Sasraya News

Wednesday, March 12, 2025

Sasraya News Sunday’s Literature Special, 13th october 2024। Issue:34-35 । সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল 13 অক্টবর 2024। সংখ্যা: 34-35

Listen

সম্পাদকীয়…

সাশ্রয় নিউজ এর লেখক লেখিকা পাঠক পাঠিকা এবং সংবাদদাতা টেকনিশিয়ন সমস্ত কর্মীবৃন্দকে জানাই আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা অভিনন্দন আলিঙ্গন ও ভালোবাসা।

সকলে খুব ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন আর আগামী বছরের অপেক্ষা করবো ঠিক এই বছরের মতো।

 

 

সকলেই পুজো পুজো পুজো করে অনেক ব্যস্ত ছিলাম। সেই ব্যস্ততা কাটিয়ে এখন আবার নতুন ভাবে শুরু করব নতুন ভাবনার নতুন জীবন।

 

🍂কবিতা

প্রেমের কথা

অরুণ কুমার চক্রবর্তী

 

 

 

প্রেমের কথা কী যে বলি,
পেছন থেকে টেনে ধরে,
যাই যাই যাই ডিঙিয়ে যে যাই, যেতে যে চাই মোহের মুঠো উদোম খুলে…
প্রেমের সুতো কোথায় যে পাই
পেলে ভীষণ ভালোই হতো
কিন্তু এমন ভাগ্যহত, নিরানন্দে আনন্দিত আমরা মানুষ
কেষ্টঠাকুর এমন বাগাল গোরু চরায়, মানুষ চরায়….
প্রেমধন নাকি জমা আছে
রাধারাণীর দুটি পায়ে,
সে খবরটি কোথায় পাবো ???
কেন্দুবীল্ব মেলায় যাবো, বাউলগানের নৌকো বেয়ে মাটির বৃন্দাবনে বসে গৌরলীলার সঙ্গী হবো….

 

 

 

মহাস্নান

বিশ্বজিৎ মণ্ডল

 

 

 

 

মহালয়ার কাক ভোরে উঠে পড়ি, পুণ্য স্নানে …

শহর জুড়ে ছড়ানো অজস্র জঞ্জাল
আর কিছু মানস-বেওয়ারিশ লাশ
নষ্ট সিরিন্জ ,ভুল ওষুধের স্ট্রিপ, দুষ্ট ব্যান্ডেজে
ভর্তি হাসপাতালের বাস্কেট

পাড়া তুতো মা মাসিরা বেরিয়ে পড়েছেন, ভোরবেলা
আমার দুই তীরে অভিশপ্ত জঙ্গল
এগিয়ে যাই___ স্নান ঘাটের দিকে

দেবীপক্ষের সূচনা জুড়ে চলছে, অশুভ নিধনের পালা…
ঘাটে আর পৌঁছানো হলো না, পথের দুপাশে
বেড়ে উঠেছে- গাছ রুপী অসংখ্য অসুরের দল
মহাস্নানে ধুয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর রং

 

 

গুমঘর

অমল বসু

 

 

 

পরন্ত বিকেলে লম্বা ছায়ার
হাত ধরে হারিয়ে যায় একটা উজ্জ্বল দিন।
সুখ দু:খের অনুভূতি স্মৃতির দোলনায় ঝুলে থাকে হয়তো আজীবন।
এই দিন যাপন আসলে একটা প্যাকেজ ট্যুর অথবা ওয়ান ডে
ক্রিকেট।
স্টেডিয়ামে বারোয়ারি উচ্ছাস দখল করে ব্যক্তিগত স্মারক চিহ্ণগুলি।
ব্যক্তিগত ঝরনার আছে গেলে শোনাতে পারে অর্থহীন সান্তনা সংগীত।
তার বেশি কিছু চাইলে ধর্ণায় বসতে হবে, ঝুলিয়ে দিতে হবে দাবীপত্র।
দাবীপত্র নিয়ে অনিবার্য তর্ক শুরু হলে হারিয়ে যাই চিরন্তন
গোলকধাঁধায়।
অর্থহীন হয়ে যায় ভালোবাসা বন্ধুত্ব, অবাক বন্দি হয় আছি গুমঘরে।

 

 

কবি দেবাশিস সাহার গুচ্ছ কবিতা

লাশ

 

 

 

 

ক্ষতবিক্ষত লাশ সাঁতার কাটবে বলে

বুক পেতে রাখে নদী

প্রতিটি ক্ষত থেকে রক্তপাতের পর

স্নানের কি উল্লাস

নদীর বুকে অ নে ক পাথর

প্রতিটি পাথরের আর্তনাদ পেয়ে

লাশগুলো আজ ভীষণ জীবন্ত

রোদ রঙের ঘিলুহীন মানুষেরা লাশ হয়ে

মেতে উঠেছে উৎসবে

মাংসাশী জিভের সামনে অসহায় সময়

রোজ ভোগ্যপণ্য হয়ে নাই

 

সাঁকোপথ

 

 

 

 

সমস্ত কু কেটে সু বসানো হলো

আশাগুলো আরও উজ্জ্বল আর সোনালী

সাঁকো দিয়ে যাদের যাবার কথা

কণ্ঠনালী হারিয়ে ভয় রঙের একটি মিছিল

কড়ি দিয়ে কেনা রাত দখল হয়ে যাচ্ছে

ঘাসের অভিমান দিয়ে বানানো সম্পর্ক

তোমার কি সারাদিনে একবারও প্রেম পায়না

ঝিরঝিরে আদাকুচি মেশানো নেশার বিনুনি

সুখ না পেয়ে

ছুট দিলো গণহত্যার দিকে

আত্মহত্যার বিকল্প কি বেঁচে থাকা

বুকু জানে না বলেই শিখিনি

সকাল হলেই দেখি

গাছেদের পাড়ায় রোদের গণপ্রহার

বাতাস এসে প্রুফ দেখে দিচ্ছে বিরহসঙ্গীতের

তুমি সাঁকোপথ তুমিই মহুয়ারস

হাতে হাতে রঞ্জন বসুর আদাকুচি

 

একাশি এখন একুশ

 

 

মেঘ এসে বদলে দিচ্ছে তারিখ

আড়ালে চলছে গণমাতলামি

বাহিরে বাহিনীর নিয়ম করে ঋতুবিহার

এখন আঠারোর নাম ঝড়

সার সার করে দাঁড় করানো হলো বাইশ

ধর্ষকের পোষাকের নাম অন্ধকার হলে

একুশ থেকে একাশির মুঠোয় এখন রাত

একাশি এখন একুশ

লাল অশ্রুপাতে ভেজা দেশ

কাঁধে করে কোথায় যাচ্ছো পথিক

সামনে আগামীকাল

তাকিয়ে আছে তোমার টিকিটের দিকে।

 

 

ছিন্নপত্রের অংশ

কবিরুল ইসলাম কঙ্ক

 

 

 

 

বৃত্তের চারধারে জমে উঠেছে অবৈধ স্তূপ
এবার চারপাশ ঘিরে জমে উঠবে উৎসব।

পাতার হাত ধরে কাঠকুড়ানি কবেই গেছে জঙ্গলে
মাটিতে সূর্য আলোর সাথে পাখির কলরব।

হিম শিশিরে অব্যক্ত চাঁদের জোছনা নিশ্চুপ
নিঃশব্দে ভেঙে যায় মাটি, ভাঙলা নদীর তীর।

দিনের আকাশে তারার দল নেই কে বলে
এই দেখো, পকেটে পড়ে খুচরো মনস্থির।

উজানগাঙে ভাসানযাত্রা আজ অসংখ্যবার
আমি ভাসি, তুমি ভাসো, হৃদয় ভাসে আকছার।

 

 

হামিদুল ইসলামের দু’টি কবিতা

 

 

 

 

তুমি পুড়ছো

 

তবু তোমার পথ চেয়ে থাকি
বিকেলটা ফিরে আসে না আর
পাতা ঝরে
হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে তছনছ

ছাদে বিবর্ণ চন্দ্রমল্লিকা
রোদের তুলিতে আঁকি তোমার চোখ
অনিঃস্ব পিপাসার নদী

তুমি পুড়ছো
পোড়াচ্ছো আমার শব
লাশ হয়ে আমি জেগে আছি তোমার চোখের ভেতর

ঈশান কোণে মেঘ। বৃষ্টি নেই একফোঁটা

ঈশ্বর ! ঈশ্বর

 

 

সন্ধ্যে উৎরে গেলে ছাদ থেকে নেমে আসি
চাঁদ ওঠে না
তুলসীতলায় নিভে যায় প্রদীপ

অন্ধকার
তবু চাঁদা চাইতে আসে ক্লাবের দাদারা

কতোবার বলি এ বাড়ি অশৌচ
এবার চাঁদা হবে না
আগামীতে মিটিয়ে দেবো

‘ দেখে নেবো ‘ বলে ওরা চলে যায়
লুপ্ত বিবেক
মৃত্যু হেঁটে আসে উঠোনে
প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু বোঝাই ট্রেণ

 

 

জ্বলছে জ্বলুক

শুভমিতা মোনার্ক

 

 

 

 

জ্বলছে জ্বলুক তোমার নামের বারুদ

প্রেম তবুও অসীম গভীর জেনো

সব অভিযোগ হঠাৎই আজ ফুড়ুত

সবশেষে না হয়, গোধূলিটুকুই এনো

 

জানি আমার অনেক আছে দোষ

তবুও বলব তিনভাগ ভালোবাসি

তোমায় ছাড়া জং ধরা এই বুকে

বিনাকারনে আজও আমি হাসি

 

রাতের পর রাত জেগে থাকি একা

আমার মাথায় সোহাগের হাত নেই

পুরোনো স্মৃতির গন্ধ ঘরে মাখা

তোমায় ছাড়া ঝাপসা জীবন-খেই।

 

জ্বলছে জ্বলুক তোমার নামে চোখ

তবুও বলব তোমায় ভালোবাসি

আনন্দ-আলো সব তোমারই হোক

তোমার হাসিতেই, আমি যে ভালো থাকি।

 

 

 

বিদ‍্যাসাগর

অভিজিৎ দত্ত

 

 

 

 

কুসংস্কারের গাঢ় অন্ধকারে

ভারত যখন নিমজ্জিত

বিদ‍্যাসাগর, তুমি তখন এসেছিলে

অন্ধকারে আলোর ন্যায়

এক দেবদূতের মতো।

 

লড়াই করেছিলেন নানা কুপ্রথার বিরুদ্ধে

অনেক লড়াই করে সফল হয়েছিলেন

বিধবাবিবাহ চালু করতে।

 

বুঝেছিলেন শিক্ষা ছাড়া সমাজ অন্ধকার

তাই জোর দিয়েছিলেন করতে শিক্ষার প্রচার

সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে

জোর দিয়েছিলেন নারী শিক্ষাতে

অনেক স্কুল খুলেছিলেন নারীদের জন্যে।

 

মানুষ যতদিন থাকবে অশিক্ষার অন্ধকারে

দেশ হবে তত নড়বড়ে।

তাই তখন দরকার ছিল গণশিক্ষার

বিদ‍্যাসাগর তারজন্য লিখেছিলেন বর্ণপরিচয়

যার তখন ছিল খুব দরকার।

 

বিদ‍্যাসাগরের আরেক নাম দয়ারসাগর

বুঝেছিলেন মানুষের বিপদে

মানুষ হয়ে পাশে থাকা খুব দরকার।

 

বিদ‍্যাসাগর ছিলেন আপোষহীন

নির্ভীক এক অক্লান্ত যোদ্ধা

বিদ‍্যাসাগরের জন্মদিনে (২৬ শে সেপ্টেম্বর)

তাকে জানাই আমার পরম শ্রদ্ধা।

 

 

না বলা কথাগুলো 

গোলাম কবির 

 

 

 

 

এখন কথাগুলো সব থেমে গেছে!
অনুভূতিহীন মৃত প্রাণীর মতো পড়ে আছি,
শব্দেরা আর আসে না অবিরাম বৃষ্টির মতো
অথচ কবিতা লেখার জন্য কী যে আকুলতা
এই হৃদয়ে আমার বোঝাবো কী করে!

এরকম আকালের দিন
কখনো এসেছে কী পড়ে না মনে!

কতো দিন হয়ে গেছে কবিতা লেখার ছলে
হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা কষ্টের দগদগে
ক্ষতগুলো নিরীহ মসৃণ সাদা কাগজের বুকে
তুলে দেবো বলে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলাম
অথচ লিখতে পারছি না এখনো!
কেনো যে আমার এমন হলো!

একটা সময় মান্নাদের গান শুনে শুনে
বিশ্বাস করতাম “অনেক কথার মরণ হলে
হৃদয় কথা বলে” কিন্তু কোথায় যে
হারিয়ে গেছে সেই কথাগুলো!
ওরা তো এখন আর একদমই আসে না
আমার কবিতা লেখার নোটবুকের পাতায়!

মানুষের হৃদয় সব মরে যাচ্ছে দারুণ দুঃসময়ে!
বিশ্বাস, ভালোবাসা, মানবতা এসব
এখন বড্ড বেশি পুরনো, তাই তো
বাতিল হয়ে গেছে পৃথিবীর মানুষের কাছে!

এখন গিরগিটির মতো মানব জীবন কাটানো
মানুষেরাই সবচেয়ে আছে ভালো!
যারাই এরচেয়ে একটু ব্যতিক্রমধর্মী ;
তাদের হৃদয় আজ পাথরের নিচে
চাপা পড়ে থাকা হলুদ ঘাসের মতো।

 

 

 

🦋মুক্তগদ্য

 

 

কবিতা আমার অতৃপ্তি ও তৃপ্তির সেতু, প্রলয় তার হাতেই

তৈমুর খান

 

 

 

কার হাতে আজ প্রলয় রাখি? প্রলয় রাখি? আমার শুধু প্রলয় নিয়ে খেলা। দাবানলের মতোই পুড়ছি। পুড়তে পুড়তে সহে যাচ্ছি তোমার অবহেলা। আমাকে আজ লেখাও তুমি, লেখাও আরও…আমার যত অতৃপ্তি, আমার যত শূন্যতার বিপুল বহ্নিজ্বালা।
সে তো যা হই আমি হই—নিজের ভেতর খুঁজতে থাকি নিজেরই অপূর্ণতা।
এভাবেই তো বাঁধ ভাঙে আর বেরিয়ে আসি—শিয়াল, কুকুর, বেড়াল, ইঁদুর অথবা শিংওয়ালা— কোনও প্রাণী কিংবা নেহাৎ আদিম ঘোড়া। এভাবেই লিখতে থাকি। আয়নার সামনে দাঁড়াই। দেখি, মাথা থেকে ধড় ছাড়া। দেখি লেজ গজানো, হাত-পায়ে খুর, অথবা আদিম অসৌন্দর্যে ভরা। আর এই চারিপাশ আমার মতোই সহযাত্রী—অস্পষ্ট আলোয় এসে খেলা পাতে কবি বন্ধুরা। খেলা তো কবিতা! আদিম অভ্যাস। খেলা তবু আমাদের সবারই প্রেরণা।
সমস্ত সৃষ্টিই আদিম অভ্যাস। সমস্ত সৃষ্টির মধ্যেই মিশে থাকে অতৃপ্তি, অথবা সমস্ত সৃষ্টিই হয় অতৃপ্তি থেকে। তবুও এই অতৃপ্তির মধ্যে স্রষ্টা খুঁজে পান কোনও তৃপ্তি— যা অতৃপ্ত হয়েও শিল্পীকে নতুনের প্রেরণা যোগায়। কবিতা রচনা সেরকমই এক শিল্প—হৃদয়ে অতৃপ্তির শূন্যতা নিয়ে এর যাত্রা। যে অতৃপ্তি আমাদের জীবনযাপন, স্বপ্ন, প্রেম আর সৃষ্টিতত্ত্ব। কখনোই আমরা পূর্ণ নই। আকাশের একপিঠ শুধু আমাদের সামনে। চাঁদের একপিঠের আলো এসে আমাদের ওপর পড়ছে। আলো আর গুঞ্জনে আমরা পথ হাঁটছি। হেঁটেই যাচ্ছি। পথের শেষ কোথায়? কখনো আমরা শেষ পৌঁছাতে পারি না। প্রেমিকা চলে যায় অন্য বাড়ি অন্য পুরুষের কাছে। বয়ঃসন্ধির গোধূলির মাঠ অন্ধকার হয়। তখন লিখি—
“সঙ্গম-পিয়াসী মেঘ একা একা মুখচোরা মেয়েটির মতো
জানালায় কাঁদে.
তার বুকের ঔদার্য থেকে মিহি মেহগনি সুর,
বুকের গভীর থেকে করাত-কলের ক্লান্ত যুবকের কান্না…”
(নিরুচ্চর মেঘ: মধু মঙ্গল বিশ্বাস)
এই নিরুচ্চার মেঘ আবহমান কালের পিয়াসী সওগাত। কালিদাসের কালেও যক্ষের পিয়াস নিবৃত্তির বাহন হয়ে কাব্য রচনার প্রেরণা যুগিয়েছে। মেঘের সঙ্গে কখনো চাঁদও এসেছে। বুকের ভেতর শোনা গেছে অযুত অশ্বের ছটফটানি। ‘বাৎসায়নই হেঁটে গেছেন পাহাড় পেরিয়ে’। সেই নিরন্তর যুবক-কন্ঠ অতৃপ্তির মেদুর ঘ্রাণে সত্তার চিরন্তন পিয়াসকেই রূপ দেয় যুগে যুগে—
“I bring fresh showers for the thirsting flowers,
from the seas and streams;
I bear light shade for the leaves when laid
In their noon-day dreams.”
(The cloud: PB Shelley)
মেঘ বৃষ্টি দিয়ে পিপাসা দূর করে, কিন্তু মেঘেরও যে পিপাসা পায়, মেঘও তৃষ্ণার্ত—এরকম antithesis কবিদের দার্শনিক প্রত্যয়ে সংলগ্ন হয়ে রয়েছে। সুতরাং আপাত প্রকাশের আড়ালে অপ্রকাশ মাধুর্যে মননের নিগূঢ় তাৎপর্য অনুভবের একান্ত অভিনিবেশ দাবি করে। যেখানে—
“প্রত্যাশার বাতাসে নাড়ায় পাতা
আর স্বপ্নের রঙে সে সবুজ হয়ে
এখনও ঘাসের মতো নিশ্চেতনায়
সারাদিন জেগে থাকে”
(অপেক্ষা ও একটি নাম: তৈমুর খান)
জেগে থাকার মধ্যে দিয়েই অতৃপ্তির অনিবার্যতা ধরা পড়ে। যেখানে সমস্ত ভাষা হারিয়ে যায়। অনুভূতি স্তব্ধতার ধ্যানে বসে। শিল্প তখন একান্ত আত্মমুখী, বাহির বিমুখ সাধনা।
এই সাধনার ভেতরই অন্ধকার জমা হয়। আর এই অন্ধকারই পোস্টম্যান হয়ে আমাদের চিঠি বিলি করে। কখনো আমাদের চিঠি নিয়ে যায়—
“আমাদের পোস্টম্যানগুলির মতো নয় ওরা
যাদের হাত হতে অবিরাম বিলাসী ভালোবাসার চিঠি আমাদের হারিয়ে যেতে থাকে।”
(হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় চিঠি। প্রদীপ নিভে ধুলোয় মিশে যায়। রামধনু আঁকা মেঘ ভেঙে যায়। প্রেম বিষাদের হাওয়ায় বাড়তে থাকে। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে প্রেমের এই ক্রিয়া-বিক্রিয়া। মানুষের থেকে মানুষে ছড়িয়ে যায়। শেলি যা অনুভব করেন, আমরাও তখন তা-ই করি—

“When the lamp is shattered,
The light in the dust his dead,—
When the cloud is scattered,
The rainbow’s glory is shed.
When the lute is broken,
Sweet tones are remembered not;
When the lips have spoken,
Love accents are soon forgot.”
(The fight of Love).

চণ্ডীদাস যা লিখলেন, সারাজীবন আজকের প্রেমিকও তাই পেলেন— “দুঁহু কোরে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া”। এই বিচ্ছেদই তো কবিতা লেখায় বিশ্বের তাবৎ প্রেমিককে তথা কবিকে। তাঁরা অতৃপ্তি কুড়িয়ে নেন আর ভিখিরির মতো, পাগলের মতো, তপস্বীর মতো জীবনের পর্ব-পর্বান্তরে পাড়ি দেন। সবাই-ই যেন পূর্ণতার পানে ধাবিত হতে চান। প্রকৃতি নিসর্গ-বনমর্মরের শূন্যতা কিংবা দিগন্তের নীলেও আশ্রয় খোঁজেন। রবীন্দ্রনাথ ‘স্ফুলিঙ্গে’র শাশ্বত বাণীতে তাকেই রূপ দেন—
“কল্লোলমুখর দিন
ধায় রাত্রি পানে।
উচ্ছল নির্ঝর চলে
সিন্ধুর সন্ধানে।
বসন্তে অশান্ত ফুল
পেতে চায় ফল।
স্তব্ধ পূর্ণতার পানে
চলিছে চঞ্চল।।”
তখনই অতৃপ্তির ব্যাপক যজ্ঞে দিনের রাত্রি পানে, নদী-ঝরনার সমুদ্র পানে, ফুলের ফল হবার সাধনায় ছুটে যেতে দেখি। শূন্যতার চিরন্তন স্তব্ধতাও পূর্ণতা চায়। সুতরাং জীবনও মৃত্যুর পানে ছোটে। মৃত্যুকে প্রিয়ার মতন ডাকে।
কিন্তু এই অতৃপ্তি যখন থেমে নেই, তার সর্বগ্রাসী বাঁধনে আমাদের বেঁধে রেখেছে, পৃথিবীর যাত্রী হয়ে আমরা প্রতিনিয়ত তার শিকার—কী প্রেমে, কী প্রাপ্তিতে, কী ভোগে, কী চরিতার্থতায় এক অনির্বাণ আগুন-উৎসব চলছে। তাতে আমরা পতঙ্গ হয়ে চারপাশ থেকে উড়ে উড়ে আসছি। নিজেকে ছাই করে দিচ্ছি। নিরুপায় না পাওয়াকেই তখন পাওয়ার বিকল্পে চালান করে দিয়ে তৃপ্তির সুখদ বার্তায় বলে দিতে পারছি—
“এই করেছ ভালো নিঠুর হে,এই করেছ ভালো–

এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।”
নিত্যনতুন আঘাত আসুক। আঘাত পেয়েও অবিচল থাকতে পারব। যেমন করে অভাবের দিনগুলিতে চুমু খেয়ে থেকে যেতে পারি। যেমন নিঃসঙ্গ দিন-রাত আকাশের তারা গুনে কাটে। যেমন ঘুরে ঘুরে কথা বলে একলা রাতের জোনাকি। গরম ভাতে ঘি না পেয়েও আমরা প্রার্থনা করি—
“আমাদের ঠান্ডা ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।”

(নুন: জয় গোস্বামী)
তখন চণ্ডীদাস আবার উঠে এসে বসেন। আমাদের ভাঙা প্রেম জোড়া লাগে। সমাজ-শাসনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে আমরা লিখি—
“কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে
তাহাতে নাহিক’ দুখ।
তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার
গলায় পরিতে সুখ।।”
এই সুখ তো তৃপ্তিই। এই পৃথিবীর কলুষ বীভৎস রূপ গ্লানি ও ভয়ঙ্করতায় আমাদের তিষ্ঠোতে দেয়নি। এতোটুকু স্থান নেই শান্তির কিংবা বিশ্রামের। বারবার পলায়নী সত্তা জেগে উঠেছে। অসুখ, নষ্ট শশা কিংবা পচা চালকুমড়োর ছাঁচে জীবন ফলেছে। আমাদের সভ্যতার জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে উটের গ্রীবার মতো অন্ধকার। তখন এখানে আর স্বপ্ন বুনে কে বাঁচতে চায়?—যন্ত্রণা, হাহাকার, রক্তাক্ত পৃথিবীর মূর্খ উচ্ছ্বাস কিছুই কবিকে বাঁচার আশ্বাস দিতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত নেন—
“ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো—
পউষের রাতে—
কোনোদিন আর জাগবো না জেনে
কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন জাগবো না আর—”
(অন্ধকার)
জীবনানন্দ দাশের এই অঙ্গীকার যে শেষ কথা নয় তা সকলেরই জানা। জীবনের তিক্ত হলাহল পান করে অতৃপ্তির বেদনায় কবি ক্লান্ত, বিষণ্ণ। আমরাও জানি বিষাদের নিরন্তর সমুদ্র আমাদের সামনে প্রবাহিত হয়েছে, ঠিক তার পাশাপাশি আশাদ্বীপও। তা দারুচিনির না হোক, ইন্দ্রের প্রমোদ উদ্যান না হোক,— একটু নিঃশ্বাস ফেলার ঠাঁই অবশ্যই। তা কাঁটাবন হলেও তৃপ্তির স্বর্গের মতন। আমাদের ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত শরীরের নুন চেটেও জীবনের ঘ্রাণ পাই। জীবনানন্দ দাশ সেই মুহূর্তটিকেও লেখেন—
“সকল ভুলের মাঝে যায় নাই কেউ ভুলে-চুকে
হে প্রেম তোমারে!—মৃতেরা আবার জাগিয়াছে!—
যে ব্যথা মুছিতে এসে পৃথিবীর মানুষের মুখে
আরো ব্যথা—বিহ্বলতা তুমি এসে দিয়ে গেলে তারে,—
ওগো প্রেম,—সেইসব ভুলে গিয়ে কে ঘুমাতে পারে!”
(প্রেম)
সুতরাং প্রেম যখন আমরা ভুলতে পারি না, তখন পিপাসার গান আমাদের গাইতেই হয়। আর সেই গান বেয়েই আমরা জীবনের সিঁড়ি ডিঙোই। আমাদের গোধূলিলগ্ন সমাগত হলেও বৃন্দাবনকে তাচ্ছিল্য করতে পারি না। তখন আবার শেলিকে মনে পড়ে। কিটসের ব্যর্থ প্রেমের প্রদীপ যাঁর সামনে নিভে গেছে। যে কবি দেখেছেন সৌন্দর্যের মৃত্যু। সেই কবিই যথার্থ হাহাকার আর অতৃপ্তিকে অনুভব করেই বলতে পেরেছিলেন:

“We look before and after,
And pine for what is not:
Our sincerest laughter
With some pain is fraught;
Our sweetest songs are those that tell
Of saddest thought.”

(To A Skylark)
সুতরাং দুঃখের উৎস থেকেই আসে আনন্দের গান। যে অতৃপ্তি মৃত্যু লেখে, সেই অতৃপ্তি স্বপ্নও লেখে। যে অতৃপ্তি বিচ্ছেদ লেখে, সেই অতৃপ্তি মিলনও লেখে। যে অতৃপ্তি পরাজয় লেখে, সেই অতৃপ্তি বিজয়ও লেখে। দিন যেমন রাতের পাশাপাশি হাঁটে, শূন্য আর পূর্ণও তেমনি পাশাপাশি বিরাজ করে। কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না। সেই কারণে দিনেও রাতের বাঁশি বাজে। পূর্ণতায়ও শূন্যের ভজন শোনা যায়।এ এক বৈরাগ্যের লীলা—আমাদের সৃষ্টিসত্তাকে লীলাময় করে তোলে। পূর্ণ কলসি কখনোই বাজে না। নিরেট মানুষ বোধশূন্য। কখনোই লেখে না। মনন-ই প্রকৃত স্রষ্টাকে চিনিয়ে দেয়। তাঁর জগৎ-জীবনের ওপর ভাবনার নিরন্তর পর্যায় চলে। দিনযাপনের গ্লানি তাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে পারে না। অনাহারক্লিষ্ট হলেও তিনি যে দার্শনিকতায় আত্মধূপের মতো নিজস্ব অন্বেষণে ব্যাপৃত থাকেন তা তাঁর কোনও না কোনও সৃষ্টিতে ধরা পড়ে।
মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কবি ভাস্কর চক্রবর্তী জীবনকে যেভাবে দেখেছিলেন—তা ছিল একজন দার্শনিকেরই প্রকৃত নির্মোহ দৃষ্টি। পার্থিব আসক্তি সে সময় না থাকারই কথা। ছিলও না। কিন্তু কোনও কালেই কি ছিল? সারাজীবন কবিতাগত প্রাণ উৎসর্গ করেছেন আত্মমগ্ন যাত্রায়। যে যাত্রায় অবসাদই তাঁর সঙ্গী। মৃত্যুকে জন্মের পাশাপাশি হেঁটে যেতে দেখেছেন। বেঁচে থাকার প্রতিক্ষণে মৃত্যু চেনা হয়ে গেছে। তবু চলেছে সিগারেট ধরানো। প্রেম ও মৃত্যু দুই-ই তাঁর কাছে সমান। শীতকাল এলে তিনি দীর্ঘ ঘুম দিতে চান। সুসংবাদকে আহবান করেন। ‘নীলরঙের গ্রহ’ কাব্যে লেখেন—
“মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতেও আমি বেঁচে আছি বটে।
কোথায় বেটোফেনের চিঠিপত্র
আমি আরেকবার ওইসব পড়ে দেখতে চাই।
আমার পুরোনো জীবন আমি
ভাঁজ করে রেখে দিতে চাই সুটকেসে।
ভাবতেই পারি না
কী শান্ত আর সুন্দর আর পবিত্র থাকি
আমি যখন তোমার কাছে যাই।”
(হাতবোমা নয়)
এই বেঁচে থাকা অতৃপ্তিকে ছাপিয়ে গেছে। নবান্নের ক্ষেতে কাক হয়ে ফিরে আসার সান্ত্বনা নেই। কিংবা জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ঘোড়া হয়ে ঘাস খাওয়ার। রাত্রির অন্ধকারে শেয়াল হয়ে বেরিয়ে পড়ারও চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়নি। নিজেরই লাশ বয়ে আয়ুটুকুর সীমানায় মৃত্যুর কাঁটাতারে বন্দী হয়ে যথাসম্ভব নিজের সঙ্গেই জীবনযাপন। একমাত্র ভাস্কর চক্রবর্তীই পেরেছিলেন অতৃপ্তি অপূর্ণতার কফিনে ঢাকা জীবনের এই স্বাদ গভীর-গভীরতর করে তুলতে। আমরা জানি—
“আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু—নাই, কিছু নাই।”
(দারিদ্র্য: নজরুল ইসলাম)
কিন্তু এই ‘নাই’-এর ভেতরেই ‘আছে’-এর সাধনা। বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, শেষে প্রত্যাশা—
“প্রতিজ্ঞা কঠিন হাতে
একে একে তারা সব
চোখের শোকাশ্রু মুছে ভাবে—
ঘরে ঘরে নবান্ন পাঠাবে।”
(স্বাগত: সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
কবিতা অতৃপ্তি আর তৃপ্তির মাঝখানে দাঁড়িয়েই কবিদের ইঙ্গিত দেয়। সব সৃষ্টিই অপূর্ণ থেকে পূর্ণের দিকে, অসম্পূর্ণ থেকে সম্পূর্ণের দিকে ধাবিত হয়। সেই ক্রিয়াটি কিন্তু কখনোই সফলতায় পৌঁছায় না। কবিতা সেই উৎসের ধারাটিতেই প্রবহমান একটি শিল্প। আমার কাছে তারই রহস্য চিরকাল অতৃপ্তি এবং তৃপ্তির সেতুতে নির্মাণ চায়।
তখন কবিতার হাতেই সমূহ প্রলয় রাখতে হয়।

 

 

🍂  ধারাবাহিক উপন্যাস/১৯ 

 

ঐ পুঁচকে সাহসিনী মেয়েটা রাজ্যব্যাপী রাত দখলের ডাক দেয়, তখনও অনঙ্গ ভেবেছিলেন… এটা হয়তো কোনো বিরোধী দলের কর্মসূচীর অঙ্গ। বিশেষ আমল দেননি, নেহাৎই কৌতুহলবশে একবার গেছিলেন ওর নিজের এলাকায়, শুধুই দেখতে।


অনেকটা গল্পের মতো

সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

 

 

“আমার প্রতিবাদের ভাষা
আমার প্রতিরোধের আগুন
দ্বিগুণ জ্বলে যেন দ্বিগুণ
দারুন প্রতিশোধে।
করে চূর্ণ, ছিন্নভিন্ন
শত ষড়যন্ত্রের জাল যেন;
আনে মুক্তির আলো আনে,
আনে লক্ষ শত প্রাণে,
শত লক্ষ কোটি প্রাণে…
আমার প্রতিবাদের ভাষা,
আমার প্রতিরোধের আগুন “…

আজ এই গানটাই বড়ো বেশী মনের মধ্যে বাজছে অনঙ্গর। অনেকদিন নয়, প্রায় একমাসেরও বেশী হয়ে গেলো ধারাবাহিক উপন্যাসে একেবারেই হাত ছোঁয়ানো হয় নি। একটা চরম অরাজক সময় ও পরিস্থিতিতে টিভির পর্দায় চোখ রেখেই সময় কেটে গেছে। কখনো কোনোদিন এমনও হয়েছে অনঙ্গর নিজেরই তৈরী করা নিয়ম নিজেই ভেঙে ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ না করে, শোবার ঘরে টিভির সামনের সেন্টার টেবিলে সোমাকে লাঞ্চ দিতে বলেছেন এবং তার জন্য সোমার কাছে যা যা শোনার, সেসব নিঃশব্দে হজম করেছেন। কিন্তু সোমাকে বোঝাতে চান নি বা পারেন নি মানুষ সুদুর অতীতে এমন প্রতিবাদ, এমন আন্দোলন দেখেছে কিনা সন্দেহ! ছাত্র আন্দোলনের হাতে হাত রেখে সাধারন, অতি সাধারন ও অসাধারন সর্বস্তরের মানুষের সাড়া দেওয়া, এগিয়ে আসা তাঁদের প্রাণের টানে, বিবেকের দংশনে… এটাই কি কেউ দেখেছে? যেখানে ডিম ভাত, বিরিয়ানীর হাতছানি নেই, যেখানে বাসে চড়ে গিয়ে কলকাতায় চিড়িয়াখানা বা দক্ষিণেশ্বর বা কালীঘাট ঘুরতে যাবার মজা নেই, যেখানে যোগ না দিলে পরদিন থেকে তার ” দোকানের সাটার খুলবে না বা অটোর লাইনে গিয়ে তাঁর অটো নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না অথবা তাঁর কাজে ফাঁকি দেবার অভিযোগে তাঁকে কাজ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে দেওয়া হবে (অতি সাম্প্রতিক ঘটনা ) ” … এমন হুমকি নেই, স্বার্থগন্ধহীন এমন একটা প্রতিবাদ কি কেউই দেখেছে? তবে সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে অনঙ্গর…শুধুই কি স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতঃপ্রণোদিত আন্দোলন? সেই দুর্নীতিও কি কেউই কখনও দেখেছে? কথায় বলে… ” গাঁয়ের লোক, পেটে বিদ্যে ভারী ভয়ঙ্কর “। ঠিক সেটাই আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে সেই লোকটা বা সেই লোকগুলো যাদের হাতে মানুষ পরম নিশ্চিন্তে নিজের জীবনের বাঁচা মরাকে অর্পণ করে নির্দ্বিধায়। সেই লোকগুলোর সাথে
‘ মানুষ ‘ শব্দটা সত্যিই বড়ো বেমানান। আর জি কর হাসপাতালের যে দুষ্ট চক্র, আর শুধু আর জি করেই বা কেন, রাজ্য জুড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যা দেখলো সারা বিশ্বের মানুষ, ভাবলে গা শিউরে ওঠে। কোথাও কম, কোথাও বা বেশী। নতুন একটা শব্দবন্ধ
” থ্রেট কালচার ” সেটাও একইসাথে হাত ধরাধরি করে উঠে এসেছে, যা অনঙ্গ সেন তাঁর এই বয়সে হয়তো কানাঘুষো শুনে থাকবেন অন্যভাবে, কিন্তু এইভাবে??? এই লোকগুলোর মধ্যে দিয়ে?? অশিক্ষিত মূর্খ, ক্ষমতাভোগী, বাহুবলী মানুষ এসব করবে, সেটাও মেনে নিতে কষ্ট হলেও মেনে নিতে হয়, কিন্তু এই লোকগুলো!!!
অনেক কিছু দেখে নিলেন অনঙ্গ লকডাউন থেকে সাম্প্রতিক আন্দোলন। এই আন্দোলন ও প্রতিবাদ দেখে অনঙ্গর মনে হয়, মানুষের মনে প্রতিবাদের তুষের আগুন হয়তো ধিকিধিকি জ্বলছিলো, আর সেই আগুনে হাওয়া দিয়ে তীব্রতর করলো ডাক্তার কন্যার মৃত্যু ও হঠাৎ করে প্রকাশ পাওয়া সব দুর্নীতি।
প্রথমদিকে এমনটা ছিলেন না অনঙ্গ। টিভির পর্দায় একটা ধর্ষণ আর খুন এমনটা তো আগেও হয়েছে, কিন্তু ছত্রিশ ঘণ্টা ডিউটি করার পর সেই ডাক্তার মেয়ে যখন বিশ্রাম নিতে গিয়ে ধর্ষিতা হয়ে খুন হয়, যখন ” ডাক্তারেরা ” মৃতার বাবা মাকে কখনও ‘ সুইসাইড ‘, কখনও” খুব অসুস্থ ” বলে ডেকে আনে, পুলিশি তৎপরতায় যখন তাঁদের মেয়েকে দেখাতে তিনঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়, যখন বিনা বাধায় বিশেষ ” ব্যবস্থাপনায় ” সূর্যাস্তের পর পোস্টমর্টেম হয়ে যায়, যখন বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতেই অতি ব্যস্ততায় শ্মশানে তড়িঘড়ি দাহকার্য সমাপ্ত হয়… যখন প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় রাত দখল কর্মসূচীর ফাঁকে চল্লিশ মিনিট ধরে কিছু দুষ্কৃতী ভাঙচুর করে নিষ্ক্রিয় পুলিশের সামনেই…এতোগুলো
‘ যখন ‘ এর পর সব মানুষের হৃদয়েই কিছু প্রশ্ন ভীড় করে আসে। আর অনঙ্গ সেই প্রশ্নগুলোর শিকার হয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখতে বাধ্য হন।
যেদিন প্রথম ঐ পুঁচকে সাহসিনী মেয়েটা রাজ্যব্যাপী রাত দখলের ডাক দেয়, তখনও অনঙ্গ ভেবেছিলেন… এটা হয়তো কোনো বিরোধী দলের কর্মসূচীর অঙ্গ। বিশেষ আমল দেন নি, নেহাৎই কৌতুহলবশে একবার গেছিলেন ওর নিজের এলাকায়, শুধুই দেখতে। কিন্তু তারপর থেকে মানুষের এই স্বতঃপ্রণোদিত প্রতিবাদকে কোথায় যেন মন থেকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছেন, নিজেও একটু একটু করে দ্রবীভূত ও সম্পৃক্ত হয়েছেন চিনি ও জলের রসায়নের মতো, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের রসায়নের মতো। ছুটে গিয়েছেন আর জি করের ধর্নায়… হ্যাঁ, শুধুই সংখ্যা বাড়াতেই বলা যায় বা নিজেকেই প্রবোধ দিতে… এমন একটা অন্যায়ে আমিও তোমাদের পাশে আছি, আমিও ” বিচার চাই “। ” ঘোলা জলে ” মাছ ধরতে সবাইই না হলেও কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ চিরকালই চেয়েছে, চাইছে এবং চাইবেও, কিন্তু সবাইই সেই ঘোলা জলে ধরা ” পাকগন্ধী ” মাছ খেতে যে চায় না, সেটা দীর্ঘ আন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে জুনিয়র ডাক্তাররাই শুধু নন, অনমনীয় শিরদাঁড়াসম্পন্ন সিনিয়র ডাক্তারেরা ও সাধারন মানুষরা তাঁদের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে বুঝিয়েও দিয়েছেন।
কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে, আন্দোলনকে ছোটো করে দেখিয়ে হয়তো আনন্দ পেয়েছেন, রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে তারা নিজেরাই হয়তো নিজেদের সম্মানহানি করেছেন।
অনঙ্গ সাধুবাদ দেয় সেইসব শিল্পী, গায়ক গায়িকা, অভিনেতা অভিনেত্রী এবং অতি সাধারণ কিছু ” দিন আনা দিন খাওয়া ” খেটে খাওয়া মানুষদের সবাইকেই যাঁদের ভয় নেই পুরস্কার বা কাজ হাতছাড়া হবার।
অনঙ্গ সাধুবাদ দেয় সেইসব মিডিয়া বন্ধুদের যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, নির্ভীকভাবে তাঁদের সঠিক কাজটি করে গেছেন।
কিন্তু এ তো হোলো ” ধান ভানতে শিবের গীত “। তার পাঠকের থেকে এতোদিন দুরে সরে থাকার জবানবন্দি। তাকে যে লিখতে হবে। ” লিখতে তোমায় হবেই, হবে, ছাড়বো না “।
কিন্তু একটা উপন্যাস মানে কি শুধুই কিছু চরিত্র?
তাদের সাংসারিক বা পারিবারিক টানাপোড়েন?
সেইসব চরিত্রের মানসিক শব ব্যবচ্ছেদ?
একটা উপন্যাস কি লেখকের লেখায় সেই বিশেষ সময়কে তুলে ধরে না বা তুলে ধরার অধিকার নেই? সেখানেও কি লেখক নির্ভীকভাবে সময়ের খতিয়ান লিপিবদ্ধ করতে তার লেখক স্বত্তার কাছেই অঙ্গীকারবদ্ধ নয়?
তাই আজ এই ঊনবিংশতিতম পর্ব নাহয় হয়ে থাকুক কালের সাক্ষী হয়ে সময়ের আদালতে বিচারের অপেক্ষায়।
“আমি সেইদিন হবো শ্রান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধবনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ
ভীম রণভূমে রনিবে না…”
(নজরুল ইসলাম)

(চলবে…)

 

 


 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একাধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি ও ছবি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী

অবশ্যই লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা দয়া করে পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব । দায় লেখকের নিজস্ব। কোন বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোন ভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোন আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না । লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন।

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment