



সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে…
স্বামী বিবেকানন্দ-এর চিঠি
আলমোড়া, ২৯ জুলাই, ১৮৯৭
কল্যাণীয়া মিস নোবল১,
স্টার্ডি২ -র একখানি চিঠি কাল পেয়েছি। তাতে জানলাম যে, তুমি ভারতে আসতে এবং সবকিছু চাক্ষুষ দেখতে দৃঢ়সংকল্প। কাল তার উত্তর দিয়েছি। কিন্তু মিস মুলারের৩ কাছ থেকে তোমার কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে যা জানতে পারলাম, তাতে এ পত্রখানিও আবশ্যক হয়ে পড়েছে; মনে হচ্ছে, সরাসরি তোমাকে লেখা ভালো
তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। ভারতের জন্য, বিশেষত ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর—একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন । তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তা—সর্বোপরি তোমার ধমনিতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তের জন্য তুমি ঠিক সেইরূপ নারী, যাকে আজ প্রয়োজন।
কিন্তু বিঘ্নও আছে বহু। এদেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কী ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পারো না। এদেশে এলে তুমি নিজেকে অর্ধ-উলঙ্গ অসংখ্য নরনারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে। তাদের জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে বিকট ধারণা; ভয়েই হোক বা ঘৃণাতেই হোক—তারা শ্বেতাঙ্গদের এড়িয়ে চলে এবং তারাও এদের খুব ঘৃণা করে। পক্ষান্তরে, শ্বেতাঙ্গেরা তোমাকে খামখেয়ালি মনে করবে এবং প্রত্যেকটি গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখবে।
তা ছাড়া, জলবায়ু অত্যন্ত গ্রীষ্মপ্রধান। এদেশের প্রায় সব জায়গার শীতই তোমাদের গ্রীষ্মের মতো; আর দক্ষিণাঞ্চলে তো সর্বদাই আগুনের হলকা চলছে।
শহরের বাইরে কোথাও ইউরোপীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ কিছুমাত্র পাবার উপায় নেই। এসব সত্তেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস কর, তবে অবশ্য তোমাকে শতবার স্বাগত জানাচ্ছি। সর্বত্র যেমন, এখানেও তেমনি আমি কেউ নই; তবু আমার যেটুকু প্রভাব আছে, সেটুকু দিয়ে আমি অবশ্যই তোমায় সাহায্য করব।
কর্মে ঝাঁপ দেবার পূর্বে বিশেষভাবে চিন্তা করো এবং কাজের পরে যদি বিফল হও কিংবা কখনও কর্মে বিরক্তি আসে, তবে আমার দিক থেকে নিশ্চয় জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে— তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ কর আর নাই কর, বেদান্ত-ধর্ম ত্যাগই কর আর ধরেই থাকো। ‘মরদ কি বাত হাতি কা দাঁত’—একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না; খাঁটি লোকের কথারও তেমনি নড়চড় নেই—এই আমার প্রতিজ্ঞা। আবার তোমাকে একটু সাবধান করা দরকার— তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মিস মুলার কিংবা অন্য কারও পক্ষপুটে আশ্রয় নিলে চলবে না। তাঁর নিজের ভাবে মিস মুলার চমৎকার মহিলা ; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধারণা ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাথায় ঢুকেছে যে, তিনি আজন্ম নেত্রী আর দুনিয়াকে ওলটপালট করে দিতে টাকা ছাড়া অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। এই মনোভাব তাঁর অজ্ঞাতসারেই বারবার মাথা তুলছে এবং দিন কয়েকের মধ্যেই তুমি বুঝতে পারবে যে, তাঁর সঙ্গে বনিয়ে চলা অসম্ভব। তাঁর বর্তমান সংকল্প এই যে, তিনি কলকাতায় একটি বাড়ি ভাড়া নেবেন— তোমার ও নিজের জন্য এবং ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে যেসব বন্ধুদের আসার সম্ভাবনা আছে তাঁদেরও জন্য। এটা অবশ্য তাঁর সহৃদয়তা ও অমায়িকতার পরিচায়ক ; কিন্তু তাঁর মঠাধ্যক্ষাসুলভ সংকল্পটি দুটি কারণে কখনও সফল হবে না— তাঁর রুক্ষ মেজাজ এবং অদ্ভুত অস্থিরচিত্ততা। কারও কারও সঙ্গে দূর থেকে বন্ধুত্ব করাই ভালো ; যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।
মিসেস সেভিয়ার৪ নারীকুলের রত্নবিশেষ; এত ভালো, এত স্নেহময়ী তিনি। সেভিয়ার দম্পতিই৫ একমাত্র ইংরেজ, যাঁরা এদেশীয়দের ঘৃণা করেন না; এমনকি স্টার্ডিকেও বাদ দেওয়া চলে না। একমাত্র সেভিয়াররাই আমাদের উপর মুরুব্বিয়ানা করতে এদেশে আসেননি। কিন্তু তাঁদের এখনও কোনো নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী নেই। তুমি এলে তোমার সহকর্মীররূপে তাঁদের পেতে পারো এবং তাতে তোমার ও তাঁদের—উভয়েরই সুবিধা হবে। কিন্তু আসল কথা এই যে, নিজের পায়ে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।
আমেরিকার সংবাদে জানলাম যে, আমার দুজন বন্ধু—মিস ম্যাকলাউড৬ ও বস্টনের মিসেস বুল৭ এই শরৎকালেই ভারত পরিভ্রমণে আসছেন। মিস ম্যাকলাউডকে তুমি লন্ডনেই দেখেছ— সেই পারি-ফ্যাসনের পোশাক-পরিহিতা মহিলাটি! মিসেস বুলের বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং তিনি আমেরিকায় আমার বিশেষ উপকারী বন্ধু ছিলেন। তাঁরা ইউরোপ হয়ে এদেশে আসছেন, সুতরাং আমার পরামর্শ এই যে, তাঁদের সঙ্গে এলে তোমার পথের একঘেয়েমি দূর হতে পারে।
মি. স্টার্ডির কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত একখানা চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছি। কিন্তু চিঠিটা বড়ো শুষ্ক এবং প্রাণহীন। লন্ডনের কাজ পণ্ড হওয়ায় তিনি হতাশ হয়েছেন বলে মনে হয়।
অনন্ত ভালোবাসা জানবে।
ইতি-
সদা ভগবৎ-পদাশ্রিত,
বিবেকানন্দ
[চিঠি ঋণ : আন্তর্জালিক ]🍁
🍂কবিতা
সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন, প্রবাদপ্রতিম কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী। সাশ্রয় নিউজ-এর অত্যন্ত আপনজন। কবির সদ্য প্রেরিত বেশ কিছু কবিতা এখনও অপ্রকাশিত। তার ভেতর থেকে চারটি কবিতা আজকের রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এ।
অরুণ কুমার চক্রবর্তী
খেয়ালি প্রকৃতি
বেশ তো ছিলো টেথিস সাগর
ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল
সাগরতলের গাছগাছালি
মাছমাছালি, বালির চড়া
রংবাহারি প্রব্বাল
হটাৎ কখন মাথার নড়ে উঠলো
খেলা, এবার বুঝি সময় হোলো
পাল্টে যাবার বেলা,
অনেকদিন তো জলের তলায় ঘুমিয়ে ছিলে তুমি,
এবার তুমি নতুন করে পাবে জন্মভূমি, চাপ আসছে
চাপ আসছে, চাপের কী রূপ বাপ্
চাপের ঠেলায় সরিয়ে সাগর
কাঁপিয়ে সাগর হটাৎ দিলো লাফ, ঐ উঁচুতে, সবার উঁচু, উঁচু উঁচু, জীবন্ত পাহাড়, দারুণ প্রলয়
হিমের আলয় সাগরমাতা নাম
পৃথিবী জোড়া মানুষ রাখে তার পায়ে প্রণাম, প্রকৃতি মায়ের খেয়ালিপনা কে বুঝতে পারে,
দলে দলে আমরা এলাম
ঘুম পাহাড়ে, সারা পৃথিবী এখানে আসে দেখতে ঘুমের রূপ
আহা, অপরূপ, অপরূপ…
ও মুখের ছায়া
চোখের পাতায় একটি মুখ
মিষ্টি মিঠাম আলোর খেলা
জড়িয়ে ধরে, উলোটঝুলট জলের পাখি ছড়িয়ে ডানা রোদে শুখায়, চোখের পাতায়
আর সে তো নেই, আর সে তো নেই, ঐ আকাশে শূন্যমহল, ঐখানে চোখ আটকে আছে, আমায় দেখে, আমিও দেখি, সবখানে চোখ আটকে আছে, তারা দেখে আমিও দেখি, দেখাদেখির মজার খেলায় আমরা কেবল মজে আছি,, মজে আছি
পর্যটক
ধূসর আকাশে ভাসে ডানাওলা
উড়ন্ত পর্যটক,
কোথা যাবে, কতদূর যাবে, ওরা জানে, চেনে, চিনে রাখে ভাসমান পথের মানচিত্র
ছোট্টো মগজে থাকে অপূর্ব প্রাকৃতিক চুম্বকের খেলা, অপূর্ব চোখের ফোকাল লেংথ নিয়ে ঠিক নামে পরিচিত জলের উঠোনে,
এই ক্লান্তিহীন ডানা মানুষের নেই, অথচ উড়তে চেয়েছে, ওদের ভালো করে দেখেটেখে নিয়ে মেধার জটিল জট ছাড়িয়ে বানিয়েছে ধাতব পাখি,
তার পেটে বসে, প্রচুর খরচ করে উড়ে উড়ে, উড়ে চলেছে একদেশ থেকে অন্যদেশে…
দুই পর্যটকদের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে আকাশেজমিন ফাঁক, তবুও দুজনে একনিষ্ঠ তন্ময়
তাই এই ভ্রমণ, শুধুই পর্যটনময়…
পূর্ণতার এই মাধুকরী
আমাদের চাওয়ার শেষ নেই জেনেও, আমাদের ছোটো হাত মাঝারি হাত, বড়ো বড়ো হাতগুলি কেবলই আরও আরও লম্বা হ’তে হ’তে কতদূর পৌঁছতে পারে, আমরা নিজেরাই জানি না…
শান্ত সমাচ্ছন্ন নির্জনে যাকে চেয়েছি এতদিন,
সে তখন কলকাতা কবিতার বাগানে উড়ু উড়ু পরি,
যাকে চেয়েছি ধেই ধেই রাম্বাসাম্বা নাচের আসরে, সারা গায়ে মুখে ঘামতেল মোহিনীমায়ার কুহেলিকা
সে তখন শনিঠাকুরের দোরে ভীরু নাবালিকা,
যাকে চেয়েছি মিছিলে রাজপথে প্রতিরোধে প্রতিবাদে,
সে তখন পর্যপ্ত ডলারের লোভে উড়ে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে,
যাকে চেয়েছি প্রকৃতই ভারতীয় রমণীর বেশে, লালপেড়ে শাড়ী,
কপালে সিঁদুরচাঁদ, মোহময়ী সুচারু কল্যাণী,
সে তখন ফ্যাশান প্যারেডে যৌবনের পাল তুলে ক্যাটওয়াকে দারুণ পটিয়সী ছিমছাম রম্ভা উর্বশী,…..
তবুও পূর্ণতা চাই, ফসলের উর্বরতার শীর্ষে প্রেম চাই, চাই
মেধার প্রগাঢ ব্যবহার, ফুলেদের হাসি, তামাচ্ছন্ন হৃদয়প্রবাস থেকে উঠে আসা গোলাপীআভার পদ্মবন, দুটি মন…..
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস/৪
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজকে পাঠকদের জন্য পেশ করা হল চতুর্থ পর্ব।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
চার.
আকাশ জুড়ে লেখা হলো একটি নাম
গ্রাম বলতে যা বোঝায় ক’য়েকটি জীর্ণশীর্ণ খড়ের চালের ছাউনি করা মাটির দেওয়াল দেওয়া কতগুলো বাড়ি। অধিকাংশ বাড়িরই প্রাচীর নেই। ধোঁয়া ওঠা রান্নাশাল। মাটির উনুনে খড় বা পাতার জ্বালে রান্না হয়। মাটির হাঁড়িতেই হয় ভাত-তরকারি। রান্না করে খেতে খেতে প্রতিদিনই বেলা যায়। কাকেরা কা-কা শব্দে বাসায় ফেরে। বাঁশের ডালে পতিত হয় শেষ রোদের আভা। রাখাল বালকেরা হাট্ হাট্ শব্দে গরু-বাছুরের পাল নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
গ্রীষ্মকালে রোদের সময় একটুও চোখে ঘুম নেই। পকেটে নুনের গুঁড়ো নিয়ে বেরিয়ে পড়ি মাঠে মাঠে। কোথায় আছে আমের বাগান, কোথায় আমের গাছে আম ধরে আছে তার খোঁজ করি। সকাল সকাল স্কুল করে এসে নিত্যদিন এই আমাদের কাজ। কাঁচা আম নুন মাখিয়ে খেতে খেতে সারা দুপুর কেটে যায়। তারপর গাছতলায় বসে বসে চলতে থাকে সত্যপীর অথবা কবিগানের মহড়া। সত্যপীরের মূল গায়েন হয়ে গাইতে থাকি:
রাজার মনে সুখ নাই
দোহারী, কেন বলো তো ভাই?
তখন আরেকজন দোহারী উঠে বলে:
রাজার যে সন্তান নাই
মনের দুঃখ তাই তো ভাই!
কখনো মনসামঙ্গলের গানেরও রঙ্গরসিকতার পংক্তিও মনে পড়ে। বেহুলা লখিন্দরের লাশ নিয়ে ভেসে চলেছে আর নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর নৌকা ঘিরেছে এক গোদা। নানারকম প্রলোভন দেখাচ্ছে বিধবা বেহুলাকে বিয়ে করার জন্য। তার সেই কথাগুলো হুবহু বলে যাচ্ছি সুর করে:
যেও না গো বেহুলা সুন্দরী
তোমায় আমি বউ করে নিয়ে যাব বাড়ি।
কোনো দুঃখ থাকবে নাকো রাখবো রানি করে
আলতা-সিঁদুর পরিয়ে দেবো হাতে সোনার চুড়ি।
গয়না দেবো, ফিতে দেবো, দেবো ঢাকাই শাড়ি
সঙ্গে করে নিয়ে যাবো তোমার বাপের বাড়ি।
সেই গোদার কথায় বেহুলা কিছুতেই ভুলবে না। অন্য একজন তখন তার উত্তর দিবে এই ভাবেই:
বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে আসিস না
হাতখানা তোর খসে যাবে টের পাবি না।
তারপর পুনরায় দু’জনেই তখন গোদার ছিপ ফেলার পদ্ধতি বর্ণনা করতাম:
তালগাছ কেটে গোদা ছিপ বানাইলো
আধ মণ লোহা দিয়ে বঁড়শি করিল।
তোলে আর ফেলে গোদা মাছ নাহি পায়
বেহুলাকে দেখে গোদা করে হায় হায়।
গোদার কথা বলতেই আমাদের মনে দারুণ আমোদ জেগে উঠতো। চোখের সামনে যেন তাকে দেখতে পেতাম। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রতিবছরই নিয়ম করে গ্রামে হতো মনসার গান। আর এই গান শোনার জন্যই মঞ্চের চারিপাশে আগে থেকে গিয়ে জায়গা দখল করতাম। গায়েন গান ধরলে তার নকল করতাম। তার সুরে সুর মিলিয়ে বলতাম। পরবর্তীকালে এইসবেরই প্রতিধ্বনি বেজে উঠতো আমাদের মহড়ায়। তবে এসব গানের থেকে কবিগানের মহড়াই বেশি হতো। প্রতিবছর নবান্ন এলেই অঘ্রাণ মাসে কবিগানের আসর বসত। কখনও রাম-রাবণের পালা তো কখনও একাল-সেকাল। দুই কবিয়ালের গানের ছন্দে চাপান-উতোর চলতেই থাকতো। আমি বেশিরভাগ সময়েই সেকালের পাঠ নিতাম আর এ-কালকে বলতাম:
একালের মানুষগুলো বদলে গেছে ভাই
রাস্তাঘাটে চোর জোচ্চোর কত দেখতে পাই।
সাজ পোশাকে কতই তারা সেজে থাকে বাবু
পেটে কারো বিদ্যা নেই পড়াশোনায় কাবু।
গুরুজনকে কেউ তারা মানে নাকো ভাই
বড়দের সামনে তারা সিগারেট বিড়ি খায়।
কী বলিব এদের কথা বলতে লজ্জা লাগে
বাবাকেও এরা এখন ড্যাডি বলে ডাকে।
আমার প্রতিপক্ষ যে হতো সে তখন এর জবাব দিত:
মানুষ কেউ বদলেনিকো বদলে গেছে দেশ
তাইতো সকলের এমন সাজ-পোশাকের বেশ।
চুরির জন্য তবে কেন দায়ী হবে এরা
চুরির শিক্ষা দিয়ে গেছে পূর্বপুরুষেরা।
বিদ্যা আছে বলেই তারা চাঁদে যেতে পারে
কত রোগের ওষুধ এরা আবিষ্কার করে।
ইংরেজিতে ড্যাডি বলে এটাতো সাহেবদের ভাষা
সিগারেট বিড়ি টেনে এরা সাহেব সাজে খাসা।
এসব যদি করতে পারো তুমিও হবে সেরা
সভ্যজাতির সকল কাজে এগিয়েছি আমরা।
এভাবেই চাপান-উতোর চলতো ঘন্টার পর ঘন্টা। শেষপর্যন্ত কে জিতবে এই নিয়ে মুখিয়ে থাকতো সমবয়সী দর্শকরা। হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াশোনাকালীন এভাবেই কবির লড়াই করতে করতে কখন কবিতা লেখা শিখে গিয়েছিলাম। খাতার পাতায় ভরে যেত কবিতার ছোট ছোট পংক্তি। অষ্টম শ্রেণির ক্লাসরুমে একদিন দরজা বন্ধ করেই আমাদের সহপাঠী হালিম আব্দুল আলিমের গাওয়া লোকগীতি পরিবেশন করতে লাগলো:
“ডাক দিয়েছে দয়াল আমারে
রইবো না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে…”
শুনতে শুনতে আমরা উদাস হয়ে গেছি আর সে নেচে নেচে গাইছে। দরজার ফাঁক দিয়ে আমাদের ইংরেজির স্যার চুপচাপ লক্ষ করছেন তা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর তিনি একটা ছড়ি এনে সেদিন সকলকেই আমাদের পিটিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ক্লাসের মধ্যে গান করতে দেখলে এবার তোদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেব। আর কোনোদিন যেন শুনতে না পাই।
আমরা ভয়ে সেদিন থেকে ক্লাসে কবিগানের তরজা বা লোকগীতির আসর করতে সাহস পেতাম না। টিফিনের সময়ই একটি আমবাগানে গিয়ে আবার আমাদের শুরু হয়ে যেত অনুষ্ঠান। একদিন আমাদের রবিন স্যার বললেন, আগামী পঁচিশে বৈশাখ পালিত হবে রবি ঠাকুরের জন্মদিন। ওই দিন যে যত পারিস কবিতা আবৃত্তি ও রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারবি। তোরা কে কী করবি লিখে তোদের নামগুলি জমা দিবি আমাকে।
পঁচিশে বৈশাখ আসতে তখনো দিন দশেক দেরি ছিল। অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতা চয়েস করেছিল। মেয়েরা কয়েকজন গান গাইবে ঠিক করেছিল। আমি আমাদের পাঠ্য বইয়েরই ‘প্রভাত’ কবিতাটি আবৃত্তি করার জন্য ঠিক করেছিলাম। মাঝে মাঝে টিফিন পিরিয়ডে তা মুখস্থ করেও অভ্যাস করতাম। অন্যান্য সহপাঠীরাও তাই করতো। আমাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল মেয়েরা কে কী গান করে তা শোনার জন্য।
পঁচিশে বৈশাখ সকাল থেকেই হই হই পড়ে গেল স্কুল মাঠে। মঞ্চ বাঁধা হলো। রবীন্দ্রনাথের বড় বাঁধাই করা ছবি টেবিলে রাখা হলো। চারিপাশে সাজানো হলো ফুল দিয়ে। মাথার উপরে টাঙানো হলো একটি বড় ত্রিপল। দুই দিকে লাগানো হলো দুটি বক্স। সকাল থেকেই বাজতে লাগলো রবীন্দ্র সঙ্গীত :
“আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই কিছু
নাই গো॥”
গান শুনতে শুনতে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। বৈশাখের সকালে পরিষ্কার উজ্জ্বল আকাশ। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সামনের বড় বটগাছটিতে কয়েকটি বিভিন্ন জাতের পাখি কাকলি-কূজনে এই অনুষ্ঠানটিকে আরো মুখরিত করে তুলেছে। মাইকে ঘোষণা হলো, প্রথমে রবীন্দ্রের ছবিতে মালা পরানো হবে এবং শঙ্খধ্বনি ও পুষ্প স্তবক দিয়ে কবিকে বরণ করা হবে। তারপর হবে উদ্বোধনী সঙ্গীত। সঙ্গীত গাইবে প্রতিমা ঘোষ। মাইকের ঘোষণায় আমরা নড়েচড়ে বসলাম। প্রতিমা কখন গান গাইতে শিখেছে তা আমাদের জানা ছিল না। তাই তার গান শোনার জন্য প্রবল উৎসাহ দেখা দিল। একে একে ঘোষণামত সব কাজ হতে লাগলো। শেষে মঞ্চে এলো প্রতিমা ঘোষ।
প্রতিমা আমাদের সঙ্গেই পড়ে। চৌদ্দতেই সে গোলাপ কুঁড়ির মতোই স্ফুটনোন্মুখ। শ্যামবর্ণা হলেও দুর্গাপ্রতিমার মতোই তার দুটি চোখ আমাদের আকৃষ্ট করতো। দীর্ঘাঙ্গি লম্বা চুলের অধিকারী রাজহংসীর মতো মাথা উঁচু করে হাঁটতো বলে আরো তাকে ব্যতিক্রমী মনে হতো। তার সুরেলা মধুর কণ্ঠে বেজে উঠল—
“আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো।”
যেখানে এতক্ষণ বক্সে শুনছিলাম, সেই গান জীবন্ত প্রতিমার কন্ঠে শুনতে শুনতে একটা ঘোরের মধ্যে যেন প্রবেশ করছিলাম। সমস্ত সুরের ঝরনা ছাপিয়ে আমাদের বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়ানো যৌবনের অনভিজ্ঞ তরণী যেন প্লাবিত হয়ে চলেছিল। এই একটি গানের সুরেই হৃদয়ের সব সমর্পণ যেন তার উদ্দেশ্যেই নিবেদন করেছিলাম। সেদিন অনুষ্ঠানে আর কোনো গানই মনের দরজা খুলতে পারেনি। নিজের মুখস্থ করা কবিতাখানি মাইকের সামনে বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। লজ্জায় মুখ খানি রাঙা হয়ে গেছিল। মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলাম। আমার এই অবস্থা দেখে সবাই হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। হৃদয়ে তখন প্রথম অভিঘাত শুরু হয়েছে। আছড়ে পড়েছে ঢেউ। সমস্ত বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। সেদিন বাড়ি এসে ভালো করে খেতে পারিনি। বই পড়তে পারিনি। বড় বড় খাতার চার পৃষ্ঠা জুড়ে লিখেছিলাম চিঠি প্রতিমার উদ্দেশ্যে। কী লিখেছিলাম?
লিখেছিলাম হৃদয়ের আকুতি, লিখেছিলাম প্রথম জেগে ওঠা অন্তর্বেদনার কথা, লিখেছিলাম অঙ্কুরিত প্রেমের কম্পন, লিখেছিলাম বাল্যপ্রেমের স্বপ্ন দর্শনের প্রথম সূত্র।
অনেক রাতে বাড়ির বাইরে এসে সেদিন দেখছিলাম বৈশাখী চাঁদের জ্যোৎস্না সারা চরাচর ঘিরে আছে। আলোর কালি দিয়ে কে যেন একটি নাম শুধু লিখে গেছে। নক্ষত্ররাও যেন তারই গল্প করছে পরস্পর। নিশাচর কোনো পাখি উড়ে উড়ে যাচ্ছে সেই গল্পের ভিতর দিয়ে। (চলবে)🍁
🍂কবিতা
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ-এর দু’টি কবিতা
কপাল
সালোকসংশ্লেষ বিবর্তনের দরজায়
আলোছায়ায় মিলিয়ে যায়
অট্টহাসির ইমো
ভালোবাসার চোখে চোখ
রাত্রিতে জুড়ে আছে
মৃত সংলাপ
দরজা
জানালার দুপাশে দুপুরের রঙ
লিকলিকে পাতায় অবাধ যৌনতা
যৌক্তিক উপসংহারে মিলিয়ে যায়
গতজন্মের সাধন কথা
অশোক কুমার রায়
বেশ আছি
ঘরে এখন অসুস্থ সময়ের বসবাস।
নিরাময়ের কি প্রয়োজন
বেশ আছি।
ঘরে ঘরে জন্ম নেয়
আগ্নেয়গিরির মত সারমেয় জলাতঙ্ক।
ওদের হাত ধরে জমে রত্ন ভান্ডারের পাহাড়।
বেশ আছি।
সময় অসুস্থ তাতে কি।
নপুংসকরা পুরুষ নয় বলে
এই সময় অন্ধকারে গা ঢেকে
দিব্যি সময় পার করি।
বেশ আছি
🍂ধারাবাহিক গদ্য / পর্ব ৪
ভাষাতত্ত্বের মৌলিক বিষয় নিয়ে এরূপ উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ দুই বাংলার মধ্যে তিনিই প্রথম রচনা করেন। আর এই গ্রন্থটি ধ্বনিবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। ‘রেহানা বীথি’-এর লেখা ‘ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’- সম্পর্কীত ধারাবাহিক গদ্যের আজকে চতুর্থ পর্ব।
ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর শাসকশ্রেণীর বিরূপ মনোভাবের কারণে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পড়ে কঠিন সংকটের মুখে। আরবি হরফে বাংলা লেখা, আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অত্যধিক প্রয়োগ, বাংলা সাহিত্য থেকে হিন্দুয়ানি বিষয় বর্জন, রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ, এমনকি কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত প্রচাররোধ, এরকম বিতর্কিত কর্মকাণ্ড শুরু হয়। সংস্কৃতির এ দুর্দিনে দৃঢ়চিত্ত আব্দুল হাই পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিভাগে ফিরে তিনি যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বাংলা বিভাগকে পুনর্গঠিত করেন। তাঁর আগ্রহে সৈয়দ আলী আহসান, মুনির চৌধুরী, আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রমুখ কৃতি শিক্ষক বাংলা বিভাগে যোগদান করেন।
মুহম্মদ আব্দুল হাই যখন ১৯৬২ সালে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভ করেন, তখন বাংলা ভাষা ও সংস্কতির অঙ্গনে ছিলো এক দুঃসময়। সেই দুঃসময়েই তিনি গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত ও প্রসারের লক্ষ্যে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। উচ্চমাণের জন্য খুব দ্রুত পত্রিকাটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করে। এ পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি নিরলসভাবে নিজের গবেষণাও চালিয়ে যান তিনি। প্রকাশিত হয় তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪), বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন(১৯৫৮), তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৬০), ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব (১৯৬৪) প্রভৃতি গ্রন্থ। বাংলা ভাষার ধ্বনির গঠন, উচ্চারণ ও ব্যবহারবিধি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে রচিত তাঁর ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ গ্রন্থটি মুহম্মদ আব্দুল হাইকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। গ্রন্থটির বর্ণনা বিজ্ঞানানুগ। বইটির ভাষাভঙ্গি ও রচনাকৌশল এতটাই হৃদয়গ্রাহী যে, এই বইয়ের নিরস তত্ত্বকথাও হয়ে উঠেছে রসপূর্ণ। ফলে এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছেও তা অত্যন্ত সহজবোধ্য এবং আকর্ষণীয়। ভাষাতত্ত্বের মৌলিক বিষয় নিয়ে এরূপ উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ দুই বাংলার মধ্যে তিনিই প্রথম রচনা করেন। আর এই গ্রন্থটি ধ্বনিবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
মুহম্মদ আব্দুল হাই-এর অপর উল্লেখযোগ্য অবদান, বাংলা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত “ভাষা ও সাহিত্য” সপ্তাহ (২২-২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩) পালন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিরোধিতা করা এবং নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা। আয়োজনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিলো এবং সেটা সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছিলো। বিদেশের বৌদ্ধিক সমাজের জ্ঞানের অংশীদার হওয়ার জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে এবং প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রামে যোগদান ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে তিনি দশ মাস মেয়াদে ১৯৬৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর আমেরিকান মিজোরী বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। (চলবে)🍁
🍂কবিতা
দেবাশিস সাহা-এর দু’টি কবিতা
শীতল কবিতা
লাল শীত
শীত এলেই
মনে পড়ে লালের কথা-
সকাল হলেই মুখে কত কিছু মাখতো
এই বাটা ওই গুঁড়ো
মুখ চিকন নরম আর ফর্সা হবে
এই ভরোসায়
ছাই হত
সূর্যের নিভে যাওয়া আলোয়
গোধুলি লগ্নে
মুখে নানা ভেষজ মেখে
দেখে নিত
আলোর চেয়ে সে কতটা
অপরূপ হয়ে উঠেছে
রাত হলেই
লেপের তলায় পা ডুবিয়ে
হাতে পায়ে গোটা শরীরে
মেসেজ করতো
নানা রঙের আর ঢঙের ক্রিম
মাঝরাত অবধি ডলেই যেত
আলো জ্বলতো
ওম মেখে শীত রাত অপেক্ষায়
গোটা শীত জুড়ে
লাল তার শরীর রাখতো নরম
মন তার নরমের লেশমাত্র ছিলো না।
শীতের মানুষ
শীতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে
সর্বনাশ নিয়ে যেসব মানুষ
বেঁচে থাকে
তাঁরা আমার ভাইবোন
আত্মীয়স্বজন
সোমপ্রভা বন্দোপাধ্যায় -এর কবিতাগুচ্ছ
বৃষ্টি ১
গনগনে আঁচে হাঁড়ি বসিয়ে বাজারের দিকে
এগোলে, পায়ে লেপ্টে যায় কাদা
সারারাতের বৃষ্টি ভাসিয়ে দিয়েছে পথঘাট
অথচ আমাদের ভেজার কথা থাকলেও
ভিজেছে কেবল পোশাক মাত্র।
বৃষ্টি ২
তোমার লেখা গল্প পড়ে পাশের পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে দেখি আস্ত একটা চাঁদ ধরা পড়েছে জালে
ফাতনা আটকেছে গলার কাছে
স্বর ভঙ্গের ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছে আকাশ
আর কিছু সময় পরেই পোয়াতি হবে মেঘ।
বৃষ্টি ৩
সারাদিন বৃষ্টির ক্যাকোফনিতে জমছে আসর
ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ ও একবাটি মুড়ির থেকে
উঠে আসছে মুদ্রার বিভঙ্গ
রান্না বাটি খেলায় জম্পেশ আয়োজন
একটা কাক কার্ণিশে বসে বিলাপ করলে
উঠে আসে এক চুটকি সিঁন্দুর কি কিমত।
বৃষ্টি ৪
আজ পড়ার ঘরে আসতেই ধাক্কা খেলাম
যাঁদের বুকে নিয়ে যত্নে রাখতাম
তাঁরা অবহেলা পেয়ে সরে গেছে দূরে
কবিতা থেকে বিচ্যুত হয়েছে যাপন
এখন বৃষ্টি এলেই কাপড় তোলার পালা।
বানীব্রত
এ কোন স্বাধীনতা
কোথায় গেল সেই স্বাধীনতা
ভ্রষ্টাচারে হারিয়ে যায় দেশপ্রেম
চারদিকে শুধু জিঘাংসা
ক্রুর লোলুপতা
মিথ্যাচারে সাজানো প্রতিশ্রুতি।
উপর থেকে ফেলে মারে
কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে,
প্রমান লোপাট, চাপা কান্না
স্বজন হারানো ব্যাথা
চারদিকে ক্ষণিকের বিক্ষোভ মিছিল…
মা বাবার লালিত রাজকন্যা
ডাক্তারি পড়তে গেল
দুর্বৃত্তদের লোলুপ বাসনায়
নগ্ন হলো সমাজ, জায়গা হল খবরের শিরোনামে
নামি হাসপাতাল, সাদা অ্যাপ্রোন, রুগীর সেবা
তারই মাঝে ভয়াল রাত কেঁদে ওঠে।
পিসাচের দাঁত নখে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত
সাদা অ্যাপ্রোনে রক্তের ছিঁটে,
রক্তে ভিজেছে সারা শরীর, ক্ষত- বিক্ষত জন্মস্থান
বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারও কানে যায় না কারোর
অবশেষে নিথর হল দেহ তাতেও পিশাচের কুকর্ম।
অপরাধীদের বাঁচাবার জন্য তথ্য লোপাট
সন্তান হারা বাবা-মা শোকে মৃয়মান
হায় রে স্বাধীনতা, হায় রে দেশপ্রেম
স্বাধীনতা, লজ্জার চাদরে মুখ ঢেকে কি খুঁজছ?
রক্তের দাগ নাকি রক্তে রাঙানো স্বপ্নগুলো!
স্বপন কুমার ধর
আনমনে
একটু স্পর্শ, মিষ্টি হাসি, আর-
আধফোঁটা মুখ নিঃসৃত শব্দগুলো,
বদলে দিয়েছিল আমাকে,
ভুলিয়ে দিয়েছিল, প্রিয়াহীনের
অদৃশৃ যন্ত্রণা, আবছা হচ্ছিল স্মৃতি।
ডেকে সে ছাড়াতো শয্যা,
হয়তো বলতে চাইত-
“ওঠো খেয়ে নাও”, “বেরোতে হবে”,
কর্ম জীবনের দৈনিক রুটিনে।
ভরসা যোগাত, আশ্বস্ত করত,
জীবনের প্রতি ক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেই, তার দর্শনে
দুর হত সমস্ত ক্লান্তি, চিন্তা, অবসন্নতা।
পাশে এসে বসে শোনাত,
সারাদিনের অভিযোগ, অনুযোগ, আর-
শেষে চলত তার মান-অভিমান,
ভাঙানোর পালা, আদরের পালা।
এমনি করেই কাটছিল, আনন্দের দিনগুলি,
আর চলছিল অতীত বিয়োগ যন্ত্রণার উপর প্রলেপ।
হঠাৎ একদিন নিয়তির ডাকে অকালে,
সে ও, কন্যাও চলে গেল,
আর আমি হয়ে পড়লাম, একা
সম্পূর্ণ একা, প্রকৃত একা, আর-
আজ ও খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাদের
নিজেরই আনমনে, অজানা জগতে,
যদি একটিবার, অন্তত একটিবার,
স্ব-বিলীন এর আগে, কোথাও দেখা পাই!
শুভমিতা মনার্ক
ভালোবাসার ওম
তোমাকে নীরবে কুড়িয়ে নিয়েছি বুকের ভিতর
অথচ তুমি সে কথা জানতেই পারোনি
জানো, তোমাকে ভাবলেই
লাল নীল বৃষ্টির জল
চিকচিক করে আমার চিবুকে
তীব্র অপেক্ষায় থাকতে থাকতে
হৃৎপিন্ড ছটফট করে,
জ্বর আসে,
শোয়ার ঘরে ভেসে আসে ছাতিম গন্ধ
বসন্ত এলে, তোমাকে স্পর্শ না করার অনুভূতি
আমাকে একা দাঁড় করিয়ে
রাখে নীলচে জানালার কাছে
যেখানে আমার চোখের জলে
চাঁদের আলোটুকুও গলে যায়
অথচ তুমি কখনো প্রশ্নই করোনি
তোমার সামনে দাঁড়ালে কেনো কেঁপে ওঠে আমার কণ্ঠস্বর
সবটুকুর পরেই নিস্তব্ধ থাকি
ভালোবাসার ওমের জন্য
তুমি না জানলেও আমি জানি,
তোমাকে ভালোবাসা আমার কাছে
ঈশ্বর আরাধনার মতোই শান্তির
🍂গল্প
চারিদিকে কি হয় কি হয় ভাব! পত্র-পত্রিকায় শিউরে ওঠা খবরাখবর পেয়ে উদ্বিগ্ন জীবন সঙ্গিনী দময়ন্তী। বেতার, প্রচার মাধমে দেখা গেল বিজয়ের ছবি। বন্দী শিবিরে। সাহসে ভর করে ছুটে গেলেন পত্রিকা অফিসে, গেলেন সরকারি দপ্তরেও।
গল্প নয়
কুণাল কান্তি দে
দিল্লী বিমান বন্দরে দেখা না হলে জানতে পারতাম না পঞ্চাশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন, যে নারী তাঁর বীর স্বামী পাইলট ক্যাপ্টেন বিজয় তাম্বেকে কি ফিরে পাবেন? এ দেশের ব্যাডমিন্টন তারকা পাঁচবারেরও বেশী অর্জুন পুরস্কার পাওয়া খেলোয়াড় দময়ন্তী তাম্বে অগ্নি সাক্ষী করে বিয়ে করেছিলেন যাকে তাঁর সঙ্গে “সাজানো ঘর” বাঁধতে জীবন শুরু করেছিলেন। দুর্ভাগ্য মাত্র দুই বছরের কম সময়ে দেশ মাতৃকার সেবার জন্য আকাশে লড়াই করে শত্রু সেনাকে পরাজিত করবে। তখন কতই বা বয়েস? দময়ন্তীর তেইশ, স্বামীর তিরিশেরও কম। দুর্জয় সাহস। ১৯৭১ / ১৯৭২ সালে পাকিস্তান-এর সঙ্গে ভারতের মহারণ। স্থল, জল, আকাশে বারুদের গন্ধ। মরণপণ লড়াই। স্বপ্ন ভঙ্গ করে ভীষণ লড়ে পরাজিত হননি তিনি। চারিদিকে কি হয় কি হয় ভাব! পত্র-পত্রিকায় শিউরে ওঠা খবরাখবর পেয়ে উদ্বিগ্ন জীবন সঙ্গিনী দময়ন্তী। বেতার, প্রচার মাধমে দেখা গেল বিজয়ের ছবি। বন্দী শিবিরে। সাহসে ভর করে ছুটে গেলেন পত্রিকা অফিসে, গেলেন সরকারি দপ্তরেও।
কীভাবে মুক্তি পাবে বিজয় তারই উদ্যোগ। সহানুভূতি, আবেগে ভেসে গেল, দেশ। শুধুমাত্র এক বিজয় ছাড়াও এমন অনেক বীর সন্তান আছেন তাদের জন্য কুটনৈতিক প্রয়াস চলল। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক প্রচার প্রসার হল। “সাজানো ঘর”তেমনি পড়ে রইল। কখনও বিজয়ের বাবা শ্বশুর মশায়ের সঙ্গে দিল্লী কলকাতা, সংসদের অলিন্দে, রাষ্ট্রপতি ভবনে কিভাবে মুক্ত করে আনা যায়! এই চিন্তায় নুতন সাহস সঞ্চয় করে নূতনভাবে পদক্ষপ। পাকিস্তান সরকারের কাছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যার সঙ্গে দেখা করা। ছোটাছুটি থামেনি। যুদ্ধ থেমেছে। নুতন দেশের জন্ম হয়েছে, প্রশাসক বদল হয়েছে। কিন্ত দময়ন্তীর পথ চলা পঞ্চাশের বেশী বছর হয়ে গেল। দীর্ঘ লড়াই করেও ক্লান্তি নেই।
বয়েস সত্তর পেরিয়েছে। বেঁচে থেকে যে স্বামী বাড়ি ফিরতে পারেননি । HOPE DIES LAST IN WAR গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। বিজয়দের কথা লেখা সেই বইয়ে। দেশের আম জনতা সহানুভূতি দেখিয়েছে, প্রশাশকের দল অসহায় অনুভূতি জানিয়েছেন। কিন্তু ৭৩ বছরের দময়ন্তী পর পর INTERVIEW দিয়ে চলেছেন “সাজানো ঘর” একইভাবে আছে। বিমান বন্দরে বসে এক নারীর বীরত্বের কথা শুনেও ইতিবাচক উত্তর দিতে পারিনি। সাজানো ঘর কতদিন সাজানো থাকবে জানি না। বিজয় কি ঘরে ফিরবে? কেউ কি ভরসা দেবে ? চোখের জল আর নেই দময়ন্তীর।🍁
তথ্য সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
🍂অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
**

3 thoughts on “Sasraya News Sunday’s Literature Special | 1st December 2024 | Issue 41 || সাশ্রয় নিউজ | রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪১”