



সম্পাদকীয়
গোপন স্থানের জিনিস গোপন থাকাই ভালো। যাঁঁরাই প্রকাশের মাধ্যম খুঁজেছি, তাঁরাই বিপত্তি ঘটিয়ে দিয়েছি। চার দেওয়ালের মাঝে আমরা কী করলাম না করলাম কেউ দেখতে যাবে না। অথচ, তা কীভাবে ফাঁস হয়! কেউ একজন নিশ্চয় প্রকাশ করেছে! এই প্রকাশের মাধ্যমকে সংযম করে নিজের ভেতরেই ডুব দেওয়া ভালো। এতে পরিতৃপ্তির আনন্দ লাভ হয়। 🦋
গল্প /১
জীবন্ত ছবি
সীমা ব্যানার্জ্জী
সবে পূর্ব মেদিনীপুরের নতুন শহর ঘোড়াধরায় এসেছে মিতারা। ঘোড়াধরা নামটা একটু বিচিত্র হলেও কিন্তু বেশ ছিমছাম। না না এখানে ঘোড়া ধরা হয় না। এখানেই থাকতে হবে বাবার চাকরির সুবাদে। মা বলেন, ‘অনেক দেখা ঘোরা হল তোর বাবার পাল্লায় পড়ে। কোথাও থিতু হয়ে বসার আর উপায় নেই।’ মায়ের অনুযোগের কারণ অনেক। স্বামীর ফাই ফরমাশ, বাড়ি সাজানো গোছানো, ছেলেমেয়ের স্কুল ঠিক করা, ভালো কাজের লোক খুঁজে পাওয়া, এরকম অনেক কিছুই একা মাকেই সামলাতে হয়।
একটু একটু করে বাড়িঘর গোছানো হল। ছেলেমেয়ের স্কুলও শুরু হয়ে গেছে। তবে বাড়ির কাজের জন্য ভালো লোক খোঁজা এখনও চলছে। এরকম সময় বাবার এক সহকর্মী যোগাড় করে দিলেন ছেলেটাকে। ওকে দেখে মা-এর মন বলল, বাড়ির সব কাজ ওর দ্বারা হবে না, তবে বাজার করে দেওয়া, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা, গাছে জল দেওয়া, এসব ও ভালোভাবেই করতে পারবে। প্রথম দর্শনেই বাবা, মা উভয়েরই পছন্দ হয়ে যায় ছেলেটিকে। দেখে মনে হয় ভালো ঘরের ছেলেই হবে। পয়সার অভাবে এধরণের কাজ করছে। মায়ের মনটা একটু খুঁত খুঁত করে। কারণ একে দিয়ে ঠিক ঘর পরিষ্কার বা রান্নাঘরের কোটাবাটার কাজ করানো যাবে বলে মনে হয় না। সব না হোক, কিছুটা সাহায্য যে পাওয়া যাবে এই নতুন শহরে, তাই যথেষ্ট।
মায়ের মনের কথা যেন টের পায় ছেলেটা, বলে দরকার পড়লে বলবেন ঘরের অন্যসব কাজেও সাহায্য করে দেব। মা ভাবে… বলে কি ছেলেটা-তেলা চকচকে চেহারা পরনে হাওয়াই সার্ট, চোখে কালো রোদ চশমা পরে, সাইকেল চালিয়ে এসেছে। মা ওর কথা বুঝেই নিয়েছেন, শুধু মাথা নাড়ে। কাজে খুব ভালো হয়ে যায় ছেলেটা, নামটা যার ভন্তা আর ভন্তার কাজের ধরণ আর রকম-সকম দেখে মায়ের অবাক হবার পালা শুরু হয়ে যায়। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসা খুব পছন্দের কাজ ওর। খুবই সময় মতো, নিয়মিত ভাবে করে। তার সঙ্গে ইলেক্ট্রিকের বিল দেওয়া, মায়ের সিল্ক শাড়ি ধুইয়ে আনা, বাজার করা, বেশ খুশি হয়েই করে। বাইরের কাজেই উৎসাহটা বেশি দেখা যায়। মিতা, তোতার সঙ্গে সহজ হয়েছে সম্পর্ক। তবে মিতার উপর ওর মনোযোগটা বেশি মনে হয়। ভন্তা ওদের স্কুলে যাবার জামা-জুতো, বইখাতা, জলের বোতল- টিফিনবাক্স সব সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়। মা বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করেন। আবার অবাকও হন ছেলেটা যে এতো গোছানো হবে আগে বোঝা যায়নি, সেটা ভেবে মায়ের বিস্ময় চরমে ওঠে।
_____________________________________________
নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মিতা দেখতে পায় সিঁড়িতে নিচের ঘরে আলো জ্বলছে। ও ঘরে তো আজ ভন্তাদার শোবার কথা। তবে ও কি এখনও ঘুমায়নি! দেখি তো কি করছে পাজিটা, দু এক পা এগোবার পর মিতার চলৎশক্তি রোহিত হয়ে যায়।
_____________________________________________
সেদিন, যেদিন মা পাশের বাড়ির হাসিদির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সকালের কাজে একটু দেরী করে ফেলেছেন। “মিতার চুলটা এখনও বাঁধা হয়নি স্কুলে যেতে না দেরী হয়ে যায়।” এই কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভেতরের বারান্দায় পা দিয়ে মা অবাক। ভন্তা মিতার চুল বেঁধে, রিবন দিয়ে মাথার দু-পাশে সুন্দর দু’টো বো করে দিয়েছে। মাকে দেখা মাত্র মিতা নাকে কেঁদে ওঠে “ মা আমি চাইনি তবু দেখো কি বিচ্ছিরি করে ভন্তাদা আমার চুল বেঁধে দিয়েছে।” শিশুদের মন বড্ড স্বাধীন কিনা! ওরা মনে মনে যা চায় তা না পেলে কাঁদতে থাকে।
মা বলেন, “কই না তো কি সুন্দর দু-পাশে দু’টো প্রজাপতির মতো ফুল করেছে বেশ লাগছে দেখতে তো।”
ভন্তাও থেমে থাকে না। মিতাকে কোণঠাসা করার জন্য বলে, “ তুমি তো স্কুলে গিয়ে অনেক কিছু শিখে এসেছো দেখছি ; সবুজ জামার সাথে সবুজ রিবন, লাল ফ্রকের সাথে লাল ফিতে, এখন থেকেই ম্যাচিং চাই তোমার, এ্যাঁ”! ছোটদের বিরক্ত করতে ভন্তা ওস্তাদ। তার সঙ্গে গালমন্দ খাওয়াটাও প্রাপ্য বলে মেনে নেয়। মনে হয় বেশ উপভোগ করে এধরণের ব্যাপারগুলো। এর মধ্যে মা’র সঙ্গেও বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে ভন্তাদা। মা’র অনেক কাজকর্ম করে দেয় ও। মা’কে দিদিমণি বা মেমসাহেব না বলে কাকিমা বলে ডাকে। তবে মিতার এসব একদম পছন্দ নয়। “ওকে ছাড়িয়ে দাও মা। ভন্তাদা একটা বিচ্ছিরি লোক, স্কুলে পৌঁছে দেবার পরও আমার দিকে তাকিয়েই থাকে যেন আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধুদের নাম জানা চাই। আর মাঝে মধ্যেই বলে, “আচার আচার গন্ধ পাচ্ছি। তুই নিশ্চয়ই আচার খেয়েছিস।” মিতাও কথা শোনাতে ছাড়ে না, বলে, “তোমার কাজ ছোটদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া আর বাড়ি ফিরিয়ে আনা, এসব খবরের কি দরকার তোমার ভন্তাদা?” এ ধরণের ধমক খেয়েও ভন্তা দাঁতবার করে হাসে।
এহেন ভন্তাদার কিন্তু একেবারে ভিন্নরূপ বিকেল থেকে। মিতা ও তোতাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার পর আর বেশি কিছু করতে চায় না। কিছু কাজ থাকলে কোনওরকমে সেরে নিয়ে ভন্তাদা সাইকেল নিয়ে উধাও হয়। আবার তার দেখা পাওয়া যাবে ঠিক রাত নটার সময়।
ছোট শহর। কাছাকাছির মধ্যেই দু’টো সিনেমা হল। তার যে কোনও একটার আশেপাশে পাওয়া যাবে ভন্তাদাকে এই সময়। বিকেলের ভন্তাদাকে সকালের কাজের ছেলে বলে চেনাই যাবে না। পাটভাঙা জামা-কাপড়, টেরি বাগানো চুল। মাথায় টুপি। চোখে কালো রোদ চশমা। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। উদ্ধত দাঁড়ানোর ভঙ্গী। কথায় প্রতিবাদের সুর। বিদ্রোহের আগুনে যেন জ্বলজ্বল করে ওঠে ভন্তাদা। ভীষণ উত্তেজিত ভাবে কথা বলে চলেছে ভন্তাদা ওর বখাটে মতন ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে। মাঝে মাঝে এর তার উদ্দেশ্যে কিছু অল্প মধুর মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই কম বয়সী মহিলাদের উদ্দেশ্যে। বেশিরভাগ সময়েই সবাই ওকে উপেক্ষা করে চলে যায়। দুই একজন রাগত ভঙ্গীতে কটমট করে তাকায়। তবে যে কোনও কারণেই হোক এর বেশি দূর কিছু এগোয় না। ভন্তাদার অভিযোগ আর বিপ্লবের রূপ পায় না।
এর মধ্যে মিতার বাবাকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে। তাই ঠিক হয় রাত্রিবেলায় বাড়ি পাহারায় থাকবে ভন্তা। সিঁড়ির নিচে ছোট ঘরটায় ওর শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। রাত নটার পর সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে ভন্তাদা এসে হাজির। মিতা আর তোতা এর মধ্যে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। মিতা টের পায় ভন্তাদা মাকে টুকটাক সাহায্য করছে, টুকটাক কথাবার্তা চলছে। শুনতে শুনতে মিতার চোখে ঘুম নেমে আসে।
বেশ অনেক রাতে মিতার ঘুম ভেঙে যায়। বাথরুমে যেতে হবে। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মিতা দেখতে পায় সিঁড়িতে নিচের ঘরে আলো জ্বলছে। ও ঘরে তো আজ ভন্তাদার শোবার কথা। তবে ও কি এখনও ঘুমায়নি! দেখি তো কি করছে পাজিটা, দু এক পা এগোবার পর মিতার চলৎশক্তি রোহিত হয়ে যায়। বিস্ময়ে হতবাক মিতা দেখে ভন্তাদা হাপুস নয়নে কাঁদছে। কান্নায় যেন ভেঙে ভেঙে পড়ছে। অন্য দিকে কোনও মন নেই। ওর ঢাউস ব্যাগটার মধ্য থেকে নানারকম জিনিসপত্র উঁকি মারছে। কিছু মেঝেতে ছড়ানো। তার মধ্যে তোয়ালে, বাচ্চা মেয়েদের ফ্রক, পুতুল, খেলনা, জামা জুতো সবই আছে। আর ভন্তাদা বাচ্চাদের একটা জামা আর তূলোর একটা খরগোস জাতীয় কিছু খেলনা বুকে চেপে ধরে কাঁদছে আর বলছে, “তোর মা তোকে একটুও ভোলেনি সোনামণি, তুই যেখানেই থাকিস না কেন ভালো থাকিস মা।”
ভীষণ ভয় পায় মিতা। নিষিদ্ধ জায়গায় পা দিয়েছে, নিষিদ্ধ কথা শুনে ফেলেছে, ভয় হয়, কষ্ট হয়, বিস্ময়ে হতবাক হ্য়, আর একটা অপরাধবোধে যেন মাটিতে মিশে যায় মিতা। খানিকক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পায়। পা টিপে টিপে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে ভাবতে থাকে মা? কোন মা? মেয়ে? কোন মেয়ে? ভন্তাদার এত দুঃখ তাদের জন্য। এসব চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না। সকালে ঘুম ভাঙার পর প্রথম চিন্তা, মাকে কিভাবে কখন রাত্রির ঘটনাটা বলা যায়। মা কি বলবেন, মিতার তো কোনও দোষ নেই ঘটনার সাক্ষীমাত্র। সকাল থেকে কাজের মাসী ভুটিয়াদি ভীষণ ঘরের কাজে মন দিয়েছে। মার সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরছে। মিতা খুব বুদ্ধি করে ভুটিয়াদিকে এড়িয়ে চলেছে। সারা সকাল মাকে একবারের জন্যও একা পাওয়া গেল না। মিতা আজ একটাও কথা বলেনি ভন্তাদার সঙ্গে। ভন্তাদাও কি মিতাকে এড়িয়ে চলেছে?
স্কুলে এসে মিতা একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। প্রথমে ইংরেজি তারপর অঙ্কের ক্লাস সেরে ড্রইং ক্লাসে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচে মিতা। লিলির পাশে বসে, পাখির ডানায় রং বুলাতে বুলাতে প্রথম উন্মোচন করে গত রাতের অভিজ্ঞতার কথা। ভেবেছিল লিলি হয়ত চমকে উঠবে সব শুনে। লিলি একটু অবাক হয় মাত্র। তারপর অনীপ্সাভাবে পাখির ল্যাজে রঙ করতে করতে বলে ভন্তার হয়ত ওর মেয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছিল তাই কাঁদছিল। আরও একবার ভীষণ চমকে ওঠে মিতা। বলে, “কি বলছিস লিলি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।” লিলি ধীরে সুস্থে জবাব দেয় “যতই হোক মায়ের মন তো বাচ্চার জন্য কষ্ট হবেই। ভন্তাদা তো আসলে একটা মেয়েছেলে, তাই না? আমি ভেবেছি তুই বোধহয় সব জানিস। তোদের বাড়িতে কাজ করে, ওর তো বিয়ে হয়নি। কিন্তু একটা বাচ্চা হয়েছিল। বাচ্চাটাকে যখন মিশনারিদের হাতে তুলে দেওয়া হল, তখন থেকেই ওর পাগলাটে ভাব। কাজকর্ম শিখল না, পড়াশুনা করল না। ছেলে সেজে থাকে। বাচ্চাটা থাকলে আমাদের বয়সীই হত, ঝিনিদি আমাকে সব বলেছে। ঝিনিদিকে জিজ্ঞাসা কর, সব জানতে পারবি।”এসব শুনে মিতার মাথাটা কেমন ঘুরতে থাকে। কিছু ভালো লাগে না। পাখির পাখার রঙ সব মিলিমিশে একাকার হয়ে যায়।
‘কণা’ মিস এসে মিতার ছবি দেখে অবাক- বাহ কি ‘জীবন্ত ছবি” জীবনের সব রঙ। সুখ-দুঃখ আশা-হতাশা, প্রতিবাদ, ঘৃণা বিদ্রোহ সব যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু মিতা কিছুই যেন মেনে নিতে পারছে না। ভীষণ কষ্ট হয় ওর। ভন্তাদা যার আসল নাম পাখী (প্রতি পালিত’ পূর্ণ যৌবনা নারী, সন্তানের মা। সন্তান হারানোর হাহাকার ওর মাতৃ হৃদয়ে। সবার চোখে ধুলো দিয়ে ও লুকিয়ে রাখে ওর আসল রূপ। তবে কি ও মিতার মধ্যে খুঁজে ফেরে নিজের সন্তানকে। সেই চিরপরিচিত সহজ সরল জগতটা যে ধীরে ধীরে সরে যায় মিতার কাছ থেকে দূরে অনেক দূরে… চোখদুটো কখন চলে গেছে জানলা পেরিয়ে যেখানে পাতারা নিঃশব্দে টুপটাপ ঝরে চলেছে… 🍁
অঙ্কন : প্রীতি দেব
🦋 কবিতা / এক
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
শঙ্খসাগর, দুই এক কলমের অশ্রু
৩.
প্রবাহিত মানুষের ভালোবাসা
সাতসাগরের, এক মায়া উন্মাদনা…
দশ আঙুলে মেখেছি,
দিতে পারি অকৃপণ সব ভালোবাসা,
সমুদ্র শঙ্খ এর রব,
হৃদয়ের দুয়ারে,দাঁড়িয়ে রয়েছে,
এখানেই সব রক্তপাত।
৪.
আমি দু’চোখ উপড়ে, অন্ধ হয়েছি,
শুধু শব্দচুমোর পরশের অন্তিম লোভে,
ভেতরের সব শব্দ
গানের মতন বেজে ওঠে।
অন্ধ চোখের কান্না
কোনোদিন আর থামবে না।
শিবনাথ মণ্ডল
বসন্তের বাহার
এসেছে ফাগুন
লাগছে দারুন
বইছে দক্ষিণ হাওয়া ;
বসন্ত আজ
মধুর হয়ে
সবার মনে পাওয়া।
এলো ফাগুন
জ্বালায় দারুন
মন বসেনা ঘরে :
আপন মনে
ডাকছে কোকিল
সাথী পাবার তরে।
মাখাবো রং
হোলির দিনে
রং নেব সবার :
প্রতি বছর
ফিরে আসুক
বসন্ত টা আবার।
আবু জাফর দিলু
ফাগুনের আগুন ঠোঁটে ফুল ফোটাবো
তোমার মনের সবক’টি জানালা খুলে দাও…
ঋতুরাজ এই বসন্ত দিনে নতুন মোড়কে আসুক ফুল পাখি।
সূর্য ডুবুডুবু সাঁঝে কবিতা সৈকতে কণ্ঠে কণ্ঠ ছুঁয়ে..যাক্,… জ্বলুক বুকে স্বপ্নালোক,
শতখণ্ড, ফালি চাঁদ হয়ে পরনের কাতান শাড়ি পূর্ণিমা জোছনার মত হাসুক।
আমি এখানে একটু খোলামেলা আকাশ চাই,
যেখানে কোঁচড় ভরে রোদ কুড়নো যায়…
সজনে পাতা-ফুলের ডগায়, কুঞ্চি লতায় কোকিলের কুহু তানে…
সব সখীদের ফুল্ল খোঁপায় স্বচ্ছ একটি গোলাপ গুঁজে দেয়া যায়।
যেখানে নীরবে সংগোপনে হলুদ বরণ কাজল কালো চোখ… গোল্লাছুট খেলবে…
না না ছুঁই ছুঁই প্রেময়তার আলতা রাঙা পায়ে
এঁকে দেবে চাঁদের উষ্ণতা কোমল চুমোয়।
একটি গোলাপ হাতে শুধু এটুকু মনে রেখো…
ফাগুনে আগুন ঠোঁটে আজ ফুল ফোটাবো।
দু’আঙুলের ফাঁকে ঝড় তুলে দেবো৷ শ্বাস-প্রশ্বাস খুলে,
যেখানে তুমি আর আমি চাঁদ বুকে ক্ষণ পারি দেবো…
যেখানে ফুল-পাখি ফুলে ফুলে করবে একান্তে কোলাকুলি।
মৌন বুনতার উষ্ণতায় দুলে ওঠে ষোড়শী শরীর,
ছুঁয়ে নেয় তার সবটুকু সুখ মনের কার্ণিশে।
যেখানে তুমি আর আমি ফাগুনের আগুন ঠোঁটে ফুল ফোটাবো।
ফাহিমা সরকার
আবার বসন্ত আসে
ঘণ কুয়াশায় এক কাপ ধূমায়িত চায়ের মতো
বসন্ত আমার ভীষণ প্রিয় ঋতু,
অথচ মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে এখন স্মৃতি বিভ্রাট।
প্রায়শঃই ভুলতে বসি, কী নিপুণ ছিল সে-সব দিন,
যখন বসন্তের জয়োল্লাসে মুখর আমি, আমরা।
কত গুলো বসন্ত পেরিয়েছে,
কিঞ্চিৎ অনাগ্রহে পুড়িয়েছিলাম আমার বাসন্তী জীবন।
তারপর বসন্তও আমাকে পুড়িয়েছে দ্বিগুণ উৎসাহে,
দিয়ে গেছে সমুদ্র সমান অবহেলা।
স্মৃতি বিভ্রাট আঁটকে পড়ছিলো বিস্মৃতির গুদামে।
তারপর…
তারপর কেটে গেল অনেকটা সময়।
আমি এখন রোজ কোকিলের কুহুতান শুনি,
আমার বাগানে রোজ ফোটে, টকটকে লাল গোলাপ
ধবধবে সাদা বেলি, রাতভর গন্ধে বিভোর করে রজনীগন্ধা, কামিনী।
বসন্তের ফিরে আসা আমি টের পাই, অভিমান ভুলে বসন্ত কড়া নাড়ে আমার দরজায়।
বসন্ত আসে আবারও, আমাকে রাঙাতে।
ইসমাত মির্যা
ঠাঁই
তারস্বরে কেঁদে মহাআগমন
অজানা পৃথিবীটিতে, অসহায়ভাবে-
খুঁজেছি সেদিন ঠাঁই,
জননীর কোল পেয়েও বুঝিনি
কতটা প্রাপ্য; সময় গড়ায় বাড়ে অতৃপ্তি
আরো চাই, আরো চাই, অমুকের মত
বিশাল নিবাস- ঠাট বাট আরো-
ভূমি পেয়ে গেলে আকাশে হাত বাড়াই!
অদৃষ্ট মেনে গড়ায় জীবন
মেয়াদ ফুরিয়ে আসে,
ইত্যোবসরে শিখেছি কত কি
হাঁটা চলা, কথা বলা, কেউবা শিখেছি
খেটেপিটে খাওয়া, কেউ কেউ লেখাপড়া-
বয়সের সাথে বিচিত্র সব প্রজ্ঞা অভিজ্ঞতা;
জ্ঞানের রাজ্যে অন্ধ যে আমি
রহস্যভরা পৃথিবীটা প্রায় রয়ে গেল অজানাই!
দৃশ্য জগৎ ভ্রমণ ফুরালে
বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে চলে যাই-
ধণী বা গরীব অভিন্ন তবু সবার কামনা
এখানে থাকতে চাই- আরো কিছুকাল
হোক না সে পথে, ছোট কুঁড়েঘরে, অথবা প্রাসাদে,
বিদায় নিতে কে চায় বাসা ছেড়ে?
চেনা আস্তানা ফেলে যেতে মনে জাগে প্রচণ্ড ভয়
প্রকাশ্যে কেঁদে অদৃশ্য দেশে অবশেষে খুঁজি ঠাঁই!
শহিদ মিয়া বাহার
প্রেম ও বিপ্লব
আমি প্রেমিক না বিপ্লবী প্রশ্ন করো না
জেনে নিও
প্রেম আর বিপ্লব হাওয়ার চটিতে সমান্তরাল হাঁটে না কখনো
আমার এক হাতে স্লোগানের কঙ্গো বাজে
অন্য হাতে প্রেম
তোমার চোখের ঝড়ের বিদিশায়!
তুমি বিপ্লব জ্বালিয়ে প্রেমের মশাল জ্বেলো না প্রিয়!
যুদ্ধের ময়দানে বুলেট যদি বিঁধে
বুকে না পিঠে?
প্রশ্ন করোনা
যদি বুলেট বিঁধে যায় পিঠে
জেনে নিও বিপ্লব মরে যায় প্রেমের আতশী তিরে!
প্রেমের হাটে ক্ষুধার বিকিকিনি হয় কি কখনো?
ক্রীতদাস প্রেমিক নই আমি
বিপ্লবের যৌবনদাস হয়ে গ্যাছি শায়েরি
জেনে নিও
ক্ষুধাময় পাঁজরের হৃৎপিণ্ডে বিদ্রোহ ছাড়া
আর কোনও প্রেম জমা থাকে না প্রিয়!
ঝুমানা সিকদার আফসানা
পুঁই মাচার ঘর
আমি তোমায় ভালোবেসে
তোমার অগোছালো, অসম্পূর্ণ জীবনকে
পূর্ণতা দেয়ার জন্য কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে
নিয়ন আলোকে উপেক্ষা করে
আসবো তোমার কপির নিবাসে।
যেখানে থাকবে না ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোর উজ্জ্বলতা, থাকবে না ইন্টারনেটের সংযোগ।
তবুও আমি আসব তোমার
পুঁইমাচার সাথে জুড়ে থাকা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে।
যেখানে তটিনী’র তটভূমিতে
নগ্ন পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে
আস্ত একটি বাজরার হলদেটে রুটির মতো
সূর্যাস্ত দেখা যায়।
যেখানে দল বেঁধে পাখিরা সন্ধ্যায় নিড়ে ফিরে,
যেখানে নদী-নালা, খাল-বিলে উপচে পড়ে
জোয়ারের যৌবন।
যেখানে আযানের ধ্বনির সাথে সাথে জেগে উঠে শালিক, চড়ুই আর ঘুঘু পাখির ঝাঁক।
প্রত্যুষে প্রভাতে-
তাদের কিচিরমিচিরে ভাঙবে দু’জনের ঘুম
আর তুমি আদুরে কণ্ঠে বলবে ভালোবাসি সবটা জুড়ে।
রোকসানা রহমান
বোধিবৃক্ষ
আমি এতগুলো আমার আমি কে নিয়ে
অসংখ্য প্রয়োজনের মাঝে
হারিয়ে গিয়েছি…!?
তাইকি আর আমার আমি কে নিয়ে আর ফেরা হল না…!
চেনা ঘর গ্রীল বারান্দা ঝুলন্ত গাছ করতলে
উষ্ণরাগ মাটিমাখা প্রশ্বাসের নিচে
অন্ধকার থেকে বোধিবৃক্ষের ছায়ায়
আগুন মেখে পবিত্র অন্তরে গাঁথা- মগ্নতার
সুবিশাল সাঁকোয় দাঁড়িয়ে আছি আজও ভালোবাসার প্রত্যাশায়।
অথচ ফেরার পথটুকু চিনে নিতে চাইলে
আমার হাঁটু ভাঁজ করে কেন গুটিয়ে থাকে।
তবু আমি এতগুলো আমির ভিতর খুঁজি
শোক, দুঃখ তাপের ভিতর সেই রঙের বাহার
শীতের বিকেলের সোনাঝরা রোদ্দুরমাখা
নিঝুম সকাল
ছায়া- মায়া, জোনাকির আলোর রূপকথার
রূপালি ঝালর।
এতগুলো আমি কি কেবলই বোধিবৃক্ষের
উৎসর্গ পাতায় আমি – আমিই হয়ে থাকবো…!?
চৈত্রের দুপুরের আগন্তুক জড়িয়ে নিবে
হে বিষাদ, আমি আমার ভিতরে জ্বলে রাতের
স্বপ্নের মায়াবী আলোর রহস্যময় স্রোতের
বানডাকা ভাঙা নৌকার মতন, ইচ্ছের কাছে
আত্মসমাহিত অন্য এক আমি।
আমার ভিতরে লুকায়িত আমি দেখি বকুল ভাসে হাসি ঝরে ঢেউয়ের মিছিলে
আমি ভেসে যাই দুরে – বহুদুরে একটা
আমার আমিকে খুঁজে পেতে।
আর ফেরা হলোনা, বৃক্ষের ডালেপালারা ঝুলে আছে
অন্য আমির আঁচল ধরে।
🦋গল্প /২
বিশ্বরূপ
রাখী নাথ কর্মকার
বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন যেন ধড়ফড় করে উঠল জগদীশের। চেয়ারি দিয়ে পুতুলের মুখটা তৈরি করতে গিয়ে হাতটা কেঁপে গেল ওর। মজানো এঁটেলে মাখামাখি চড়চড়ে আঙুলগুলো সব থরথরিয়ে কাঁপছিল। পরনের খেটো মলিন ধুতির কোলে ঘাড় কাত করে কেতরে পড়েছে হাতের নরম পুতুলটা। পিছনের হাড় জিরজিরে বেলগাছটার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে হাঁপাতে শুরু করল জগদীশ…
শেওড়াতলির মাঠ থেকে মাইকে দুম দাম ভেসে আসছে একঘেয়ে হিন্দি গানের সুর! আহা, সে দিনগুলো সব গেলো কোথায়… চোখের সামনে ভেসে ওঠা সাদাকালো ছবির মতো… ক’য়েক বছর আগেও যে এই সময়টায় বাতাসে কান পাতলে শোনা যেত পরাণ উতাল করা ঝুলন গান-“দোলে রাধাশ্যাম ঝুলনদোলায় /দোলে আজি শাওনে…!” পুবপাড়ার শিবকালী সঙ্ঘের মন্ডপে হই হই করে শুরু হয়ে যেত মানুষ ঝুলন। ছোটছোট ছেলেমেয়েদের জ্যান্ত রাধাকেষ্ট সাজিয়ে দোলায় দোলানো হত, তাই দেখতে কত্ত না ভিড়! পাড়ার গোস্বামীদের বাড়িতে বাচ্চাগুলো সব ঝুলন সাজাত। উঁচু চৌকাঠে টকটকে তেলসিঁদুরের ছোপ। দালানের গা ঘেঁষে ঝিরিঝিরি পাতার বুড়ো ঘোড়া নিমগাছের তলায় বাচ্চাগুলো ঝুলন নিয়ে মেতে উঠত। কাঠের গুঁড়ি, বালি, সুড়কি, খোয়া দিয়ে রাস্তা বানাত। কচি দুব্বোঘাসের শতরঞ্জি বিছানো থাকত উঠোনে, তারই ওপর থকথকে জলকাদা মাখা কাপড় দিয়ে বানাত এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়। ঘাসের চাকলা কেটে খেলার মাঠ, কড়াইএর চারধারে কাদামাটি বসিয়ে পুকুর। চারপাশে হরেকরকমের পুতুল!
আহা, কত রকমের পুতুলই না বানাতে পারত জগদীশ! ছাঁচে ফেলে, আঙুলের কায়দায়…! ওর ছোট্ট টালির ঘরের সামনে এক চিলতে দাওয়ায় সার দিয়ে শুকোত সেইসব কাঁচা মাটির পুতুল। খড়িমাটিতে গুঁড়ো রঙ, গদের আঠা গুলে যখন ন্যাতার পুঁটুলি দিয়ে পুতুলগুলোর মেটে, উদোম শরীরে রঙ বোলাত, নিমেষের মধ্যে যেন পুরো গাঁখানাই জ্যান্ত হয়ে চলে ফিরে বেড়াত জগদীশের চোখের সামনে। দইওলা, ফলওলা, বরকনে, মেছুনি, মেঝেনি, ধানঝাড়া চাষী, কলসি কাঁখে বউ..কে নেই সেই গাঁয়ে? এমনকি দূর দেশে লড়াইএ ব্যস্ত সেনাপল্টনও হাজির!
বাপঠাকুদ্দার পেশা ছিল এই মাটি ছেনে পুতুল গড়া। অভাবের সংসারে হরেক না পাওয়ার কষ্টের মাঝেও কিন্তু অনেক পাওয়ার সুখ লুকিয়ে ছিল…! এখন আর কেউ পুতুল কেনে না, ঝুলন সাজানোর সময় নেই কারো। তবু পুতুল গড়ে জগদীশ, কাঁপা হাতে মাটি ঘাঁটে, সার দিয়ে রঙ করা পুতুল সাজিয়ে রাখে দাওয়ার এক কোণে। কীসের আশায় কে জানে…!
নাতিটা মুখ ভেঙচে বলে–‘পাগল!’ তার অবিশ্যি এ হেন কাজে মন নেই এতটুকুন।
অথচ একটা সময় ছিল যখন ঝুলন সাজিয়ে দেওয়ার জন্যে হাতপা ছুঁড়ে বায়না করত নাতিটা, কাঁদত, লাফ কাটত। জগদীশের পাশে বসে পড়ে মাটির তাল ঘেঁটে ট্যারাব্যাঁকা পুতুল বানানোর চেষ্টা করত। তখন কত অল্পেই আমোদ হত নাতিটার, পেঁপে পাতার ডাল জুড়ে ফোয়ারা বানিয়ে দিলে বাপমামরা ছেলেটার করুণ মুখে উথলে উঠত আহ্লাদে। সদ্য গড়া রঙিন পুতুল হাতে তুলে দিলে সেই কাচগুলি চোখেই বিশ্বরূপ দশ্যন হয়ে যেত জগদীশের। সে সুখের চেয়ে বড় সুখ আর কী আছে?
ছেলে-বৌটা হঠাৎ সেবার একটা গাড়ির তলায় পড়ে পটাস করে মরে গেল। কানাখোঁড়ার লাঠির মতো নাতিটাকেই শক্ত করে বুকে আঁকড়ে ধরেছিল জগদীশ আর ওর বৌ কমলা। সেই বাপের সুপুত্তুর এখন বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সামনে দিয়ে চলে যায়, বুড়ো ঠাকুদ্দার পানে ফিরেও দ্যাখে না! জগদীশের ছেলেটা কিন্তু এমনতরো হ্যাঁকাটে ছিল না, বরং এট্টু বাপন্যাওটাই ছিল! টলমলে বুড়ো জগদীশের বুকের মধ্যে দুখের কালবোশেকি পাক দিতে থাকে। সক্কলেই তো সুযোগ বুঝে কেটে পড়ল, এমনকি ধম্মসাক্ষী করা বউটাও! একলাটি বিড়বিড় করে জগদীশ-“এট্টিবারের জন্যিও ভাবলি নি, এই শেষবেলা একা পাইলে গেলে এই নিড়বিড়ে বুড়োটার চলবি কী করে?” আজকাল নাতিটার ধরণধারণ দেখে চোখ বুঁজতেও যে ভরসা পায় না জগদীশ।
কেমন যেন হয়ে গেছে ছেলেটা। ঢ্যাঙা, সিড়িঙপানা চেহারা। কোনও মতে টেনেটুনে ইস্কুলটা পাশ দিয়েছে, সারাদিন পাড়ায় টো টো। মাঝেসাঝে দু-একদিন ভ্যানগাড়ি টানে, কখনো জোগাড়ের কাজ করে… প্রায়ই দিন সোমত্ত ছেলে গাঁজা, তাড়ি, চোলাই টেনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে দাওয়ায়। মন্দিরতলার পাথুরে বেদীতে পেন্নাম ঠোকে, মাথা কোটে জগদীশ- ‘নাতিটার নেশাগুলান সব ছাইড়ে দ্যাও ঠাকুর। দুট্যাকার বাতাসা ভোগ দুবো!’
_____________________________________________
চাঁদগলানো অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটিভর্তি দুধের মতো হাঁড়িয়া একটু একটু করে ওকে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু আজ…কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না জগদীশের। উঠোনের দড়ির খাটিয়াটা আজ বড্ড টানছে।
_____________________________________________
আজ সকাল থেকেই শরীরটা আনচান আনচান করছিল জগদীশের। দুপুরে কোনমতে চাট্টি ফ্যানভাত গড়িয়ে নিয়েছিল। বিকেলে নাতিটাকে বেরোতে দেখে শুধিয়েছিল জগদীশ- “বদ্যিবাবুর গুমটিতে এট্টিবার যাবি দাদা? ওখেন থেইকে দুটা পুইরা এনে দিবি? বুকের ভিতরটা কেমন যেন ধড়ফড় করতেছে…”
মুঠোফোনে খুচখাচ করতে করতে বেরিয়ে যাবার আগে মুখ ঝামটা দিয়েছিল নাতিটা- “ধড়ফড় না ছাই! সকাল থেকে ক’পাত্তর গিলেছ শুনি? ঝুলনের বেলা শেষ হতে চলল, তবু মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে! ওসব পুতুলফুতুল এখন আর কার পিন্ডিতে লাগবে? সব ছেড়ে-ছুড়ে এখন যাও ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো দিকিনি…”
দু’হাতে বুক চেপে ধরে দাওয়ায় গিয়ে বসেছিল জগদীশ।
বুকের ভিতরটা আজ সত্যি বড় অস্থির করছে জগদীশের। মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে…। সুয্যি ডুবেছে খানিকখন হল। জগদীশের বউটা মরেছিল আজ থেকে বছর তিনেক আগে… এমনই অলুক্ষুণে এক সন্ধেয়…। রতন, সুবল, হারাধন… ভোরের আধোজাগা স্বপ্নের মতো ছেলেবেলার বন্ধুগুলোও সব এক এক করে মরে হেজে যাচ্ছে। সেই চেনা সুরে ‘জগা’ বলে ডাক পাড়ত যারা, তাদের কেউই আর বেঁচে নেই। আজকাল বড্ড একা একা লাগে জগদীশের। দুটো সুখদুখের কতা কইবার লোক নেই, আপদেবিপদে পাশে এসে দাঁড়াবার মতো লোক নেই। সবাই কেমন নিজেতে চিত্তির। সবাই ছুটছে। ওদের ছেলেবেলায় ও পাড়ার হাবুলকাকা নিত্য এসে রুগ্ন বাপের খবর নিয়ে যেত। লক্ষীমাসি মাকে দুদিন ঘাটে দেখতে না পেলেই দোরে এসে হাঁক পাড়ত! আর এখন দ্যাখো দিকি, কেউ বাঁচল কী মরল, কারোর কোনও গা নেই!
দুপুরের ঠান্ডা মন্ড হয়ে যাওয়া ভাতেই একটু জল ঢেলে কাঁচা পেঁয়াজ, নুনলঙ্কা ঘষে নেয় এই সময় জগদীশ। রাত্তির হয়ে গেলে আর ক্ষিদে বোধটা থাকে না… চাঁদগলানো অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটিভর্তি দুধের মতো হাঁড়িয়া একটু একটু করে ওকে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু আজ… কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না জগদীশের। উঠোনের দড়ির খাটিয়াটা আজ বড্ড টানছে। কিন্তু না, অদ্দূর আর যাওয়া নেই, পিঁড়েটার পাশে ঠান্ডা দাওয়ার ওপরেই শরীরটা এলিয়ে দেয় জগদীশ।
* * *
হাসপাতালের খুপরি জানলা দিয়ে টুকরো আকাশ দেখা যায়। জোলো আষাঢ়ের সেলেটরঙা গোমড়া আকাশ। থম মেরে থাকে। আর সেই অচেনা আকাশের নীচে অচেনা মুখ সব। নাতিটা তো গত ক’দিন ধরেই বেপাত্তা!
বুকের মধ্যে উথালপাথাল করে জগদীশের, ঐ ভাঙা টালির ছোট্ট এট্টুখানি ঘর; দাওয়ার টিঙটিঙে বেলগাছ; দড়ির খাটিয়া; ফুলআঁকা তোবড়ানো টিনের তোরঙ; ইটপাতা, ভাঙা তক্তপোষের তলায় ডাঁই করা পুতুলের মেলা… তাতেই যেন আজন্মের সুখ। সে ঘরে আর বোধহয় ফেরা হবে না ওর! আঁকুপাঁকু ঘোলাটে চোখে অসাড়, অবশ জগদীশ কোঁকায় –‘শেষবেলাটা আমায় ঘরে নে চল দাদা…’ গোঁ গোঁ শব্দে হারিয়ে যাওয়া তাঁর সে আকূতি কেউই বোধকরি আর শুনতে পায় না!
হাসপাতালের নোনাধরা দেওয়াল, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের মধ্যে গায়ে গা লাগানো একের পর এক খাট। খাটের ভাগ্যি নেই জগদীশের, তাই এক কোণে এক ছেঁড়া কাঁথাতেই তার জগৎসংসার! একদম পাশের খাটটাতেই পা ভেঙে পড়ে থাকা একটা কালোকুলো লোক। ‘কাকা’ ‘কাকা’ করে ডাকে মাঝেসাঝে। সে ডাকটা শুনতে বড় ভালো লাগে জগদীশের। ভালো লাগে তার কচি খোকাটা জগদীশকে এসে ছুঁলে… যখন মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে বাপটাকে দেখতে আসে বছর চারেকের খোকাটা। ছ্যেলে নয়ত পিলে! পিড়িক পায়রার মতো বকবকানি, নধর ছাগলছানার মতো ছটপটানি! রান্নাঘর থেকে মায়ের ঊনকোটি চৌকুট্টি জিনিসপত্তর নিজের ছেঁড়া গেঞ্জির কোঁচড়ে ভরে চলে আসে হাসপাতালে। ভাঙা ছাঞ্চে, ব্যাঁকা কুনকে, হলুদের ডিবে, তেলের চোঙা, আটার ডেলা…। চমকে দ্যাখে জগদীশ- আটার ডেলাটুকুনকে হাতের তেলোয় গোল গোল করে দলা পাকাচ্ছে সে ব্যাটা!
খোকাকে ইশারায় কাছে ডাকে জগদীশ। দুব্বল, অশক্ত শরীরে মাথা তুলতে পারে না, ঘাড় ঘোরাতে পারে না, গলা দিয়ে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ ছাড়া আর কিচ্ছুটি বের হয় না। অথচ কী অদ্ভুত! আটার ডেলাটার গায়ে জগদীশের কাঁপা আঙুলগুলো ঘুরতে থাকে যেন আগের মতোই। বেআক্কেলে ডেলাটা কখন যেন জাদুবলে ঝাঁকামাথায় সবজিওলা হয়ে যায়… চার বছুরে খোকা গোল্লা গোল্লা চোখে চেয়ে থাকে! কাচগুলি চোখে সে যেন এক অদ্ভুত আশ্চয্যি…!
পরের দিন খুপরি জানলা দিয়ে পিছনের টুকরো মেঠো জমিতে আগাছার মাঝে বাচ্চাটাকে আপন মনে কাদামাটির ডেলা পাকাতে দ্যাখে জগদীশ। ঘোলাটে, ঝাপসা চোখে জগদীশের মনে হয়… কচি হাতের কাঁচা ভাঁজে ডেলাটার গড়ন কেমন চেনা চেনা লাগছে না?
সেই রাত্তিরেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দ্যাখে জগা, বাপটা তার উঠোনে বেলগাছটার তলায় বসে ছাঁচের দুই খোলে পুতুল বানিয়ে জোড়া দিচ্ছে, উনুনের ধারে বউটার কোলের কাছে উপুড় হয়ে শুয়ে একমনে ঝুলন সাজাচ্ছে নাতিটা…! গোস্বামীদের মন্দির থেকে ভেসে আসছে চেনা সুর-“ওরে ঐ যে কান্দে মিলন বাঁশরী / আজ মিলিবে বিশ্ববাসী বংশীধারী…” আর তারপর… তারপর কখন যেন ওর ছোট্ট নাতির মুখটা বদলে গিয়ে মাটির পুতুল হাতে চার বছুরে খোকার মুখ হয়ে যায়…!
ঘুম না ভাঙা ভোরে, অজানা ঘোরে কখন জানি এক ফোঁটা নোনতা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ে নিথর জগার মাথার তেলচিটে বালিশে…! 🍁
🦋অঙ্কন : প্রীতি দেব
🍁কবিতা /দুই
অর্ণব দত্ত
উষ্ণ ফাগুন
অবুঝ মনের সবুজ ব্যথা-
বসন্তের আগায় বেঁধে রেখেছি।
কিশোর মনের উন্মুক্ত জানালা
গঙ্গার হাওয়া বয়েছে কত।
বসন্তের রঙ আমাকে হতবাক করে,
রেনু মেখে প্রজাপতি বলে যায় আগমনের গান,
রূপালী পর্দার আড়ালে লুকানো সোনার রূপায়ণ।
জীর্ণ পাতা ঝরেছে অবুঝ ভাবে,
ঠিকানার অভাব।
বাতাস যেমন বৃষ্টি এড়ায়
বসন্ত তোমায়…
অসম্ভব।
বিপ্লব ভট্টাচার্য্য
ঘরের মেয়ে
আমি তোমাদের সেই মেয়েটি
যাকে ভোর না হতেই
ঢুকতে হয় রান্না ঘরে।
আমি তো সেই মেয়েটি,
যার জঠোরে লালিত হয় তোমার সন্তান।
আমিই সেই মেয়ে
যাকে ছয় মাসের সন্তানকে
আলের উপর ঘুম পাড়িয়ে
কাটাতে হয় সোনালী ফসল।
আমি সেই মেয়েটা-
তোমারা যাকে রাস্তায় একলা পেয়ে,
লোলুপ রসনাভরা চোখে তাকিয়ে থাকো?
আমি তো সেই মেয়েটা
যাকে বাপের ঘর ছেড়ে, স্বামী নামক,
পুরুষটাকে আপন করতে হয়।
কিন্তু ভেবে দেখেছো কি কোনদিন?
আমি তোমাদেরই ঘরের মেয়ে।
মমতা রায় চৌধুরী
বসন্ত জাগ্রত হয়
পড়ন্ত বিকেল পাতাঝরা বসন্তে
মনটা হু হু করে কিংশুকের বনে
আবির আর রঙের ছটায় তোমার মুখে
ফুটে ওঠে ঝরা পাতার বিবর্ণতা
কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরের সেই স্বতস্ফুর্ততা
বসন্তের কোকিলের কুহুতান
আনমনাতে হাজির হয়
তোমার মুখ
দু’চোখ জুড়ে আলপনা আঁকে ভালোবাসার সুখ
মধুমাসে আবার ৪০ বছরের
উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে দেহের প্রতিটি কোষে
শব্দরা জোট বাঁধে
রঙেরা অনুরণন তোলে
তখন বুঝি বসন্ত বাতাসে
কাউসারী রোজী
ভেতর ঘরে বসবাস
কৌশল আর রহস্য বাস করে
মানুষের ভেতর,
একই বুকে সমাহিত রক্তহীম প্রকল্প,
বর্তমান আর অতীতের নিরন্তর
দমবন্ধ ইতিহাস।
কাগজ কলমে নির্মমভাবে মনের দানব সামলানোর জন্য ধর্ম নীতির প্রচার, তৈরী হয় বিচার ঘর
আর কায়েদখানা।
বাস্তববুদ্ধির শেকলে লোভের সপ্ন পালতে পালতে
মানুষ ভুলে যায় কবরস্থানে বায়না হওয়া জমির খবর,
জমানো সম্পদ দুর্যোগ
ঘটাতে ঘটাতে নাই হয়ে যায় সময়ে।
ভালোবাসার হেঁচকা টানে
নেমে যাক প্রার্থনার নৌকা,
সাধনার উচ্ছ্বাসে খসে যাক
দুঃসময়ের বিষন্নতা।
খোয়াবের সদরঘাটে থেমে থাকে
পারাপার বাহন পানির আয়নায়,
নীরব প্রকৃতির অবয়ব-
এটুকুই বসবাস।
চিশতী রিমা
কবি ও কবিতা
কবিতার খাতা খুলে,
বসে থাকি আনমনে,
ভাবনার ইন্দ্রজালে,
ছন্দরা প্রতিবাদ করে।
কি লিখবে তুমি
খাতার পৃষ্ঠা ভরি,
ভালবাসার ছন্দ গেঁথে,
কত ভুলাবে মানুষ কে।
চেয়ে দেখ চোখ খুলে,
বা তব-তার কণ্ঠ ছেয়ে,
চারিদিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত,
করছে তোমার প্রতিবাদ।
আর নয় কবিতা,
ভুলানো মিথ্যে মায়া,
আর নয় ছন্দ,
দাড়ি, কমা, মাত্রায় আবদ্ধ।
বৃত্তে পিঞ্জর ভাঙ্গ
শত ভয় মারিয়ে।
সভ্য আখি মেলো,
অসভ্য কন্টক চেতনায়,
কর দৃঢ় আঘাত,
হও দূরত্ব অবরোদ্ধ
মগ্ন তন্দ্রা থেকে জাগ্রত,
সত্য সত্য সত্য চাই কবি,
চাই শৃঙ্খলা বন্ধ থেকে মুক্তি।
হরিপদ বিশ্বাস
সময় ও অস্তিত্ব
জীবনের অতীত নিয়ে বর্তমানের চলমান যুদ্ধ,
নিমগ্নতা অতীত ঘুরিয়ে দেখায়,
সমারোহ সুউচ্চ পাহাড়ের ঢেউ খেলানো কালো রূপকথার গল্পের মতো,
সংগ্রাম-চেতনা-চৈতন্য দগ্ধ হয় কেবল সংলাপ বহুপক্ষিকতার মাধ্যমে,
সুর ওঠে সজন হারানোর মতো ;
কলের যন্ত্রের মতো চলমান রাজনৈতিক সভ্যতা,
সময়ের নিরীক্ষার দিকে যন্ত্রণা ধেয়ে আসে,
ভাষাগত নিপীড়নের শিকার, বৈদেশিক শব্দ চয়নে,
প্রাচীন সভ্যতার শিক্ষা চাপা পড়ে পরিবর্তিত বর্গি’র পূর্ব-সূরির হাতে,
কেবল জীবন আটকে যায় ভাবনার গলি পথে,
চলার রাস্তা সম্পূর্ণ কন্টাকিত,
কিন্তু লোক দেখানো নাটক অনুচিত ভাবনা,
আত্মার যুক্তিবাদী প্রশ্ন সূচকে সমাজ বিদ্ধ হয়,
প্রকৃত ভাষা কারিগর অনু-পরমাণুর চুল চেরা বর্ণ বিশ্লেষণ,
অক্ষর সমুদ্রের যাদু করের মতো,
পরবর্তী সংগ্রামের ভাষা কাণ্ডারী হয়ে।
জেসমিন ইসলাম
বসন্তের আগমনে
বুকে জমেছে ভালবাসার অফুরন্ত হাওয়া
বসন্ত এসেছে…
কী নামে তোমায় ডাকি বলতো
এখন ও যে আসেনি ফাগুন
তবু সে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়
নিমগ্ন থাকি কবিতার খাতায়
মনের ক্যানভাসে আঁকি ছবি
অভিমানী বিকালের মতো
আবীর রঙে রাঙিয়ে যাও।
বসন্তের আনন্দ শিহরণে
প্রকৃতি হয়ে উঠে উৎসব মুখর
প্রকৃতির এই আনন্দে কোকিল
তাঁর কুহু কুহু কুঞ্জনের মধ্যে প্রকাশ করে।
কোকিলের মিষ্টি সুরে কবিতা পরে বাসন্তী রস
তোমার আসার খবর নিয়ে গাছে গাছে
বসন্তের হাওয়া ফুলের মুড়ানো ভালবাসার
কথা বলতে পলাশ শিমুলের বনে বনে
কোকিল এই সৌন্দর্যের দূত হয়ে আসে।
প্রতি মুহূর্তে দোলা দেয় এই মনে
আসবে তুমি ফুলের ডালা সাজিয়ে
সেই আনন্দের রেশ যে আজ এসেছে
আমার ও প্রাণে রাঙিয়ে দিয়ে যায়।
ফুলে ফুলে ভ্রমর করবে খেলা
গাছে গাছে বসবে মেলা পলাশ আর শিমুলের
বসন্তের এই বর্ণিল সাজ রঙের ছটা
ইট পাথরের নগর বাসীর জীবনে
ছড়িয়ে দেয় প্রাণের স্পন্দন।
🍁গল্প /৩
মা
অঞ্জন নন্দী
মলির ভালোবাসা -প্রেম সম্পর্কীয় কোনও স্বপ্ন নেই। রাত বা দিবা, কোনও স্বপ্নই না। তার গায়ের রং কালো, নাক বোঁচা, এমনকি আহামরি ডাগর আঁখিও নেই। তার হাইট কম, ভারি শরীর। স্কুলে যখন অন্য মেয়েদের পিছনে ছেলেরা ঘুরঘুর করতো, পথের মাঝে সাহসী ছেলেরা প্রেয়সীর হাতে চিঠি গুঁজে দিতো, তখন মলির সেগুলো দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। এ নিয়ে তার কোন মাথাব্যথাও নেই।
রবীন্দ্রনাথ কালোমেয়েকে কৃষ্ণকলি নাম দিলেও, সে কলি কখনও ফুল হয়ে ফোটেনি মলির জীবনে।
মলি দেখতে ওর মায়ের মতোন। মেয়েরা না-কি মায়ের মতো হলে, সুখী হয় না ! মেয়েরা দেখতে বাবার আর ছেলেরা মা’য়ের মতো হলে তারা সুখী হয়। এসব কুসংস্কার হলেও, মলির জীবনে কাকতালীয় ভাবে সত্যি হয়ে গেছে।
______________________________________________
মলি বোঝে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির লোকজন তার চেহারার দিকে তাকিয়েই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তাদের জুলজুল করা লোভী চোখ মলির বুক, পেটসহ শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য খোঁজে। আর তখন নিজের উপর মলির ঘেন্না আসতে শুরু করে।
______________________________________________
মা আর মেয়ে, দু’জনেই দেখতে বদখত, তাই সুদর্শন বাবা (!) তার সুদর্শণা কলিগকে বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে। মলি তখন ক্লাস ফোরে পড়তো। বাবাকে নিয়ে মলির কোনও আগ্রহ নেই, যে মানুষ তাদের ফেলে গিয়েছে, সে যাক ; তার কথা ভাবতে বয়েই গিয়েছে। বাবা আলাদা সংসার পাতলেও, মলির মা ভেঙে পড়েনি। কর্পোরেশনে কেরানির চাকরির বেতনে চলতে কষ্ট হয় বলে, টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে বাড়তি কিছু আয় করে। তারা থাকে, শহরতলীর ছোট্ট এক বাসায়। সেখানে বাবার কোনও ছবি বা অন্য কোনও চিহ্ন নেই। জামাকাপড় যা ছিল, মা ভিখারিদের দান করে দিয়ে,বাবার ছবি আর ব্যবহার্য। জিনিসপত্র ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।
মাস্টার্স পাশ করে মলি বেকার হয়ে বসে থাকল। মা’কে সেলাইয়ে হেল্প করলেও পাড়ার সেলাই দিদিমণি হয়ে পরিচিতি পেতে তার ইচ্ছে নেই। কিন্তু চাকরি সোনার হরিণ। মামা-কাকা বা টাকার জোর না থাকলে চাকরি হয় না। মলির কোনওটাই নেই। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভাইবা বোর্ডে ঝরে যায়৷ মলি বোঝে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির লোকজন তার চেহারার দিকে তাকিয়েই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তাদের জুলজুল করা লোভী চোখ মলির বুক, পেটসহ শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য খোঁজে। আর তখন নিজের উপর মলির ঘেন্না আসতে শুরু করে। ক’য়েক বছর এভাবেই কাটে,আর মলির মধ্যে হীনমন্যতা গাঢ় হয়।
মা কর্পোরেশনে মলির চাকরির অনেক চেষ্টা করেছে, যে কোনও সেকশনে, যে কোনও পদে। চেয়ারম্যান থেকে লেবার ইউনিয়নের নেতা, সবাইকে ধরেছে, লাভ হয়নি। চেয়ারম্যান হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘আপনি মরলে না-হয় আপনার পোস্টে চাকরি দিতাম। কিন্তু সেটা তো আর হচ্ছে না।’
‘স্যার, আমি মরলে সত্যি মেয়েকে চাকরি দেবেন?’
‘কথা দিচ্ছি দেবো, নিয়মও আছে, কর্পোরেশনের কেউ মারা গেলে তার সন্তানকে চাকরি দেয়ার, তবে যদি তার চাকরির বয়স ও যোগ্যতা থাকে।’
মলির মা কিছুক্ষণ বসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে।
ঢাকাগামী ননস্টপ ট্রেনের ড্রাইভার দেখে, এক মহিলা, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ রেললাইনের উপর চলে আসছে। প্রবল হুইসেল দিয়েও কোনও লাভ হল না, ব্রেক করলো ড্রাইভার, কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গিয়েছে। চলন্ত ট্রেন থামতে অনেক সময় লাগে। রেলওয়ে পুলিশ এসে মহিলার ছিন্নভিন্ন দেহটি মর্গে পাঠিয়ে দেয়।
মলি এখন কর্পোরেশনের ক্লার্ক, মায়ের চেয়ারেই সে বসে। মা কেন সেদিন অফিস থেকে বাসায় না ফিরে রেললাইনে হাঁটতে গেলো, অনেক ভেবেও মলির তা বোধগম্য হয়না। 🍁
🦋অঙ্কন : প্রীতি দেব
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
🌎সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, পুস্তক আলোচনা। 🌎 ই-মেল : editor.sasrayanews@gmail.com
