



সম্পাদকীয়
আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেখছি যে এই সময়ের সাহিত্য দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং তার মধ্যে কল্পবিজ্ঞান, সমাজ, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট।
আধুনিক সাহিত্য বিভিন্ন মাধ্যম এবং ধারায় বিকশিত হচ্ছে, যেমন উপন্যাস, কবিতা, গল্প, নাটক এবং এমনকি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা প্রতিটি উন্নতশীল দেশে বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে আমার মনে হয়।
বলা যেতেই পারে যে, এই সময়ের সাহিত্য বিশ্বব্যাপী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলোকে তুলে ধরছে, যেমন প্রযুক্তির প্রভাব, মানুষিক স্বাস্থ্য, লিঙ্গবৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত সংকট। প্রতিটি লেখক তাদের কাজের মাধ্যমে নানা ধরনের আধুনিক সমস্যা, অসন্তোষ, এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতাকে তুলে ধরছেন।
এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি যেমন সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ও ডিজিটাল পত্রিকাগুলি লেখকদেরকে আরও বেশি স্বাধীনতা ও সম্ভাবনা প্রদান করেছে, যা আরও তরুণ পাঠকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা, যেমন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, ঔপন্যাসিক সাহিত্য, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
ভারতীয় সাহিত্যের গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী একথা অস্বীকার করতে পারবে না কোনও দেশ। আর এর মূল কারণই বাংলা সাহিত্য। রবীন্দ্র যুগের পরবর্তী সময়ে সাহিত্যের প্রসার ঘটলেও সাহিত্যের প্রতি প্রেমের সম্পর্ক বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে। ফলে, প্রতিভাশীল অনেক লেখকই তাঁর যোগ্য সম্মান এমনকি মর্যাদা পায়নি বা পায়ওনা। আর আগামীতেও পাবে বলে আমার মনে হয় না। তার প্রধান কারণই হল রাজনীতি। এবং আমিত্মের ফলনে এতটাই আসক্ত যে প্রতিভার খোঁজ নয় বরং আসক্তই! কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ সমস্ত ধারার লেখায় সামাজিক রাজনৈতিক জনৈকনীতি এবং কল্পবিজ্ঞান বিভিন্ন বিষয় আলোচনা সাহিত্যে উঠে আসছে বলেই ধারণা।
সর্বোপরি বলা যেতেই পারে যে, এই সময়ের সাহিত্য একটি সংবেদনশীল, বহুমুখী এবং প্রযুক্তিগতভাবে জটিল যুগের প্রতিফলন!🍁
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১৫
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ১৫।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
পনেরো.
ভাবতে ভাবতে কখন ভোর হয়ে গেছে
টিউশান পড়াচ্ছিলাম একটা বড় বাড়ির দোতলার উপর। রাত তখন ন’টা থেকে সাড়ে ন’টা হবে। পাশের একটা মাটির পোড়ো বাড়ি থেকে গাঁ-গাঁ শব্দ শুনেই চমকে উঠলাম। একটানা বেশ কিছুক্ষণ গোঁঙাানির শব্দ। তৎক্ষণাৎ নিচে নেমে এসে সেই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম একটা ছেঁড়া তালাইয়ে পড়ে আছে পুতুলের মতো একটি মেয়ের নিথর দেহ। মাথার চুলগুলি চারিদিকে ছিটকে পড়েছে। দু’টি হাত গলার কাছে এসে থেমে গেছে। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম শরীরটা এখনো গরম হয়ে আছে।
—কী কারণে মেয়েটা মরলো গো?
—হার্টফেল করেছে। হঠাৎ মারা গেল।
—আগে থেকে জানতে পারেননি?
—না, আমাদের কিছু বলেনি।
বাড়ির লোকদের আর কিছুই বলতে পারলাম না। ২২ থেকে ২৪ বছর বয়স হবে মেয়েটির। কলকাতা শহরতলীর বারাসাত এলাকার কোনো বস্তির মেয়ে। বাড়ির ছেলেটি সেখানে সেলসম্যানের কাজ করতে গিয়ে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তারপর মেয়েটিকে ঘরে আনে। কিভাবে কোথায় তাদের বিয়ে হয়েছিল সে খবর কেহই জানে না। শুধু বলতে শোনা যায়, “ছেলে কলকাতায় কাজ করে, ওখান থেকেই বিয়ে করে বউ এনেছে।” কিন্তু বউ আনলে কী হবে? যে বউ গৃহকাজ করতে পারে না, বাড়ির উঠোনটুকু ঝাঁট দেবার যার অভ্যাস নেই তাকে কী করে বউ বলে মানা যায়? তাকে ঘরে আনাতে ছেলে এক পয়সা যৌতুক পায়নি । শ্বশুর শাশুড়ি কেউ বেঁচে নেই যে ভবিষ্যতেও কিছু পাবে। মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া অনাথ মেয়ে। তাকে রেখে কী করবে তারা? সুতরাং যা হবার তাই হয়েছে। খুন-খারাপি হয়নি এই খুব। শ্বাসরুদ্ধ করে কয়েক মুহূর্তেই তাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাখ্যা শুনলাম পুনরায় টিউশান করা বাড়িতে ফিরে এসে। মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল। নিষ্পাপ উজ্জ্বল ফর্সা মেয়েটির মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো বারবার। কত কিছু অন্যায় আমাদের চোখের সামনে ঘটে অথচ কোনো প্রতিবাদই করতে পারি না।
সেদিন আর ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোতে মনোযোগ দিতে পারলাম না। মেয়েটি মারা গেল, কিন্তু একটা মানুষকেও কাঁদতে দেখলাম না । বরং মনে হলো একটা আপদ বিদায় হয়েছে এবার সবাই শান্তি পাবে। আসলে মেয়েটিকে মারলে যে কোথাও থানা পুলিশ হবে না, কেউ জানতেও পারবে না এটা ওরা আগে থেকেই জানতো। আর সেই কারণেই কাজটি করা তাদের পক্ষে সহজ ছিল। সে রাত্রে বাড়ি ফিরতে একটু রাতই হয়ে গেল। গাতানের দরজা দিয়েই যেতে হবে আমাকে।
বেশ সতর্কতার সঙ্গেই টর্চ জ্বালালাম। আলো ছিটকে পড়তেই দেখি ছায়ামূর্তির মতো কোনো অলৌকিক মানবী রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথার চুল খোলা। অবিকল পুতুলের মতোই। আমার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়েছে বলে মুখটি দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু অপরূপ তার শরীরী সৌষ্ঠব। কোমর পর্যন্ত ঢেকে গেছে চুলগুলি। গভীর নিতম্বের বক্রতা ধাতু নির্মিত ধনুকের মতো উজ্জ্বল চকচকে। আড়াল করা ঊরুদ্বয়ের দীর্ঘ ঋজুতা মসৃণ কোনো কদলী গাছের মতোই। এক ঝলক দেখেই আর সেদিকে অগ্রসর হবার সাহস হলো না। যে পথে গিয়েছিলাম সেই পথেই আবার ফিরে এলাম। বুকটা ধড়াস্ করে উঠল।
কে ছিল মেয়েটি? প্রকৃত মেয়ে নাকি সে জ্বীন-পরি? কী উদ্দেশ্যে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল?
এর উত্তর কোনোদিন পাইনি। যে সাহস নিয়ে নিজেকে অকুতোভয় ভাবতাম তা নিমেষেই চুপসে গেল। একবার মনে হলো হয়তো গাতানই তার মেয়েকে দাঁড়িয়ে রেখেছিল কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। আবার এমনও মনে হলো এতে তার কি ফল লাভ হতো? নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই পড়ে আমাকে রাত্রে টিউশান পড়ানোর সময় পাল্টাতেই হলো।
একটা মৃত মেয়েকে ছুঁয়ে একটা জীবন্ত মেয়েকে অর্ধেকটা নগ্ন দেখে এসে সে রাত্রে আমার আর ঘুম এলো না। আপন মনে বিষণ্ণরাতের তারার মতোই জ্বলতে লাগলাম। বিছানার একপাশে ঢাকা দেয়া ছিল ছোট্ট একটা বাটিতে চাট্টি মুড়ি। তা ছুঁয়েও দেখলাম না।
শহরতলীর বস্তি অঞ্চলের মেয়ে। গ্রামের একটা ছেলেকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল। তার পরিণতি যে এরকম হবে তা সে ভাবতেও পারেনি। এইটুকু বয়সেই তাকে দুনিয়া ছেড়ে যেতে হলো। এরকম কত মেয়েই যে যায় তার হিসেব আমরা রাখি না। এই গাঁয়েরও বহু মেয়ে বিয়ের প্রলোভনে পা দিয়ে চলে গেছে বিদেশে। আর কেউ ফিরে আসেনি। হয়তো তাদের দশাও এরকমই হয়ে থাকবে। সবার কথা ভাবতে গিয়েই মনে পড়লো সরার কথাও। মনে পড়লো হারুন পালের দুই মেয়ে চন্দ্রা ও হরির কথাও। অনেকদিন হয়ে গেল তাদের কোনো খোঁজ আর নেই। আগুনে পুড়ে সেদিন মারা গেছিল মান্তু লেটের বউও। ও সে কী মৃত্যু! এত বীভৎস মরণ কখনো দেখিনি। সেই সব মেয়েদের প্রেতাত্মা যেন আমার চারিপাশে ঘুরতে লাগলো। রাত্রির অন্ধকারে তারা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানান দিয়ে গেল, আমরা অশরীরী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের কোথাও আশ্রয় হয়নি। কোথাও সংসার পাইনি। কোথাও ভালোবাসা পাইনি।
বিছানার উপর উঠে বসলাম। হারিকেনের বাতিটা একটু উসকে দিলাম। নিঃসীম অন্ধকারে চারিদিকে আলো ছড়িয়ে পড়লো। বাইরে একটি কুকুর ডেকে উঠলো। মনে হলো কেউ যেন দৌড়ে পালালো। দূরের শিমুল গাছে একটি প্যাঁচার ডাকও শুনতে পেলাম। রুমা এ সময় কী করছে তা আর জানা হয়নি। ওকে শেষ চিঠি লিখেছিলাম একটি পোস্ট কার্ডেই। সে নাকি তার দিদির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে । কলেজে রেজাল্ট হলে তবেই সে ফিরবে। অনেক কথা আছে তাকে বলার। চিঠিতে সব কথা বলা হয়নি। অবশ্য রেজাল্ট বের হতে আর দেরি নেই।
আতর চাচা আবার যেতে বলেছে। মুম্বাই থেকে চিঠি এসেছে তাদের। চিঠি পড়ে তার উত্তরও লিখে দিতে হবে। আরফা সম্পর্কে আবার নতুন কী বলবে সে সম্পর্কেও আমার কৌতূহল আছে। কারণ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতে বাইরের লোকজনের যাওয়া-আসা বেড়েছে। মূলত তারা আরফাকেই দেখতে এসেছিল বিয়ের জন্য। লোকমুখে শুনেছিলাম তাদের নাকি মেয়েও পছন্দ হয়েছে। তাহলে কি আতর চাচা আমাকে মনগড়া কথা বলেছিল? আমি তো কখনো আশাও করিনি তাদের মতো বড় বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করার। সুতরাং আমার কিছু হারাবারও নেই। তবু মনটা কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। বস্তুতপক্ষে রুমাকে প্রেম করা সহজ হলেও বিয়ে করা কঠিন এ কথা আমি সেদিন বুঝেছিলাম। তাই আরফার প্রতি অনেকটাই ঝুঁকে পড়েছিলাম বাস্তব পরিস্থিতির কথা ভেবে। কিন্তু আমার ভাবনার সঙ্গে আমার লক্ষ্যের কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। তাই সে ভাবনাটাও অলীক হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে বসেছিল। স্রোতে ভাসমান কোনও মৃত্যুযাত্রীর মতোই স্বপ্নের খড়কুটো ধরতে চেয়েছিল। হয়তো, বলেই আতর চাচার বাড়ি থেকে সেদিন ফিরে এসে একটা সাদা খাতার প্রায় আট পৃষ্ঠা জুড়ে নিজের অনুভূতির কথা লিখেছিলাম। শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘আরফা, তোমাকে’। সেই লেখার কিছুটা অংশ ছিল এ রকমই: একটা সাদা গোলাপের বনে আজ প্রবেশ করলাম। চারিদিকেই সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছিল। নিজেকে দেবদূতের মতো মনে হচ্ছিল। আরফা, সত্যি বলছি, তুমি স্বর্গীয় পরির মতো। তোমার ভ্রমর কালো চোখ দুটি বারবার নিরীক্ষণ করছিল আমাকে। দু-একটি গোলাপ তুলে তোমার খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছিলাম। তুমি নিঃশব্দ হেসে উঠছিলে। এক রকমের বেগুনি রোদ পড়েছিল তোমার শরীরে। কাশ্মীরী আপেলের মতো তোমার শরীরের রং চমকাচ্ছিল। আমি ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে পারছিলাম না। কী অপার্থিব হয়ে উঠছিলে তুমি! লাল টুকটুকে তোমার ঠোঁট দুটিতে চুম্বন করতে গিয়েও মুখ সরিয়ে নিচ্ছিলাম। ফুলের পাপড়ির মতো পেলব। শিশির ভেজা আঁখিপল্লব দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সত্যিই তুমি কি আমার? না, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সারাক্ষণ যেন তোমাকেই দেখতে ইচ্ছে করছিল। আমার মনের বাগানে তুমি ঘোরাফেরা করছিলে সারাদিন। আমি ব্যস্ততার মাঝেও তোমার দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলাম। সত্যি বলছি আরফা, তোমার কথা শোনার পর আমি যেন কীরকম হয়ে গিয়েছিলাম! কীরকম তা নিজেও জানি না!
এমনই এসব প্রলাপ বাক্য লিখতে লিখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর মনে নেই। লেখার খাতাখানা খুব গোপন জায়গায় রেখেছি। যেদিন আরফাকে পাবো সেদিনই ওকে দেখাবো মনের ইচ্ছেটা সেই রকমই। এসব মনে পড়তে লাগলো আর ভাবতে ভাবতে কখন ভোর হয়ে গেছে। মসজিদের মাইকে তখন ঘোষণা করতে শুরু করেছে :
আসস্বলা-তু খাইরুম মিনান্ নাওম…🍁 (ক্রমশঃ)
🍂কবিতা
http://রণজিৎ সরকার-এর লিমেরিক আজকের লিমেরিক
রণজিৎ সরকার-এর লিমেরিক
আজকের লিমেরিক
মনময়ূরী
১.
ওরে মন-ময়ূরী করিস না আর গা-জোয়ারি
লোকে তোরে বলবে কী,হলে এমন বারদুয়ারি
দিসনে গায়ে ভর
থোড়া শরম কর
ধরলে পুলিশ খাটবে না আর জারিজুরি
২.
পার্কে চল ঘুরে বেড়াই রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি
ময়ূর বলে ও ময়ূরী তুই দেখতে ভারী মিষ্টি
এখান থেকে ভাগ
মেয়ে পটানো রাখ
দেখছিস না জোড়ায় জোড়ায় কী অনাছিষ্টি
৩.
লাজের মাথা খেয়ে ময়ূর পেখম দিল তুলে
ময়ূরী দেখে কিছুই নাই ডাঁটি গেছে খুলে
ডাঁটিই যদি খসাবি
কেমন করে পটাবি
বরষা নাই ভরসা নাই যখন তখন উঠিস কেন দুলে
বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর কবিতাগুচ্ছ
স্মৃতির ওয়ারড্রব
এখন যা কিছু জঞ্জাল আছে, সবটাই ভাসিয়ে দিই
মনের মধ্যে আঁকা সেই কীর্তনখোলাতে
নদী কথা রাখে, মিথ্যা ফেরায় না কখনও
সমস্ত তোলপাড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখি, অভিমান
উপবনে চুরিয়ে রাখা আমার কৈশোর নিয়ে খেলছে
ঈশ্বরের কোন সন্তান
এইবার নদী তোমার শরীরে পবিত্র হই…
আমার শরীরের মধ্যে বাস করে যে পবিত্র পুরুষ
সেও সুগন্ধি রুমাল উড়িয়ে জানিয়েছিল, দায়বদ্ধতা
ইদানিং বড় ভালো থাকি
বুকের ভেতর এসে, ওড়াউড়ি করে—শ্রেয়সীর
এঁকে দেওয়া প্রজাপতি
ভুলতে পারিনা, সেই সব বাসমতি বিকেল
মেট্রোয় হারিয়ে ফেলা, এক টুকরো নীল খাম…
আমার প্রেমিকারা
১.
কৈশোরে মেঘ ডাকা বিকেলে ছুটে যেতাম
আম বাগানের উপান্তে
খেলার ছলে লুকোচুরি আঁকতাম, তার কিশোরী আঙুল
কিংবা সম্ভাবনার আরো কয়েকটি বছর…
এপিসোড শেষ হলে দেখতাম, আদিগন্ত ফসলের মাঠ
উদাত্ত প্রেমিকা হয়ে ডাকছে, বয়ঃসন্ধির চোরাবালিতে
২.
নদীর ডানায় কতবার ভেসে গেছি, একা অবিবেচক
জলকেলিতে জেগে থাকে, চোরাবালির দুপুর
ডানাওয়ালা প্রণয়ী নই, বিভাজনে খুঁজেছি __
জল রেখার দূরত্ব
উপকূলে দাঁড়িয়ে স্বীকার করি, যৌবনের খরতাপে
নদী তুমি আমার সোমত্ত প্রেমিকা
৩.
এখন প্রান্তিক বিকেল
মুনিয়া পাখিটা ক্লান্ত গোধূলিতে লিখছে, ডুয়ার্সে কাটানো
ব্যর্থ দিন
সমতলের জীবন শেষ হলে, নেমে আসে
কালেনেমি বিকেল
অপ্রিয় হলেও স্বীকার করি, রুগ্নতা মাখা বিকেলে
তুমিই শেষ প্রেমিকা
একুশে ফেব্রুয়ারি
আজ সারাদিন রক্তের মধ্যে অশান্ত হিমোগ্লোবিন… একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি?
কৈশোরে ভুল বানানেও কতবার লিখেছি, অশান্ত
দিন গুজরান
ঠোঁটে ঠোঁটে জেগে আছেন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ,
কাজি নজরুল, শামসুর রহমান সহ এক আকাশ তারকা
সংগীতে সংগীতে উদাত্ত আকাশ বলে দেয়—
আমরা বাঙালি
এখানে শান্ত পাখিরা দেশ বদল করে
কাঁটাতার ভেঙে উন্মত্ত এক সবুজ সোপানে
লিখে গেছে, ভাষা শহীদদের উত্তাল দিনযাপন
ক্রমশ বদলে যাচ্ছে মুখ ও মানুষের মুখোশ
তবুও একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই মিশে যায়
উৎসব প্রিয় মানুষের অবয়ব
গোলাম কবির-এর কবিতা
ভালোবাসা যেন সোমনাথ দূর্গ, আমিও নাছোড়বান্দা সুলতান মাহমুদ
যতোবারই দূরে সরে যেতে চাও
ততোবারই ফিরে আসো তুমি হৃদয়ে আমার!
তুমি আসো আমার প্রতিটি নম্র সকালের ভাবনায় ,
আসো বিষণ্ণতায় ভরপুর উদাস দুপুরে
নিজের প্রতিই প্রবল আক্রোশে
পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে নিরর্থক
ঢিল ছোঁড়ার মূহুর্তের ভাবনায়,
আসো আমার ঘোরলাগা লাজুক সন্ধ্যায়,
এমনকি প্রতিটি নির্ঘুম একাকী রাতের
প্রহরে প্রহরে স্মৃতির দহনে নিজেকে
ভষ্ম করার বৃথা চেষ্টায়!
ভালোবাসা যেনো সোমনাথ দূর্গ,
আমিও নাছোড়বান্দা সুলতান মাহমুদ!
ভালোবাসার বৃত্তে আটকে গেছি আমি!
তাই যতোবার
ফিরিয়ে দাও,
ততোবারই
ফিরে আসি
ভালোবাসা নামের
রামধনুর সাত রঙে
জীবন রাঙাবো বলে।
কপিল কুমার ভট্টাচার্য্য-এর কবিতা
শ্রীপঞ্চমীতে
শুভ্র সকালে শ্বেত বসনে বেদীতে বসে স্বর, পলাশ-গাঁদা-টগর পাত্রে সাজিয়ে সকলে জড়। তিথি হয়েছে সুন্দর আজ মন্ত্রের শ্লোকে মুখর, মণ্ডপগুলি বিদ্যার্থী ভরা সকলে দাঁড়িয়ে করজোড়। শঙ্খধ্বনি হচ্ছে জোরে পুষ্পে ভরা চরণ, চারিদিক থেকে আসছে ভেসে মন্ত্র উচ্চারণ।
মমতা রায় চৌধুরী-এর কবিতা
শূন্যতা
কথা দিয়েছিলে তুমি আসবে
চারিদিকটা কেমন রোদ ঝলমল করে উঠেছিল
কুয়াশার অস্পষ্টতা মুছে গিয়ে
এক অদ্ভুত সূর্যমুখী ভোর এসে
দরজায় কড়া নেড়েছিল।
সেও হয়ে গেল অনেক দিন
তারপর…
চলে গেলে কথা দিয়ে আসবে ফিরে
আমি একরাশ হৃদয় বোধের গোলাপ ফুটিয়ে
বসেছিলাম তোমার প্রত্যাশায়
একদিন যায়
এক সপ্তাহ যায়
মাস যায়
বছরের পর বছর যায়
আস্তে আস্তে গোলাপের পাপড়ি ঝরে যায়
প্রদীপ জ্বালা ঘরে সোহাগের আকাঙ্ক্ষা
আস্তে আস্তে মিলে যায় অন্ধকারের কোলে
এখন শুধু বুকের ভেতর বয়ে যায় কেমন এক রক্ত ক্ষরণের শূন্যতা
আজ বৃষ্টি পড়লেও আর তেমন করে রোমাঞ্চিত হই না
স্বপ্নে আর নতুন করে গান বাঁধি না।
মনের ভেতরে শুধু একটাই জায়গা জুড়ে আছে
তা হল শূন্যতা…
সুচিতা সরকার-এর কবিতা
শীতের গল্পে
তারপর?
তারপর আকাশটা হঠাৎ মেঘলা করে এলো।
উত্তুরে হাওয়ার গায়ে যেন ডানা লাগল।
ভাঙা জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল
একরাশ ভারী কনকনে ঠান্ডা বাতাস।
খোলা ক্ষতোয় দাঁত বসাল।
কথা ছিল যন্ত্রণা আঘাত হানবে
আকাশের বুকে।
অঝোরে বৃষ্টি নামবে।
কিন্তু রক্ত যে কঠিন হয়ে গেছে।
কেউ খবর রাখেনি।
তুই থাকলে হয়তো গল্পটা অন্য হতো।
🍂অনুবাদ |গল্প
“না…না এটা করলে ভুল হবে। সাধারণ মানুষের প্রতি অবিচার করা হবে। দেখি আমি ওর দ্বারা কি করাতে পারি। আমি বক্তিতা দেব, তোমরা ওর সঙ্গে শোনো।”
সাধারণ মানুষ
শঙ্কর পূণতাম্বেকর
ভাষান্তরঃ মিতা দাস
নৌকা চলে যাচ্ছিল। মাঝপথে মাঝি বলল, “নৌকায় ভার বেশি হয়েছে। কেউ একজন কম হলে ভালো হয় তা না হলে নৌকা ডুবে যাবে।
এখন প্রশ্ন হল কে কম হবে? অনেকে সাঁতার জানত না এমনকি যারা জানত তাদের পক্ষেও অন্য দিকে নেমে যাওয়াটা কোনও খেলার কথা নয়।
নৌকায় সাধারণ মানুষ ছাড়াও ডাক্তার, অফিসার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, পুরোহিত, নেতা সব ধরনের মানুষ ছিল।
ডাক্তার। আইনজীবী, ব্যবসায়ী এরা সবাই চেয়েছিল যে সাধারণ মানুষ জলে ঝাঁপ দিক। সে সাঁতার কেটে পারে পৌঁছে যাবে, আমরা পারব না।
ওরা এবার সাধারণ মানুষকে লাফ দিতে বলল, সে অস্বীকার করে দিল। সে বলল, ‘যখন আমি ডুবি তখন কি তোমরা কেউ আমায় সাহায্য করতে ছুটে আসো? আমি তাহলে কেন তোমাদের কথা মনে রাখব?”
অনেক বোঝানোর পর যখন সাধারণ মানুষটি রাজি হল না তখন এই লোকরা নেতার কাছে যায়, সে আবার এদের থেকে একটি দূরে আলাদা হয়ে বসে ছিল। সেই নেতা সব কথা শোনার পর বলল, “সাধারণ মানুষ যদি আমাদের কথা না শোনে তাহলে আমরা ওকে ধরে নদীতে ফেলে দেব।”
নেতা বলল, “না…না এটা করলে ভুল হবে। সাধারণ মানুষের প্রতি অবিচার করা হবে। দেখি আমি ওর দ্বারা কি করাতে পারি। আমি বক্তিতা দেব, তোমরা ওর সঙ্গে শোনো।”
নেতা একটি আবেগ প্রবণ বক্তিতা শুরু করল, সেই বক্তিতার মধ্যে সে রাষ্ট্র, দেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের গাথা গেয়ে, দেশের জন্য আত্মত্যাগের আওহানে জানিয়ে বলল, সবাই হাত তুলে বল, “আমরা মরব, কিন্তু আমাদের নৌকা ডুবতে দেব না… দেব না… ডুবতে দেব না…।
এ কথা শুনে সাধারণ মানুষ এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠল যে সে নদী তে ঝাঁপ দিল।🍁
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি)। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
