



সম্পাদকীয়
বিশেষ রূপেই প্রকাশিত যে, রামায়ণ ও মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল। মহাভারতে পাণ্ডব ও কুরু বংশের মধ্যে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নামেই পরিচিত। এই যুদ্ধের প্রধান কয়েকটি কারণে মধ্যে সর্বপ্রধান যে কারণটি তা হলো “দ্রৌপদী’র বস্ত্র হরণ”। এখানে একজন নারীর সম্মানের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। যা শুধু পাণ্ডবদের নয় গোটা নারী সমাজের সম্মান। সেই সম্মানের আবরণকে কুলষিত করতে চেয়ে ছিল কুরু বংশের ভাইয়েরা। যে কারণে সম্পূর্ণভাবেই কুরু বংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মানে বিনাশ হয়েছিল। পাশা খেলায় নারীর সম্মান সেদিন রক্ষা হলে তাদের রাজত্ব যেত না। কোন ভাইয়ের মৃত্যুও হতো না। আর সত্যের জয়ের প্রশ্ন আসতো না।
সংক্ষেপে এই কথাটুকু উল্লেখ করবার কারণ হলো, আজকের অভয়া’র করুণচিত্র। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থেকে প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নিশ্চয় জানেন, এই মহাভারতের কথা। এমন কি তারও আগে রামায়ণ-এর রাম রাবণের যুদ্ধের কারণও সেই নারী। এই কথা জানেন তাঁরা। রামায়ণে রাম রাবণের যুদ্ধে তাতেই রাবণের সোনার লঙ্কা তার আধিপত্য তার বিস্তারিত সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ওই একই কারণ। মা সীতাকে মিথ্যা চার করে ভিক্ষুক রূপে তুলে নিয়ে এসে বন্দী করে রেখে ছিল। এখানেও শ্রী রাম, লক্ষ্মণ ও মহা বীর হনুমান সহ বানর রাজেরা মিলে রাবণের পরাজয় নিশ্চিত করে মা সীতাকে উদ্ধার করে ছিল। সেখানেও সত্যের জয় হয়ে ছিল। এখানেও সেই নারী সম্মান রক্ষা। করতেই রাবণের নিজস্ব সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়ে ছিল। যেখানে আমাদের শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থের প্রধান দুটি বিষয় নারী সমাজের সম্মান এবং সত্যের জয়। আর এখানেও তিলোত্তমা বা অভয়াকে যথা সম্মান দেওয়া ও সত্যের জয়ের দাবি। আজ অভয়ার বিচারের এমন দৈন্যদশা দেখে রাজ্যের মানুষ স্থির। এখানেও সেই রামায়ণ ও মহাভারতের মতই নারী সম্মান রক্ষা করতে আদালত ও ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কঠোর ভাবে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে আইনানুগ শিক্ষা প্রদান করতে হবে এবং সত্যের জয় দিয়ে নারী সমাজকে সম্মানের সঙ্গে মর্যাদা দিয়ে এক নতুন ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্যের সূচনা করতে হবে। ভারতের প্রধান বিচারপতি যেন তার বিবেককে বিক্রি না করে একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাক্তার মানেই মানুষের তৃতীয় ভগবানের সম্মানকে রক্ষা করতে পারেন। এই জয় যেন ইতিহাসে সত্যের জয় বলেই চিহ্নিত হয়ে থাকে। নারী সম্মান রক্ষার জন্যই জনগণের কথা একটাই, জাস্টিস ফর আর জি কর। 🍁
🍂কবিতা
অরুণ কুমার চক্রবর্তী
নোঙর
অদৃশ্য অলৌকিক নৌকোরা অথৈ অন্তহীন মহাসমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে পৃথিবীর ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলেছে…
নামিয়ে দিচ্ছে জড়বস্তু, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষ…
স্থবির জড়বস্তরা হাঁটতে পারেনা
হাঁটতে পারে না গাছগাছালী,
শুধু ওদের পাকা ফলের বীজ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর পথে ঘাটে মাঠে জলে জঙ্গলমহলে….
যেখানে যায় নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ে,
আর প্রাণীদের দল উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে পৃথিবীময় নোঙর ফেলতে ফেলতে আজও চলেছে,
আর মানুষ, সারা পৃথিবীতেই নোঙর ফেলে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে, তাঁদের মধ্যে কিছু লোভী মানুষ বিশ্বমানবায়নের নামে বিশ্ববাণিজ্যায়ন করে অলক্ষ্যে লুটপাট করতে করতে গান গাইছে…
লুটছে পুটছে লুটেপুটে খাচ্ছে
এক চোর অন্যকে চোর বলে ডাকছে
আর, সেই অলৌকিক নৌকোরা কখন কোন ঘাটে এসে কাকে কখন তুলে নিয়ে যাবে কেউই জানে না…
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
গল্প
ফেসবুকে গল্প লিখব বলে অক্ষর সাজাতেই
উধাও হয়ে গেল- দাড়ি কমা সেমিকোলন পূর্ণচ্ছেদ
গল্পের প্লট বেয়ে উঠে গেল, একদল সন্ত্রাসী
পাড়ায় পাড়ায় হোর্ডিঙে লিখে ফেলল-
বাদামি শহরের জন্মছক
আমরা ওদের চিনি, নাম জানিনা
গল্পের মধ্যে মিশে থাকা কনিষ্ঠ পাখিটা
গেয়ে উঠলো , ঠিক যেন মিঞা তানসেন
কিন্তু অচিরেই থেমে গেল, অসমাপ্ত সংগীত
একটা দুরন্ত ঈগল এসে, এঁকে দিল- দস্যুতা…
অমনি গল্পের দরজা বন্ধ করে, আমি এক অর্বাচীন
ঘুমিয়ে পড়লাম, শতাব্দীর শেষ রাতে
ভালবাসা
আমাদের ভালবাসাগুলো কবেই মরে
ভূত হয়ে গেছে
অথচ আজও তুমি ঠাঁঁই দাঁঁড়িয়ে রইলে
ছবির ভেতর
অগত্যা আমার বলার কিছু ছিল না
পোস্টমর্টেম টেবিল থেকে কখন যেন
রক্তাক্ত গোলাপটা সরিয়ে নিয়েছ,
অস্থির বিবেচনায়
আমাদের ভালবাসাটা কবেই মরে গেছে
অহেতুক কোন প্রজাপতি আজও ওড়াওড়ি করছে
আমাদের ডেথ সার্টিফিকেটের ওপর
কেননা ভালবাসার মৃত্যু নেই…
সুপ্রভাত দত্ত
ঠিকানা
ধুলোর যে পথে
শিশুদের পায়ে হাঁটা ছাপ
‘শুয়ে থাকা ফুল’ হয়ে ফোটে…
সেখানে আমি পাই সুস্থ পথের খোঁজ।
এত এত আলো থেকে দূরে,
যখন কোনও খেটে খাওয়া মানুষ
নীরবে কবিতা লেখে…
সেখানে আমি পেয়েছি সুস্থ ভাষার খোঁজ
ইভা আলমাস
অন্ধ কূপ
জানালার ওপাশে
অচেনা এক আওয়াজ
ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই জানালার কাছে।
আলোহীন সন্ধ্যায় দিগন্ত ছোঁয়া মাঠ
আবছা ঝোঁপঝাড় আর কুঁড়েঘর,
বাতাসে পাতার মর্মান্তিক সুর
সবকিছু ডুবে যাচ্ছে প্রবল স্রোতে
প্রকৃতিতে পাঁজর ভাঙা কান্নার রোল।
আমি গরাদে মাথা রেখে তাকিয়ে থাকি
কে যেন কী ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে
ঠিক জানালার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় কিছু
বুকের খাঁচায় টানাটানি
হাত রাখি হৃৎপিণ্ডে
ব্যথায় চিৎকার দেয় অন্তর-
বুঝতে বাকি থাকে না
অস্তিত্বের টানাপোড়েন।
ক্রমেই আলগা হচ্ছে বাঁধন
অস্তিত্বের মৃত্যু কি দেখা হবে না?
গোলাম কবির
কম্পিত হৃদয়ের হাহাকার
যদিও জানি, তুমি শুধু একান্ত আমারই।
তবুও কেন জানি এই হৃদয় গেয়ে ওঠে
মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত
জনপ্রিয় গান, “ভালোবেসে সখী নিভৃতে
যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে “!
তবে কী তোমার মনের মন্দিরে আমি নেই?
এই তো তুমি আছো এই হৃদয়ে,
বুকের ধুকপুকানিতেও শুনতে পাই
তোমারই দোর্দণ্ড প্রতাপ ক্ষণে ক্ষণে!
তবুও কেন যে আমার বাউল হৃদয়
কেঁদে ওঠে তোমারই জন্য এই জীবনের
বেলা শেষের গানে গানে
কম্পিত হৃদয়ের হাহাকার নিয়ে
চাই প্রেম, আরও বেশি প্রেম!
ঈশান বিশ্বাস
ঘোর
কিছু ঘোর থাকা ভালো
কিছু ঘোর আঁটকে রাখে জন্ম-জন্মান্তর…
ভোরের ফুলের মতো গন্ধ ছড়িয়ে দেয়
কিছু ঘোর তোমাকে বৃত্তের চক্রান্ত
চিনিয়ে দেবে
🍂গল্প/১
______________________________________________
লক্ষ্মী বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে। নবীন নেবার লোকের পাশে বসে লোকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল তোমাকেও তো বুঝতে হবে আমি ইচ্ছে করে দেরি করে আসি নি। আমার এতে কি অপরাধ আছে?’
______________________________________________
এক টুকরো আলোর সন্ধানে
মমতা রায়চৌধুরী
‘বাবা , বাবা ও বাবা ‘আদুর গায়ে আট বছরের দুর্গা কাতর স্বরে বাবা বাবা বলে ডেকেই যাচ্ছে। বাবা একবার মেয়ের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে খরিদ্দারের কথা শুনছিল। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি সামান্য রাস্তার ধারে কোনরকমে একটু জায়গা, সে জায়গাটা যে চায়ের দোকান নবীনের স্থায়ী ঠিকানা নয় সেটা পরী ভালই বুঝতে পারল ।টানা ভ্যান গাড়িতে একটা মাটির উনুন, চায়ের কেটলি, গোটা কয়েক বেকারী বিস্কিটের বয়াম। একদিকে একটা পাত্রে দুধ অন্যদিকে রয়েছে গোটা ক’য়েক কেক, রয়েছে বিড়ি আর জলের হাত থেকে পথযাত্রীদের বা খরিদ্দারদের মাথাটা রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনওরকম একটা তাঁবু খাটিয়ে নিয়েছে।চাতক পাখির মত তাকিয়ে রয়েছে কখন তার খরিদ্দাররা চা চাইবে, কেউ বিস্কিট চাইবে। আর বারবার চায়ের পাত্রটার দিকে তাকাচ্ছে নবীন। কিন্তু সেরকম খরিদ্দার কেউ এসে দাঁড়ায় নি। যিনি চা খাবেন অনেকেই দাঁড়িয়েছেন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য। পরী টোটো থেকে নেমে সরাসরি দাঁড়িয়েছে নবীনের দোকানটার পাশে।
পরী একটা কবিসম্মেলনে গিয়েছিল। এত দুর্যোগের মধ্যে সেই অনুষ্ঠানে না আসলেই পারত কিন্তু পরীর মনের খিদে, তার রসতৃপ্তি এই সাহিত্যরস থেকে বঞ্চিত হলে তার জীবনটাই যেন কেমন পানসে হয়ে যাবে। যত কাজই থাকুক না কেন সে চেষ্টা করে সাহিত্য মজলিসে আসবার। বাড়িতে পরীকেও নানা বাধা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হয় তার লেখার মধ্যে দিয়ে তার শৈল্পিক সত্তার বিকাশের জন্য।
দুর্যোগ বলেই পরীর অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যাবার পরেই সে বেরিয়ে পড়েছে রিক্স নেয়নি। ট্রেন পাবে না তাই বাস ধরার জন্যই সে এসে দাঁড়িয়েছে নবদ্বীপের হেমাতপুরের মোড়ে।
আবার সেই ছোট্ট মেয়েটির অসহায় আর্তি,
‘বাবা ও-বাবা! বাবা গো… ‘
সাড়া না দেওয়াতে এবার মেয়েটি বাবার লুঙ্গিটা ধরে টানছে ‘বাবা, ও বাবা’ শেষে বিরক্ত হয়ে নবীন বলল কেন তুই এই বৃষ্টির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিস, দেখছিস না এখানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কি জন্য ডাকছো!’
‘আজ কি রান্না হবে?’
‘কি রান্না হবে মানে? ঘরে যা আছে তাই দিয়ে…। যা তাই রান্না হবে।’
মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
নবীনের মেয়ের কথা শুনলে হবে না তার পাখির চোখ কখন দু’টো খরিদ্দার তার কাছে চা খেতে চাইবে তার দুটো পয়সা আসবে ঘরে। এই দুর্যোগে তাকে কিছু নিয়ে যেতে হবে ঘরে। সে বুঝতে পারছে বাড়িতে রান্নার কিছু নেই। তাই তার স্ত্রী পাঠিয়েছে মেয়েটাকে।
অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটার লক্ষ্য করছিল
একটু দূরেই ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পরী
তাতে তাঁবুর কাছে আসার চেষ্টা করছে ।নবীন খুব উৎসক মুখে বলল, ‘দিদিমণি আসুন আসুন এখানে এসে দাঁড়ান।’ বলেই সে চায়ের কেটলিটা নিয়ে আবার উনুনে বসাল। মেয়েটি আবার বলল, ‘বাবা কি রান্না হবে?’
‘আর বিরক্ত করিস নে দুর্গা, মাকে গিয়ে বল ভাতে ভাত করতে।’
‘বাবা ঘরে চাল নেই।’
‘কি যা তা বলছিস দুর্গা! চাল নেই মানে! এখন এই দুর্যোগের সময় আমি কোথায় চাল আনতে যাব।’ নবীন জানে সত্যিই ঘরে চাল নেই তাই দুর্যোগে সে বেরিয়েছিল দু’টো পয়সা আসবে সে চালটা কিনবে, ঘরে আরও একটি বাচ্চা আছে কি যে খাওয়াবে।
লক্ষ্মী তো সকালেই বলেছে,
‘দেখো দুর্গার বাপ, ছেলে মেয়ের যখন জন্ম দিয়েছ রুটি রোজগারের ব্যবস্থা তো তোমাকেই করতে হবে।’
লক্ষ্মী সাধারণত এরকম কথা বলে না আজকে সাত সকালে বেরোনোর সময় এই কথা শুনে একটু থমকে গিয়েছিল নবীন।
আড়চোখে একবার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল সেই মুখটা ছিল ভারী অন্ধকার একরাশ অভিমান ক্ষোভ পাহাড় সমান জমা হয়ে আছে বৃষ্টি যেমন অঝোরে ঝরছে কোনও একদিন নিশ্চয়ই সেই ক্ষোভ অভিমান কান্না হয়ে ঝরে পড়বে নবীনের জীবনে সেই আশঙ্কাতেই সে ভ্যানটা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে।
পরী ব্যাপারটা বুঝল। বলল, ‘দাদা আমাকে চা দিন না। খুব ভাল করে মালাই চা।’
নবীনের মুখটা কেমন হঠাৎ করে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘দিদিমণি আর কিছু নেবেন না?’
পরী উপলব্ধি করল সত্যিই নবীনকে সাহায্য করার দরকার’ হ্যাঁ নেব তো। এই বেকারীর বিস্কিটগুলো খেতে ভাল হবে?’
একটা খেয়ে দেখুন, এটা দেব দেখুন এটা লম্বা এর নাম হয়েছে ক্ষীর বিস্কিট, আর এই বিস্কিটটা দেখছেন গোল গোল মুখে দিলেই নিমিষেই একদম মিলিয়ে যাবে। এর নাম হচ্ছে মাখন বিস্কিট
আর এই ছোট ছোট এগুলো দেখতে পাচ্ছেন যে বিস্কিটগুলো এগুলোর নাম হচ্ছে রসবড়া।’
বাহ দারুন নাম তো নাম শুনেই খেতে ইচ্ছে করছে। সবকিছুই দিন আমার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘দুর্গা, দুর্গা বস, এখানটা বস।’
‘একটু সরে বস মা, খরিদ্দার আমাদের লক্ষ্মী দিদিমনি আপনি এখানে বসুন।
‘আরে না, না বাচ্চা মেয়েটা বসেছে ওকে তুলে দিলেন কেন আমি ঠিক আছি।’
‘গরিবের ঘরের মেয়ে ওদের আবার বসা কি দিদিমণি।ছোট থেকেই ওদের পরিশ্রম করতে হবে তবেই তো জীবনটা সম্পর্কে ওরা বুঝতে পারবে যে জীবনের পথটা কতটা কষ্টদায়ক, পথ মোটেই মসৃণ নয়। ‘
‘আর ক’য়েকটা কেকও দিন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দিচ্ছি দিদিমণি।’
‘বাবা ,ও বাবা…।’
‘দুর্গা তোর কথা আমি পরে শুনছি।’
‘আমার খুব খিদে পেয়েছে বাবা, আমাকে দুটো বিস্কিট দাও না?’
‘তোকে বলেছি না একটু দাঁড়া আগে খরিদ্দার।’
‘আহা ওকে এভাবে বলছেন কেন?’
ওকে বলছি একটু সবুর কর…
‘আপনার নাম কি দাদা?’
‘নবীন দাস। ‘
দিদিমণি কত করে শেখাই যখন ব্যবসা করব এভাবে জালাসনে।
‘আহা খিদে পেয়েছে? দু’টো বিস্কিট দিন না?’
‘তোর কি সকাল থেকে শুধু খিদেই পেতে থাকে দুর্গা? যখন শ্বশুর বাড়ি যাবি তখন যদি সব সময় খাই খাই করিস সেটা কি ভাল?!
‘আমাকে কটা বিস্কিট আগে দিন তো?’
আপনি নিয়ে যাবেন বললেন তো প্যাকেটটা
করি।’
‘আগে কটা আমাকে লুজ দিন।’
‘এই নিন দিদিমণি।’ নবীন পরীকে একটা কাগজে ক’য়েকটা বিস্কিট দিল।
পরী এবার মেয়েটিকে কাছে টেনে নিল বলল, ‘তুমি দুর্গা? তুমি পড়াশোনা করো?’
‘ওকে খিচুড়ি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি দিদিমণি।’
ওই যে স্কুলে খাবার দেয় দু’মুঠো খাবার পায় খাবারও পেল যদি কিছু শেখে তাও ভালো।’
‘এই নাও দুর্গা এই বিস্কিটগুলো তুমি খাও।’
মেয়েটা কিছুতেই বিস্কিটগুলো নিতে চাইছে না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
সে কি! দিদিমণি আপনি ওকে বিস্কিট দিচ্ছেন কেন? আমি দিচ্ছি ওকে।’
না, না, না আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি দিচ্ছি আপনি কিছু বলবেন না। বাধা দেবেন না।’
‘দুর্গা, তুই তখন থেকে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছিস বাড়ি যা, মা তো তোর জন্য চিন্তা করবে’।
দুর্গার মাথার চুলগুলো রুক্ষ শুষ্ক পায়ে কোনও চটি নেই। একটা সাদামাটা রঙ চটা ফ্রক পড়ে এসেছে সে মাটিতে পা দিয়ে সমানে পাটা রগড়াতে লাগল। পায়ের ভেতরে জল কাদায় একাকার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
‘নাও দুর্গা বিস্কিটগুলো ধরো।’
দুর্গা এবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নেবে কি নেবে না বুঝতে পারছে না।
‘খাবি যখন বলেছিস দিদিমণি শুনতে পেয়েছেন তাহলে নে।’
এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে বিস্কুট নিল আপন মনে বিস্কুটগুলো খেতে লাগল।’ পরীর মনের ভেতরটা কেমন ধাক্কা লাগলো সত্যিই আজ কদিন পরেই দুর্গাপুজো মায়ের আগমন। সেই মায়ের আগমনকে কেন্দ্র করে ক্লাবগুলো বারোয়ারিগুলো কেমন সেজে উঠবে। কাশফুল শিউলি, পদ্ম তার সুগন্ধ ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে। মায়ের আগমনের বার্তা।
স্বর্গীয় দুর্গাকে বরণ করার জন্য মানুষ কত কত টাকা ব্যয় করে এত প্যান্ডেল এত আলোকসজ্জা ব্যবস্থা করছে অথচ আমাদের চারপাশে কত এরকম অসহায় দুর্গা রয়েছে তাদেরকে যদি আমরা সেই টাকায় কিছু করতে পারি তাহলে বোধহয় পৃথিবীটা আরও বেশি সুন্দর হবে পরীর মনের ভেতরটা তোলপাড় করছে।
পরী হাত বাড়িয়ে চা টা নিল। চা খেতে খেতেই বাস এসে গেল।
‘দিদিমণি বাস এসে গেছে।’
‘আসুক। এরপরে বাস আছে তো?’
‘হ্যাঁ আছে, আসলে যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে বাস খুব কম চলছে। আসলে ওদেরও তো প্যাসেঞ্জার না হলে ওদের লোকসান। তাই বুঝে শুনেই গাড়ি চালায়।’
‘ঠিক আছে আমি যখন বসেছি চা খেতে একটু চা খেয়েই যাব।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বসুন না। আপনি কোথায় যাবেন?’
‘পারহাটি। ‘
আচ্ছা আচ্ছা ম্যাজিক ভ্যানগুলোও আসে। আজকে সকাল থেকে সেরকম ম্যাজিক ভ্যান দেখতে পাইনি।’
পরীর কপালে এবার একটু চিন্তার ভাঁজ পড়ল বাড়িতেও তো তার অসহায় শাশুড়ি মা রয়েছেন তাকে খাবার দিতে হবে। বড্ড দেরি হয়ে যাবে এই দুর্যোগে তো রাঁধুনি আসেনি ফোন করেছিল।
‘তবে বাস থাকবে একটু দেরি হবে এই যা।’
পরী মনে মনে সংকল্প করেছে সে চা খেয়ে নবীনকে একটু সাহায্য করতে চায়।’
‘কত হল নবীনদা?’
‘এই যেগুলো প্যাক হল ১০০ টাকা আর চা টা হচ্ছে আপনার দশ টাকা।’
‘আর ওই বিস্কিটগুলো?’
‘আমার মেয়েকে দিয়েছেন দাম নিতে পারবো না।’
‘আমি তো ওকে দিলাম দাম নেবেন না কেন?’
‘না দিদিমণি মাপ করবেন।’
আমি দুর্গাকে প্রথম দেখেই ভালবেসে ফেলেছি, ভালবেসে বিস্কিট খাওয়ালাম। তাতে কি হয়েছে?’
‘কিন্তু…’
‘আর কিন্তু নয়’।
মাথা চুলকে নিয়ে নবীন বলল’ ৮০ টাকা হয় ৫০ টাকা দিন।’
মেয়েকে ভাল করে লেখাপড়া শেখান ওকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলুন।
আমরা গরিব নুন আনতে পান্তা ফুরায় আমাদের মনে কি কখনও গোলাপ চারা লাগানো শোভা পায়?
তবে আমার মেয়েটি পড়াশোনায় ভাল।
পাড়া গাঁয়ে থাকি, মেয়ে বড় হতে না হতে কুদৃষ্টি পড়ে রাক্ষসদের। আমরা কোথায় লুকাব।
পরী কথাগুলো মন দিয়ে শুনল।
এইতো সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে লজেন্স দেওয়ার নাম করে দুর্গাকে নিয়ে যাচ্ছিল।
‘সে কি!’
‘আমাদের হাসি মাসি ওকে অন্য রাস্তায় দেখতে পেয়ে নিয়ে চলে আসে।’
পরী বুঝতে পারে এদের দুর্ভাবনা।
‘আমাদের জীবনটাই অন্ধকারে ভরা তবু এক টুকরো আলোর জন্য উদগীব হয়ে থাকি।’
‘বৃথা আশা মরিতে মরিতে ও মরে না ,কথাতেই আছে নবীন দা? মনের ভেতরে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর লক্ষ্যটাকে স্থির করে রাখুন আর পরিশ্রম
করুন ।ঈশ্বর নিশ্চয়ই সে আশা পূর্ণ করবেন।
এমন সময় বাসের খালাসি চিৎকার করে
সাতগেছিয়া, পারহাটি, বুলবুলিতলা কে যাবেন? কে যাবেন?’
পরী একবার পাশে দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা আপনার টাকাটা নিন বাস এসে গেছে। আসি সবাই ভাল থাকবেন। দুর্গা ভালো করে লেখাপড়া করবে কেমন।’
পরী দুর্গার মাথায় হাত রেখে কথাগুলো বলে।
দিদিমণি ফোন নম্বরটা দেবেন?’
‘আচ্ছা ,আচ্ছা এই নিন এই কার্ডটা রাখুন যদি কোনও দরকার হয় বলবেন।’
নবীন বলল ‘আবার আসবেন।’
‘দুর্গারে মা দুর্গাকে দেখলাম কি ভাল না? আমরাও আর থাকব না দোকানপাট গুটিয়ে চল বাড়ি যাই, যেভাবে বৃষ্টি ঝরছে, বাড়িতে তোর মা রান্না বসাতে পারবে না। চাল কিনতে হবে।’
আজকে হতাশ হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম দেখ ঈশ্বর কিন্তু আমাদের সঙ্গে আছেন যতই অন্ধকার আসুক আলোর দিশা তিনি দেখাবেন।
টোটো চালক রিন্টু বলল, ‘আরে নবীন দা চলে যাচ্ছ।’
‘হ্যাঁ ,ভাই বাড়িতে তো উনুন জ্বলবে না।’
এই বৃষ্টিতে আর কিছু ভাল লাগছে না আমরা তো ভাড়াও পাচ্ছি না। দু’টো পয়সা যে বাড়িতে নিয়ে যাব। ছেলেমেয়েগুলোর পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে বাবা কি নিয়ে আসে।’
‘আরে ভাই আমাদের মত গরিব মানুষদের সারাটা জীবন ধরেই শুধু টেনশন আর টেনশন।’
‘ঠিক আছে চলি রে।’
‘ও বাবা দুগ্গা নাকি !’
‘হ্যাঁ।’
‘তো ওকে বৃষ্টির মধ্যে নিয়ে এসেছো?’
‘আরে বাবা আমি আনিনি, তোর বৌদি-ই পাঠিয়েছে। ‘
‘কিরে দুগ্গা স্কুলে যাচ্ছিস?’
দুর্গা মাথা নাড়ে।
‘হ্যাঁ রে পুতুল স্কুলে যায়?’
দুর্গা আবারও মাথা নাড়ে।
‘চল, চল দুর্গা পা চালিয়ে চল।’
বাড়িতে ঢুকতেই কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ ।ঝড় আসার আগে চারিদিক যেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায় ঠিক তেমনি।’
দুর্গার মায়ের দাওয়াতে বসে থাকা অথচ সহজ, সরল শান্ত মুখশ্রী হঠাৎ যেন মনে হল ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে ।
নবীন দুর্গাকে বলল ‘দুর্গা মাকে গিয়ে বল এই ব্যাগে চাল, ডাল আছে।’
পাশে ছেলেটি ককিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
নবীন ভেবে পাচ্ছে না যে এমন কি হলো যার জন্য তার স্ত্রীর অবস্থা এরকম।
নবীন ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে বলল ‘লক্ষ্মী, বাবানকে দুধ খাওয়াও আর এই দেখো বাজার করে এনেছি, রান্না চাপাও বুঝতে তো পারছ এই তো ওয়েদার এই অবস্থায় কাস্টমার পাওয়া খুব মুশকিল। তবে ভাগ্য দেবতা সুপ্রসন্ন। তাই এক দিদিমণি এসেছিলেন যেন তিনি বিপদতারিনী মা দুর্গা।’
‘কি রে দুগ্গা, বল মাকে।’ উৎসাহের সঙ্গে
নবীন বলল।
দুর্গা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস পেল না। ও ঘরে ঢুকে গেল।
নবীন ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল।
এতক্ষণে লক্ষ্মী ফোঁস করে উঠল ‘থাক আর আদিখ্যেতা করতে হবে না।’
বাবানকে কোল থেকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
নবীন কত বড় মুখ করে অনেক আশা নিয়ে এসেছিল আজকের এই দিদিমনির ব্যাপারে কথাগুলো বলবে ভেবেছিল লক্ষ্মী খুশি হবে কিন্তু এই লক্ষ্মীর কি রূপ দেখছে, এই রূপ তো নবীনের জানা ছিল না।
ভেবে পাচ্ছে না কি হয়েছে?
এবার নবীন ঘরে গেল দেখল লক্ষ্মী
বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে।
নবীন নেবার লোকের পাশে বসে লোকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল তোমাকেও তো বুঝতে হবে আমি ইচ্ছে করে দেরি করে আসি নি।
আমার এতে কি অপরাধ আছে?’
এবার লক্ষ্মী বলল’ আমাকে আর কত অপমান সহ্য করতে হবে বলতে পারো? শয়তানটা আবার এসেছিল তুমি টাকা ধার নিয়েছিলে। টাকা দিতে না পারলে এবার শাসিয়ে গেছে আমাকে আর না হয় তোমার মেয়েকে এবার তাদের হেফাজতে নেবে।’
এবার নবীনের মাথা গরম হয়ে খুন চেপে গেল।গ
‘কি বললি? কি বললি তুই? তোকে না হয় দুর্গাকে। এবার শালা বাড়িতে ঢুকলে ওকে কুপিয়েই আমি মেরে ফেলব। আমি কি ওর টাকা না দিয়ে থাকবো কিন্তু কিছু করার নেই। ওর কপালে মরণ লেখা আছে।’
লক্ষ্মী ভয় পেয়ে গেল একবার নবীন রেগে গেলে কত ভয়ংকর হতে পারে।
তাছাড়া নবীন যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না।
‘মাথাটা ঠাণ্ডা করো আর ভাবো কি করে টাকাটা দেয়া যায়।’
‘কবের মধ্যে টাকা শোধ দিতে হবে।’
‘১৫ দিন সময় দিয়েছে।’
নবীন ভাবল এবার তার এই ভ্যানটাকে বিক্রি করতে হবে তা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই শয়তানদের মুখ জব্দ করতে হবে।
কিন্তু এরপর নবীন কি করবে?
আর ভাবতে পারছি না আগে তো সামনের বিপদটা সামলাই। সে কিছুতেই তার প্রাণ থাকতে তার স্ত্রী বা তার মেয়ের ওপর কোনও আঁচ আসুক সেটা সে চায় না।’
‘তোমার ভ্যান বিক্রি করে ফেলবে’ লক্ষ্মী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার স্বামীর মুখের দিকে।
‘যখনই অন্ধকার ছেড়ে আলো আসে আমাদের এই কুঁড়ে ঘরে ঠিক তখনই কোনও না কোনও বিপদ এসে উপস্থিত হয়’
‘তাহলে আমরা খাব কি?’
নবীন লক্ষ্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে আমি আছি তো, দরকার হলে জন মজুরের কাজ করব।’
লক্ষ্মী স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘যতদিন বাঁচবো মাথা উঁচু করে বাঁচব।’
লক্ষ্মীর হাত দু’টো শক্ত করে ধরে নবীন।
লক্ষ্মী নবীনের ঘাড়ে মাথা রাখে, ‘এভাবে আমাদের কতদিন চলবে? দুটো বাচ্চা আছে।’
নবীন লক্ষ্মীকে আশ্বাস দেয় এরকম কত হাজার জনমজুর আছে জানিস। আর আমি পারব না শুধু তুই আমার সাথে থাকিস। আমার দুঃখের দিনে কখনও আমাকে ছেড়ে চলে যাস না। দেখবি আমি সব লড়াই জিতে গেছি।’
নবীনের চোখ দু’টো ছলছল করছে।
লক্ষ্মী স্বামীর হাত দুটো, বাচ্চা দুটোকে কাছে টেনে নিয়ে খুব শক্ত করে ধরে। ‘আমি তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব সাত জনম তো বাঁধা পড়ে গেছি।’
নবীনের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যেন একরাশ সূর্যমুখী ভোরের আলো ওদের জীবনে এসেছে নতুন যাত্রাপথে।🍁
🍂গল্প /২
______________________________________________
আমি তরে ও মা রে কত জায়গায়, ক্যাম্পে, ডাক্তার, পাহারাদার, পুলিশ সবাইরে জিগায়া মরেছি। কত ঘুষ দিতে হইছে তুই কি খবর রাখিস? যা পাচ্ছস খায়া পরে থাক কোণায়। আমার মাথা- কান খাস না। সরিল বেচি তাই চাট্টি খেতে পাস।’
______________________________________________
দয়া
মিতা দাস
‘মুখ পুড়ি… মাগী, বদজ্জাৎ … কুলটা… রোজ – রোজ মুরগী – মাংস, ডিমের ওমলেট আর তন্দুরি রুটি গিলছিস। আমি কি বুঝতে পারিনে এসব কোত্থেকে আসতেছে। এই টেন্ট এখন আর থাকবার মতো রইল না রে, মাগী। আমি তর বাপ… ভুলে যাস কেন? কাটা পা লইয়া পরি আছি… একটু ভাল-মন্দ আমার লাগ্যা আনতি পারস না? গোটা টেন্টটা-ই নোঙরা বস্তি বাড়ির মতো করে রাখছোস, ভাল মানুষের মুখ দেখা দুর্লভ… যত্তো সব চোর – গুণ্ডা-মস্তানদের দল। তর মা ছিল সতী মেয়ে-মানুষ আর তুই কোথায় নাক কাটাইয়া মাগী হইলি… আহা কপাল।’
হো – হো করে হেঁসে উঠল ময়না।
‘মাগী… মুখ পুড়ি আবার হাঁসে, আমি তোরে কক্ষনো কিছুর জন্নি কষ্ট দিছি?’
‘দেখিছি… তোর সব কারবারই দেখিছি… ভুলি নাই… সেই বছর বানে ভাসিয়া যাইবার সময় দোকানের দেওয়ালটা ভাঙগিয়া পড়তেছিল মা তোরে ঠেল্যা নিজে দেওয়ালের নিচে চাপা খায় মোর গেলো না বাঁচ্যা রইল তুই তো ফিরা ও তাকাইলি না। আমি তরে ও মা রে কত জায়গায়, ক্যাম্পে, ডাক্তার, পাহারাদার, পুলিশ সবাইরে জিগায়া মরেছি। কত ঘুষ দিতে হইছে তুই কি খবর রাখিস? যা পাচ্ছস খায়া পরে থাক কোণায়। আমার মাথা- কান খাস না। সরিল বেচি তাই চাট্টি খেতে পাস।’
‘কে দয়া দেখিয়েছে যে আমি দয়া করব।’ চিৎকার করে উঠল ময়না, ‘চিৎকার শুনে রামজীবন এর বুক এ আদ্রতা নেমে এল’।🍁
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস /১৮
______________________________________________
মহিলাটিকে খুবই প্রগলভ, বাচাল মনে হয়েছিল। কিন্তু গরজ বড় দায়। তাই নিজের নামটা বলেছিলেন। তারপরই অপর প্রান্ত থেকে বলা কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন, ‘একটু কেন? পুরোটা দেব। আপনি ফোন ধরে থাকুন। তারপরই চেঁচিয়ে ডাকতে এবং হাসতে হাসতে বলতে শুনেছিলেন, ‘ঊর্মি দ্যাখ দেখি, তোর কোনও পেশেন্ট বুঝি ওষুধ বুঝতে পারছে না, ওষুধগুলো বুঝিয়ে দিয়ে যা রে।’
ঊর্মির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার স্লিপারের শব্দ প্রত্যেকটা স্টেপে তার বুকের মধ্যের লাপডুপ শব্দটাকে বাড়িয়ে তুলছিল। ফোনটা ক্রেডেলের পাশ থেকে তোলার আওয়াজ পেয়েছিলেন, ‘হ্যালো’
______________________________________________
অনেকটা গল্পের মতো
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়।
মেঘের স্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।
এমন দিনে তারে বলা যায়…
সেকথা শুনিবে না কেহ আর
নিভৃত নির্জন চারিধার
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি
আকাশে জল ঝরে অনিবার
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।’
অমৃত কথা: গত দু’দিন ধরে নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থামার কোনও লক্ষণ নেই। অমৃত খবরের চ্যানেল খোলেন না পারতপক্ষেই। খুললেই তো দেশে বিদেশে শুধুই অশান্তি, খুন, রাহাজানির খবর। কোথায় কার স্বার্থ বিঘ্ন হওয়ায় কোনও প্রোমোটারের শরীরে ঊনচল্লিশ সেকেণ্ডে চল্লিশবার চপারের কোপ পড়েছে সেই খবর, কোথায় কোনও মহিলাকে বিবস্ত্র করে মেরে এলাকা পরিক্রমা, চাকরীর পরীক্ষায় উপযুক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের বছরের পর বছর ধরে গণ অবস্থান ধর্মঘট, রেশন দুর্নীতি, শিক্ষা দুর্নীতি, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নিরীহ মানুষের ওপর নির্মমভাবে গুলি চালনা আর শিক্ষিত ভদ্র মানুষগুলো টিভির সামনে আলোচনায় বসে আলোচনার নামে কেউ কারুর কথা না শুনে, না শুনতে দিয়ে তারস্বরে চিৎকারকরে একে অন্যকে আক্রমণ করে যাওয়া… এসব দেখতে আর এই বিরাশী বছর বয়সে ভাল লাগে না। তাই আবহাওয়ার খবরও জানা হয় না। নিম্নচাপ না বর্ষার বৃষ্টি কিছুই বুঝতে পারেন না। একফালি জানলা দিয়ে সামনের পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। আশেপাশের অনেক পুকুর বুজিয়ে বাড়ি হয়ে গেলেও তার বাড়ির পিছনের এই পুকুরের মালিকের ক্ষমতা বা বাড়ির ভোট সংখ্যার বিচারেই হয়ত নিষ্কৃতি পেয়েছে এই পুকুরটা। অমৃত উদাস চোখে পানকৌড়ির ডুব সাঁতারে মাছ ধরা বা মাছরাঙার চুপ করে বসে থেকে একসময় ধা করে চকিতে মাছ ধরেই আবার গাছের ডালে বসে তারিয়ে তারিয়ে সেই মাছ খাওয়া দেখতে থাকেন। কখনও আমড়া গাছের আড়ালে লুকিয়ে ঘুঘু ডাকে। বিষন্ন লাগে। ভাল লাগে না কিছুই। ছাতাড়ে পাখিরা ঝাঁক বেঁধে এসে পিছনের কলতলায় কিচিরমিচির করতে করতে পড়ে থাকা খাবার খায়। এভাবেই সময় বয়ে যায়। উঠে একটু চা করে খেতেও ইচ্ছে করে না।
আজ বড়ো ঊর্মির কথা মনে পড়ছে। এক একটা মানুষ অন্যের ভাললাগাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারে। ঊর্মি পারতো অমৃতর সেই ভাললাগাকে বুঝতে। এমন একটা বর্ষণক্লান্ত দিনে অমৃতকে কখনও বলে দিতে হয় নি তার ভাললাগা। ডিউটি না থাকলে এমন দুপুরে রান্নাঘর থেকে গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগ ডালের খিচুড়ির গন্ধ, তেলেভাজার গন্ধ ভেসে আসত। সন্ধ্যেয় আচারের তেল দিয়ে পেঁয়াজ লঙ্কা কুঁচিয়ে চানাচুর, বাদাম, নারকোল দিয়ে একবাটি মুড়ি ভেজে, অন্য প্লেটে চারটে পিঁয়াজি বা আলুর চপ…। ঊর্মি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো অতীত। এখন এই সংসারে অমৃত কিছু আশা করেন না। তিনি জানেন তার আশা করা উচিৎ নয়, যদিও তারই পয়সায় এ বাড়ির সংসারটা এখন জমজমিয়ে চলছে। ঊর্মির পয়সা কি তার পয়সা নয়? ঊর্মি রিটায়ার হবার পর তার পেনশনের টাকা থেকেও বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করে গেছে। অমৃতকে নমিনি করার সময় অমৃত আপত্তি করেছিলেন, ‘সেকি! তোমার নমিনি আমি হতে যাবো কেন? তুমি কি ভাবো বলো তো? তুমি ড্যাং ডাং করে আমায় ফেলে চলে যাবে, আর আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়ো হয়েও তোমার সম্পত্তি যখের মতো আগলাব।’ ঊর্মি অদ্ভুত এক হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলেছিল, ‘মরার কথা কে বলতে পারে? কে আগে যায়, কে পরে যায় সেটাই যদি মানুষ আগে থেকে জানতে পারতো, তাহলে সংসারের হিসেব-নিকেশটাই বদলে যেতো। তাছাড়া, আমার তো তেমন কেউ-ই নেই, থাকার মধ্যে ভাইঝি তুতুল। সেও এখন বিদেশে। কোনওদিনই কি আর পিসির সঙ্গে দেখা করতে আসবে। সব সম্পর্কই তো চুকে বুকে গ্যাছে। তোমার তো তবু ও পক্ষের একটা ছেলে আছে। কিছুই না হোক, কিন্তু আমার কিছু হলে তো আর তোমাকে একা থাকতে হবে না। অন্ততঃ পয়সাগুলো থাকলে ঠিক তোমার ও বাড়ীতে একটা ঠাঁই হয়ে যাবে।’
অমৃত বসে বসে ভাবেন, কি অসাধারণ দূরদৃষ্টি! যেন জ্যোতির্বিদ্যা জানত! এমন নির্ভুল অঙ্ক মিলিয়ে দেওয়া…
সিনেমার ফ্ল্যাশ ব্যাকের মতো এক লহমায় অনেক বছর পিছনে ফিরে যান অমৃত…। এফ এমে খুব সুরেলা গলায় গান বাজছিল,
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায় “…।
ফোন নম্বরটা এক টুকরো কাগজে লিখে তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গেছিল ঊর্মি। তখন ঐ টুকরো কাগজটায় লেখা নাম আর নম্বরটা বারবার দেখতে দেখতে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছিল। তবুও অনেক গোপনীয়তা বজায় রেখে ব্যাগের ভেতর তুলে রেখেছিলেন। ঊর্মির কথা সত্যি করে সেদিনই ছুটি হয়ে গেছিল অমৃতর। ডাক্তার দ্বীবেদী প্রেসক্রিপশন লেখার পর, সেসব বুঝিয়ে দিয়ে বেশ একটু তির্যক ভঙ্গীতে হেসে বলেছিলেন, ‘হোপফুলি ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি কমপ্লেইন অ্যাবাউট আওয়ার সার্ভিস এন্ড নার্সিং মিঃ দত্ত?’
ব্যবসায়ী অমৃত দত্তের ইঙ্গিতটুকু বুঝতে তেমন কিছু অসুবিধা হয়নি। উনিও একমুখ হেসে কিছু একটা বলবার আগেই ডাক্তার দ্বিবেদী আবার বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেবেন। ইফ আই এম নট রং, প্রবাবলি উই উইল মীট এগেইন ভেরি সুন…। বলেই আবার একটু মুচকি হেসেছিলেন। অমৃত তখন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচেন। তাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে ডাক্তার নিজেই ডেকেছিলেন, ‘সিস্টার! নেক্সট পেশেন্ট প্লীজ।’ অমৃত ডাক্তারকে শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘আসি স্যার, থ্যাংকস ফর ইউর মেডিকেল সাপোর্ট।’
হাসপাতালের বাইরে এসে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখছিলেন, নাকি খুঁজছিলেন ঊর্মিকে! উনি তো জানতেন ঊর্মির ডিউটি শেষ হয়ে গেছে। তবুও কেন? এ প্রশ্ন নিজেকেই নিজে করেছিলেন। তারপর একটা রিক্সা ডেকে বলেছিলেন, ‘রুবী বোর্ডিং চলো’ তখন কুচবিহারে ওর চেয়ে ভাল হোটেল আর ছিল না। এসে স্নান খাওয়া সেরে হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে নম্বরটা ডায়াল করেছিলেন। ফোনটা বেজে যাচ্ছিল। যতক্ষণ বাজছিল ততক্ষণ যেন এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগছিলেন। তারপর একসময় বহুযুগের ওপার হতে যেন ভেসে এসেছিল, ‘হ্যালো ‘! কাকে চাইছেন?
অচেনা গলার স্বর বুঝতে অসুবিধা হয় নি। কোনক্রমে নামটা বলতে পেরেছিলেন, ‘ঊর্মি সান্যালকে একটু দেওয়া যাবে।’ ফোনের ওপ্রান্তে ঝর্নার মতো হাসি ঝরে পড়েছিল। তারপরই বলেছিল, ‘নামটা বলুন, আপনি কে চাইছেন ঊর্মিকে?’ অমৃতর মহিলাটিকে খুবই প্রগলভ, বাচাল মনে হয়েছিল। কিন্তু গরজ বড় দায়। তাই নিজের নামটা বলেছিলেন। তারপরই অপর প্রান্ত থেকে বলা কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন, ‘একটু কেন? পুরোটা দেব। আপনি ফোন ধরে থাকুন। তারপরই চেঁচিয়ে ডাকতে এবং হাসতে হাসতে বলতে শুনেছিলেন, ‘ঊর্মি দ্যাখ দেখি, তোর কোনও পেশেন্ট বুঝি ওষুধ বুঝতে পারছে না, ওষুধগুলো বুঝিয়ে দিয়ে যা রে।’
ঊর্মির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার স্লিপারের শব্দ প্রত্যেকটা স্টেপে তার বুকের মধ্যের লাপডুপ শব্দটাকে বাড়িয়ে তুলছিল। ফোনটা ক্রেডেলের পাশ থেকে তোলার আওয়াজ পেয়েছিলেন, ‘হ্যালো’ বলার আগেই উনি বলেছিলেন, ‘ঊর্মি! আমি বলছি।’ ঊর্মি হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘বুঝলাম না, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই তো এক একজন আমি আর প্রত্যেক আমির একটা নাম থাকে তো!
অমৃত বুঝেছিলেন ঊর্মি মজা করছে কিন্তু তবুও উনি নাম বলেছিলেন, ‘আপনার পেশেন্ট অমৃত দত্ত।’
ঊর্মি হেসে বলেছিল, ‘তাই! একেবারে বাড়ি পর্যন্ত! এই তো ছাড়া পেলেন…।’ তারপরই বলেছিল, ‘সাগরদীঘির উত্তর পারে সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায়, দেরী হলে কিন্তু আমায় পাবেন না।’ বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল।(ক্রমশঃ)
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
