রূপান্তরিত করিয়া রক্তে মাংসে স্বাস্থ্যে শক্তিতে পরিণত করিবার জন্য। আজ আমাদের মুশকিল হইয়াছে এই যে, এই এত বছরের নোটবুকের বস্তা-ভরা শিক্ষার মাল লইয়া আজ আমাদের গোরুর গাড়িও বাহিরে তেমন করায় ভাড়া খাটতেছে না, অথচ সেটাকে মনের আনন্দে দিব্য পাক করিয়া ও পরিপাক করিয়া পেট ভরাই সে ব্যবস্থাও কোথাও নাই। তাই আমাদের বাহিরের থলিটাও রহিল ফাঁকা, অন্তরের পাকযন্ত্রটাও রহিল উপবাসী। গাড়োয়ান তাহার লাইসেন্সের পদক গলায় ঝুলাইয়া মালখানার দ্বারে চোখের জল মুছিতেছে, তাহার একমাত্র আশাভরসা কন্যার পিতার কাছে। এমন অবস্থাতেও এখনো যে যথেষ্ট পরিমাণে অসন্তোষ জন্মে নাই তাহার কারণ, বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না এবং নিষ্ফল অভ্যাস আপন বেড়ার বাহিরে ফললাভের কোনো ক্ষেত্রে চোখেই দেখিতে পায় না। উপবাসকৃশ অক্ষম আপন ব্যর্থতার মধ্যেই চিত হইয়া পড়িয়া মনে করিতে থকে, এইখানেই এক পাশ হইতে আর-এক পাশে ফিরিয়া কাঁদিয়া-কাটিয়া দৈবকৃপায় যেমন-তেমন একটা সদুপায় হইবেই। জামা কিনিতে গেলাম, পাইলাম একপাটি মোজা; এখন ভাবিতেছি, ঐটেকেই কাটিয়া ছাঁটিয়া কোনোমতে জামা করিয়া পরিব। ভাগ্য আমাদের সেই চেষ্টা দেখিয়া অট্টহাস্য করিতেছে।
বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীটাই যে আমাদের ব্যর্থতার কারণ, অভ্যাসগত অন্ধ মমতার মোহে সেটা আমরা কিছুতেই মনে ভাবিতে পারি না। ঘুরিয়া ফিরিয়া নূতন বিশ্ববিদ্যালয় গড়িবার বেলাতেও প্রণালী বদল করিবার কথা মনেই আসে না; তাই, নূতনের ঢালাই করিতেছি সেই পুরাতনের ছাঁচে। নূতনের জন্য ইচ্ছা খুবই হইতেছে অথচ ভরসা কিছুই হইতেছে না। কেননা ঐটেই যে রোগ, এতদিনের শিক্ষা-বোঝার চাপে সেই ভরসাটাই যে সমূলে মরিয়াছে।
অনেককাল এমনি করিয়া কাটিল, আর সময় নষ্ট করা চলিবে না। এখন মনুষ্যত্বের দিকে তাকাইয়া লক্ষ্যেরও পরিবর্তন করিতে হইবে। সাহস করিয়া বলিতে হইবে, যে শিক্ষা বাহিরের উপকরণ তাহা বোঝাই করিয়া আমরা বাঁচিব না, যে শিক্ষা অন্তরের অমৃত তাহার সাহায্যেই আমরা মৃত্যুর হাত এড়াইব।
শিক্ষাকে কেমন করিয়া সত্য এবং প্রাণের জিনিস করা যায়, সেই কথার আলোচনা যথাসাধ্য ক্রমে ক্রমে করা যাইবে।🍁
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১৩
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ১৩
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
১৩.
স্বপ্নে দেখছি আরফার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে
নয় এর দশকে তখনও গ্রামে ইলেকট্রিক আলো আসেনি। সন্ধ্যা হলেই চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে। গ্রামের চারিপাশ ঝোপঝাড়, কাঁদর, ফাঁকা মাঠ, কবরস্থান, পুকুর-পুষ্করিণিতে ভর্তি। একটু অন্ধকার হলেই শেয়াল, বনবেড়াল, পেঁচা ডাকতে শুরু করে। রাস্তাঘাটে সাপ-বিচ্ছুরও ভয় খুব। বাইরে বের হতে গেলে হয় লাঠি-টর্চ কিংবা লণ্ঠন নিয়ে বের হতে হবে। আমাকেও বেশ কয়েকবার সাপের সম্মুখীন হতে হয়েছে। গোখরো, কেউটে, কালাচ, চন্দ্রবোড়া সাপই বেশি। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ঝোপ-জঙ্গল ভেদ করে তাল কুড়োতে গিয়েই সাপ, খাটাস অথবা শেয়ালের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু সেসবকে আর ভয় পাই না। অনেক সময় সাপকে মেরেও ফেলেছি।
গ্রামের সব মানুষই প্রায় খেটে খাওয়া মানুষ। কিছু চাষ-জমি থাকলেও সারা বছর ফসল ফলে না। যে সামান্য ধান হয় তাতে কারোরই সারা বছর চলে না। তাই ভাদ্র-আশ্বিন মাসেই ধার-দেনাতে জড়িয়ে পড়ে। তখন বিল ছেঁচে মাছ ধরে, ঘাস কেটে বিক্রি করে। মাঠের শাঁকপাতা তুলে, পুকুরের কাঁকড়া-গুগলি-শামুক ধরে শহরে বিক্রি করে আসতে হয়। তাতেই খুদকুঁড়ো জুটে যায়। একটা মাটির মসজিদে পাঁচবার আজান হয় বটে কিন্তু তেমন লোকজন নামাজে সামিল হয় না। ওই কয়েকজন মুরুব্বিই মসজিদে যান। একটা শিব মন্দির ভেঙে পড়ে আছে। তার মেরামতিরও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেবলমাত্র শিব পূজার জন্যই একসময় সবাই উপস্থিত হন। তবে মনসা ও রামায়ণ গান হলে ওই শিব প্রাঙ্গনেই হয়। খাঁ-পাড়া মণ্ডল-পাড়া মিলে গ্রামের মানুষ প্রায় একাকার হয়ে বাস করে। সুতরাং বাইরে থেকে চেনা যাবে না কে কোন সম্প্রদায়ের। বিভিন্ন উৎসব এলে এপাড়া ওপাড়া মিলে নিমন্ত্রণ চলতে থাকে। এমনকি বিয়েশাদীর ক্ষেত্রেও সব সম্প্রদায়েরই নিমন্ত্রণ থাকে। বিপদে-আপদে সবাই এর ওর পাশে দাঁড়ায়।
কিন্তু এই গ্রামের সবচেয়ে খারাপ সংবাদ হলো অনেক মেয়েই কম বয়সে বাইরে পাচার হয়ে গেছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের হিন্দিভাষী লোকেরা এসে বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে মেয়ের বাপকে সামান্য টাকার বিনিময়ে তার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে চলে গেছে। একবার বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে সেই মেয়েকে কোথায় বিক্রি করে দিয়েছে তার আর হদিস পাওয়া যায়নি। প্রথম প্রথম দুই এক বছর সেই মেয়েটি চিঠিপত্র আদান প্রদান করেছে। তারপর কোনো এক সময় তার চরম দুর্দশার কথা জানিয়েই শেষ চিঠি দিয়েছে। এদিকে বাড়িতে মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন তার চিঠির অপেক্ষা করে করে হয়তো মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েছে। সমস্ত গ্রাম জুড়েই কত মেয়ে যে এভাবে চলে গেছে তার হিসেব নেই। সেদিন হারুন পালের বউ এসে আমার সামনেই চোখের জল ফেলে তার শাড়ির আঁচলই ভিজিয়ে গেল। তার দুটি ফুটফুটে মেয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। উত্তরপ্রদেশ থেকে দুই যুবক এসে পাঁচশো টাকা করে দিয়ে তাদের বিয়ে করে নিয়ে যায়। বড় মেয়েটি প্রথম দুবছর চিঠি লিখেছিল। ছোট মেয়েটি মাত্র এক বছর। তারপর থেকেই চিঠি বন্ধ। শ্রাবণ মাসের একটি দুর্যোগপূর্ণ রাত্রে লণ্ঠন জ্বেলে পুরনো চিঠির কয়েকটা খাম হাতে নিয়ে নতুন একটি চিঠি লিখে নেবে বলে সে আমার কাছে এসেছে।
—বাবা দেখোতো এই চিঠিটা, এক বছর হয়ে গেল আর কোনো চিঠি পেলাম না। আজ একটা চিঠি লিখে দাও।
—এই চিঠিটা তো চন্দ্রার চিঠি! সে তো এক বছর আগেই পড়েছিলাম। এই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমাকে ওরা নতুন আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এই নিয়ে আমি তিনবার বিক্রি হলাম।’ এই চিঠিতে তো ঠিকানা নেই! লিখবেন কোথায়?
—কোথা থেকে এসেছে চিঠিটা তা লেখা নেই?
—না, তা তো লেখা নেই! ও লিখেছে, আমাকে আরো একজনের কাছে বিক্রি করতে চাইছে। সেই জায়গাটা কোথায় আমি জানি না। তবে আমি বিক্রি হতে চাই না। আমার মরণ হলেই ভালো হয়। যে আমাকে কিনে নেয়, সে খুব অত্যাচার করে আমার শরীরের ওপর। আমি আর সহ্য করতে পারি না। এই চিঠিটা খুব কষ্ট করে লিখলাম। যদি ঠিক সুযোগ পাই তো আবার তোমাকে জানাবো।’
—তাহলে আজ পর্যন্ত আমাকে জানালো না, নিশ্চয়ই ওর বিপদ হয়েছে। ও কি আর বেঁচে থাকবে? হায়! হায়! আমার কী হলো গো! দুটি মেয়ে দুটিই চলে গেল অকালে! ভগবান, আমাকেও আর এই পৃথিবীতে রাখিও না!
চন্দ্রার বোনের নাম ছিল হরি। বারো-তেরো বছর বয়স মাত্র। সে প্রথম এক বছর তার চিঠিতে লিখেছিল, ‘আমাকে বিষ খাইয়ে মারোনি কেন মা? আমি এই যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না! ওরা কী রকম ব্যবহার করে আমার সঙ্গে তা তোমাকে আমি বলতে পারবো না। আর হয়তো চিঠি লেখাও হবে না আমার।’
মেয়ে দুটির কথা মনে পড়লে আমারও চোখ ভিজে আসে। হারুন পালের বউকে সান্ত্বনা দেবার মতো আমার কিছুই ছিল না। জেলে পাড়ার বহু মেয়ের করুণ অবস্থার কথা শুনেছিলাম। একজন পালিয়ে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। তারপর সে কিভাবে হারিয়ে যায় তার খোঁজ আর কেউ বলতে পারেনি। তেমনি মালপাড়ারও অনেক মেয়ে লেখাপড়াই জানতো না। তাদের কী পরিণতি হয়েছে গ্রামের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। মুসলমানদের কয়েকটি মেয়ে অবশ্য মুম্বাই ও পুনেতে রয়েছে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের কোনো পুরুষ তাদেরকে বিয়ে করেছে। কিন্তু তেমন কেউই যোগাযোগ রাখেনি। আবার অনেক মেয়ে স্বেচ্ছায় দেহ বিক্রি করেও অর্থ উপার্জন করে। মুম্বাই শহরে তারা আত্মগোপন করে থাকে। গ্রামে তার স্বামী এবং সন্তান-সন্ততি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে হতাশ হয়। সে আর ফিরে আসে না। কখনো কখনো নতুন কোনো পুরুষের সঙ্গে ঘরকন্না পাতে। এই সব মানুষদের সংবাদ চিঠি লিখতে আসা কোনো মেয়ের বা কোনো পুরুষের কাছে পেয়ে যাই। নিয়মিতই আমাকে চিঠি লিখতে হয়। বউ পালিয়ে যাওয়া, স্বামী পালিয়ে যাওয়ার সংবাদও কম পাই না।
তবে আতর চাচার বাড়িতে আমাকেই যেতে হয় চিঠি লেখার এবং পড়ার জন্য। তার শাশুড়ি ও সুমুন্দি থাকে মুম্বাই শহরে। শাশুড়ি ঝি’র কাজ করে। সুমুন্দি করে রাজমিস্ত্রির কাজ। প্রতিমাসের রোজগার একসঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। সেইসব টাকাতেই কেনাকাটা হয় নানা রকম ঘরকন্নার সামগ্রী। চিঠিতেই সংবাদ আদান প্রদান করতে হয়। আতর চাচা বেশ দিলদার মানুষ। তার বাড়ি গেলে এটা সেটা খাবারও পাওয়া যায়। চিঠি লিখতে ও গল্পগুজব করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায় ফিরতে। যেদিন টিউশনি থাকে না বলেই অনেকটা সময়ও ব্যয় করতে পারি। সেদিন আতর চাচা আমার ব্যক্তিগত জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকটাই আলোকপাত করতে চাইলেন।
—দেখো বাপু, লেখাপড়া শিখে বসে থাকা ঠিক হবে না। আমি একটা কথা ভেবে রেখেছি তুমি রাজি হলে মন্দ হবে না।
—কী কথা চাচা, বলুন না! আপনার তো সব কথাই আমি রাখি।
—আমি তো নিজের ভাইপোর মতোই মনে করি তোমাকে। তাই তোমার ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবি।
—আমিও সে কথা জানি চাচা, দেখুন আমরা তো বড় গরিব। তবু লেখাপড়া শিখেছি। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের রেজাল্ট বের হবে। পাস করতে পারলে হয়তো আর পড়তে পারবো না বাইরে গিয়ে। তবে তেমন যদি কিছু সুযোগ পাওয়া যায় তবে অবশ্যই আমি গ্রহণ করবো।
—আমি মনে মনে ভেবে রেখেছি, গাঁয়ের কিসমত মোড়লের মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়েটা লাগাবো। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। ওরা বর খুঁজছে খুব,কিন্তু তেমন বর পাচ্ছে না। আর আমি যা বলবো তাই হবে।
আমি কী বলবো ভেবেই পেলাম না, মাথা নিচু করলাম। কিসমতের মায়ের মৃত্যুতে একদিন ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেদিন দেখেছিলাম মেয়েটিকে। দুধে-আলতার মতো রং। দীর্ঘাঙ্গি ফুটন্ত শরীর। স্বপ্নের রাজকন্যার মতোই। তারা কখনো গরিব ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়? আতর চাচার এই কথা একেবারে অলীক। মনে মনে আমার হাসি পেল। মাথা নেড়ে বললাম, আচ্ছা আপনার মনে যদি তাই ভালো হয় তো তাই করুন।
তারপরেও বেশ কয়েকবার আতর চাচার বাড়ি গেছি। ওই কথা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। রুমার কথা আমি কাউকেই বলিনি। কেননা প্রেম আর বাস্তব বিবাহ দুটির মধ্যে একেবারেই মিল নেই। একটি রূপকথা আর একটি পার্থিব কথা। রূপকথাকে মনে মনেই কল্পনা করা ভালো। কিন্তু পার্থিব কথা জীবনের ক্ষেত্রভূমি। সেখানে সুখ-দুখের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। কিসমতের সম্পত্তি ভালোই আছে। দুটি মাত্র মেয়ে। বিয়ে হলে রাজকন্যা রাজত্ব সবই জুটে যাবে। তাহলে কি রুমার সঙ্গে বেইমানি করা হবে না? মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে গেল। মনের দুটি অংশ ভাগ হয়ে ঝগড়া শুরু করে দিল। একটি মন বললো, প্রেম করলে তো বিয়েও করতে হবে। কিসমতের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে? রুমাও তো খুব ভালো মেয়ে। বড়লোক ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলে পরিণতি সুখের নাও হতে পারে। অন্য মনটি যুক্তি দেখালো, কিসমত মোড়লের মেয়ে আরফা রুমার থেকে বহু গুণে সুন্দরী। অর্থকড়ি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব হবে না। হাতের নাগালে চাঁদ পেয়ে কেউ কি আর জ্যোৎস্নার খোঁজ করে? একবার বিয়ে হয়ে গেলে তখন আর কি ফেলতে পারে?
সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই মনের এই দ্বন্দ্বের মিমাংসা ক’রছি। কিন্তু কিছুতেই মিমাংসা করতে পারছি না। এমনি করে জেগে জেগেই ভোরবেলায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। আর স্বপ্নে দেখছি, আরফার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। পাশাপাশি দু’জনেই ঘুমিয়ে আছি। তার নরম দুটি ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুতের মতো শিহরন খেলে গেল! ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, ভোরবেলায় শুরু হয়েছে ঝড় আর ফাঁপি। জানালার ফাঁক দিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েছে আমার শরীরে। বিছানা ছেড়ে উঠতেই আর ইচ্ছে করলো না। (চলবে)
🍂ফিরেপড়া | কবিতা
শামসুর রাহমান-এর তিনটি কবিতা
থমকে থেকো না
থমকে থেকো না; আর কতকাল এভাবে দাঁড়িয়ে
থাকবে? এগিয়ে যাও। পেছনে হটতে
চাও বুঝি? এখন সে পথ বন্ধ; প্রখর দুপুর
বিকেলের সঙ্গে ঢলাঢলি শুরু করে
দিয়েছে সে কবে, দেখতেই পাচ্ছো। এবার ঝাড়া
দিয়ে ওঠো, নয়তো অন্ধকার
অচিরে করবে গ্রাস তোমাকেই। তখন অরণ্যে একা-একা
কেঁদে বেড়ালেও কেউ করবে না খোঁজ।
যদি ভাবো, সময় তোমার
মুঠোয় থাকবে বন্দী সারাক্ষণ, তবে ভয়ঙ্কর
ভুল হয়ে যাবে হিসেবের
হিজিবিজি খাতার পাতায়। পা বাড়াও তাড়াতাড়ি;
তোমাকে ছাড়াই সব কিছু ঠিকঠাক
চলবে, একথা মনে ঠাঁই দিতে পারো অবশ্যই। তবু বলি,
যতদিন আছো
প্রবল আবেগ নিয়ে বাঁচো, শত্রুর ব্যুহের দিকে
এগোতে করো না দ্বিধা। অভিমন্যু হলেও তোমার
খেদ থাকা অনুচিত; কেউ কেউ এভাবেই যায়,
যেতে হয়, পরিণাম ছায়া হয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন
মেফিস্টোফিলিস, মুখে হিংস্র হাসি। তোমাকে পাতালে
নিয়ে যাবে, সাধ্য কার? নিজের পাহারাদার তুমি।
সবারই কিছু না কিছু পিছুটান থাকে। পুরাকালে
নাবিকেরা গভীর সমুদ্রে নাকি কখনো সখনো
কুহকিনী মোহিনীর গান শুনে চৈতন্যরহিত
দ্রুত ভ্রমে হারাতো জীবন নিরুদ্দেশে। যতদূর
জানা আছে, তুমি নও তেমন নৌজীবী। সামনের
দিকে পা চালাও, দাও ডাক দশদিকে
এমন জোরালো কণ্ঠে যাতে
বজ্রেরও লজ্জায় মুখ বন্ধ হয়ে থাকে।”
অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই
কস্মিনকালেও অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই।
না ছোরা, না ভোজালি, না সড়কি না বল্লম
না তলোয়ার না বন্দুক-
কোনা কিছুরই প্রয়োজন নেই আমার।
আমি মারমুখো কোনো লোক নই।
বালক বয়সেও আমি কোনো ফড়িং-এর
পাখনা ছিঁড়িনি,
প্রজাপতিকে আলপিন দিয়ে
আটকে রাখিনি কাগজে।
কখনো উড়ন্ত কিংবা গাছের ডালে বসে-থাকা
কোনো পাখির প্রতি তাক করিনি
বন্দুকের চকচকে নল।
ছায়াময় আশ্রয়ে সময়-পোহানো
পাখি,
বিকেলের আবীর মেখে দাঁড়ানো তন্বীর মতো
গাছ,
পলায়নপর সূর্যের চুমো-খাওয়া
নদী,
ইতস্তত ছড়িয়ে-থাকা খুচরো সিকি আধুলির মতো
তারা,
প্রত্যেকেই নিজস্ব ভাষায়
গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে শান্তির পাঁচালিতে।
দুই আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
আমি কান পাতি গোলাপ আর চন্দনের ব্রতকথায়।
যতদূর মনে করতে পারি,
কোনোদিন আমার ওষ্ঠ অস্ত্রবন্দনায়
স্ফুরিত হয়নি।
কিন্তু আমার ঘরে কেউ আগুন দিতে এলে,
আমার ভায়ের বুক কেউ বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলে,
আমার বোনের রওশন চৌকি
কেউ তছনছ করে দিতে এলে,
নিরস্ত্র আমি নিমেষে হয়ে উঠি দুরন্ত লড়াকু।
আমার লড়াইয়ের রীতি
নদীর ফেরীর মতো; ফুল আর সুরের মতো
পবিত্র।
আমার কোমর কালো বেল্টে শোভিত হোক আর নাই হোক,
শেষ অব্দি লড়ে যাবো
অস্ত্রের প্রশ্রয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন।
না ছোরা, না ভোজালি, সড়কি না বল্লম,
না তলোয়ার না বন্দুক-
কিছুই নেই আমার,
এই আমি নিজেই আমার অস্ত্র।
“পন্ডশ্রম”
“এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
“কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
“দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
“কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কী-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
“যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরছে চিলে,
পাজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো-কিলে।
“সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
“মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভূ।
“ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘূরে সোনার চিলের পিছে?
“নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
“ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলছি, পন্ড হল শ্রম।
🍁কবিতা
অশোক কুমার রায়-এর দু’টি কবিতা
বড় অচেনা
সমুদ্র দেখলেও বড় সে অচেনা।
তার গভীরে কতটা দয়ামায়া
কিংবা ক্রূরতা?
প্রতি পলকে জন্ম নেয় জোয়ার ভাটা ।
কি তার হাতছানি কি তার কথা?
নিজের মত করে বুঝলেও
বুঝি না তার মনের কথা।
ওর ভিতরে লুকিয়ে থাকে দানব রুপ
বুঝি না।
একবার গিলে নিয়ে
ফেরত দেয় লাশ।
বুঝি না তার মহিমা।
ভালবেসে চরণ ছুঁলেন
বুঝি না তার অভিলাষ।
নীল আঁধারে লুকিয়ে রাখে
তার প্রতিবিম্ব।
সমুদ্র অবগাহনে কি আছে বিশ্বাস?
বিলাপ
সারি বদ্ধ তীর
বিঁধে চলেছে আমায়।
এক এক তীরে এক এক রকম যন্ত্রণা।
বলাকার অনন্ত গমনে সাথী হলে
মুক্ত আকাশে নীল দ্রাঘিমায়
যন্ত্রনা হীন নীড় খুঁজে নিতাম।
এত দিন যে নীড় গড়েছি
প্রতিদিনের দমকা হাওয়ায়
শুধু বাস্তুহীন নক্সা পেয়েছি।
তবু মত্ত নির্মাণ মরিচিকায়
গারদে পুরেছে কে?
বলাকারা উড়ে মুক্তির হাওয়ায়।
কেবল যন্ত্রনার তীর এসে আসর জমায়
আমরা উঠোন জুড়ে।
আশিস সরকার -এর কবিতা
রহস্যময় ঝাপটা বাতাস
আমার খুব কাছের বন্ধু সে
প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে আসে
প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে একই পায়রা গুলোও আসে
খুঁটে খুঁটে খায় ; হঠাৎ কিছু ঝাপটা বাতাস রেখে চলেও যায়।
আমাদের বাড়িতে আমার বন্ধুটি প্রতিদিন আসে যেমন প্রতিদিন রেলস্টেশনে রেলগাড়ি আসে- নিয়মমতো
ও এলে বাড়ির সকলে খুব সতর্ক হয়ে ওঠেন
যেমন গানের সাথে সঙ্গতকারেরা ঠিক তেমনি
কোন ভুল করা চলবে না
ছেলেটি আমার বন্ধু ওকে আমি তেমন ভালো মন্দ
কিছুই বলিনা কিন্তু ও আসে প্রতিদিন – ইঙ্গিতময়
এ বাড়ির কর্তা যেদিন শেষ নিঃশ্বাসের জন্য তৈরী হচ্ছেন
তখন বাড়ির সকলে ওকেই খুঁজে আনবার জন্য ছুটোছুটি শুরু করল
কর্তা ওর জন্য আঁকুপাঁকু করতে করতে এক দীর্ঘ হতাশায় ডুবতে ডুবতে চলে গেলেন
সেই শেষ তারপর পায়রাগুলো হারিয়ে গেল, বন্ধুটি আমার হারিয়ে গেল!
অবশেষে রয়ে গেল গভীর রহস্যময় ঝাপটা বাতাস!
সবটাই কী মিথ্যে মিথ্যে…!
নিবারণ দাস -এর কবিতা
ঘুম
ঘুম থেকে যখনই উঠি জেগে
মনে মনে ভীষণ যাই রেগে
চারিদিকে কিসের এত রব?
দেশ জুড়ে হচ্ছে একি সব!
তারপর যেই লাল লাল চোখে
আগুন ছুড়ে মারে আমার দিকে
চোখ দুটো তখন বুজে নিয়ে
আমি আবার শুয়ে পরি গিয়ে
এভাবেই আমাদের ঘুম ভাঙে মাঝে মাঝে
জানি না কবে আসব কোন কাজে।
🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ১৩
তাঁর “বিলেতে সাড়ে সাত’শ দিন” গ্রন্থের এই অংশ দু’টি পড়েই বোঝা যায় তাঁর লেখার শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিবোধ। এই রুচিবোধের সাথে যুক্ত হয়েছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং নির্মল ও গভীর রসবোধ। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১৩।
ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই
রেহানা বীথি
(পূর্ব প্রকাশের পরে…)
মোট সাতটি অধ্যায়ে বইটি সমাপ্ত। যথাক্রমে :
১. ভূমিকা( Introduction),
২. ইসলাম যে বাণী নিয়ে এলো ( The Mission of Islam),
৩. ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম (Social and Historical Background of Islam),
৪. জয়ের পেছনে যে কারণ ছিল ( The Causes of Triumph),
৫. মোহাম্মদ যা শেখালেন (Mohammad and his techings),
৬. ইসলাম ও দর্শন ( Islamic Philosophy),
৭. ভারতবর্ষ ও ইসলাম ( Islam and India)।
এই সাতটি অধ্যায়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, ইসলামের বৈপ্লবিক শক্তির কথা। শুধুমাত্র তরবারির সাহায্যে রাজ্য জয় আরও অনেক জাতি করেছিল, কিন্তু ধূমকেতুর মত উদয় হয়েই তারা আবার মিলিয়ে গেছে। বিশ্বসভ্যতায় তাদের কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলামের রাজ্য জয় তাদের থেকে একেবারেই আলাদা। বিশ্বসভ্যতায় ইসলাম যোগ করেছিল এক ভিন্ন মাত্রা, সঞ্চারিত করেছিল এক নতুন শক্তি। যে সামাজিক পরিবেশ ও ঐতিহাসিক পটভূমিতে ইসলামের জন্ম হয়েছে তার মধ্যেই পরিবর্ধিত হয়ে কিভাবে একটি অসভ্য ভবঘুরে জাতি থেকে ধীরে ধীরে হযরত মুহম্মদ( সাঃ) – এর হাত ধরে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছে সে কথা অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে বইটিতে। মানবেন্দ্রনাথ রায বিশ্ব ইতিহাসে ইসলামের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর গ্রন্থে ইসলামি অনুশাসন আশা করা যায় না, কারণ তিনি মুসলিম নন। তাছাড়া তিনি কুরআনকে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) – রচনা বলে মনে করেছেন, কিন্তু মুসলমানদের কাছে কুরআন ঐশী গ্রন্থ। ইসলামের দার্শনিক তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা তিনি অনেকাংশে মুসলমানরা তা মানেন না। হাই সাহেবও তাঁর মতের সাথে পুরোপুরি একমত নন, কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে নিজস্ব মতামত, ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাসকে আরোপ করেননি। বইটির শুরুতেই তিনি বলেছেন, “আমি মুসলমান হলেও অনুবাদকালে নিতান্ত নির্লিপ্ত ও নৈর্ব্যক্তিক মন নিয়ে অনুবাদ করার প্রয়াস পেয়েছি।” হাই সাহেবের এই অনুবাদ গ্রন্থটি এতটাই প্রাঞ্জল ও সাহিত্যগুণান্বিত যে তা অনুবাদ বলে মনেই হয় না। বিদেশী ভাষার গল্প-উপন্যাস প্রচুর অনুবাদ হয়েছে কিন্তু এ ধরনের প্রয়োজনীয় গ্রন্থের অনুবাদ কেউ করেননি, করার প্রয়োজনও অনুভব করেননি।
ইচ্ছে থাকলেও ভাষাবিজ্ঞান চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়ায় আর কোনো গ্রন্থ অনুবাদ করার অবকাশ তাঁর হয়নি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে টুকটাক অনুবাদ করেছিলেন কখনও কখনও। এছাড়া ছাত্রদের প্রয়োজনে পি. আর. বড়ুয়ার সাথে আলফ্রেড সি. উলনারের ‘Introduction of Prakrita’ গ্রন্থের আংশিক অনুবাদ করেন।
বিলেতে সাড়ে সাত’শ দিন
হাই সাহেব প্রথমে ভেবেছিলেন বিলেতে কাটানো তাঁর দিনগুলো নিয়ে যে ভ্রমণ কাহিনীটি তিনি লিখেছেন, তার নাম দেবেন “বিলেতের কথা” ; এ কথা মাথায় রেখেই “সাহিত্য ও সংস্কৃতি” (১৯৫৪) গ্রন্থের চতুর্থ প্রচ্ছদে এই নামে বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে বইটি “বিলেতে সাড়ে সাত’শ দিন” নামে প্রকাশিত হয়। বিলেতে অবস্থান কালে সেখানকার সমাজের চালচলন, আদব-কায়দা, শিক্ষা এসবের সাথে নিজের দেশের তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা মোট একত্রিশটি অধ্যায়ে লিখেছেন। এই গ্রন্থে তিনি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখেছেন। দেখতে গিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন তাতে করে তাঁর মনে হয়েছে যেন দেশের বাইরে গিয়ে নিজের দেশকে নতুনভাবে চিনেছেন। এই গ্রন্থেরই এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “নিজের দেশের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে স্বজাতির ও স্বদেশের যতটা জানা যায়, বিদেশে নানা মানুষ এবং নানা বস্তুর সংস্পর্শে এসে দেশকে লোকে আরও ভালো করে চিনে। কারণ তখন তাদের দৃষ্টি প্রসারিত হয়, প্রত্যেকটি জিনিসকে সে বিচার করতে শেখে (অধ্যায় বারো, পৃ. ৯২)।
বুদ্ধিদীপ্ত রসগ্রাহী ভ্রমণ কাহিনীরূপে হাই সাহেবের এই বইটি এককথায় অনবদ্য। অতি সরস ও উপাদেয়, নিখুঁত বর্ণনায় নিটোল এই বইটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য। বইটি পড়ে পাঠকদের হঠাৎ করেই মনে হতে পারে, সেও যেন লেখকের ভ্রমণসঙ্গী। গাম্ভীর্যের ভারে ভারাক্রান্ত তো নয়ই, উপরন্তু লেখক তাঁর নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পাঠকের ওপর চাপও দেননি। বইটি কিছু সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারমিডিয়েট বাংলা পাঠ্য তালিকার অতিরিক্ত পাঠরূপে নির্বাচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, “প্রচলিত অর্থে ভ্রমণ কাহিনী বলতে যা বুঝি তার চেয়ে বেশি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করা।… লেখকের নিজের কৌতূহলের ছাপ এ বইতে আছে, কিন্তু পাঠকের কৌতূহলকে উৎসাহিত করার চাইতে তার বুদ্ধিবৃত্তির কাছে আবেদন করাকেই তিনি সহজ মনে করেছেন (উত্তরণ, ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা)।”
যে একত্রিশটি অধ্যায়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর এই গ্রন্থটিতে ভ্রমণ কাহিনী তুলে ধরেছেন, সেই অধ্যায়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিলেতের জীবনের সবগুলো দিক তিনি নিপুণতার সঙ্গে দেখেছেন। সে দেখা বিহঙ্গ অবলোকন নয়। কোনও অধ্যায়ে কী বিষয় সম্পর্কে বলেছেন তার একটি তালিকা নিচে দেয়া হল :
১. যাত্রারম্ভ, ইংল্যান্ডে পদার্পণ
২. শীতের লন্ডন
৩. বিলেতে বড়দিন
৫-৬. বিভিন্ন প্রকৃতিতে লন্ডন
৭. ফয়েলসের বই দোকান
৮. শিশুদের প্রতি মা-বাবার দায়িত্ব, শিশুশিক্ষা
৯. চিড়িয়াখানা
১০. টিউব রেলওয়ে
১১. বিলেতে প্রবাসী মুসলমান ও ঈদ উৎসব
১২. ইংরেজের সামাজিক জীবন
১৩. পারী ভ্রমণ
১৪. বৃটিশ মিউজিয়াম ও মাদাম তুসো
১৫. ইংরেজের জাতীয় চরিত্র
১৬. সাধারণ ইংরেজের প্রকৃতি
১৭. অভিজাত ইংরেজের প্রকৃতি
১৮. পোশাক পরিচ্ছদ
১৯. বিলেতের চিত্রশালা, গান বাজনার আসর
২০. নিয়ম-শৃঙ্খলা ও ছুটি-ছাটা
২১. পড়ুয়া ইংরেজ, সাময়িক পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থাগার
২২. খেলাধূলা
২৩. গাই ফকসের উৎসব ৫ই নভেম্বর
২৪. বিলেতের পুলিশ
২৫. লাইনে দাঁড়ান
২৬. ইংরেজের খাওয়া-দাওয়া
২৭. বিলেতের বাজার
২৮. লন্ডনের হাইড পার্ক
২৯. ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুতে শোক মিছিল
৩০. ইংরেজি সাহিত্য ও সাহিত্যিক, পোয়েটস কর্নার
৩১. ঘরে ফেরা
তিনি তাঁর বিলেতে অবস্থানের সময় কতটা সূক্ষ্মভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন, তার সুস্পষ্ট এবং নিখুঁত বিবরণ এই অধ্যায়গুলোর মাধ্যমেই তুলে ধরা হয়েছে। বইটির কিছু কিছু অংশ নিচে দেয়া হল –
“এই একটি বছর বহুরূপী ইংল্যান্ডের নানারূপ দেখেছি। দেশের যারা মানুষ তাদের চোখে দেশ যেভাবে ধরা দেয়, বিদেশীর চোখে ঠিক তেমনভাবে ধরা দেয় না। বিদেশীরা বিদেশে পা দিয়ে যা দেখে নিজের দেশের সঙ্গে তা মিলিয়ে নিতে চায়। ফলে যা দেখে তা তাদের চোখে অনেক সুন্দর এবং বিচিত্রভাবে ফুটে ওঠে। বিদেশের বিচিত্রতাই বিদেশীর মনকে সজাগ রাখে, চিত্তকে রাখে উন্মুখ” ( অধ্যায় পাঁচ পৃ. ৪৯)।
দুনিয়াতে মানুষের মন বোধহয় সবচেয়ে দুর্গম ও দুর্জ্ঞেয়। একটি মানুষের মন জানাই কম দুরূহ ব্যাপার নয়। আমরা নিজেরাই বা নিজেদের মন কতটুকু জানি। সুতরাং বহু লোকের মন জানতে পেরেছি এ অহঙ্কার কেমন করে বা করি? কিন্তু মন জানা তো পরের কথা, মন জানবার আগে মানুষকে দেখবার সৌভাগ্যও তো কম নয়! তাই বা কার কপালে জোটে? সে জন্যে নিজের ভাগ্যের কথা নিয়ে যখন চিন্তা করি, কোথাকার মানুষ কোথায় এসেছি, যখন এ কথা ভাবি, তখন নিজের ভাগ্যকে আর ধিক্কার দেই না। এ জীবনে কি পাইনি তা নিয়ে তর্ক তুলি না। যা পেয়েছি তাকে সৌভাগ্য বলে মানি। শত দুঃখ-বেদনার মধ্যেও প্রবাসের এ দু’টি বছরে আমি যে মরজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছি, সেজন্যে গর্ববোধ করি। আমি মিশে গেছি মানুষের মহৎ মেলার মধ্যে। এ মানুষের কত জাত, বর্ণ ও ধর্মের লোকের সঙ্গে যে মিলেছি, কত নরনারীর সঙ্গে কত কথা বলার যে সুযোগ পেয়েছি, কতভাবে যে তাদের অন্তরের মমত্বের পরিচয় পেয়েছি, পেয়েছি তাদের মনের উদারতার কত যে স্পর্শ। লন্ডন আমাকে এ সুযোগ দিয়েছে। তাই লন্ডন ছেড়ে যাবার আগে লন্ডনের প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা জানিয়ে যাই। যদি এ জীবনে আর এ সুযোগ না আসে, আর কোনোদিন ইউরোপের পথে যদি পা না বাড়াতে পারি, তবে মানুষের এ মহাজীবনের সঙ্গে এ মহামিলনের আর মনের এ মহামুক্তির স্বাদ কোথায় পাবো? ( অধ্যায় একত্রিশ, পৃ. ২০৭- ২০৮)
তাঁর “বিলেতে সাড়ে সাত’শ দিন” গ্রন্থের এই অংশদু’টি পড়েই বোঝা যায় তাঁর লেখার শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিবোধ। এই রুচিবোধের সাথে যুক্ত হয়েছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং নির্মল ও গভীর রসবোধ। আর এসব বৈশিষ্টই বইটিকে অনন্য করে তুলেছে।
যদিও আরও ক’য়েকবার তিনি বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়েছেন, কিন্তু ভ্রমণ কাহিনী আর লেখা হয়ে ওঠেনি তাঁর। তবে পুত্রকন্যা ও নিকট আত্মীয়দের চিঠিপত্রের মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতেন। 🍁[চলবে ]
🍁অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
সম্পাদকীয় ঋণ : মহামিলনের কথা, ফিরেপড়া প্রবন্ধ ও ফিরেপড়া কবিতা অন্তর্জাল থেকে সংকলিত।
