Sasraya News

Saturday, February 15, 2025

Sasraya News Sunday’s Literature Special | 26th January 2025 | Issue 49 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | চিঠি সংখ্যা |২৬ জানুয়ারি ২০২৬ | সংখ্যা ৪৯

Listen

সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে…

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লেখা নেতাজীর চিঠি 

 

মান্দালয় জেল
১২/৮/২৫

শ্রদ্ধাস্পদেষু—

‘মাসিক বসুমতী’তে আপনার “স্মৃতি কথা” তিনবার পড়লুম—বড় সুন্দর লাগল। মনুষ্য-চরিত্রে আপনার গভীর অন্তর্দৃষ্টি; দেশবন্ধুর সহিত ঘনিষ্ট পরিচয় ও আত্মীয়তা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার অপূর্ব্ব বিশ্লেষণ ক’রে রস ও সত্য উদ্ধার করবার ক্ষমতা— এই উপকরণের দ্বারাই আপনি এত সুন্দর জিনিষ সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

যাহারা তাঁর অন্তরঙ্গ ছিল তাদের মনের মধ্যে কতকগুলি গোপন ব্যথা রয়ে গেল। আপনি সে গোপন ব্যথার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করে শুধু যে সত্য প্রকাশ করবার সহায়তা করেছেন তা’ নয়— আপনি আমাদের মনের বোঝাটাও হাল্‌কা করেছেন। বাস্তবিক “পরাধীন দেশের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, মুক্তি-সংগ্রামে বিদেশীয়দের অপেক্ষা দেশের লোকদের সঙ্গেই মানুষকে লড়াই করতে হয় বেশী।” এই উক্তির নিষ্ঠুর সত্যতা

— তার অনুগ্রহ, কর্মীরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে এবং এখনও বুঝছে।

 

 

আপনার সমস্ত লেখার মধ্যে এই কথাগুলি আমার সবচেয়ে ভাল লাগল—“একান্ত প্রিয়, একান্ত আপনার জনের জন্য মানুষের বুকের মধ্যে যেমন জ্বালা করিতে থাকে— এ সেই। আজ আমরা যাহারা তাঁহার আশে পাশে ছিলাম, আমাদের ভয়ানক দুঃখ জানাইবার ভাষাও নাই; পরের কাছে জানাইতে ভালোও লাগে না।” বাস্তবিক, হৃদয়ের নিগূঢ় কথা পরের কাছে কি সহজে বলা যায়? তারা উপহাস করলে হয় তো সে উপহাস সহ্য করা যায়। কিন্তু তারা যদি রসবোধ না করতে পারে তা’ হলে অসহ্য বোধ হয়, মনে হয়, “অরসিকেষু রস-নিবেদনং শিরসি মা লিখ”। আমাদের অন্তরের কথা, অন্তরঙ্গ ভিন্ন আর কে বুঝতে পারে?

অনেকে মনে করে যে, আমরা অন্ধের মত তাঁকে অনুসরণ করতুম। কিন্তু তাঁর প্রধান চেলাদের সঙ্গে ছিল তাঁর সবচেয়ে ঝগড়া। নিজের কথা বলিতে পারি যে, অসংখ্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া হ’ত। কিন্তু আমি জানতুম যে, যত ঝগড়া করিনা কেন—আমার ভক্তি ও নিষ্ঠা অটুট থাকবে—আর তাঁর ভালবাসা থেকে আমি কখনও বঞ্চিত হ’ব না। তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, যত ঝড় ঝঞ্ঝা আসুক না কেন— তিনি আমাকে পাবেন তাঁর পদতলে। আমাদের সকল ঝগড়ার মিটমাট হ’তো মা’র (বাসন্তী দেবীর) মধ্যস্থতায়। কিন্তু হায় “ রাগ করিবার, অভিমান করিবার জায়গাও আজ আমাদের ঘুচে গেছে।”
আপনি এক জায়গায় লিখেছেন—“লোক নাই, অর্থ নাই, হাতে একখানা কাগজ নাই, অতি ছোট যাহারা তাহারাও গালি-গালাজ না করিয়া কথা কহে না, দেশবন্ধুর সে কি অবস্থা!” সেদিনকার কথা এখনও আমার মনে স্পষ্ট অঙ্কিত আছে। আমরা যখন গয়া কংগ্রেসের পর কলিকাতায় ফিরি— তখন নানা প্রকার অসত্যে এবং অর্দ্ধ সত্যে বাঙ্গলার সব খবর কাগজ ভরপুর। আমাদের স্বপক্ষে ত কথা বলেই নাই— এমন কি আমাদের বক্তব্যটিও তাদের কাগজে স্থান দিতে চায় নাই। তখন স্বরাজ্য ভাণ্ডার প্রায় নিঃশেষ। যখন অর্থের খুব প্রয়োজন তখন অর্থ পাওয়া যায় না। যে বাড়ীতে এক সময়ে লোক ধরত না, সেখানে কি বন্ধু, কি শত্রু— কাহারও চরণ ধুলি আর পড়ে না। কাজেই আমরা কয়েকটী প্রাণী মিলে আসব জমাতুম। পরে যখন সেই বাড়ীর পূর্ণ গৌরব ঘুরে এল— বাহিরের লোক এবং পদপ্রার্থীরা যখন এসে আবার সভাস্থল দখল করল— তখন আমরা কাজের কথাও বলবার সময় পাই না। কত পরিশ্রমের ফলে, কি রকম হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ক’রে ভাণ্ডাবে অর্থসঞ্চয় হ’ল, নিজেদের খবর কাগজ প্রকাশিত হ’ল এবং জন মত অনুকূল দিকে ফেরান হ’ল তা বাহিরের লোক জানে না— বোধ হয় কোনও দিন জানবেও না। কিন্তু এই যজ্ঞের যিনি ছিলেন হোতা, ঋত্বিক, প্রধান পুরোহিত, যজ্ঞের পূর্ণ সমাপ্তির আগেই তিনি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন! ভিতরের আগুন এবং বাহিরের কর্ম্মভাব— এই দুয়ের চাপে তাঁর পার্থিব দেহ আর সহ্য করতে পারল না।
অনেকে মনে করেন যে, তাঁর স্বদেশ সেবাব্রতের উদ্দেশ্য ছিল দেশমাতৃকার চরণে নিজের সর্ব্বস্ব উৎসর্গ করা। কিন্তু আমি জানি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এর চেয়েও মহত্তর। তিনি তাঁর পরিবারকেও দেশমাতৃকার চরণে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। এবং অনেকটা সফলও হ’য়েছিলেন । ১৯২১ খৃঃ ধর-পাকড়ের সময়ে স্থির সঙ্কল্প করেছিলেন যে একে একে তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে কারাগৃহে পাঠাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আসবেন। নিজের ছেলেকে জেলে না পাঠালে পরের ছেলেকে তিনি পাঠাতে পারবেন না— এ রকম বিবেচনা তাঁর আদর্শের দিক থেকে খুব নিম্নস্তরের বলে আমার মনে হয়। আমরা জানতুম যে, তিনি শীঘ্রই ধরা পড়বেন, তাই আমরা বলেছিলুম যে তাঁর গ্রেপ্তারের পূর্ব্বে তাঁর পুত্রের যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নাই এবং একজন পুরুষ বর্ত্তমান থাকতে আমরা কোনও মহিলাকে যেতে দিব না। অনেকক্ষণ ধরে তর্ক বিতর্ক চলে, কোনও সিদ্ধান্ত হয় না— আমরা কোনও মতে তাঁর কথা স্বীকার করতে পারিনি। শেষে তিনি বলেন, “এটা আমার আদেশ—পালন করতে হবে।” তারপর প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা সে আদেশ শিরোধার্য্য করলুম।

তাঁর জ্যেষ্ঠা করা বিবাহিতা—তাঁর উপর তাঁর অধিকার বা দাবী নাই, সেইজন্য তাঁকে পাঠাতে পারলেন না। কনিষ্ঠা কন্যা তখন বাগদত্তা—তাঁকে পাঠান উচিত কিনা—সে বিষয়ে ভীষণ তর্ক হ’ল, তিনি পাঠাতে চান—কন্যারও যাবার অত্যন্ত ইচ্ছা, কিন্তু অন্যান্য সকলের মত—তাঁকে পাঠান উচিত নয়। কারণ একেই তিনি অসুস্থ, তারপর আবার বাগদত্তা— শীঘ্রই বিবাহ হবার কথা। এ ক্ষেত্রে দেশবন্ধু সাধারণের মত স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। শেষে সিদ্ধান্ত হ’ল সর্ব্ব প্রথমে ভোম্বল যাবে— তারপর বাসন্তী দেবী ও উর্ম্মিলা দেবী যাবেন— এবং তাঁর ডাক যে মুহূর্তে আসবে তখনই যাবার জন্য তিনি প্রস্তুত থাকবেন।

বাহিরের ঘটনা সকলেই জানে। কিন্তু এই ঘটনার মূলে— লোক- চক্ষুর অন্তরালে যে ভাব, যে আদর্শ, যে প্রেরণা নিহিত রয়েছে— তার সন্ধান কয়জন রাখে? তাঁর সাধনা শুধু নিজেকে নয়—তাঁর সাধনা তার সমস্ত পরিবারকে নিয়ে। আমার মনে হয় যে, মহাপুরুষের মহত্ত্ব বড় বড় ঘটনার চেয়ে ছোট ছোট ঘটনার ভিতর দিয়েই বেশী ফুটে উঠে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের ‘বসুমতী’তে আমি দেশবন্ধুর সহকর্ম্মী ও অনুগত কর্ম্মীদের লেখা সযত্নে পড়লুম। অধিকাংশ লেখাই ভাসা ভাসা রকমের এবং কতকগুলো বাঁধা শব্দের পুনরুক্তিতেই পরিপূর্ণ, কেবল আপনি একা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার বিশ্লেষণের দ্বারা দেশবন্ধুর চরিত্র অঙ্কিত করবার চেষ্টা করেছেন। তাই আপনার লেখা পড়ে যে কতদূর তৃপ্তি হ’ল তা বলিতে পারি না। ………দেশবন্ধুর শিষ্য ও সহকর্ম্মীদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী আশা করেছিলুম। তাঁরা বোধ হয় কিছু না লিখলেই ভাল করতেন।

সময়ে সময়ে আমি মনে না করে পারি না যে, দেশবন্ধুর অকাল-মৃত্যু ও দেহত্যাগের জন্য তাঁর দেশবাসীরা ও তাঁর অনুচরবর্গও কতকটা দায়ী। তাঁরা যদি তাঁর কাজের বোঝা কতকটা লাঘব করতেন, তা’হলে বোধ হয় তাঁকে এতটা পরিশ্রম করে আয়ু শেষ করতে হত না। কিন্তু আমাদের এমনই অভ্যাস যে, যাকে একবার নেতৃপদে বরণ করি, তাঁর উপর এত ভার চাপাই ও তাঁর কাছ থেকে এত বেশী দাবী করি যে কোনও মানুষের পক্ষে এত ভার বহন বা এত আশা পূরণ করা সম্ভব নয়। রাজনীতি-সংক্রান্ত সব রকম দারিত্বের বকলমা নেতার হাতে তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে চাই।

যাক্ —কি বলতে আরম্ভ করে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা—শুধু আমরা কেন—এখানে সকলের অনুরোধ ও ইচ্ছা আপনি ‘স্মৃতি কথা’র মত দেশবন্ধু সম্বন্ধে আরও কয়েকটী প্রবন্ধ বা কাহিনী লিখুন। আপনার ভাণ্ডার এত শীঘ্র শূন্য হতে পারে না, অতএব লেখার জন্য উপাদানের অভাব হবে বলে আমি আশঙ্কা করি না। আর আপনি যদি লেখেন, তবে সুদূর মান্দালয় জেলে বসে কয়েকজন বাঙ্গালী রাজবন্দী যে অত্যন্ত আগ্রহের সহিত সে রচনা পাঠ ও উপভোগ করবে কোনও সন্দেহ নাই।
আমি বোধ হয় খুব বেশী দিন এখানে থাকব না। কিন্তু খালাস হবার তেমন আকাঙ্ক্ষা এখন আর নাই। বাহিরে গেলেই যে শ্মশানের শূন্যতা আমাকে ঘিরে বসবে–তার কল্পনা করলেই যেন হৃদয়টা সঙ্কুচিত হ’য়ে পড়ে। এখানে সুখে দুঃখে স্মৃতি ও স্বপ্নের মধ্যে দিন- গুলি এক রকম কেটে যাচ্ছে। পিঞ্জরের গরাদের গায়ে আঘাত করে যে জ্বালা বোধ হয়— সে জ্বালার মধ্যেও যে সুখ পাওয়া যায় না— তা আমি বলতে পারি না। যাঁকে ভালবাসি— যাঁকে অন্তরের সহিত ভালবাসার ফলে আমি আজ এখানে— তাঁকে বাস্তবিক ভালবাসি— এই অনুভূতিটা সেই জ্বালার মধ্যেই পাওয়া যায়। তাই বোধ হয়, বদ্ধ দুয়ারের গরাদের গায়ে আছাড় খেয়ে হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হলেও— তার মধ্যে একটা সুখ, একটা শান্তি—একটা তৃপ্তি পাওয়া যায়। বাহিরের হতাশা, বাহিরের শূন্যতা এবং বাহিরের দায়িত্ব—এখন আর মন যেন চায় না।
এখানে না এলে বোধ হয় বুঝতুম না সোনার বাঙ্গলাকে কত ভালবাসি। আমার সময়ে সময়ে মনে হয়, বোধ হয় রবিবাবু কারারুদ্ধ অবস্থা কল্পনা করে লিখেছেন—

“সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।”

যখন ক্ষণেকের তরে বাঙ্গলার বিচিত্ররূপ মানস চক্ষের সম্মুখে ভেসে উঠে— তখন মনে হয় এই অনুভূতির জন্য অন্ততঃ এত কষ্ট করে মান্দালয় আসা সার্থক হয়েছে। কে আগে জানত—বাঙ্গলার মাটি, বাঙ্গলার জল—বাঙ্গলার আকাশ, বাঙ্গলার বাতাস—এত মাধুরী আপনার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে।

কেন এ পত্র লিখে ফেল্লুম জানি না। আপনাকে পত্র দিব এ কথা আগে কখনও মনে আসেনি। তবে আপনার লেখা পড়ে কতকগুলো কথা মনে আসতে লিপিবদ্ধ করলুম। যখন লিখে ফেলেছি—তখন পাঠিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আপনি আমাদের সকলের প্রণাম গ্রহণ করিবেন। পত্রের উত্তর ইচ্ছা হয় দেবেন। তবে উত্তর দাবী করবার মত ভরসা রাখিনা, যদি উত্তর দেন এই আশায় ঠিকানা দিলুম—

C/o D.I.G. I.B., C.I.D.
13, Elysium Row
Calcutta,

 

 

 

🍁মহামিলনেরথা 

 

 

‘নাম করলে প্রারব্ধ বিনষ্ট হয়?
সেই কথা তো ভক্তগণ বলেন।’

নাম করলে কি করে প্রারব্ধ নষ্ট হয়?
নাম করতে করতে ভক্ত যখন নামময় হয়ে যান তখন তাঁর প্রারব্ধ,বর্ত্তমান, আগামী সমস্ত কর্ম্মই নামময় হয়ে যায়। তখন সেই নামে সব হারান ভক্ত সুখ দুঃখ শান্তি অশান্তি কিছু অনুভব করতে পারেন না; তিনি বলেন হরি,দেখেন হরি,যান হরি,শোনেন হরি,আঘ্রাণ করেন হরি,স্পর্শ করেন হরি। প্রারব্ধ আর তাঁর কি করবে? —
বামন অবতারে যখন ঠাকুরটি বলির সর্ব্বস্ব গ্রহণ করে তাঁকে বন্দী করেন,মুক্তি দেবার পর শুক্রাচার্য্যকে যজ্ঞের অচ্ছিদ্রাবধারণ করতে বলেছিলেন তখন শুক্রাচার্য্য বলেন— মন্ত্র তন্ত্র দেশ কাল যোগ্য বস্তুর ছিদ্র তোমার নাম সঙ্কীর্ত্তন সমস্ত ছিদ্রহীন করেন। তোমার নাম করলে কোন কর্ম্মের ত্রুটি থাকে না।
সর্ব্বশ্রেষ্ট রামনাম সঙ্কীর্ত্তনে দেশ কাল শৌচ অশৌচের কোন নিয়ম নাই। যে কোন অবস্থায়,যে কোন স্থানে,যে কেহ,যে কোন প্রকারে নাম করলে কৃতার্থ হবেন—এতে কোন সন্দেহ নাই।
যে কোন প্রকারে যাঁর নাম কীর্ত্তিত অথবা শ্রুত হলে পাপিগণ বিশুদ্ধ হয়ে শুদ্ধ মোক্ষ লাভ করে থাকে।
যত নামের মহিমা শুনছি তত শুনতে ইচ্ছা করছে। হরি তোমার নামের বালাই,নিয়ে মরি! যে কোন প্রকারে নাম বললে শুনলে মানুষ অতি দুর্লভ মোক্ষ,যা জ্ঞান ভিন্ন লাভ হয় না একথা জ্ঞানিগণ বলেন,সেই মুক্তিও লাভ করে থাকে। জয় নাম জয় নাম।

শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী
শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী

 

 

🍁সে চিঠি 

 

 

হ্যাঁ, এতদিন পরে আজ আমার ওয়ার্ড্রোব গোছাবার সময় পুরনো কিছু জিনিসের মধ্যে আমাকে লেখা তোমার শেষ চিঠিটা, যেটা আমার বিয়ের কয়েকদিন আগে লিখেছিলে, বেরিয়ে পড়ল। আগ্রহী হয়ে (স্বাভাবিক) তোমার চিঠিটা আদ্যোপান্ত পড়লাম, একবার নয়, দু’বার, তিনবার

 

 

একটি চিঠি

সুব্রত নন্দী মজুমদার

 

 

 

 

আমার সোম,

তুমি খুবই অবাক হয়ে যাবে অযাচিতভাবে আমার এই চিঠিটা পেয়ে। আমার হাতের লেখা তোমার ভুলে যাবার কথা নয়, গুচ্ছের না হলেও, কলেজে পড়ার সময় আমি তোমাকে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিলাম। আর বয়স বেড়ে গেলেও হাতের লেখার তেমন বদল হয় নি। লেখাটা যখন চিনতে পারবে তখন তোমার মনে প্রশ্ন জাগবে সুদীর্ঘ পনেরো বছর পর হঠাৎ কেন তোমায় লিখতে গেলাম ।

তোমার প্রশ্নের উত্তরটা জটিল। গত পনেরো বছর ধরে তোমার কোন খোঁজ নিই নি (আপাতদৃষ্টিতে, তুমিও অবশ্য নাও নি), এতদিন পরে আজ কেন ……..

হ্যাঁ, এতদিন পরে আজ আমার ওয়ার্ড্রোব গোছাবার সময় পুরনো কিছু জিনিসের মধ্যে আমাকে লেখা তোমার শেষ চিঠিটা, যেটা আমার বিয়ের কয়েকদিন আগে লিখেছিলে, বেরিয়ে পড়ল। আগ্রহী হয়ে (স্বাভাবিক) তোমার চিঠিটা আদ্যোপান্ত পড়লাম, একবার নয়, দু’বার, তিনবার। তুমি সাহিত্যিক মানুষ অলঙ্কারবদ্ধ অনেক শব্দ ব্যবহার করে সুন্দর সুন্দর কথা লিখেছ, আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ সব কথা ভাল করে বুঝতেও পারিনি। কিন্তু আমার চোখ আটকে গেল শেষের কটা লাইনে। তুমি লিখেছ, “আমি যে তোমায় কতখানি ভালবাসি তোমায় ভাষায় বোঝাতে পারব না। আজ তুমি অন্যের হাত ধরে আমায় ছেড়ে চলে যাবে ভাবলেই আমার মনটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। তুমি সুখি হও, কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালবাসা অটুট ও অমলিন থাকবে”।
এটা পড়ে আমার না খুব হাসি পেল, মনে হল ভালবাসা কথাটার অর্থই তুমি জান না। শেষবার তোমার সঙ্গে আমার একান্তে দেখা হয়েছিল আমার বিয়ের কিছুদিন আগে গঙ্গার ঘাটে। গাছের ছায়ায় সন্ধ্যেবেলার অস্তরাগে আধো অন্ধকারে বসে তুমি একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে আমার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে (এই প্রথম এবং শেষ) বলেছিলে, “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না সু”। আমি আজো ভাবি কি অবলীলাক্রমে সেদিন তুমি ওই মিথ্যে কথাটা বলেছিলে। কবিগুরুর ভাষায় “ভালবেসে সখি নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখ তোমার মনের মন্দিরে”। আর মান্না দে ও গেয়ে গেছেন, “যদি হৃদয়ে লিখ নাম, সে নাম রয়ে যাবে”। আমার হৃদয়ে তোমার নাম লিখিত নয়, গভীরভাবে খোদিত হয়ে গিয়েছিল, যেদিন আমি তোমায় প্রথম দেখেছিলাম। আর দীর্ঘ পাঁচ বছর মেশার পর তোমার হৃদয়ে আমার নাম সামান্য আঁচড় কেটেছিল মাত্র, এর বেশি কিছু নয়।

আমি যদিও নাটকীয়ভাবে তোমাকে কোনদিন বলিনি যে আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু আভাষে ইঙ্গিতে, ঠারেঠুরে তোমাকে সেটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম অনেকবার। যে কটা চিঠি তোমাকে লিখেছিলাম কলেজে পড়ার সময় সেগুলোও যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ ছিল যা তোমার না বোঝার কথা নয়। তুমি কি সত্যিসত্যিই সেদিন আমার নীরব ভাষা বুঝতে পার নি কিম্বা না বোঝার ভান করেছিলে সেই কথাটা জানবার বড়ই ইচ্ছে হল আজ এতদিন পরে, তোমার চিঠিটা পড়ার পর।
একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে সোম। তোমার বউ কি তিলোত্তমার মতই সুন্দরী? আমার চেয়েও বেশি? কে জানে, আমি যে সুন্দরী সে কথাটা তুমি মান কি না, তবে আমার বর কিন্তু আমার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়েই আমাকে বিয়ে করেছিল।

আমি যে বললাম না, আকারে ইঙ্গিতে আমি তোমাকে অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছি আমি তোমাকে ভালবাসি, সেগুলো তোমার মনে দাগ না কাটলেও প্রত্যেকটাই আমার অন্তরে গাঁথা হয়ে আছে। যে বছর আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করি আমি আপ্লুত হয়ে সেই কথাটা যখন তোমাকে বলতে গিয়েছিলাম, তুমি খুশি হয়ে বলেছিলে, তোকে সন্দেশ খাওয়াব। আমি গাল ফুলিয়ে বলেছিলাম, এতে হবে না, এর চেয়েও মিষ্টি জিনিষ চাই। তুমি আমার কথার মর্মার্থটাই বুঝলে না গো, তুমি বললে, ঠিক আছে আইস ক্রীম খাওয়াব। আমার প্রতিটি অঙ্গে অঙ্গে তখন প্রস্ফুটিত যৌবনের স্পর্ধা।

কলেজে ভর্তি হবার পর অনেকবার তোমাকে ফোন করে বলেছি, আজ আমার ক্লাস নেই, কি করে সময় কাটাই বল তো? কথাগুলো কি যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ ছিল না? তুমি হেসে উত্তর দিতে, কি আর করবি, পড়ে পড়ে ঘুমো। হায়রে বিধাতা, কি দায়সারা উত্তর! তুমি অবশ্য মাঝে মাঝে বলতে, অস্বীকার করছি না, তোকে আমার খুব ভাল লাগে। তুমি কি জান না ভাললাগা আর ভালবাসার পার্থক্যটা।

একদিন সাহস করে ফোনে বলেছিলাম, তোমার সাথে একটা কথা আছে (তখন আমার মা বাবা আমার বিয়ের সম্বন্ধ দেখছেন), আজ সন্ধ্যেবেলা তোমার সাথে দেখা করতে চাই। তুমি একটু ভেবে বলেছিলে, না রে আজ হবেনা, একটা জরুরী কাজ আছে, কাল ফোন করিস। শুনে আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। তুমি যদি আমায় এভাবে বলতে, রাজ্যের কাজ ছেড়ে দিয়ে আমি তোমার সাথে দেখা করতাম।

যাকগে, নির্লজ্জের মত আমি পরদিন তোমায় আবার ফোন করেছিলাম। তুমি যেন অফিসের কলিগের সঙ্গে কথা বলছ তেমনি করে বলেছিলে, ঠিক আছে, কোথায়, কখন বল। সেদিনই তোমার সঙ্গে আমার শেষবারের মত দেখা। গঙ্গার ঘাটে বসে আমি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তোমার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিলাম, বাবা আমার বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন, আমি কি করব বল। তুমি যদি তখন বলতে, তোকে আমি ছাড়ব না, তুই আমার সঙ্গে চল। তাহলে সেইদিন সেই মুহূর্তে আমি একবস্ত্রে তোমার সঙ্গে চলে যেতাম। তুমি তা না বলে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলেছিলে, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব কি করে?
এখন আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি কথাগুলো মন থেকে বলনি, নাটক নভেল থেকে ধার করা কথা। আমি তক্ষুনি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম।। পরদিন তুমি একটা চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়েছিলে, আমি সেই চিঠিটার কথাই বলছিলাম। তোমার লেখা শেষের লাইন দুটো পড়ে ভাবলাম তুমি কি করে এই কথাগুলো লিখতে পেরেছিলে গো, ওগুলো মিথ্যে সেটা ভাল করে জেনেও। আমার আজ পনেরো বছর পর সেই কথাটা জানতে খুব ইচ্ছে হল সোম, তাই এই চিঠিটা লিখলাম।

তুমি ভাল থেকো, এতাই আমার অন্তরের একমাত্র কামনা।

ইতি
(তোমার) সু তপা

লক্ষ্য করে দেখ ‘তোমার’ কথাটা লিখে ও কেটে দিয়েছি, আর ‘সু’ লেখার পরে একটু ভেবে ‘তপা’ লিখেছি।

[বর্ষীয়ান সাহিত্যিক সুব্রত নন্দী মজুমদার প্রয়াত হয়েছেন। ওঁর পাঠানো চিঠিটি এসংখ্যার অন্যান্য লেখকদের চিঠি ও লেখার মতনই সম্পদ হয়ে রইল। প্রয়াত লেখককে সাশ্রয় নিউজ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। ]

 

 

🍂প্রচ্ছদ গদ্য / এক

 

 

গৌরীর নীল চোখে সমুদ্রের ডাক শুনতে পেল ছেলে আর ঝাঁকড়া চুলের পেশল গ্রানাইট কোঁদা অবয়বে ভরসার ডাক ভারি স্বস্তি দিল গৌরীটিকে। সকালের নরম আলোয় পৃথিবীর সমস্ত পদ্ম-বিলে ফুটে ফুটে উঠল কলির পর কলি। ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাসিমুখে গ্রানাইটের কাঠিন্য নতজানু হল। দুহাতে নিবেদন করল সদ্য ছাড়িয়ে আনা বাকল খানি।

 

 

আজ সকালের ডাকে

কুন্তল দাশগুপ্ত

 

 

 

হুইইইই…
একটা বিশাল অর্জুন গাছের মোটা গুঁড়ির গা থেকে খুব সাবধানে বাকল ছাড়াচ্ছিল ছেলেটা। কানে এল তীক্ষ্ণ ঐ আওয়াজ। পাত্তা দিল না। বাকল ছাড়িয়ে গাছের গায় কাদামাটি লেপে তবে না ছুটি। এখন অন্য কোনো দিকে নজর দিলে চলবে না। নিজেকে বোঝাল ছেলেটা, তবে ওর হাতে লাগল তাড়া। আওয়াজটা কোনো মানুষ করেছে। ডাক এসেছে। মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে, হবেই। ছেলেটা কাজ করতে করতেই তারা সপ্তকে সাড়া দিল— হেএএএএ… কাজ সারতে লাগল দ্রুত।

হুইইইই… হেএএএএ… হুইইইই… হেএএএএ… ডাক চালাচালি করতে করতে ছেলেটা বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে, সামনে নদী— চওড়া-গভীর-শীতল। নদীর ধারে এসে চোখ সরু করে ছেলেটা নদীর ওপারের দিকে ডাকের উৎস খুঁজতে লাগল। সমানে চলেছে ডাক চালাচালি।
হ্যাঁ। ওই তো। সবুজ পোশাক ঢাকা একটা মানুষ। মাথার ওপরে হাত নাড়ছে আর আকুল ভাবে ডাকছে। মানুষটার ঊর্ধাঙ্গ সবুজ পাতার আবরণ। তার মানে…
মানেটা বুঝেই ছেলেটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে তাকে নদী পেরোতে হবে, হবেই। বিশেষ করে ওই মানুষগুলোকে তোলা তোলা করে রাখতে হয়। ওরাই তো নতুন বাচ্চা-মানুষ এনে দেয়। ওরা ডাক পাঠালে যেতেই হয়। ওরা কোনো কাজ দিলে করতেই হয়— মানুষ-দলের নিয়ম। সব দল মানে। অগত্যা…

ছেলেটা পরণের বাকল খুলে আর সদ্য ছাড়ান অর্জুন বাকলটা নিয়ে নদী সাঁতরাতে নামল। বদলে গেছে তার ডাক, সে তারস্বরে ডাক দিতে দিতে সাঁতরাতে লাগল আআআআ… আআআআ… আআআআ… ওপারের ডাক থেমেছে। খুশী খুশী খুশী… দুটো বাকলকে লতায় বেঁধে জলে ভাসিয়ে বুক দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বরফ ঠাণ্ডা নদী-জল দ্রুত সাঁতরাতে লাগল ছেলে… খুশী তার ভরপুর উমে নদীর ঠাণ্ডা চোখের পাতা বুজিয়ে বুজিয়ে দিচ্ছিল নিঃশেষে।
সবুজ পাতার পোশাকে ঢাকা সোনালী চুলের ভূমিকায় এক গৌরীর নীল চোখে সমুদ্রের ডাক শুনতে পেল ছেলে আর ঝাঁকড়া চুলের পেশল গ্রানাইট কোঁদা অবয়বে ভরসার ডাক ভারি স্বস্তি দিল গৌরীটিকে। সকালের নরম আলোয় পৃথিবীর সমস্ত পদ্ম-বিলে ফুটে ফুটে উঠল কলির পর কলি। ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাসিমুখে গ্রানাইটের কাঠিন্য নতজানু হল। দুহাতে নিবেদন করল সদ্য ছাড়িয়ে আনা বাকল খানি। পছন্দের মানুষকে আনুগত্যের বার্তা দিতে উপহার দেওয়াই রেওয়াজ। দুজন ভিন্ন গোষ্ঠির মানুষ বন্ধুত্বের সবুজ সমতলে প্রতিষ্ঠা পেল গৌরী উপহার গ্রহণ করায়।

মেয়ের ইশারায় ছেলেটির চোখ আটকাল মাটিতে পড়ে থাকা গন্ডারের একটা ভাঙা শিরদাঁড়ায়। মেয়ের বিভিন্ন বিভঙ্গে নটরাজের ইঙ্গিতে ছেলে বুঝলে যে মাছ ধরতে এসে বড় মাছ গেঁথে তুলতে পারেনি মেয়ে উল্টে সে মৎস অবতার তার ছিপ ভেঙে নিয়ে গেছে হতাশার অতলতায়। এখন খালি হাতে সে কীভাবে ফেরে? ভারি আতান্তরে পড়ে মেয়ে স্বর-সম্বল করেছিল সাহায্য কাঙ্খায়। কিন্তু কিই বা সাহায্য করে ছেলে তার সুন্দরী বন্ধুকে? ছেলের মুখের সহায়তা পড়ে নিয়ে মেয়ে উপহার পাওয়া বাকলটির নরম দিকটায় পাথরের ছুরি দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে। পাশটিতে শান্ত বাধ্য ছেলে ব’সে ব’সে দেখতে থাকে রেখার নিঃশব্দ বাঙ্ময়তা। যত্ন করে মেয়ে তার ছিপ-ভাঙা অবস্থান ও উত্তর-পূর্ব দিকে পাহাড়ের কোলে তার ঘরদোরের ছবি ফোটাল আর বাকলটির ছেলের হাতে সমর্পণ করে উত্তর-পূর্ব দিকে তাকে দৌড়ে যেতে নির্দেশ দিল। দৌড়ল ছেলে…
পৃথিবী-মা-টি বুকে ধরে রাখল আগামীর ডাক-ব্যবস্থা উন্মেষ এর প্রথম ভঙ্গীটি।
তারপর…

কত অযুত কাল পেরল। কত নিযুত বার পৃথিবী সেরে নিল পরিক্রমা। কত অর্দে পৃথিবীর পূর্ণ আবর্তন ঘটে গেল তার হিসাব আজ অধরা তবে বার্তা প্রণয়ন ও তার আদান-প্রদান আজও সমাজে সমান গুরুত্বে বিরাজিত, যদিও পদ্ধতি বদলেছে ক্রমাগত।
পৃথিবীতে প্রথম চিঠি কে লিখেছিল?
কার জন্য লিখেছিল?
সঠিক জানা নেই। বহু বহু বছর আগে মেসোপটেমিয়ার সুমের অঞ্চলের মানুষ চিঠি লিখত। আফ্রিকার মিশর দেশের মানুষও বার্তা পাঠাতে চিরকুট তথা চিঠি লিখত। তবে, ওই চিঠিতে কোনো শব্দ সজ্জা থাকত না। থাকত ছবি তথা প্রতীক। অনুভূতি প্রকাশের এই প্রতীক ভিত্তিক ব্যবস্থার নাম পিক্টোগ্রাম। বর্তমান জমানার চিঠি হলো পিক্টোগ্রামেরই বিবর্তিত রূপ।

প্রথম চিঠি কোথায় লেখা হয়েছিল জানা নেই, তবে পৃথিবীর প্রথম প্রেমপত্র লেখা হয়েছিল ব্যাবিলনিয়ায়। খ্রিস্টপূর্ব বাইশ’শো সালের ঘটনা। গিমিল নামে এক যুবক প্রেমে পড়েছিলেন কাসবুয়া নামের এক যুবতীর। দু’জনার মাঝখানে ছিল স্থানগত দূরত্ব। গিমিল চিরকুট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন একখণ্ড প্রস্তর। উপরে খোদাই করেছিলেন কিউনিফর্ম লিপিতে ভালোবাসা শব্দটি আর পাঠিয়েছিলেন কাসবুয়ার নিকট। পাঠানোর পদ্ধতি কী ছিল বা কাসবুয়া ওই প্রস্তরখণ্ড গ্রহণ করেছিলেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। ওই প্রেম পূর্ণতা পেয়েছিল কিনা তাও জানা যায় না। তবে পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রেমপত্রের প্রেরক ও প্রাপক হিসেবে গিমিল ও কাসবুয়া অমর হয়ে রইলেন ইতিহাসের পাতায়। অমর হয়ে রইল হৃদয় প্রকাশে চিঠির দৌত্য। দূত, হ্যাঁ তাইই তো, নাহলে রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত বিরহী যক্ষ মেঘকে তার বিরহ-যন্ত্রণা-ভার প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দিতে দৌত্যে বরণ করত না আর আমরা মহাকবি কালিদাসের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত রয়ে যেতাম।

ধ্বনিমালা থেকে বর্ণমালা ধারণ করতে লেগেছে বিস্তর দিন, গভীর গবেষণা যা সরল ও বক্র রেখার অশেষতায় মুক্তি পেয়ে বিভিন্ন বিচিত্র হরফ এনেছে। হরফ রেখাচিত্র বই আর তো কিছু নয়। আমাদের মহাকাব্যে নখের আঁচরে পদ্মপাতায় হৃদয় প্রকাশ করার কাব্যিক বর্ণনা পাই। সেসময় চিঠি সুখ-দুঃখের খবর ধারণ করত আর তা প্রতীক্ষা-পারাবতের কণ্ঠ-মালায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ভেসে ভেসে পৌঁছে যেত বার্তা উন্মুখ তারায় তারায়— এনে দিত স্বস্তি-সুখ বা অস্বস্তির অসুখ। কখনও পারাবত উড়ান ছিন্নভিন্ন হত বাজের প্রচণ্ডতায় আর অভিমুখ বদলে চিঠি গিয়ে পড়ত অনাকাঙ্খিত হাতের পীড়নে।
চিঠি পাঠানো নিয়ে ছিল ভারি চিন্তা। কখন যে তা মাঝপথে চুরি যায় তার কোনো নৈশ্চিন্তি ছিল না। রাজকার্যে চিঠি যেত সৈন্যবাহিনীর খবরদারিতে কিন্তু ব্যক্তিগত চিঠির গুরুত্ব গভীর হলে বড়াই-বাহকের প্রাণান্তের আশঙ্কা থাকত এক আকাশ। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে চিঠি যুদ্ধ বাধিয়ে ছেড়েছে তার প্রজ্জ্বলন্ত প্রমাণ “এমস টেলিগ্রাম”।
ঐতিহাসিকরা প্রথম রাষ্ট্রীয় পত্র লিখন ও প্রেরণ এর কৃতিত্ব দিয়েছেন পারস্য সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের প্রথম কন্যা সম্রাজ্ঞী অতোয়াকে। তিনিই ৫০০খৃস্ট পূর্বাব্দে বার্তা প্রেরণ এর পদ্ধতি হিসেবে চিঠি লেখা ও পাঠানোর সুসংবদ্ধ ধারা প্রণয়ন করেন।

ভারতে সরকারি সুরক্ষায় সাধারণের বার্তা অভিপ্সিত লক্ষে পৌঁছে দিতে অশ্বারোহী ডাকের প্রথম প্রচলন করেন শের শাহ। পুরো মোগল আমলে এই ব্যবস্থা অনুসৃত হয়েছে। পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে বৃটিশ ভারত জুড়ে পরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ডাক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। শাখা ডাকঘর থেকে প্রধান ডাকঘরে চিঠি আদান-প্রদানে নিযুক্ত সরকারী কর্মচারীরা রাত ভর কাজ করতেন দৌড় সম্বলে। বাংলা সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন এই ‘রানার’ তথা ‘ডাকহরকরা’। রানারের ঘামের হিরে কুঁচি আঁজলা ভ’রে তুলে এনেছেন কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং ছোটগল্পে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাক হরকরা ‘জুজিস্টিরকে’ বাঙালি পাঠক কোনও দিন ভুলতে পারবে না। আধুনিকে বার্তা বিলির গায়ে লেগে রয়েছে ‘ডাক শব্দটি। মনে হয় যেন সেই কল্পনা-ধূসর অতীতে যখন মানুষ শব্দ সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি, কেবল ভঙ্গী আর ধ্বনির আঙুল ধ’রে ঘটাত পারস্পরিক নিঃশব্দ বোঝাবুঝি— তখন যে মেয়ে ডাক পাঠিয়েছিল এক ছেলেকে আর মনের কথাটি বাকলে এঁকে তাকে খবর পৌঁছতে পাঠিয়েছিল নিজের গোষ্ঠির দোরে সেই কষ্ট কল্পনার স্বীকৃতিতে আজও চিঠি ‘ডাক’-এ যায় ঘরে ঘরে।

চিঠি লিখবার কত কায়দা ছিল! যে চিঠি বইত হৃদয়-গন্ধ তার লিখন পত্র হত রঙিন ও সুবাসিত। বি-চিত্র খামে প্রেরিত হত সে সব লোনা গভীরতা যা হয়ত মারিয়ানা খাতের ওপরে হাসতে হাসতে জয়ন্তী শোভিত করতে পারে। কেজো চিঠি স্মার্ট। খবরটুকু স্পষ্ট করে জানিয়েই তার তৃপ্তি। আপিস কাছারির চিঠি ওপর-নীচ ওঠা-নামা করে। খুশি, ক্রোধ, প্রতিহিংসা, মেশামেশি করে থাকে এই অফিসিয়াল লেটার গুলোতে। তবে আলাদা ক’রে বলতে হয় ছুটির দরখাস্তের কথা। শ্রদ্ধেয় মুজতবা আলি এক রচনায় কবুল করেছেন যে তিনি ছুটির দরখাস্ত লিখতেই পারেন না। কেন পারেন না? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় স্বীকার করেননি রসরাজ মুজতবা আলি আর তাঁর এই অস্বীকার সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইশারে হি কাফি হ্যায় এই আপ্ত বাক্য অনুসারে দুষ্টু বাতাস ফিসফিসোয়— পৃথিবীতে কোনো ছুটির দরখাস্তে সত্যি কথা জায়গা পায়নি।

যোযনগন্ধা চিঠির রোমান্টিক অস্তি আজ বুঝি ভেসে যায় কাল-জলে। অন্তর্জাল আবদ্ধ সময় ধৃত মানুষ আপন করেছে বেগ কিন্তু বেগবান হতে গিয়ে সে ক্রমশ হারাচ্ছে আবেগ। চেনাকে অচেনার আনন্দে ফিরে ফিরে পাওয়ার সুখ থেকে অনেকটা দূরে সে। “আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম”—গান আর উদাস করে না নবীনকে। এ শুধু স্বর্ণযুগের নস্টালজিয়া প্রবীণের।🍁

 

 

🍂প্রচ্ছদদ্য / দু 

 

 

আমি বলতাম- তোমার কণ্ঠ  আমাকে টানে যেমন সমুদ্র নদীকে টানে কিংবা ঘুম বালিশকে কাছে ডেকে নেয় সেরকমই। একসময় দ্বীপু কাবু হয়ে যেতে থাকে আর আমি তীব্র মজা পাই। কিন্তু বাঁধ সাধলেন নানার বড় মেয়ে শিল্পী আন্টি। বললেন- টেলিফোন বিল তুই দিবি? আব্বা ছ্যাঁচা দিবে।

 

 

‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে’... : পত্র মিতালি

নুসরাত সুলতানা

 

 

 

প্রথম কাকে চিঠি লিখেছিলাম? যতদুর মনে পড়ে বড় ভাইকে লিখেছিলাম। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। আমরা ছয় ভাইবোনই দাদার অন্ধ ভক্ত ছিলাম। হঠাৎ করে দাদা বাড়ি ছেড়েছেন খুব ফাঁকা লাগে বাড়ি। ঘরময় যেন শুধুই শূন্যতা.. তো দাদাকে সমস্ত পৃষ্ঠায় দাদা, দাদা, দাদা লিখে ভরে পাঠিয়েছিলাম। দাদা সেই চিঠি বান্ধবীদের দেখিয়েছিলেন। খুব গল্প করতেন বান্ধবীদের কাছে ছোট বোনকে নিয়ে। বলতেন তাঁর বোন খুব ইন্টেলেকচুয়াল। এরপর দাদা প্রায়শই চিঠি লিখতেন। আমি বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের হোষ্টেলে যখন থাকতাম। দাদার সেসব চিঠি কলেজের বান্ধবীদের দেখাতাম। চিঠিতে সাহিত্যের প্রভাব যেমন থাকতো তেমনি আগামীর জন্য দিক নির্দেশনা থাকতো।
আবার বান্ধবীরা সেই চিঠি চেয়ে নিয়ে পড়তো কেউ কেউ।

এরপর বরিশালের পার্ট চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে এলাম। উঠলাম নানার বাসা লালমাটিয়ায়। অইখানে আমার বয়সী মায়ের এক কাজিন আছে নাম নীপা। আমি ডাকতাম নিপু বলে। নিপু বলল যে ওকে বুয়েটে পড়া এক ছেলে নাকি খুব জ্বালাতন করত নাম দ্বীপু। তো আমি বললাম যে অই দ্বীপুর নাম্বার দাও আমি ওর ঘুম হারাম করে দিই। যেই কথা সেই কাজ। দ্বীপুকে প্রথম প্রথম ফোন করে কথা বলতাম না। শুধু নি:শ্বাস ফেলতাম। আর দ্বীপু বলতো হ্যালো, হ্যালোও, হালোও…। দ্বীপুর কন্ঠস্বর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গমগমে। যদিও তখন আমার ফ্যান্টাসি পাকিস্তানের ক্রিকেটার আকিব জাভেদ। আকিভ জাভেদ যখন ক্রিজে ব্যাট করতো আমার মনে হত- আমাকে দেখে দেখেই ব্যাট করছে ছেলেটা। শচীনকে ভালো লাগতো অনেক বেশি কিন্তু ফ্যান্টাসি আসতো না। যাহোক দ্বীপুর প্রসঙ্গে আসি।
দ্বীপুর সাথে কথা বলা একটা নেশা হয়ে গেল। দ্বীপু যখন বলতো কে আপনি? কখনো বলতাম আমি মেঘ,
কিংবা বলতাম দখিনা বাতাস আবার বলতাম আমি তোমার মনের তলে মনের তলদেশ। দ্বীপু কখনো হাসতো আবার কখনো বিরক্ত হতো। বলতো -এসব করে কী মজা পান? আমি বলতাম- তোমার কণ্ঠ  আমাকে টানে যেমন সমুদ্র নদীকে টানে কিংবা ঘুম বালিশকে কাছে ডেকে নেয় সেরকমই। একসময় দ্বীপু কাবু হয়ে যেতে থাকে আর আমি তীব্র মজা পাই। কিন্তু বাঁধ সাধলেন নানার বড় মেয়ে শিল্পী আন্টি। বললেন- টেলিফোন বিল তুই দিবি? আব্বা ছ্যাঁচা দিবে। বাদ সব… এরপর আমি চলে আসি রোকেয়া হলে।

রোকেয়া হলে এসে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে পড়া শানাইয়ে সাথে জান-পরাণের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। শানাই আর আমি সারাদিন ফাঁকিবাজি আর আড্ডাবাজি করতাম। যদিও আমি বাম এক্টিভিষ্ট ছিলাম। তবে নিজের একাডেমি পড়ালেখার বাইরে বরাবরই ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি এসব পড়তাম। আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা খুব ভালো লাগতো। শানাই বেনামি চিঠি হলের দারোয়ান দাদুদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে নিয়ে পড়তো। অইসব চিঠির অধিকাংশ হত পর্ণ চিঠি। ওর নাকি খুব মজা লাগতো। আর আমার বমি চলে আসতো। আমি চাইতাম নান্দনিক এবং শৈল্পিক চিঠি। সেইসময় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়া রাব্বি নামের একটা ছেলের একটা সুন্দর বেনামি চিঠি পেলাম। আমি রাইনা হয়ে লিখলাম। আমি খুব খুশি হলাম। খুব শৈল্পিক, গভীর নিবেদনের একটা লিখলাম। ভাবলাম চিঠি লিখতে, লিখতে আমার লেখার হাত ঝালাই হয়ে যাবে। আর একজন পত্রমিতাও পাব। আমার একলা একটা দ্বীপ হবে। হবে একটুকরো আকাশ। কিন্তু সে কখনো আমাকে দেখতে চাইবে না। আর কখনো আমরা দেখা করবো না।
কিন্তু তৃতীয় চিঠিতে মেইল এড্রেস লিখে দিল। আর বলল- আমি আগ্রহী হলে মেইল করতে পারি। চিঠি লেখার সময় ওর নেই। আমি ইমেইল করতে আগ্রহী নই। আর রাব্বিকেও এরপর হারিয়ে ফেললাম। এভাবেই প্রযুক্তি আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে হাতের লেখা, চিঠি, ছোট ছোট অনুভূতি আর অপেক্ষা.. যেমন বিশ্বায়নের আগ্রাসনে প্রতিদিন ছোট ছোট জাতির সংস্কৃতির অপমৃত্যু ঘটছে।
মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আব্বু-আম্মুর চিঠি পেতাম। আর টাকা আসতো খামে করেই পোস্ট অফিসে। তখন চিঠির জন্য একমাস, দুইমাস অপেক্ষা করে তারপরই প্রিয়জনের খবর পাওয়া যেত। তখন কত যে চিঠি পড়ে কেঁদেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখন সারাদিন ফেসবুক, মেসেঞ্জার আর হটস এপে কথা হয় কিন্তু আত্মিক টানেরই বড় অভাব। পরিশেষে বলি হৃদয়, নদী আর সংস্কৃতি প্রত্যেকেই নাব্যতা হারিয়ে হয়ে উঠেছে এক সর্বহারা পৃথিবী। আর বন্ধ্যা সময় কেবলই নির্বাক তাকিয়ে আছে… 🍁

 

 

 

🍂প্রচ্ছগদ্য / তি

 

 

অমিত রায় যে যুগে বসে চিঠি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে যুগ এখন একেবারে অতীত। মূল্য-নির্ধারিত এযুগ চিঠির নয়।বলুপূর্বক লেখা হচ্ছে যে সব অফিসিয়াল ও আধা- অফিসিয়াল চিঠি তা আর যাই হোক সঞ্চয়ের সুদৃশ্য বাস্কেটে থাকার মতো নয়। এখনকার দিনে এছাড়া চিঠি নামে বজায় আছে সামাজিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণের চিঠি। এলে ভাল লাগে। আনন্দ হয় না।

 

 

আগেকার দিনের চিঠি ফুরিয়েও যায়নি তাই বলে…

তন্বী মুখোপাধ্যায় 

 

 

 

 

‘চিঠি’ শব্দটা যে ভাব নিয়ে আসে সেই ভাব অত্যন্ত এক আমিপ্রধান ভাব।কবে কোন চিঠি আমার কাছে এসেছিল, এক লহমায় ক্ষণগুলো কী বিস্তীর্ণ ইতিবার্তার রেশ টেনে আনে! এক সেকেণ্ডের মধ্যে তাড়া তাড়া নানা লেখা কাগজ আমার সযত্ন- রক্ষিত ঝাঁপির ধুলোপড়া ডালা খুলে দিব্যমূর্তিতে চোখের সামনে ফুটে ওঠে। কতো নিবিড়ভাবে চেনা লেখার ছাঁদ,কতো বা তার লঘু- গুরু কথার আনা-নেওয়া, তোলাপাড়া।তবে নিজের চিঠির মধ্যে নিজেরাই শুধু নেই, আলাদা করে একটু আবেগে ভাঁটা পড়লে দেখতে পাই চিঠিসমূহকে, কিংবা এক-একটা চিঠি আলাদা আলাদা করে রাখি যদি পাই ‘চিঠি’ সত্তার, লিপিচিত্রের প্রাণের সংজ্ঞাকে। ওরা চিঠি, প্রত্যেকের পারিবারিক পরিচয়, গোত্র ওরা চিঠি। ওরা বা কেমন? ওরা যদি কখনও জানতে চায় পাঠকের নিজেদের নিজত্ব বাদ দিয়ে তাদের মূল্যে তারা কেমন ছিলো। কেমন লাগত চিঠি পেলে চিঠির খাতিরে একটু বিস্তারিত বলা যায় যদি।

চিঠি তো আসলে নানা দাগের খবরাখবর। ভালোলাগা মনেরাখা চিঠি মানে বোধ হয় বেখবর পাঠককে ধীরে ধীরে ক্রমশঃ বিচিত্র ভাবনায় সংলগ্ন ও অভিভূত করে ফেলা, তা একপ্রকার তখনকার মতো দখলদারি। আর একটু ভেঙে বললে তা মনের খবর। চিঠি বিচিত্রিতা হয়ে ওঠেও তার খেয়াল-রসের সঙ্গী হতে বাধা নেই বলে। চিঠি বিচিন্তাও হয়ে উঠতে বাধা পায় না এবং প্রজ্ঞার বাহক হয় অনায়াসেই। সরস্বতীকে বহন করে যেমন তাঁর হাঁস। চিঠির পরিসীমা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তার কারণ ঘটেনি কোথাও কখনও, অতিকথন তার পরিবেশনের গুণ পেলেই উপাদেয়। চিঠিপত্রের আরেক স্বাধীনতার জায়গা তার বিষয়ান্তরে যত্রতত্র যাতায়াতের সুযোগের মধ্যে রয়েছে। একইসঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসের ভিয়েন, রসের বহু ‘পারমুটেশনস- কম্বিনেশনস’-(“বর্ণিমেটা কারো সঙ্গে মিলে পাছে যায়-“) মিশ্রণে মিশে চিঠিই যে অভূতপূর্ব। সব চিঠি কোথাও অনন্য।
হাসি থাকতে পারে, উপহাসও, ফাজলামি, ফচকেমি, এমন কী ভাঁড়ামিও।এখানে মাত্র জানা চাই উদ্দিষ্ট পত্রপ্রাপকের মনের মধ্যে ইতিউতি ভ্রমণের গলিপথ থেকে রাজপথের হদিশজ্ঞাপক মানচিত্রখানা। প্রাপকের তথা পাঠকের মনের সঙ্গে একপ্রকার তাল মিল রেখেই চলো, ঠেকা হলেই হলো। এভাবেই ক্রমশ মেলে। দ্বৈত মনের এক সুর-ছন্দ যখন আবিষ্কার করি ভাবাবেগে ভাসতে থাকা ‘শৈবালের দল’ হয়ে ওঠে চিঠি। ছোটবেলায় স্কুল ছেড়ে আসার পর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি বিশেষ, চিঠি- চালাচালি কিন্তু বন্ধ হয়নি। দু’জনেই পাঁচ –সাত বছর পরেও কৈশোরের বিশেষ অধ্যায়ে দু’জনকে বন্ধু বলেই খুঁজে পাই এই চিঠি জাতীয় প্রতিফলকের মধ্যস্থতার ফলে।

চিঠি প্রথমত ও শেষত দু-তরফা। বিনিময় বলাও যেতে পারে।চিঠির মূল্যে ফলত কোনও অসমতা নেই। চমৎকার একটি চিঠির উত্তরে লেখা অতি সাধারণ চিঠির সমান দাম। উভয়কে দাম মেটাতে হবে চিঠি দিয়ে। দু’টিই প্রাপকের কাছে ব্যক্তিগত মর্যাদা। সুন্দর এই শর্ত থাকার পরও চিঠি আজ লেখা হয় না। মি. অমিত রায় যে যুগে বসে চিঠি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে যুগ এখন একেবারে অতীত। মূল্য-নির্ধারিত এযুগ চিঠির নয়।বলুপূর্বক লেখা হচ্ছে যে সব অফিসিয়াল ও আধা- অফিসিয়াল চিঠি তা আর যাই হোক সঞ্চয়ের সুদৃশ্য বাস্কেটে থাকার মতো নয়। এখনকার দিনে এছাড়া চিঠি নামে বজায় আছে সামাজিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণের চিঠি। এলে ভাল লাগে। আনন্দ হয় না। এখন মেসেজে কাজ চলে যায়। বিলুপ্ত দ্বি-পাক্ষিকতা। বাধ্যতামূলক আলাপের মধ্যে RSVP উল্লেখটুকুই সার, একরকম পক্ষপাতদুষ্ট হয়েই বর্তমানে বাঁচি। চিঠি বলতে আসলে কিন্তু উত্তর- প্রত্যুত্তরের গাঁঠবন্ধন। চিঠি ব’লে কবিতায় কবি জসীমুদ্দীন প্রতিশ্রুতি পালন করে গেলেন। খোকা ভাইয়ের চিঠির সঙ্গে পাখপাখালির চিঠি মিলিয়ে নিয়েছেন, কবি যাদের চিঠি পেয়েছেন তাদের সকলকে উত্তর দিচ্ছেন -“চিঠি পেলুম কিচিরমিচির বাবুই পাখির বাসার থেকে, ধানের পাতায় তালের পাতায় বুনট- করা নকশা এঁকে‘ –আর চিঠির দৌলতে ” খুশির নূপুর ঝুমুর-ঝামুর বাজছে আমার নিরালাতে।”
যিনি লিখেছিলেন তিনি আর নেই, চিঠি রয়ে গেছে, যিনি পেয়েছিলেন তিনিও আর নেই। আর এমন তো হয়েছেই যে চিঠি দিতেনই যাঁরা, তাঁরা পুরোনো অভ্যাস ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছেন। আছেন তাঁরা, সম্পর্ক নেই আর, তথাপি কিন্তু চিঠিগুলো আছে। মুক্তোর মতো অসাধারণ হস্তলিপি নিয়ে আছে, পরামর্শ নিয়ে আছে, পরামর্শের অপেক্ষায় থাকার কথা নিয়ে আছে, শিল্প সমালোচনায় ভরে আছে, হিসেবী কথাবার্তা জানিয়ে আছে, নিছক সংবাদ নিয়ে আছে, মাঝেমাঝে ভ্রমণ নিয়ে আছে, পরনিন্দা পরচর্চা সহ আকছার আছে, বছর শুরুর গ্রিটিংস নিয়ে আছে, অনুতাপ প্রকাশ করে আছে, প্রেম নিবেদন করে আছে, বিরহ-হুতাশে কি ভিন্ন হতাশায় বিহবল হয়ে থাকার কথা বলার জন্যেও রয়ে গেছে। অজস্র চিঠি। চিঠি মোটামুটি দু- রকমের, পাতি চিঠি ও ভালো চিঠি। বড়ো বড়ো মানুষদের চিঠি পড়ে কিছু শেখা যায়, বা উপলব্ধি যাচাই করা যায়, আবার এমনি অনেক চিঠি পড়েও অনেক সময় সংশয়- সন্দেহ নির্মূল হওয়া সম্ভব বলে দেখেছি। মোটমাট ভাব দেওয়া-নেওয়া। অতি গম্ভীর প্রকৃতির ব্যক্তির সরস মন্তব্যে ভরা চিঠি পড়ে পরে তাঁকে ভালো লেগেছে এমনও হয়েছে।

আজ জীবন রেসের ঘোড়ার মতো পাল্লা দিয়ে ছুটছে। নিস্তব্ধ দুপুরে একটা চিঠি আসার কল্পনাতে রোমাঞ্চিত হওয়ার বাতুলতা আর কোথাও নেই। সেই টাইম-স্পেসটাই ফিরবে না, আমরা যে নিত্য ভবিষ্যতের অভিযাত্রী। এখন যে মুহূর্তে আমাদের মনে কথা জমে আমরা ফোন ডায়াল করি। তক্ষুনি গলা ভেসে আসে-হ্যালো-।সোশ্যাল মিডিয়া কী জিনিস, ফাইভ- জি কী জিনিস যখন বোঝার কোনো উপায় ছিলো না সেইদিন আমরা মনে মনে কথা জমাতাম, হয়তো পক্ষকাল পরে নতুবা মাসব্যাপী অপেক্ষার পরে ডাকবাক্সে অনাগত চিঠির উত্তরের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা লিখতাম। চিঠির গতি ছিলো বেশ শ্লথ। একপক্ষের দ্বারা পরিচালিত নয় বলে মান-অভিমানের ট্র্যাফিক জ্যামও থাকতো। ডাক ব্যবস্থার প্রতিকূলতাও ছিলো মানুষকে ভাগ্যবাদী করার পক্ষে যথেষ্ট। তবু চিঠি লিখতে হতো মন খুলে প্রাণ ভরে।প্রিয়জনের জন্য উদ্বেগ সত্ত্বেও অপেক্ষা করতে হ’তো। চিঠি-সংস্কৃতি জানতো কোনো ভালো কিছুই ত্বরিতগতি নয়।আশ্বাস ছিলো চিঠি আসার, দায়িত্ব ছিলো ফাঁক পূরণ করে চিঠি লেখার। আমি যাঁর লেখা পেতে কিংবা খবর পেতে ব্যাকুল, তিনিও তাই, এই বিশ্বাসে কতো কী বাঁধা থাকতো!
আর ভালবাসার চিহ্ন বলতে অনেকের কাছে ছিলো চিঠিটি, কখনও চিঠিক’খানা। প্রয়াত মানুষের চিঠি বড়ো বেশি করেই সত্যি দেখায় তাঁর স্মৃতিকে। আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষদের সঙ্গে এখন যারা পঞ্চাশোর্ধ্ব সেই আমাদের প্রজন্মের এখানে একটা মিল ছিলো। সেই মিলের ভাবচ্ছায়ায় থেকে অনুভব করতে পারি যে, চিঠি তাৎক্ষণিক ছিলো না, ছিলো ক্ষণশাশ্বতী।অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘রত্ন ও শ্রীমতী’র সম্বন্ধসূত্র তৈরি করা চিঠিগুলো পড়ে প্রেমের ধাপ বলেও চিঠিকে চেনানো যেতে পারে।আশা-আশঙ্কায় ঈপ্সিতকে মুঠোয় ধরার নাম ছিলো ‘চিঠি’। আর ডাকপাখির পায়ে বিদায়ী তথা মেলানি রূপে বেঁধে দিতে হবে তোমার প্রত্যুত্তর। সবসময় প্রেম বলেও নয়, কতো সময়োচিত আশীর্বাদ,উপদেশ, শুভেচ্ছা নিয়ে এসে কতো চিঠি অমূল্য হয়ে গেছে। নৈরাশ্যের গড়খাই যখন হাঁ করে গিলতে আসছে তখন কীভাবে হঠাৎ লাভ হয়েছে কোনো পত্রবন্ধুর পত্রালি সান্নিধ্য আর মিটে গেছে অনেক সমস্যা।

প্রতি ব্যক্তিই অন্য অনেকের ভাবনার সমবায়ে গড়া। চিঠি ভাবনার একজন গুরুত্বপূর্ণ বাহক। আগেকার দিনের চিঠি ফুরিয়েও যায়নি তাই বলে, এখনও পড়লে তার স্নিগ্ধতা সবাইকারই মনকে টানে বুঝি। মতভেদের কথাও মনে পড়ে যায়। পরে চিঠি পড়ার সময় আর সেই সময়ের তিক্ততা থাকে না। একসময়ের সম্ভবত আক্রমণ কেমন যেন নির্মোহ হয়ে দেখা যায়, সব বিরূপতা অন্তরালে গিয়েছে এখন এই বোধ শান্তি আর উপভোগ্যতা আনে।এখন নিজের তখনকার প্রতিক্রিয়াকে ছেলেমানুষি না ভেবে পারি না। শুধু চিঠিগুলো নিয়ে সে-যুগে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেন দাঁড়িয়ে থাকি।
তবে চিঠির ব্যাপারে আমরা ক’য়েকটা নিষেধাজ্ঞা জানি আছে। অন্যের চিঠি না-পড়ার শিক্ষা আমরা পেয়েছি। তেমনভাবে গোপনীয় না হলেও এই একটা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপের জায়গায় চিঠির নিজস্বতা রক্ষা করা হয়। এরকম মূল্যবোধকে সকলে সর্বদা মেনেছি এমন হয়তো নয়। লঙ্ঘন করেছি মাঝেমাঝেই। লুকিয়ে-চুরিয়ে পড়েছি। এমনকী যে আমাকে বিশ্বাস ক’রে তার একান্ত কথা লিখেছে, তাকেও না জানিয়ে কতো সময় তার চিঠির ভাষার জন্য, হাতের লেখার জন্য অন্য কাউকে দেখিয়ে ফেলি আমরা। সুন্দর চিঠিও যে অন্য সুন্দর সামগ্রীর মতো, দেখিয়ে আশ মেটে না।এমন স্বভাব না হ’লে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ লেখার দরকারই বা কেন পড়ত?

তবে সমাজের মূল্যবোধ ছিলো চিঠির স্বাধীনতার পক্ষে। মনে পড়ে, অন্যের চিঠি পড়া উচিত নয় জেনে নিজের চিঠি সম্পর্কে বারো-চৌদ্দ আনা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি। যার যেথা দেশ-এর বাদলের মতো উজ্জয়িনীর চিঠির উত্তর সুধীকে দিয়ে লেখানোর ঔদাসীন্য কখনও কল্পনা করতে পারি না। পাঠানোর যোগ্য লেখা লিখতে চাওয়াও স্বাভাবিক সর্বাঙ্গীন আকাঙ্ক্ষা। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, বরাবরই চিঠিকে মনে হয়েছে, কাউকে স্পষ্টভাবে জানার সুযোগ। যেহেতু চেনার পরিধি বেড়েছে, যেন অনুভবের ব্যাসার্ধ আরও দীর্ঘ হলো। বেশ কিছুটা বেড়ে ওঠা চিঠি মাধ্যমের সম্পর্কগুলো থেকে রেণু রেণু বাস্তববোধ জমিয়ে কংক্রিট করেছি এমনভাবে যে আজকের অনেক পর্যালোচনায় সেই সত্য ভিত্তি উপস্থিত থেকে প্রায়শ সিদ্ধান্তকে পরিণতি দেয়। 🍁

 

 

 

🍂প্রচ্ছদ গদ্য / তিন

 

 

সখ্য ঘনিষ্ট হলে দেখা হল দু’জনের। গাঁয়ের ছেলে কবিতাকে দেখে তো থ। এত সুন্দর হয় কোনো মেয়ে? এত সুন্দর হতে পারে!
তারপর যা হবার তা-ই হল। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কঠিন কঠিন পড়াগুলো মাথায় আর ঢুকতে চাইল না। মাথায় শুধু কবিতা ঘোরে। শয়নে-স্বপনে কবিতা। শেষমেশ লেখাপড়া শেষ হওয়ার একবছর আগেই চুপটি করে কবিতাকে কবুল করে ফেলল।

 

 

বন্ধুর কাছে মনের খবর

রেহানা বীথি

 

 

 

প্রেম করেছি। পত্রে পত্রে প্রেম।
না না, পত্রের মাধ্যমেই যে জমে উঠেছিল  সেই প্রেম, তা নয়।  চোখে চোখ,  চেনাজানা, ভালোলাগাটুকু লজ্জাবনত হয়ে মৃদু প্রকাশ, অতঃপর প্রেম।  তারপর পত্র বিনিময়।  সে কী রোমাঞ্চ! বুকের ভেতর ঢাকের আওয়াজ – যদি কেউ দেখে ফেলে!

যৌবনের সূচনালগ্নের সেই প্রেম আমার বাকি সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।  বাকি সব পথ মানে – ওই দু-চারজন ছেলের সঙ্গে একটু দুষ্টুমি,  একটু চিঠি চালাচালি কিংবা এক্কেবারে অচেনা কারও সঙ্গে শুধু চিঠিতেই কবিতা বুনে ফেলা – এসব আর কী! দিব্যি করে বলছি – এক প্রেমেই কুপোকাত।
কিন্তু মনে মনে আফসোস কি হয়নি? হয়েছে, ভীষণভাবেই হয়েছে।  কতজনের কাছে গল্প শুনেছি,  কত পরিচিতজনকে স্বচক্ষে দেখেওছি দেশে বিদেশে চিঠিতে চিঠিতে কথা হতে হতে গভীর প্রেম।  কিংবা শুধুই বন্ধুত্ব। চোখের দেখাটুকু নেই,  অথচ কী গভীর ভাবের বিনিময়।  কিন্তু আমার বেলায়… ধুর! তবে আফসোস জিইয়ে রেখেই বা কী হবে? যেখানে কুপোকাত,  সেখানেই মন রাখি ভিজিয়ে – এই ভাবখানা ধরে কাটিয়ে দিলাম এতগুলো বছর। সমাজের সিনিয়র সিটিজেনের খাতায় নাম উঠব উঠব করছে। ওসব কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। এমন সময়ে ডাক এল পত্রমিতালি নিয়ে লেখার।  আর যায় কোথায়! সেই মিইয়ে যাওয়া ছাই-ছাই অতীত সিনেমার পর্দার মতো কেঁপে কেঁপে আলো ফেলতে লাগল চোখের পাতায়। মনে হল – এই তো সেদিনের কথা,  এই তো সেদিন,  কী যেন নাম ছিল ছেলেটার…!

শীত, বর্ষায় মাখামাখি গাঁয়ের এক ছেলে,  যে কিনা ভীষণ মেধাবী,  চান্স পেয়ে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার।  ঝলমলে রাজধানী শহরে গিয়ে শিখে ফেলল নতুন নতুন কায়দা-কানুন। এই নতুন কায়দা-কানুনের একটি হল পত্রে মিতালি পাতান। বিষয়টি ওকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করল এবং পত্রিকায় ঠিকানা দেখে দেখে কয়েকজনের সঙ্গে শুরু করল পত্র বিনিময়। এরমধ্যে কবিতা নাম্নী একজনের সঙ্গে যেন একটু বেশিই সখ্য গড়ে উঠল। সখ্য ঘনিষ্ট হলে দেখা হল দু’জনের। গাঁয়ের ছেলে কবিতাকে দেখে তো থ। এত সুন্দর হয় কোনো মেয়ে? এত সুন্দর হতে পারে!
তারপর যা হবার তা-ই হল। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কঠিন কঠিন পড়াগুলো মাথায় আর ঢুকতে চাইল না। মাথায় শুধু কবিতা ঘোরে। শয়নে-স্বপনে কবিতা। শেষমেশ লেখাপড়া শেষ হওয়ার একবছর আগেই চুপটি করে কবিতাকে কবুল করে ফেলল।
একদিন গেল,  দু’দিন গেল – খবর একসময় পৌঁছে গেল গাঁয়ে। বেধে গেল লঙ্কাকাণ্ড। ছেলের পিতা হুঙ্কার দিয়ে বললেন – এমন ছেলের মুখ তিনি আর জীবন থাকতে দেখবেন না। আর মা তো কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালেন। ছেলের বড় ভাই-বোনেরা চড়-থাপ্পড় দিয়ে ভাইকে বাপের পা ধরে বসিয়ে রাখল। বাপের মন গলল একসময়। ছেলের পত্রমিতালি বউকে মেনে নিলেন তিনি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বাড়িসুদ্ধ সবাই।

এ তো গেল একটি ঘটনা।
আর ওই যে আমাদের পাশের বাড়ির বুদ্ধিজীবী মার্কা ছেলেটা,  সে-ও তো চিঠি পাঠিয়ে আর পেয়ে হিরো বনে গেছিল। নামী-দামী মানুষ থেকে শুরু করে সুন্দরী যুবতীরা নাকি তার পত্রমিতা ছিল। গোছা গোছা চিঠি আসত তার। সেসব চিঠি মোড়ের চায়ের দোকানে সান্ধ্য আড্ডায় বন্ধুদের সামনে মাঝে মাঝে পড়েও শোনাত। আড্ডার বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ তো ওকে রীতিমতো ঈর্ষা করত। আর এই ঈর্ষাকে ও-প্রশান্তচিত্তে উড়িয়ে কাঁধের ঝোলা দোলাতে দোলাতে চলে যেত ওদের থেকে দূরে,  আরও দূরে। পরেরদিন সন্ধ্যায় আবারও ফিরে আসত আড্ডায়,  ঈর্ষার ঝোলা কাঁধে নিয়ে।

বুদ্ধিজীবী মার্কা ছেলেটি ফিরে আসত; কিন্তু সেই সময়টা,  সেই স্মৃতিময় অতীত তো আর ফিরে  আসে না! আমার দেখা আশি কিংবা নব্বইয়ের দশক ধীরে ধীরে হারিয়েই গেল। হারিয়ে গেলে সেই আবেগমাখা মিষ্টি দিনগুলো,  হারিয়ে গেল চিঠিরা। পত্রমিতারা এসে ঠাঁই নিল মোবাইলের স্ক্রিনে। খাঁ-খাঁ দুপুরে ডাকপিওনের অপেক্ষা এখন আর নেই।
আর রোমাঞ্চ?
ইচ্ছে হলেই টুক করে একটা টেক্সট ছেড়ে টুং শব্দের অপেক্ষাটুকুতে এসে আটকে গেল।
তবে, এতে রোমাঞ্চ খানিকটা ফিকে হলেও মেজাজ কিন্তু সেই অতীতের পত্রমিতালির ছাঁচেই নকশাকার।  সেই দেশ-বিদেশে,  সেই নারী-পুরুষ,  সেই বন্ধুত্ব,  সেই ভাবের আদান-প্রদান সব এক।  এ যেন পুরোনো ভাবনা নতুন মোড়কে পরিবেশন।

প্রযুক্তির গতি আর ভাবনার নতুন মোড়ক আমাদেরকে আঙুলের ছোঁয়ায় পত্র ছাড়া  মিতালি পাতানোর যে সুযোগ দিয়েছে,  তা-ই বা মন্দ কী!🍁

 

 

 

🍂প্রচ্ছগদ্য / চা

 

কলেজে পড়তে হস্টেলে থাকতে যদি কারুর খামে চিঠি আসত সেই চিঠি খুলে পড়ে তবেই মেয়েটির হাতে দেওয়া হত। না, কোনোদিন কোনো মেয়ে বলেনি এটা আমার ব্যক্তিগত অধিকার। আপনি চিঠি কেন খুলে পড়েছেন অথবা সেরকম দেখলে ধমক দেওয়া হয়েছে মেয়েটিকে পরেরবার এইরকম চিঠি যেন কলেজের ঠিকানায় না আসে। তাহলে কি বলব আমরা অনেক গোবেচারা ছিলাম! মোটেও তা নয় তখন ও পর্যন্ত আমাদের পরিবারতন্ত্রের একটা সংস্কার ছিল। সেটা হল বড়দের শ্রদ্ধা করা।

 

 

সমাজকে লেখা একটি খোলা চিঠি

হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় 

 

 

তুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় বাবা চিঠি লেখা শিখেয়েছিলেন। এরপর বিভিন্ন আবেদন পত্র তার নিয়ম, ভাষার তফাৎ সবকিছুই। আমার খুব মনে আছে তখন বাবার কাছে শিখেছিলাম কেয়ার অফ মানে প্রযত্নে। সেই থেকেই হাতেখড়ি।

তবে শুধু নম্বর পাওয়ার জন্য পড়াশোনা কোনোদিন করিনি তাই এর ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল। পুজোর পর বিজয়ায় , যারা দূরে থাকতেন তাঁদের প্রণাম জানিয়ে চিঠিলেখা ছিল বাধ্যতামূলক। এরপর খুব নস্টালজিয়া কাজ‌ করত যখন বাবার মুখে রাণার রাণার গানখানি শুনতাম। ছোটো থেকেই আবেগপ্রবণ মানুষ তাই যখন বাবা গাইতেন—- ” পিঠে তে টাকার বোঝা তবু টাকাকে যাবে না ছোঁয়া… ক্ষুধিত রাণার পৌঁছে দিয়েছে মেলে। আমার মনে পড়ে বাবার কোলে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। মানুষের দুঃখ ছিল, কষ্ট ছিল, উপার্জন ছিল কম। কিন্তু একটা সুস্থ সমাজ, সুস্থ পরিবেশের সুর ছিল। মানুষের দুবেলা দুমুঠো খাবার হয়ত জুটত না কিন্তু তবুও একটা নীতি ছিল একটা আদর্শ ছিল সর্বত্র।

এরপর রাতারাতি সমস্ত ডাকঘর গুলো বদলে গেল। মানুষের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে গেল। এখন আর চিঠি লিখে খোঁজ নেওয়ার দরকার পড়ল না। জায়গায় জায়গায় টেলিফোনের তার বসে গেল। অফিসিয়াল কাজকর্ম ছাড়া আর চিঠি লিখবার প্রয়োজন হল না।

খুব মনে পড়ে কলেজে পড়তে হস্টেলে থাকতে যদি কারুর খামে চিঠি আসত সেই চিঠি খুলে পড়ে তবেই মেয়েটির হাতে দেওয়া হত। না, কোনোদিন কোনো মেয়ে বলেনি এটা আমার ব্যক্তিগত অধিকার। আপনি চিঠি কেন খুলে পড়েছেন অথবা সেরকম দেখলে ধমক দেওয়া হয়েছে মেয়েটিকে পরেরবার এইরকম চিঠি যেন কলেজের ঠিকানায় না আসে। তাহলে কি বলব আমরা অনেক গোবেচারা ছিলাম! মোটেও তা নয় তখন ও পর্যন্ত আমাদের পরিবারতন্ত্রের একটা সংস্কার ছিল। সেটা হল বড়দের শ্রদ্ধা করা।

যাক সেসব কথা। দিন চলে গেছে। এখন তো অনেক ছেলেমেয়েদের দেখেছি গুগল দেখে আবেদন পত্র লেখে। কী অদ্ভুতভাবে এগিয়েছে এই শিক্ষাক্ষেত্রের অক্ষমতা। আমরা কিন্তু এটাকে একেবারেই আমল দিইনি। আমরা নিজেদের পিঠ , নিজেরা চাপড়ে বলেছি‌, আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক স্মার্ট । ওরা ম্যানেজ করতে শিখে গেছে। এই বোধ যবে থেকে আমাদের হয়েছে তবে থেকে আমাদের সমাজটা শেষ হয়ে গেছে। তবে এতে আমাদের ছেলেমেয়েদের কোনো অসুবিধে হয়নি । অসুবিধে হয়েছে আমাদের বাবা , মায়েদের। যাদের অনেক কিছু বলার থাকে আমাদের কিন্তু টাইপ করতে অসুবিধে হয় বলে , বলতে পারেন না। ওদের কষ্টগুলো জমা হয় হৃদয় নামক খামে। খুব কষ্টে চেপে রাখে‌ নিজেদের কথাগুলোকে। তাতে ভারতীয় ডাক বিভাগের কিছু যায় আসে না। আমি তো দেখেছি এখন খাতায় লিখতে গেলেই আমার মত অনেকেরই হাত আড়ষ্ট হয়ে আসে।

যাক সেসব কথা। এবার আসুন কিছু আবেদন করি সমাজের উচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সুপ্রিমকোর্ট, মহামান্য সি . বি. আই এর দপ্তর, মহামান্য সরকারের প্রতি। মহামান্য , আপনাদের ছুঁয়ে দেখবার ক্ষমতা সাধারণ মধ্যবিত্তের বাইরে। তবুও কিছু কিছু এমন অসামাজিক কার্যকলাপ সমাজে হচ্ছে যখন আমাদের আপনাদের দারস্থ হতে হচ্ছে।

বিশ্বাস করুন একজন দর্জির বাবার পক্ষে একটা ডাক্তার সন্তান অনেকখানি গুরুত্ব রাখে। আসলে দুবেলা দুমুঠো খাবারের জোগাড় করতেই যখন নাভিশ্বাস ওঠে, সেইসময় একজন প্রতিষ্ঠিত মেয়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে, বাবার হাতটা শক্ত করে ধরবে। এটুকুই তো চেয়েছিল! আপনারা সর্বত্র টাকা দিয়ে সবকিছু ছিনিয়ে আনতে পারেন কিন্তু যেটা আপনারা পারেন না সেটা হল একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে মেরুদন্ড সোজা করে বাঁচার যে মন্ত্র দেওয়া হয় সন্তানদের সেইটে। যদি পারতেন তাহলে বুঝতেন মধ্যবিত্ত সৎ মানুষগুলোকে কেনা যায় না। কারণ এই মানুষগুলো আছে বলেই প্রতিদিন সূর্য, চন্দ্র ওঠে।

আমি বিশ্বাস করি না মানুষ বা দলের পরিবর্তন হলেই রাতারাতি সমাজটা বদলে যাবে। সেই স্বর্ণালী যুগটা আর নেই। মধ্যবিত্তের জীবনেও এসেছে বহু জটিলতা। আমাদের বাঁচার মধ্যেও অনেক ভুলভ্রান্তি এসেছে। আমরা ভুলে গেছি সততা , আমরা ভুলে গেছি শ্রদ্ধা, আমরা ভুলে গেছি মানবতা। তাই সব দোষ আপনাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নিজেদের সাধু পুরুষ বলতেও চায় না। বরং আবেদন করছি মানুষ যদি তার ভুল শুধরে নিতে পারেন একটিবার সাহস করে তাহলে আপনাদের নিয়েও আমাদের প্রজন্ম হয়ত একদিন গর্ববোধ করবে। দয়াকরে পুজোর আগে আর কিছু না পারুন সুবিচার দেবেন আশাকরি। আসলে গান্ধিজীর আবেদন নিবেদন মূলক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তাই সবকিছু অগ্রাহ্য করে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বপ্নের স্বাধীনতা। কিন্তু আমরা এতগুলো মানুষ আপনার কাছে কিন্তু আবেদন করছি সুবিচার ফিরিয়ে আনুন।

প্রতিটি মানুষ যেভাবে পথে নেমেছেন তারা কিন্তু সকলেই রাজনীতির লোকজন নন । বিরোধী পার্টিও না। একটা তিনবছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত বিচার চাইছে। বাঁচতে চাইছে! এতগুলো মানুষের আবেদন যেন বৃথা না যায়। কারণ ইতিহাস সাক্ষী যতবার নারীর অবমাননা হয়েছে ততবার এ সমাজ ধ্বংস হয়েছে।

বাঙালি বুদ্ধিজীবীর দল। লোকজন গর্ববোধ করে এই জাতিকে নিয়ে। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চাওয়া মানুষ। ভারতবর্ষের যেখানে যত গৌরবময় ঘটনা সবকিছুতে সামিল হয়েছে বাঙালি। জয়ের মুকুট ছিনিয়ে এনেছে। আসুন না একটিবার আবার সেই হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। আমরা তো কেউই অমর না। আমাদের জন্ম যেমন সত্য মৃত্যুও তেমন সত্য। বরং আমাদের সকলকে মানুষের অধিকারে বাঁচার সুযোগ দিন। নাহলে এমন দিন আসবে যেদিন অরাজকতার ভয়ে আপনারাও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবেন। আপনাদের তৈরি মিথ্যে বিচার ব্যবস্থায় আপনারাই ফেঁসে যাবেন একদিন। আজ বিশ্ব পত্রলেখা দিবস। তাই এই খোলা চিঠি।🍁

 

 

 

🍁আকের চিঠি/

 

প্রিয় সহযোদ্ধা,

আপনার কলম এখনো কওতল তরোয়াল। চিঠির ওপারে তার ঝকঝকে শাণিত শরীর পরিস্কার দেখা যায়। আমি জানি আপনার এই অজ্ঞাতবাস একান্তই স্বেচ্ছাবশত নতুবা আপনি কোনো শরসন্ধানে ব্যস্ত আছেন। ফেরা না ফেরার মধ্যে ছোট্ট এক হাইফেন, হয়ত সেটাও আপনার ইচ্ছা তবুও যে দীর্ঘ চড়া পড়ে রয়েছে নদীতে, দেখতে ইচ্ছা করে তার নিজস্ব তরঙ্গ। হলদে হয়ে আসা সংবাদ পত্রে, পড়তে ইচ্ছা করে সেই সব বাক্যবন্ধ যার তীক্ষ্ণ সংযোজনে সত্যের মুখবন্ধে দিন শুরু হবে। সুপ্রভাতের টেবিলে জুড়িয়ে যাবে কফিকাপ, আর রক্তের চিনি।

 

 

 

 

নেমেসিসের খড়গ আর কার হাতে থাকে বলুন, সময় ছাড়া গতি স্তব্ধ করার ক্ষমতা কার আছে! বিছিন্ন সময়, রক্তাক্ত দিন , শূন্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া এই সমাজ, চারপাশ দিন বদলের জন্য কেমন নেমে এসেছে ঢালুতে! এক পা এদিক ওদিকে, সম্পূর্ণ মৃত্যু!

আপনি নিশ্চয় দূর থেকে এই শহরকে দেখছেন! শহরের প্রতিটি বলয় এখন অগ্নিপথ! পিঠ ঠেকে আছে শহরের। আপনি দেখবেন আমি জানি, আর অনেক রাতে মোটা চুরুটে আগুন জ্বালিয়ে বলবেন, কাল ভোর রাতে এই খবরগুলি প্রেসে যাওয়া চাই! খটাখট শব্দ তুলে টাইপের আওয়াজ রাতের নৈঃশব্দ ভেঙ্গে দেবে—— কেমন আছে সেই হাতের আঙ্গুল গুলো! যে আঙ্গুলে একদিন ঝড় উঠত, নিভৃতের স্পর্শ, সেই আঙুল কী সত্যিই বড় ক্লান্ত! কিন্তু তবুও আপনার শর সন্ধান ব্যর্থ হয়নি আজ ও! আপনার ফতুয়ার পকেটে খালি বন্দুকের বাকি গুলি গুলো রাখা। শুধু নিপুণ একটা ট্রিগারের টান! বন্দুক নয়, আপনার কলম অপেক্ষা করছে একটি নিপুণ ফায়ারিং স্কোয়াডের— ভিজে যাওয়া গোলা বারুদ গুলি জ্বলে উঠুক আবার– তঞ্চক জমানায় একজন অন্তত সকলের কথা ভাবুক। একটি কথাও না বলে বেরিয়ে গেছিলেন, আপনার বনবাসের চোদ্দ বছর,এবার পেরিয়ে গেছে, এবার প্রতি শর নিক্ষেপের পালা! আপনার প্রতীক্ষায় আমরা।
——পুরোনো দিন বড় কাছে টানে, আর একবার আপনার পাশাপাশি সহযোদ্ধা হতে বড় ইচ্ছা করে — যে সামান্য জীবন বেঁচে আছে গচ্ছিত আছে আপনার কাছেই। কবে ফিরছেন?

যোগাযোগের করার নিশানা রেখে যান নি, শুধুমাত্র আন্দাজে ভর করে পুরোনো ঠিকানায় চিঠিটি পাঠালাম– জানি একবার অন্তত ওখানে আসবেন আপনি—

ইতি,
সহযোদ্ধা তনুকা, এক নম্বর স্কোয়াড
ব্যাজ নাম্বার টুয়েন্টি।

 

প্রাপক : 
শ্রীযুক্ত অনিমেষ মজুমদার
৪৭, বিনয় সরকার রোড
ফুলবাড়ি
জেলা, পোস্ট অফিস – মালদহ

 

 

🍁আজকের চিঠি/২ 

 

 

ডাক্তার শ্রীমতী সেঁজুতি… 

হাডকো,

উল্টোডাঙ্গা

কলকাতা।

মাননীয়া মহাশয়া, 

সালটা বোধ-হয় দু’হাজার আট বা নয়। এক শীতের রাত। আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মিনিট পনেরোর জন্য। দেখা বলতে যা বোঝায় ঠিক তা নয়। উপস্থিতিটুকুই টের পেয়েছিলাম। শুনেছিলাম কন্ঠস্বর। ঐদিনের কথা মনে পড়লে এখনো ভীষণ অসহায় বোধ করি। যে ঘটনা নিয়ে এই চিঠি তার শেষটুকু বললে হয়তো মনে করতে পারবেন। কারণ সেটুকু ঐ পনেরো মিনিটের মধ্যেই ঘটেছিল। তার আগের কাহিনী বড্ড মর্মান্তিক। ও পীড়াদায়ক। সংক্ষেপে এখানে রাখছি।
১৯৮৪ সালে আমার মায়ের ব্লাড সুগার ধরা পড়ে। রিপোর্ট বলছিল রক্তে সুগার একেবারে থই থই। সেই থেকেই শুরু সুগার কে বাগে রাখার লড়াই। জারি ছিল ২০১২ র জুন মাসের ২০ পর্যন্ত। পুলিশের তাড়া খেয়ে চোর যেমন গা ঢাকা দেয় তেমনিভাবেই ওষুধ এবং নিয়ম কানুনের দাপটে সে সিঁটিয়ে থাকতো। একটু শিথিলতা পেলেই আবার যে কে সেই। আবার থই থই। ওষুধের ডোজ দুগুণ তিনগুণ হতো। এভাবেই চলছিল। একসময় ইনসুলিন স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেল।

 

 

দু-তিনবার সংকটজনক অবস্থায় হাসপাতালে থাকতেও হয়েছিলো। ধীরে ধীরে নানা প্রত্যঙ্গ বিদ্রোহী ও বিকল হতে লাগলো। একসময় কিডনি আর ঠিকঠাক কাজ করতে পারছিল না। নিয়মিত পিয়ারলেস হাসপাতালে চেক আপে যেতে হতো। তেমনি এক দিনের ঘটনা-
শীতকাল হলেও সেইদিন দুপুর থেকেই মেঘলা আকাশ। বিকেল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মাঝে মাঝেই জোরদার। বেশ কনকনে ঠান্ডা। অফিসে বলেকয়ে আগে আগে ফিরে মাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে পিয়ারলেস হাসপাতাল রওনা। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ছাড়া পেলাম সাড়ে ছ’টায়। তখন আমার স্মার্ট ফোন ছিল না। তাই ওলা বা উবের বুক করার প্রশ্ন ছিল না। ফেরার সময়ে প্রতিবারের মতো হাসপাতালের গেটে এসে অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষা করেও কোনো ট্যাক্সি পেলাম না। তখন মায়ের হাঁটুতে একেবারে জোর নেই। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না। রাস্তার আলো গুলো জ্বলে উঠেছে অনেকক্ষণ। চারদিক বেশ ফাঁকা। কী করা! ইতিমধ্যেই বৃষ্টি মায়ের শাড়ি আর আমার প্যান্ট অনেকটা ভিজিয়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে একটা রিক্সা পেলাম। পাশের ঝুপড়ির দোকানের চা-অলা, রিক্সা চালক আর আমি তিনজনে মিলে ঠেলে মাকে রিক্সায় উঠিয়ে হাইল্যান্ড পার্ক বাসস্টপে পৌঁছলাম। ট্যাক্সির আশায়।
অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। সঙ্গে প্রচন্ড হাওয়ার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। বাসস্টপের শেডের ভিতরে কোনো লোকজন নেই। তবে সব সিটগুলোয় কুকুর-বিড়ালের কুন্ডলী। তারা মাঝে মাঝে গাঝাড়া দিলেই নোংরা মাখা জল আমাদের গায়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে। খুঁজেপেতে চারটি ইঁট জোগাড় করে উপরে উপরে সাজিয়ে মাকে বসালাম।
ছাতা মাথায় বাই পাসের উপরে দাঁড়িয়ে ডান দিকে তাকিয়ে আছি তো আছি। দূরে যতবার দুটো আলোর চোখকে এগিয়ে আসতে দেখি ততবারই আশা যাগে। কাছে আসতেই – এ যে মরীচিকা। আবার দুটো জোরালো হেড লাইটের আলো দেখতে পেলাম। এবার নিশ্চয়ই হবে। এলো। একটা বড়ো প্রাইভেট বাস। নিউটাউনে যাবে। ছেড়ে দিলাম। শেডের পাশেই একটুকরো টিন খাটিয়ে যে ছেলেটা চা বিক্রি করছিল সে হেঁকে বলল – দাদা যাবেন কোথায়? আমরা যেখানে থাকি সেটা ও চিনবে না ভেবেই জানালাম – সামনেই যাবো। ও বলল- এবার যে গাড়িই পাবেন সেটাতেই যতটা পারেন এগিয়ে যান। ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না। বলতে বলতেই একটা সাদা রংয়ের মিনি বাস এলো। সম্ভবত পুলকার। হাত দেখাতেই থামলো। ফাঁকা। বহুকষ্টে মাকে নিয়ে উঠলাম।
ও সাইন্সসিটি থেকে বাঁদিকে যাবে। কন্ডাক্টরের হাতে একটা ৫০ টাকার নোট দিয়ে সাইন্সসিটি থেকে একটু এগিয়ে নামলাম। খানিকটা ভরসা পেলাম। এবারে নিশ্চয়ই ট্যাক্সি মিলবে। বেশ খানিকটা অপেক্ষাতেও কিচ্ছুটি পেলাম না। হুশহুশ করে প্রাইভেট গাড়ীগুলো ছুটে যাচ্ছে। তাদের টায়ার আর ভিজে রাস্তার জলের ঘর্ষণে চিডিক চিড়িক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। গাড়ির হেড লাইটের আলোয় ভিজে রাস্তায় সার সার আলোর রেখা ছাড়া কোনো জনমানব নেই। সিগনালে কখনো লাল বাতির নিষেধ চোখে পড়লো না। রাস্তার পাশের ফলের দোকানে, বলেকয়ে একটা টুলে, মাকে বসালাম। মাথায় ছাতা থাকলেও পাগল করা হাওয়ার দাপটে তা বাগে রাখা যাচ্ছিল না। এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরাই কিন্তু কোথাও কোনো উপায় দেখতে না পাই।
আকাশে আরো মেঘ জমছে। মনে জমছে গভীর আশঙ্কা। চারদিকে যতদূর ঘাড় ঘোরাই আকাশ মুখী সব বাড়িগুলোয় প্রতিদিনের মতো লেপ্টে আছে আলোর রোশনাই। বৃষ্টির জলে নানা রংয়ের আলো যেন গলে গলে পড়ছে। এ কোন তিলোত্তমা!! এতো বছরের আমার নিত্য যাতায়াত। কিন্তু এ রকম কখনো দেখিনি। কোনোরকমে পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখি রাত সাড়ে আটটা। বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল। পিছন ফিরে মা’কে দেখলাম। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ। ঘাড় ঘুরিয়ে নিলাম। তখনই একটা পুলিশ ভ্যান এসে থামলো। সাদা পোশাকের একজন ট্রাফিক পুলিশ কে নামিয়ে দিয়েই নিমেষে মিলিয়ে গেল। পায়ে গামবুট। এইয়া বড় একটা ছাতা মাথায় চাপিয়ে রাস্তার অন্যপ্রান্তে হাঁটা শুরু করেছেন। কাছে গিয়ে প্রয়োজনটুকু বললাম। ধৈর্য্যধরে শুনেই খানিকটা ধমকের সুরেই বললেন – আজ বেরিয়েছেন কেন! জানেননা আজ স্টেডিয়ামে এ.আর.রহমানের প্রোগ্রাম। কিচ্ছু পাবেননা। আমি মাকে রাস্তাটা পার করে দিচ্ছি। যতটা সম্ভব এগিয়ে যান।
বাঁহাত উঁচু করে গাড়ি গুলো দাঁড় করিয়ে ডানহাতে মা’র বাঁহাত ধরলেন। মা’র অন্যহাত আমার বাঁহাতে। প্রায় পাঁজা কোলে রাস্তা পার করা গেল। উনি আবারও বললেন – যতটা পারেন এগিয়ে যান। বৃষ্টির তেজ তখন একটু কমেছে ঠিকই। কিন্তু আকাশে ক্ষণেক্ষণে জ্বলে উঠছে আঁকাবাঁকা, শাখাপ্রশাখা ছড়ানো বিদ্যুতের ঝলকানি। সঙ্গে মেঘের তুমুল তর্জনগর্জন।

সাকুল্যে ফুট দশেক হাঁটার পর আর চলছে না মা’র পা। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। যা হয় হোক, বেপরোয়া হয়েই পাশে পড়েথাকা একটা গাছের গুড়ির উপর বসিয়ে দিলাম। কিচ্ছু মাথায় আসছেনা। গাড়িঘোড়ার সংখ্যা আরো কমে আসছে। মিনিট দশেক পরে বললাম – এবার চলো। আর একটুখানি এগোলেই ঠিক ট্যাক্সি পেয়ে যাবো। শামুকের গতিতে আবার হাঁটছি।
মায়ের কাঁপুনি তে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। সামনে থেকে ধেয়ে আসা গাড়ির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। পিছন থেকে আসা গাড়ির আলোয় সামনেটা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎই যেন মনে হল – পিছন থেকে আসা দুটো আলো একসঙ্গে নিভছে জ্বলছে। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের গা ঘেঁষে একটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ির আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই।কিছু বুঝে ওঠবার আগেই আপনি দরজা খুলে নেমে মা’র হাত ধরে খুব সাবধানে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন। আমাকে সামনে বসতে বললেন। গাড়ি ছুটলো। ভিতর থেকে একজন বয়স্কা মহিলা মৃদুস্বরে বললেন – সেঁজুতি টিঙ্কিকে কোলে নিলে উনি একটু ভালো ভাবে বসতে পারবেন। তাই হলো। তোয়ালে দিয়ে মা’র মাথা মুছিয়ে জল বিস্কুট খাইয়ে দিলেন। জেনে নিলেন আমরা কোথায় যাবো। তারপর জানালেন আপনারা উল্টোডাঙ্গায় হাডকোতে নেমে যাবেন। ড্রাইভার আমাদের পৌঁছে দেবে। আমি বলেছিলাম সামনে কোথাও ট্যাক্সি পেলে সেখানে নামিয়ে দিলেই হবে।
কথা প্রসঙ্গে জেনেছিলাম আপনি নিজে একজন ডাক্তার। আপনার শাশুড়িমা ও মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। চিংড়িঘাটার মোড়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামাতে বললাম। মাকে নামতে না দিয়ে আমাকে দেখে আসতে বললেন। ছুটে গেলাম। ট্যাক্সি রাজি। মাকে নামিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়ার আগে মাকে প্রণাম করে বললেন – মাসীমা সাবধানে থাকবেন। ট্যাক্সি স্টার্ট দিল। আপনি আস্তে আস্তে হাত নাড়তে থাকলেন। এগিয়ে চললাম আমরা।
খানিকটা সময় পার হলে, পরিস্থিতির বিহ্বলতা কিছুটা কাটতেই নিজেকে বললাম – কি অকৃতজ্ঞতা অভদ্রতার কাজ করলাম। একটিবারের জন্যও ওদের কৃতজ্ঞতা জানালাম না। ফোন নং বা বাড়ির ঠিকানাও জানতে চাইলাম না। বাড়ি পৌঁছে খবরটা জানাবার কোনো উপায় রইলো না।

মা মারা গেছেন বারো বছর হলো। কিন্তু এই ঘটনা আমাকে মাঝে মাঝেই পীড়িত করে, আঘাত করে। ধিক্কার দিই নিজেকে। এই চূড়ান্ত অভদ্রতা অসভ্যতা কে আমি আজও ক্ষমা করতে পারিনি। শুনেছি সোশাল মিডিয়ার সাহায্যে অনেক সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে অনেক যোগাযোগ ঘটে যায়। সেই আশা নিয়েই এই খোলা চিঠি। মাননীয়া, যদি কোনো ভাবে এই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছায় এবং ঐদিনের ঘটনা মনে করতে পারেন তবে একটিবার নিচে দেওয়া নম্বরে ফোন করবার অনুরোধ রাখছি। ভাল থাকবেন।

কৃতজ্ঞতা সহ,
-তাপস বসু

যোগাযোগ : 8240461650

 

 

 

 

🍂আজকের চিঠি/

 

 

দেয়াসিনি,
তোমাকে চিঠি লিখি না অনেকদিন হল,
আসলে যেখানে এখন থাকি সেখান থেকে ডাকঘর অনেক দূরে। গল্পের মত মনে হলেও গোটা একটা পাহাড় পেরোতে হয় চিঠি ফেলতে গেলে। একদিন রাতভোরে উঠে হাতের কাজ শেষ করে, কাজে না গিয়ে তোমার জন্য লেখা চিঠি ডাকে ফেলতে যাই। অন্য কাউকে দিয়ে যে কাজটা করানো যায় না তা নয়, কিন্তু এই কাজটা নিজে করতে ভালো লাগে। ওইদিন যাত্রাপথের পুরোটা জুড়ে তুমি আমার সঙ্গে থাকো। কত গল্প করি তোমার সাথে। সেখানে তোমার সংসার, তোমার সমাজ স্বীকৃত আপনজনেরা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না একটুও।

 

 

 

 

জানো, আজ এখানে বসে বেশ দেখতে পাচ্ছি, দুপুরে পিয়ন চিঠি দিয়ে যাওয়ার পর , সব কাজ সেরে তুমি পড়তে বসেছো। তোমার পাটভাঙা শাড়িতে চন্দনের গন্ধ। খাম খুলতে গিয়ে তোমার মুখ যেন আলো হয়ে উঠল ..নাকি কনে দেখা আলো এসে পড়ল তোমার মুখপদ্মের উপর.. জানা নেই। যেটা জানা আছে তা হল, চিঠি পেয়ে তুমি প্রথমে মনে মনে খুব হাসবে, এই দুরন্ত গতির জমানায় আমি এখনও চিঠির উপরই ভরসা করি বলে..। আমি আসলে মনে করি, ইচ্ছে করলেই যেখানে কথা বলা যায়, সেখানে তা যেন শুধুই শব্দ হয়ে থাকে। শুধুই শব্দ বড়ই পীড়াদায়ক। সেজন্যই নৈঃশব্দ্যকেই মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম করে ফেলি প্রায়ই। জানি তুমি অনেকদিন কোনো খবর না পেয়ে অভিমান করো আমার উপর। আমি তোমার অভিমান বুঝি, আর এও জানি তুমি আমার এই ভাব বুঝবে। তুমি বোঝো বলেই হয়ত আরও বোঝার দায় চাপাই তোমার উপর। যাইহোক, আর পোস্টঅফিসকে ডাকঘর কেন বললাম জানো..? তোমাকে ছেড়ে সারাজীবনের পরবাসে থাকতে থাকতে নিজেকে অমলের মতন মনে হয়। অসুস্থ। যেন আর কোনোদিন পথে পথে হেঁটে তোমার শামলী গাঁয়ে পৌঁছতেই পারব না।

মাঝে মাঝে ভাবি, তোমার সাথে কাটানো মহূর্তগুলো এই জন্মেরই তো..? নাকি আমাদের দেখা হয়েছিল কোনো গন্ধর্বলোকে.. সে যেন কোন জন্মের কথা…! আচ্ছা, থাক বরং এসব প্রলাপ। যার জন্য তোমাকে এই অসময়ে চিঠি লিখতে ইচ্ছে করল তা বলি। এখন এখানে বর্ষা নামছে। একদম ঘনঘোর বর্ষা। জানো, পাহাড়ের ওপার থেকে যখন মেঘ ভেসে আসে তখন তার কালো মন্থর গতি তোমার চিলেকোঠার ঘরে বসে সেতারে মেঘমল্লার রাগ বাজানোর কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই ভরদুপুরে সুরের স্বর্গ যেন নেমে এসেছিল সেই ঘরে। বাইরের অন্ধকার হয়ে আসা আলো, প্রবল বর্ষণ আর তোমার সেতার সব মিলিয়ে আমাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল। সেই যে সুরের বাঁধনে বাঁধলে সেই বাঁধন থেকেই গেল জীবনভর।

এখানকার বৃষ্টি বড়ই তীব্র। আমার ছোট্ট ঘরের টিনের চালে সে যখন আছড়ে পড়ে আর সারারাত তার নূপুরের শব্দে কান প্রায় বধির করে দেয়, তখনই চোখে ঘুম নামে। ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে আমি ওই নূপুরের রুনঝুন আর বৃষ্টিতে ভেজা বনজ গন্ধের মধ্যে তোমাকে খুঁজে পাই। আর পরের দিনের মেঘ কেটে যাওয়া ঝলমলে আকাশ তোমার অমলিন হাসির কথা মনে পড়ায়। ভালো থেকো দেয়াসিনি। তোমার ভালো থাকাই আমার একমাত্র কাম্য। তোমারও যে তাই, তা আমার অজানা নেই। আর দুজনেই তো জানি আমাদের লক্ষ-কোটি বছর দেখা হবে না এবং দুজনে এও জানি আমাদের মতো বিরহীযুগলের জন্য মেঘ দূত হয় প্রতিবার। তাই লেখা চিঠি কিছুদিন পরে পৌঁছবে বলে, আগেই তোমার শহরে আমার পাহাড়ের মেঘ পাঠালাম। উত্তর দিও, অপেক্ষা থাকবে।
ইতি,
তোমারই বিরহী যক্ষ

 

 

 

 

🍂আকের চিঠি/৪

 

মা’ তোমাকে,
চিঠি লেখা কাকে বলে আমরা এ যুগের ছেলেমেয়েরা তা জানি না। আমরা ই মেইল,হোয়াটস্অ্যাপ,মেসেঞ্জারে কথা বলি। তাই বোধহয়, সংক্ষেপে কথা সারতে সারতে আমরা জানিই না মনের জমিতে অনবরত যে কথার চাষ হতে থাকে, সেটা উর্বর জমি ছাড়া ফলে না। সেই জমি হোল চিঠি।
বিঘার পর বিঘা জমিতে চাষী যেমন ফসলের বীজ বপন করে, লাঙল চালায়,সার দেয়,জল দেয়… তবে গিয়ে ফসল ফলে; তেমনি কাগজের পৃষ্ঠার পাতা ভরাট না হলে, মনের হিজিবিজি ভাবনার প্রকাশ না ঘটালে, চোখের জল পড়ে লেখার কালি ধেবড়ে না গেলেও কি কেউ কাউকে পুরো বুঝতে পারি! না, নিজেকে বোঝাতে পারি?

 

 

 

 

তোমাকে বুঝতেও কোনোদিন হয়ত পারি নি। তাই এ চিঠি… কিন্তু এটা কি তোমার কাছে পৌঁছবে? জানি, পৌঁছবে না। তবু মনকে আশ্বাস দিয়ে শান্ত করার প্রয়াস মাত্র।
মা, তুমি বলতে… দুঃখ তো সবারই থাকে। সে সাগরে পড়ে না কাতরে, তা সাঁতরাতে জানতে হয়। তোমার কথাগুলো তখন বুঝতাম না… এখন বুঝি ও তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি।
জীবন নামের লোকটা আমাকে কতবার যে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করতে চাইছে! পারছেই না… প্রতিবারই আমার প্রবল আত্মবিশ্বাসের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ছে।

আমাকে জানো তো, সুখে থাকতে ভুতে কিলিয়েছে! আমি না একটা ভেঞ্চার করে ফেলেছি। কী করেছি বলো তো! আমার ঘর সংসার ত্যাগ করে একটা এনজিও তে জয়েন করেছি। আমার কাজটা অবশ্য একটু আলাদা। আমি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মহিলাদের কাছে গিয়ে তাদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয় স্বজনের, বন্ধুবান্ধবদের কাছে তাদের হয়ে চিঠি লিখি।
সে চিঠিতে কিন্তু কোনো অর্থ সাহায্যের কথা লিখি না।
বরং লিখি… “আমার আজকের এই অবস্থার জন্য আমি বিশেষভাবে জীবনের কাছে ঋণী। কারণ, জীবনের আসল সময়টাই আমি ব্যয় করেছি পরের মঙ্গলের জন্যে। কখনো সন্তানের শিরদাঁড়া শক্ত করতে… তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে ; কখনো পরিবারের বাকি সদস্যদের শরীর, স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন রাখতে ; এই করতে গিয়ে আমি ভুলেই গেছিলাম আমার স্বতন্ত্র জীবনকে। আমার আমি কে। আমি ভুলেই গেছিলাম… আমার ভেতরে বধূসত্ত্বা,মাতৃসত্ত্বা ছাড়া আরেকটি সত্ত্বাও বেঁচে আছে। আমার নিজসত্ত্বা। যাকে আমরা কেউ দেখিই না। আসলে দেখার চেষ্টাই করি না।
সেটা যদি সময় থাকতে থাকতেই বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে হয়ত শেষ বয়সে ঘর থেকে বেঘরে যেতে হয় না। তবে, কখনও কখনও যে আপনার চাইতে পরই আপন হয়ে ওঠে… তা এখানে না এলে অজানাই থেকে যেত। আমরা এখানে মোট সাতাশ জন থাকি। হাসি,ঠাট্টা,মস্করা,ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটি মাখানো জীবনটা একদম আচারের মত চেটে চেটে উপভোগ করছি। পালা করে হাতবদল করে রান্না করি আমরা। যে যেটাতে পারদর্শী, সে সেই রান্নাটা করে খাওয়াই। ভালো লাগে যখন সবাই হাত চেটে খেতে খেতে রান্নার তারিফ করতে থাকে যা সংসারজীবনে কখনো কারোর মুখ থেকেই শুনি নি।
আমি খুব খুশী যে আজ আমি সংসার জীবন থেকে বাইরে। যদি না বাইরে বের হতাম, তাহলে আজও আমি সংসারের সেই মানুষগুলোকেই খুশী করার জন্য সারাটা সময় ধরেই সচেষ্ট থাকতাম যারা কেউ কখনোই আমার ছিল না।
তোমরা সবাই ই ভালো থেকো কেমন! আমিও খুব ভালো আছি।

তোমাদের…

এইরকম বয়ানের চিঠি আমি সবার হয়ে লিখি আর কাঁদি। কাঁদি আর প্রায়শ্চিত্ত করি। এই মানুষগুলোর মধ্যে দিয়েই তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেবার চেষ্টা করি।
আমায় ক্ষমা কোরো মা। বেঁচে থাকতে তোমাকে কোনোদিনও বুঝি নি। নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি। শুধু আফশোস থেকে গেল তোমাকে কোনোদিনও এই কথাগুলো বলতে পারলাম না সামনাসামনি। ভাসিয়ে দিলাম এই চিঠিটা কাগজের নৌকো বানিয়ে… এই ভবের বৈতরণী পার হয়ে জানি এই চিঠি কোনোদিনও তোমার কাছে পৌঁছবে না কোনো ডাকপিওনের হাত ধরে। ভালো থেকো মা যেখানেই থাকো।
প্রণাম নিও।
-তোমার মনি।

 

 

 

🍂আকের চিঠি/

 

 

প্রিয় তরী
কেমন আছ? হঠাৎ কেন চিঠিটা লিখতে শুরু করলাম জানি না। তবে মনের মনিকোঠায় পুরোনো স্মৃতিতে শুকনো গোলাপের কাঁটা যেন আমাকে রক্তাক্ত করছিলো আজ আর তাই.. না থাক অনেক কিছুই তো বলা যায় তবে আগডুম বাগডুম কথার জালে নাই বা জড়ালাম তোমায়। যে ভালোবাসার বন্ধনে তোমায় বেঁধে ছিলাম, সেই বাঁধন যে হাল্কা হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারিনি। যেমন ভাবে গাছের চারপাশের মাটিকে কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে দিলে গাছও বুঝতে পারে না সে কখন শিকড় আলগা হয়ে পড়ে যাবে। যেই অবস্থা এখন আমার হয়েছে।

 

 

 

কত স্বপ্ন আঁকা ছিলো তোমার সাথে, কাটিয়েছি কতগুলো বসন্ত। আজও বসন্ত আসে মনের বাগানে ফোটেনা আর শিমুল পলাশ। পিরিচে রাখা শুকিয়ে যাওয়া সাঁচিপান পাতার মতো বিবর্ণ হয়ে যায় মনের আঁতুরঘড়টা।
তোমায় দেখলাম গঙ্গার ধারে। কনে দেখা আলো পড়েছিলো তোমার মুখে, পাশে তোমার বর। মাথা ভর্তি সিঁদুর। হাতের পরে হাত রেখে নতুন জীবনের সুখালাপে ব্যস্ত ছিলে। আমাদের ফেলে আসা সেই দিনের কথাগুলো যেন জলছবি হয়ে আমার হৃদ্ মাঝারে ফুটে উঠছিল। তরী, আজ নিশ্চয়ই তুমি খুব সুখি। আমার মতো বাউন্ডুলে আজ আর বিরক্ত করে না তোমায়। জানো তরী, আমার মন খারাপের বিকেল কাটে ওই গঙ্গার পাড়ে, তোমার স্মৃতিকে ঘিরে। আজ তোমায় দেখার পর আমাকে অপদার্থ বলে বলে হচ্ছে, পেটে বিদ্যে পিঠে ডিগ্রি নিয়েও একটা চাকরি জোটাতে পারলাম না। যার ফল স্বরূপ আমার ভালোবাসাকে ধরে রাখতে পারলাম না। ব্যার্থ আমি এই জীবনে। তুমি বলেছিলে তোমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে। তুমি এ-ও বলেছিলে আমরা পালিয়ে বিয়ে করব। আমি বুকে
পাথর রেখে বলেছিলাম, না তোমাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করতে পারব না। আজ বলি কেন বলেছিলাম, আমার টিউশনির ওই কটা টাকায় সংসার পাতব তাতে তোমাকে কষ্ট করে চলতে হবে সেই কথা ভেবে পিছিয়ে গেছি। নিজের সাথে কত যুদ্ধ করেছি। একটাই উত্তর মনে এসেছে তোমাকে সুখি থাকতে দেখা যা আজ দেখলাম দূর থেকে সার্থক হলো আমার চোখ। ভালো থেকো তরী, খুব ভালো থেকো। আমি আছি নিবিড় রাতের নিরালা ব্যালকনিতে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে আর তোমার স্মৃতি নিয়ে।

ইতি,
তোমার বাউন্ডুলে

 

 

 

 

🍂আজকের চিঠি/৬ 

 

প্রিয়তমা ডলি, 
কতদিন হল কোনো চিঠি পত্র লেনদেন হয়নি।
ভীষণ ইচ্ছে গেল তোমাকে চিঠি লিখি। চিঠি লিখতে গিয়ে কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ লাগছে
সেই লুকিয়ে চিঠি লেখার প্রথম পরিচয়ের মতো। তখন এমন ভয় লাগতো পাছে ধরা পড়ে যাই।
আজ ও ঠিক সেই রকম অনুভব অনুভূত হচ্ছে।
আসলে অনভ্যাসের ফোঁটা যেমন কপালে চড়চড় করে তেমন আর কি।

 

 

আচ্ছা বলতো চিঠি ছাড়া এমন কী আছে যাতে মনের কথা এমন গোপনে অকপটে বলা যায়?
ফোন সে তো ফিসফিসিয়ে কথা বলা যায় না।
ভাবনার কুঁড়ি গুলো চিঠিতে এমন সুন্দর ফুটে ওঠে যেন মনে হয় প্রজাপতি হয়ে তোমার চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে আপন মনে। মনে হবে যেন পাশাপাশি বসে কানাকানি কথা বলছি।
তোমাকে দেখার ইচ্ছে হলে ভিডিও কল করা যেত ঠিকই কিন্তু সব কথা ভিডিওতে বলা যেত না সে তো তুমি জানতে।
যাক অনেক বাজে বকবক করলাম এবার কাজের কথায় আসি। তা তুমি এখন কি করছ?
সকালের জলখাবার খাওয়া হয়েছে তো?
নাকি এখনও সেই রকম সব কাজ সেরে জলখাবার খাও? তবে এখন তো আমি কাছে নেই যে আমার জন্য আলাদা কিছু করতে হবে।
ওখানে সবাই ভালো আছে তো? যেই তোমার বাবা এবং মা চলে গেলেন তুমি ও চলে গেলে হঠাৎ।
ভাবতে বেশ কষ্ট হয়। আমি কেমন আছি সেকথা আর বলতে ইচ্ছে করে না। তোমার মনে পড়ে
তুমি ব্যলকনিতে যে গাছগুলো টবে লাগিয়ে ছিলে যত্ন করে সেগুলো এখন এমন ডাগর ডুমুর হয়েছে, মনে হবে যেন পূর্ণ যুবতী নারীর মতো সুন্দরী হয়ে সেজে উঠেছে। সেই বেলফুল, চন্দ্র মল্লীকা, জিনিয়া এমনকি রডোডেনড্রন সব এমন ডানা মেলেছে দেখলে মনে আনন্দে ভরে যায় ঠিকই কিন্তু একটা ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ও বেরিয়ে আসে।
তোমার হাতে সাজানো ফ্ল্যাট এখনও তেমনই আছে। মনে পড়ে খুকু যাকে তুমি পাশের বাড়ি সর্বানীদির কাছ থেকে এনে আমাদের বাড়িতে কাজে লাগিয়ে ছিলে সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। তবে খুব যত্ন নিয়ে কাজ করে, ঘরবাড়ি একদম চকচকে করে রাখে ।
তোমাকে জানাই যে তুমি চলে যাওয়ার পর জিতেন বলে একটি ছেলেকে আমাদের পাশের গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছি। খুব ভালো। ভীষণ কেয়ারিং। ওই সব রান্নাবান্না করে। রোগজ্বালা হলে দেখাশোনা করে। ওর বাড়ির লোকেরাও বেশ ভালো। ও রোগের কথা উঠলো যখন বলেই ফেলি –আমার ভীষণ শরীর খারাপ হয়েছিল
প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি। তোমার সেজদির ছেলে ডাঃ অভিজিৎ না থাকলে আমি চলেই যেতাম।
সমস্ত ব্যবস্থা অভিজিৎ করেছিল। পনের দিন
নার্সিং হোমে ভর্তি ছিলাম। জিতেনও কম করেনি।
আমি হাঁটতে চলতে পারছিলাম না জিতেন হাত ধরে ধরে আমাকে বাচ্চাদের মতো হাঁটাতো।
ও! সে যে কী দিন গেল তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তোমাকে জানাইনি। তুমি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে। তুমি যে কী সে তো আমি জানি।
তুমি যাওয়ার পর তোমার ভাইবোনেরা কেউ আসেনি। এমনকি অমল সেও খুব একটা
আমল দেয় না! যাক ওসব ভেবে মন খারাপ করবে না কিন্তু। ভালো থেকো। সাবধানে থাকবে। সময় করে উত্তর দিও। জানিনা কবে তোমার সাথে আমার দেখা হবে? রাখলাম একবুক ভালবাসা।
ইতি তোমার-
২৬/০৫/২২ (সোহাগ)
দুর্গাদাস মিদ্যা

 

 

🍂আকের চিঠি/৭ 

 

 

অদিতি,

পড়ন্ত বিকেলের আলোটা আজ তোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ক্ষণিকে উজ্জ্বল, ক্ষণিকে ম্লান। যেই সূর্য মজা করে একটু মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে, বিকেল কেমন অস্থির হয়ে, মুখ শুকিয়ে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। তোর মনে আছে বোটানিকাল গার্ডেনে একবার আমি কেমন লুকিয়ে পড়েছিলাম? আর তুই ডেকে ডেকে অস্থির হয়ে প্রথমে নাকের পাটা ফোলালি, তারপর তোর কালো হরিণ চোখে ডেকে আনলি বান? আমি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে টোকা মারলাম তোর গালে। সেখানে তখন কুলকুল করে ঝর্ণা বইছে। আমাকে দেখেই মুহূর্তে অভিমান ভুলে রোদ ফুটে উঠল তোর মুখে। আজ ঠিক তেমন রোদ বিকেলের গায়ে।

 

 

 

ঠিক তেমন রোদ আমি আইজার মুখেও দেখি। দূর থেকে। মেঘলা মুখে এক চিলতে রোদ, “ওলা! কোমো ভাই ভোসে?” ব্যাস, আবার চোখে মেঘ নেমে আসে। সেই মেঘে লেখা থাকে এক দু:খগাথা। আমি সবটা পড়ে উঠতে পারি না, কিন্তু অনেকটা বুঝে নিই। আইজা পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে। ইংরাজি জানে না। ওর পাঁচ বছরের ছেলে স্কুল থেকে যেটুকু শিখে আসে সেটুকুও না। স্কুলবাস থেকে নেমেই যখন তীরের মতো ধেয়ে এসে এক লাফে মায়ের কোলে ঝুলে পড়ে তখন আইজা যেন এক প্রস্ফুটিত ফুল, এক আশ্রয়দায়ী বৃক্ষ। তখন কোথায় সেই মেঘ আর কোথায়ই বা সেই চিলতে রোদ! ছেলের নিবিড় আলিঙ্গনে নিজেকে জড়িয়ে পাশ দিয়ে যেতে যেতে আরেকবার বলে ‘ওলা’। আমিও স্মিতমুখে পুনরাবৃত্তি করি আর খুঁজি ওর খুশিতে উপছে পড়া চোখের মধ্যে কালো মেঘের টুকরোটা।

তুই ভাবছিস, আমি বড়োই স্যাডিস্টিক হয়ে উঠেছি। খুশির মাঝে দু:খ খুঁজে বেড়াই। তা নয় রে। বরং দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই একা থাকার অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবুক করে তুলেছে। জীবনের আর কোনো লক্ষ্য পূরণ বাকি নেই। কোনো কিছুকে সামনে রেখে এগিয়ে যাবার তাগিদ নেই। বরং একান্তে বসে নিজের সাথে সময় কাটাতে কাটাতে বুঝেছি সুখ বল বা দু:খ সবই ক্ষণিক। ঢেউয়ের মতো আসে যায়, আবার আসে। আসল হল এই বেঁচে থাকাটুকু। যত নিরুত্তাপ হয়ে বাঁচব তত বেশি চিনব জীবনকে, মৃত্যুকে – এই দুটোর চেয়ে অমোঘ সত্যি কী আর কিছু আছে! দিন দশেক আগে টমেটো বীজ পুতেছিলাম। আজ দেখলাম টবের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট কচি পাতা। মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টিসুখে মন উদ্বেলিত। তারপরেই ভাবলাম, আমি জন্ম দেবার কে? এই মাটি কী আমার? এই বীজ, আলো, হাওয়া, জল কিছুই তো আমি বানাইনি। আমি শুধু একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বীজ রেখেছি। নির্দিষ্ট সময়ে জল দিয়েছি। আর প্রকৃতির নিয়মে তারা জন্মেছে। আমি মালি মাত্র। কাল আমি না থাকলেও এই পাতাগুলো বড় হবে, ফুল দেবে, ফল দেবে, জন্ম দেবে নতুন গাছের হয়তো একাই, হয়তো অন্য কারুর হাত ধরে। আসলে আমিও তো মাটিরই একজন। একদিন ছাই হয়ে মিশে যাব মাটিতেই।

যখন দেশ ছেড়ে চলে আসছিলাম তুই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিলিস, “একদিন তোকে মাটির টানে ফিরতেই হবে!” হয়তো বলতে চেয়েছিলিস, “একদিন আমার টানে ফিরতে হবে।” বলতে পারিসনি। তখন দুটো টান বড় প্রবল ছিল। মাটির টান আর পেটের টান। এই স্কলারশিপটা নিলে বাড়ির ছাদটা সারানো যেত, বাবার ওষুধের আর সংসারের ডাল-ভাতের লড়াইটা বন্ধ হতো। তাই চলে আসতে হলো। তারপরের গল্পটা আর দশটা পাতি গল্পের মতো যা বহুবার লেখা হয়েছে, পড়া হয়েছে। জানিস অদিতি, প্রয়োজন কখনও শেষ হয় না। টালির ছাদ থেকে পাকা ছাদ, কুঁজো থেকে ফ্রিজ, পাখা থেকে এয়ারকন্ডিশন, ভাইপোর এডমিশন থেকে ভাগ্নীর বিয়ে এভাবেই তালিকা বাড়ে। এই দেশে এসে অনিকেত হয়ে উঠল একটা কল্পতরু কিংবা আলাদিনের জিন। আমি মানুষটা মাঝখানে কোথায় হারিয়ে গেলাম। ফিরে আসব বললে সবাই জিজ্ঞাসা করত ক’দিনের জন্য? ‘পাকাপাকি’ কথাটা বলতে ভয় পেতাম। কী জানি, এই যে এত গুরুত্ব, এত ভালোবাসা, এত যত্ন যদি নিমেষে উধাও হয়ে যায়? একেই কী মাটির টান বলে, অদিতি?

আসলে এই টান জিনিসটাই খুব গোলমেলে। যেন এক বন্ধনহীন গ্রন্থি। আমার পাশের বাড়িতে থাকেন এক বৃদ্ধা, তাঁর নাতির ডাউন সিনড্রোম। ছেলেটি পঁচিশ ছাব্বিশ বছর তো হবেই, তার বেশিও হতে পারে। সব কাজ যে নিজে করতে পারে তা নয়। দু’ পা চলতে না চলতেই বসে পড়ে, আবার ওঠে, আবার হাঁটে। কাছেই সব্জির মার্কেট। এলিস বিয়ান্দ্রোকে স্বাবলম্বী হতে শেখাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আমার বারান্দার সামনে এসে জড়ানো গলায় বলে “ডু ইউ হ্যাভ টেন বাকস?” কখনও দিই, কখনও দিই না। এলিসই বলেছেন সবসময় না দিতে। অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাবে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি, “হোয়্যাট উইল ইউ ডু উইথ টেন বাকস?” ও বলে খাবার কিনবে এমার জন্য। এমা ওর পোষা কুকুর, ওর একমাত্র বন্ধু। এলিস বলেছেন এমার দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে। রোজগারের চেষ্টা করতে হবে। বিয়ান্দ্রো কখনও কারুর গাড়ি মোছার চেষ্টা করে, কখনও গ্রসারি শপের কার্টগুলোকে সামলে কিছু টাকা পায়। হাত খালি থাকলে আমার কাছে আসে। এও এক প্রকার অচেনা টান। তার নিজের পরণের জামাকাপড় যে সবসময় ঠিকঠাক নেই, সে খেয়াল যে রাখতে পারে না সে এমার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। কোভিড যখন বাড়াবাড়ি রকমের থাবা বসাচ্ছিল বয়স্কদের উপর, এলিস খুব ভেঙে পড়েছিলেন। বলতেন, আমার পরে বিয়ান্দ্রোর কী হবে! অথচ এলিসের কন্যা আর প্রাক্তন জামাতা যে যার মতো সংসারী। সেখানে বিয়ান্দ্রো ব্রাত্য! ‘টান’ বড়োই আজব একটা শব্দ, তাই না?

গ্রীষ্মে আমেরিকার বিকেলগুলো খুব সুন্দর। প্রায় সাড়ে আটটা অবধি বিলম্বিত লয়ে রোদ পড়তে পড়তে সন্ধে নামে। মৃদু হাওয়ায়, অল্প তাপে আরাম কেদারায় গা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে বিশেষ আর কিছু করার থাকে না। সময় দিব্যি রূপকথার ডাইনিবুড়ির মতো সুতো ছাড়তে থাকে আর নিয়ম মাফিক কাজ করে চলে আশেপাশের মানুষজন। বাস থেকে নেমেই বাচ্চারা হই হই করে খেলায় মেতে ওঠে সবুজ ঘাসে। আইজার মতো মায়েরা মিষ্টি মধুর বকুনি দিতে দিতে একাধারে বাড়ি যাবার তাড়া এবং আরেকটু খেলার প্রশ্রয়, দুটোই দেয়। কেউ পোষ্য নিয়ে হাঁটতে বেরোয় তো কেউ সেকেন্ড শিফটের কাজের জন্য গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কর্মব্যস্ততা যেটুকু দেখতে পাই তা এই বিকেলেই। সকালে তো আর এখানে এসে বসতে পারি না। বাড়ি যতই ছোট হোক, নির্জন হোক তারও কিছু যত্ন লাগে, যত্ন লাগে গাছগুলোর। তাই বিকেলটুকুকে আমার আলস্যের ভাগীদার করে রেখেছি। স্থবির হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া বেশি কিছু করতে ইচ্ছে করে না।

কখনও কখনও সন্ধে গড়িয়ে কখন রাত নামে বুঝতে পারি না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় কেটে যায়। এই একই আকাশ তোর মাথার উপরেও আছে। শুধু সেখানে তারার জায়গায় এখন প্রখর রোদ। ভাগ্যিস এই আকাশকে আমরা ছুঁতে পারি না। নইলে মাটির মতোই ফালাফালা করে ভাগ করে ফেলতাম। বলতাম এই দাগ থেকে ওই দাগ অবধি আমার জায়গা। জানি, আকাশ-সীমাও আছে। আর তা লঙ্ঘন করলে আছে মিসাইলও। তবু যা সচরাচর চোখে দেখা যায় না তা আমার মতো সাধারণ মানুষ মাঝে মাঝে নেই বলে ধরে নিয়ে আনন্দ পায়। যেমন আমি ভাবি, আমি আর তুই এক আকাশের নীচে আছি। যেমন গঙ্গার পাড়ে বসে আমরা সূর্যাস্তের দোল খেলা দেখতাম, এখানেও বারান্দা থেকে লেকের ওপর দেখি মেঘের সেই রঙ। কিন্তু কিছুতেই ভাবতে পারি না আমি আর তুই একই মাটির উপর হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি। ভাবনাতেও যোজন দূরত্ব অজান্তেই তৈরি হয়ে যায়। এদেশের মানুষের কাছে এদেশের মাটি প্রিয়। ওদেশের মানুষের কাছে ওই সীমারেখার মধ্যে যে মাটি সেই হলো মা। আচ্ছা, মাকে কী সত্যিই ভাগ করা যায়? তবু করব। ‘আমার আমার’ বলে বেড়া দিয়ে আগলে রাখব। রক্ষা করার চেষ্টা করব তাকে, যার বুক নিংড়ে নিরন্তর বেড়ে ওঠা ফসলেই গোটা দুনিয়া বেঁচে আছে।

এ বিভেদ কখনও যাবার নয় রে অদিতি। মাটি থেকে শুরু করে জল, জাতি-ধর্ম থেকে শুরু করে চামড়ার রং এমনকি ভাষা পর্যন্ত – সব কিছুতেই বিভেদ আর হিংসা। আমরা শুধু ভেবেই যাব, মনে মনে খুব চাইব সব ঠিক হয়ে যাক, পৃথিবী শান্তিময় হোক। পরেরদিন সকালে রক্তাক্ত খবর শুনে আবারও শুরু করব নতুন দিন। তবু এই ভাবনাটুকু আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকুক। একটা প্রদীপ গোটা একটা বাড়িকে আলোকিত করতে পারেনা ঠিকই, তবে প্রতি উঠোনে যদি শুভ চিন্তার দীপালিকা জ্বলে তাহলে একদিন হিংসে করার মতো, বিভেদ সৃষ্টি করার মতো অন্ধকার মন আর বেড়ে উঠতে পারবে না, এমন আশা রাখা কী অন্যায়?

বেলা পড়ে এলো রে। কম আলোয় আজকাল লিখতে কষ্ট হয়। আবার বারান্দায় বাতি জ্বাললে মৌতাতটা কেটে যায়। কাগজ কলমের পর্ব হয়তো এখানেই শেষ করতে হবে, তবে তোর সাথে কথা বলাটা আজ আর বন্ধ হবে না। তোকে তো জিজ্ঞাসাই করা হলো না যে কেমন আছিস? এমন সময় খোয়াইয়ের ধারে বসে যেমন বলতাম “একটা গান শোনাবি?” এখনও তেমন বলতে ইচ্ছে করছে। মানুষ এত উন্নতি করেছে যে চাইলেই মোবাইলের বোতাম টিপে গান রেকর্ড করে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে নিমেষে পাঠিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তোর জবাবী চিঠিতে সুছাঁদ অক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে তোর মিষ্টি কণ্ঠটাও যে ভেসে আসবে – সেটা আর ইহ জীবনে দেখে যেতে পারব বলে মনে হয় না। সেই আবিষ্কার যদি ভুল করে হয়েও যায়, ততদিনে হয়তো ‘চিঠি’ বলে বস্তুটাই একটা অবলুপ্ত ইতিহাস হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো তোর আমার এই চিঠিগুলোই হবে পৃথিবীর অন্তিমতম চিঠি! এরপর হয়তো কেউ আর কোনোদিন কাউকে চিঠি লিখবে না! এভাবেই আমরা একসাথে কোথাও না কোথাও অমর হয়ে থেকে যাব, কী বলিস?

আদর নিস,
অনিকেত

 

 

🍂আকের চিঠি/৮

 

 

মা তোমাকে,
চিঠি লেখার সুযোগ পেতেই মনে হলো দুঃসংবাদের খবরটা মা তোমায় জানাই। আমার হৃৎপিন্ডের গভীরে, অদৃশ্য ভালোবাসার একটাই নাম ভোলু। সবথেকে আপন ও প্রিয় সারমেয়। যাকে ছাড়া মনে হয় আমি অসম্পূর্ণ। গত (৬.৫.২২)তারিখ মাত্র কয়েক দিনের অসুস্থতায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। কোনো চিকিৎসাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগেনি। একসঙ্গে থাকতে থাকতে, কখন যে ভোলুর মা হয়ে উঠেছিলাম বুঝতেই পারিনি। ওর ভাষা, আনন্দ, রাগ, মান অভিমান সবটা বুঝে নিয়ে বুকে আগলে বড় করেছি তিলে তিলে।

 

 

বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে লোম, প্রত্যেকটা জিনিসে ভোলুর ছোঁয়া অনুভব করি। গায়ের গন্ধ ভেসে আসে। মাঝে মাঝে মনে হয় ও বুঝি সঙ্গেই আছে। রান্নাঘরে গরম ভাতের হাঁড়ি নামালেই আঁচল ধরে টানাটানি শুরুকরে দিত। পাখার হাওয়াতে ঠান্ডা করে সবার আগে ওকে খেতে দিতে হবে। এটা ছিল নিত্য কাজ আমার।মা তুমি জানোনা! আজও একইভাবে গরম হাঁড়ি নামিয়ে রাখি ।শুধু হাওয়ায় ছড়ায় না ভাতের ঘ্রাণ। ওর খাবার জলের বাটিটা, আমার চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় এখন। চব্বিশ ঘণ্টা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো সঙ্গীকে ভুলে থাকা খুব সহজ কাজ না। ভালোবাসা মায়ার বন্ধনে বেঁধে রেখেছিল চোদ্দ বছর। আর কোনদিন ঘেউ ঘেউ করে ঝাঁপিয়ে পড়বে না কোলের উপরে।
উঠোনের ঈশান কোণের দিকটা ছিল ভোলুর খুব প্রিয়। লুকিয়ে থাকতো খেলার ছলে। ওইখানেই মাটির তলায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এখন সে। সমাধিতে রোজ ছড়িয়ে দিয়ে আসি পছন্দের notix পাউডার। গায়ে মাখতে খুব ভালোবাসতো যে‌! শোক ভুলে থাকার জন্য খুঁজে চলেছি সময় কাটানোর নানান ছুতো। স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকার লড়াই চলছে প্রত্যেক মুহূর্তে আমাদের। কঠিন বাস্তবের কাছে হার মানতে বাধ্য আমরা সকলেই। জানি সময় মনকে অনেকটা প্রলেপ দেবে। তবে পুরোটা কোনোদিন সম্ভব হবে না।পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে আবার দেখা হবে আমাদের। ভোলুর আত্মার শান্তি কামনা করি।

ইতি
জুলি

 

 

 

 

🍂কের চিঠি/৯  

 

 

 

চিঠি 

মমতা রায়চৌধুরী 

 

 

১৩.৭.২৪ রাত্রি ২৩.৩৮

 

প্রিয়,
শিমুল,
আজ বসন্ত নয় তবুও কেন জানি না শ্রাবণের এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় তোমাকে বড্ড মনে পড়ছে। কেন মনে পড়ছে? তোমার কি মনে আছে? আমি তো কিছুতেই ভুলতে পারি না অথচ তুমি কি সুন্দর ,সুন্দর মুহূর্তটাকে ভুলে দিব্যি আছো সংসারের যাবতীয় সুখশান্তি তোমার হৃদয় আসনে বিরাজ করুক এটা আমি সবসময়ই চাই কিন্তু বড্ড জানতে ইচ্ছে করে তুমি কি সত্যিই ভালো আছো ?এই এত ঐশ্বর্য গাড়ি-বাড়ি পার্টি সবকিছু মিলে ,নাকি রাতের অন্ধকারে যখন তুমি গালের ফাউন্ডেশন মুছে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়াও তখন একবারের জন্যও তোমার মনে পড়ে?

 

 

 

 

জানিনা। জানতে চাই ও না সেটা সম্পূর্ণ তোমার নিজস্ব কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতেই হবে কোনদিন যদি তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি তোমাকে ওই প্রশ্নটাই করতে চাই ।আর যদি দেখা নাও হয় তোমার বিবেককে প্রশ্ন ক’রো বসন্তের রক্তিম ফাগুনের বিকেলে সূর্য ঢলে পড়েছে সমুদ্রের ঠিক কিনারে তুমি আমি বসে আছি সমুদ্রের ধারে। দুজনেই সমুদ্রের ঢেউ গুনছিলাম বোধহয় মনের ভেতরেও দুজনের ঢেউ গুলো ক্রমশই উত্তাল হয়ে উঠছিল কেমন যেন একটা ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছিলাম কিন্তু সেই দুর্যোগ যে অত সুন্দর একটা সুন্দর মুহূর্ত সারা জীবন স্মরণীয় করে রাখবে ,সেটা আমি কল্পনাতেও আনতে পারিনি। মনে পড়ে প্রথম আমাদের কলেজ থেকে পালিয়ে, ঠিক পালিয়ে বলবো না। বেরিয়ে পড়েছিলাম কলেজের
এক্সকারশন এর নাম করে ফিরে আসার কথা ছিল কিন্তু ফিরতে পারিনি হয়তো দুর্যোগের সেই রাতটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল একটা সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেবে বলে। দুটো উপোসী হৃদয়। সমুদ্রের ঢেউ গুনতে গুনতে কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছিল উপকূলবর্তী এলাকায় সতর্কতা জারি হল। আর এখানে বসে থাকা যাবে না শীঘ্রই যে যার নিরাপত্তা ঘেরাটোপে পৌঁছে যেতে হবে। একদিকে বাড়ি ফিরতে না পারার ভয় অন্যদিকে দুর্যোগ দুটোই যেন কেমন অনিশ্চিত দিক নির্দেশ করছিল ।অগত্যা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হল হোটেলে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির ছাট জানালা দিয়ে এসে পড়ছে তুমি আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কেমন যেন একটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ তুমি হঠাৎ করে এসে হাতটা আমার ধরলে আমার ভেতরে কেমন একটা শিহরণ খেলে গেল বুঝতেই পারলাম না কি করব ।হঠাৎ করে তুমি আমার আরো কাছে চলে আসলে ঠিক বুকের কাছে আমি তখনও বুঝে উঠতে পারছি না আমি কি করবো আমার কি করনীয় কিন্তু হৃদয়ে তখন তুমুল ঝড় ।মনে হচ্ছিল সব ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে । ফাগুনের সেই সন্ধ্যার মুহূর্ত যেন মনে হচ্ছিল শ্রাবণের বৃষ্টি ভেজা কদমফুল তোমার সুঘ্রান নিতে বড্ড ইচ্ছে করছিল কিন্তু ভেতর থেকে কেমন যেন একটা বিবেক সত্তা কাজ করছিল নানা এটা করা ঠিক হবে না সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে জয় হল আমাদের ভালোবাসার ।প্রথম অনুভূতি ,প্রথম ছোঁয়া প্রথম কাছে আসা এ যে কি অনাবিল আনন্দের তা প্রকাশ করতে পারবো না।
ফাগুনি উপোসী দুটি হৃদয় বড্ড রঙিন হতে চাইছিল দুজনেই ভেসে গেছিলাম এক অনাবিল আনন্দে ।বাঁধভাঙ্গা সেই আনন্দ ,নিজেদেরকে ঠিক রাখতে পারিনি।
তারপর সারারাত চলেছিল আমাদের গল্প আর ভালোবাসা। মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তগুলো যদি আর ফিরে না আসে, কেন যে একটা আশঙ্কায় ভুগছিলাম জানিনা।
তারপর তো সব ইতিহাস সেই ইতিহাসের সাক্ষী আমাদের দুজনের প্রথম অংকুর যখন তুমি জানলে তোমার ভেতরে সেই সৃষ্টি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে তারপরে নিলে তুমি বড় পদক্ষেপ তুমি সেই গাছটিকে উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলে।আমি তার ঘোরোতর বিরোধী ছিলাম। তারপর একদিন তুমি আমাকে ফোনে জানালে তোমার পক্ষে আর ক্যারি করা সম্ভব নয়।আমার কাছে আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল মুষড়েপড়েছিলাম।
তারপর আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো ।পরে শুনেছিলাম তোমার খুব বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে আমি মনে মনে খুশি হয়েছিলাম যে তুমি উপযুক্ত পাত্র পেয়েছো। কারণ আমি তখনো সেভাবে এস্টাবলিস্ট হতে পারিনি। তুমি রাজরানী হয়েই থাকো কিন্তু আমাদের সেই মুহূর্তটাকে নিয়ে কেন তুমি ছেলে খেলা করেছিলে তার উত্তর তোমাকে দিতেই হবে।
ভালো থেকো। চিরদিন এই কামনা করেই এসেছি। ভালোবাসা নিও কথাটা বলতে পারলাম না। কারণ তুমি তাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গেছো। হ্যাঁ তোমার ঠিকানাটা আমাকে অনিন্দ্য দিয়েছিল এজন্য আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তাই এই পত্রলেখা।
ইতি
পলাশ।

 

প্রাপক : 

শিমুল মুখোপাধ্যায়
প্রযত্নে : শিব শংকর মুখোপাধ্যায়
কলকাতা ৭০০০২৩

 

 

 

🍂কেচিঠি/১০  

 

 

চিঠি

রবীন বসু

 

 

 

 

প্রিয় বাবা,

কতদিন পর তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি, আজ আর ঠিক মনে করতে পারছি না। ছোটবেলায় খুব দুষ্টু আর দুরন্ত ছিলুম। আজ একে মারছি তো কাল নিজেই চুরি করে কুল পাড়তে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে পিঠ রক্তাক্ত করছি। কখনো বা টার্গেট প্র্যাকটিস করতে গিয়ে নিরীহ ছাগলের পা ভেঙেছি। ডিঙি নৌকো নিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ে পিয়ালি নদীতে ডুবে গেছি। প্রতিদিন কেউ না কেউ তোমার কাছে এসে আমার নামে নালিশ জানাত। তুমি বিরক্ত হয়ে আমাকে আবাসিক মিশন স্কুলের পাঠিয়ে দিলে। মা কেঁদে আকুল। বুকের ধন মেজো ছেলেকে কিছুতেই অত দূরে পাঠাবে না। তবু তুমি নিজের সিদ্ধান্তে ছিলে অটল। তবে বার বার করে বলে এলে যেন নিয়মিত চিঠি লিখি। চেনা পরিবেশ, পরিজন, বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা হয়ে পড়ার ধাক্কাটা সামলে কিছুদিন পর পোস্টকার্ডে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখি। লেখার সময় তোমার প্রতি অভিমানে চোখ ভিজে যাচ্ছিল। কিন্তু লেখা শেষ হতে অভিমান আর থাকল না। কেননা, চিঠি কেমন করে লিখতে হয়, তা তুমিই আমাকে শিখিয়েছিলে। আজ তুমি নেই। মাও নেই। আমিও আর আমাদের জন্মগ্রামে নেই। তুমি পুরো কার্তিক মাস জুড়ে উঠোনে আমাকে বসিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়াতে। পাশে বাঁশের মাথায় আকাশ প্রদীপ জ্বলত। গ্রামের লোকেরা সে পাঠ শুনতে আসত। উচ্চারণ ভুল হলে তুমি সংশোধন করে দিতে। শক্ত কোন কথার অর্থ বলে দিতে। আমার সেই ছোটবেলার জীবন্ত হিরো ছিলে তুমি। আমার আইডল। কথা বলার মধ্যে তুমি খুব প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহার করতে। এখন লিখতে গেলে ব্যবহার করি। তুমি চেয়েছিলে ছেলে বড় অফিসার হোক। হতে পারিনি। কিন্তু তোমার কোন ক্ষোভ ছিল না। বরং উল্টে কলেজে পড়ার সময় যখন সরকারি বড় কাগজে আমার লেখা প্রকাশিত হল, তুমি বাড়ি ফিরে বললে, “আমার সিনিয়ার অফিসার সবাইয়ের সামনে কী বলল জানিস? বলল, প্রমথ, তোমার মেজো ছেলের লেখা বেরিয়েছে কলকাতার বড় কাগজে। আমি পড়েছি। খুব ভালো লেখা।” সেদিন তোমার চোখে যে খুশির ঝিলিক আর গর্ব দেখেছিলাম, আজও তা ভুলিনি। সেদিন আমার সব অপারগতাকে কী অবলীলায় সীমাহীন স্নেহের স্পর্শে উজ্জীবিত করেছিলে! কী মনে করে, এই অন্তর্জাল আর ডিজিটাল যুগে তোমাকে একটা খামহীন চিঠি লিখে রাখলাম। হয়তো এটাই শেষ। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। শান্তিতে থেকো। মা ও তোমাকে শ্রদ্ধাবনত প্রণাম।

ইতি…
তোমার হতভাগ্য মেজো ছেলে

কলকাতা
৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯

 

 

 

🍂কে চিঠি/ ১১  

 

 

 

 

প্রীতিভাজন,
সব চিঠির কী ডাক নাম থাকতেই হবে! বাধ্যতামূলক? হয়ত নয়। বা হয়ত! এইসবের পাশ দিয়েই যাচ্ছিনে। ডাক নাম না থাকলেও প্রাণের ভেতরের ঢাকের শব্দটিকেই লালন করলে প্রত্যেকে আমরা ঈর্ষা প্রভৃতি বিষয়ের থেকে শান্তি নিঃশ্বাস নিতে পারতাম না কী? কী মনে হয়? যদিও সময় তার নিজগতিতেই এগুবে, এর মাঝ দিয়ে গন্ধ থেকে বঞ্চিত থাকা এর বেশি কিছু না। এই কথাগুলি খুব মনে হল, যা আপনার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। দেখুন, এই জায়টিও বেশ। ‘আপনাকে’ চিনলুমই না। এমনকী উভয়ের মাঝে সাধারণ বন্ধুত্বও নেই। বাকী সব বাদই দিন! এরপরও কৌতুহল জাগে না, আমরা হাসছি, ভাগ করে নিচ্ছি কাঁধ, বসার জায়গা, চায়ের কাপ, নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিসর! তবে? না। কিছু না। এই পৃথিবীতে হাঁটতে বেরিয়েছি সবাই। সবার হাঁটার রাস্তা এক হতে যাবে কেন? এই জন্যই সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে হাঁটার জন্য এত সিঁড়ি বানিয়েছেন। ওই যে, রাস্তার স্পীড ব্রেকার যেমন।
-আলো

 

 

 

🍂কের চিঠি/ ১২  

 

 

ডাকবাক্সের চিঠি

মিঠুন চক্রবর্তী

 

 

 

প্রিয়, পত্রলেখা
বিকেলের রোদ এসে পড়েছে আমার গায়ে, আমার জং ধরা গায়ে। পাখিরা জগতের খবর নিয়ে বাসায় ফিরছে। তোমার খবর? কেমন আছ তুমি? খুব মনে পড়ছে তোমাকে। কতদিন আমার আকাশে উড়েনি তোমার নীল অক্ষরেরা। কতদিন কতদিন আমি রাত জেগে মুখস্থ করিনি আপাদমস্তক ভিজিয়ে দেওয়া রাতভর সুগন্ধি বৃষ্টির পদাবলী। চারদিকে মানুষের এত কোলাহল, এত বিস্মৃতি, এত ঘন ঘন বদলে যাওয়া রিংটোনের হাসি। এই সবকিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে এখনও তোমাকে মনে পড়ে পত্রলেখা। এখনও আমার বুকের উঠোনে ঝুলিয়ে রেখেছি মরচে পড়া হৃদয়। মনে পড়ে এক সময় সারা দিন-রাত তোমার নানা রঙের অলংকারের রিনিঝিনি ছন্দে আমার বুকের চিলেকোঠায় হাসি-কান্নার প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াত। সময় বড় নিষ্ঠুর, বড় বাস্তববাদী পত্রলেখা!
তার কাছে যখন যেটা দরকার তখনই তার আদর। ইমেলের যুগে তুমি – আমি ভীষণ বেমানান, অচল। তুমি কী এখনও বসন্তে হলুদ জমির উপর লাল সবুজ অক্ষরে সাজো? আমার তো সেই একই লাল জামা। এখন অবশ্য লালের ছিটে ফোঁটাও নেই। ছেঁড়া – মরচে ধরা। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা ! বুকে ফুটো ! তোমার উষ্ণ স্পর্শের অপেক্ষায় আজও আমি দিন-রাত মাথায় খাঁ খাঁ রোদ্দুর, ভয়ংকর ঝড়-বৃষ্টি ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকি।
তোমাকে লিখতে লিখতে কখন রাত্রি নেমে এসেছে পত্রলেখা।শীতের রাত্রি। একটা পর্ণমোচী শিমুল, যে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে আমারই মতো, তার সঙ্গে এমন শীতের রাতে খুব কথা হয়। ওর শূন্যতা আর অপেক্ষার গল্প শোনায় আমাকে। আমিও শোনাই আমার গল্প। তবে ওর অপেক্ষা প্রতি বসন্তে সার্থক হয়। আমি জানি আমার অপেক্ষার গল্পটা হয়তো আর শেষ হবে না কোনোদিন। তবু বিশ্বাস করো পত্রলেখা আমার এই ভগ্ন শরীর ধুলোয় মিশে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তোমার গায়ের গন্ধ জড়িয়ে রাখবো, আর মনে মনে গাইবো ‘ মুছে যাওয়া দিন গুলি আমায় যে পিছু ডাকে….’
ইতি, তোমার ডাকবাক্স

 

 

🍂ফিরেপড়া চিঠি 

 

 

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর লেখা চিঠি 

 

 

 

 

বেলেঘাটা
কলকাতা
৩৪, হরমোন ঘোষ লেন

-ফাল্গুনের একটি দিন।

 

 

অরুণ,

তোর অতি নিরীহ চিঠিখানা পেয়ে তোকে ক্ষমা করতেই হল, কিন্তু তোর অতিরিক্ত বিনয় আমাকে আনন্দ দিল এইজন্যে যে ক্ষমাটা তোর কাজ থেকে আমারই প্রাপ্য; কারণ তোর আগের ‘ডাক-বাহিত’ চিঠিটার জবাব আমারই আগে দেওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, উল্টে আমাকেই দেখছি ক্ষমা করতে হল। তোর চিঠিটা কাল পেয়েছি। কিন্তু পড়লুম আজকে সকালে; কারণ পরে ব্যক্ত করছি। বাস্তবিক, তোর দুটো চিঠিই আমাকে প্রভূত আনন্দ দিল। কারণ চিঠির মতো চিঠি আমাকে কেউ লেখে না এবং এটুকু বলতে দ্বিধা করব না যে, তোর প্রথম চিঠিটাই আমার জীবনের প্রথম একখানি ভাল চিঠি, যার মধ্যে আছে সাহিত্য-প্রধানতা। তোর প্রথম চিঠির উত্তর দেওয়া হয় নি তোর মতোই অলসতায় এবং একটু নিশ্চিন্ত নির্ভরতাও ছিল তার মধ্যে। এবারে চিঠি লিখছি এইজন্যে যে, এতদিন ভয় পেয়ে পেয়ে এবার মরিয়া হয়ে উঠেছি মনে মনে।

কাল বিকেলে তোর বাবা ঠিকানা খুঁজে খুঁজে অবশেষে তোর চিঠিখানা আমার হাতে দিলেন এবং আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তোর মা-র কাছে। কিন্তু তুই বোধ হয় এ খবর পাস নি যে, তোদের আগের সেই লতাচ্ছাদিত, তৃণশ্যামল, সুন্দর বাড়িটি ত্যাগ করা হয়েছে। যেখানে তোরা ছিলি গত চার বছর নিরবচ্ছিন্ন নীরবতায়, যেখানে কেটেছে তোদের কত বর্ষণ-মুখর সন্ধ্যা, কত বিরস দুপুর, কত উজ্জ্বল প্রভাত, কত চৈতালি হাওয়ায়-হাওয়ায় রোমাঞ্চিত রাত্রি, তোর কত উষ্ণ কল্পনায়, নিবিড় পদক্ষেপে বিজড়িত সেই বাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হল আপাত নিষ্প্রয়োজনতায়। তোর মা এতে পেয়েছেন গভীরতম বেদনা, তাঁর ঠিক আপন জায়গাটিই যেন তিনি হারালেন। এক আকস্মিক বিপর্যয়ে যেন এক নিকটতম আত্মীয় সুদূর হয়ে উঠল প্রকৃতির প্রয়োজনে। শত শত জন-কোলাহল-মথিত ইস্কুল বাড়িটি আজ নিস্তব্ধ নিঝুম। সদ্য বিধবা নারীর মতো তার অবস্থা। তোদের অজস্র-স্মৃতি-চিহ্নিত তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গ যেন তোদেরই স্পর্শের জন্য উন্মুখ; সেখানে এখনও বাতাসে বাতাসে পাওয়া যায় তোদের স্মৃতির সৌরভ। কিন্তু সে আর কতদিন? তবু বাড়িটি যেন আজ তোদেরই ধ্যান করছে।

তোদের নতুন বাড়িটায় গেলুম। এ বাড়িটাও ভাল, তবে ও-বাড়ির তুলনায় নয়। সেখানে রাত প্রায় পৌনে এগারোটা পর্যন্ত তোর বাবা এবং মা-র সঙ্গে প্রচুর গল্প হল। তাঁদের গত জীবনের কিছু-কিছু শুনলাম; শুনলাম সুন্দরবনের কাহিনী। কালকের সন্ধ্যা কাটল একটি পবিত্র, সুন্দর কথালাপের মধ্যে দিয়ে, তারপর তোর বাবা-মা, তোর ছোট ভাই আর আমি গিয়েছিলাম তোদের সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে এবং এইজন্যেই ঐ সন্বন্ধে আমার এত কথা লেখা। দেখলাম স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে, সদ্যবিয়োগ-ব্যথাতুরা বিরহিণীর মতো বাড়িটার এক অপূর্ব মুহ্যমানতা। তারপর ফিরে এসে হল আরও কথা। কালকের কথাবার্তায় আমার তোর বাবা এবং মা-র ওপর আরও নিবিড়তম শ্রদ্ধার উদ্রেক হল (কথাটা চাটুবাদ নয়)। তোদের (তোর এবং তোর মা-র) দুজনের লেখা গানটা পড়লুম; বেশ ভাল। কালকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলুম ‘পাঁচটি ফাল্গুনসন্ধ্যা ও একটি কোকিল’৪ গল্পটি। আজ দুপুরে সেটি পড়লুম। বাস্তবিক, এ রকম এবং এ ধরনের গল্প আমি খুব কম পড়েছি (ভালর দিক থেকে), কারণ ভাব এবং ভাষায় মুগ্ধ হয়ে গেছি আমি। পাঁচটি ফাল্গুনসন্ধ্যার সঙ্গে একটি কোকিলের সস্পর্ক একটি নতুন ধরনের জিনিস। গল্পটা বিশ্ব সাহিত্যে স্থান পাবার যোগ্য।

যাই হোক, এখন তোর খবর কি? তুই চলে আয় এখানে, কাল তোদের বাড়িতে তোর অভাব বড় বেশী বোধ হচ্ছিল, তাই চলে আয় আমাদের সান্নিধ্যে। অজিতের৫ সঙ্গে পথে মাঝে মাঝে দেখা হয়, তোর কথা সে জিজ্ঞাসা করে। ভূপেন৬ আজ এসেছিল— একটা চিঠি দিল তোকে দেবার জন্যে— আর একটু আগে তাকে এগিয়ে দিয়ে এলাম বাড়ির পথে। উপক্রমণিকার মোহ প্রায় মুছে আসছে। শ্যামবাজার প্রায়ই যাই। তুই আমাকে তোদের ওখানে যেতে লিখেছিস, আচ্ছা চেষ্টা করব।

চিঠিটা লিখেই তোর মা-র কাছে যাব। বাস্তবিক, তোর মা তোর জীবনে স্বর্গীয় সস্পদ। তোর জীবনে যা কিছু তা যে তোর এই মা-কে অবলম্বন করেই এই গোপন কথাটা আজ জেনে ফেলেছি। তুই কিসের ঝগড়া পাঠালি, বুঝতে পারলুম না। তুই চলে আয়, আমি ব্যাকুল স্বরে ডাকছি, তুই চলে আয়। প্রীতি- ট্রিতি নেওয়ার ব্যাপার যখন আমাদের মধ্যে নেই, তখন বিদায়।
—সুকান্ত ভট্টাচার্য।

 

 

 

পাঠকদের প্রতি : সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল’- নিয়মিত বিভাগগুলি পরবর্তী সংখ্যা থেকে যথারীতি নিয়মিত প্রকাশিত হবে।

 

🍁এসংখ্যার সম্পাদনা সহযোগী : মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়।  

🍁ছবি : আন্তর্জালিক 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

 

সম্পাদকীয় ঋণ : মহামিলনের কথা, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু-এর চিঠি, সুকান্ত ভট্টাচার্য্য-এর চিঠি অন্তর্জাল থেকে সংকলিত। 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment