



সম্পাদকীয়
ভাইফোঁটা রীতিনীতি আমি দেখছি। আমার পূর্বে বাবারা দিখেছিলেন তার পূর্বে ঠাকুরদাদারা তারপূর্বে বড়োবাবারাও। এই ভাবেই হয়ে আসছে শুনে আসছি। আনুমানিক ভাবেও বলা যায়না যে এটা ঠিক কখন কি ভাবে প্রচলন হয়েছিল। তবে এখনও হয়ে আসছে । এই বিষয়ে কিছু বই লক্ষকরলে দেখতে পাওয়া যায় যে কিংবদন্তী অনুসারে, মৃত্যুর দেবতা যম কার্তিক শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বোন যমুনার নিমন্ত্রণ স্বীকার করে তাঁর বাড়ি যান। সে দিন যমুনার পুজো গ্রহণ করে, তাঁর গৃহে ভোজন করেন। যমুনা আশীর্বাদ চাইলে যম বলেন যে, এই তিথিতে যে ভাই নিজের বোনের বাড়ি গিয়ে তাঁর পুজো স্বীকার করবে ও তাঁর হাতে তৈরি রান্না গ্রহণ করবে, তাঁর ভাগ্যে অকালমৃত্যুর ভয় থাকবে না। তার পর থেকেই এই তিথিটি যম দ্বিতীয়া, ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া বা ভাই ফোঁটা নামে পরিচিত হয়।
সনাতনী হিন্দুধর্ম অনুসারে, নরকাসুর নামে দুষ্টু রাক্ষসকে বধ করার পর, কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার সাথে দেখা করেছিলেন। যিনি তাকে মিষ্টি এবং ফুল দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা করেছিলেন। তিনিও স্নেহের সাথে কৃষ্ণের কপালে তিলক লাগিয়েছিলেন। কেউ কেউ এটাকে উৎসবের উৎপত্তি বলে মনে করেন।
উৎসবের দিনে, বোনেরা তাদের ভাইদেরকে তাদের প্রিয় খাবার/মিষ্টি সহ একটি জমকালো খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। বোন চন্দন কাঠ জল দিয়ে ঘষে হলুদ নিয়ে দইও মিশ্রিত করেন চন্দন কাঠের সাথে নিজের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের কপালে নিচের বাক্যগুলো পড়তে পড়তে তিনবার ফোঁটা দিয়ে দেন।
“ ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয় আমার ভাই হোক অমর।”
অনেক সময় এই ছড়াটি বিভিন্ন পরিবারের রীতিনীতি ভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। অতঃপর, বোন তার ভাইয়ের মাথায় ধান এবং দুর্বা ঘাসের শীষ রাখে। এই সময় শঙ্খ বাজানো হয় এবং সনাতনী হিন্দু নারীরা উলুধ্বনি করেন। এরপর বোন তার ভাইকে আশীর্বাদ করে থাকে আবার যদি বোন তার ভাইয়ের তুলনায় বড় হয় অন্যথায় বোন ভাইকে প্রণাম করে আর ভাই বোনকে আশীর্বাদ করে থাকে । তারপর বোন ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি দ্বারা ভাইকে মিষ্টিমুখ করায় এবং উপহার দিয়ে থাকে। ভাইও তার সাধ্যমত উক্ত বোনকে উপহার দিয়ে থাকে।
ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হলো সনাতন ধর্মের হিন্দুদের দ্বারা পালিত একটি উৎসব। এটি কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে উদযাপিত হয়।পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে ভাইবিজ বলা হয়। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে ভাইটিকা এবং অনেক জায়গায় যমদ্বিতীয়া নামেও পরিচিত রয়েছে।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ভাই ফোঁটা অনেক জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। অনুষ্ঠানটি অনেক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ভাইদের জন্য একটি জমকালো ভোজের আয়োজন করা হয়। 🍁
🍂কবিতা
অরুণ কুমার চক্রবর্তী
ক্ষতো
দূরত্ব কিছু নয়, শুধু দুইটি মনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে একটি আকাশ
সেই আকাশ পার হতে চায় দুটি হৃদয়
এইবার সাঁতার সাঁতার বাতাসের বুকে…
টানটান আলোর উদ্ভাসে দুটিদুটি হাত ডানার সামিল, উড়ু উড়ু হৃদয়ের গান তরঙ্গমালায় গাঁথে দিব্যসুখ দেহের অধিক,
কাঁদে কাম, লোভ, মোহ, ঈর্ষার বাগান… তবু ওরা আছে, যেভাবে জড়িয়ে থাকে পানপাতাগাছ অতি দীর্ঘ মহিরুহর গায়ে, যেমন
প্রেম থাকে প্রেমের মতো,
তাকে আদর করে যতন করে রাখতে পারলে থাকে, জড়িয়ে জড়িয়ে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে থাকে, নইলে আজীবন বয়ে যাও
সঙ্গমের ক্ষতো…
দেবব্রত সরকার
ভাইফোঁটা
ভোর হয়েছে ; শিশির খোঁজো, দুর্ব্য কোথায়! গুছিয়ে তুলো!
মিষ্টি সন্দেশ; জিলেপি কাজু! নিও নারকেল! কিছুটা ফুলও!
ভাই দাদারা আসবে ছুটে! বোন দিদির আশীর্বাদের
সঙ্গ নিতে, সময় মতো আসবে সব্বাই, ফোঁটা তোদের!
আজ দুপুরে খাবার খাবি! ঘুগনি লুচি খাসির মাংস
ইলিশ মাছে কাঁটা পাবিনা! কাতলা ফ্রাই কষা মাংস!
এসব খাবার আগেই তোদের সাজিয়ে রাখা
কাঁসার থালায় আশীর্বাদের ছোঁয়া নেব যমের দ্বারা
সেই থালাটি হাতে দেব কপালে দেব তেল ও বায়ু
যমের কাছে মনে প্রাণেই চাইব অনেক দীর্ঘ আয়ু
কষ্ট সবার দূরে যাবেই হাসি খুশিই মন মাতানো
হাজার বছর থাকবে খুশি প্রতি বছর এই খাওয়ানো
মিষ্টি মুখের সঙ্গে হাতে পান সুপারি কলাও বটে
তোদের নামে জল ঢেলেছি প্রতি বছর শিবের ঘটে।
আইরে তোরা বুকে আমার জুড়িয়ে দেরে মনের ভীতি
তোদের হাতে দিলাম তুলে আয়ুর আশীষ; না হোক ক্ষতি
সারা জীবন থাকবি সুখে তেল দিয়েছি চুলের মাঝে
ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে গিয়ে জয় পাবীরে সকল কাজে।
এবার তোরা খেতেই পারিস পায়েস মিষ্টি যে যার খুশি
আদর ভোরে দিলাম তুলে মনের ভেতর কোষাকুশি
গিফট দিতে না করিস না যেন ! অনেক টাকা এবং সোনা !
এসব আমরা চাইনা ওরে! চাই ভালোবাসায় জীবন গোনা
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
নিশ্চুপ স্মৃতিরা
ডানা ঝেড়ে উড়ে গেল, আগুন পাখি…
পড়ে রইল উড়ানের নৈঃশব্দ
কখনো স্বজন ভাবিনি, পাখিদের মতো বলা
তোমার প্রণয় কাব্য
আজ পৃষ্ঠা উল্টাতেই একে একে জেগে উঠে
রবীন্দ্র সদন, কলেজ ঘাট, মোহন টকিজের ব্যালকনি
আর ক্লাস ফাঁকির দুপুর
কতবার মিশরের ফ্যারাওদের মতো
খুঁজেছি- তোমার মমি- শরীর
ইস্তক বলতে পারিনি, আমি সেই ক্লাউন
ভুল সুতোর ট্রাপিজ ছিঁড়ে উড়ে গেছি-
কালবেলার অন্ধকারে
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ
আরেকটি পাঠাও
পাঠানোর জন্য জলের ভাষায়
কাকতালীয় প্রথায় সীমাবদ্ধ
সাক্ষাৎ বিবর্তন দুলতে দুলতে
স্রোত চলে বিপরীতে
আলগোছে রুটির কথা
ছিড়েখুঁড়ে নেয় ব্যভিচার
🍂ধারাবাহিক গদ্য /পর্ব ৩
বাংলা ভাষার ধ্বনির গঠন, উচ্চারণ ও ব্যবহারবিধি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে রচিত তাঁর ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ গ্রন্থটি মুহম্মদ আবদুল হাইকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। গ্রন্থটির বর্ণনা বিজ্ঞানানুগ। বইটির ভাষাভঙ্গি ও রচনাকৌশল এতটাই হৃদয়গ্রাহী যে, এই বইয়ের নিরস তত্ত্বকথাও হয়ে উঠেছে রসপূর্ণ। ফলে এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছেও তা অত্যন্ত সহজবোধ্য এবং আকর্ষণীয়। ভাষাতত্ত্বের মৌলিক বিষয় নিয়ে এরূপ উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ দুই বাংলার মধ্যে তিনিই প্রথম রচনা করেন। আর এই গ্রন্থটি ধ্বনিবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। রেহানা বীথি -এর লেখা ‘ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুল হাই ‘ আজকে তৃতীয় পর্ব।
ভাষাবিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুল হাই
রেহানা বীথি
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর শাসকশ্রেণীর বিরূপ মনোভাবের কারণে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পড়ে কঠিন সংকটের মুখে। আরবি হরফে বাংলা লেখা, আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অত্যধিক প্রয়োগ, বাংলা সাহিত্য থেকে হিন্দুয়ানি বিষয় বর্জন, রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ, এমনকি কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত প্রচাররোধ, এরকম বিতর্কিত কর্মকাণ্ড শুরু হয়। সংস্কৃতির এ দুর্দিনে দৃঢ়চিত্ত আব্দুল হাই পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিভাগে ফিরে তিনি যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বাংলা বিভাগকে পুনর্গঠিত করেন। তাঁর আগ্রহে সৈয়দ আলী আহসান, মুনির চৌধুরী, আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রমুখ কৃতি শিক্ষক বাংলা বিভাগে যোগদান করেন।
মুহম্মদ আবদুল হাই যখন ১৯৬২ সালে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভ করেন। তখন বাংলা ভাষা ও সংস্কতির অঙ্গনে ছিল এক দুঃসময়। সেই দুঃসময়েই তিনি গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত ও প্রসারের লক্ষ্যে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। উচ্চমাণের জন্য খুব দ্রুত পত্রিকাটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করে। এ পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি নিরলসভাবে নিজের গবেষণাও চালিয়ে যান তিনি। প্রকাশিত হয় তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪), বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন(১৯৫৮), তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৬০), ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব (১৯৬৪) প্রভৃতি গ্রন্থ। বাংলা ভাষার ধ্বনির গঠন, উচ্চারণ ও ব্যবহারবিধি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে রচিত তাঁর ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ গ্রন্থটি মুহম্মদ আবদুল হাইকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। গ্রন্থটির বর্ণনা বিজ্ঞানানুগ। বইটির ভাষাভঙ্গি ও রচনাকৌশল এতটাই হৃদয়গ্রাহী যে, এই বইয়ের নিরস তত্ত্বকথাও হয়ে উঠেছে রসপূর্ণ। ফলে এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছেও তা অত্যন্ত সহজবোধ্য এবং আকর্ষণীয়। ভাষাতত্ত্বের মৌলিক বিষয় নিয়ে এরূপ উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ দুই বাংলার মধ্যে তিনিই প্রথম রচনা করেন। আর এই গ্রন্থটি ধ্বনিবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
মুহম্মদ আব্দুল হাই-এর অপর উল্লেখযোগ্য অবদান, বাংলা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত “ভাষা ও সাহিত্য” সপ্তাহ (২২-২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩) পালন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিরোধিতা করা এবং নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা। আয়োজনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল এবং সেটা সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছিল। বিদেশের বৌদ্ধিক সমাজের জ্ঞানের অংশীদার হওয়ার জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে এবং প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রামে যোগদান ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে তিনি দশ মাস মেয়াদে ১৯৬৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর আমেরিকান মিজোরী বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। (চলবে) 🍁
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস /পর্ব ১
শুরু হচ্ছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ প্রথম পর্ব।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
এক.
শূন্য ঘর
—আমাকে নিয়ে চলো বাবা, এখানে আমার একেবারেই ভালো লাগছে না! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!
—হ্যাঁ বাবা নিয়ে যাব, আর কয়েকদিন এখানে থাকো, আরেকটু সুস্থ হয়ে ওঠো তারপর।
—আমার আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না, তোমার ওখানে আমি মরবো তবু ভালো, আমাকে নিয়ে চলো!
—কিন্তু বাবা, আমার ওখানে দেখবে কে? আমি তো তোমাকে তুলে বাথরুমও নিয়ে যেতে পারবো না, তোমার বৌমাও পারবে না। তাই তো এখানে রেখেছি!
বাবা আর কথা বলতে পারলো না, আমার দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। আমি আর বেশিক্ষণ বাবার কাছে বসে থাকতে পারলাম না।
_____________________________________________
উইপোকাতে অনেকগুলো বই নষ্ট করে ফেলেছে। ভালো বই গুলো বাছাই করছিলাম। বাবা চেয়ারে বসে বসেই জানতে চাইল—আমার বইগুলো ঠিক আছে তো?
বাবার বই বলতে কোন্ বই? সে তো রামায়ণ মহাভারত, বেদবেদান্ত, পুরাণসমগ্র! আগে সেগুলো ভালো করে দেখলাম। হ্যাঁ সেসব বই ঠিক আছে।
_____________________________________________
তেরো বছর হয়ে গেল বাবা আমাদের সঙ্গেই থাকে। আগে ছোট্ট শহরটিতে আমাদের কোনো ঘর ছিল না। চাকরিতে ট্রান্সফার নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম তারপর এই ছোট্ট শহরে বাড়ি। গ্রামে আমার পরের ভাইগুলি থাকলেও তাদের অভাবের সংসার। তাই বয়স্ক বাবাকে ওষুধপত্র কিনে দেবারও সামর্থ্য হয় না। বরাবরই বাবা খুবই স্বল্পাহারী। মাছ-মাংস কোনো কিছুই পছন্দ করে না। একবেলা আলুসেদ্ধ ডাল-ভাত হলেই বাবা সন্তুষ্ট। সকালে একবার চা-সহ অল্প চাট্টি মুড়ি, সন্ধ্যায় এক কাপ দুধ। অন্যকোনো নেশা নেই, শুধু নেশার মধ্যে বই পড়াটাই বাবার নেশা। মজুর খেটে সংসার করলেও মাঝে মাঝেই বই সংগ্রহ করেছে। বিশেষ করে প্রাচীন সাহিত্যে বাবার অগাধ ভক্তি। শয্যাশায়ী হবার পর থেকেই শহর থেকে তাকে গ্রামে ভাইদের বাড়িতে এনে রেখেছি। ছুটি পেলেই চলে আসছি দেখার জন্য। আর তখনই বাবার আবদার—আবার আমাকে নিয়ে চলো!
বাড়িতে দুই ছেলে মেয়ে আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। প্রতিবেশী বলতে এখানে তেমন কেউ নেই। পাশের বাড়িতে বাবার বয়সী নির্মল ভৌমিক ছিলেন বাবার জুটি। কিছুদিন আগে তিনিও মারা গেছেন। তার মৃত্যুটাও বাবার কাছে একটা শূন্যতা। তবু শহরে থাকলে সব সময় বাবা ওষুধটা ঠিকমতো পায়। সকাল বেলায় মধু, দুপুর বেলায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য লিভোগার্ড চূর্ণ এবং রাত্রিবেলায় হাইপ্রেসার এর ওষুধ। সবগুলোই ঠিকঠাক দিতে হয়। মাঝে মাঝে ঠান্ডা লেগে জ্বর হয়। সারারাত ঘুম আসে না। তখন ওই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ঘুমের ওষুধ এনে দিতে হয়। এভাবেই চলে যাচ্ছিল প্রায় তেরো বছর। কিন্তু ইতিমধ্যেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ছোট ভাইয়ের মৃত্যু বাবা সহ্য করতে পারে না। বাড়ির সব থেকে ছোট ছেলে রুকুন বাবার চোখের সামনেই প্রায় তড়পে তড়পে মারা গেল। কত আর বয়স হবে, বড়জোর পঁয়ত্রিশ! গোপনে গোপনে ধারদেনা করে সে নাজেহাল হয়ে গেছিল। আবার মদ্যপানেও এত আসক্ত হয়ে পড়েছিল যে, তার লিভার পর্যন্ত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। ধরা পড়ার পর শেষ মুহূর্তে আর বাঁচানো যায়নি। একমাত্র ছেলে ও তরুণী স্ত্রীকে রেখেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সেই যন্ত্রণা বৃদ্ধ বয়সে বাবাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। তাই ছ-মাস যেতে না যেতেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারাদিন আমি কর্মস্থলে থাকি। এখানে বাবার সেবা করার মতো লোক নেই। মেজো ভাইটিকে কয়েকদিন এসে বাবাকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু তারও দিন-আনি দিন-খাই অবস্থা। এখানে এসে দেখাশোনা করার মতো সময় তার নেই। সুতরাং গ্রামেই আমাকে পাঠাতে হলো বাবাকে। দুই ভাই এক বোন গ্রামে আছে। কোনো না কোনো সময় কেউ না কেউ দেখবে বলেই ভেবেছিলাম।
কিন্তু গ্রামের অপরিসর ঘর। আলো-বাতাসেরও যথেষ্ট অভাব। খোলামেলা উঠোনও ছিল না। মেঝেতে তালাই পেতে থাকাও বাবা পছন্দ করতো না। ফুসফুসের জল জমে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। শ্বাস নেওয়ার জন্য কৃত্রিম যন্ত্রও কিনে দিয়েছিলাম। তবু কিছুতেই স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছিল না। বাবাকে কী বলে সান্ত্বনা দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেবা বলতে গা মুছিয়ে কাপড় পরিয়ে তেল মালিশ করে দেওয়া। কিছু খেতে চাইলে খাইয়ে দেওয়া এইটুকুই কাজ। করার মতো লোক ছিল না। মা বেঁচে আছে, কিন্তু মায়েরও শরীর দুর্বল বলে এসব করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বাবার অশ্রু মুছে দিয়ে বললাম—তুমি চিন্তা করো না, ডাক্তার ভালো ওষুধ দিয়েছে, কয়েকদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা জানে, আর ঠিক হতে পারবে না, হয়তো এটাই তাঁর শেষ যাত্রা। তাই ইশারায় পাশ ফিরিয়ে দিতে দিতে বললে, আবার ঠিক হওয়া! আর হবে না! আর হয়তো উঠে দাঁড়াতে পারব না!
তখন সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে। পৌষ মাসের শীত। আমাদের ফিরে আসতে হবে শহরের বাড়িতে। শীতকাল বলে সন্ধ্যাতেই গ্রামও প্রায় শুনশান হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। শরীরে চাদর জড়িয়ে আমি, আমার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটি টোটোতে চেপে বসলাম।
গ্রাম থেকে এই শহর মোট আট কিমির পথ। আসতে আসতে কেবলই ভাবতে লাগলাম, বাবা নেই এই অবস্থাটা কেমন হবে। এমনিতেই কয়েকদিন থেকে বাবা নেই বলে আমাদের ঘরটি প্রায় শূন্য। কোথাও বাইরে গেলে বাবা সারাদিন দরজায় বসে থাকতো। রান্না করার লোক না থাকলে বাবার সেদিন অপেক্ষা করতো না খেয়েই। দরজায় বসলেই কেউ না কেউ পথিক এসে বাবার সঙ্গে গল্প করে যেত। কত রকম কথা তারা শুনতে পেত। শাস্ত্র পুরাণ বেদবেদান্ত ধর্ম দর্শন প্রায় সব বিষয়েই বাবার দখল ছিল। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো ধরনের মানুষ বাবার বন্ধু হয়ে উঠতো। আমরা বাড়ি ফিরে বাবাকে বলতাম—সারাদিন তোমার খিদে লাগেনি?
উত্তরে বাবা বলতো, সব সময় খাবার চাইলে হবে? খিদেকেও বুঝতে হবে ঘরে এখন মানুষ নেই!
তারপর রান্নাবান্না হলে বাবা পারলে সেই সময় অল্প কিছু খেত। অসীম ধৈর্য এবং সহ্য ছিল বলেই জীবনে কারো সঙ্গেই বাবা কখনো কলহ বিবাদ করেনি। মায়ের কাছে কথা শুনেও চুপচাপ থেকে গেছে। কষ্ট পেলে স্মরণ করেছে তাঁর প্রভুকে। কিন্তু তবুও কাউকে জানতে দেয়নি। সারাদিন মজুর খেটে রাত্রেও মাঠপাহারার কাজ করতো। রাত জেগে জেগে জমির শস্য আগলাতো। জমির মালিক জানতো, একটা খাঁটি লোক পাহারায় আছে। ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না!
বাড়ি এসে আলো জ্বেলে দেখলাম বাবার ফাঁকা বিছানা। বইগুলো সব মাথার কাছে রাখা আছে। বিছানায় হাত দিয়ে দেখলাম এখনো তাপ উঠছে। আজ তিনদিন থেকেই বাবা এই বিছানা ছাড়া। বালিশটা সরিয়ে দেখলাম একটা টুকরো কাগজ। ডট পেন দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে: আমার বইগুলো ভালো করে গুছিয়ে রাখিও। আবার আমি এসে পড়বো।
বাবার বিছানাতেই কাগজের টুকরোটি হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। এই ক’য়েকদিন আগেই বইয়ের আলমারি সরাচ্ছিলাম। উইপোকাতে অনেকগুলো বই নষ্ট করে ফেলেছে। ভালো বই গুলো বাছাই করছিলাম। বাবা চেয়ারে বসে বসেই জানতে চাইল—আমার বইগুলো ঠিক আছে তো?
বাবার বই বলতে কোন্ বই? সে তো রামায়ণ মহাভারত, বেদবেদান্ত, পুরাণসমগ্র! আগে সেগুলো ভালো করে দেখলাম। হ্যাঁ সেসব বই ঠিক আছে। এতোটুকু উই ধরেনি। বাবাকে জানালাম সে কথা। বাবা শ্বাস নিতে নিতে, অনেকটা স্বস্তি পেল। বলল, যাক তাহলে, আমার খুব কষ্টের সম্পদগুলি রক্ষা পেয়েছে!
শহর থেকে যাবার মুহূর্তে শেষবারের মতো বাবা তার জামা ও কাপড় দুখানা গুছিয়ে রেখে গেছে। তাকে তুলে রেখে গেছে একটা বাটি ও গ্লাস। প্লাস্টিকের কৌটোতে কিছুটা শুকনো মুড়ি। একটা পলিথিনের ছোট্ট প্যাকেটে কয়েকটি রসুনের কোয়া। মুড়িগুলি চূর্ণ করে খাওয়ার জন্য ছোট একটি হামানদিস্তা। সবগুলোর দিকেই আমার চোখ পড়ল। নিজের অজান্তেই চোখ দুটি ভিজতে লাগলো। আমি আর স্থির হতে পারলাম না। বাবা কি পুনরায় ফিরে আসতে পারবে? প্রশ্নটি ঘুরপাক খেতে লাগলো সমস্ত ঘরময়। (চলবে) 🍁
🍂কবিতা
গৌতম হাজরা
নীরব, নির্বাক
কাগজের নৌকো ভাসিয়ে দিলেই শৈশব
আর শৈশব হাওয়ায় ভাসালেই যৌবন
তখন সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে এগিয়ে যাওয়া নিজস্ব অভিধানে
অথচ, রোজই চলে সমুদ্র মন্থন
তুলে আনা তরল গরল
যে গরল গিলতে গিলতে এগিয়ে যাওয়া
অন্য দিবাস্বপ্নে
যেখানে চারিদিক ঘিরে থাকে ধোঁয়ার কুন্ডলী
যেখানে শুধুই নীরব, নির্বাক !
কুন্তল দাশগুপ্ত
ভ্রান্তি
জানো,
আসলে পাষাণ-ই ছিল
তুমি শুধু ভেবেছো সলিল।
ঝুঁকে মুখ দেখবার
কাকচক্ষুজল
বিম্ব ফেরায় শুধু
গ্রহণ করার তার কোনও দায় নেই।
আলো ছুঁয়ে দিলে,
হিরে হয়ে ঝলকায় বিন্দুমাত্র
জলও।
গভীর হবার থেকে চোখ ধাঁধানোতে তার বেশী
মনোযোগ।
যে কেবল গভীর- আরও গভীর হতেই শিখে নিল-
গভীরতা মাপিবার রীতি তার জানবার কথা নয়।
কিশোরগঞ্জে তাই ভরপুর
বন্যায়
গভীরতা মাপা বড় দায়।
ভুল হয়- হয়ে যায়…
পরাণ মাঝি
আগুন কথা
অবহেলাও এক ধরনের খেলা। অবিশ্বাসের রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটবেই।
জল শরীর ছুঁলে কেঁপে ওঠে ভেতর পুরের জ্বলীয়-
প্রতিশ্রুতির সিঁদুরে মেঘ দেখে মনমরা ঈশান কোণ
ছাই উড়ে গেলে আগুনও বড় একা ; নিশ্চিহ্ন, নিরাকার
গীতা চক্রবর্তী
শিরোনামহীন কবিতা
অধরা
ভালোবাসা শুয়েছিল
পদ্মপাতায় শিশিরের বিন্দু।
একাকীত্ব
আকাশছোঁয়া সমুদ্র বুকে
শূন্য নাও
অভিমান
বুকের মধ্যে গ্যাস বেলুন
বাতাসের সখা
মুন চক্রবর্তী
দীপ কথা
মাটির প্রদীপ দিয়ে কলা গাছ সাজানোর দিনটি লুপ্ত
প্রতিটি বাড়ির দাওয়ায় জ্বলে উঠা প্রদীপ অতীত
পরিবর্তনের হাত ধরে জ্বলে উঠছে রকমারি আলো
মনটা ঘুরে ফিরে দেখতে চায় প্রদীপের প্রদীপ্ত শিখা।
শক্তি পূজার আরধনায় জড়ো হয়েছে অপশক্তির চাহিদা
রাম ফিরে আসার বিজয় তপোধ্বনিতে শোনা যায়
শব্দ বাজির সন্ত্রাস,মাটির প্রদীপটি কেবলই শত শতাব্দীর অন্ধকারের ঈশ্বরী ভবানী।
পরিবর্তনের চাহিদায় ফিরে গেছে পূজা, উৎসব তরঙ্গে ভাসছে অবাঞ্চিত চাহিদা।
একদিকে কালী আরেক দিকে লক্ষ্মী নারয়ণ শক্তির উৎসে দাঁড়িয়ে অভিনব দীপ ঈশ্বরী।
অতীত গোপনে আলোর অধিশ্বরী,বিঘ্নিত বিপদে
মা যেন সকলের উদ্ধারে রণরণঙ্গীণি।
“শ্মশানে জাগিছে শ্যামা”, বালক রামকৃষ্ণের মা ভবতারিণী।
দীপ কথা অমানিশায় একাই জগতোশ্বরী,মাটির প্রদীপে শুদ্ধ চেতনার মৃন্ময়ী।
পরিবর্তনের ঝলসানো আলোতে বিলুপ্ত চেতনা ফিরে পেতে জ্বালো দীপ, মনের অন্ধ চেতনা ফিরাতে।
🍁অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
