



সম্পাদকীয়
জনগণ থামবেনা
এ বিচার মানবে না
সময়ের অপেক্ষাতে
অভয়া’রা হারবেনা
রাজনীতি হারিয়ে যা
এ আমার মাটির মা
সবার বুকের ব্যথা
রাজপথে থামবে না
জনগণ আগুন হো
মা মেয়ে কারোর বৌ
ওরে সব মায়ের জাত
হাতে হাত দিয়ে এসো
জয় গান উঠবে যে
হেসে ফুল ফুটবে যে
অভয়া বুকের মাঝে
আর একা কাঁদবে না।
জনগণ থামবেনা
এ বিচার মানবে না
সময়ের অপেক্ষাতে
অভয়া’রা হারবেনা ! 🍁
🍂কবিতা
তাপস রায়
আমাদের গয়নাগাটি অন্ধকারে ডুবে থাকে, রোদে দিতে পারি না তেমন
স্নানের আদুরেপনা জানি, অনেক ঝাপট তাকে মুছে দিতে হয়
তার হাততালি আবহ রচনা চোখে পড়ে, মৃত চোখে
যেভাবে জোনাকি জ্বালায়, অথবা সে জেলে ডিঙি হয়ে
তীরে তুলে আনে
তোমাকে অভ্যাস করি আর সুতোর গহনা খুলে দেখি
কী যেন হারিয়ে ফেলেছ, চোখ-মুখে মিথ্যে লেগেছে ঢের
বলি, স্নানে যাও, তোমার আনাচে-কানাচে রাম ও রাবণ ঘোর
মাঠে নেমে আসছে তারার রাত্রিখানি, তারাদের ফুলের বাগান
চলো, সমস্ত আড়াল ফেলে গাছেদের সাথে আজ খুব গল্প করি
এভাবে সহিষ্ণুতা বাড়ে, ফ্রেমের ভেতরে থাকা ছবিদের টেনে আনতে হয়
রেল লাইন বাঁকিয়ে দিতে দিতে এতটা এলোমেলো করি
গন্তব্য মুছে যায়, ফেরাও থাকে না, আমাদের সবুজ জানালারা চোখ টেপে
আমাদের মাধ্যাকর্ষণ কমে যায় আর ভেসে বেরাবার কাল আসে…
ঠিক কী মাস তখন বলতে পারব না, বৃষ্টি হতে হতে হচ্ছে না
শীত বা গরম মালুম করি না, পরাজয় মাছ ধরবার বর্শির মতো গেঁথে তোলে, জানি
ইচ্ছের মুখোমুখি যে বুলেট অমন ছুটন্ত, তাকে মিথ্যে দেব না
সৌমিত বসু
মায়াবৌ-১৩১
ছাই উড়ছে। চোখের ওপর দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো ছাই উড়ে যাচ্ছে বাতাসের সীমানা পেরিয়ে। আমি ভাবি, কোথাও হয়তো বা লেগেছে আগুন। কারো পুড়ে যাওয়া আসবাব, বিছানাপত্র হু -হু করে ছড়িয়ে পড়ছে বুঝি বাতাসের সাথে।
ইস্কুলে বেরোবো, আবার সামনে সেই ছাই। আমি ভাবি, কারোর জীবনে বা লেগেছে আগুন। সংসার ভেঙে ভেঙে চতুর্দিকে। তারই ছাই, ওড়ে বুঝি দিনের বাতাসে।
বিকেলে পার্কে দেখি মুখচোখ সাদা হয়ে ছাইয়ের প্রলেপ। এবার ভেবেছি, কারোর কবিতাখাতা হয়তোবা আগুনে পুড়ছে। হয়তোবা পুড়ে যাচ্ছে হারমোনিয়াম।
রাতে স্বপ্নের ভেতর দেখি ছাই ওড়ে। আলোটা জ্বালাই। ছাইগুলো মেখে নিই দু-হাতে আঙুলে। ভালো করে দেখি,
তবে কি সবার অগোচরে পুড়ে যাচ্ছিস তুই?
দেবাশিস সাহা
নিছকই কল্পরাতের গল্প
আমার কোনো নাইট নেই ফলে ত্যাগ নেই
আমাদের রাত আছে
দখল নেবার হক আছে
১৩ এপ্রিল ১৯১৯ জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা
কালা আদমিদের মিছিলে জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার
মোমবাতি হাতে চিৎকার করছে
WE WANT JUSTICE
রক্তমাখা হাত উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে বলছে
খুনিদের শাস্তি চাই ফাঁসি চাই
এসব নিছকই কল্পগান
আজও সেই লাকি থার্টিন
প্রতিদিন একই তারিখ একই খুন- ধর্ষণ মৃত্যু
সেই ডায়ার সেই নানা ছল
সেই শববাহিনী গঙ্গা বহে চলেছে নিরন্তর
আইন আছে
আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে বেড়াল
আর জি কর আর জালিয়ানওয়ালাবাগ কি এক হলো
ডায়ার আর… না আমি কিছু বলতে চাইনি
আমাকে মাফ করবেন ব্রিগেডিয়ার সাহেব
ঘুমের ঘোরে কিসব বলে ফেললাম…
রুবি রায়
রীনাদির ঘুমের কোলে আমি
মাঝে মাঝে গভীরভাবে মনে হয়
আর বাঁচবো না।
পিঠে-বুকে একটা চাপ ব্যথা
অভিমান করে ঠায় বসে থাকে,
কেউ অপেক্ষায় নেই জেনেও।
প্রবল ভয়ে চোখ বন্ধ করি…
বহুক্ষণ যাপন শেষে যখন বৈরাগী দৃষ্টি মেলি-
দেখতে পাই আমার স্বপ্নে নীল মহামারী।
সাধ করে তার নাম রাখি নীলকান্ত।
কোনো এককালে নীলকান্ত তারিখ গোছাতো।
শেষ সই করার সময় তার সুন্দর নামের পাশে ছিল
দু’ফোটা পলাশ।
আমার চুলের পূর্বরাগে রীনাদির নেমে আসায় শিখলাম
কীভাবে জীবনের করুন ফ্যান্টাসিকে স্যাতানো মেঝেয় পেতে দিতে হয়।
লিকার চায়ের মতো অন্ধকারকে শুষে নিতে পারলেই কবিতারা বেরিয়ে আসে।
চাঁদের পাশে মাখানো ভাবাবেগকে লেপটে দিই
রীনাদির কপালে।
এবার আটপৌরে ঘুম নেমে আসুক।
যে ঘুমে অভিসারে ডুব দেওয়া এক চুপ আঁকা থাকবে।
মিঠুন চক্রবর্তী
ডাক
এক কোকিলের ডাকে বন্ধু বসন্ত আসে ফিরে
শিমুল পলাশ পুস্প ফোটে শূন্য গাছের অন্তর চিরে
তুমি বন্ধু কেমন সুজন, থাকো যোজন দূরে
বসন্ত কী ফুরিয়ে যাবে মনস্তাপে পুড়ে…
নদীর ডাকে নৌকা ভাসে, বানের ডাকে ঘর
আমার ডাকে কই আসো বন্ধু, আমি যেন পর!
কলমি ঢাকে নিঃসঙ্গ ওই ঝিলের শূন্য দুপুর,
রাতের ফাঁকা মাঠ ভরিয়ে জ্যোৎস্না বাজায় নূপুর
তুমি বন্ধু কেমন সুজন, থাকো যোজন দূরে
বসন্ত কী ফুরিয়ে যাবে মনস্তাপে পুড়ে…
চাঁদের ডাকে জোয়ার আসে, প্রাণের ডাকে স্বজন
আমার ডাকে কই আসো বন্ধু, আমি যেন নই আপন!
শ্রীতন্বী চক্রবর্তী
বিকল্পনা
এ শহরে বৃষ্টি খুঁজি না, মৃত্যু খুঁজি, মোহত্যাগ আর শরীর হাতড়াই।
রক্ত, থুতু, ঘামের ফোঁটা দেখি, বৃষ্টি খুঁজতে উন্মুখ হই না।
মাটি ফুঁড়ে গুলি চলে, কার্তুজে লেখা থাকে অবিভক্ত হৃদয়ের নাম।
ভারী বৃষ্টি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, স্থলপদ্মের পাতায় পাতায় বৃষ্টি,
মালয়েশিয়ার দুর্ভেদ্য জঙ্গলের বৃষ্টি, পাহাড়ি মেঘভাঙা বৃষ্টি।
এ শহরে কোনোরকম বৃষ্টির শব্দ পাই না,
হয়তো অন্য কোনো এক শহরে, দেশে, দেশান্তরের ভাগিদার হয়ে
ছুটির পরিসরে বৃষ্টিস্নাত হয়ে আশ্রয় নেবো পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোলাহলে।
দেবীপ্রসাদ বটব্যাল
ক্ষমা
ঈশ্বর
তুমি ওদের শক্তি দাও মিথ্যুক হবার
যথেষ্ট শক্তি দিও
ঔদ্ধত্য দেখাবার, যারা প্রতিবেশীর
বিশ্বাস আর সহবস্থানকে খুন করছিল অবিশ্বাসের ছুরিতে,
শিশুদের খুলিতে রাখছিল ছাই,
অভাব রাখছিল শেষ মাটিটুকুরও
গভীর দৃষ্টি দিও ওদের,
একটা সুন্দর মনও।
মনোহর শিস দিয়ে গান গাইবার
দিও অপূর্ব ক্ষমতা
যাতে ওরা নিজেরা
নিজেদের ক্ষমা করতে পারে।
🍂গল্প
আমার বাবা সেলিব্রিটি
সুপ্রিয় চক্রবর্তী
আজকে আমাকে অনেকটা নেতার মতো লাগছে? বাবার এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেওয়া সম্ভব না, কারণ সত্যিই বাবাকে এরকম নতুন পোশাকে অনেকদিন দেখিনি। যৌথ পরিবারের দায়ভার সারাজীবন বহন করে এই মানুষটাকে আমি অন্তত কোনোদিন হাসতে দেখিনি। এখন প্রায় মধ্যরাত, শহর গভীর নিদ্রায়, আমরা দুজনে চললাম গঙ্গাতীরে কিছুক্ষন সময় কাটাতে। আমিও বাবার মতো কম কথা বলি, রাস্তায় কোনো কথা হলো না, শুধু গাড়ি যখন শ্যামবাজারের মোড়ে, তখন বাবাকে একটু বিচলিত দেখালো। স্বাভাবিক, বাবার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে এই রাস্তায়। গঙ্গাতীরে পৌঁছে, দু’জনে কিছুক্ষণ জায়গা খুঁজলাম, একটু নিরিবিলি, যাতে শান্তিতে কথা বলা যায়। আজকে বাবা অনেক শান্ত, কোনো প্রশ্ন করছে না, সঙ্গে মাসকাবারি হিসেবের খাতা নিয়ে আসেনি, এমনকি ঘড়িটা পর্যন্ত বাড়িতে রেখে এসেছে।
_____________________________________________
আমরা চুপচাপ বসে আছি। দেখলাম ক’য়েকটি ছেলে বাবার সঙ্গে সেলফি তুলতে আগ্রহী। কোনও অনুমতি ছাড়াই অনেকে ইতিমধ্যে বাবার ছবি তুলতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। এসব দেখে বাবা বেশ বিরক্ত। বাবাকে বললাম –‘কেমন লাগছে তোমার? নিজেকে বেশ সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে না?’
_____________________________________________
‘তুই এত রাতে আমাকে এখানে নিয়ে আসলি? চারিদিকে কত মানুষ, এতো ভিড়ে আমি বসতে পারবো না। এর থেকে চল বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে থাকি।’
‘কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না। আমি আছি তোমার সাথে।’ কিন্তু, আমাদের শান্তি কিছুক্ষণের মধ্যেই বিঘ্নিত হতে থাকলো। চারপাশ থেকে কিছু মানুষ তাদের মোবাইলে অনবরত ছবি তুলতে শুরু করেছে। অবাক হলাম দেখে যে কেউ কারো অনুমতি নিচ্ছে না। অনেকে আবার ভিডিও করছে।
‘এতো লোক এখানে কি করছে? কোনো সিনেমা তৈরী হচ্ছে?’
‘না, রিলস বানাচ্ছে।’
‘সেটা কি?’
সমাজমাধ্যমে সবাই এসব ভিডিও, ছবি পোস্ট করে। বুঝলাম বাবাকে এসব বলে কোনও লাভ নেই, কারণ বাবা কোনও দিন মোবাইল ফোন ব্যবহার করেনি। অনেকবার চেষ্টা করেছি শিখিয়ে দিতে, কিন্তু কোনও দিন বুকে পেসমেকার আছে, আবার কোনও দিন চোখে দেখতে পায়না বলে সেই ফোন আমার কাছে ফেরত এসেছে। প্রায় এক ঘন্টা অতিক্রান্ত, আমরা চুপচাপ বসে আছি। দেখলাম ক’য়েকটি ছেলে বাবার সঙ্গে সেলফি তুলতে আগ্রহী। কোনও অনুমতি ছাড়াই অনেকে ইতিমধ্যে বাবার ছবি তুলতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। এসব দেখে বাবা বেশ বিরক্ত। বাবাকে বললাম –‘কেমন লাগছে তোমার? নিজেকে বেশ সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে না?’
‘সেলিব্রিটি আমি কোনও দিনই ছিলাম না। জানি না এরা কি চায় আমার থেকে, কেনই বা আমার ছবি তুলছে, আমার নিজের কাছেই তো আমার কোনও ছবি বা ভিডিও নেই। রিফিউজি সার্টিফিকেট নিয়ে যখন এই শহরের অলিগলি ঘুরেছি তখন কেউ ছবি তোলেনি, তবে তখন তোদের এই রিলসও ছিল না, সমাজমাধ্যমও ছিল না। থাকলে, তুমি ভাইরাল হয়ে যেতে, তোমার জীবন সিনেমার থেকে কিছু কম না। তবে, ওরা যখন তোমার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইছে তখন একটু আলাদা আলাদা অ্যাঙ্গেলে তোলো। এক ভাবে বসে থেকে ছবি তুলো না।’
আমার কথা শুনে বাবা মুচকি হেসে শুয়ে পড়লো। প্রথম বাবাকে হাসতে দেখলাম। আমি চিৎকার করে বললাম – ‘কি করছো কি? তোমাকে পোজ দিতে বলেছি, তা বলে তুমি মাটিতে শুয়ে পড়বে?’ বাবার চোখ বন্ধ, ভাবলাম হয়তো ঘুম পেয়েছে।
‘উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন! এই আগুনটা নিয়ে আপনার বাবার চারপাশে তিনবার ঘুরবেন, আমার সাথে সাথে মন্ত্র বলবেন। তাড়াতাড়ি করুন, কোলাপ্সিবল গেট খুলে দেবে এক্ষুণি, তার আগে মুখাগ্নি শেষ করতে হবে।’ পুরোহিতের কথা শুনে উঠে পড়লাম, কিছুক্ষণ পরে বাবা চিরনিদ্রায় চলে গেলো, এক বিকট শব্দে চুল্লির গেট বন্ধ হলো, সেই শব্দ মোবাইল ক্যামেরার ফ্ল্যাশের থেকে অনেক তীব্র, প্রচণ্ড ভয়ঙ্কর।
আমার বাবা আজ সত্যিই সেলিব্রিটি, হয়তো সমাজমাধ্যমে বেশ কিছু জায়গায় বাবার ফটো ঘুরছে, অথবা অনেকের মোবাইলে রয়ে গেছে ভিডিও। ভাইরাল আর ভাইরাসের মধ্যে একটা মিল আছে, দুটোই ছড়িয়ে পরে দ্রুত, কিন্তু পার্থক্য হলো, ভাইরাসের প্রতিকার আবিষ্কার করা সম্ভব, ভাইরালের প্রতিকার করা সম্ভব না।🍁
🍂কবিতা
সুফিয়া শিউলি
কাশকন্যা ও শরতের গাথা
মুগ্ধ আকাশ অবাক হয়ে দেখে
দুধসাদা কাশ হাওয়ায় নেচে-নেচে
হাতছানিতে ডাকছে তাকে এসো…!
শ্যামল মায়ের মায়াবী দোলনাতে
দুলে দুলে কাশের সাদা মেয়ে
সহজ হাসি ছড়িয়ে আকাশটাকে
দেখছে কেমন মুগ্ধ নয়ন মেলে…।
এমন সময় কোত্থেকে ঝাঁক বেঁধে
শ্বেতবলাকা পাখনা মেলে উড়ে
নীল আকাশের পাশটি কেটে শেষে
কাশকন্যের কপোল দিলো চুমে।
এরপরে সেই শ্বেত-বলাকাগুলো
আবেগমাখা মিষ্টিমেদুর ডেকে
দূরের আকাশ পেরিয়ে গেলো চলে…।
কাশের ডাকে আকাশ ভেবেছিল
কাশমেয়েদের শুভ্র-শ্বেত গালে
ধন্য হবে আদর এঁকে দিয়ে।
কিন্তু সেটা আর হলো না দেখে
দূরের আকাশ কষ্ট পেয়ে মনে
জমিয়ে চোখে অশ্রু মেঘমালা
বৃষ্টি হয়ে ভাসিয়ে দিলো সবে।
কাশের যত আনন্দ যায় থেমে…
শ্বেত-বলাকার পাখনা গেল ভিজে
দিনের খেলা সাঙ্গ করে শেষে
মিলায় সাঁঝে দিগন্তেরই রেখা…!
সাঁঝের এমন আঁধার নিরজনে
মা-মাটি খুব আদর-স্নেহ দিয়ে
কাশমেয়েদের নেয় শিয়রে টেনে।
এমনতর আবেগঘন শোভা…
দেখেই হেসে উঠলো শারদ-শশী!
জোছনা-ঝরা চাঁদের মায়া মেখে
ফের খুশিতে নাচলো কাশের মেয়ে!
অনিন্দ্য পাল
লিলি
শুধু ফুটে আছে
রাত এবং রাতে
দীর্ঘশ্বাসে
ভালবাসায়
আদরে
আহ্লাদে
তবু ফুটে আছে
বৃন্তে
সময়ের চুম্বন
শ্বেত পাপড়িতে
রক্তের দাগ
নীল কষ্ট
টপ
টপ
ঈশ্বরের খিদে
শুকনো পাতা
উপহাস করে
ও রূপ
মরণের সমান।
সুচিতা সরকার
তারপর সকাল হল
তারপর, সকাল হল।
সূর্য আলো জ্বাললো।
পাখিরা নতুন সুর তুললো।
বাসি ফুলগুলো সরে গিয়ে
নতুনদের জায়গা করে দিল।
রাতের এক গল্প,
শহরের কানে কু করলো।
তারপর!
তারপর, কথা হল।
কোলাহল হল, কাঁটাছেঁড়া হল।
রংয়ের ওপর রং পড়ল।
বিশ্লেষণ হল, তরজা হল।
আন্দোলন হল, বিদ্রোহ হল।
সাদা-কালোর মাঝের দড়িটায়,
টান পড়ল।
তারপর?!
তারপর, আবার রাত হল।
দিনের গল্প, আগুন হল।
হাসি-কান্নার কচাল হল ।
দারিপাল্লায় ওজন হল।
আলো-আঁধারের তর্ক হল।
বিচার-বিবেচনায় মালা পড়ল।
তারপর?!
তারপর, আবার সকাল হল।
সূর্য উঠল।
পাখিরা উঠল।
শহর উঠল।
একটা পোড়া গন্ধ এলো।
শহরের কি ঘুম ভাঙল?
তপন মুখার্জি
স্মৃতিমেদুরতা
অনেক চেষ্টা করলাম দূরত্ব ঘোচাতে। বাঁধ দিলাম, নিঃশ্বাসের শব্দ শোনার ভান করে কাছে এসে দাঁড়ালাম, বক্ররেখা মুছে সরলরেখা টানলাম। তবু তোমার -আমার দূরত্ব সেই একই রয়ে গেল। জীবনের সাজানো শো -কেসে বসন্ত আর জাগল না।
উম্মে ফারহিন
যন্ত্রণার ঢেউ
দেওয়ালটা আর্দ্র হয়ে গেছে আবহাওয়ার প্রতিকূলতার পূর্বাভাস
মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে উঠেছে
স্পর্শে যেন পরিচলন স্রোত বয়
আমি লিখতে থাকি কবিতার লাইন
আচ্ছা নোনা জল দিয়ে দৃশ্য আঁকলে
কবিতার স্বাদও কি নোনতা হয়
মিষ্টতার অভাবে মোহনায় মেশার আগে স্রোতশূন্য হয়ে যায়
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আতিথ্য গ্রহণকারী শাখা-নদীটি
হয় অভিমানী
নতমস্তকে চোখে রোদ চশমা লাগিয়ে
লুকিয়ে রাখে যন্ত্রণার ঢেউ
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস /পর্ব ১৫
অনেককাল পর সুপ্রতিমের মুখটা চোখের সামনে ভেসে এল। নকশাল আন্দোলনের পর সুপ্রতিমকে বাগবাজারে কেন, কলকাতার কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাওয়ার সঙ্গে মিশে কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল সুপ্রতিম। সিনেমার স্লাইডের মতো সরে সরে যায় দৃশ্যপট। সুজিত চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অনেকটা গল্পের মতো’। আজ পর্ব ১৫।
অনেকটা গল্পের মতো
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা, নিশিথিনী সম’…
অমৃত চায়ের কাপ এগিয়ে দেন এবং প্রতিমা নির্লিপ্ত হয়ে গ্রহণ করেন। ব্যস, এতটুকুই। প্রতিমা সম্পর্কের ছেঁড়া ফাটাগুলোকে রিফু করার মতো কোনও আগ্রহই খুঁজে পান না। প্রীতম দু’চারবার বলেছে, ‘মা! যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আর কতদিনই বা… একটু মানিয়ে নাও না।’ প্রতিমা প্রয়োজনের তুলনায় হয়ত কিছুটা বেশি কঠিন হয়েছেন। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন প্রীতমের দিকে। প্রীতম ঐ দৃষ্টিকে এখনও এই বয়সে এসেও ভয় পায়। প্রীতম জানে, এই মানুষটিকে নমনীয় করা তার সাধ্য নয়, তবুও চেষ্টা! প্রতিমা প্রীতমকে ছাদে আসতে বলে নিজেই উঠে যান। অমৃত আসার পর ছেলের সঙ্গে কথা বলার জায়গাও কমে গিয়েছে। ছাদে উঠতে এখন কষ্ট হয়। হার্টের রোগ তো নয় নয় করেও সাত আট বছর হয়ে গেল! তবু কিছু কথা প্রীতমকে না বললেই নয়। এতদিনের নিজের মতো করে তৈরি করা ছেলে হঠাৎই ক’টা পয়সার জন্য অন্যরকম হয়ে যাবে, অন্যের হয়ে যাবে, সেটা প্রতিমা কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। এটাকেই কী পজেসিভ্নেস বলে? ছাদে উঠে একটু লম্বা শ্বাস নিয়ে নেন। তারপর গলা তুলে ডাকেন, ‘পীতু! আমি তোকে ডেকেছি।’
এই ডাকা ও প্রীতমের সাড়া দেবার মধ্যে ওঁ-খুঁজে পেতে চান তার তিল তিল করে গড়ে তোলা ছেলে কীএখনও তার একডাকে সাড়া দেয়, নাকি টাকার অঙ্ক সব হিসেবের গড়মিল করে দিয়েছে! প্রীতম আসতেই খুব ঠাণ্ডা স্বরে প্রতিমা শুরু করেন, ‘পীতু! পয়সা অনেক কিছুকে হাল্কা করে দেখতে শেখায়, নারে! ভুলে যাস না, একটা সময় তোর কাকা ঠাকুমার মারা যাবার পর যখন আসা প্রায় বন্ধ করে দিল, কীভাবে দিনগুলো চলেছে, কীভাবে তোকে মানুষ করেছি! অনুদা, জ্যেঠিমা, জ্যেঠু, ভালদিদিরা পাশে না থাকলে আজকের এই দিনটাও তোকে দেখতে হতো না। কোথায় থাকতিস তুই? এখন তুই ঐ লোকটার হাত থেকে কিছু টাকা পাচ্ছিস, সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে আর পুরনো দিনগুলোকে ভুলেই গেছিস, কেমন? তুই তোর মতন যদি থাকতে হয় থাক না, আমি তো বারণ করিনি। কিন্তু আমি কী করব, না করব সেই জ্ঞানটা দিতে না আসলেই বোধহয় ভাল হয়। আমারও বয়সটা কিছু কম হয়নি। আর সময় যদি মনে করে সব স্বাভাবিক করে দেবে, তবে সেটা তো তার মতো করেই হবে, তাই না? তুই ঠিক করে দেবার কে? আমি তো তোদের সম্পর্কের মধ্যে কোথাও নাক গলাতে যাইনি!’ কথাগুলো একটানা বলে উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন। প্রীতম চুপ করে শুনে যায়। এক লহমায় মনে পড়ে যায় সেই সব কষ্টের, অভাবের দিনগুলো। মাকে হাঁফাতে দেখে বলে, ‘মা! কষ্ট হচ্ছে? ইনহেলারটা এনে দেব?’ প্রতিমার বুকের মধ্যে কষ্ট হলেও মনের মধ্যে একটা তৃপ্তির আবেশে ভরে যায়, ‘যাক, এখনও পীতু হাতের বাইরে চলে যায়নি’
প্রতিমার চোখে কান্নার আভাস। কবেই তো চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে, তবে আজ কেন চোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রুধারা! প্রীতম বিব্রত বোধ করে। বিয়ের আগে যেমন কথায় কথায় মাকে জড়িয়ে ধরত, আজ অনেকদিন পর আবার জড়িয়ে ধরে প্রতিমাকে। বুঝিয়ে দিতে চায়, পয়সা নয়, প্রতিমার ভালবাসা, স্নেহই তার কাছে অনেক বেশি দামী।
প্রতিমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘যা নিচে যা পীতু। আমি এখন কিছুক্ষণ ছাদেই থাকব’। প্রতিমা তো তাঁর জ্যেঠিমাকে কথা দেবার পর আর কখনও সুপ্রতিমের কথা তেমনভাবে মন থেকে ভাবেননি। কখনও কখনও অনাহুতের মতো চলে এসেছে সুপ্রতিম। সেটাও কি তাঁর দায়? তবে কি অবচেতনে কোথাও ঘরের কোণের ময়লা থেকে যাবার মতো, বাসনের খাঁজে সাবান লেগে থাকার মতোই রয়ে গেছে, প্রতিমা বুঝতে পারেননি! “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” করে অমৃতকে তো মেনে নিয়েছিলেন সর্বতভাবে, মনে প্রাণে। শুধু প্রীতমের নামটা! হ্যাঁ, প্রতিমাই নামকরণ করতে চেয়েছিলেন এবং বালিগঞ্জের বাড়ির সবাই প্রতিমার পুত্র প্রীতম… এভাবেই মেনে নিয়েছিলেন প্রীতমের নামকরণ। আজ অনেককাল পর সুপ্রতিমের মুখটা চোখের সামনে ভেসে এল। নকশাল আন্দোলনের পর সুপ্রতিমকে বাগবাজারে কেন, কলকাতার কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাওয়ার সঙ্গে মিশে কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল সুপ্রতিম। সিনেমার স্লাইডের মতো সরে সরে যায় দৃশ্যপট। বাগবাজারে রবীন্দ্রজয়ন্তী…! ছোটকার বন্ধু সুপ্রতিম ক্লাবের সর্বেসর্বা। গানটাও চর্চা না করা সত্ত্বেও অসাধারন ভাল গাইত। সেবার ফাংশনে দু’জনে ডুয়েট গেয়েছিলেন। প্রচুর করতালি। তারপর থেকেই সম্পর্কের সমীকরণটা কীভাবে যেন বদলে যাওয়া শুরু হয়েছিল! আগে সুপুকাকা বিশেষ পাত্তা দিত না প্রতিমাকে। কিন্তু সেই সন্ধ্যেয় লাল পাড় সাদা শাড়ী, মাথায় জুঁইফুলের মালা হঠাৎ করে সুপ্রতিমের চোখে বড় করে দিয়েছিল প্রতিমাকে। তারপরের বেশ কিছুদিন কীভাবে না জানি দু’জনের দৃষ্টিতেই পরিবর্তন। এক অন্য আবেগে, অন্য আবেশে ভেসে যাওয়া দু’টো একটা বছর।
মনে পড়তেই গলায় উঠে আসে সেই সন্ধ্যেয় মাচার অনুষ্ঠানে গাওয়া গান : ”তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম,
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী সম “…
গাইতে গাইতে কখন আত্মস্থ হয়ে গলা উঠে গেছে জানতেও পারেন না প্রতিমা। হঠাৎ টের পান পুরুষ কণ্ঠে কখন গান ভেসে আসে সিঁড়ির দিক থেকে…
“মম জীবন যৌবন, মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী সম “…
প্রীতম, তাঁর প্রীতম আবার কতদিন পর গান গাইছে। ওর গলায় যেন আজ সুপ্রতিম গাইছে। সেই সন্ধ্যা আর এত বছর পরের সন্ধ্যা কোথায় একাকার হয়ে গেছে। কতোদিন প্রীতম গায়নি। সেই কলেজে পড়ার সময়, তারও পরে, চাকরী পাবার আগে ওরা মা ছেলে মিলে ওদের দুঃখ কষ্ট হাওয়ায় উড়িয়ে দিত এমন কত সন্ধ্যায় গানে গানে। আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়েন প্রতিমা। গলা মেলান প্রীতমের সঙ্গে নির্ভুল কোরাসে :
“জাগিবে একাকী তব করুন আঁখি
তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখ বেদন, মম স্বপন শাপন
তুমি ঝরিবে সৌরভে, নিশীথিনী সম “…
শেষদিকে আর গাইতে পারেন না প্রতিমা। আনন্দে কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায়। দু’চোখের কোল বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। বুকের ভেতর একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা টের পান। শুধু বুঝতে পারেন না সে ব্যথা সুপ্রতিমের জন্য না আজ অনেকদিন পর প্রীতমকে আগের অবস্থানে ফিরে পাবার জন্য। 🍁 (ক্রমশঃ)
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
