Sasraya News

Friday, March 28, 2025

Sasraya News Sunday’s Literature Special | 16th February 2025 | Issue 52 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | সংখ্যা ৫২

Listen

সম্পাদকীয় 


 

বসন্তের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে গাছেদের হাসি। পলাশ শিমুল। ডালে ডালে আমের মুকুল। মোহো মোহো করছে চারপাশ। তার আশপাশ জুড়ে কতই না প্রাণ মঞ্জুরিতে এসে বসছে। তাদের আগমন মনে করিয়ে দিচ্ছে সামনেই এগিয়ে আসছে দোল। বসন্ত উৎসব। ভালোবাসার আরও এক দিগন্ত দিন। রবি ঠাকুরের গান আর কবিতায় বসন্ত যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বসন্তের উৎসব এই ভারতবর্ষ জুড়েই পালিত হয় ভিন্ন ভিন্ন রূপে। এর আগের বছর আমাদের “সাশ্রয় নিউজ”এ লিখেছিলেন কবি মমতা রায় চৌধুরী। কবি সানি সরকার সহ অনেকেই। এই বছরও আরও অনেকেই লিখবেন আশা করি।
আজকের প্রচ্ছদ পর্বের যে বিষয় সেই বিষয় নিয়ে তেমন লেখা না এলেও অনেক অনেক ভালো লেখা সবার জন্য রয়েছে। হাজার হাজার পাঠক তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন আমাদের।

 

 

 

এই বারের প্রচ্ছদ পর্বে রেখেছিলাম সামাজিক পোষ্য।  তাদের নিয়ে আমাদের সম্পর্ক অটুট। কারণ তারা দেশি পোষ্য হয়ে অবহেলার শিকার হয় ঠিকই কিন্তু, এটা কি ভেবে দেখেছেন কেউ! যে, তারা আমাদের সমাজের কত বড় বড় উপকার করে থাকে! জেনেও জানেন না অনেকেই। তাদের এক মুঠো খাবার দিতে অনেকেই পেছপা হয়ে যান। এমন কিছু মানুষ এখনও সমাজে বর্তমান। যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবেই চিনি।  তাঁরা নিজের সন্তানের মতন যত্ন করেন। কোনও বিলাতি নয় এই দেশি পোষ্য। সমাজের কিছু মানুষ যদি নিজেদের খাদ্যের এক মুঠো অন্ন তুলে রাখেন তাতে তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে না বরং উপকারই হবে এগিয়ে আসেন তাহলেই। মন শান্ত হবে। এমন কি শরীর মন ও আত্মার তৃপ্তি এবং সামাজিক কাজে নিজেকে ঘরে বসেই হাত লাগিয়ে দিতে পারবেন। আমরা অনেকেই সামাজিক কাজ করবার চেষ্টা করি। এটা যে অনেক সহজ কাজ অথচ কঠিন হয়ে গেছে আমাদেরই ভুল অভ্যাসের উপর নির্ভর করে। প্রতিটি পরিবারের যদি একজন ব্যক্তি একমুঠো অন্ন দান করেন তাহলে কোনও পোষ্যই অভুক্ত থাকেন না। যদি ভুল কিছু মনে করে থাকেন কেউ তাহলে ক্ষমা করবেন। কিন্তু এইটুকু বলব প্রকৃতির ভগবান এই সমস্ত পোষ্যরাই।🍁

 

 

🍂মহাজীবনের কথা 

 

লাটু মহারাজ (স্বামী অদ্ভুতানন্দ) 

 

 

“এ ছেলেটি বেশ শুদ্ধ-সত্ত্ব, তোমার যখন যা প্রয়োজন হবে একে বলো, এ করে দেবে।” ঠাকুর নিশ্চল লাটুকে ধ্যান থেকে তুলে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে এইভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে মায়ের সেবায় নিযুক্ত করলেন। সরল লাটু সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করে বলতেন,”দেখো! মা কত কষ্টে না দিন কাটিয়েছে। মার মত বৈরাগ্য হামনে দেখে নি। আউর তাঁর দয়ার কি তুলনা আছে? হামার বহু ভাগ্য যে, উনি হামাকে মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন—মায়ের কৃপায় হামার জীবন তো সার্থক হয়ে গেছে।” এই অদ্ভুত বালক মায়ের সঙ্গে কখনও ছেলের মতো কখনও পিতার মতো মান-অভিমান করতেন— মা ছাড়া তাঁকে আর কেউ বুঝতে পারতেন না। বলরামবাবুর বাড়ি থেকে মা জয়রামবাটী যাচ্ছেন। বুঝিবা মনের আবেগ চাপা দিতে সন্ন্যাসী লাটু মায়ের সঙ্গে দেখা না করে নিচের তলায় পায়চারি করতে করতে বলে চলেছেন, “সন্ন্যাসীকো কো পিতা, কো মাতা, সন্ন্যাসী নির্মায়া।” মাও দরজার কাছে এসে বললেন, “বাবা লাটু! তোমার আমাকে মেনে কাজ নেই বাবা।” আর যায় কোথায়, রুদ্ধ আবেগ মুক্ত হয়ে গেল, কান্নায় ভেঙে পড়লেন লাটু মায়ের চরণতলে। মার চোখেও জল। অমনি পিতার মতো লাটু তাঁর চাদর দিয়ে মায়ের চোখ মুছিয়ে দিলেন, “বাপের ঘরে যাচ্ছ মা! কাঁদতে কি আছে? আবার শরোট্ তোমায় শীগগির এখানে নিয়ে আসবে, কেঁদো না মা! যাবার সময় চোখের জল ফেলতে আছে কি?”

পরবর্তী কালে লাটু মহারাজ নিজের অনুপম ভাষায় মায়ের সম্পর্কে আপন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন: “মাকে মানা কি সহজ কথা রে। তাঁর (ঠাকুর) পূজা তিনি গ্রহণ করেছেন, বুঝো ব্যাপার। মা-ঠাউন যে কি, তা একমাত্র তিনি বুঝেছিলেন আর কিঞ্চিৎ স্বামীজী বুঝেছিলেন তিনি যে স্বয়ং লক্ষ্মী।…🍁

 

🍂ফিচার 

 

নারীকে একজন পুরুষের সমপর্যায়ের মর্যাদা তো দেওয়া দূরে থাক, উল্টে তাকে মহাকাব্যের পুরুষ – চরিত্ররা পুরুষের ওপর চরমভাবে সার্বিক অর্থে নির্ভরশীল দুর্বল জীব হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়েছেন সব সময়ই। এর ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোই জারি থেকেছে। রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা একজন পুরুষ। খুব সহজেই তাই রামচন্দ্রকে সমগ্র ভারতীয় সমাজের আদর্শ পুরুষের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কবি চন্দ্রাবতী রামকাহিনী রচনায় স্বতন্ত্র মনীষার পরিচয় দিয়েছেন , যা যুগ যুগ ধরে পুরুষ – কবিদের হাতে লিখিত প্রচলিত রামকাহিনীর মাহাত্ম্যকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ফলে তাঁর এই পালাটি নিম্নবর্গীয়, বিশেষত পল্লীসমাজের নারীর, ঘরোয়া রমণীর আচার – অনুষ্ঠানে আজ ও সমাদৃত। লিখেছেন : হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় 

 

চন্দ্রাবতীর রামায়ণে সীতায়ন 

 

 

‘নারীত্ব’ আর ‘কবিত্ব’ যে গুণগতভাবেই পরস্পর বিপরীত বস্তু, এই উপলদ্ধিই চন্দ্রাবতীকে মহিলা – কবি হিসেবে তুলে ধরার প্রধান কারণ। প্রকৃতপক্ষে চন্দ্রাবতী মহিলা হয়ে কাব্যচর্চা করছেন সেইটেই বড় কারণ হয়ে উঠেছে ঠিক এ কারণেই আধুনিক সমাজেও’পুরুষ -কবি’ বলে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। ভাবটা এমন যেন কবিতা লেখার মত ‘স্বাভাবিক’ কাজ পুরুষের নেই। ঠিক সেকারণেই পন্ডিতমহলে চন্দ্রাবতীর পরিচয় নিয়ে কথা উঠলেই সেই চিরাচরিত ‘ রোমান্টিক জীবনকাহিনী’র কেচ্ছাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটু বিশদে বলা যাক। যখনই চন্দ্রাবতীর কাব্যচর্চার বিষয় উঠে এসেছে তখনই জয়ানন্দের সঙ্গে তাঁর প্রেমকাহিনী এবং পরবর্তীতে মুসলিম নারীকে বিবাহজনিত করুণ বেদনার কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খুব সুকৌশলে চন্দ্রাবতীকে পরোক্ষ নিষ্ক্রিয় সত্তায় পৌঁছে দেওয়া হয়। ফলে কর্তা কিন্তু থাকলেন সেই পুরুষটি। অবশ্যই চন্দ্রাবতীর ‘ মলুয়া’ ,’ দস্যু কেনারামের পালা’ নিয়ে সমালোচনা কিছু হয়েছে কিন্তু চন্দ্রাবতীর রামায়ণের তাৎপর্য নিয়ে কাউকেই বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের কৃষি সমাজের নিম্নবর্গীয় প্রান্তিকতাকে ভেদ করে প্রথম যে নারীর স্বর আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সাহিত্যওয়ালাদের দরজায় কড়া নেড়েছিল , তিনি ছিলেন চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতীর জন্ম সাড়ে ৪শ‌ বছর আগে, ১৫৫০ সালে। কিশোরগঞ্জ জেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের পাতুয়ারি গ্রামে। মা সুলোচনা দেবী পিতা দ্বিজ বংশীদাস। পিতা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মনসামঙ্গলের কবি। গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই সময় দাঁড়িয়ে পিতার সঙ্গে একসঙ্গে মনসা ভাসানের গান রচনা করেছিলেন তিনি । তাঁর রচিত বিভিন্ন মেয়েলি ব্রতকথা, প্রাচীন আচার – পদ্ধতি অবলম্বনে বিভিন্ন কবিতাও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত তাঁর ‘ দস্যু কেনারামের পালা’ দীনেশচন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ গীতিকায় স্থান পেয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনেক পুরুষের মাঝে যে মহিলার নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন এই কবি চন্দ্রাবতী। কৃত্তিবাস ওঝা, মাধব কন্দলি, শঙ্কর দেব, নিত্যানন্দ আচার্য, রামশঙ্কর দত্ত, দ্বিজ লক্ষ্মণ নামের সঙ্গে চন্দ্রাবতী নামটি স্বমহিমায় জ্বল জ্বল করে। সম্পূর্ণ মৌলিক চিন্তা ভাবনায় বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করে সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন।

মহাকবি বাল্মীকি যে অনুক্রমে রামায়ণ লিখেছিলেন, তখনকার দিনের কোনো কবিই সে অনুক্রম ভাঙতে সাহস দেখাননি। প্রথম বাঙালি কবি চন্দ্রাবতী সেই সাহস দেখিয়েছিলেন। তিনি প্রথম মানুষী যিনি রাম নয় রাবণকে গুরুত্ব দিয়েছেন। রামায়ণের স্বতন্ত্রতা চন্দ্রাবতীর জীবনচর্চা থেকে উঠে এসেছে বলেই বোধ হয়।

পৃথিবীর সব মহাকাব্যই পুরুষের রচিত; পুরুষের গৌরবগাথার বয়ান। নারী সেখানে পুরুষের হাতের পুতুল মাত্র। কখনও সে পুরুষের থাবার মধ্যে, কখনও অপহৃতা। (সেখানে পুরুষ তাকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে)। অর্থাৎ নারীকে একজন পুরুষের সমপর্যায়ের মর্যাদা তো দেওয়া দূরে থাক, উল্টে তাকে মহাকাব্যের পুরুষ – চরিত্ররা পুরুষের ওপর চরমভাবে সার্বিক অর্থে নির্ভরশীল দুর্বল জীব হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়েছেন সব সময়ই। এর ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোই জারি থেকেছে। রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা একজন পুরুষ। খুব সহজেই তাই রামচন্দ্রকে সমগ্র ভারতীয় সমাজের আদর্শ পুরুষের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কবি চন্দ্রাবতী রামকাহিনী রচনায় স্বতন্ত্র মনীষার পরিচয় দিয়েছেন, যা যুগ যুগ ধরে পুরুষ – কবিদের হাতে লিখিত প্রচলিত রামকাহিনীর মাহাত্ম্যকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ফলে তাঁর এই পালাটি নিম্নবর্গীয়, বিশেষত পল্লীসমাজের নারীর, ঘরোয়া রমণীর আচার – অনুষ্ঠানে আজ ও সমাদৃত।

 

 

কবি চন্দ্রাবতী তাঁর রামায়ণ -গানে কোনো প্রকার ভক্তিরস , বীররস, শৃঙ্গার রস তুলে ধরেননি। শুধুমাত্র মধুর আর করুণ রসকে আশ্রয় করে কাহিনী নির্মাণ করেছেন। কবি সীতাকে তাঁর রচনায় মুখ্যরূপে দেখিয়েছেন, প্রচলিত রামায়ণকারদের পথে না হেঁটে সীতার জীবনকেই পাঠককুলের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সীতার দুঃখ – কষ্টকে তিনি তার নারী – মনোভাব দিয়ে উপলদ্ধি করেছিলেন। তাই রামকে তিনি কোনো কোনো স্থানে সমালোচনা করতে পিছুপা হননি। ঠিক সে কারণেই, প্রথাবিরুদ্ধ এই রামায়ণ গান গ্রহণযোগ্যতার বিনিময়ে নিন্দিত হয়েছে।

‘পরিশীলিত’ রামায়ণে সাতটি কান্ড রয়েছে, যার মধ্যে উত্তরাকান্ড একটি। এই উত্তরাকান্ডেই সীতার বনবাস ও তাঁর ধরিত্রী- প্রবেশ ঘটে। চন্দ্রাবতী এই কান্ডটিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করেছেন তাঁর রামায়ণে। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ তিন খন্ডে বিভক্ত। এটিও প্রচলিত অর্থে ঐতিহ্যবিরোধী। প্রথম খন্ডটি তিনি সীতার জন্মকালীন ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ করেছেন, যেখানে সীতার পৌরাণিক কাহিনী অনুসরণ করা হয়নি। দ্বিতীয় পরিচ্ছদে দেখা যায়, ‘সীতার বারমাসী’, যেখানে সীতা সখীদের সঙ্গে বসে আছেন, তাঁর জীবনের সুখ -দুঃখ তিনি সখীদের কাছে গল্পচ্ছলে বলে চলেছেন। তাঁর বাল্যের কথা, বিবাহের কথা, রাবণ কর্তৃক তাঁর হরণের কথা, অশোক বনে তাঁর বন্দিদশার কথা, রামের জন্য তাঁর বিরহ কাতরতার কথা, রাম কর্তৃক তাঁর উদ্ধারের কথা এবং অযোধ্যায় তাঁর প্রত্যাবর্তনের কথা। তৃতীয় পরিচ্ছেদে চন্দ্রাবতী ও সীতা উভয়েই কথকের ভূমিকা নিয়েছেন। এ পরিচ্ছেদে কবি তাঁর আত্মপোলদ্ধি দিয়ে রামায়ণের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাম যখন তার বোনের কথায় বিশ্বাস করে চরম ক্রোধে ফেটে পড়ে, তখনকার পরিস্থিতিটি কবি তার নিজের বয়ানে হাজির করেন:

বনেতে আগুনি জ্বলে গো সায়রে ছোটে বোন

উন্মত্ত পাগলপ্রায় গো বসিলেন রাম।।

রাঙা জবা আঁখি রামের গো শিরে রক্ত ওঠে।

নাসিকায় অগ্নিশ্বাস ব্রহ্মরন্ধ্র ফুটে।।

যে আগুন জ্বালাইল আজ গো
কুকুয়া ননদিনী।

সে আগুনে পুড়িবে সীতা গো সহিত রঘুমণি।।

পুড়িবে অযোধ্যাপুরী গো কিছুদিন পরে।

লক্ষ্মীশূন্য হইয়া রাজ্য গো যাবে ছারখারে ।‌।
পরের কথা কানে লইলে গো নিজের সর্বনাশ।

চন্দ্রাবতী কহে রামের গো বুদ্ধি হইল নাশ।।
রামের চরিত্রের এই রূপ কিন্তু আর কোথাও নেই। এখানে সীতার দুঃখে কবির কাতরতা, রামের প্রতি তাঁর ক্ষোভ – এগুলো খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন কবি। বলাইবাহুল্য তদানীন্তন কালে দাঁড়িয়ে এমন দৃপ্ত উচ্চারণ ‌একদম ভিন্ন চিন্তনের ছাপ রাখে সমাজে। বিশেষকরে নারীদের ঘরোয়া আসরে তারা চন্দ্রাবতীর গান গেয়ে সীতার জীবনের নানা সুখ – দুঃখের সঙ্গে নিজেদের সুখ- দুঃখে একাত্ম হতে পারতেন।

সমগ্র রামায়ণটিকে শেষ করেছেন তিনি সীতার বনবাসের সূচনার ভেতর। তাঁর রচনার স্টাইল পুরো ভিন্ন রীতির। রামায়ণে সীতার অগ্নিপরীক্ষার পরেও শেষ পর্যন্ত রামকে চরম প্রজা হিতৈষী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু চন্দ্রাবতী ভিন্ন রীতিতে হাঁটলেন। তিনি একজন নারী হয়ে অপর নারীর অপমান কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। বরং এই ঘটনায় রামের প্রতি তীব্র বিদ্রুপ ডেকে আনলেন এবং রামকে পাষণ্ড ও সন্দেহপ্রবণ স্বামীরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোনোরকম রাম বন্দনার ধার তিনি ধারলেন না। একজন নারীর এমন মনোবল সেই যুগে এ যেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কবি চন্দ্রাবতী এই ব্যতিক্রমী রামায়ণটি রচনা করেন তার জীবনের শেষ পর্যায়ে। আজ থেকে বহু বছর আগে কবি চন্দ্রাবতীর জীবনাবসান ঘটেছে , কিন্তু তার এই রামায়ণ – গান আজও সেই অঞ্চলের মেয়েরা তাদের নিজস্ব উৎসব অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকেন। এটাই কবির রামায়ণ রচনা সার্থকতা। পুরুষতান্ত্রিক এই ঘুণ ধরা সমাজে সাহিত্য- শিল্প -সংস্কৃতি সমস্ত কিছু পুরুষের দ্বারা নির্ধারিত হলেও আজও পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা তাদের সমাজে চন্দ্রাবতীর রামায়ণকেই বেছে নিয়েছেন পৌরাণিক পুরুষ -সাহিত্যিকের রামায়ণকে বয়কট করে। এখানে নারীবাদী কবির চিন্তনের ছাপ স্পষ্ট হয়েছে গরিব নারীদের এই রামায়ণী গানকে আপন করে গাওয়ার মধ্য দিয়ে। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গানও নারীরা সম্মিলিতভাবে উপস্থাপন করে, যে গানে ধ্বনিত হয় সীতার মহিমা, সীতার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়। তার জন্ম -বিবাহ- সন্তানধারণ- স্বামী পরিত্যক্ত হওয়া, সন্তান নিয়ে একাকী জীবন কাটানো। অর্থাৎ একটা নারীর জীবনে যে সমস্ত বিষয় প্রায়শই ঘটে থাকে, সেই সব বিষয় এই রামায়ণের গানে বড় করে এসেছে। যার জন্য সমাজের শোষিত প্রান্তিক নারীরা এই রামায়ণ গানের সঙ্গে সহজেই শামিল হতে পারে। সীতার কষ্ট- বেদনার সঙ্গে নারীরা তাদের নিজেদের দুঃখ-বেদনাকে সীতার বেদনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে সীতার কষ্টে কাতর হয়। নারীদের রামায়ণ হয়ে ওঠে নারীদের ইতিহাস, নারীদের নিজস্ব স্বর। এখানে অবশ্যই বলতে হয় চন্দ্রাবতীর অনেক পরে উনিশ শতকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রচলিত রামকথার একটি বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ বুনেছিলেন ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’। যদিও নারীর ভাষ্য এতে ছিল না তবে তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যে সেই চেষ্টাটি আছে। রেনেসাঁ প্রভাবিত মনন দিয়েও মধুসূদন যে কাজটি করতে পারেননি বহু বছর আগে সপ্তদশ শতকে সেই কাজটি করে ফেলেছিলেন চন্দ্রাবতী। মধ্যযুগের প্রবল ঈশ্বরবিশ্বাসী পরিবেশের মধ্যে কোথা থেকে এমন দৃষ্টিকোণ পেলেন চন্দ্রাবতী? সেও বড় বিস্ময়!

সমগ্র রামায়ণটি তিনটি পরিচ্ছদে বিভক্ত। প্রথম পরিচ্ছেদে আছে , লঙ্কার বর্ণনা, রাবণের স্বর্গ জয় করিতে গমন, রাবণ কর্তৃক মর্ত্য ও পাতাল বিজয়, সীতার জন্মের পূর্ব -সূচনা, মন্দোদরীর গর্ভসঞ্চার ও ডিম্ব -প্রসব, মাধব জালিয়া ও সতা জাল্যানী , রামের জন্ম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ- সীতার বারোমাসী, এরপর তৃতীয় পরিচ্ছেদ- সীতার বনবাসের পূর্ব সূচনা।

কথিত আছে, শিব তখন বনে বাস করতেন , একদিন বিশ্বকর্মা একটা লাঠি দিয়ে বলেন যে পেছনদিকে না তাকিয়ে একটা দাগ কাটতে। যে- ই শিবের দাগ কাটা শেষ হল, সঙ্গে সঙ্গে সোনার লঙ্কা নির্মিত হল। তারপর উৎসব হল। শিব তখন রাবণকে জিজ্ঞাসা করেন এই যে সোনার লঙ্কা তৈরি করা হল, এর জন্য তিনি কি পুরস্কার চান? রাবণ সোনার লঙ্কা ফিরে চাইলেন। ফিরে চাইছেন মানে তা আসলে তাঁরই ছিল। শিব তখন পর্বতে তাঁর নিজের জায়গায় ফিরে যান। সেই লঙ্কার বর্ণনা দিয়েই চন্দ্রাবতী শুরু করেছেন তাঁর রামায়ণ। বাল্মিকী বা কৃত্তিবাস রাবণকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন, চন্দ্রাবতী সম্পূর্ণ অন্যভাবে দেখেছেন এবং চিত্রিত করেছেন। কারণ বীর কখনও বিষ প্রয়োগের শত্রু নিধন করতে চায় না। বিষ প্রয়োগ কাপুরুষের কাজ , সেই নিজকর্ম লঙ্কেশ্বর কেন করবেন? আরো দেখার যে লঙ্কেশ্বর এতদিন পর দেশে ফিরে স্ত্রীকে সঙ্গ না দিয়ে পরোনারিদের সঙ্গে জলকেলি করতে চলে গেছেন। এই অপমানে মন্দোদরী মরতে চাইলেন। যে বিষ রাবণ এনে রেখেছিলেন ইন্দ্রাদি দেবতাদের জন্য এবং রেখেছিলেন মন্দোদরীর জিম্মায় মনের দুঃখে মন্দোদরী সেই বিষ পান করলেন। দশ মাস দশ দিন পরে একটি ডিম প্রসব করলেন সংবাদটা শুনে রাবণ জ্যোতিষী ডাকলেন। অনেক হিসেব-নিকেশ করে জ্যোতিষী বললেন– অবধান করো আজি গো রাক্ষসের নাথ।
সুবর্ণ লঙ্কার কশিরে গো হইল বজ্রঘাত।।

এই ডিম্বে কন্যা গো এক লোভিল জনম।
তা’ হইতে রাক্ষস -বংশ গো হইবে নিধন।।
আর এক কথা শুন গো রাক্ষসের পতি।
কন্যার লাগিয়া বংশে গো না জ্বলিবে বাতি।।

দৈবের নির্বন্ধ কভু খন্ডান না যায়।
আপনি মরিবে রাজা গো এই কন্যার দায়।।
রাক্ষসের রক্ষা নাহি গো গণিলাম সার।
সুবর্ণের লঙ্কাপুরী হইল ছারখার।।‌

অতঃপর রাবণের আদেশে সেই ডিম একটা বিশেষ কৌটো করে ভাসিয়ে দেওয়া হল।

এরপর নতুন দুটো চরিত্র আসছে, যা রামায়ণের পাঠকদের কাছে অপরিচিত।
খুব দুঃখী অভাবী একজন জেলে ও তার স্ত্রী, তাদের নাম যথাক্রমে মাধব ও সতা। একদিন সেই মাধব সারাদিন জাল টেনে একটাও মাছ পাননি। বারবার মাছ না পেয়ে শেষবারের মতো ঈশ্বরের নাম করে জাল ফেলে এবং মাছ ধরতে গিয়ে জালের মধ্যে সোনার কৌটো পায়। “চন্দ্রাবতী কহে , মাধব গো ঘরে ফিইরা যাও/ পোহাইল দুঃখের নিশি গো সুখে বৈস্যা খাও।” সেই দিন থেকে মাধবের অবস্থা ফিরে গেল। পাড়া-প্রতিবেশী এবং পরিচিতরা এই নিয়ে আলোচনা করত। সমগ্র রামায়ণের গতিপথ পাল্টে গেল। সমগ্র রামায়ণে সীতা এক বোন থাকলেন। অথচ চন্দ্রাবতী রামায়ণে সতার থেকে সীতার নামকরণ হল। অথচ বাল্মিকী রামায়ণে এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার জন্মকালীন কাহিনী অন্যভাবে বিবৃত আছে।
রামের জন্মবৃত্তান্তেও তিনি পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কথা বলেননি। বলেছেন পুত্র না থাকায় মনের দুঃখে দশরথ অনশনে বসেছিলেন। তখন এক সাধু এসে দশরথের হাতে একটা ফল দিয়ে বলেন রানীদের খাওয়াতে। কৌশল্যকে দিলে তিনি তিন ভাগ করে তিনজনে খান এবং গর্ভবতী হন। অর্থাৎ রামের জন্মকথাও প্রচলিত গল্প থেকে পাল্টে গেছে।

পরবর্তী পরিচ্ছদে সীতার বারোমাসী বর্ণিত হয়েছে। এখানেও অভিনব কায়দায় গতানুগতিক রামায়ণের গল্পকে সরিয়ে রাখলেন। সীতার পাঁচসখীর একজন জিজ্ঞাসা করছে, ” তুমি যে গেছ্লা গো সীতা এই বনবাসে।/ কোন্ কোন্ দুঃখ পাইয়া ছিলে গো, কোন্ কোন্ মাসে।” সখি শুধু দুঃখের কথা জিজ্ঞাসা করেছে। তার উত্তরে সীতা বলেছেন, তার জন্ম বিবাহ বৈশাখ মাসে বনবাস, স্বর্ণমৃগ , অপহরণ ইত্যাদি প্রতিমাস অনুযায়ী লিখেছেন। পড়লে মনে হয়, সীতা বৈশাখ মাস থেকে চৈত্র মাস অবধি অযোধ্যার বাইরে ছিলেন। সীতার বারমাসী পড়ে মনে করা সম্ভব হয় না, এই বারোমাসে চোদ্দ বছরের কথা বলেছেন। সেদিক থেকে এখানেও নতুন রামায়ণ তৈরি হয়। এই পরিচ্ছেদ শেষ হচ্ছে–
সীতার বারমাসী কথা গো দুঃখের ভারতী।
বারোমাসে দুঃখের কথা গো ভনে চন্দ্রাবতী।‌।

অন্তিম বা তৃতীয় পরিচ্ছদের শিরোনাম– সীতার বনবাসের পূর্ব- সূচনা। অর্থাৎ বনবাসে যাওয়ার আগের ঘটনা। রাম সীতাকে লঙ্কা থেকে উদ্ধার করে অযোধ্যায় নিয়ে এসেছেন। সখী পরিবৃত হয়ে সীতা সবসময় থাকছেন। এমত অবস্থায় রাম কি করছেন? রাম পাশা খেলায় বাজি ধরেছেন। হারলে হাতের বহুমূল্য আংটি খুলে দেবেন আর জিতলে সীতা ” দিবেগো প্রেম -আলিঙ্গন।” এই সময় কুকুয়া বলে একজন ননদের প্রবেশ। ঋষ্যশৃঙ্গ মনির সঙ্গে যার বিবাহ হয়। এখানে শান্তা নেই, আছেন কুকুয়া। কুকুয়া একসময় রাবণের ছবি আঁকতে বাধ্য করেছেন সীতাকে অপরদিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সীতা আঁকছেন এবং অস্বস্তি বোধ করছেন । পাঁচ মাসের গর্ভবতী সীতা দশ মুন্ড রাবণের ছবি আঁকতে আঁকতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় কুকুয়া রামকে রাজসভা থেকে ডেকে এনে দেখালেন ,সীতা রাবণকে আঁচলের তলায় বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছেন। রাম অবাক হননি ,অগ্নি মূর্তি হয়েছিলেন। কুকুয়াকে তিনি ভালোই জানতেন , ভরতের ছোট বোন, যার শিক্ষা মন্থরার কাছে। শিক্ষা তো পাননি এমন কি শ্বশুরবাড়িতেও থাকতে পারেননি। বাপের বাড়িতেই গত দশ বছর ধরে আছেন। হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে সীতার দ্বিতীয়বার বনবাস যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন।
অন্য কোন রামায়ণে কিন্তু বনবাসে যাওয়ার কারণে রাবণের ছবি আঁকা নিয়ে কোন গল্প নেই। সেখানে পারিষদদের কাছে রাম জানতে চাইছেন, আমজনতা তাঁর সম্বন্ধে কি বলছেন?

লঙ্কারাজ রাবণকে শুধু নয়, রাক্ষসকুল ধ্বংস করার পর জনগণ তাঁকে কিভাবে দেখছেন, রাম হয়তো সেটাই জানতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ সমাজ রামচন্দ্র কে মেনে নিলেও সীতা দেবীকে মানতে নারাজ। ফলে রাবণের ছবি আঁকার কথা উল্লেখ করে চন্দ্রাবতী অনন্য হয়ে উঠেছেন। কুকুয়া নামটিও রামায়ণে কোথাও উল্লেখ নেই। এমনকি সেই সময় নামটি প্রচলিত ছিল বলেও মনে হয় না। কোন অভিধানই শব্দটিকে স্থান দেয়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ভাষার অভিধান থেকে আমরা পাই ‘কুয়া ‘ মানে কুহেলিকা,কুকুয়া মানে কুহেলিকার চরম কিছু? চন্দ্রাবতী আমাদের জন্য হেঁয়ালি রেখে গেছেন।

চন্দ্রাবতী ( ১৫৫০- ১৬০০) অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীর কবি। কৃত্তিবাস তাঁর আগের শতকের। হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি অন্য রামায়ণ রচনা করেছিলেন। বাল্মিকী বা কৃত্তিবাসী কোন রামায়ণের সঙ্গে তাঁর রামায়ণের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। যেটুকু মিল পাওয়া যায় তা তেলেগু রঙ্গনাথ রামায়ণ – এর সঙ্গে। ১৩শ শতকে এই রামায়ণ লিখেছিলেন রাজা গোণা বুদ্ধ রেড্ডি, তিনি প্রথম ছ’টি কান্ড লিখেছিলেন, শেষ বা উত্তরা কান্ড লিখেছিলেন তাঁর দুই ছেলে। এছাড়া ওড়িয়া জগমোহন রামায়ণে পাওয়া যায় সীতারাবনের ছবি এঁকেছেন ‌। এই রামায়ণটি ১৫শ শতাব্দীতে লিখেছিলেন বলরাম দাস। বাল্মিকির সংস্কৃত রামায়ণ অনুবাদ করেননি। বিভিন্ন লোকগাথা, গান কথকতা ও পুরোহিতদের থেকে শুনে রামায়ণ লিখেছিলেন। এই রামায়ণ হয় চন্দ্রাবতী পড়েননি বা শোনেননি। সে কারণেই তিনি ভরতের বোন কুকুয়া নামে একটি চরিত্র বাংলা রামায়ণের সংযুক্ত করেছেন। তামিল কবি কম্বন (১১৮০- ১২৫০) চন্দ্রাবতীর অনেক আগের মানুষ। তিনি যুদ্ধকাণ্ডে রামায়ণ শেষ করেছেন। ফলে সীতার বনবাস তাঁর রামায়নে নেই। সেখানে সীতার ননদ কুকুয়া। সেই সময়ে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এরকম একটা অন্য রামায়ণ লেখা কবি অবশ্যই অনন্যতা দাবী করেন।

“… ‘ চন্দ্রাবতী রামায়ণে’, কান পাতলে একটি পরিচ্ছন্ন উচ্চারিত নারীর কন্ঠ স্পষ্ট শোনা যায়। চন্দ্রাবতী ব্রাহ্মণদের রামায়ণ কে চুপ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি রামের বীর্যশৌর্য বিষয়ে নীরব, নিরব রামের গুণপনা ও দেবত্ব বিষয়ে, নিরব রামের যুদ্ধ -দক্ষতা বিষয়ে, এবং নীরব রামের বোধি সম্পর্কেও।” নবনীতা দেবসেন।

রামায়ণ গবেষক কোয়েল চক্রবর্তী বলেছেন, ” নস্যাৎ করেছেন দেবভক্তি বাদকেও।”
চন্দ্রাবতী তার রামায়ণে গঠনগত, ভাষাগত ও কাহিনীগত দিক থেকে প্রচলিত প্রথা কে ভেঙেছেন। মহাকাব্যের ঢঙে নয়, পাঁচালীর ঢঙে লিখেছেন তাঁর রামায়ণ আর মঙ্গলকাব্যের ঢঙে লিখেছেন সীতার বারোমাস্যা। প্রায় প্রতিটি ছত্রে পাঁচালী ঢঙে “গো” শব্দটি যোগ করেছেন। চন্দ্রাবতী যে সংস্কৃত জানতেন না, এমনটা নয় রামায়ণ রচনার সময় সংস্কৃত ভাষার বা শব্দ ভান্ডারের সাহায্য নেননি। তিনি পালাগানের ভাষা ব্যবহার করেছেন। রামসীতার কথা , বলা ভালো শুধুই সীতার কথা।

বিগত শতাব্দীতে দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর রামায়ণ ও পালাগানগুলি সম্পাদনা করে প্রকাশ না করলে কবি চন্দ্রাবতীর এই অত্যাধুনিক রামায়ণ সম্পর্কে বাঙালি অজ্ঞাত থাকত। ক্ষিতীশ চন্দ্রের সম্পাদিত রামায়ণটি সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় যত গুরুত্বই দিম না কেন ভাষাতত্ত্বের বিচার করে সুকুমার সেনের মতো অনেকেই একে অবহেলায় দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন।
এ সম্পর্কে নবনীতা দেবসেন বলেছেন–

“বছরের পর বছর ধরে আমাদের বাংলা সাহিত্যের হর্তাকর্তা যাঁরা, সেই পন্ডিত- পুরুষ সুরক্ষীদের দ্বারা একটি দুর্বল মহাকাব্য এবং অসম্পূর্ণ কাজ হিসাবে উপকৃত ও বর্জিত হয়ে এসেছে “চন্দ্রাবতী রামায়ণ”। একেই আমরা বলছি টেক্সটের কণ্ঠরোধ। রাম -স্তুতি নেই বলে এই রামায়ণকে দীন মনে করা হল। মৌখিক লৌকিক গানের রচনাশৈলীকে ধ্রুপদী কাব্যের রচনাশৈলীর সঙ্গে তুলনা করে একে দুর্বল এবং গুরুত্বহীন সাহিত্যকৃতি বলে খারিজ করে দেওয়া হল।।” নবনীতা দেবসেন চন্দ্রাবতী রামায়ণ পড়ে এতটাই অভিভূত হন যে, ১৯৮৯ সালে প্রথমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে দুটি বক্তৃতা দেন। ১৯৯১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ নিয়ে বক্তৃতা দেন। পরে ইউটা , কলম্বিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানা জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে এর সম্পর্কে আলোচনা করেন। অবাঙালিদের কাছে এর গুরুত্ব বোঝাতে তিনি চন্দ্রাবতী রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদও করেন। এভাবেই বাংলার পরিধি ছাড়িয়ে বাইরে ও পৌঁছায় কবি চন্দ্রাবতী ও তার রামায়ণ কথা। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশের শতবর্ষের আলোকে আজ আরও একবার আলোকিত হচ্ছে চন্দ্রাবতী ও তাঁর রচনা। তাঁর রামায়ণের সীতার মতো মলুয়া ও সোনাই , কমলা, কাজলরেখা,লীলা, তেমনই আলোচিত হচ্ছে । পুরুষের অবহেলা ও অত্যাচারের কারণে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছে নারী। জাতি -ধর্ম , ধনী- দরিদ্র নির্বিশেষে সমাজের সবচেয়ে দুঃখী , কোনঠাসা , অপমানিত, অবহেলিত লাঞ্ছিতদের কথা বলেছেন তাঁর কাব্যে, যার ফলে চন্দ্রাবতীর রামায়ণও হয়েছে সীতায়ণ! নারীর বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে চন্দ্রাবতীর এই প্রতিবাদকে আগামী শতাব্দীর সূর্য স্মরণ করবে সন্দেহ নেই।

কবির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে জানা যায়, দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া চন্দ্রাবতী বিদ্বান পিতার কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন ছোট থেকেই। দ্বিজ বংশী দাস শুধু বিদ্বানই ছিলেন না, ধার্মিকও ছিলেন। বাড়িতে শিবের পূজা করতেন। রোজ সকালে পুকুরপাড়ে শিবপূজারী দ্বিজ বংশীদাসের পুজোর ফুল তুলতে যেত তাঁর কিশোরী কন্যা চন্দ্রাবতী। সেখানে জয়ানন্দ নামে এক কিশোর তাকে ফুল তুলতে সাহায্য করত। সকাল সন্ধ্যা পুজোর ফুল তুলতে গিয়েই তাদের বন্ধুত্ব , সেখান থেকেই প্রেম। কাহিনীর শুরুতেই মামার বাড়িতে আশ্রিত পিতৃমাতৃহীন জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীকে প্রেমপত্রে আড়াই অক্ষরের প্রেম নিবেদন করে বসে। শুধু তাই নয় জয়ানন্দ পরে আবারও প্রেমপত্র পাঠায়। সে প্রেমপত্র ছিল গোছানো সাহিত্যরস সমৃদ্ধ। প্রথম প্রেমপত্র পেয়ে কিশোরী চন্দ্রাবতীর মন উচাটন হয়। হৃদয়ের পাপড়িগুলো যেন হালকা হাওয়ায় উড়তে থাকে! চন্দ্রাবতীও পিতাকে শিব পূজোর আয়োজনে সাহায্য করে নির্জনে সুযোগ খুঁজে জয়ানন্দের চিঠি পড়তে বসে। এভাবেই প্রেমপত্রের মাধ্যমে দুটি হৃদয় কাছাকাছি আসে – চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে স্বামী হিসেবে কামনা করে। জয়ানন্দ এমনিতেই অস্থির , উদ্দাম। ফুল তুলতে গিয়েই ধৈর্য হারিয়ে ডাল ভাঙ্গে – চন্দ্রাবতীকে পেতে আর দেরি করতে চায় না। তবে জয়ানন্দের প্রতি চন্দ্রাবতীর গভীর , অনন্ত ও সংযত প্রেম পিতার অনুমতির অপেক্ষা করে। কিন্তু বিবাহের কথা ঠিক হতেই হঠাৎ করে জয়ানন্দের মন পরিবর্তিত হয়। এক মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়ের প্রতি সে হঠাৎ করেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে ‌– সবকিছু ভুলে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ওই মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েটিকে বিবাহ করে বসেনজয়ানন্দ। তখন তার নাম হয় জয়নাল। পরবর্তীতে ভালো ভালো সম্বন্ধ এলেও কিন্তু চন্দ্রাবতী আর বিবাহ করতে সম্মত হন না। তৎকালীন সমাজের সাধারণ নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারের অভিভাবকদের পক্ষে মেয়েকে সারাজীবন কুমারী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব একটা শহর ছিল না। কুমারী মেয়েদের জন্য অরক্ষনীয়া শব্দটিও ছিল বেশ প্রচলিত। তথাপি দ্বিজ বংশী দাস এই কঠিন সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছিলেন। এই সঙ্গে মেয়েকে ভবিষ্যতের পথও দেখিয়েছেন। পিতার নির্দেশ পাবার পর চন্দ্রাবতীর জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। শুরু হয় সাধনার জীবন। পাতুয়ারি গ্রামের বাড়িতেই দ্বিজমাধব একটি শিব মন্দির নির্মাণ করে দেন চন্দ্রাবতীকে। সেখানেই শিব পূজা ও অবসরে বিদ্যাচর্চায় মন দেয় সে, সম্পূর্ণ তপস্বীর জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলে।
এদিকে কালের স্রোতে ভেসে গিয়ে হঠাৎ একদিন জয়ানন্দ তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পারেন। বিয়ের দু তিন বছর পর মুসলিম সমাজে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। সে আবার চন্দ্রাবতীকে চিঠি লেখে অন্তত একবার দেখা করার জন্য। চিঠি পেয়ে চন্দ্রাবতীর মন বিচলিত হয়। তিনি আবারও পিতার আদেশের অপেক্ষা করেন। কিন্তু তার পিতা আর অনুমতি দেননি। ফলে জয়ানন্দের ডাক উপেক্ষা করে,চন্দ্রাবতী শিব মন্দিরের প্রবেশ করে ধ্যানে নিমগ্ন হন।‌ জয়ানন্দ দুয়ারে বসে সারারাত সন্ধ্যা মালতীর রক্ত – রসে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। সকালে মন্দিরের দরজা খুলে তাঁর লেখা দেখে চন্দ্রাবতীর মনে করুণা জাগে না বরং মুসলিম সম্প্রদায়ের ছোঁয়ায় মন্দির অপবিত্র হয়েছে এই কথা ভেবে ফুলেশ্বরী নদীতে জল আনতে যান। নদীর ঘাটেই জয়ানন্দের মৃতদেহ ভাসতে দেখে চন্দ্রাবতী ও উদাস হয়ে যায়, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই কাহিনী এক অপার্থিব প্রেম কাহিনী হিসেবে রয়ে যায়।এদিক থেকে বিচার করলে তাঁর জীবনের করুন কাহিনীও তাঁর লেখা রামায়ণের উপর কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করেছে।🍁

 

 

🍂ফিরেপড়া | গল্প 

 

‘আহা লোকটা সারাজীবন কী কষ্টটা না করল। কী কষ্ট! কী কষ্ট! মেকানিকের আর কয় পয়সা বেতন? বাড়ির জমিজমা যা ছিল বেচে পড়ার খরচ চলল মজিদের। এত কষ্টের পয়সায় পড়ে আজ মজিদের এই হাল। সন্ধ্যা নামতেই বন্ধুরা আসে। মিটিং বসে ঘরে। ট্রেড ইউনিয়ন, মৎস্য সমবায় সমিতি, হেনো তেনো। ছিঃ।…’ সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এ আজ হুমায়ূন আহমেদ-এর গল্প… 

 

 

শ্যামল ছায়া

হুমায়ূন আহমেদ

 

 

http://হুমায়ূন আহমেদ এর গল্প শ্যামল ছায়া

খুটখুট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

কয়েক মুহূর্ত সে নিশ্বাস নিতে পারল না, দম আটকে এল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে রহিমার এরকম হয়। আজ একটু বাড়াবাড়ি হল, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ, ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে যাচ্ছে। রহিমা ভয় পেয়ে ভাঙা গলায় ডাকল, মজিদ মিয়া, ও মজিদ মিয়া।

মজিদ শেষপ্রান্তে থাকে। এত দূরে গলার আওয়াজ পৌঁছানোর কথা নয়। তবু রহিমার মনে হল মজিদ বিছানা ছেড়ে উঠেছে, দরজা খুলছে শব্দ করে! এই আবার যেন কাশল। রহিমা চিকন সুরে দ্বিতীয়বার ডাকল, ও মজিদ মিয়া ও মজিদ।

কিন্তু কেউ এল না। মজিদ তাহলে শুনতে পায়নি। চোখে পানি এসে গেল রহিমার। হাঁপাতে-হাঁপাতে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর একসময় হঠাৎ করে ব্যথাটা মরে গেল। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। একটু আগেই যে মরে যাবার মতো অনুভুতি হয়েছে তাও পর্যন্ত মনে রইল না।

নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে এল রহিমা। বালিশের নিচ থেকে দেয়াশলাই নিয়ে হারিকেন ধরাল। খুব আস্তে অনেকটা সময় নিয়ে দরজার খিল খুলল। রাতের বেলা ঝনঝন করে দরজা খুললে মজিদ বিরক্ত হয়। বাইরে বেশ শীত, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। কার্তিক মাসের শুরুতেই শীত নেমে গেছে এবার। বাঁ হাতে হারিকেন উঁচু করে ধরে পা টিপেটিপে মজিদের ঘরের পাশে এসে দাঁড়াল রহিমা। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে মজিদ এখনো জেগে। বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উবু হয়ে শুয়ে বই পড়ছে। ঘরের মেঝেতে আধ-খাওয়া সিগারেটের আস্তরণ। কটু গন্ধ আসছে সিগারেটের। রহিমা কোনো সাড়া শব্দ করল না। চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপতে লাগল।

রহিমা ভেবে পায় না এত রাত জেগে কী পড়ে ছেলেটা। পরীক্ষার পড়া তো কবেই শেষ হয়েছে। রহিমা অনেকক্ষণ হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে তার যখন ঝিমুনি এসে গেল তখন মৃদু গলায় ডাকল, ও মজিদ মিয়া।

মজিদ বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, ঠিক করে ডাকো মা। কী সবসময় মিয়া মিয়া কর।

রহিমা একটু অপ্রস্তুত হল। (মজিদকে মজিদ মিয়া ডাকলে সে রাগ করে কিন্তু রহিমার একটুও মনে থাকে না) রহিমা বলল, শুয়ে পড় মজিদ।

তুমি ঘুমাও গিয়ে। ঘ্যানঘ্যান করো না।

রহিম মৃদু গলায় বলল, জানালা বন্ধ করে দেই? ঠাণ্ডা বাতাস।

মজিদ সে-কথার জবাব দিল না। বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগল। রহিমা তবুও দাঁড়িয়ে রইল। তার ঘুমুতে ইচ্ছে করছিল না। কে জানে আবার হয়তো ঘুম ভেঙে যাবে, দম বন্ধ হয়ে যাবার কষ্টটা নতুন করে শুরু হবে। মজিদ রাগী গলায় বলল, যাও না মা, দাঁড়িয়ে থেকো না।

রহিমা জানালার পাশ থেকে সরে এল। মজিদকে তার ভয় করে। অথচ জন্মের সময় সে এই এতটুকুন ছিল। রাতদিন ট্যা-ট্য করে কাঁদত। মজিদের বাবা বলত, এই ছেলে বাঁচবে না গো, এর বেশি মায়া করলে কষ্ট পাবে।

ছিঃ ছিঃ কী অলক্ষুণি কথা। বাপ হয়ে কেউ এরকম বলে? লোকটার ধারাই এমন, কথার কোনো মা-বাপ নাই।

রহিমা এসে শুয়ে পড়ল। ঘুমুতে তার ভালো লাগে না। তাই ঘুম তাড়াতে নানা কথা ভাবে। রাত জেগে ভাববার মতো ঘটনা তার বেশি নেই। ঘুরেফিরে প্রতি রাতে একই কথা সে ভাবে। যেন সে একা একা একটি সাজানো ঘরে বসে আছে। হইচই হচ্ছে খুব। মনটা বেশি ভালো নেই। ভয়-ভয় করছে এবং একটু কান্না পাচ্ছে তার। এমন সময় বড়ভাবী মজিদের বাবাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই বললেন, নাও তোমার জিনিস। এখন দুজনে মিলে ভাব-সাব কর। এই বলে বাইরে থেকে খুট করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। নতুন শাড়ি পরে জড়সড় হয়ে বসে আছে রহিমা। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। কী বলবে তা-ও ভেবে পাচ্ছে না। এমন সময় কী কাণ্ডটাই না হল। কথাবার্তা নেই হড়হড় করে লোকটা বমি করে বিছানা ভাসিয়ে ফেলল। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে রহিমা তাকে এসে ধরল। ভাবতে-ভাবতে চোখ ভিজে উঠে। আহা নতুন বউয়ের সামনে কী লজ্জাটাই না পেয়েছিল লোকটা। কতদিনকার কথা অথচ মনে হয় এই তো সেদিন।

অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে রহিম উঠে বসল। পানের বাটা থেকে পানি বের করল। সুপুরি কাটুল ফুচি-ফুচি করে। পান মুখে দিয়ে আগের মতো চুপি-চুপি মজিদের জানালায় উঁকি দিল। না এখনো ঘুমায়নি। রহিমা মজিদের কোনো ব্যাপারই বুঝতে পারে না। লেখাপড়া না-জানা মূর্খ বাপ-মার ছেলে যদি বৃত্তিটুত্তি পেয়ে পাস করতে-করতে এম.এ. পাস করে ফেলে তাহলে সে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।

একসময় মজিদের চোখ গিয়ে পড়ে জানালায়। এ কী মা, এখনো ঘুরঘুর করছ? ঘুমাও না কেন?

যাই বাবা যাই।

রহিমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। বারান্দায় এসে বসে রইল একা একা। আধখানা চাঁদ উঠেছে। আলোয় আবছাভাবে সবকিছু নজরে পড়ে। রাতের বেলা একলা লাগে তার। বুকের মধ্যে হু-হু করে। দিনের বেলাটা এতটা খারাপ লাগে না। ঘরের কত কাজকর্ম আছে। কাজের লোক নেই। তাকেই সব করতে হয়। সময়টা বেশ কেটে যায়। বাসার কাছেই মাইকের দোকান আছে একটা। তারা সারাদিনই কোনো গানের সিকিখানা, কোনো গানের আধাআধি বাজায়। বেশ লাগে।

মজিদের বাবারও গান ভালো লাগত। এক-একবার গান শুনে চেঁচিয়ে বলেছে, ফাঁস ক্লাস, ফাঁস ক্লাস। মজিদের বাপ লোকটা আমোদ-আহ্লাদের বড় কাঙাল ছিল। বদনসিব লোক। আমোদ-আহ্লাদ তার ভাগ্যে নাই। কোনোদিন হয়তো জামাটামা পরে খুশি হয়ে গেছে সিনেমা দেখতে। ফিরে এসেছে মুখ কালো করে। হয় টিকিট পায়নি, নয়তো পকেট মার গেছে। কোনো বিয়ের দাওয়াতটাওয়াত পেলে হাসিমুখে গিয়েছে কিন্তু খেতে পায় নি কিছু। তার খাওয়ার আগেই খাবার শেষ হয়ে গেছে। নিজের ছেলেটা যখন লেখাপড়া শেষ করেছে, চাকরিবাকরি করে বাপকে আরাম দেবে, তখনি কথা নেই বার্তা নেই বিছানায় শুয়েই শেষ। রহিমা রান্নাঘর থেকে বলেছে পর্যন্ত— অসময়ে ঘুমাও কেন? চা খাবে, চা দিব?

রহিমা সেই মন্দভাগ্য লোকটার কথা ভেবে নিশ্বাস ফেলল। এমন খারাপ ভাগ্যের লোক আছে দুনিয়ায়ঃ মরণের সময়ও যার পাশে কেউ রইল না। মজিদের তখন কোনো খোঁজ নেই। কোথায় নাকি গিয়েছে মিটিং করতে। তার বাপকে কাফন পরিয়ে খাটিয়ায় তুলে সবাই যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে উঁকি দিয়েছে তখন মজিদ নেমেছে রিকশা থেকে। বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে?

আহা লোকটা সারাজীবন কী কষ্টটা না করল। কী কষ্ট! কী কষ্ট! মেকানিকের আর কয় পয়সা বেতন? বাড়ির জমিজমা যা ছিল বেচে পড়ার খরচ চলল মজিদের। এত কষ্টের পয়সায় পড়ে আজ মজিদের এই হাল। সন্ধ্যা নামতেই বন্ধুরা আসে। মিটিং বসে ঘরে। ট্রেড ইউনিয়ন, মৎস্য সমবায় সমিতি, হেনো তেনো। ছিঃ।

মজিদের মাথায় কিসের পোকা ঢুকেছিল কে জানে। মজিদের বাপকে রহিমা কত বলেছে, ছেলেকে এসব করতে মানা কর গো, কোনোদিন পুলিশে ধরবে তাকে। মজিদের বাপ শুধু বলেছে— বুঝদার বিদ্বান ছেলে, আমি মুর্খ মানুষ, আমি কী বলব?

রহিমার শীত করছিল, সে ঘরের ভেতর চলে গেল। অন্ধকার ঘরে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা লাগল কিসের সঙ্গে। পিতলের বদনা ঝনঝন করে গড়িয়ে গেল কতদূর? মজিদ ঘুম-জড়ানো স্বরে বলল, কে কে?

আমি।

আর কোনো সাড়াশব্দ হল না। রহিমা যখন ভাবছে আবার শুয়ে পড়বে কি না, তখনি শুনল মজিদ বেশ শব্দ করে হাসছে। কী কাণ্ড। রহিমা ডাকল, ও মজিদ মিয়া।

কী?

হাস কেন?

এমনি হাসি। ঘুমাও তো, ফ্যাসফাঁস করে না।

না, মজিদকে রহিমা সত্যি বুঝতে পারে না। শুধু মজিদ নয়, মজিদের বন্ধুদের ও অচেনা লাগে। ঠিক সন্ধ্যাবেলায় তারা আসে। চোখের দৃষ্টি তাদের কেমন-কেমন। কথা বলে থেমে-থেমে, নিচু গলায় হাসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে তাদের আলাপ। সিগারেটের ধোয়ায় ঘর আচ্ছল হয়ে যায়। পাশের রইসুদ্দীনের চায়ের স্টল থেকে দফায়-দফায় চা আসে। কিসের এত গল্প তাদের? রহিমা দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে চেষ্টা করে।

না ইলেকশন হবে না। পরিষ্কার বুঝতে পারছি।

কিন্তু না হলে আমাদের করণীয় কী?

শেখ সাহেব কী ভাবছেন তা জানা দরকার।

শেখ সাহেব আপস করবেন। সাফ কথা।

সাদেক বেশি বাড়াবাড়ি করছে। একটু কেয়ারফুল না হলে …

রহিমার কাছে সমস্তই দুর্বোধ্য মনে হয়। তবু রোজ দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে সে শোনে। আর যদি কোনোদিন শিখা নামের মেয়েটি আসে তবে তো কথাই নেই। রহিমা জেঁকের মতো দরজার সঙ্গে সেঁটে থাকে। শিখা আসে লম্বা একটি নকশীদার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে। একটুও সাজগোজ করে না, তবু কী সুন্দর লাগে তাকে। সে হাসতে-হাসতে দরজায় ধাক্কা দেয়। ভেতর থেকে মজিদ গম্ভীর হয়ে বলে, কে কে? (যদিও হাসির শব্দ শুনেই মজিদ বুঝতে পেরেছ কে, তবু তার এই ঢংটা করা চাই-ই।)

আমি, আমি শিখা।

অগ্নিশিখা নাকি?

না, আমি প্রদীপশিখা।

বলতে-বলতে মেয়েটা হাসিতে ভেঙে পড়ে। দরজা খুলে মজিদ বেরিয়ে আসে। মজিদের চোখমুখ তখন অন্যরকম মনে হয়। দেখেশুনে রহিমার ভালো লাগে না। কে জানে শিখাকে হয়তো পছন্দ করে ফেলেছে। হয়তো এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করে রেখেছে অথবা মজিদের বপি সুতাখালীর ঐ শ্যামলা মেয়েটির সঙ্গে মজিদের বিয়ে দেবে বলে কী খুশি (টাঙ্গাইলের লালপাড় একটি শাড়িও সে দিয়েছে হাসিনা নামের ঐ ভালোমানুষ মেয়েটিকে। রহিমা মেয়েটিকে দেখে নি, শুনেছে খুব নরম মেয়ে আর ভীষণ লক্ষ্মী)। আহা মজিদের বাপ বেচারা বিয়েটা দিতে পারল না! আহা!

রহিমা কতবার দেখেছে শিখ এলেই মজিদ কেমন অস্থির হয়ে উঠে। শুধু-শুধু হো হো করে হাসে। চায়ের সঙ্গে খাবার আনতে নিজেই উঠে যায়। কথাবার্তার মঝিখানে ফস করে বলে, আজ আর ইলেকশন-ফিলেকশন ভালো লাগছে না। আজ অন্য আলাপ করব। ঘরে যারা থাকে তারা উসখুস করলেও আপত্তি করে না। শুধু হাসি নয়, গানটানও হয়। শিখা মেয়েটি মাঝে-মাঝে গান গায় তার জন্য সবাইকে খুব সাধ্যসাধনা করতে হয়। খুব অহংকারী মেয়ে)।

রহিমা বুঝতে পারে না এত রাত পর্যন্ত মেয়েমানুষ কী করে আড্ডা দেয়। মজিদের বাপ এইসব দেখেও কোনোদিন কথা বলে নি। শুধু বলেছে— বুঝদার বিদ্বান ছেলে, আমি কী করব?

মজিদের বাপ লোকটাও কী কম বুঝদার ছিল? চুপ করে থাকলে কী হবে, দুনিয়ার হাল অবস্থা ঠিক বুঝত। রহিমার কতবার মনে হয়েছে পড়াশুনা করতে পেলে এই লোকটাও বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যাবেলা ইংরেজিতে গল্প করত। নসিবে দেয় নি। ইমানদার লোক বদনসিব হয়।

রহিমা আবার বিছানা ছেড়ে উঠল। বাতি জ্বাললি। একা একা অন্ধকার ঘরে ভালো লাগে না। যুদ্ধের পর তেলের যা দাম হয়েছে। কে আর সারারাত বাতি জ্বালিয়ে রাখবে? ঐ ঘরে মজিদ আবার ঘুমের মধ্যে খুকখুক করে কাশছে। নতুন হিম পড়েছে। রহিমা কতবার বলেছে জানালা বন্ধ করে ঘুমুতে। কিন্তু মজিদ কিছুতেই শুনবে না। বন্ধ ঘরে তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। মজিদের বাপেরও এরকম বদঅভ্যাস ছিল। মাঘ মাসের শীতেও জানালা খোলা রাখা চাই। একবার তো খোলা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার শার্ট আর গেঞ্জি নিয়ে গেল। শার্টের পকেটে ছয় টাকা ছিল। কী মুশকিল। শেষপর্যন্ত মজিদের বাপ ছোট এক শার্ট গায়ে দিয়ে কারখানায় গেছে। আহ একটা শর্ট ছিল না লোকটার। কম বেতনের চাকরি। তার উপর পয়সা জমানো নেশা। খুব ধুমধাম করে মজিদের বিয়ে দিবে সেইজন্যে পাই পয়সাটিও জমিয়ে রাখা।

শিখা মেয়েটির সঙ্গে মজিদের পরিচয় না হলে সুতাখালীর ঐ মেয়েটির সঙ্গে কত আগেই মজিদের বিয়ে হয়ে যেত। আর বিয়ে হলে কি বউ ফেলে যুদ্ধে যেত মজিদ? কোনোদিন না। গ্রামের মধ্যে বউ নিয়ে লুকিয়ে থাকত কিছুদিন। তারপর সব ঠাণ্ডা হলে ফিরে আসত সবাই।

কিন্তু সেরকম হল না। শিখা মেয়েটি বাহারি ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আসতেই থাকল। আসতেই থাকল। আর দিনদিন সুন্দর হতে থাকল মেয়েটা।

তখন খুব গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। মজিদের ঘরে দিনরাত লোকজনের ভিড়। আগের মতো শিখা মেয়েটির তীক্ষ্ণ হাসি শোনা যায় না। রহিমা বুঝতে পারে খুব খারাপ সময়। দেশের অবস্থা ভালো না। কিন্তু দেশের অবস্থা দিয়ে রহিমা কী করবে? সে শুধু দেখে তার নিজেরই কপাল মন্দ। মন্দ কপাল না হলে কি মজিদ তার বাপকে বলে— দেশের অবস্থা খুব খারাপ। কী হয় বোঝা যাচ্ছে না। তোমরা গ্রামে চলে যাও।

মজিদের বাপ বলেছে, তুই গেলে আমরা যাব।

আরে কী বল পাগলের তো। আমি কী করে যাই? আমার কত কাজ এখন। তোমরা কবে যাবে বল? আমি সব ব্যবস্থা করে দেই।

মজিদের বাপ সে-কথার জবাব না দিয়ে ফস করে একটা বিড়ি ধরিয়েছে আর মজিদ হঠাৎ করে প্রসঙ্গ পাল্টে নিচু গলায় বলেছে, শিখাকে বিয়ে করলে তোমাদের আপত্তি নেই তো বাবা?

মজিদের বাপ একটুও অবাক না হয়ে বলেছে, কবে বিয়ে?

সে দেরি আছে। তোমাদের অপিত্তি আছে কি না তাই বল।

না, আপত্তি কিসের জন্যে? বিয়েটা সকাল-সকাল করে ফেললেই তো ভালো। হয়। টাকার জন্যে ভাবিস না তুই। তোর বিয়ের টাকা আলাদা করে পোস্টাপিসে জমা আছে।

ছেলের বিয়ে দেখে যেতে পারল না। রহিমা যখন রান্না ঘরে ডাল চাপিয়ে খোঁজ নিতে এসেছে লোকটা চা-টা কিছু খাবে কিনা তখনি জেনেছে সব শেষ। সব আল্লার ইচ্ছা।

তারপর তো যুদ্ধই শুরু হল। গ্রামের বাড়িতে রহিমাকে রেখে মজিদ উধাও। কত উড়ো খবর কানে আসে। কোথায় নাকি একশ মুক্তিবাহিনীর ছেলে ধরা পড়েছে। কোথায় নাকি চারজন মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে মিলিটারি পুড়িয়ে মেরেছে। রহিমা শুধু মন্ত্রের মতো বলেছে, মজিদের হায়াৎ ভিক মাংগি গো আল্লাহ। তুমি নেকবান। হাসবুনাল্লাহে নিয়ামুল ওয়াকিল নেয়ামুল মওলা ওয়া নিয়ামুন নাসির। রহিমার রাতে ঘুম হয় না। জেগে-জেগে রাত কাটে। সেই সময়ই অসুখটা হল। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মনে হয় মৃত্যু বুঝি এসে বসেছে বুকের উপর।

যুদ্ধ থেমে গেল। মজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে হাসিমুখে একদিন দরজার সামনে এসে ডাকল, মা আমি মরি নাই গো। দেখ বেঁচে আছি।

অসুখটা তখন খুব বাড়ল রহিমার। ক্রাচের খটখট শব্দ তুলে মজিদ যখন এক পায়ে হেঁটে বেড়ায় তখন রহিমার বুক ধড়ফড় করে। কী কষ্ট, কী কষ্ট। সে মজিদের মতো ভাবতে চেষ্টা করে, একটি স্বাধীনতার কাছে এই ক্ষতি খুব সামান্য।

মজিদ বলে না কিছু, কিন্তু রহিমা জানে শিখার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সেই ছেলেটি নিশ্চয়ই মজিদের মতো ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটে না।

স্বাধীনতার কাছে এই ক্ষতি খুব সামান্য। রহিমা মজিদের মতো ভাবতে চেষ্টা করে। কিন্তু রহিমা মজিদ নয়। জীবন তার সুবিশাল বাহু রহিমার দিকে প্রসারিত করে নি। কাজেই তার ঘুম আসে না।

শেষরাতে যখন উঁদ ডুবে গিয়ে নক্ষত্রের আলোয় চারদিক অন্যরকম হয়, তখন সে চুপি-চুপি মজিদের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাঙা গলায় ডেকে উঠে, ও মজিদ মিয়া, ও মজিদ মিয়া। সেই ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে মজিদের ঘুম ভাঙে না। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করবার জন্যেই হয়তো শেষরাতের দিকে তার গাঢ় ঘুম হয়।🍁

 

🍂কবিতা

 

 

 

 

গৌতম হাজরা-এর কবিতা

মনখারাপের গল্প

প্রত্যেকটা মফস্বলে এক একটা মনখারাপের গল্প থাকে
যে গল্পে থাকে দমকা বাতাস
যে গল্পে থাকে দমবন্ধ করা এক দুর্ধর্ষ ঘটনার কথা
যা প্রত্যেকটা মানুষের মনের দরজায় টোকা দিয়ে যায়
তখন চর্তুদিকে শ্মশানের নীরবতা
মনে হয় মনখারাপের গল্পে কেউ যেন বড়শি গেঁথে দিয়েছে

আসলে মনখারাপের গল্প মানে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত আর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ছবি
যা আজও গুপ্তঘাতকের মতো
দাঁড়িয়ে থাকে মনের গভীর ছায়ায়

 

Sasraya News Sunday’s Literature Special | 16th February 2025 | Issue 52 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | সংখ্যা ৫২

 

 

 

তন্বী মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা

নিশ্চিন্ত মানুষ

অবান্তর ভালোমন্দ ঠেলে মুখখানি মনে পড়ে যায়
বাঁশবনে নীলাকাশ ঝুঁকে মর্মরের দীর্ঘশ্বাস বয়
উপদ্রব বারুদের বিষ সর্বান্তঃকরণে শুষে চশমা
মুঠোয় ধরা যেন তিনিই বিধাতা সেই শায়িত মুখ
তাঁকে লাশ হতে বাধা দেয় জ্বলদর্চি অমেয় আলেয়া
কট্টরপন্থার অনন্ত সফল ক্ষুব্ধ শিয়ালের মুখ
অগ্রাহ্য করে উদারপন্থার মানে মৃত্যু সাধা নহে
বলে নির্লিপ্ত নিরেখ মুখ সাধারণ লিপি ও নিরভিমান

রোজ মনে পড়ে যায় সেই মুখ। জ্বর কমে তাপ
জ্বালা কমে, শয়নের শয্যা জুড়োয়-পৃথিবীর শাপ-

 

 

 

 

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়-এর কবিতা

গাছ

ছায়া ছড়িয়ে দিয়ে কোথায় চলে গেছে
যেখানে সূর্য দাউদাউ করে জ্বলছে
সেখানেই তার পাতায় শ্যামলদাগ
রান্নাঘর
আর লিখে রাখা অজস্র কবিতা

গাছের চেয়ে ভালো কবিতা আর কেউ লেখেনি বলে
আমি তার ছায়ার নিচে বসি।

 

 

 

 

স্বপন দত্ত-এর কবিতা 

হনুমান, অনুমান, বুক চেরাচেরি

আকাশের কাছাকাছি
আরে না না— আকাশের কাছাকাছি
আবার কিছু হয় নাকি
কেন তারা, নক্ষত্র, এগুলো ধুর হনুমান
তুমি আজকের দিনে আমায় হনুমান বলছ
অনুমান করো যে আমি তোমায়
বুক চিরে দেখাতে পারি, তুমি পারো
তার মানে
তার মানে তুমি হনুমান হলে
হুঁম… অর্থাৎ বুক চিরে দেখাতে পারি
এখানেই তুমি
আকাশের কাছাকাছি হয়েও
তুমি কিন্তু আমাকে দেখাতে পারো না
ধূর… আমি তো অন্যের কাছে…
এই কথা বলছ না কেন

 

 

 

 

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ-এর কবিতা

লেখা

বছর ধরে বিবর্তন
আলোর সীমারেখায় হিংস্রতা
কাকতালীয় জীবনে
লেখা থাকে বালকের সংলাপ

জন্মের পর আকাশ থেকে
নেমে আসে জুয়াড়ির নিয়তি

 

 

 

 

মমতা রায় চৌধুরী-এর কবিতা

তুমি যা চেয়েছিলে

তুমি যা চেয়েছিলে
সব পাবে শুধু সময় দাও
এক আকাশ মেঘ থেকে চুরি করে
বৃষ্টির ধারা মেখে সারাটা দুপুর
একসঙ্গে কাটাবো বলে
হাতের ইশারায় চোখের ভাষায় বুঝিয়েছিলে
আমি বুঝেছিলাম ভালোবাসার জন্য
আমি সবটুকু উজার করে চেষ্টা করেছিলাম…

আমি এখনো পূর্ণিমার আকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের মাঝে আলোর টুকরো একটু একটু করে
পরশমাখা হাতে বন্দি করে হৃদয় মাঝে সঞ্চয় করেছি
এখনো ইতিউতি দুপুরে শুধু তোমার কথা ভেবেই বৃষ্টি গায়ে মেখে রোমাঞ্চিত হই।
তুমি যা চেয়েছিলে সব পেতে
শুধু একটু সময় আমাকে দিতে পারতে

দেখো, এখনো কেমন কৃষকের বোনা ফসলে
সোনার বরণ দেখে তোমার ওই কাঞ্চন বর্ণা মুখখানি হৃদয়ে আঁকি।
তুমি যা চেয়েছিলে সব পেতে
কিন্তু তুমি আমাকে সময় না দিয়ে কিছু করার সুযোগ না দিয়েই অভিমান ভরা হৃদয়ে অন্যের হাত ধরে চলে গেলে —
আমি রয়ে গেলাম একাই নীরব ঊষর ভূমিতে

সোনা ঝরা মিঠে কড়া রোদের পরশ ভাগ করে নেবার সুযোগ না দিয়েই—
তবুও কেমন আমি বারবার তোমার কথা ভেবেই লুকিয়ে মেঘের আতর মাখি
রোজ গোলাপে চোখ রাখি বসন্তের পড় বসন্ত এভাবেই কাটিয়ে দেবো
তোমার কথা ভেবে—

 

 

 

 

রাজীব হোসেন-এর কবিতা

তুমি বুঝতে পারবে

কি অবাক হয়ে গেলে তো!
-তুমি এখানে আসলে কেনো…?
-আমাকে তুমি আসতে বলছিলে না।
-তুমি সেদিন যে বললে,
-আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো।
-কিন্তু আমি তোমাকে কখনই ভুলবো না।
-এমন অনেক লোক আছে,
যাদের হাত শূন্য থাকে।
তারা অন্যের বাড়ি তৈরি করে;
বা বেগার কাজ করে।
ওরা মাঝ রাস্তায় হাল ছাড়ে না।
যদি তারা চাই;
তাদের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
-“পায়েল মেরি জান”…
তুমি আমার ভালোবাসা দেখেছো।
-বাংলার ছেলেদের-কে তুমি চেনো না।
জানি না; তুমি কতটা বুঝতে পারবে!
তবে এই জার্নি আমার একার।
-“পায়েল মেরি জান!”
তোমাকে নতুন জীবনের শুভকামনা রইল।

 

 

 

 

কাকলি দাস ঘোষ-এর কবিতা

নির্জন

রাতের সে কথা তোমাকে বলিনি
যে কথা সেই পাহাড়টার গায়ে লেখা ছিল।

রাত ঝিলমিল ফুল ফুটিয়েছিল…
গাছের চোখে দেখেছি
আকাশের বুকে ফুলেরা আলো হয়ে ঘুমায়।
তুমি কী জান?
আমি তো সেকথাও তোমাকে বলিনি।

পাহাড়টা এসব আগে থেকেই জানত…
শুধু পাহাড়টা এই প্রথম দেখল
একটা ফুটফুটে মেয়ে অনেক দূরে হারিয়ে যাচ্ছে…
অনেক দূরের মোমের আলোয়
পাহাড়টা অদ্ভুতভাবে সেই মুখটাই দেখতে পেল।

তোমাকে বলিনি…
যে পাহাড়টা একদিন মানুষ ভালবাসত…
আজকাল মানুষ দেখলে
নিজেকে গুটিয়ে ছোট করে নেয়।
আসলে ও মানুষ আর পশুর তফাৎ বুঝতে পারে না।।

 

 

 

 

🍂লোক-কথা
 

এসব দেখে তো প্রচন্ড রাগে ফুঁসছিল ছাউনির সর্দার বিগ জন। কিন্তু কিছু করতেও পারছিল না। মনমেজাজ ভাল ছিল না ছাউনির রাঁধুনী পিয়েরেরও। পিয়েরে ছিল ছাউনির মধ্যে সবথেকে বেঁটেখাটো, রোগাপাতলা, আপাত নিরীহ এক মানুষ। সাধারণ শ্রমিক আর কাঠুরেদের ওপর জনের পাশবিক অত্যাচার সে সমর্থন তো করতই না, উলটে মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলত – “একদিন দেখো, আমি জনকে পিটিয়ে মেরেই ফেলব!” বেঁটেখাটো পিয়েরের সেই কথা শুনে সবাই মজা করত, নিছক কৌতুক ভেবে হাসাহাসিও করত। আজকে সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এ ব্রিটিশ আমেরিকান লোক-কথাটি লিখেছেন : রাখীনাথ কর্মকার

 

যে কর্বেরির পালক উপড়েছিল

[ব্রিটিশ আমেরিকান লোক-কথা]

 

 

সে ছিল বহু যুগ আগের কথা। আমেরিকার উত্তর-পূর্বের রাজ্য মেইনের ঘন অরণ্যে তখন এক লগিং কোম্পানি তাদের ঘাঁটি গেঁড়েছিল। কোম্পানির সেই ছাউনিতে থাকত বেশ কিছু কাঠুরে যাদের প্রতিদিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হত। বিশাল বড় বড় গাছ কাটা থেকে শুরু করে সব টুকরো টুকরো করে গুছিয়ে রাখা … সারা দিনের সেই অমানুষিক কাজের এতটুকু অন্যথা হওয়ার উপায় ছিল না। কারণ এই সমস্ত কাজের তদারকি করত কোম্পানির বিশ্বস্ত চাকুরে ‘বিগ জন’, যে ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর, বর্বর এবং হৃদয়হীন। সামান্য ছুতো পেলেই, সুযোগ পেলেই সেই হিংস্র জন কাঠুরেদের প্রায় চার-পাঁচ জনকে একসঙ্গে পিটিয়ে নিজের মস্তানি ফলাত।
তখন সবে ফেব্রুয়ারীর শুরু। মেইনে হঠাৎই শুরু হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর তুষার ঝড়। টানা তিনদিন ধরে চলেছিল সেই ঝড়। কাঠুরেরা তাই কেউ ওই কয়দিন বাইরেই বেরোতে পারছিল না। অগত্যা, ছাউনির মধ্যেই বসে বসে খাওয়াদাওয়া করা, পান করা বা তাস খেলা ছাড়া তাদের আর কোনও কাজও ছিল না। এমনিতেই এই পরিস্থিতিতে সকলেই মেজাজ খারাপ ছিল… কিন্তু বিগ জনের মতো মোটেই নয়। এসব দেখে তো প্রচন্ড রাগে ফুঁসছিল ছাউনির সর্দার বিগ জন। কিন্তু কিছু করতেও পারছিল না। মনমেজাজ ভাল ছিল না ছাউনির রাঁধুনী পিয়েরেরও। পিয়েরে ছিল ছাউনির মধ্যে সবথেকে বেঁটেখাটো, রোগাপাতলা, আপাত নিরীহ এক মানুষ। সাধারণ শ্রমিক আর কাঠুরেদের ওপর জনের পাশবিক অত্যাচার সে সমর্থন তো করতই না, উলটে মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলত – “একদিন দেখো, আমি জনকে পিটিয়ে মেরেই ফেলব!” বেঁটেখাটো পিয়েরের সেই কথা শুনে সবাই মজা করত, নিছক কৌতুক ভেবে হাসাহাসিও করত।

একদিন বিকেলবেলা… বাইরে তুষার ঝড়ের প্রাবল্য তখন বেড়েই চলেছে। ঠিক এমন সময় কোত্থেকে একটা অসহায় কর্বেরি পাখি উড়ে এসে বসল জন যেখানে বসেছিল, সেই বন্ধ জানালার শার্সিতে… যেন কাতর অনুরোধ জানাচ্ছিল জনকে, ওকে ভিতরে আসতে দেওয়ার জন্য। পাখিটাকে দেখে জনকে জানালাটা খুলতে দেখে সবাই অবাক হল। কিন্তু জন যে কেন জানালাটা খুলেছে, সে সম্বন্ধে কারোর বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। একটু পরে সবাই বিস্ফারিত নয়নে দেখল, জন পাখিটাকে দুই হাতের মুঠোয় পুরে সেই অসহায়, অবলা প্রাণীটার শরীর থেকে সব পালক একটা একটা করে ছিঁড়ে নিচ্ছে! উফ, এমন নির্দয়, এমন নিষ্ঠুরও কেউ হতে পারে! ছাউনির প্রতিটা শ্রমিক জনের এই ভয়ংকর নিষ্ঠুর কান্ডকারখানা দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। কিন্তু কারোর টুঁ শব্দটি করার সাহস হল না! হ্যাঁ, এরপর জন পালক উপড়ানো পাখিটাকে জানলা খুলে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু সেটাকে ওই বাইরের হিমশীতল ঠান্ডায় মরার জন্যে!

একমাত্র বেঁটে বাঁটকুল পিয়েরে, দশাশই জনের পাশে দাঁড়ালে যাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না, সে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এল এই ভয়ানক কান্ড দেখে। পিয়েরে চিৎকার করে জনকে বারণ করলেও জন শুনবে কেন তার কথা! তাকে তো সে মানুষ বলেই গণ্য করে না। পিয়েরে রাগান্বিত হয়ে জনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল… “এরকম নিষ্ঠুর কাজ ফরাসীরা ছাড়া আর কেউ করে না জন!”
কিন্তু জন যখন পিয়েরের কথায় কোনও পাত্তাই দিল না, বিষম রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিয়েরে হুমকি দিয়ে বসল –“জন, দশাশই শয়তান জন, একদিন তোমারও এমন একটি দিন আসবে যেদিন তুমি ঘুম থেকে উঠে দেখবে তোমার শরীরের সমস্ত লোম কেউ উপড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে!”
সেদিন রাতে সবাই সেই ভয়ানক স্মৃতি বুকে নিয়ে ঘুমোতে গেল। পরের দিন, তখন সবে ভোর হয়েছে, কী আশ্চর্য, ছাউনির মধ্যে অমন ভাবে গোঙাচ্ছে কে? ছাউনির প্রত্যেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে অবাক বিস্ময়ে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে দেখল …একী কান্ড…! ছাউনির মেঝের ওপর পড়ে আছে নিষ্ঠুর, বর্বর জন! ছাউনির মেঝের ওপর পড়ে পড়ে সে কাতরাচ্ছে। শয়তানটার শরীরে একটা লোম নেই, নেই কোনও পোশাক, নেই এক টুকরো সুতো!

ঠিক এই সময় বেত নিয়ে এসে হাজির হল পিয়েরে। যে বেত দিয়ে শ্রমিকদের পিটিয়ে সোজা করত জন। হ্যাঁ, সেই বেত দিয়েই পিটিয়ে মারতে মারতে ওরকম প্রকান্ড চেহারার জনকে ছাউনি থেকে বাইরে অসহ্য ঠান্ডার মধ্যে বের করে দিয়ে পিয়েরে গর্জন করে উঠল –“আর কোনও দিন যেন তোমায় এ ছাউনির আশেপাশে না দেখি, জন!”
সেই দিনের পর থেকে মেইন তো দূরের কথা, নিউ ব্রানসউইকের কোনও ছাউনিতেও কেউই এক সময়কার দোদণ্ডপ্রতাপ নেতা বিগ জনের হয়ে কাজ করতে চাইল না। অবশেষে জনের অভিজ্ঞতার কথা গুরুত্ব দিয়ে ও তার দুরবস্থার কথা ভেবে সেই লগিং কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা একটা নিয়ম করে দিল… এরপর থেকে জন জঙ্গলের মধ্যে কোম্পানীর বিভিন্ন ছাউনির কোনও একটাতে মাত্র একটা রাতের জন্য আশ্রয় ও খাবার পাবে আর তার বদলে, জনকেও কোম্পানির জন্য কিছু করে দিতে হবে…। সেই থেকে জন প্রতি রাতে ভিখারির মতো এক ছাউনি থেকে অন্য ছাউনিতে গিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পায়, আর তার প্রতিদানে সে কোম্পানিকে কাটার জন্য ও ব্যবসার জন্যে ভাল ভাল গাছ মেইনের সেই বিশাল অরণ্যের কোন কোন অঞ্চলে পাওয়া যাবে সেই খবরটুকু জোগাড় করে দেয়!🍁

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১৪

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ১৪।

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

 

চোদ্দ.

দুই হাতের মুঠি শক্ত করে ধরে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারলাম মহাশূন্যে 

ক্লাব থেকে বেরিয়েই আমরা পড়িমড়ি করে ছুটে চলেছি। লেট পাড়ায় আগুন লেগেছে। আগুনের লেলিহান শিখা ঊর্ধ্ব আকাশে ধোঁয়া ও ছাই উগরে দিচ্ছে। পাড়ার মানুষ ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে ছুটে পালাচ্ছে। কে কোথায় কান্না করছে, কে চিৎকার করছে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না। একটা বাড়ির আগুন সমস্ত পাড়াকেই যেন খেয়ে ফেলছে। এ পড়ার ও পড়ার লোকজন ছুটে এসে যতটা সম্ভব কাজে নেমে পড়েছে। বালতি বালতি জল তুলে লাইন ধরে হাতে হাতে আগুনের উপর ঢেলে দিচ্ছে। প্রায় ঘন্টা তিনেক বহু চেষ্টার পর আগুন কমে এলো। কার কার বাড়ি পুড়েছে এবং কোথায় আগুন লেগেছিল সেটা তদন্ত করে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, সরাদের বাড়িতেই আগুন লেগেছে। পুরো বাড়িটা পুড়ে একদম বসে গেছে। কাঁথাধোকড়, কাপড়চোপড়, চাল-ডাল যা ছিল, কিছুরই রক্ষা হয়নি। উঠোনে সরা আর ওর দিদির একজোড়া করে চপ্পল পড়ে আছে। থালাবাটিও এলোমেলো হয়ে আছে। বাড়িতে একটা কুকুর থাকতো তারও দেখা পেলাম না। শুধু একটা পোড়া পোড়া গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো প্রাণী না মানুষ তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে আমাদের ধারণা হলো মুরগি-হাঁসও হতে পারে। গুনে গুনে দেখলাম প্রায় ছয়-সাতটা বাড়ি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। একটা ধ্বংসস্তূপের মাঝখান থেকে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এলেন শাম লেট। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। এসে আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন:
—তোমরা বিচার কেন করতে গেলে সরার? ওকে গ্রাম থেকে তাড়ানোর জন্যই ওর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর সেই আগুনে আমাদেরও বাড়ি পুড়লো!
—কে আগুন লাগিয়েছে দেখেছেন?
—তা দেখবো কী করে? কত লোক যাওয়া আসা করছে ওদের বাড়িতে। আজও এসেছিল সন্ধ্যের দিকে। বাড়িতে বেশ হাঙ্গামা শুনতে পাচ্ছিলাম। চেঁচামেচি হচ্ছিল খুব। কী কারণে তা জানি না। অবশেষে দেখি আগুন জ্বলে উঠেছে। রাত্রি তখন এগারোটা হবে। বিছানায় গা গড়িয়েছি, ঘুমও আসেনি। হঠাৎ বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। বাইরে বেরিয়ে দেখি কারা ছুটে পালাচ্ছে। আর এগিয়ে যাবার সাহস হয়নি। তারপর নিজের ঘর গোছাতে গোছাতেই আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়লো। —তাহলে তো এটা পরিকল্পিত ব্যাপার ওদেরকে তাড়ানোরই ব্যবস্থা করেছে।
—সেটাই তো শুনছিলাম। ক্লাবে ওরা আবেদন করেছিল সুবিচার পাওয়ার জন্য। কিন্তু মাহরির লোকজন এসে ওদেরকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিল আর সেইসঙ্গে আমাদেরও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল।
সেদিন লেটপাড়া থেকে আমরা ফিরে এসে দুর্জয় বাবুর সঙ্গে একটা আলোচনাও সেরে নিয়েছিলাম। মাহরির নামে থানায় একটা ডাইরি করা দরকার। অত্যাচার সীমার বাহিরে চলে গেছে। তবে সরারা কোথায় গেছে সে খোঁজখবরও নিতে হবে আমাদের।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে সেদিনকার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল দশটার দিকে আমাদের থানায় যাওয়ার কথা। গরিব মানুষদের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। আর এসব না করতে পারলে আমাদের ক্লাব করা বৃথা। সুতরাং কোমর বেঁধেই আমরা কাজে নেমে পড়লাম।
গ্রাম থেকে রামপুরহাট থানার দূরত্ব প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার হবে। দুর্জয় বাবুর সঙ্গে আমি ও সহ-সম্পাদক তিনজনেই তিনটি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। আষাঢ় মাস কিন্তু তেমন বৃষ্টি নেই। যথেষ্ট গরমের আঁচ অনুভব করা যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে সোনাঝুরি ও ইউক্যালিপটাস গাছের সারি বেশ ঝোপ হয়ে আছে। যেতে যেতে আমাদের কথাবার্তাও হচ্ছে। সরার নিখোঁজ হওয়ারও একটা ডাইরি করতে হবে। মেয়েটাকে মেরে ফেলেনি তো? মনের মধ্যে একটা সংশয়ও আছে। লেটপাড়ার ছোট ছোট বাড়ি সবগুলোই খড়ের চালের। ছিটে দেওয়া কঞ্চির বেড়ার দেওয়ালও তাদের ছিল। তাই খুব সহজেই সেগুলো ভস্মীভূত হয়েছে। আবার কিছু বাঁশ ও তালপাতা দিয়ে সেসব বাড়িগুলি মেরামত করে বাস করার উপযোগী করতে হবে। এরকমই একটি পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কাজে নামবো এরকমই ভাবনা আমাদের।

 

 

গ্রাম পেরিয়ে দাদপুর নামেও আরেকটি গ্রাম রাস্তার মাঝেই পড়ে। এখন প্রায় সেটিও পেরিয়ে এসেছি। মাঝখানে ফাঁকা মাঠ। লোকজন নেই বললেই চলে। হঠাৎ সামনে ভয়ংকর একটা বোমার আওয়াজ। চারিদিক ধোঁয়ায় ঘিরে ফেলেছে। দুই কানেও যেন তালা লেগে গেল। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না সামনে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। হঠাৎ পাশ থেকেই একটা আওয়াজ ভেসে এলো— “মার শালাদের শেষ করে ফ্যাল্!”
ছিটকে এসে ক’য়েকটি বোমার আগুনের ঢেলা আমাদের শরীরেও লেগেছে। ভীষণ জ্বালা শুরু হয়েছে তখন। পায়ের একটা আঙুল প্রায় ক্ষত হয়ে গেছে। সাইকেল ঘুরিয়ে গ্রামের দিকে আবার রওনা দেব এমন সময় চেঁচিয়ে জোর গলায় বলতে লাগলো— “যদি পুনরায় থানা যাবার বা সরার বিচারের চেষ্টা করিস তো তোদের বংশের বাতি দিতে কাউকে রাখবো না!”
সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকেই আমরা গ্রামে ফিরে এলাম। কাকে বলবো গ্রামে এসব কথা? তেমন কেউ কি আছে যারা সুবিচার করবে বা আমাদের সঙ্গে থাকবে? না, কেউ নেই। সবাই গরিব মানুষ খেটে খাওয়া মানুষ। থানা পুলিশের নাম শুনেও ভয়ে কাঁপে। আমাদের তখন লেখাপড়াও শেষ হয়নি। নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর একটা স্বপ্ন রয়েছে। গরিব মা-বাবারা মুখ চেয়ে আছে আমাদের। সুতরাং বেশিদূর আর আগানো গেল না। আমরা ক্লাবটাকেই তুলে দিলাম। সেদিন থেকেই ক্লাবের আর কোনো অস্তিত্ব রইলো না। যে যার মতো চুপচাপ হয়ে গেলাম। পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলো যে যার মতন সারাই করতে লাগলো, কিন্তু সরারা দুই বোনে কোথায় গেল তার হদিশ আর কেউ পেল না। আমরাও মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বোমের আঘাতে ক্ষত হওয়া স্থানগুলিতে মলম লাগাতে লাগলাম। মাহরিরও আর গ্রামে টিকিও দেখা গেল না।
অনেক পরে একদিন ঝুমকোলতার সঙ্গে দেখা হলো। ঝুমকোলতা আসলে আমাদের ঝুমু বৌদি। গ্রামে ক’য়েক ঘর দাইদের বাড়ি রয়েছে। তাদেরই একজন ঝুমু বৌদি। বাড়িতে আঁতুড় হলে ঝুমু বৌদির ডাক পড়ে। সন্তান প্রসবে নাকি তার জুড়ি নেই। ডাক্তার নার্সের মতো সেও ধন্বন্তরি। তাই যাদের বাড়িতেই সন্তান হোক তারই ডাক পড়ে। বাঁশের ছিলাতে নাড়ি কেটে বাবলার কাঠের আগুনের আঁচে সেঁক দিয়ে সে একবারে সতেজ করে তোলে। কলার পাতায় আগুনের শিষে কাজলও তৈরি করে। সারা শরীরে সরষের তেল মাখিয়ে সকালের রোদে শুইয়ে দেয়। বাচ্চা দিব্যি হেসে খেলে ঘুম পাড়ে। সেই ঝুমু বৌদি ডেকে বললেন— “জানো ভাইটি, সেদিন তোমাদের মেরে ফেলারই প্ল্যান ছিল। ভাগ্য ভালো তোমরা বেঁচে গেছ। সরা আর সরার দিদিকে জোর করে বাড়ি থেকে তাড়ানো হয়েছে। তারা না পালালে সেদিন তাদের মেরে লাশও গায়েব করা হতো। কিন্তু ওরা কথা দিয়ে গেছে আর কখনো গাঁয়ে ফিরবে না। হায় বেচারীরা যাবার সময় একটা কাপড়চোপড়ও নিতে পারেনি!”
জানতে চেয়েছিলাম, জানো বৌদি ওরা কোথায় গেছে?
একটা ঢোঁক গিলে ঝুমু বৌদি বলেছিল— “যে জায়গায় গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না। আমাদের এখানকার বহু মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে কিছুদিন ভোগ করার পর শেষ পর্যন্ত ওইখানেই বিক্রি করে দেয়।”
আবার ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলাম, সেটা কোন জায়গা বৌদি বলুন না!
বৌদি গলার স্বর নিচু করে বললেন— “এলাহাবাদের মীরগঞ্জ!”
—তাহলে কি ওরাও দেহ ব্যবসা করবে?
—তা না করলে তো কোনো গতি হবে না! ওখানেতে ওই একটিই কাজ, যতদিন নারীদের যৌবন থাকে ততদিনই তাদের কদর!
এসব কথা শুনে সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। হাজার হলেও গ্রামের মেয়ে। দুর্গাপূজায় কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিল, আর এসেই ফাঁদে পড়ে মাহরির। জীবনটাই তার শেষ হয়ে গেল!
নিষ্ফল আক্রোশে দুই হাতের মুঠি শক্ত করে ধরে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারলাম মহাশূন্যে। হয়তো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই। হয়তো নিজেদের অক্ষমতার উদ্দেশ্যেই। মাহরি যে ভাড়া করা লোক এনে আমাদের হুমকি দিয়ে এবং সরাদের গৃহছাড়া করে ছাড়বে তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আমাদের কোনো অস্ত্র ছিল না। আমরা শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেবার জন্য ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ভবিষ্যতের দিকে পথ চেয়েছিলাম।🍁 (ক্রমশঃ)

 

 

🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ১৪

 

মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্য বা ঊনবিংশ শতাব্দীর জাগরণের ওপর তাঁর আলোচনাও আছে। আবার বিদ্যাপতি, আলাওল, সৈয়দ সুলতান সম্পর্কে যেমন আছে তেমন গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন সম্পর্কে রচনা আছে। ‘কাসাসোল আম্বিয়া’, ‘আলেফ লায়লা’ পুঁথির পরিচয় যেমন দিয়েছেন, তেমনই মীর মোশাররফ হোসেন-এর ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক, দীনেশচন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ-গীতিকা’, কাজী আব্দুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাসের আলোচনা করেছেন। মোটকথা এসব আলোচনায় তাঁর পঠনস্পৃহা এবং জানার পরিধির পরিচয় পাওয়া যায়।
রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১৪।

 

ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই

রেহানা বীথি 

 

 

 

(গত সংখ্যার পরে…) 

সাহিত্য আলোচনা 


অধ্যাপক হাই সাহেব অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে এত বিশদে আলোচনা করেছেন, যা কেবলই মুগ্ধ করে। পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান ছাত্রদের প্রয়োজনের কথা ভেবে লিখেছেন পুঁথি সাহিত্যের কথা, বাঙালি মুসলমান লেখকদের কথা। অধ্যাপনা সূত্রে এবং আপন মনের ভালোলাগায় সাড়া দিয়ে আলোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, গিরিশচন্দ্র প্রভৃতি স্রষ্টাদের অবদান। আগেও বলেছি, প্রফেসর হাই ছিলেন রবীন্দ্রপ্রেমিক। রবীন্দ্রসাহিত্য ছিল তাঁর প্রাণ। এক অভাবনীয় নিমগ্নতায় ডুবে যেতেন তিনি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে। যারা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, সকলেই তাঁর এই নিমগ্নতার কথা জানতেন। কিন্তু তাই বলে মধ্যযুগের গীতিকবিতা কিংবা পুঁথিসাহিত্য নিয়ে তিনি যে কাজ করে গেছেন, সেগুলোও তাঁর কাছে অবহেলিত হয়নি মোটেও। যে নিমগ্নতা নিয়ে তিনি এসব আলোচনা করেছেন এবং তুলে এনে একত্রিত করেছেন, সেটাও অভাবনীয়।

 

সাহিত্য ও সংস্কৃতি


পূর্ববাংলা থেকে তাঁর প্রথম আলোচনামূলক প্রবন্ধের বই “সাহিত্য ও সংস্কৃতি” ১৯৫৪ সালে বের হয়। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন : “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনাব্যপদেশে বিগত বারো বৎসরের চিন্তা ও সাধনা বিভিন্ন সময়ে প্রবন্ধাকারে নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করি। সেগুলোকে বিস্মৃতির হাত থেকে উদ্ধার করে এ গ্রন্থে একত্রিত করে দিলাম। প্রবন্ধগুলো আপাতবিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে বিভিন্ন সময়ে ভাষা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের যে বিকাশ হয়েছে, মূলত তারই আলোচনা বলে প্রবন্ধগুলোর মধ্যে চিন্তাধারার একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাবে (আগস্ট ১৯৫৪)।

১৯৪৩ থেকে ১৯৫৪ লিখিত প্রবন্ধগুলোর সংকলন মূলত তাঁর এই গ্রন্থ। মোট সতেরটি প্রবন্ধ আছে এই গ্রন্থে। প্রবন্ধগুলো হল :
১. ভাষা ও সমাজ জীবন
২. আমাদের ভাষা ও সাহিত্য
৩. হিন্দু বাংলার ধর্মান্দোলন ও ঊনবিংশ শতাব্দী
৪. বাংলাদেশে মুসলিম অধিকারের যুগ ও বাংলা সাহিত্য
৫. কবি সৈয়দ সুলতান
৬. কবিগুরু আলাওল
৭. মানুষের প্রেম ও কবি আলাওল
৮. রবীন্দ্র-কাব্যে মানবতা
৯. নজরুল প্রতিভার বৈশিষ্ট্য বাংলা কাব্যের নতুন ধারা ও নজরুল
১০. কবি শাহাদাৎ হোসেন
১১. বাংলা সনেটের পটভূমি
১২. ঐতিহাসিক উপন্যাস
১৩. ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকা
১৪. ইসলামের শাসন-সংহতি
১৫. মুসলিম ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা
১৬. মুসলিম ভারতে স্ত্রী শিক্ষা

দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ভাষা ও সমাজজীবন’ ও ‘রবীন্দ্রকাব্যে মানবতা’ বাদ দিয়ে ‘বিদ্যাপতি কাব্যপাঠ’, ‘আলাওলের সেকান্দারনামা’, ‘লালন শাহ ফকীর’, ‘ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ’ এই চারটি প্রবন্ধ সংযোজিত হয়।

 

ভাষা ও সাহিত্য


সাহিত্য সংক্রান্ত আলোচনায় তাঁর আর একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রয়েছে। গ্রন্থটির নাম ‘ভাষা ও সাহিত্য’ (১৩৬৬ ফাল্গুন, মার্চ ১৯৬০)। এই গ্রন্থটি দু-খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ের আটটি প্রবন্ধ ও দ্বিতীয় খণ্ডে সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয়ের একুশটি আলোচনা আছে। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, “আমার লেখা ভাষা সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলো পাঠকেরা যাতে এক জায়গায় পেতে পারেন, সেজন্য আমার পূর্ব প্রকাশিত ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থের ‘ভাষা ও সমাজজীবন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি এখানে পুনর্মুদ্রিত হলো।”

এই গ্রন্থের ভাষা অংশে রয়েছে, ভাষা ও সমাজজীবন। আমাদের সাহিত্যের ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে ভাষার অনুশীলন। বাংলা ভাষা ও তার পঠন-পাঠন। আমাদের বাংলা উচ্চারণ। রোমান বনাম বাংলা হরফ। বাংলা সাহিত্যে পুরনো ধারার লেখক ও আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার। সীমান্তের ভাষা ও সাহিত্য।

সাহিত্য অংশে রয়েছে : পূর্ব পাকিস্তানের তামদ্দুনিক সংগঠন। পুঁথি ও পুঁথির ভাষা। পুঁথি সাহিত্য ও কাসাসোল আম্বিয়া। পুঁথি সাহিত্য ও আলেফ লায়লা। ভারতচন্দ্রের মানসিংহ। মৈমনসিংহ গীতিকা। নদীবক্ষে। জমিদার দর্পণ। গিরিশ ঘোষ, ডি.এল. রায় ও ক্ষীরোদাপ্রসাদ। যুগচিত্ত ও গিরিশ-প্রতিভা। কবি কায়কোবাদ। কবি নজরুল। ঔপন্যাসিক নজরুল। কবি জসীমদ্দীন। আমাদের নাট্য- সাহিত্য। বৈষ্ণব কাব্যে প্রেম। বাংলা কাব্যে নৈরাশ্যবাদ। উর্দু কবিতার জন্মকথা ও কবি হালী। পাকিস্তানের জাতীয় কবি ইকবাল। ইকবালের মোমেন। ইকবালের বাণী।

তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থ দু’টির সূচিপত্র থেকে দেখা যায়, তিনি যেমন ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকার কথা ভেবেছেন, তেমনই তার শাসন-সংহতি, শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। মুসলমান যুগের বাংলা সাহিত্যের বিকাশ সম্পর্কে যেমন ভেবেছেন, তেমনই মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্য বা ঊনবিংশ শতাব্দীর জাগরণের ওপর তাঁর আলোচনাও আছে। আবার বিদ্যাপতি, আলাওল, সৈয়দ সুলতান সম্পর্কে যেমন আছে তেমন গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন সম্পর্কে রচনা আছে। ‘কাসাসোল আম্বিয়া’, ‘আলেফ লায়লা’ পুঁথির পরিচয় যেমন দিয়েছেন, তেমনই মীর মোশাররফ হোসেন-এর ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক, দীনেশচন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ-গীতিকা’, কাজী আব্দুল ওদুদের লেখা ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাসের আলোচনা করেছেন। মোটকথা এসব আলোচনায় তাঁর পঠনস্পৃহা এবং জানার পরিধির পরিচয় পাওয়া যায়। ড. এনামুল হক ‘ভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের সমালোচনা প্রসঙ্গে একে “বিশাল সাহিত্য রাজ্যের বৈমানিক জরিপ” বলে উল্লেখ করেছেন (সাহিত্য পত্রিকা, ১৩৬৭ শীত সংখ্যা)। এই কথা তাঁর যাবতীয় সাহিত্য সংক্রান্ত আলোচনা সম্পর্কে প্রযোজ্য। আলোচনা গতানুগতিক হলেও কিছু কিছু চিন্তার স্ফুলিঙ্গ আছে যা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে।
আমাদের সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন-
“ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যে অতি সুনিবিড় একথা নতুন নয়। মানুষের সভ্যতাকে ইতিহাসের ধারার সঙ্গে প্রবাহিত রাখার শ্রেষ্ঠ উপকরণ হচ্ছে মানুষেরই মুখের ভাষা। তার সংসার জীবনের গতানুগতিকতাকে বাঁচিয়ে রাখবার প্রয়োজনে যেমন ভাষা ব্যবহৃত হয়, তেমনি তার সকল চিন্তা ও কর্মের, চারু ও ললিতকলার, এককথায় তার জীবন মৃত্যুর বাহন হিসেবেও প্রধানতম অবলম্বন ভাষা। ভাষা যদি না থাকতো তাহলে মানুষের সামাজিক জীবন রুদ্ধ হতো, বদ্ধ হতো মানুষের সংস্কৃতির গতি; মানুষের সংসারও সুন্দরভাবে রচিত হতো না, তার জন্ম-মৃত্যুর, সুখ-দুঃখের ও আনন্দ-বেদনার কাহিনীও কারুরই কল্পনাকে নাড়া দিতো না। এত রঙিন পৃথিবী মানুষের চোখে একেবারে নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ প্রতিভাত হতো। সাহিত্য যেমন মানুষের সংসার ও সমাজের প্রতিচ্ছবি, তেমনি তার আকাঙ্ক্ষার ও হাসি-কান্নার মূর্ত প্রতীক। যে ভাষার সাহায্যে মানুষ তার জীবনের সর্বাঙ্গীন রূপের পরিচর্যা করে, সাহিত্যে মানুষের সেই জীবনের সর্ববিধ রূপের প্রতিফলন হয় বলেই, ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক তাই সুনিবিড়।”

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর আমাদের সাহিত্যের ভাষা কি হবে, তা নিয়ে সাহিত্যিক, শিক্ষক ও সাংবাদিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল আত্ম-জিজ্ঞাসার যে সূচনা হয়েছিল, সে সম্পর্কেও প্রফেসর হাই আলোকপাত করেছেন। “ভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থের প্রথম অংশেই তিনি লিখেছেন, “আমাদের সাহিত্যের ভাষা কি হবে রাষ্ট্রের পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন যে আজকেই মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো তা নয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় তৃতীয় দশক থেকেই মুসলমান রচিত বাংলা সাহিত্যে ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও ওঠে এবং সেকালের নানা পত্র পত্রিকায় জল, পানি, ঈশ্বর, আল্লাহ, খোদা প্রেরিত পুরুষ, রসুল ও পয়গম্বর, উপাসনা- নামাজ, উপবাস – রোজা, প্রভৃতি শব্দ নিয়েও নানা দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হতে দেখি। ঐতিহাসিক কারণেই সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অংশ বাঙালি হিন্দুরই সৃষ্টি। সে কারণেই উক্ত শতাব্দীতে তারা যেমন শিক্ষা দীক্ষায় এবং চাকরি বাকরি ইত্যাদির দিক দিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়েছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর পাকিস্তান পূর্ব – যুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধান অংশ তেমনি তাদের দ্বারা রচিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মুসলমানেরা আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এগুতে থাকে এবং জীবিকার্জনের জন্য চাকরিতে প্রবেশের প্রয়াস পায়। কিন্তু চাকরি বাকরিতে ঢুকতে গিয়ে তারা যেমন তাদের অগ্রবর্তী হিন্দু সমাজের কাছ থেকে বাধা পেয়েছে, ঠিক তেমনি মুসলিম সমাজ এবং ধর্মজীবনের প্রতিচ্ছবি নির্ধারক শব্দগুলিও মুসলিম রচিত সাহিত্যে ব্যবহৃত হতে গিয়ে নানাভাবে নিন্দিত হয়েছে। সে জন্যেই অধিকাংশ হিন্দু এবং হিন্দু আদর্শ প্রভাবান্বিত মুসলিম সাহিত্যিকদের কাছ থেকেই মুসলিম জীবনের প্রতিচ্ছবি নির্দেশক শব্দগুলোও বাংলা সাহিত্যে সহজ সমর্থন পায়নি। তাই অনেক মুসলমানকেও সাহিত্যে আল্লাহ কি খোদার বদলে ঈশ্বর ব্যবহার করতে দেখেছি। নামাজের বদলে উপাসনা, রোজার বদলে উপবাস প্রভৃতি শব্দ তাঁরাও ব্যবহার করেছেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পূর্বেও পানি শব্দ ব্যবহার করলে আমরা ‘পানির সাহিত্যিক’ নামে অভিহিত হয়েছি।”

“ভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থে আলোচনায় আমরা দেখতে পাই, ভাষা স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। এই গতিশীলতায় ভাষা যেমন পূর্বপুরুষের শব্দ ব্যবহার ও উচ্চারণ রীতির দ্বারা বর্তমান পুরুষ প্রভাবিত হয় বটে, তবু দেখা যায় অনুকরণের মাধ্যমে ভাষা আহরণ করতে গিয়ে বর্তমান পুরুষের লোকেরা ভাষার পূর্বরূপ অক্ষুণ্ন রাখতে পারে না। ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হতে থাকে ভাষা। হয়তো অনেক শব্দের অর্থগত পরিবর্তন হয় না, কিন্তু শত বছরের ব্যবধানে ধ্বনিগত পরিবর্তন এমনভাবে হয়েছে যে, তারা যে একই শব্দ একথা স্বীকার করতে সাধারণের অসুবিধাই হবে।
ভাষার কোন শব্দ সেই ভাষাভাষী কোন মানুষেরই ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। শব্দ কোন কনক্রিট বা চক্ষুগ্রাহ্য বিষয়ের প্রতীক হোক কিংবা সূক্ষ্ম ভাবানুভূতিমূলক এ্যাবস্ট্রাকট্ প্রতীকের বাহন হোক, তা বহুকাল ধরে বহু মানুষের ব্যবহারে নির্দিষ্ট কতকগলো অর্থে সমাজ জীবনে স্বীকৃতি লাভ করে।”

তাঁর আলোচনায় আরও দেখতে পাই, ভাষা কোন ধরা ছোঁয়ার বিষয় নয়, সেই ভাষার উপাদান তার শব্দাবলীও তেমনি অদর্শনীয়। সমাজ ও জাতীয় জীবনের কোথায় কোন স্তরে তারা যে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে তার হদিস কেউ দিতে পারে না, অথচ সমাজের প্রতি মানুষের প্রয়োজনে তারা আলাদীনের প্রদীপের মতো তাদের কাজ উদ্ধার করে দেয়। প্রতিটি শব্দের পেছনে সমগ্র জাতির সম্প্রদায়ের কিংবা গোত্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকে বলে শব্দগুলো কারুর একার নয়, সকলেরই অর্থাৎ জাতীয় সম্পদরূপে পরিগণিত হয়। কোনও শব্দের অর্থের পরিবর্তন সাধিত হলে, সে পরিবর্তনও সকলের গ্রহণযোগ্য পথ ধরেই আসে।🍂 (ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি)। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সম্পাদকীয় ঋণ : এই সংখ্যায় প্রকাশিত মহাজীবনের কথা, ফিরেপড়া গল্প, ফিরেপড়া কবিতা বিভাগের লেখাগুলি অন্তর্জাল থেকে সংকলিত। 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment