



সম্পাদকীয়
জীবন সহজ, সরল ও স্বাভাবিক করা ভালো। প্রতিটি জীবনের একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু জীবনের পথ আঁকা বাঁকা। এখনকার শেয়ার বাজারের মত ওঠা নামা করে। সবুজ সংকেত দেয় প্রতিটি ওঠা নামার ক্ষণে। কেউ বুঝে উঠতে পারে কেউ বুঝে উঠতে পারে না। এই বোঝা না বোঝার মাঝেই বাস করে কৌতূহল। এখান থেকেই উৎপত্তির আবেগ মাখন হয়ে উঠলেই আমরা দেখতে পাই আনন্দ ও নিরানন্দকে।
এগুলি তুলে ধরবার আসল উদ্দেশ্য এই সময়ের ভিত্তি। মন ও চোখ খুলে দেখলেই সময়ের ভয়ঙ্করতা লক্ষণীয়। যেমন- নিজের থেকে শুরু করলে একদিন বিশ্বতে গিয়ে মিশলে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। যেমন – নিজের ভালো মন্দ, পরিবারের ভালো মন্দ, পাড়ার ভালো মন্দ, গ্রামের ভালো মন্দ, অঞ্চলের ভালো মন্দ, ব্লকের ভালো মন্দ, মহকুমার ভালো মন্দ, জিলার ভালো মন্দ, রাজ্যের ভালো মন্দ, দেশের ভালো মন্দ, বিশ্বের ভালো মন্দ। যদি ঠিক ভাবে দেখি তাহলে দেখতে পাব বিশ্বের নানা কূটনৈতিক খবরাখবর। দেশের পরিস্থিতি বালাজী মন্দিরের প্রসাদ এর লাড্ডু নিয়ে বিতর্কিত পরিবেশ। তেমনই রাজ্য নিয়ে দেখতে গেলে দেখব অভয়া কাণ্ড। জেলা নিয়ে দেখতে গেলেই বন্যা কাণ্ড। মহকুমা নিয়ে দেখতে গেলে দেখব নিত্য দিনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার সাবির্ক কাণ্ড। ব্লক নিয়ে দেখতে গেলে দেখব নিত্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাণ্ড। অঞ্চল নিয়ে দেখতে গেলে আঞ্চলিক উন্নয়ন কাণ্ড। গ্রাম নিয়ে দেখতে গেলে দেখব গ্রামীণ উন্নয়ন ও সামাজিক কাণ্ড। পাড়া নিয়ে দেখতে গেলে দেখব প্রতিবেশী কাণ্ড। আর পরিবার নিয়ে দৈনন্দিন কাণ্ড ও সর্বশেষ নিজেকে নিয়ে দেখতে গেলে ব্যক্তিগত কাণ্ড। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি জীবনের মূল্যবোধে যুক্ত হয়ে পড়েছে কৌতূহল।
সংস্কৃতির অন্যতম আকর্ষণ হল শিক্ষা। অথচ আশ্চর্য ভাবেই সেই শিক্ষা বিক্রি দেখা গেল।
মানুষের বেঁচে থাকার মূল বিষয়গুলি হল, খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান, পানীয় জল ও স্বাস্থ্য এই বিশেষ দিকগুলি যদি সরকার পক্ষের আমলা দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে সংস্কৃতির কতবড় ক্ষতি তা কি তাকিয়ে দেখা হবে না ! কুর্শি আর ক্ষমতা অধিকারের লক্ষে যদি অভয়া কাণ্ড ধামা চাপা দিতে চাই অথবা গরু ও কয়লা পাচারের অভিযোগ কারীদের সম্মানের সঙ্গে বড়ো করা হয় বা খাদ্য ও জল নিয়ে হাস্যকর হতে হয় অথবা গরীব মানুষের ঘরের অর্থ নিয়ে যদি অভিযোগ শুনতে হয় তাহলে কুর্শি বাঁচিয়ে কি লাভ। ক্ষমতা বলে হয় তো পরিবার পাড়া গ্রাম অঞ্চল ব্লক মহকুমা বা জেলা হতে পারে তাই বলে রাজ্য বা দেশ নয়। রাজ্য বা দেশ চালাতে গেলেই জনগণই নির্ধারণ করবেন সঠিক ও সময়ের অন্যতম অধিকার কার পক্ষে দেওয়া হবে। জনগণ ক্ষিপ্ত হলে রাজ্য ও দেশের সিংহাসনে যিনিই থাকুন না কেন সরাতে সময় লাগবে ৫ দিন।
সাধারণ ভাবেই বলতে পারি। মানুষ হয়ে বাঁচার গল্প। প্রাণ নিয়ে কুর্শি রক্ষা না করায় ভালো। বিদ্বেষ পোষণ করে দেশ বা রাজ্য ক্ষমতায় না রাখায় বুদ্ধির মুক্তি। মানুষ আজ একে অপরের খুব সহজেই কাছাকাছি আসতে পারছেন। কারণ সশ্যালমিডিয়া। নচেৎ, “ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না”।
শিল্পী ও সাহিত্য প্রেমিকেরা তাঁদের নিজস্বতা দিয়েই বিভিন্ন ভাবেই প্রতিবাদ করছেন তাঁদের সম্মান করতে শিখুন। তাহলেই মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান বোধ চালু হয়ে যাবে। 🍁
🍂কবিতা
সুনীল মাজি
আমাদের মাঠগুলো
এক বিস্তৃত প্রান্তর ছাড়া আমরা কিছু চাইনি।
চেয়েছি রৌদ্রকরোজ্জ্বল—চেয়েছি বৃষ্টিস্নাত জ্যোৎস্নায়
অরণ্যঘেরা এক দ্রাঘিমার ভিতর ও বাহির পতঙ্গধ্বনি।
স্টেথোয় ধরা পড়বে তারার আগুন—আলোর বাজনায়
বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে মানুষ ঘুমাবে জানালা খুলে।
কিশোর বাজবে কিশোরী নাচবে জাতধর্ম বিভাজন ভুলে।
গাছের সবুজ পাতায় ভরে যাবে পোশাক আসাক
অগ্রজরা অনুজের মাথায় হাত রেখে বলবে : সুখে থাক।
কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের মাঠ? বহুতল ছায়া
ডায়ানাসোরের কঙ্কাল গুহা— উদ্বৃত্ত মানুষের মনুষত্ব
ঢুকে পড়েছে সংকীর্ণ অন্দরে —প্রকৃতিহীন এক আজব দুনিয়া
কেড়ে নিয়েছে আমাদের পায়ের ধুলোমাটির মানচিত্র
ছোট ছোট গাছগুলো দুলছে দোলনায় পাখিরা খাঁচায়
ফুলে গন্ধ নেই— স্বরে কলতান নেই, মোবাইলে এর তার দিকে চায়
কেউ তেমন কথা বলতে চায় না ঝড়বৃষ্টির সুরে।
কোথায় হারিয়ে গেল নদীমাঠচাঁদ দৃশ্যের ওপারে!
আমাদের আর কারও ঘর নেই বোধ হয়
সূর্যাস্তের পারে বসে প্রতীক্ষায়—এখনও হয়নি সূর্যোদয়।
গৌতম হাজরা
নীরব, নির্বাক
কাগজের নৌকো ভাসিয়ে দিলেই শৈশব
আর শৈশব হাওয়ায় ভাসালেই যৌবন
তখন সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে এগিয়ে যাওয়া নিজস্ব অভিধানে
অথচ, রোজই চলে সমুদ্র মন্থন
তুলে আনা তরল গরল
যে গরল গিলতে গিলতে এগিয়ে যাওয়া
অন্য দিবাস্বপ্নে
যেখানে চারিদিক ঘিরে থাকে ধোঁয়ার কুন্ডলী
যেখানে শুধুই নীরব, নির্বাক!
পরাণ মাঝি
আলোর মাস্তুল
ভুল
তোমার, ছিল না
ছিল
তাদের, যারা বিষবৃক্ষ জেনেও শেকড় শুদ্ধ উপড়ে ফ্যালেনি প্রথম রাতে
ফুল
তুমি, চেতনা জাগানিয়া ফুল; প্রতিবাদের নীরব দুল
ভুল
তোমার, ছিল না একচুল
ফুল
তুমি, আঁধার ঘুচিয়ে আলোর মাস্তুল
🍂গল্প
_____________________________________________
নিজস্ব গাঁ ছিল ওর। মায়ের শরীরের গন্ধের মতন মাটির গন্ধ তার চারপাশে একটা বলয়ের মতন ঘিরে থাকত।দামুদরের চরে গরুবাগালি করা একট জীবন ছিল। গোবরকুড়ানি মা আর পরের ঘরে মুনিষ খাটা বাপ। তালপাতা ছাওয়া মাটির ঘর। মাড়ভাত আর আমানির লিত্যজীবন।
_____________________________________________
জলডুবি গাঁ
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
দীনবন্ধু মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে। বসে গল্প করে। চা বিড়ি খায়। তারপর একসময় বলে- ‘উঠি মাস্টর। তুমি বড় ভাল লেখ।ই লেখাগুলা শুনার লাইগেই তুমার ঠেনে আসি।’ দীনুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি, একসময় তার ছায়া মিলিয়ে যায়।তখন নিজের মনেই হাসি-চা বিড়ি পান বা মদ নয় দীনুও বলে কীনা গল্পের নেশা। কাজকম্মো বলতে তেমন কিছু স্থায়ী কাজ নেই ওর।যখন যা পায় তাই করে, কৃষিমজুর থেকে ঠিকা লেবার। বেশিরভাগ দিন কাজ জোটে না।তখন এর ওর বরাত শুনে দুচার পয়সা পায়। আমার কাছে দীনু কেন আসে আমি নিজেও জানি না। সত্যিই কি ও-গল্প ভালোবাসে? তাও আবার আজকের কেন্দ্রবহির্ভুত গল্প। বিশ্বাস হয় না আমার, মনে হয় সে কিছু বলতে চায়। অথচ বলতে পারে না। তবু দীনু একদিন না এলে ঘরটা ফাঁকা লাগে। কেমন যেন শূন্য মনে হয় সবকিছু। মনে হয় আজকের কর্মসুচির মধ্যে কিছু যেন বাদ পড়ে গেছে।
সেও নিয়ম করে দু’বেলা আসে। গল্প না শুনলে না কি তার ভাত হজম হয় না। চোঁয়া ঢেকুর ওঠে। অথচ সেই দীনুই আজ ক’দিন হল বেপাত্তা। লিখতে লিখতে এ-পাশ ও-পাশ করি। লেখার ভেতরে ঢুকতে গিয়েও বারবার দরজার দিকে চলে যায় চোখ। কেউ কি এল? না কেউই তো নয়। মন বসে না লেখায়। গল্পের জানলা খুলে চরিত্রগুলো ঠিকমতো কাছে আসে না। অথচ এতদিনের লেখালেখিতে তেমন তো এর আগে। নিজেই চমকে উঠি আমি কি লেখার কথা না ভেবে দীনুর কথাই ভাবছি বেশি করে? দেখতে দেখতে আরও দু’দিন পেরিয়ে গেল।
এক সপ্তাহ। কম সময় নয়।সাতদিন। লোকটার কী হল বুঝতে পারছি না। এতদিন টানা কাজ করে যাওয়ার লোক দীনু নয়। জ্বর সর্দি বা কোন শরীর খারাপ হয়নি তো? এসব সাত পাঁচ ভাবনার ভেতরই খাতা খুলে বসি। গল্পটা শেষ করতে হবে তিনদিনের মধ্যে।সম্পাদকের কড়া নির্দেশ। পুজো আসছে। প্রেসে প্রায় সমস্ত ম্যাটার চলে গেছে। শুধু আমার গল্পের জন্য পাঁচটা পাতা ছেড়ে রেখে দিয়েছেন সম্পাদক। যেভাবেই হোক এই সময়সীমার মধ্যে লেখাটা শেষ করতে হবে। পুজোর লেখাগুলো এরকমই হয়। ইচ্ছে না থাকলেও অর্ডার যখন ধরেছি তখন তা যোগান দিতেই হবে। ফলে সব ধরনের সামাজিকতা বন্ধ রেখে লেখার কাছে এসে বসতেই হয়। ফলে দীনুর বাড়ি গিয়ে দেখা করার ইচ্ছেটা আর বাস্তব রূপ পায় না।
সাদা কাগজের উপর লেখা গল্পটার দিকে তাকিয়ে থাকি।আজকের গল্পটা একটু অন্যরকমের।এ গল্প দীনুদের নয়।একটা পুরানো বাড়ি।যার গায়ের উপর লেগে আছে ইতিহাসের দাগ। সভ্যতার ধ্বংসস্তুপ খুঁড়ে সেই খননচিহ্নগুলি লিখতে হবে।শব্দের পর শব্দ গাঁথতে গাঁথতে আমি যেন সেই ঘরটার ভেতর ঢুকে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। যে ভাঙা ঘরটার দিকে আঙুল তুলে দাদু বলত –এখানেই আমাদের আসল বাড়ি ছিল।
দাদুর হাত ধরে আমি তখন একটু একটু করে চিনতে শিখছিলাম গাছ নদী আর পাথরের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব। পুরানো একটা পাথর কুড়িয়ে গন্ধ শুকতে শুকতে দাদুকে জিজ্ঞেস করতাম – এই পাথরটার গায়ে কি কোন ইতিহাস আছে?
-কেন থাকবে না? এগুলোই তো চিহ্ন।
-কী রকম ?
-প্রত্যেক পাথরেই কিছু কিছু স্মৃতির আঁচড় আছে। এতেও থাকবে।
-কী ইতিহাস, তোমার মনে আছে?
দাদু বলত – আমি তখন কোথায়? আমার দাদুর দাদু নিজেদের গ্রাম থেকে সরে এসে আমরা যেখানে আছি সেখানে বসত গড়েছিল। ঠিক এখানেই ছিল আসল বাড়িটা। দাদু একটা ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। সারাদিন আমরা দু’জন ঘুরে বেড়াতাম মাঠে প্রান্তরে, খেতে অথবা নদীর চরে। আমার মনে হত পুরানো দিনগুলো নতুন জীবন নিয়ে ফিরে আসছে আবার। মুক্তবিহঙ্গের মতো সময়ের অন্য প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে আর আমি যেন স্পর্শ করতে পারছি তার অস্তিত্ব। এই মুহূর্তগুলো আমার নিজস্ব। এক একটা দিন ছিল স্বপ্নের মতো। মনে হত এই দিনটা যেন আমার নিজের। আমার একলার। আর কারোও নয়, অন্য কোন লোকের নয়। পুরনো পাথর গাছপালার ভেতরে যেন আমারই স্পর্শ লেগে আছে। হ্যাঁ আমার কোন পূর্বপুরুষের। আমি তো তাদেরই শরীরের একটা অংশ। আমিও তো কোথাও স্বপ্নের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম তাদের স্মৃতিকোষে, তাদের নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছের গোপন প্রকোষ্ঠে। শুকনো ধুলো ওড়া দিন সেই স্মৃতি থেকে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে এখানে। দাদু হাঁফ ধরত বুকে। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসত দাদু। অল্পক্ষণ। আবার শুরু করত হাঁটতে।
তখন তার চোখে ঝিলমিল করে উঠত আলোর নাচন। জাগতিক সব ব্যর্থতা আর তুচ্ছতাকে দু’পাশে সরিয়ে রেখে সুখের খাঁচা বুনতে বুনতে দাদু বলে উঠত – তুই আমার বুকের ভেতরটা দেখতে পাস, এর চেয়ে শান্তি আর কীসে আছে বল। এই কথাগুলো বলতে বলতে তার উল্লাসমুখর হৃদয়ের ভেতর আমি দেখতে পেতাম নিজেকেই। গল্পটা এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল মনের ভেতর। এই গল্পভাবনার ভেতর দীনু কখন এসে দাঁড়িয়েছে আমি টের পাইনি।
-মাস্টর কি লেখচ্য আইজ ?
-তেমন কিছু না।
-বইল্লে হবেক। নিজের মনের ভিতরে ডুইবে গুগলি তুলছিলে, আমি যে দেইখতে পাইলম।
-তুই দেখতে পাস সবকিছু?
-সব কি পাওয়া যায় মাস্টার? তবে অনেককিছু দেইখতে পাই। যা হয়ত চইখের ছামুতে নাই।
পড়ার আগে ভাবছিলাম আমি যেমন দাদুর ভেতরটা দেখতে পেতাম দীনুও কি সেভাবে আমাকে দেখতে পায়? বাধ্য হয়ে যতদূর লেখা হয়েছিল আমি পড়ে যাই।
‘’রাতে ঘুম না এলে আমি আমবাগানের কাছে এসে দাঁড়াই।হাঁটতে হাঁটতে আমার শরীর থেকে খুলে যায় বর্তমানের পোশাক। বহু যুগ আগে আমাদের যে পুরানো জনপদ ছিল তার কথা ভাবতে থাকি, সে দেশ তো আমি দেখিনি। তবু কল্পনার ভেতর তার মানচিত্র ডানা মেলে আমার কাছে আসে। কেমন ছিল তখনকার মানুষ।আমার দাদুর দাদু যাকে আমি দেখিনি কখনও। তার সাথে দেখা হলে সে কি আমার পাশ দিয়ে নির্বিকার হেঁটে যাবে নাকি থমকে দাঁড়াবে এক অদ্ভুত স্নেহে? ভাবতে ভাবতে সেই গ্রামটার ভেতর আমি ঢুকে যাই। অন্ধকারের ভেতর ডুবে আছে সারা গাঁ।আমি হাঁটতে থাকি। ছায়ার মতো একটা মানুষ পেরিয়ে গেল আমার সামনে দিয়ে আমি তাকে চিনতে পারলাম না। হাঁটতে হাঁটতে আমার পা ব্যথা করতে লাগল। তবু এক অদ্ভুত শক্তি যেন পেয়ে বসেছে আমাকে। নিজেদের ইতিহাস ভূগোল আর শেকড়ের গল্পগুলি জানতেই হবে আমাকে।একটি ঘরের সামনে এসে থামলাম। লম্ফের আলোর ম্রিয়মাণ শিখায় মনে হচ্ছে কেউ জেগে আছে এখনও। তালপাতার ছাউনি দেওয়া একটা মাটির ঘর। জানালা নেই একটা কুলুঙ্গির ভেতর দিয়ে অস্পষ্ট আলোর ইঙ্গিত।আমি থামলাম। দেওয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। কোন শব্দ ভেসে আসছে না। আমি মৃদু গলায় বললাম – কেউ আছেন? কোন উত্তর এল না। এবার সচেতন ভাবে একটু জোরে বললাম – কেউ কি জেগে আছেন?
নড়াচড়ার শব্দ স্পষ্ট টের পেলাম। ঠিক দরজা নয় আগুড় খুলে কেউ একজন বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সুদর্শন পুরুষ। গলার স্বরে গম্ভীর ব্যক্তিত্ব।আমাকে দেখে বিচলিত ভঙ্গিতে বলল- এত রাতে? কোন বিপদ হয়নি তো?
আমি হ্যাঁ বা না কিছুই বললাম না।স্তব্ধ হয়ে লম্ফের আলোয় যতদূর দেখা যায় দেখতে লাগলাম। বিপদ নয় সময়ের অন্য এক প্রান্ত থেকে আমি একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। জীবনের ভেতর থেকে শীতল ছায়া সরিয়ে আমি তাকে দেখব। নিয়ম ভাঙার দুর্বিনীত বেপরোয়া সাহস তখন আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি যেন আমার নিজের সময়ে নেই। নিজের মধ্যে ভয়াবহ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বর্তমানের কোন অস্তিত্ববিন্দুতে যেন আমি আর নেই। এক রহস্যময় ভাঙনের ভেতর দিয়ে আমি যেন এসে দাঁড়িয়েছি এখানে। খুঁজে পেতেই হবে তাকে।
গম্ভীর কণ্ঠে পরশন ভেসে এল- তুমি কি তাকে চেনো ?
-না।
তাহলে বুঝবে কী করে?
-বোঝার দরকার নেই শুধু সেই মানুষগুলোকে দেখলেই হবে। যারা আমাদের-ই কেউ। যাদের ভেতরের অন্তস্রোত থেকে আমি বা আমরা এসেছি।
-এর জন্যই কি তুমি এই অন্ধকারে ছুটে এসেছো?
আমি বললাম – হ্যাঁ ।
লোকটা বলল- তোমার চোখ কই?
আমি বললাম –এই তো দু’টো চোখ জ্বলজ্বল করছে।
লোকটা হাসল বিস্ময়াতীত হাসি- এই চোখ দিয়ে সময়ের অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না তুমি। চোখের ভেতর ক্যাপল্যাম্প জ্বেলে ইতিহাসের খনিগর্ভে ঢুকতে হয়। তোমার সে চোখ নেই…”
আমি দীনবন্ধুর দিকে তাকালাম –এসব পাগলের প্রলাপ শুনে তোর মাথা খারাপ হবে। আর আমাকেও উন্মাদ ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না তোর।
দীনু চেয়ে আছে আমার দিকে। তার অপলক চোখের দৃষ্টিতে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ গল্প পরাবাস্তবের সঙ্গে বাস্তব মিলেমশে একাকার। সুররিয়েলিজমের অনন্ত স্পর্শ দীনু বুঝবে কী করে?
দীনু একবুক কৌতুহল নিয়ে গিলে খাচ্ছিল আমাকে। যেন প্রতিটি শব্দের ভেতর রয়েছে খিদের আগ্রাসন। একসময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ঘটনাটা এতটাই আচমকা ঘটে গেল যে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বিদ্যুৎচমকের মতো আমার গলা থেকে বেরিয়ে এল একটি মাত্র বাক্য- তুই কাঁদছিস দীনু?
দীনু কোন উত্তর দিল না। চুপিচুপি সরে এল আমার কাছে। যেখানে সাদা পাতার উপর অক্ষরের মানচিত্র।তারপর বলল- আমার বুকের ছামুতে কান পাত মাস্টর। কিছু শুইনতে পাইছ?
আমি ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ ছাড়া কিছুই টের পেলাম না।
বললাম – কই না তো
‘কিছুই পাইছ নাই? জলের তোড় শুইনতে পাইছ নাই? দু’কূল ভাসানঅ দামুদরের বান। ‘দীনু বলে যাচ্ছিল- “মানুষের শিকড় খুঁজার গল্প লেইখ্যেছ মাস্টর। হাঁরাই যাওয়া মাটির সুলুকসন্ধান কইরতে আইস্যে তুমি ইট কার কহনি লেইখল্যে। ই গল্পে ফুঁফাই উঠা মানুষের বুকফাটা কান্না কই?” বলতে বলতে দীনু ডুবে যাচ্ছিল ওর অতীতপুকুরে। স্মৃতির তলদেশ ছুঁয়ে সে তুলে আনছিল তার নিজের গাঁয়ের গল্প। তার নিজস্ব উচ্চারণের সঙ্গে আমার শব্দ মিলেমিশে যা দাঁড়িয়েছিল তা এরকম-
ছোটবেলায় নিজস্ব গাঁ ছিল ওর। মায়ের শরীরের গন্ধের মতন মাটির গন্ধ তার চারপাশে একটা বলয়ের মতন ঘিরে থাকত।দামুদরের চরে গরুবাগালি করা একট জীবন ছিল। গোবরকুড়ানি মা আর পরের ঘরে মুনিষ খাটা বাপ। তালপাতা ছাওয়া মাটির ঘর। মাড়ভাত আর আমানির লিত্যজীবন। এসব মানুষের গল্প লিয়ে বিক্রিবাঁটা কম। তাই শিক্ষিত লেখকেরা কেন লিখবে এই জীবনবৃত্তান্ত? সেবার মেঘছ্যান্দা বর্ষা। বৃষ্টির তোড়ে আর আচকা ড্যামের জল ছাড়ায় জলের তলে তলিয়ে গিয়েছিল ওদের পুরো বস্তি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল বাড়িটা। বাপ আর মা ভাসতে ভাসতে কুথায় চলে গেছে দীনু জানে না। নদীর জলে সে নিজেই তখন দিশাহারা। অগাধ জলে সাঁতার দেবেই বা কীভাবে? কপাল ভালো একটা আধমরা গাছের ডাল ধরে সে ঝুলেছিল চারদিন।খাবার দাবার ছাড়া একদম লিজ্জলা উপাসে। এই জীবনবৃত্তান্ত বলতে বলতে দীনু কাঁদছিল আর বলছিল- ‘লিজের মা বাপ ভাইবুইন সব কুথায় বিরবিত্থান হইয়ে গেল।আর খুঁইজে পালি নাই। গাঁ ট চইলে গেল নদীর গাভায়। জীবন ত বানের মতনই। ভাসাইতে ভাসাইতে লিয়ে আইল তুমাদের গাঁয়ে।খাইটে খাওয়া মানুষের কনহ দ্যাশ নাই।যেখানে পেট সিটই তার দ্যাশ।’
অবাক লাগা চোখ আমার। আপাত শান্ত মানুষটার ভেতর অন্য এক মানুষ।ভেতরে ভেতরে সে কতটা উত্তেজিত তা বুঝতে পারছিলাম। তার হাত কাঁপছে।শরীর কাঁপছে। চোখের পাতা কাঁপছে। বিড়বিড় করছে ঠোঁট দু’টো। আশ্চর্য অতীত ফেরানো চোখে যেন এক তড়িৎ আবেশ ঘিরে রেখেছে তাকে।
বুকের ছামুতে কান পাত মাস্টর কিছু শুইনতে পাইছ? চইখের ভিতর চিক চিক কইরছে যে জল সেখানে কিছু দেইখতে পাইছ মাস্টর?
জিজ্ঞাসায় জিজ্ঞাসায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিল আমার অস্তিত্ব। চর জেগে উঠছিল মনের ভেতর। চোখ খুলে যাচ্ছিল। জানলা খুলে যাচ্ছিল। সমস্ত আড়াল সরে যাচ্ছিল।
“একট জলডুবি গাঁ এখনও আমার বুকের ভিতর জাইগে আছে। সি মাটির মহককেই আমি দিনরাইত মা ডাকি…” দীনু বলে যাচ্ছিল আরও অনেক কথা। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি শুধু ওর বুকের ভেতর উথালপাথাল জলের তোড় শুনতে পাচ্ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম দু’কূল ভাসানো প্লাবন। সময়ের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম আলো জ্বলে উঠছে ওর চোখে। আশ্চর্য ক্যাপল্যাম্প। জলের ভেতর ডুবে যাওয়া একটা গ্রাম তার মানুষজন আর শেকড়ের রহস্যগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল আমি এতদিন কী লিখেছি। চোখের সামনে দেখতে পাওয়া দেশ কাল ভূখণ্ডের কথা! কিন্তু হারিয়ে যাওয়া একটা মাটিকে খুঁজে পেতে গেলে যে চোখ লাগে, তা আমি খুঁজে পাইনি এতদিন। হয়ত কোথাও তলিয়ে ছিল। আজ এতদিন পর দীনুর বানভাসি চোখের নিচে ডুবে যাওয়া একটা গ্রামকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম – জলডুবি গাঁ। 🍁
🍂কবিতা
মিঠুন চক্রবর্তী
গাঁট
দু’টো সুতো
দু’জনকে আষ্টেপৃষ্ঠে সমান ভাবে জড়িয়ে ধরলে
গাঁট হয়,
বোঝেনি অবুঝ সুতো
তাই একা একা পাক খেয়ে অন্য সুতোকে
জড়িয়েছে হাজারবার
তারপর দিনের শেষে পশ্চিমে যখন আলো ডুবে গেছে
অনেক দূরের পূবে একই সূর্য ছড়িয়েছে নতুন সকাল
অন্য সুতো সহজ টানে মুক্ত হয়ে বলে ‘ ফস্কা গেরো ‘
রাতের অন্ধকারে
দোমড়ানো মোচড়ানো বুকে দাঁড়িয়ে থাকে
অন্য সুতোর শূন্যতা জড়িয়ে একাকী সুতোটি
গোলাম কবির
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
তোমাকে যতোবারই অস্বীকার করতে চাই
ততোবারই ফিরে আসো গভীর ভালোবাসায়।
যতোবারই ভাবতে চাই
তুমি আমার কেউ নও,
ততোবারই হৃদয়ের গহীন ভিতর থেকে
কী এক গভীর বিশ্বাস ভরা আবেগে
জলদগম্ভীর কণ্ঠে ভেসে আসে
তোমার লেখা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত
“আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি “।
যতোবারই বিভিন্ন ঋতু ফিরে ফিরে আসে
ততোবারই তোমার লেখা গান, কবিতায়
ফিরে আসো তুমি –
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তে ;
সেই তুমিই তো আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ!
শুভমিতা বিশ্বাস
বিচ্ছেদের ছায়া
আর কিছুদিন পর দরজায় এসে দাঁড়াবে
বিচ্ছেদের ছায়া
একটা কলমের কালিতে
যে সম্পর্কটা কোনোদিন তৈরীই হয়নি
সেই সম্পর্কটাই নাকি ভেঙে যাবে একটা কলমের খোঁচায়
আমার চোখের ভিতরেই ধুয়ে যাবে
তোকে স্পর্শ করার সাহস
বুকের ভিতর বয়ে যাবে
তোর শরীরের চন্দনগন্ধ
আচ্ছা, আমাদের কি আর কখনো মাঝরাতে নীল-ভিক্টোরিয়া দেখা হবেনা?
তুমুল ঝগড়াটাও হারিয়ে যাবে
গভীর নির্জনতায়
তবে,আমাদের দেখা না হলেও
আমরা থেকে যাবো
এই শহরের হৃদয়ে
থেকে যাবো,সেই পুকুর ঘাটটাতে
যেখানে পূর্ণিমার আলোজলের পাশে দাঁড়িয়ে
প্রথমবার জড়িয়ে ধরেছিলাম তোকে
যদি কখনো মনে পড়ে
কথা দিলাম দেখতে পাবি
সেই হলুদ বারান্দায়,
যেখানে দুজনের একসাথে বসে বাইরের আকাশটা দেখার ইচ্ছে ছিলো
তবে কি জানিস,
শত ভুলের পরেও
অভিযোগের পরেও
আজও তোকে হারানোর ভয়ে
ঘুম ভেঙে যায়
আর বুঝতে পারি
আমরা কেউই
দুজনের মাঝখানের পাথরের দেওয়ালটা ভেঙেচুরে কাছে
কাছে আসতে পারছি না
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
আমাদের পালিত বাঘ
আমাদের সমাজে প্রতিদিন পালিত হচ্ছে, অভিনব বাঘ
রক্ত মাংস মজ্জা বেয়ে উঠে যাচ্ছে বারবার
তার নব নব হত্যার প্রয়াস
অথচ আমরা এভাবে একটু করে সরে দাঁড়াচ্ছি
তার আবর্ত টুকু ছেড়ে রেখে
অবলীলায় হিংসুক দৃষ্টিতে প্রতিদিন ছিঁড়ে খাচ্ছে
কুমারী মাংসের ওম
প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখি পায়ের তলায় ফেলছে
তার প্রিয় খাঁচার জঞ্জাল
একদল দুর্বৃত্ত, তার পাহাড়ায় সাজাচ্ছে-
এ শহরের পালিত চিড়িয়াখানা
পিন্টু কর্মকার
অভিমানের হিমমিশ্র
মাঝে মাঝে ভাষাগুলো বোবা হতে চায়…
কবিতা তো জীবনের অল্প ক্ষেত্রফল;
বাকি অধ্যায়ে পৃষ্ঠা টানা-ছেঁড়ার কত অবাঞ্ছিত!
অনেক না পেয়েও এগোতে হয়—
হয়তো তা লিক হওয়া সাইকেলের মত।
যান্ত্রিক লাভের দরজায় এসে—
আত্মিক লাভের গল্প…
কে, কোথায় হারিয়ে যায় এ সময় সমুদ্রে?
তবুও সম্পর্কের মাছ লুকিয়ে রাখে অভিমানের হিমমিশ্র…
🍁ধারাবাহিক উপন্যাস /১৭
_____________________________________________
সোমা আরও বেশি তার ওপর নজর রাখছেন। ঘুরতে ফিরতে অনঙ্গ কোথায় আছেন, কি করছেন, দেখে চলে যায়। কি ভাবে কে জানে? বাইরে জিউলী গাছটায় অনেক পাখি এসে বসে। তাদের দু’টো একটার নাম ছাড়া অন্যগুলোর নাম জানেন না অনঙ্গ। তাতে আর কি হল? তিনি তো আর পক্ষী বিশারদ নন যে তাকে জানতেই হবে!
_____________________________________________
অনেকটা গল্পের মতো
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
“গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা
আমার যা কথা ছিল, হয়ে গেল সারা।
হয়তো সে তুমি শোনো নাই,
সহজে বিদায় দিলে তাই ।
আকাশ মুখর ছিল যে তখনো
ঝরঝর বারিধারা।
চেয়েছিনু যবে মুখে, তোলো নাই আঁখি
আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিনু ঢাকি।
আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে?
জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা।।”
চোখের কারণে অনেকদিন কিছুই লেখেননি অনঙ্গ সেন। যেদিন প্রথম জানলেন যে, আর কোনওদিনই ডানচোখে দেখতে পাবেন না, সেদিনই ভেবেছিলেন যে আর লেখালেখি করে বা বই পড়ে বাঁচোখটাকে নষ্ট হতে দেবেন না। বেশ কিছুদিন মেনেও চলেছেন। শুধুই চোখের যত্ন ছাড়া আর কিছুই ভাবেন নি। কিন্তু ঐ যে বলে, ‘মদ্যপের প্রতিজ্ঞা ‘। তাই দু’দিন যেতে না যেতেই মন উসখুশ করা শুরু করে দিয়েছে। আজ আবারও পায়ে পায়ে লেখার টেবিলের দিকে কখন এগিয়ে এসেছেন নিজেও বুঝতে পারেননি। যেভাবে মদ্যপ ব্যক্তি নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করলেও সন্ধ্যে হলেই শুঁড়িখানার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়, তেমনভাবেই টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে থাকেন তার টেবিল এখন অন্যদিনের থেকেও বেশী সাজানো। যেন প্রতিদিন কেউ যত্ন নিয়ে গুছিয়ে রেখে যায়। কেউ বলতে তো আর কেউ নয়, এমন পরিপাটি সাজানো সোমা ছাড়া আর কারুর হাতের ছোঁয়া হতে পারে না। চেয়ার টেনে বসে অনঙ্গ একটা সিগারেট ধরালেন। বাইরের জিউলী গাছটায় বৃষ্টি ধোঁয়া পাতাগুলো আরও সবুজ, আরও চকচকে। অনঙ্গ ছোটবেলা থেকে শুনেছেন সবুজ রঙ চোখের জন্য নাকি খুব উপকারী। বেশ কিছুক্ষণ আনমনে তাকিয়ে থাকেন জানালার বাইরে জিউলি গাছটার দিকে। কতোকিছু মনের জানালা দিয়ে আসে আর চলে যেতে থাকে। এখন এই চোখের এমন অবস্থা হবার পর সোমা আরও বেশি তার ওপর নজর রাখছেন। ঘুরতে ফিরতে অনঙ্গ কোথায় আছেন, কি করছেন, দেখে চলে যায়। কি ভাবে কে জানে? বাইরে জিউলী গাছটায় অনেক পাখি এসে বসে। তাদের দু’টো একটার নাম ছাড়া অন্যগুলোর নাম জানেন না অনঙ্গ। তাতে আর কি হল? তিনি তো আর পক্ষী বিশারদ নন যে তাকে জানতেই হবে! অনেক কিছুই তো না জেনেই এতকাল কাটিয়ে দিলেন, বাকী দিনগুলোও ঠিক কেটে যাবে। যদি কোনও একসময় বাঁচোখটাও আর দেখতে না পান, তাহলে এভাবেই পাখির কলতান শুনেই নাহয় কাটিয়ে দেবেন।
এভাবেই বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন আনমনে গুনগুনিয়ে ওঠেন অনঙ্গ… তার প্রিয় রবিঠাকুরের গান।
“গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকে ছিল তারা
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা।।
হয়তো সে তুমি শোনো নাই,
সহজে বিদায় দিলে তাই।
আকাশ মুখর ছিল যে তখনো
ঝরঝর বারিধারা, ঝরঝর বারিধারা।
চেয়েছিনু যবে মুখে, তোলো নাই আঁখি
আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিনু ঢাকি।”
আর কি কখনও কবে এমন সন্ধ্যা…
পায়ে পায়ে কখন সোমা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেননি অনঙ্গ। কোনো প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও অনঙ্গর সুর তাল ও স্বর প্রক্ষেপনে কোথাও এতটুকু আড়ষ্টতা, ত্রুটি খুঁজে পান না সোমা। অনঙ্গ থামতেই বলে ওঠেন, ‘থামলে কেন? গাও’ বলে নিজেই গাইতে শুরু করেন…
“আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে?
জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা… হয়ে গেল হারা… গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকে ছিলো তারা “।
শেষদিকে তারও গলা ধরে যায়। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কোথায় নিজেই নিজের কাছে ধরা পড়ে যান। এতদিন অনঙ্গর সামনে নিজেকে ভীষণ কঠিন রাখার চেষ্টা করেছেন। আজই বুঝি হেরে গেলেন সোমা।অনঙ্গ এই পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। বোবা মুখে একটা দুঃখ চাপা হাসির আভাস ফুটে ওঠে। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে। কিছুতেই বাঁধ মানাতে পারেন না তিনি। এই মড়া চোখে এখনও কেন যে এত জল আসে, বিব্রত করে মানুষের সামনে, অনঙ্গ বুঝে পান না। সোমাকে লুকিয়ে চোখের জল মুছে নেবার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার ভারী হয়ে যাওয়া গলার স্বর তার সব চেষ্টাকে বৃথা করে দেয়। অনঙ্গ সামাল দেবার চেষ্টা করেন, ‘তুমি কখন এলে?’ সোমা এসে পিছন থেকে চেয়ারের ওপর থেকেই জড়িয়ে ধরে, তারপর বলে, ‘নাহয় তোমার একটা চোখ চলে গেছে, ডাক্তার তো চেষ্টা করছেন বাঁ-চোখটাকে বাঁচিয়ে রাখার। এতো ভাবছ কেন? না-হয় যদি লিখতে নাই পারলে, তোমার গলায় এখনও যে সুর খেলা করে, তাকে নিয়ে বাকী দিনগুলো কাটাতে পারবে না?’
অনঙ্গ বোঝাতে পারেন না লেখাটা তার প্যাশন। দু-মুঠো খাবার কম পেলে তার দুঃখ হয় না, কিন্তু এই যে লিখতে পারছেন না, হয়তো আরও যত দিন যাবে লেখা ততই একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, এটাকে তিনি মেনে নিতে পারছেন না। হয়ত কোনও বড়ো পত্র-পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয় না, কিন্তু তার নিজস্ব কিছু পাঠক আছে। তারা তার লেখা ভালবাসে। তাদের বঞ্চিত করতে হবে, এই ভাবনাটাই তাকে পীড়া দেয়! অনঙ্গ কথা ঘুরিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন, ‘আজ ‘সোমা’জ কিচেন’-এ স্পেশাল মেনু কি? সোমা উত্তর দেয় না, নাকি দিতে পারে না? এভাবে অনঙ্গর সামনে ভেঙে পড়তে তো তিনি চান নি। তবে আজ কেন এমন হল? শুধুই কি গানটা অনঙ্গর এই সময়ের সঙ্গে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক বলেই? যেখানে যত জমে থাকা মেঘ কেন এমন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে তাঁর চোখে? আলগোছে শাড়ীর আঁচলটা চোখে চেপে ধরেন। শুধু অনঙ্গর সামনে থেকে পালিয়ে যাবার জন্যই বলেন, ‘তুমি বোসো, আমি একটু চা করে নিয়ে আসি’
অনঙ্গ যেতে দেন। সোমাকে তিনি সারাজীবন ধরে প্রায় কিছুই তো দেননি। ওঁর এই কান্না লুকোনোর অধিকারটাকে আর কেড়ে নিতে চান না। (ক্রমশঃ)
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
