



সম্পাদকীয়
জীবনের গতি বলতে এগিয়ে যাওয়ার কথায় বলা হয় কারণ এটি আমাদের জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জীবনে আমরা সবসময় নতুন অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং সুযোগের মুখোমুখি হই। এগিয়ে যাওয়ার মানে হল আমরা আমাদের লক্ষ্য এবং স্বপ্ন পূরণের পথে কষ্ট ও সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছি।
এটি আমাদের উন্নতি, বিকাশ এবং সামনের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রক্রিয়া বোঝায়। জাগতিক বাধা অতিক্রম করে, নতুন দক্ষতা অর্জন করে এবং আমাদের চেষ্টায় প্রতিনিয়ত উন্নতি সাধন করার মাধ্যমে আমরা জীবনের গতি বজায় রাখি। তাই বলা হয়, জীবন হচ্ছে একটি চলমান প্রক্রিয়া যেখানে আমরা সবসময় নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করি।
জীবন ও প্রাণের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং এই দু’য়ের মধ্যে প্রভেদ করা কিছুটা কঠিন। সাধারণভাবে, জীবন বলতে বোঝায় সেই ব্যবস্থা যা জীবিত সত্তার সমস্ত কার্যক্রম, অনুভূতি ও বিবর্তনকে নির্দেশ করে। অপরদিকে, প্রাণ বলতে সাধারণভাবে বোঝায় জীবনের একটি মৌলিক উপাদান, যা সত্তার অভ্যন্তরীণ শক্তি কিংবা সেই জীবনের স্পৃহাকে নির্দেশ করে। জীবন ও প্রাণ একে অপরের সঙ্গে মিলে থাকলেও আমরা এটা অন্যভাবে জীবনের সঙ্গে প্রাণের সংযোগ বোঝাতে অনেক বিষয় রয়েছে তার মধ্যে আমরা কিছু বিষয় উল্লেখ করতেই পারি। যেমন, বলতে পারি জীবনযাত্রা। আসলে জীবন যাত্রা প্রাণ জীবনের সক্রিয় অংশ। একটি জীবন্ত সত্তার সমস্ত কার্যক্রম, যেমন খাবার গ্রহণ, বৃদ্ধি, প্রজনন, অনুভূতি, এবং পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ, সবই প্রাণের মাধ্যমে সম্ভব হয়।
আরও একটি বলতে পারি তা হল অভিজ্ঞতা। অন্য দিকে অভিজ্ঞতা আসলে এমন এক বিষয় যা উল্লেখিত সংমিশ্রণ। প্রাণ থাকে বলেই আমরা ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, এবং বেদনা—এগুলো সবই প্রাণের উপস্থিতিতে আমাদের জীবনকে এক বিশেষ মানে দেয়।
এছাড়াও সাধারণভাবে বলতে পারি বিকাশ। প্রাণের জড়ত্ব আমাদের জীবনের প্রবাহকে নির্দেশ করে। এটি আমাদের বিবর্তনের পথে সক্রিয় করে এবং আমাদের শেখার, বেড়ে ওঠার এবং অভিযোজনের ক্ষমতাকে একত্রিত করে। এক নতুন ক্ষমতা ও শক্তি যোগান দিয়ে থাকে।
অন্যদিকে বলতে পারি আধ্যাত্মিকতা। আমরা প্রত্যেকেই জানি জীবনে আধ্যাত্মিকতা অনেক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাণ। এই চিন্তা একটি আধ্যাত্মিক উপাদান, যা আমাদের অস্তিত্বের গভীর অর্থ সহায়তা করে। নিজেদের মধ্যে জীবন ও প্রাণের এই বন্ধন গঠন করে মানসিক শান্তি এবং আত্ম-অন্বেষণের পথ প্রশস্ত করে। আসলে নিবিড় সংযোগ স্থাপন করে থাকে। যা জীবদ্দশায় প্রতি মুহূর্তে এক বিশেষ বোধের জন্ম দেয়।
তাই বলা যেতে পারে যে, এভাবেই জীবন ও প্রাণ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। যেখানে প্রাণ জীবনকে শক্তি ও বাস্তবতা প্রদান করে এবং জীবন প্রমাণ করে প্রাণের অর্থ ও কার্যকারিতা।
আসলে আমাদের অস্থিত্ব এমন এক পরিকাঠামো দ্বারা তৈরী যে সেখানে কোনও এক বিপরীত শক্তি নিজেদের দাঁড় করাতে সক্ষম বোধ করবে না। কারণ ভাব ও বোধের সঙ্গে জীবন ও প্রাণের এক গভীর যোগ রয়েছে।🍁
🍂মহামিলনের কথা
গুরুর সেবা ফলে সাধক যখন স্থুল সূক্ষ্ম সমস্ত বস্তু এবং নিজের দেহ মন প্রভৃতি বিষয় বিস্মৃত হয় অর্থাৎ যখন সে শূন্যময় হইয়া নিজের সত্তা পর্য্যন্ত ভুলিয়া যায়, তখন সুখ-দুঃখের অতীত এক শান্ত অব্যক্ত ভাব জন্মে; আবার যখন স্থুল সূক্ষ্ম সমস্ত বিষয়কেই আত্মরূপে দর্শন করে; অর্থাৎ নিতান্ত দ্বেষ্য বিষয়কেও সে আত্মীয় বলিয়া বোঝে— আপনরূপে দেখে—সকলকে এক বলিয়া জ্ঞান করে, তখন তাহার আত্মা অন্তরে পরম তৃপ্তি, শান্তি ও স্বাস্থ্য লাভ করে—দুঃখের মধ্যেও সুখ লাভ হয়— বাহ্য চঞ্চলতা সত্বেও অন্তরে স্থিরতা থাকে। (দীক্ষাসারে গুরুতত্ত্ব)
—শ্রীশ্রীঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ দেব
*বানান অপরিবর্তিত
🍂ফিরেপড়া | গল্প
“ঈশ্বর কোমরের কাপড় তুলে বুকে বাঁধলে, আর তার ঝাঁকড়া চুল একমুঠো ধুলো দিয়ে ঘষে ফুলিয়ে তুললে; তার পর মাটিতে জোড়াসন হয়ে বসে পাঁচ মিনিট ধরে বিড় বিড় করে কি বকতে লাগল। অমনি লেঠেলরা সব চীৎকার করে উঠল, “দেখছেন, বেটা মন্তর আওড়াচ্ছে, আমাদের নজরবন্দী করবার জন্যে।” ঈশ্বর এ-সব চেঁচামেচিতে কর্ণপাতও করলে না।“
মন্ত্রশক্তি
প্রমথ চৌধুরী
মন্ত্রশক্তিতে তোমরা বিশ্বাস কর না, কারণ আজকাল কেউ করে না, কিন্তু আমি করি। এ বিশ্বাস আমার জন্মেছে, শাস্ত্র পড়ে নয়— মন্ত্রের শক্তি চোখে দেখে।
চোখে কি দেখেছি, বলছি।
দাঁড়িয়ে ছিলুম চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দায়। জন দশ-বারো লেঠেল জমায়েত হয়েছিল পুব দিকে, ভোগের দালানের ভগ্নাবশেষের সুমুখে। পশ্চিমে শিবের মন্দির, যার পাশে বেলগাছে একটি ব্রহ্মদৈত্য বাস করতেন, যাঁর সাক্ষাৎ বাড়ির দাসী-চাকরানীরা কখনো কখনো রাত-দুপুরে পেতেন— ধোঁয়ার মতো যাঁর ধড় আর কুয়াশার মতো যাঁর জটা। আর দক্ষিণে পুজোর আঙিনা— যে আঙিনায় লক্ষ বলি হয়েছিল বলে একটি কবন্ধ জন্মেছিল। এঁকে কেউ দেখেন নি, কিন্তু সকলেই ভয় করতেন।
লেঠেলদের খেলা দেখবার জন্য লোক জুটেছিল কম নয়। মনিরুদ্দি সর্দার, তার সৈন্য-সামন্ত কে কোথায় দাঁড়াবে, তারই ব্যবস্থা করছিল। কী চেহারা তার! গৌরবর্ণ, মাথায় ছ ফুটের উপর লম্বা, পাকা দাড়ি, গোঁফ-ছাঁটা। সে ছিল ওদিকের সব- সেরা লক্ড়িওয়ালা।
এমন সময় নায়েববাবু আমাকে কানে কানে বললেন, “ঈশ্বর পাটনীকে এক-হাত খেলা দেখাতে হুকুম করুন-না। ঈশ্বর লেঠেল নয়, কিন্তু শুনেছি কি লাঠি, কি লক্ড়ি, কি সড়কি— ও হাতে নিলে কোনো ঠেলেই ওর সুমুখে দাঁড়াতে পারে না। আপনি হুকুম করলে ও না বলতে পারবে না, কারণ ও আপনাদের বিশেষ অনুগত প্ৰজা।”
এর পর নায়েববাবু ঈশ্বরকে ডাকলেন। ভিড়ের ভিতর থেকে একটি লম্বা ছিপছিপে লোক বেরিয়ে এল। তার শরীরে আছে শুধু হাড় আর মাংস—চর্বি এক বিন্দুও নেই। রঙ তার কালো, অথচ দেখতে সুপুরুষ।
আমি তাকে বললুম, “আজ তোমাকে এক-হাত খেলা দেখাতে হবে।”
লোকটা অতি ধীরভাবে উত্তর করলে, “হুজুর, লেঠেলি আমার জাত-ব্যবসা নয়। বাপ-ঠাকুরদার মতো আমিও খেয়ার নৌকো পারাপার করেই দু পয়সা কামাই। আমার কাজ লাঠি খেলা নয়, লগি ঠেলা। তাই বলছি হুজুর, এ আদেশ আমাকে করবেন না।”
আমি জিজ্ঞেস করলুম, “তা হলে তুমি লাঠি খেলতে জান না?”
২
সে উত্তর করলে, “হুজুর, জানতুম ছোকরা বয়েসে, তার পর আজ বিশ-পঁচিশ বছর লাঠিও ধরি নি, লক্ড়িও ধরি নি, সড়কিও ধরি নি; তা ছাড়া আর-একটা কথা আছে। এদের কাছে আমি ঠাকুরের সুমুখে দিব্যি করেছি যে আমি আর লাঠি-সড়কি ছোঁব না। সে কথা ভাঙি কি করে? হুজুরের হুকুম হলে আমি না বলতে পারি নে; কিন্তু হুজুর যদি আমার কথাটা শোনেন, তবে হুজুর আমাকে আর এ আদেশ করবেন না।”
আমি জিজ্ঞেস করলুম, “কেন এরকম দিব্যি করেছিলে?”
ঈশ্বর বললে, “ছেলেবেলায় এরা সব খেলা শিখত। আমিও খেলার লোভে এদের দলে জুটে গিয়েছিলুম। আমার বয়েস যখন বছর কুড়িক, তখন কি লাঠি, কি লক্ড়ি, কি সড়কিতে আমিই হয়ে উঠলুম সকলের সেরা। এরা ভাবলে যে আমি কোনো মন্তর-তন্ত র শিখেছি—তারই গুণে আমি সকলকে হঠিয়ে দিই। হুজুর, মন্তর-তন্তর কিছুই জানি নে; তবে আমার যা ছিল তা এদের কারো ছিল না। সে জিনিস হচ্ছে চোখ। আমি অন্যের চোখের ঘোরাফেরা দেখেই বুঝতুম যে তার হাতের লাঠি-সড়কির মার কোন্ দিক থেকে আসবে। কিন্তু আমার চোখ দেখে এরা কিছুই বুঝতে পারত না, আর শুধু মার খেত। শেষটায় এরা সকলে মিলে যুক্তি করলে যে আমাকে কালীবাড়ি নিয়ে গিয়ে হাড়কাঠে ফেলে বলি দেবে।
“তার পর একদিন এরা রাতদুপুরে আমার বাড়ি চড়াও হয়ে আমাকে বিছানা থেকে তুলে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে, কালীবাড়ি নিয়ে গিয়ে হাড়কাঠে ফেলে আমাকে বলি দেবার উদ্যোগ করলে। খাঁড়া ছিল ঐ গুলিখোর মিছু সর্দারের হাতে। আমি প্রাণভয়ে অনেক কান্নাকাটি করবার পর এরা বললে, ‘তুমি ঠাকুরের সুমুখে দিব্যি করো যে আর কখনো লাঠি ছোঁবে না, তা হলে তোমাকে ছেড়ে দেব।’ হুজুর, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে এই দিব্যি করেছি; আর তার পর থেকে একদিনও লাঠি-সড়কি ছুঁই নি। কথা সত্যি কি মিথ্যে—ঐ গুলিখোর মিছুকে জিজ্ঞেস করলেই টের পাবেন।”
৩
মিছু আমাদের বাড়ির লেঠেলের সর্দার।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, “ঈশ্বরের কথা সত্যি না মিথ্যে?”
সে ‘হাঁ’ ‘না’ কিছুই উত্তর করলে না।
ঈশ্বর এর পর বলে উঠল, “হুজুর, আমি মিথ্যে কথা জীবনে বলি নি—আর, কখনো বলবও না।”
তার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, “মিছু যদি গুলিখোর হয় তো এমন পাকা লেঠেল হল কি করে? “
ঈশ্বর বললে, “হুজুর, নেশায় শরীরের শক্তি যায়, কিন্তু গুরুর কাছে শেখা বিদ্যে তো যায় না। বিদ্যে হচ্ছে আসল শক্তি। সেদিন দেখলেন না, ঠাকুরদাস কামার অত বড়ো মোষটার মাথা এক কোপে বেমালুম কাটলে; আর ঠাকুরদাস দিনে-দুপুরে গুলি খায়। আমি নেশা করি নে বটে, কিন্তু বয়সে আমার শরীরের জোর এখন কমে এসেছে— যেমন সকলেরই হয়। যদি এরা অনুমতি দেয় তা হলে দেখতে পাবেন যে বুড়ো হাড়েও বিদ্যে সমান আছে।”
এর পর আমি লেঠেলদের জিজ্ঞেস করলুম তারা ঈশ্বরকে খেলবার অনুমতি দেবে কি না। তারা পরস্পর পরামর্শ করে বললে, “আমরা ওকে হুজুরের কথায় আজকের দিনের মতো অনুমতি দিচ্ছি। দেখা যাক, ও কি ছেলেখেলা করে।”
লেঠেলদের অনুমতি পাবার পর, ঈশ্বর কোমরের কাপড় তুলে বুকে বাঁধলে, আর তার ঝাঁকড়া চুল একমুঠো ধুলো দিয়ে ঘষে ফুলিয়ে তুললে; তার পর মাটিতে জোড়াসন হয়ে বসে পাঁচ মিনিট ধরে বিড় বিড় করে কি বকতে লাগল। অমনি লেঠেলরা সব চীৎকার করে উঠল, “দেখছেন, বেটা মন্তর আওড়াচ্ছে, আমাদের নজরবন্দী করবার জন্যে।” ঈশ্বর এ-সব চেঁচামেচিতে কর্ণপাতও করলে না। তার পর যখন সে উঠে দাঁড়ালে, তখন দেখি সে আলাদা মানুষ। তার চোখে আগুন জ্বলছে, আর শরীরটে হয়েছে ইস্পাতের মতো।
৪
ঈশ্বর বললে, “প্রথম এক-হাত লক্ড়ি নিয়েই ছেলেখেলা করা যাক। এদের ভিতর কে বাপের বেটা আছে, লক্ড়ি ধরুক।”
মনিরুদ্দি সর্দার বললে, “আমার ছেলে কামালের সঙ্গেই এক-হাত খেলে, তাকে যদি হারাতে পার তা হলে আমি তোমাকে লক্ড়ি খেলা কাকে বলে তা দেখাব।” তার পরে একটি বছর-কুড়িকের ছোকরা এগিয়ে এল। সে তার বাপের মতোই সুপুরুষ, গৌরবর্ণ ও দীর্ঘাকৃতি বাঁ হাতে তার ছোট্ট একটি বেতের ঢাল, আর ডান হাতে পাকা বাঁশের লাল টুকটুকে একখানি লড়ি। খেলা শুরু হল। এক মিনিটের মধ্যেই দেখি—কামালের লক্ড়ি ঈশ্বরের বাঁ হাতে, আর কামাল নিরস্ত্র হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তখন ঈশ্বর বললে, “যে লড়ি হাতে ধরে রাখতে পারে না, সে আবার খেলবে কি?” এ কথা শুনে মনিরুদ্দি রেগে আগুন হয়ে লক্ড়ি-হাতে এগিয়ে এল। ঈশ্বর বললে, “তোমার হাতের লড়ি কেড়ে নেব না, কিন্তু তোমার গায়ে আমার লড়ির দাগ বসিয়ে দেব।”
এর পরে পাঁচ মিনিট ধরে দুজনের লক্ড়ি বিদ্যুৎবেগে চলাফেরা করতে লাগল। শেষটায় মনিরুদ্দির লক্ড়ি উড়ে শিবের মন্দিরের গায়ে গিয়ে পড়ল; আর দেখি, মনিরুদ্দির সর্বাঙ্গে লাল লাল দাগ, যেন কেউ সিঁদুর দিয়ে তার গায়ে ডোরা কেটে দিয়েছে।
মনিরুদ্দি মার খেয়েছে দেখে হেদাউল্লা লাফিয়ে উঠে বললে, “ধর্ বেটা সড়কি।” ঈশ্বর বললে, “ধরছি। কিন্তু সড়কি যেন আমার পেটে বসিয়ে দিয়ো না। জানি তুমি খুনে। কিন্তু এ তো কাজিয়া নয়—আপসে খেলা। আর এই কথা মনে রেখো, রক্ত যেমন আমার গায়ে আছে, তোমার গায়েও আছে।”
এর পর সড়কি খেলা শুরু হল। সড়কির সাপের জিভের মতো ছোটো ছোটো ইস্পাতের ফলাগুলো অতি ধীরে ধীরে একবার এগোয়, আবার পিছোয়। এ খেলা দেখতে গা কিরকম করে, কারণ সড়কির ফলা তো সাপের জিভ নয়, দাঁত। সে যাই হোক, হেদাউল্লা হঠাৎ ‘বাপ রে’ বলে চিৎকার করে উঠল।
৫
তখন তাকিয়ে দেখি তার কব্জি থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে, আর তার সড়কিখানি রয়েছে মাটিতে পড়ে।
ঈশ্বর বললে, “হুজুর, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ওর কব্জি জখম করেছি, নইলে ও আমার পেটের নাড়ীভুঁড়ি বার করে দিত। আমি যদি সড়কি ওর হাত থেকে খসিয়ে না দিতুম, তা হলে তা আমার পেটে ঠিক ঢুকে যেত। এ খেলার আইন-কানুন ও বেটা মানে না। ও চায়-হয় জখম করতে, নয় খুন করতে।”
হেদাউল্লার রক্ত দেখে লেঠেলদের মাথায় খুন চড়ে গেল, আর সমস্বরে ‘মার বেটাকে’ বলে চীৎকার করে তারা বড়ো বড়ো লাঠি নিয়ে ঈশ্বরকে আক্রমণ করলে। ঈশ্বর একখানা বড়ো লাঠি দু হাতে ধরে আত্মরক্ষা করতে লাগল। তখন আমি ও নায়েববাবু দুজনে গিয়ে লেঠেলদের থামাতে চেষ্টা করতে লাগলুম। হুজুরের হুকুমে তারা সব তাদের রাগ সামলে নিলে। তা ছাড়া লাঠির ঘায়ে অনেকেই কাবু হয়েছিল কারো মাথাও ফেটে গিয়েছিল। শুধু ঈশ্বর এদের মধ্যে থেকে অক্ষত শরীরে বেরিয়ে এসে আমাকে বললে, “আমি শুধু এদের মার ঠেকিয়েছি, কাউকেও এক ঘা মারি নি ওদের গায়ে মাথায় যে দাগ দেখছেন— সে-সব ওদেরই লাঠির দাগ। এলোমেলো লাঠি চালাতে গিয়ে এর লাঠি ওর মাথায় গিয়ে পড়েছে, ওরা লাঠি এর মাথায়। আমি যে এদের লাঠিবৃষ্টির মধ্যে থেকে মাথা বাঁচিয়ে এসেছি, সে শুধু হুজুরের— ব্রাহ্মণের আশীর্বাদে।”
মিছু সর্দার বললে, “হুজুর, আগেই বলেছিলুম ও বেটা জাদু জানে। এখন তো দেখলেন যে আমাদের কথা ঠিক। মন্তরের সঙ্গে কে লড়তে পারবে?”
ঈশ্বর হাত জোড় করে বললে, “হুজুর, আমি মন্তর-তন্তর কিছুই জানি নে। তবে সড়কি-লাঠি ধরবামাত্র আমার শরীরে কি যেন ভর করে। শক্তি আমার কিছুই নেই; যিনি আমার উপর ভর করেন, সব শক্তি তাঁরই।”
আমি বুঝলুম লেঠেলদের কথা ঠিক। ঈশ্বরের গায়ে যিনি ভর করেন তাঁরই নাম মন্ত্রশক্তি অর্থাৎ দেবতা। শুধু লাঠি খেলাতে নয়, পৃথিবীর সব খেলাতেই—যথা সাহিত্যের খেলাতে, পলিটিক্সের খেলাতে তিনিই দিগ্বিজয়ী হন যাঁর শরীরে এই দৈবশক্তি ভর করে। এ শক্তি যে কি, যাঁদের শরীরে তা নেই, তাঁরা জানেন না। আর যাঁদের শরীরে আছে, তাঁরাও জানেন না।🍁 [*বানান অপরিবর্তিত]
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১৬
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ১৬।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
ষোলো.
একজনের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না
এই প্রথম রুমার সঙ্গে অনেকটাই দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল আমার। অনার্সের রেজাল্ট দেখতে গিয়ে রুমা সম্পূর্ণ হতাশ হলো এবং প্রায় ভেঙে পড়লো। আমি অনার্স উত্তীর্ণ হলেও রুমা একেবারেই পারলো না । কেঁদে দুই চোখ ভাসিয়ে দিল। কেন তার এমনটি হলো বুঝতে পারলাম না। পরীক্ষায় পাশাপাশি দুজনেরই সিট পড়েছিল। আমি যা লিখেছি ওকেও তাই বলে দিয়েছি। লেখার মধ্যে কী ত্রুটি ঘটেছিল যার ফলে তার এইরকম রেজাল্ট ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আবার পরীক্ষা দাও, ঠিক উত্তীর্ণ হতে পারবে।
কিন্তু রুমা সে-কথা কানেও শুনলো না, হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। আমিও রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি এলাম ঠিকই, কিন্তু সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। দু’জনেরই স্বপ্ন ছিল ইউনিভার্সিটি যাবার, কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।
এদিকে বাড়ি ফিরে এসেও বাড়িতে কোনো উৎসাহই পেলাম না উচ্চশিক্ষা লাভের। কেননা দু’বেলা ভাত জোটানোই ছিল আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সুতরাং টিউশানিতে জোর দিতে হলো। দু-তিনবেলা টিউশানি পড়াতে লাগলাম। এক রকম টিউশানির টাকাতেই কোনো রকম চলতে লাগলো সংসার। ছোট ছোট ভাই-বোনেরা তখন অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছে। তারাও মাঠে-ঘাটে যেতে পারছে। গাছের ঝরাপাতা, কাঠকুটো, ঝরাধান, গরুর পালের গোবর ইত্যাদি কুড়িয়ে আনতে পারছে। এরকম চলতে চলতেই একদিন, রুমার চিঠি পেলাম। রুমা লিখেছে : কী বন্ধু! নিশ্চয়ই আমার কথা একেবারেই ভুলে গেছো! কোথায় ভর্তি হয়েছো তা জানাবে। আমার শরীর খুব খারাপ। মনের টেনশনে বেশ কিছুদিন থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। পুনরায় আর পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই। এর মাঝেই তোমার সঙ্গে একদিন দেখা করার ইচ্ছে। কোথায় গেলে দেখা পাব জানাবে।
চিঠির উত্তরে আমিও তাকে জানিয়েছিলাম: খুব ব্যস্ততায় এখন দিন কাটছে। প্রায় তিন বেলা ধরেই টিউশানি করি। সময় পেলে বিভিন্ন মাঠের কাজ। উচ্চশিক্ষা লাভ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ আমার বাড়ির যা অবস্থা তাতে একা বাবার পক্ষে সামাল দেয়া মুশকিল। শরীর মোটামুটি ভালোই আছে। তবে তোমার জন্য চিন্তা হয়। একসঙ্গে পড়ার সুযোগ হলে হয়তো তোমার সাহায্য পেতাম। কিন্তু তা যখন হলো না, তখন আমিও দেখেছি পড়াশোনা করে আর লাভ নেই।
এই চিঠি পেয়ে রুমার কী অবস্থা হয়েছিল তা আমি জানতে পারিনি। এই চিঠির উত্তরও পাইনি দীর্ঘদিন। যখন উত্তর পেলাম তখন আমি আর আমার গ্রামে নেই। মাঝখানে অনেক কিছুই ঘটনা ঘটে গেছে যা রুমাকে জানানোও হয়নি। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। কোথাও ভর্তি হতে পারিনি। এমন সময় কলেজের অন্যান্য বন্ধুরা একদিন দল বেঁধে আমার গ্রামের বাড়িতে এলো। বন্ধুরা আমার মতো কেহই গরিব ঘরের সন্তান ছিল না। সবাই এসে দেখলো একটা ছোট্ট মাটির বাড়িতে কিভাবে আমাদের জীবন কাটে। ঘরের ছাউনি দেওয়া খড়ের চাল তাও আবার ঠিকমতো সারাই করা নেই। বাড়ির উঠোনেই তালাই পেতে তাদের বসতে দিলাম। সহপাঠীদের মধ্যে নিতাই দত্ত বললো, “তোর এই অবস্থা আমরা তো কল্পনাও করতে পারিনি!”
বিশ্বময় মুখার্জি বললো, “তুই চিন্তা করবি না, আমরা এবার একসঙ্গেই ভর্তি হবো। তোর হোস্টেল খরচ আমরাই যোগান দেবো।”
দ্বারিকনাথ পাল বললো, “আগামীকালই যাচ্ছি ফরম তুলতে, তোকেও সঙ্গে যেতে হবে। আমরা সব যোগাযোগ করে ফেলেছি। বাংলা ডিপার্টমেন্টের হেড আমাদের স্যারের বন্ধু। সুতরাং কোনো অসুবিধা হবে না।”
আমি আশ্বস্ত হয়ে কী বলে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাবো তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ যেন হাতে পেলাম আকাশের চাঁদ। আমার স্বপ্ন পূরণের এরকম একটা সুযোগ আসবে তা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সেদিন চা-বিস্কুট খাইয়েই ওদের বিদায় জানিয়েছিলাম।
———
রুমা চিঠিতে লিখেছিল, আমার আর লেখাপড়া হলো না বলে দাদারা জোর করেই আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাচ্ছে। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আগামী রবিবার সকালের ট্রেনেই আমি রামপুরহাট পৌঁছাচ্ছি। তুমি স্টেশনে অবশ্যই থাকবে।
কী করে আমি স্টেশনে থাকবো? আমি তো পাটনা চলে যাচ্ছি।
———-
বিকেল পাঁচটায় দানাপুর লোকাল ধরে চারজন মিলে রওনা দিয়েছিলাম বিহারের রাজধানী পাটনায়। সারারাত ট্রেনে গিয়ে সকালে পৌঁছেছিলাম পাটনায়। স্টেশন থেকে অটো ধরে সোজা ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে নেমেছিলাম। কাউন্টার থেকে ফর্ম তুলে ফিলাপ করে জমা দিয়ে দেখা করবো ডিপার্টমেন্টের হেডের সঙ্গে এই আমাদের উদ্দেশ্য। তাই যত তাড়াতাড়ি পারি কাজগুলো করে আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। গিয়ে দেখি কাউন্টারে অনেক বড় লাইন। আমরাও গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। চারজনের চারটি ফর্ম তুলে ফিলাপ করে জমা দিতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে যায়। ফুটপাতেই খেয়ে নিই পুরী ও তরকারি। তারপর ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ডিপার্টমেন্টের খোঁজ করে যখন এলাম তখন প্রায় তিনটে বেজে গেছে।
গঙ্গাতীরেই অবস্থিত পাটনা ইউনিভার্সিটি প্রথম দেখেই আশ্চর্য হলাম। ইউনির্ভার্সিটি যেন বিশাল এক রাজবাড়ির মতো। এটি নাকি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলেই তৈরি হয়েছিল।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিহার রাজ্যে এটিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সপ্তম প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ক’য়েকটা ডিপার্টমেন্ট থেকে এক একঝাঁক তরুণ-তরুণীর চলাচল দেখে আরো সচকিত হলাম। বিভিন্ন পোশাক-আশাকে তারা যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল, তেমনি বিভিন্ন ভাষায় তাদের কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছিলাম । এক ঝাঁক তরুণ তরুণী বাংলা ডিপার্টমেন্ট থেকেই বেরিয়ে এসে আমাদের কাছে দাঁড়ালো। তাদের জিজ্ঞেস করলাম তারা বাঙালি কিনা। উত্তরে তারা জানালো, পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা থেকেই তারা যেমন এসেছে, তেমনি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রবাসী বাঙালিও তাদের মধ্যে রয়েছে। কেউ ভাড়া ঘরে এবং কেউ হোস্টেলে তারা রয়েছে। তাদের কাছেই জানতে পারলাম, বাংলা ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলে প্রথম অন্তত মাস তিনেক সময় লাগবে হোস্টেল পেতে, ততদিন ভাড়ার ঘরেই থাকতে হবে। তবে ভাড়াঘর না পেলে কিছুদিনের জন্য তাদের ঘরেও অবস্থান করা যাবে। আমরা তাদের নাম ও ফোন নাম্বার লিখে নিলাম। বিশেষ করে মৈনুদ্দিন, আব্দুল্লাহ, শিবেন, মৃদুলা এবং নুরুলদার আন্তরিকতা ও ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। এক ঝলকের দেখা অচেনা চার কিশোরকে সেদিন তারা যতটা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিল তা অন্য কোথাও ইতিপূর্বে আমরা পাইনি। তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলাম ডিপার্টমেন্টের প্রধান শিবেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করতে। চারজনে শিবেশ স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করেছিলাম। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আমরা চারজনেই বীরভূম থেকে এসেছি কিনা।
সব শুনে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, “আমি যতদিন আছি তোমাদের কোনো অসুবিধে হবে না। যত তাড়াতাড়ি হোস্টেল পাওয়া যায় সেই ব্যাপারটিও আমি দেখছি। তোমরা অ্যাডমিশন নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করো।”
শিবেশ চ্যাটার্জি মুর্শিদাবাদ জেলার লোক ছিলেন। পশ্চিমবাংলার ক’য়েকটি কলেজে অধ্যাপনার পর তিনি পাটনা ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে যান। পাটনাতেই তাঁর স্ত্রীও শিক্ষকতা করেন। একমাত্র ছেলে থাকেন বিদেশে। তাই বাংলার ছেলেদের প্রতি তাঁর যথেষ্ট দরদ ছিল। এটা অনুভব করেই আমরা পুলকিত হলাম।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে প্রায় হাজারখানেক টাকা খরচ হবে। ১৯৯০ সালে এই হাজার টাকা জোগাড় করাটাই আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। বাড়ির প্রথম সন্তান বলে আমার পিতামহ আমাকে পাঁচ কাঠা জমি উইল করে দিয়েছিলেন। সেই জমিটিই বিক্রি করতে হলো মাত্র তিন হাজার টাকায়। এক হাজার টাকা ভর্তি খরচ দিয়ে বাকি টাকা কিছু বই কেনা ও পোশাক-আশাক তৈরির জন্য ব্যয় করা হবে স্থির করলাম এবং সেই মতো কাজও হলো। কিছু টাকা বাঁচলে তা দিলাম মায়ের হাতে। সামান্য টাকা নিয়ে আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেলাম। হোস্টেল খরচ আমাকে লাগলো না ঠিকই, কিন্তু প্রতিদিনের খাবারের খরচটুকু ওদের সঙ্গে শেয়ার করতেই হলো। আপাতত পূর্বের দাদাদের কাছ থেকেই একটা ভাড়া ঘর দেখে সেইখানে গিয়ে চারজনে উঠলাম।
রুমা চিঠিতে লিখেছিল, আমার আর লেখাপড়া হলো না বলে দাদারা জোর করেই আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাচ্ছে। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আগামী রবিবার সকালের ট্রেনেই আমি রামপুরহাট পৌঁছাচ্ছি। তুমি স্টেশনে অবশ্যই থাকবে।
কী করে আমি স্টেশনে থাকবো? আমি তো পাটনা চলে যাচ্ছি। এখন চিঠি লিখলেও তা তোমার কাছে পৌঁছাবে না। হাতে একবারেই সময় নেই। মনে মনে কথাগুলি বললাম।
সেই রবিবার নাকি রুমা রামপুরহাট এসে সারাদিন বিভিন্ন ঠেকে আমার খোঁজ করেছিল। যেখানে যেখানে আমি ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতাম সেখানে সেখানে গিয়েছিল। হাটতলার এক দোকানে আমি বসতাম বিভিন্ন সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা নিয়ে। সেখানেও সে গেছিল এবং দোকানদারের সামনে অঝোর ধারায় কেঁদেছিল। বলেছিল, “একটিবার দেখা করতে চেয়েছিলাম, খুব প্রয়োজন ছিল কিছু কথা বলার। কিন্তু সেই সুযোগটুকু আর পাওয়া গেল না। আমি বেঁচে থাকবো কিনা আর জানি না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, একজন তাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিল। তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না।”
আমিও জানতাম রুমা, তোমার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না, কিন্তু আমি সব যোগ্যতা হারিয়ে দিয়েছিলাম। নিরুপায় হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন গঙ্গাতীরে অস্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে রুমার জন্য আমার কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। বারবার মনে পড়ছিল তার করুণ অসহায় মুখটি। কিন্তু আমরা যে প্রত্যেকেই নিজস্ব গণ্ডিতে আবদ্ধ এর থেকে যে বেরিয়ে যেতে পারবো না তা কেমন করে বোঝাবো? তাই চোখ মুছে ফিরে এসেছিলাম ভাড়ার ঘরে। ততক্ষণে দেখি বিশ্বময় রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। বলছে, “আজ আর ভাত হবে না একেবারে সবশুদ্ধ দিয়ে খিঁচুড়ি। আচার সহযোগে পরিবেশন করা যাবে।”
আমি তথাস্তু বলে শয্যা গ্রহণ করেছিলাম। 🍁(চলবে)
🍂কবিতা
স্বপন দত্ত-এর একটি কবিতা
ইঁদুরটা বড়ই লাফালাফি করছে
অতসী, তোর নাম যাই হোক
অতসী রঙে রাখা
অতসী, যোনীর রঙে রাঙা
অতসী, ভুল বুঝিসনে ভাই
যতই তোর কাছে যাই
ততই দেখি একই জায়গায় নিয়েছি ঠাঁই
তন্বী মুখোপাধ্যায়-এর একটি কবিতা
নিশ্চিন্ত মানুষ
অবান্তর ভালোমন্দ ঠেলে মুখখানি মনে পড়ে যায়
বাঁশবনে নীলাকাশ ঝুঁকে মর্মরের দীর্ঘশ্বাস বয়
উপদ্রব বারুদের বিষ সর্বান্তঃকরণে শুষে চশমা
মুঠোয় ধরা যেন তিনিই বিধাতা সেই শায়িত মুখ
তাঁকে লাশ হতে বাধা দেয় জ্বলদর্চি অমেয় আলেয়া
কট্টরপন্থার অনন্ত সফল ক্ষুব্ধ শিয়ালের মুখ
অগ্রাহ্য করে উদারপন্থার মানে মৃত্যু সাধা নহে
বলে নির্লিপ্ত নিরেখ মুখ সাধারণ লিপি ও নিরভিমান
রোজ মনে পড়ে যায় সেই মুখ। জ্বর কমে তাপ
জ্বালা কমে, শয়নের শয্যা জুড়োয়—পৃথিবীর শাপ—
সুদীপ মণ্ডল-এর একটি কবিতা
ইতিহাস
দুটো শোবার ঘর, একটা বড় বারান্দা, ছোট ব্যালকনি, রান্নাঘর এক কথায় যাকে বলে টু বি এইচ কে। দুটো লোক, চারটে ফুলের টব, সফা, দু-চারটে মশা, লেপ, কম্বল, টিকটিকি এবং পাখি এই নিয়ে শুরু হয়েছে একটা সভ্যতা। এরপর দিন বাড়ছে , মাস বাড়ছে, বছর বাড়ছে হিন্দি সিনেমার মত। এর ধারে পাশে গজিয়ে উঠছে থ্রি বি এইচকে, ফোর বি এইচ কে, ঝা চকচকে বাড়ি ঘরদোর বাড়ছে, গাড়ি, মশা, মাছি, মার্বেল বাঁধানো মন্দির আর এবং ট্যাক্স ফাঁকি। ঠিক যেন একটা সভ্যতারযৌবন লকলক করছে। গাছ কমছে, পাখি কমছে, মানুষ জল কিনে খাচ্ছে এবং মশার মাছি বাড়ছে, এইসব দেখছেন, রাখাল দাস বাবু আর একটা সভ্যতা খুঁজে পাবার অপেক্ষায়…
গীতা চক্রবর্তী-এর একটি কবিতা
নিখোঁজ বসন্ত
তোমাকে যতবার ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছি
তুমি অহংকারী উড্ডীন পাখি হয়ে যাও
কত ভ্রূকুটি বিদ্রূপ ভাসিয়েছো
হিম কুয়াশায় বসন্ত নিখোঁজ হয়ে গেছে বলে
কত না আলেয়া ছুঁয়ে ছিল প্রতিটি মুহূর্তে
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি একটা গল্প ছিল
রঙিন হয়ে স্বপ্নের জগতে পৌঁছে যাওয়ার ছিদ্রহীন জালে।
মই অথবা বটগাছে চড়ে ছিল
তাই ঘুণ ধরার আগেই…।
তবুও দেখি মিনি সার্কাস কত কুশীলব
দূর থেকে দেখি শিহরিত হয়ে ভাবি
আর কত আর কত!
দেবব্রত সরকার-এর একটি কবিতা
আজ তোমার জন্মদিন
আজ তোমার জন্মদিন
তার মানেই, নতুন পৃথিবীর জন্মদিন
সবুজ দিগন্তে যে ঘর চেয়ে আছে
তাতে ভালোবাসার চোখ
মুঠো রৌদ্
আর
তোমার পবিত্র ঘ্রাণে মিশে আছে
নিঃস্বার্থ ভালোবাসার রূপ
একবার চেয়েতো দেখ
কি বলতে চাই কল্পিত আকাশ
দিশাহীন সৌরজগৎ
অথচ সব শেষ যে আসে
তাকেই আমরা লর্ড বলি
অথচ চোখে দেখিনি
তোমাকে দেখেছি
যে ফুলের নাম নিয়ে চিহ্নিত
তা কেবলি সঙ্কেত
এখন চেয়ে দেখ, কেউ একা বসে আছে
গভীর অন্ধকারে
নিরলস
শুধু তোমার অপেক্ষায়
কিছু একটা উপহার
কিছু একটা কথা
যে কথায় মিশে যায়
ভালোবাসার তৃপ্তি গন্ধ মাখা মায়া
তোমার হৃদয় আমাতে বিকশিত শ্বাস
আর
পূর্ণতা
সেখানে তোমাকে ডেকেছি
যার নাম গভীর হৃদয়
চোখের তারায় যেভাবে জেগে ওঠো
ঠিক সেই ভাবে প্রতিদিন
পাহাড় ডিঙিয়ে সূর্য উঠে আসে
তোমাকে দেখার পর
তোমার মায়ায় চাঁদও হেরে গেছে
আমি আজীবন তোমাকে দেখতে চাই
আলতো স্বরে বলেছি
এই শুনছো…
আজ তোমার জন্মদিন
তার মানেই…
একটা নতুন পৃথিবীর জন্মদিন
সানি সরকার-এর একটি কবিতা
পেণ্ডুলাম
গলন্ত রাতের ভেতর একটি ফুল
ছুঁয়ে দিলেই
তুমুল বৃষ্টিপতন
গান। গানের ভেতর বুঁদ…
আর শুধু নেমে যাওয়া। কোথায়?
এত পাখি মুখ নিচু করে
পায়ের বুড়ো
আঙুলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে
এবং ঘুরন্ত পেণ্ডুলামের ভেতর
কেউ স্পর্শ করছে মন প্রাণ আত্মা বায়ু
কী উদ্ভাসিত মুখ
কী দারুণ ফুলের উৎসব
এই বিশেষ ক্ষণটি চমৎকার
থমকে আছে
এখন কী কোনওভাবে ঘুমনো যায়
না
কোনওভাবেই আলোটিকে
স্পর্শ করবে না ঝড়ের ঝাপট
🍁ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ১৫
বৈষ্ণব মতে সৃষ্টি ও স্রষ্টা অভিন্নও বটে, আবার ভিন্নও বটে। যেমন পানিবিহীন ঢেউ হয় না, কিন্তু পানি ছাড়াও ঢেউয়ের একটা রূপ কল্পনা করা যায়। তেমনি রোদ আর সূর্যকে একাধারে অভেদ ও পৃথক করে কল্পনা করা সম্ভব। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১৫।
ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই
রেহানা বীথি
পর্ব : ১৫
শুধু ইতিহাস চেতনা ও ঐতিহ্য প্রীতি যে সাহিত্য সৃষ্টি করে না, কবির অন্তরের অনুভূতি বিগলিত ও পরিশুদ্ধ না হলে, তাঁর অন্তরের জারকরসে রঞ্জিত হয়ে শব্দ নতুন ভাবার্থে শিহরিত হয় না, নিছক সংবাদ মাত্রে পর্যবসিত হয়, এ আলোচনাও তিনি অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে করেছেন। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত কবি গোলাম মোস্তফার ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’ শীর্ষক কবিতার কয়েকটি চরণ এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন :
‘এ কঠোর এনতেহাম – এ অগ্নিদহন
ইসলামের ইতিহাসে নহেত নূতন!
ফুলের শয়নে সে- ত জন্মলাভে নাই
কুসুমাস্তৃত পথে যাত্রা তার নয়, –
তার পথ চিরদিন বন্ধুর – দুর্গম।’
কিংবা
‘যে কুয়ৎ দিয়ে গেল বাজুতে মোদের
যে স্বপন এঁকে গেল আঁখিতে মোদের
যে ইঙ্গিত রেখে গেল চলার পথের
সে কি কভু ব্যর্থ হতে পারে!
কখনই নয়!! মানুষ যখন
আপনার দেহ-সীমা করি অতিক্রম
উঠে যায় ঊর্দ্ধলোকে,
সত্য সুন্দরের বেশে কল্যাণ মূর্তিতে
চলমান শক্তিরূপে পায় নবরূপ
তখন তাহার আর মৃত্যু নাই
জিন্নাহ্ উঠে গেছে সেই আলা দরজায়।’
এটি আমাদের জাতীয় জীবনে বেদনাকরুণ কাহিনীর একটা ভাষাচিত্র হওয়া সত্ত্বেও যে ভাষায় এখানে তার রূপ প্রতিফলিত হয়েছে তা আমাদের হৃদয়কে তেমনভাবে আলোড়িত করে না। কবি এখানে যেন কায়েদে আজমের অন্তর্ধানের একটা বিবৃতি রচনা করেছেন, শুধু সংবাদ পরিবেশন করেছেন। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিযের জীবনী সংক্রান্ত মুফাখখারুল ইসলামের ‘মুরশিদ’ শীর্ষক একটি নাটকে ইতিহাস চেতনা প্রবলভাবে বিদ্যমান। অথচ প্রকাশ ভঙ্গিতে আরবি ফারসি ও বাংলা শব্দের গ্রন্থন নৈপুণ্যে ত্রুটি থাকায় এ নাটকের সংলাপের ভেতর দিয়ে নাট্যকার রসজগতের সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তার সন্ধান পাওয়া যায় না বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
“বিষয় অনুসারে ভাষার উচ্চতা ও সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত” বঙ্কিমচন্দ্র-এর এ-উক্তির উল্লেখ করে তিনি বলেছেন সাহিত্য রচনার প্রথম ও প্রধান গুণ সরলতা ও স্পষ্টতা। আর তার জন্য সাহিত্যিকরা তাঁদের পূর্বসূরীদের অনুসৃত ধারার অনুবর্তন করে নতুন পথ কেটে এগিয়ে যেতে পারেন।
এই গ্রন্থে তিনি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা থেকে আমরা তাঁর উদার মনের পরিচয়টিই অনুভব করতে পারি। এক নিষ্ঠাবান মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি অন্তরে ধারণ করেছেন অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। জীবনের শুরুতে উর্দু ভাষায় শিক্ষালাভ করলেও বাংলাকে ভালোবেসেছেন হৃদয় দিয়ে এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কল্যান চিন্তায় নিয়োজিত করেছেন নিজেকে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তাঁর নিরন্তর গবেষণাকর্ম যত দেখা যাবে তত বিস্মিত হতে হবে। মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতা নিয়ে ডক্টর আহমদ শরীফের সাথে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থটি এক অপার মুগ্ধতা এনে দেয়।
মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতা
এই গ্রন্থের ভূমিকায় আমরা দেখতে পাই, কেবলমাত্র ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। কিন্তু সাহিত্যে উচ্চ শিক্ষা কেবল রসচর্চা নয়— তত্ত্ব, তথ্য এবং ইতিহাসের চর্চাও। তাই রস বিচারে বৈষ্ণব- পদাবলী উৎকৃষ্ট হলেও, মধ্যযুগের সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সামগ্রিক ধারণার জন্যে অন্যান্য শাখার পদাবলীও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিবেচনায় বৈষ্ণব, শক্তি ও বাউল পদাবলী নিয়ে তিনি ‘মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতা’ নামক এই সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। আদ্যের গম্ভীরা, ঝুমুর কিংবা ভাটিয়ালির পুরোনো পদ দুর্লভ, তাই ওগুলো এ সংকলনে ঠাঁই পায়নি। আর মুর্শিদী- মারফতি পদ নামভেদে যেহেতু বাউল সঙ্গীত হিসেবেই ধরা হয়, কাজেই আলাদাভাবে ওগুলোকে চিহ্নিত করা হয়নি।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ রচনার মত বিভিন্ন শাখার পদাবলীও ধর্মসংপৃক্ত রচনা। এগুলো বিভিন্ন ধর্মমতবাদীর একাধারে সাধন-সঙ্গীত, বোধনগীতি ও ভজন। কাজেই পদাবলীর সাহিত্য-রস উপলব্ধি কিংবা সঙ্গীত-রস উপভোগের জন্য বিভিন্ন শাখার ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে আনুষঙ্গিক পরিচয় আবশ্যক। ভূমিকায় তাই সংক্ষেপে বৈষ্ণব, শাক্ত ও বাউল তত্ত্বের সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে।
বৈষ্ণবতত্ত্ব
ধর্ম সাধনার তিনটি পথ— কর্মমার্গ, জ্ঞানমার্গ ও ভক্তিমার্গ। জীবনে সৎকর্মের মাধ্যমে মোক্ষপ্রাপ্তি, জ্ঞানের দ্বারা জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করে মোক্ষের উপায় দর্শন আর ভক্তির দ্বারা ভগবৎ- অনুগ্রহে মোক্ষলাভ, বৈষ্ণবেরা এই তৃতীয় পথের পথিক।
আধুনিক বিদ্বানদের মতে জ্ঞানবাদ ও ভক্তিবাদ ইসলামের প্রভাবপ্রসুত। এ দুটো অদ্বৈতবাদ বা একেশ্বরবাদ-ভিত্তিক। মুসলমানদের সিন্ধুবিজয়ের পরে দাক্ষিণাত্যে শঙ্করই প্রথম জ্ঞানবাদ ও অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। তাঁর জ্ঞানবাদ (বা মায়াবাদ) দাক্ষিণাত্যে বিশেষ প্রসার লাভ করেনি, কিন্তু তাঁর প্রচারিত অদ্বৈতবাদ সম্বল করে ভাস্কর, রামানুজ, নিম্বার্ক, মধবাচার্য, বল্লভাচার্য ও চৈতন্যদেব যথাক্রমে ভেদাভেদবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ, শুদ্ধাদ্বৈতবাদ ও অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। এঁরা সবাই ভক্তি-পন্থী। ইরানি সূফীতত্ত্বের প্রভাবেই ভারতে অদ্বৈতবাদ ও ভক্তিবাদ প্রসার লাভ করে। বিদেশী শাসিত ভারতে একদিকে শাসক- শাসিতের মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজনে এবং অপরদিকে ইসলামের সামাজিক সাম্য ও ভাতৃত্ববোধের আকর্ষণে ব্রাহ্মণ্য যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল, তা রোধ করার জন্য উত্তর-ভারতে সমন্বয়-প্রয়াসী সন্তধর্মের উদ্ভব হয়।
‘ভক্তি দ্রাবিড় উপজি লায়ে রামানন্দ
প্রকট কিয়া কবির নে সপ্তদ্বীপ নবখণ্ড।’
রামানন্দ, কবীর, দাদু, একলব্য, রামদাস প্রমুখ সাধকগণ মানবিক সাম্য ও ভগবৎ প্রেমের বাণীর প্রচারক। কাজেই দাক্ষিণাত্যের ভক্তিবাদ, উত্তর ভারতের সন্তধর্ম ও বাংলার বৈষ্ণবধর্ম একই পরিবেশ ও সমস্যাপ্রসুত মতবাদ। তবু কেবল বৈষ্ণব ধর্মেই ভক্তির প্রেমরূপে মহিমান্বিত প্রকাশ ঘটেছে।
বৈষ্ণব মতে সৃষ্টি ও স্রষ্টা অভিন্নও বটে, আবার ভিন্নও বটে। যেমন পানিবিহীন ঢেউ হয় না, কিন্তু পানি ছাড়াও ঢেউয়ের একটা রূপ কল্পনা করা যায়। তেমনি রোদ আর সূর্যকে একাধারে অভেদ ও পৃথক করে কল্পনা করা সম্ভব। তাত্ত্বিক কবি হাজী মুহম্মদের নিচের কবিতাটি প্রফেসর হাই এখানে উল্লেখ করেছেন:
‘বীজ হোন্তে বৃক্ষ যেন বৃক্ষ হোন্তে ফল।
ফল, বৃক্ষ, বীজ -এই তিন নাম হয়
একে হয় তিন জান তিনে এক হয়।
বীজ বৃক্ষ ফল হোন্তে কেহ ভিন্ন নয়।
কিন্তু তথাপি ফলেরে বৃক্ষ কহন না যায়।
তেন মত জানিও আল্লা আর বান্দা
আল্লা হোন্তে বান্দা সব হইয়াছে পয়দা।
ফল আর বৃক্ষ যেন দুই এক কায়
তেনরূপে জানিয়ো যে বান্দা আর খোদায়।’
কৃষ্ণদাস কবিরাজের কথাও তিনি এক্ষেত্রে উল্লেখ করেন—
‘রাধা পূর্ণ শক্তি কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র পরমাণ।
মৃগমদ তার গন্ধ যৈছে অবিচ্ছেদ
অগ্নি জ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।
রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ।’
এমন সূক্ষ্ম ভেদ-অভেদ তত্ত্বভিত্তিক বলেই বৈষ্ণব মতবাদের নাম অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ।
বৈষ্ণব মতানুসারে মানুষ ও ভগবানের সম্পর্কটা সংক্ষেপে এইঃ আদিতে পরমপুরুষ- স্বরূপ বিধাতা একা ছিলেন। তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করলেন, তাই নিজ অংশ থেকে নারী স্বরূপাকে সৃষ্টি করে যুগল হলেন। এখানেই পুরুষ-প্রকৃতি, মায়া-ব্রহ্ম ও বিষ্ণুশ্রী তত্ত্বের উদ্ভব। নারীই শক্তিস্বরূপা, নারী সম্পর্কেই পুরুষ হয় শক্তিমান। মিথুন তত্ত্বেরও উদ্ভব এভাবেই। পুরুষ-প্রকৃতির তথা নারীপুরুষের মিলনেই সৃষ্টির উদ্ভব। তাদের সম্পর্কও প্রেমের। কাজেই সৃষ্টি প্রেমজ। তিনি চাইলেন— একোহম বহুশ্যাম। কেননা, আমি নিজেকে বিচিত্রভাবে উপভোগ ‘করতে চাই।’ আর তাই সৃষ্টি স্রষ্টার আনন্দ সহচর। যেখানে স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের আনন্দের তথা প্রণয়ের সম্পর্ক, সেখানে নিয়ম-রীতির ব্যবধান থাকতে পারে না। এ প্রেম জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম।
বৈষ্ণবেরা এই কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতির উন্মেষ-পদ্ধতির কথা এভাবে বলেনঃ
‘সাধন ভক্তি হইতে হয় রতির উদয়
রতি গাঢ় হৈলে তার প্রেম নাম হয়
প্রেম বৃদ্ধি ক্রমে স্নেহ মান প্রণয়
রাগ অনুরাগ ভাব মহাভাব হয়।’🍁 (ক্রমশঃ)
🍁প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথের একুশ শতকের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে অমর্ত্য সেন তাঁর ‘The Argumentative Indian’ গ্রন্থের Culture and Communication অধ্যায়ে Tagore and His India শিরোনামের প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতে রবীন্দ্রচর্চার গভীরতা অসীম। তাঁর রচিত সাহিত্যের পঠনপাঠন ও সঙ্গীতের চর্চা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। লিখেছেন : অমিত পাল
একুশ শতকে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা
বাংলা সাহিত্য জগৎ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া পঙ্গু৷ শুধু বাংলা নয় বিশ্ব সাহিত্যে তিনি একজন উজ্জ্বল পথিকৃত৷ বিগত একশত বছরের ইতিহাসে তিনি তুলনামূলক সাহিত্যের বিরল প্রতিভার অধিকারী৷ দিন যত এগোচ্ছে তত তাঁর রচনার নান্দনিক, দার্শনিক, কাঠামোগত, আন্তঃসাংস্কৃতিক, পারিবেশিক এবং একবিশ্বকেন্দ্রিক মানবতাবাদী চেতনার উত্তরোত্তর পুনর্বীক্ষণ ও পুনর্মূল্যায়ন হয়ে চলেছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের সাহিত্য জগৎ একেবারেই অচল৷ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তিনি ক্রমাগত নন্দিত, পঠিত ও বিবেচিত হওয়ার কারণে তাঁর উপস্থিতি সর্বত্রই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে রবীন্দ্রনাথের এই কালোত্তর উপস্থিতিই একবিংশ শতাব্দীতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
আজও দেশে দেশে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়৷ শুধু মাত্র ওই একটি দিনকে আমরা পালন করি৷ এই প্রসঙ্গে কবি বিষ্ণু দে ক্ষোভ প্রকাশ করে তার ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতায় যা জানিয়েছেন তার কয়েটি চরণ হল—
“তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ্য, কবি?/ হরেক উৎসবে হই হই/ মঞ্চে মঞ্চে কেবল-ই কি ছবি?/ তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ/ আর বাইশে শ্রাবণ?/ কালবৈশাখীর তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা,/ বাদলের প্রবল প্লাবন,/ সবই শুধু বৎসরান্তে একদিনেই নির্গত নিঃশেষ?”
২০১০ সালে কলকাতা’র রত্মাবলী থেকে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ: গ্রহণে, বর্জনে’ শিরোনামে সুমিতা চক্রবর্তীর একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে যেখানে তিনি খুব অকপটে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর পছন্দ-অপছন্দের দিকটি উল্লেখ করেছেন। একুশ শতকে আমাদের জীবনে তিনি কি প্রাসঙ্গিক? হলেও কতটা তা নিয়ে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের প্রাককথনে তিনি জানাচ্ছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও অনেকের মতোই আমারও ভাবনা, রুচি, নান্দনিকতা বোধ, জীবনযাপন, কর্তব্য নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। বিশেষ করে বাঙালির বেঁচে থাকায় তাঁর দুর্মর উপস্থিতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একজন মানুষ প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই আর একজন মানুষের সবটাই গ্রহণ করতে পারেন না, পার্থক্যের জায়গা থাকেই। মানুষের মস্তিষ্কের স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণ অত্যন্ত স্পষ্ট। কোনো দুজন মানুষ একরকম হতে পারেন না। কোনো দুজন মানুষের বুদ্ধি, মেধা, কর্মক্ষমতাও একরকম নয়। কাজেই একজন মহৎ মানুষকেও যখন তাঁর অনুরাগী ব্যক্তি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন, তখনও সেই আদর্শের সবটাই গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়। এটা কোনো নতুন কথা নয়, চিরকালের কথা।’
রবীন্দ্রনাথের একুশ শতকের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে অমর্ত্য সেন তাঁর ‘The Argumentative Indian’ গ্রন্থের Culture and Communication অধ্যায়ে Tagore and His India শিরোনামের প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতে রবীন্দ্রচর্চার গভীরতা অসীম। তাঁর রচিত সাহিত্যের পঠনপাঠন ও সঙ্গীতের চর্চা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। কিন্তু বিশ শতকের শুরুতে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে ইয়োরোপ ও আমেরিকায় তাঁকে নিয়ে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল তা একেবারেই থেমে গেছে। যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা তৈরির মাধ্যমে ‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল জিতে নিয়েছিল সেই প্রতীচ্যে তিনি এখন সেভাবে পঠিত নন।
আজও দেশে দেশে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়৷ শুধু মাত্র ওই একটি দিনকে আমরা পালন করি৷ এই প্রসঙ্গে কবি বিষ্ণু দে ক্ষোভ প্রকাশ করে তার ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতায় যা জানিয়েছেন তার কয়েটি চরণ হল—
“তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ্য, কবি?/ হরেক উৎসবে হই হই/ মঞ্চে মঞ্চে কেবল-ই কি ছবি?/ তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ/ আর বাইশে শ্রাবণ?/ কালবৈশাখীর তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা,/ বাদলের প্রবল প্লাবন,/ সবই শুধু বৎসরান্তে একদিনেই নির্গত নিঃশেষ?”
সবশেষে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে আছেন আমাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। তাই তাঁর জন্মের দেড়শত বছর পরও তিনি হয়ে আছেন সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক। এখনো রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন, তাঁকে ঘিরে এখনো অপেক্ষা করছে নতুনতর বিশ্লেষণ। তাঁর প্রতিভার আঁচ সাহিত্য জগৎকে ত্যাগ করবে না৷ তিনি এবং তাঁর রচনাসমগ্র থাকবে বিশ্ব সাহিত্যে — চিরন্তন ও শাশ্বত৷🍁
🍁গল্প
কি অবস্থা হয়েছিল সেটা একজন মা-ই বুঝতে পেরেছে। যদিও সাঁঝবাতির হয়ত সেই মাতৃত্বের স্বাদ ছিল না কিন্তু তবুও জানি না কেন যেন মাতৃত্বের অপত্য স্নেহ আর মাতৃত্বের স্বাদ তুতুর ভেতর দিয়েই অনুভব করেছিল।
বসন্তে থাক তুতু
মমতা রায়চৌধুরী
সাঁঝবাতির মনের ভেতরে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা প্রসন্নতা কাজ করছিল। তুতুর একটা ভাল জীবন দিতে পারবে এই বোধ থেকে একটা দুঃসাহসিক ভূমিকা নিতে যাচ্ছিল। গল্পের শুরুতেই কেমন একটা ধাঁ ধাঁ লেগে গেল না পাঠকের। এ আবার কি কথা ।হ্যাঁ এরকমই
কথা। সাঁঝবাতি একটা ছোট্ট পোষ্য রাস্তার সারমেয় ওর মাকে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গিয়েছিল তারপর আস্তে আস্তে ওর মায়ের কোল জুড়ে আসে ওরা। ওরা বলতে পাইলট, তুতু (ভাল নাম তুলি), মিলি, লিলি। লিলি কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় আর মিলি ডিসটেম্পার রোগে। এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল পাইলট, তুতু ও। তবে ঈশ্বরের করুণায় এবং ওদের সেবা যত্ন আর চিকিৎসার মাধ্যমে সেরে ওঠে। তুতু ছোট থেকে ও সাঁঝবাতির ঘরেই মানুষ হয়েছিল ও ওর খুব ন্যাওটা ছিল। তুতুর জীবনটা পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল তবে ওকে নিয়ে মনের ভেতরে সব সময় একটা দুশ্চিন্তা ছিল ও-বাইরের পরিবেশের সঙ্গে কি করে খাপ খাওয়াবে!তারপর আস্তে আস্তে তুতুর শরীর জুড়ে যৌবন আসল। বসন্ত ওর দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। তখন থেকে সাঁঝবাতির খুব চিন্তা। তুতুটা যা ভীতুর ডিব্বা কি করে কি করবে। আশ্চর্যের ব্যাপার একদিন এই তুতুকেই দেখল রাস্তায় রাত্রি যাপন করতে। কিন্তু সারারাত্রি ওর জন্য সাঁঝবাতি ঘুমোতে পারিনি। ওকে বোধহয় কেউ মেরে ফেলবে ও তো কারও সঙ্গে মেশেনি। সেদিন যে কতবার ওই তিন-তলা থেকে নিচে নামতে হয়েছে ওর জন্য আর কতবার ডাকতে হয়েছে। আসলে তুতু তখন বড় হয়ে গেছে। হয়ত সেজন্যেই সেদিন মায়ের ডাকে সাড়া দিতে পারেনি। তারপর আস্তে আস্তে দেখে ওর কিছু বন্ধু জুটেছে। তবে হ্যাঁ, তুতু এ ব্যাপারে পারফেক্ট ও-কিন্তু ও পড়ার একটি ছেলেকে কুকুর রাজাকে ভালোবাসে ।এটাও কি সম্ভব সাঁঝবাতি সারারাত ধরে ভাবে কি করে সম্ভব। হ্যাঁ এটাই সত্যি। সাঁঝবাতি দেখেছে ওর ভালোবাসা কতটা গভীর যখন অন্যেরা ওকে খাবলে খুবলে পাবার চেষ্টা করছে। তখন ও কিন্তু সংগ্রাম করেছে। আসলে মেয়েরা বোধহয় এরকমই হয় ।সে মানুষই হোক আর পশু ই হোক সংগ্রাম ওকে করতেই হয়। আসলে ওরা যে প্রকৃতি। তারপর তারপর আস্তে আস্তে তুতু শান্ত হল। নিজের থেকেই আবার সাঁঝবাতির ঘরে থাকতে শুরু করল। এরপর ও-একদিন মা হল। কোল জুড়ে আসল মেঘ, বৃষ্টি, ঝড়, বাদল। ও-তখন সবে ডিস্টেম্পার রোগ থেকে উঠেছে। তারই ফসল স্বরূপ দু’টো বাচ্চা, হ্যান্ডিক্যাপ হয়। এভাবেই বেড়ে ওঠে ওরা আর ওদের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে যায় অক্টোপাসের মত সাঁঝবাতির। সাঁঝবাতির সংসারেও সংগ্রাম শুরু হয় যারা এর বিরোধিতা করে, যারা কুকুর বলে আখ্যা দিয়েছে কুকুর বলেই হয়ত কুকুরকে এতটা স্নেহ মায়া মমতা করে এরকম আখ্যা ওর কপালে জুটেছে। কিন্তু তাতে সাঁঝবাতির কুচপরোয়া নেহি।
যেমন করে শরৎকালের আকাশ খুব মোহনীয় হয়। ঠিক ওরা আসাতে সাঁঝবাতি জীবনটাও অন্যরকম হল। কি করে ওর দিনরাত্রি হয় সে হিসেবে রাখতে পারে না।একসময় ডিপ্রেশনের ভেতরে চলে যাচ্ছিল সাঁঝবাতি, সাঁঝবাতির সন্তান হয়নি বলে তাকে কম কথা শুনতে হয়নি। কিন্তু এখন ওর এতগুলো সন্তান তুতু তো সন্তান জন্ম দেবার পর থেকেই সাঁঝবাতির ওপর ডিপেন্ডেন্ট। কতটা বিশ্বাস করলে তবে ছোট্টবেলা থেকেই সন্তানগুলোকে ছেড়ে দেয়। শুরু হয় তুতুর আর সাঁঝবাতির সংগ্রাম। এভাবেই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ওরা বড় হলো। তারপর ও আবার নিচে চলে গেল কি কারণে গেল বুঝতে পারল না সাঁঝবাতি। যদিও সেই সময় আর একটা অনাথ সারমেয় গুজু স্থান নিয়েছে। হয়ত সেজন্যই ও জায়গাটা ছেড়ে দিল। তারপর ও বাইরের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিল কিন্তু ও রীতিমতো সাঁঝবাতি সঙ্গে দেখা করতে আসে খাবার টাইমে ঠিক সময়ের মধ্যে এসে খেয়ে যায়। মনে পড়ে ডিসটেম্পার রোগের সময় যে তুতু একদিন তাকে ছেড়ে থাকেনি। সেই তুতুকে যখন আলাদা করে রাখার চেষ্টা করা হল যেহেতু ঘরে ছিল তখন ছোট্ট গজরাজ। ওকে ওই রোগের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যাতে ওর ওপর কোনও আঁচ না আসে। কি বলবে! সারারাত ও সাঁঝবাতির বারান্দার গ্রীলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বাতি সেটা সহ্য করতে পারেনি। সে সকলের কথা অমান্য করে পরের দিন যখন আবারও ও-সাঁঝবাতিকে ছাড়া থাকতে চাইল না। তখন তুতুকে ওর ঘরেই জায়গা করে দিল ঈশ্বরের নাম করে। যাই হোক ঈশ্বর সঙ্গে ছিলেন ধীরে ধীরে ডিসটেম্পার রোগ থেকে ওকে সুস্থ করে তোলা হল। কিন্তু ওই অবস্থাতেও প্রেগন্যান্ট হওয়াতে ওর বাচ্চাগুলোর উপর তার প্রভাব পড়ল দু’টো বাচ্চা হ্যান্ডিক্যাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করল। তাদেরকে মানুষ করা অর্থাৎ বড় করে তোলা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল সেসব কষ্ট সহ্য করে তাদেরকে বড় করে তোলা হল। প্রকৃতি তো আর থেমে থাকে না ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে তার বদল হতে থাকে তার চালচিত্র।
এরপর তুতুর জীবনে আবার বসন্ত এল। তুতুর জীবন আবার রঙিন হল তার ফলস্বরূপ তুতু এবার জন্ম দিল সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, গ্রহ, তারা নক্ষত্র। তার মধ্যে সদ্যোজাত শিশু অবস্থাতেই অন্য আরেকটি মা কুকুর এসে গ্রহকে মেরে দিল সে ছিল আর এক কাহিনী মা তার সন্তানকে বাঁচানোর যে তাগিদ আর কতটা যে তাদের আত্মত্যাগ তুতুতে না দেখলে বোঝা যেত না। তুতু নিজে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ওরা ছিল নিজের ঘরে আর সাঁঝবাতিরা ছিল তিনতলায় একটা ধস্তাধস্তি আওয়াজ পেয়ে সাঁজবাতি ছুটে এসে দেখে ততক্ষণে তুতু চেষ্টা করছে তার শিশুকে বাঁচানোর। সাঁঝবাতি ছুটে গেছে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ভয়ও লাগছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন থেকে না চাইলেও অসহায় মায়ের শিশুগুলোকে বাঁচানোর জন্য আঘাত করতে হয়েছিল কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে
গেছে। কি অবস্থা হয়েছিল সেটা একজন মা-ই বুঝতে পেরেছে। যদিও সাঁঝবাতির হয়ত সেই মাতৃত্বের স্বাদ ছিল না কিন্তু তবুও জানি না কেন যেন মাতৃত্বের অপত্য স্নেহ আর মাতৃত্বের স্বাদ তুতুর ভেতর দিয়েই অনুভব করেছিল। আস্তে আস্তে এত সংগ্রাম করার পরেও একমাত্র চন্দ্র ছাড়া বাকি সবাই তারাদের দেশে চলে গেছে। একজন মা কিভাবে তার সন্তানদের হারিয়েছে তার যে মনের অবস্থা সেটা তুতুকে দেখে খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছে। তুতুর জন্য ভীষণ কষ্ট হয় শুধু যখন কাছে আসে মাথাটা বাড়িয়ে দেয় বলতে চায় ওর ভাষায় ।ওকে শুধু মুখটা বুকের কাছে এনে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় সাঁঝবাতি। তখন সাঁঝবাতি অসহায়তা লক্ষ্য করে বলে মা তুমি যে প্রকৃতি। সহ্য করতেই হবে। জানি না কেন যেন মনে হতো ও সব বুঝতো। ওর মাথার উপর যখন বাতির চোখের জলটা পড়ত তখন কেমন অসহায় দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকত। হয়ত আশ্বাস দিত সব বুঝতে পারছি। এইভাবে কত বসন্ত এসেছে। হয়ত সাঁঝবাতির জীবনেও এসেছে আবার বয়ে গেছে কালবৈশাখীর মত অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা বিশেষত রাস্তার সারমেয়দের নিয়ে দিন রাত্রি অনবরত মানসিক নির্যাতন এবং ওদেরকে নিয়ে যেভাবে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা সাঁঝবাতিকে হেনস্থা লাঞ্ছনা গঞ্জনা পেতে হয়েছে, সে কথা সাঁঝবাতি আর বলতে চায় না। কারণ ও শুধু বলতে চেয়েছে এ পৃথিবীতে ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে। তাই মানুষের মত অবলা জীবদেরও প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা পরিবর্তন আসে। তবে সাঁঝবাতি অকৃতজ্ঞ নয় এই কাজে অনেকটা সহায়তা করেছেন পাশে থেকেছেন সাঁঝবাতির স্বামী। হয়ত মনের জোরটা ওখান থেকেই পেয়েছে।
এভাবে তুতুর জীবনে বসন্ত আসে কিন্তু এই বসন্তের প্রকৃতির রং যখনই রঙিন হয় তখন সাঁঝবাতিরও কেমন ভয় করতে থাকে কিন্তু স্বাস্থ্য এবং ওর মঙ্গল কামনায় স্বামী-স্ত্রী ঠিক করল এবার তুতুকে টেরিলাইজেশন করাতে হবে। সেইভাবে ডাক্তারের সঙ্গে কথা হল বেশ আনন্দেই দিন কাটছিল মনের ভেতরে শত কষ্টকে ছাইচাপা দিয়ে। ওরা ভাবে তুতুকে একটা ভাল জীবন দিতে পারবে কিন্তু যখন আসল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তুতুর ওপর দিয়ে যে ঝড় ঝাপটা বয়ে গেল সেটা সাঁঝবাতি আর নিতে পারছিল না চোখের জল ভরে উঠেছিল তুতু কি ঠিক হবে আদপে তুতুকে ভাল করার জন্য ওকে ভাল রাখার জন্য যে প্রচেষ্টা তারা নিয়েছে সেটা ফলপ্রসু হবে তো? মনের ভেতরে একটা কালো মেঘ ঘনিয়ে আসতে থাকে নইলে ডাক্তার ওসব কথা কেন বলবেন। আদপের সত্যিই কি ডাক্তার ঠিকঠাকভাবে সবকিছু করতে পেরেছেন বুঝতে পারছে না পুরোটাই ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। সাঁঝবাতি সারাক্ষণ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে ঠাকুরের কাছে হত্যে গিয়ে বলল ‘তুমি রক্ষা করও যদি এতটুকু পুণ্য কাজ করে থাকে তাহলে সুস্থ্য কর ওকে ভাল করে তোলো ঠাকুর। আজ বসন্তের দিনে যখন পলাশ শিমুলে আগুন লেগেছে মনও যখন রঙিন হয়ে ওঠে। তখন তুতু লড়াই করতে থাকে জীবনের সঙ্গে সাঁঝবাতির মনে তখন ‘বৃথা আশা মরিতে মরিতে ও মরে না’। সাঁঝবাতি শুধু ভাবে বসন্তের সমস্ত রংগুলো যেন তুতুর জীবনে আবার ফিরে আসে। তাহলেই সাঁঝবাতিও আবার নতুন করে মন রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারবে তার নিজের গৃহ চালচিত্রকে। এ বসন্ত যেন চির জাগ্রত থাকে তার দ্বারে।🍁
🍁অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভাল হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি), গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
সম্পদকীয় ঋণ : মহামিলনের কথা, ফিরেপড়া গল্প অন্তর্জাল থেকে সংকলিত।
