Sasraya News

Wednesday, April 23, 2025

Sasraya News Literature Special, May 25, 2024, Issue 18 || সাশ্রয় নিউজ সাহিত্য স্পেশাল, মে ২৫, ২০২৪, সংখ্যা ১৮

Listen

সম্পাদকীয় 

 

পৃথিবীতে মানবজন্মের পর কৌতুহল, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সত্য-মিথ্যার আবির্ভাব ঘটে। লজ্জা, ভয়, ঘৃণার থেকে। এটাও বলা যায় যে, অহঙ্কার সত্য ও মিথ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তবুও মানব সকলের সম্মুখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য মিথ্যে সত্য সত্য মিথ্যেকে লয় ও প্রলয়ের সঙ্গে যুক্ত করে।

মানবজন্ম আসলেই সত্যের প্রতীক। সৃষ্টির সমকাল থেকে এক ও অদ্বিতীয়। সমস্ত প্রাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে। তার মূল-প্রধান বিষয়ই হল বুদ্ধি। বুদ্ধির দ্বারা প্রেমকে বিষে পরিণত করতে পারে। বিষকে প্রেমে পরিণত করতে পারে। এই নীতি কেবলমাত্র মানববুদ্ধি দ্বারা সংগঠিত।

ধর্মের বিভাজনে মানব সমাজ গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভাজন। অথচ মূল শিরদাঁড়াটিকে বাদ রেখে তাঁরা সমাজ গঠনে মন দিল। যা আজকের পরিণীতি হিংসার খড়গ। 🪔

 

 

 

🍁কবিতা 

 

 

 

 

পরাণ মাঝি

ব্যতিক্রম

 

 

উঠে পড়েছি; বদলের দুলকিচাল ও দেখেছি
কিন্তু যাবো কোথায়
কোন দিকে

গতির দিকে বুঝে শুনেই যেতে হয়
দিকে দিকে শিঙা বাজে

সকলে বলে – আয়, আয়
জেনেই যাবো নতুবা স্থির দাঁড়াবো তারপর ব্যতিক্রম তো আছেই

 

 

রেমাল

 

 

রেমাল
আয়লা-আমফান থেকেও কী বেসামাল?

না, না
তার চেয়ে সামান্য কমজোরি বটে,
তবুও বোঝে না মন-কখন, কী যে ঘটে।

সেবার ঝড়ে গেল সব উড়ে
তারপর
কোনো রকমে ঘরের চাল তুলেছি ভাইরে,
আবার
যদি আসেন তিনি সেই রূপে তবে তো কূলকিনারা নাইরে।

ভরা কোটাল মানে জোয়ার
সেই ক্ষণে আসেন যদি তিনি উপায় কী থাকবে বাঁচার?

নোনা নদীর এলাকায় বাস
ঝড় জলে কিছু না কিছু সর্বনাশ,
ঠিক মতো জোটে না ভাত বারোমাস।

কতজন এল আর গেল
তাতে কি-ই বা আর হলো?
কেউ ঘরবাড়ি উড়ালো
কেউ জলে ডোবালো
কেউ ফসল নষ্ট করলো
কেউ বা আবার জীবন নিল।

তাই-
আর কিছুতেই ভয় নাই
মরণের থেকে বড় আর কিছু কী আছে ভাই?

 

 

আশ্চর্যতম জননী

 

 

অনন্ত সংসারে অপার জননী তুমি-একাই মাঝি
দিন চলে যায়। রাত আসে। তারপর ভোর ও সকাল
বৃত্তাকার সূর্য ও চাঁদ সামলে আঁধারে পথ চলতে শেখাও

জীবন বিদ্যার তুমিই প্রথম শিক্ষিকা জননী আমার
কে না বোঝে সে আদি ও অনন্ত গান

সবুজ সীমায় সরোদ। আহা কী দুপুর ছোঁয়া; উজানেও নৌকা বাওয়া

মায়ার মৈনাক; স্নেহের বরফ এবং ভালোবাসার নির্জন স্রোত বেলা

মা ! তুমি

তরল পাথরের মেলা; সুউচ্চ জীবন হরফ
আকাশ ঋদয় আর ভাবীকালবেলার বসন্ত বাতাস

জুড়িয়ে দাও। জুড়ে দাও শান্ত ও সমাহত মোলায়েম স্পর্শে

আশ্চর্যতম যাদুকর জননী তুমি
তিরতির চাঁদ মহিমায় জেগে ওঠে সোনার কাঠি হাত দু-খানি তোমার

তোমার চরণ বুকে এঁকে স্মরণ করি আজীবন; তুমিই জীবন্ত দেবী আমার

রাখো হাত মাথায় মোর
চুম্বনে; আঁচল ছায়ায় কাটাও জীবন ঘোর

শত ভুলেও বারবার বলো- সব ভালো হোক তোর…

 

 

 

 

বানীব্রত

চন্দ্রমুখী

 

 

চন্দ্রমুখী, পুর্ণিমা রাতের চাঁদের পাশে
তোমার মুখ দেখি
তোমার সৌন্দর্যে ম্লান হয়েছে চন্দ্রকলা
পুর্ণিমা চাঁদের মনকাড়া আহ্বান
আজ যে ম্রিয়মাণ তোমার কাছে, চন্দ্রমুখী।
শুধু একবার বলো ভালোবাসো, শুধু একটি বার
ওই দেখ কৃষ্ণচূড়া নিজেকে সাজিয়েছে
রক্তিম আভায়
পলাশও সেজেছে আবির রঙে
চন্দ্রমুখী তোমার ললাট খালি কেন?
এসো না কাছে
তোমার ললাটে এঁকে দেই রক্তিম জয় টিকা।
বড় ভয় হয় তোমার দুই রূপের ছটার মাঝে কাকে বেছে নেব বলো?
তোমার রূপালী সৌন্দর্য নাকি রাঙানো মুখের বিচ্ছুরিত ছটাকে।
নিবিড় রাতের ঘন অন্ধকারে রাখা ছিলো হাতের উপর হাত
নিরব ছিলো ঠোঁটের ভাষা
ছিলো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দুটি মন।
জানো ভালোবাসি কথাটা বলতে পারিনি সেদিন
ভয়ে বা কুন্ঠাবোধে…
তুমিও তো সেদিন বলোনি কিছু।
ভালোবাসলে বুঝি, মন হয় অথই সাগর
যেখানে পাওয়া না-পাওয়া কষ্টরা ভেসে বেড়ায়।
মন দরিয়ায় আঁছড়ে পড়ে উথালি পাথালি ঢেউ
একবার বলো চন্দ্রমুখী ভালোবাসো আমায়
শুধু একবার।

 

 

 

 

তূয়া নূর

ফাটল

 

 

তুমি আমাকে হারাও
আমিও তোমাকে হারাই
একটু একটু করে
বিকাল বেলার আলো যেন
আটকে থাকা চোখ ঘড়ির কাটার সময়ে
একটা একটা করে ছিঁড়ে পড়া ক্যালেণ্ডারের পাতা।

সরে যাও তুমি
সরে যাই আমিও আস্তে আস্তে
সমুদ্রের বুকে ডুবে যাওয়া দ্বীপের মতো হারিয়ে যাই।

সরে যাই ভূখণ্ড ভেঙে আলাদা হওয়া মহাদেশ গুলোর মতো,
কাঠের গায়ে পেরেক ফোটার কষ্ট
সময় হাত দিয়ে সারিয়ে দেয় নিজের অজান্তে
আস্তে আস্তে আমরা দূরে চলে যায়
ভেতরের ফাটল বড় হয় কখন
বুঝতে পারি না কেউ!

 

 

 

 

বিজয় ঘোষ

লীলাবতী

 

তোর লাল ফ্রক, এখনও আমার মনে পড়ে!
নদীর মতো এঁকেবেঁকে চলা,
মনের ঘরে তুই-ই থাকিস,আর কেউ নয়।

সেদিনের সেই রাই কিশোরী দেহ এবং মনের ভিতর
যেমন সুগন্ধি ছড়াতো
আজও তেমন গোলাপ গোলাপ।

তোর লাল ফ্রক এখন আমার স্বপ্নে আসে
তুই -ই আমার ভালোবাসা
রক্ত এবং মাংস সহ।

কতবার ডুব দিয়েছি, তোর ঐ অগাধ দেহে
সবই কেবল স্বপ্নে পাওয়া।
বাস্তবে তুই আমার কেউ না!

তোর কেবল স্বপ্নে আসা
স্বপ্নে যাওয়া
তুই-ই আমার ঈশ্বরী আজও
যেমন ছিলি লাল ফ্রকে

তোর জন্যই আবার আমি জন্ম নেবো
তুইই আমার ঈশ্বরী
স্বর্গ কিংবা রসতলে…

ঐ লাল ফ্রকে ডুবে আছি
জন্ম থেকে জন্মান্তরে।

 

 

 

 

 

🍁গদ্য
 

সুবীর সরকার

তামারহাটের বৃত্তান্ত কিংবা ইয়াকুব ব্যাপারীর দিনকাল

 

 

১.

র সেই নদী গঙ্গাধরের চরে চরে হাঁটতে হাঁটতে কত কত ভাবনাই যে ভাবতে হয়!ভাবনা স্থির থাকে না।সে একরকমভাবে শুরু হয়। আর গতিপথ বদলাতে বদলাতে চিরনুতনের দিকে চলে যেতে থাকে। ইয়াকুব ব্যাপারীর দুই চোখে আকাশের নীল ছায়া ফেলে। বালুবাড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইয়াকুব খুব পুরোন কোন এককালে শোনা একটা গানকে নিজের খুব গহিনে টেনে নিতে থাকে-

‘ও কি ও দিদি লো
বাইশ্যালি দিন কুটুম আইলো বাড়িতে’

এই গান থেকে কি তীব্র এক বাইস্যাকালের ছবি উঠে আসে। নদীপাড়ের মানুষের যাপনের দুঃখ, যন্ত্রণার ছবি ক্রমে বিচুর্ণ হয়ে উঠতে থাকলে ইয়াকুব ব্যাপারির মনে পরে ছত্রশালের হাটে আলাউদ্দিন এমেলের ভোটের জুলুসের কথা! সে এক মজার নির্বাচনী সভা।ইয়াকুব ভাবে,এ কেমন ভোটের মিটিং! কেননা আলাউদ্দিন এমেলের মিটিঙে তো কোন ভাষণ থাকে না। বাইরে থেকে আসা কোন নেতার ঘর তো সেই সভায় থাকে না! থাকে খালি গান আর গান। ঢোল আর বাঁশি। আলাউদ্দিন মাস্টার নাকি আলাউদ্দিন এমেলে নাকি আলাউদ্দিন গিদাল হাতে দোতরা নিয়ে; দোতরা বাজাতে বাজাতে কোমরে নাচ নিয়ে গাইতে থাকেন গানের পর গান। লোকগান। মাটি ছুঁয়ে বেঁচেবর্তে থাকা সহজ সরল মানুশের প্রানের গা। জীবনের গান। মানুষ ঘিরে ধরে এক ভোটের নাকি গানের মিটিং! আর ভোটের পরে দেখা যায় আলাউদ্দিন এমেলে এক্কেবারেই পাশ। কি আজব কিসিমের মানুষ ছিলেন এই আলাউদ্দিন মাস্টার! সারাজীবন লোকগান আর মানুষের ছায়ায় ছায়ায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি তার জীবন। লিখেছেন গানের পর গান। গঙ্গাধরের চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইয়াকুব আচমকা উদাস হয়ে যান। তার চোখ জুড়ে জলের মত কিছু একটা বুঝি আসতে চায়!আর চরের উত্তর শিথান থেকে ভেসে আসে আলাউদ্দিন গিদালের গানের সুর-

‘হাত্তি মার্কা কেরাসিন তেল
কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
বাপ রে বাপ মাও রে মাও
মোর গাও ঝমঝম করে রে’

বিকেল ক্রমে ঘন হতে থাকে। আর গান গড়াতেই থাকে।

 

২.

শেষ বিকেলে জমে ওঠা তামারহাটের মস্ত ভিড়ের মধ্যে নেমে যেতে যেতে মহিউদ্দিন ওস্তাদের মনে পড়ে যায় গৌরীপুরের সাচি পান আর গোলকগঞ্জের গুয়ার কথা। তার জিভে আটকে থাকা সেই পান আর গুয়ার স্বাদের আহ্লাদ তাকে বিমনা করে তোলে। তার শরীর জুড়ে কেমন এক নাচের ছন্দ চলে আসে। সে হাটের ভেতর নিজেকে ছড়িয়ে দিতে দিতে কন্ঠে গান নিয়ে দু’চার পাক নেচেই ওঠে!হাটের মানুষ তার গান শোনে, শুনতেই থাকে;হাটের ব্যাপ্ততা হাটের ব্যাস্ততায় নুতন এক হাট জেগে উঠতে থাকে। হাট বুঝি গানের হাট কিংবা নাচের হাট হয়ে ওঠে! মহিউদ্দিন মাস্টার তকন গেয়েই চলেছেন গঞ্জহাটজনপদের খুব গহন থেকে উঠে আসা গান-

‘ও কি বাপ রে বাপ
ও কি হায় রে হায়
এল্যা কেনে আসিলুং মুই গৌরীপুরের হাট’

তখন হাটের চারদিক থেকে গোয়ালপাড়ার উন্মাদ করে দেয়া কাঠিঢোল বাজতে থাকে। সারিন্দা বাজাতে বাজাতে দীননাথ বর্মণ তার বাবড়ি ছাটা চুলের আন্দোলনে হাটের মধ্যে নুতন এক রঙ্গিলা হাট জাগিয়ে তুলতে থাকে। ধনকান্ত বড়ুয়া তার বাঁশিতে সাজিয়ে দিতে থাকেন অদ্ভূত এক ম্যাজিক। এক মায়া থেকে আমরা দেখি জীবন জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা মায়াসমুদ্র। মহিউদ্দিন গানে গানে তার জীবনকে কিছুটা বুঝি গঞ্জ আর হাটের ঢলেই বিছিয়ে দিতে থাকে, কেননা, এ ছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই। নিয়ন্ত্রণহীন পরিসরে একটা অবসাদের বিলাপের বিষণ্ণতার গোলকধাঁধায় মহিউদ্দিন তার সমস্ত গান, নাচ, সঙ্গী-সাথী নিয়ে ক্রমে প্রবেশ করতে থাকে।

এই পর্বে আমরা কিন্তু ইয়াকুব ব্যাপারিকেও দেখে ফেলি। কেননা,ইয়াকুব তখন হন্তদন্ত প্রবেশ করতে চাইছেন মহিউদ্দিন ওস্তাদের গানের ভুবন আর তামারহাটের গানবৃত্তান্তের খুব খুব ভেতরেই!

 

৩.

ইয়াকুব ব্যাপারী আর মহিউদ্দিন ওস্তাদের দেখা হয়। হয়ত দৃষ্টি বিনিময় হয় তাদের। কিন্তু কোনও কথা হয় না। হাট তখন কেন্দ্রচ্যুত হয়ে টুকরো টুকরোভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।হাটের মধ্যে জেগে ওঠে কত কত রকমের হাট।ইয়াকুব চলে যায় তামাকহাটির দিকে। আর মহিউদ্দিন ধানহাটির গহিনে মিলিয়ে যেতে থাকেন। আমরা ঠিক তখন দেখে ফেলি আসারিকান্দির লোকমান পাগেলাকে। সে তখন মাথায় গামছার পাগড়ি বেন্ধে চুপচাপ বসে আসে গিয়াস হেকিমের হেকিমি ওষুধ বিক্রির জমায়েতে।আসলে ওষুধ নয়। তার আগ্রহ গিয়াস হেকিমের ওষুধ বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে দুলে দুলে গান করবার প্রতি।

আশেপাশের বিশ তিরিশ হাটে আজ প্রায় তিন কুড়ি বছর ধরে এভাবেই গান আর হেকিমী ওষুধ নিয়েই ছুটে চলেছেন গিয়াস হেকিম।এর আগে তার বাপের সঙ্গে। তার বাপ আবার তার বাপের সাথে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন হাটে হাটে।গিয়াস হেকিম আর তার গান আর তার শিকড় বাকর ছাল বাকলার ওষধি সামগ্রী নিয়ে এক রঙ্গিলা জীবনের ভেতর কাটিয়ে যাচ্ছেন তার আয়ুষ্কাল। আমরা দেখতে পাই গিয়াস হেকিম
তার বাবরি ছাটা চুল দোলাতে দোলাতে গাইছেন-

“ছাড়িবার না পাং
এই গানের মায়া”

গানের পর গান চলতে থাকে। গান থামে। কিছু কথা তথা হয়। ওষুধের গুণকীর্তন হয়। মজা গুয়া পান বিড়ি তামাকু সেবন হয়। হাসি মস্করা হয়। লোকমান পাগলা
শরীরের আড়মোড়া ভেঙে তার পেশিসমগ্রে একটা মত্ততা বইয়ে দিতে দিতে একটা নাচের তীব্রতা ক্রমে নির্মিত করতে থাকেন।গিয়াস হেকিম তখন দোতরা বাজিয়ে গাইছেন-

“গান গান করিয়া সর্বনাশ
তবু না মেটে গানের হাউস”

এইভাবে হাটের মধ্যে জেগে ওঠে নুতন এক হাট।

 

______________________________________________

হাটে হাটে গরুর দালালি করে বেড়ায়। আর “চোর চুন্নি” পালাগানে সাজু চোরের ভূমিকায় অভিনয় করে। তার শরীরের পরতে পরতে তীব্র এক নাচের ছন্দ লুকিয়ে আছে। সাজু চোরার পালা দেখার জন্য মানুষ হামলে পড়ে গানবাড়িতে। সাজু মোহাম্মদকে এখন আর কেউ চেনে না।

______________________________________________

 

৪.

 

আর একসময় প্রসঙ্গ হারিয়ে কিরকম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকে লোকমান।লোকমান পাগেলা। চরে চরে বালাবাড়ির কাশিয়ার ঝোপে ঝোপে হাটগঞ্জের মস্ত পরিধির ভেতর ডুবে যেতে যেতে কত কত পুরাতন আর নুতন গল্প সে তুলে আনে। সাজিয়ে দেয়।ছড়িয়ে দেয়। হাটে হাটে লোকমান হাটুয়া পাইকার ব্যাপারীদের শোনায় সেই সব গল্প।মানুষ ভালোবেসে তাকে পাগেলা বলে ডাকে। লোকমানের বাবা নইমুদ্দিন ছিল পান গুয়ার দোকানি। গোলকগঞ্জের আর আসারিকান্দির হাটে সপ্তাহে তিন দিন তার দোকানদারি। বাকি চারদিন সে বিবাগী। কখনও গৌরীপুরের বড় রাজকুমারীর বেটা মৃণাল বড়ুয়ার সঙ্গে গানবাড়িতে,কখনো লালজি রাজার হাতি ধরার ফান্দিদের দলে মিশে যাওয়া, কখনও আসগর বয়াতির পালাটিয়ার দলে ঢোল বাজানোর কাজে ডুব দেওয়া। এইভাবেই একটা জীবন কখন কীভাবে বুঝি ফুরিয়ে গেল। নইমুদ্দিনের ইন্তেকালের পর প্রায় হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল তার জানাজায়।এসেছিলেন লালজি রাজা। রঘুনাথ মাহুত। বয়ান শেখ।

আজও, মরণের প্রায় চল্লিশ বছর পরেও মানুষের স্মৃতিতে খুব খুব বেঁচে আছেন নইমুদিন। লোকমানের রক্তেও বাপের রক্তের ধারা। পীরনানার জীন। ঘুরে ঘুরে জীবন দেখার জীবন লোকমানের। গানের জীবন। নাচের জীবন। বাদ্য বাজনার জীবন।চিরকালের সব মানুষের গল্পের জীবন। আসলে মানুষ তো গল্প জড়িয়েই বেঁচে থাকতে চায়। হাটের জমে ওঠা কিংবা ভাঙা হাটের স্তব্ধতার ভিতর লোকমান গতিয়েই দেয় না ফুরনো গল্পের ভাড়ার। টোকন ব্যাপারী আর তার মত্ত হাতি জংবহাদুরের গল্পকে ভরা হাটে ডুবিয়ে দিয়ে লোকমান একমনে গুনগুন করে-

“ওরে কামাই কাজে যেমন তেমন
মানুষ মারার যম”

হাট এভাবেই লোকমান পাগেলার হাটে রূপান্তরিত হয়ে যেতে থাকে।

৫.

 

সব হাট কি একরকম!সোমবারের হাটের ভেতর কি খুঁজে পাওয়া যাবে বুধবারের হাট! তামারহাটের রঙের সাথে কি পুরোপুরি মিল থাকা সম্ভব রতিয়াদহ হাটের! ছত্রশালের হাটের পাখিদের কি দেখা মেলে পানবাড়ির কোন এক শনিবারের হাটে! সব হাট একরকম হয় না।সব গান একরকম হয় না। সব গঞ্জ আর গাঙ একরকমের হতে পারে না।

প্রবেশ আর প্রস্থান দিয়ে এক একটি হাটপর্ব রচিত হতে থাকে। আর লোকমান পাগলার হাটে ধুলোর ঝড়সমেত ঢুকে পড়ে জোড়া মহিষ।গদাধর নদীর কোনও বা চর থেকে বাথান ভেঙে এরা বুঝি চলে এসেছে এই হাটে ভেতরে। সমস্ত হাট জুড়ে একটা হুড়াহুড়ি লেগে যায়। মানুষের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। তখন কোথায় ইয়াকুব ব্যাপারী কোথায় মহিউদ্দিন ওস্তাদ কোথায় লোকমান! ভরা হাটের কোলাহল থেকে সরে আসতে আসতে ময়কান্ত মৈশাল তখন খুঁজতে শুরু করে বাথান পালানো সেই জোড়া মহিষদের। তার হাতে দীর্ঘ পেন্টি। মাথা গামছা দিয়ে পাগড়ির মত করে বাঁধা।প্রায় তিন কুড়ির পেশীবহুল সুঠাম শরীরের পেশীগুলো একত্রিত করে। ময়কান্ত তার কণ্ঠে তুলে আনেন মহিষের কণ্ঠের আকুতি। এই ডাক শুনে সেই জোড়া মহিষ কেমন থমকে দাঁড়ায়। তাদের বড় বড় চোখে কেমন মেঘের ছায়া! একটু বাদের দেখা যাবে সেই জোড়া মহিষ অদ্ভুত আহ্লাদ নিয়ে হেলে দুলে ময়কান্তর পিছনে পিছনে সেই বাথানের পথ ধরে ফেলেছে। গদাধর নদীর কোন বা চরের খুব অন্দর থেকে ভেসে আসছে হাহাকার ভরা গানের সুর-

“আরে ও মৈষের দফাদার ভাই
ডালা সাজাও ডালা সাজাও
চল মৈষের বাথানে যাই রে”

ময়কান্ত তার জোড়া মহিষ নিয়ে বাথানে চলে যেতে থাকে।কিন্তু হাট ভেঙে যায়।

 

৬.

 

ইয়াকুব ব্যাপারী মহিউদ্দিন ওস্তাদ লোকমান পাগেলাকে ভুলে গিয়ে আপাতত আমরা ঢুকে পড়তেই পারি বালাজানের হাটে।গঙ্গাধরের বাতাসে নদীর বালু উড়ে আসছে হাটের মস্ত খোলের ভেতর। শরীর ভরতি বালুকণা মেখে গরুহাটির উত্তর শিথানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সাজু চোরা। না, সাজু চোর নয়। তার নাম সাজু মোহাম্মদ। হাটে হাটে গরুর দালালি করে বেড়ায়। আর “চোর চুন্নি” পালাগানে সাজু চোরের ভূমিকায় অভিনয় করে। তার শরীরের পরতে পরতে তীব্র এক নাচের ছন্দ লুকিয়ে আছে। সাজু চোরার পালা দেখার জন্য মানুষ হামলে পড়ে গানবাড়িতে। সাজু মোহাম্মদকে এখন আর কেউ চেনে না। সবাই সাজু চোরাকে একনামে চেনে। সাজু যখন নেচে নেচে শরীরে অদ্ভুত পাক দিতে দিতে গেয়ে ওঠে-

“ও কি হায়রে হায়
আজি মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়”

তখন সমগ্র গানবাড়ি জুড়ে কি এক উন্মাদনা! সাজু চোরা ছিল গানমাস্টার মঈনুদ্দিন এর শিষ্য। মঈনউদ্দিন আবার ছিল আলাউদ্দিন এমেলের সাকরেদ।সারাজীবন এই গান, এই নাচ,রাতের পর রাত গানবাড়ি নিয়েই জীবন কাটে সাজু চোরার। গরুর দালাল সাজু চোরা গরুহাটির ভেতর দাঁড়িয়ে
কী ভাবছিল! রহস্যমোড়া গানবাড়ির কথা। নাকি সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরবার কথা! তার শরীর জুড়ে নাচের ছন্দ ক্রিয়াশীল থাকে আর হাটের অন্ত মধ্যে সাজু ছড়িয়ে দিতে থাকে গুনগুন সুরের কোন এক গান,যা দূরাগত হওয়ার ডানায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমস্ত হাটের পরিসরে-

“ওরে ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি”

এইভাবে পুরোন হাটপর্ব শেষ হয়ে যায়। নূতন নূতন হাটগুলোর হাট হয়ে উঠবার জন্যই হয়তো বা!

৭.

 

এত এত হাট, এত এত গঞ্জ,এত এত নদীপরিধির ভেতর মানুষের বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকতে থাকতে আবহমান এক জীবনকে বারবার পাল্টে পাল্টে দিতে থাকা। ইয়াকুব মহিউদ্দিন লোকমান সাজু চোরা আরও কত বর্ণময় আর বিচিত্র মানুষের সমাবেশ দিয়ে সেজে ওঠে গঞ্জহাটের এক চিরকালের ভুবনজোত। এক হাট থেকে মানুষকে চলে যেতে হয় অন্য কোন হাটে। নূতন নূতন হাটে। নয় ফরেস্ট আর কুড়ি নদীর দুনিয়ায় কত যে হাট! ইয়াকুব একবার পানবাড়ি হাটে গিয়ে ফেরার পথে পথ ভুলে গিয়েছিল।তাকে কি তবে ভুলায় ধরেছিল! বগরিবাড়ির যতীন ডাকাতের সঙ্গে দেখা হবার পর পরেই ইয়াকুব যতীন কে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল চিকন চিড়ার হাটখন্ডের দিকে। সেখানে বসে দই চিড়া খেতে খেতে যতীন তার ডাকাতিয়া জীবনের রোমহর্ষক সব গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিল।

লালজি রাজার ভাই প্রণবেশ সাহেবের সামনেই তো একবার ব্রহ্মপুত্রে জেগে ওঠা নয়া চরে চরদখলের লাঠালাঠিতে কি এক ভয়ানক লড়াই! সেবার মাথা ফেটেছিল যতীনের। যতীনের ডাকাতিতে হাতখড়ি হয়েছিল বিজনির হামিদ মিদ্দার কাছে। তিরিশ বছর ডাকাতির জীবনে একবারই যতীনকে থমকে যেতে হয়েছিল! তার চোখ কান্নায় ভিজে গিয়েছিল! এবং এই প্রথমবার পুলিশের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল সে। সেবার ডাকাতি করতে গিয়েছিল যতীন রূপসীর নন্দ ধনীর বাড়িতে।খবর ছিল তামাক বিক্রির প্রায় তিন লক্ষ টাকা ধনীর বাড়িতেই রাখা আছে। আছে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার।ধনসম্পত্তি। মধ্যরাতে দল নিয়ে যতীন হানা দিয়েছিল নন্দ ধনীর বাসায়। তারপর সে এক ধুন্ধুমার মারি ফেলা কাণ্ড। হঠাৎ নন্দ ধনীর বছর পাঁচ বয়সী বাচ্চা ছেলে যতীনের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে এলে যতীন আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক চালিয়ে দেয়। চোখের সামনে ছটফট করতে করতে সেই বাচ্চাটির মৃত্যু যতীনকে হতভম্ব করে দেয়। তারপর সব ইতিহাস। জেল থেকে বেরিয়ে যতীন ডাকাতি ছেড়ে দেয়।যোগ দেয় কুষাণ গানের দলে। দোয়ারির ভূমিকায়।মাঝে মাঝে কীর্তন করে বেড়ায়। আর ইচ্ছে মত দোতরা কাঁধে ঘুরে বেড়ায় কোন কোন হাটে। দাঁতের মাজন, হজমি গুলি, কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করে আর গান করে ফাঁকে ফাঁকে। আর দেখা হলেই চেনা বা অচেনা লোকজনকে শোনাতে থাকে ডাকাতিয়া জীবনের নানান গল্পকথা। জীবন কি অদ্ভুত! ঘোর লাগা দুই চোখ জাগিয়ে রেখে যতীন বিড়বিড় করে গান তোলে-

“এপার থাকি না যায় দেখা রে
নদীর ওই পারের কিনার”

৮.

 

ইউসুফ মোল্লার বেশ মনে পড়ে শালমারার বড় বালার চরে বড় রাজকুমারীর গান নিয়ে নাচ নিয়ে বাদ্য বাজনা নিয়ে এক শীতের রাতে জমিয়ে তোলা গানবাড়ির কথা। ইউসুফ মোল্লা তখন সদ্য যুবক। পালতোলা নৌকোর দুরন্ত মাঝি। ব্রহ্মপুত্র শাসন করে সে।পণ্য পৌঁছে দেয় বন্দরে বন্দরে। আর নেশা বলতে গানবাড়িতে ঘুরে ঘুরে গান শোনা। তখন রাজবহাদুর প্রভাত বড়ুয়া বেঁচে। শিকারে যান মস্ত দাঁতাল হাতি জংবাহাদুরের পিঠে চড়ে। বড় রাজকুমারী আর ছোট রাজকুমারী তখন গঞ্জ গা হাট ঘুরে ঘুরে গান,নাচ, শোলোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নিজেরাও নাচছেন। গাইছেন। বালাবাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সব গান। যা চিরকালীন।যা ভরভরন্ত জীবনের কথা বলে-

“কালা বাইগণ ধওলা রে
বাইগণের গোড়ায় কাটা”

এক হাট থেকে বেরিয়ে নূতন এক হাটে প্রবেশ করতে গিয়ে এই চার কুড়ি পেরিয়ে আসা জীবনে বারবার ইউসুফ মোল্লার মনে পড়ে সেই সব সোনার বরণ পাখির মতন দিনগুলির কথা। হায়রে, কত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে মানুষের জীবনে! জলে ভিজে ওঠে ইউসুফের চোখ। সে দেখতে পায় “টলমল টলমল কচুপাতের পানি”।

ঠিক এখানেই একটা গল্প শেষ হয়ে যায়, নূতন এক শুরুর অপেক্ষায়!🪔

 

 

 

 

 

🍁কবিতা 

 

 

 

 

অমলকান্তি চন্দ

নীলকন্ঠ পাখি

 

উঠোনের ডান পাশে ধুতুরার ফুল
মধ্যমার মতো লম্বাটে, জোড়া পাপড়ির ভেতর
নীলকণ্ঠ পাখি।

পয়চারি শেষে গোটাকয়েক মধু পোকা
সরু সুড়ঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে
খণ্ড মেঘের ভেতর অদ্ভুত ঝিলিক, জেগে উঠে
সর্প
চ্যাপ্টা ফণা জুড়ে মিহি আবীর গুঁড়ো
লতানো শরীরের ভাঁজে পল্লবিত শিকড়।

মাটি আঁকড়ে ধরে মন
সময় টলতে থাকে তরল ভাঙের ভেতর।

 

 

 

 

শিশির আজম

পাখিটা উড়ে গেল

 

বাতাসে

তা

পা

 

 

 

তপনকান্তি মুখার্জি

গ্রহণ

 

সব আছে সেই আগের মতোই।এখনও উচ্ছিষ্টের লোভে হাত পাতে মানুষ, অর্থের বিনিময়ে হাত ফেরি হয় নারী, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে হিসেবি মানুষ।

পশ্চিম আকাশে যে মেঘ ওঠে, খিদের ভাষার কাছে তা এখনও সেই ডাল-ভাত-পেঁয়াজ-লঙ্কা

শুধু একা হওয়ার সাহসটুকুই হারিয়ে ফেলেছে মানুষ

 

 

 

 

হারাধন চৌধুরী

ফাগের অগ্রজ

 

আমি চোখ বুজলেই শুধু তোর জগৎ।
অথচ নিমুনিয়ার ভয়ে কত ঘেন্না
করেছি। কালো জলের গভীরে ফুলকুঁড়ির
চোখ মেলা ছুঁয়ে থাকি

দিগন্তের রক্তশূন্যতা সবুজপাতাদের
বক বয়ে আনে। নিশপিশ করে দেহটি…
তবু আমি নিজেকে বোঝাই, যদি সৎ
থাকতে পারি, নিরুদ্দেশ হলেও, অনেক

মাঘ জন্ম নেবে—সে-ই অগ্রজ, ফাগের।

 

 

 

 

তমা বর্মণ

বাতিস্তম্ভের মতো

 

 

বেদনার শেষ দাঁড়িয়ে আছে গ্রাম পার্বত্য
বাতিস্তম্ভের মতন

সময়ের অভিঘাত অনুভব করো ভাষার নিঃশব্দে
নৈঃশব্দ্য বিরাজ যেখানে ডাক দিলেই ফেরে অঙ্গীকার
ভুলেছে সময় সেই সমাহিত ভাষা
কূটকচালে ঢুকেছে রাজনীতি, গুপ্তবাহিনীর এখন উল্লাস

এখানে একদিন আমার শৈশব ছিল
পার্বত্য শস্যক্ষেতে হেঁটেছে যুবকের যুবতি ছিলাম আমি
ধান্যবতী প্রেম ছিল বহুধাবিস্তৃত…
রাবার বাগানে আজ সারারাত জ্বলি জুমের বাতাসে
ভাষাহারা কান্না, প্রস্তরীভূত আকাশে মরা পাখি
আমার বাংলা সেদিনের আর নেই!
যে ভাষায় ছিল চাঁদের অনুভব বনজ্যোৎস্নার
বৈদেশিক অন্ধকার গ্রাস করেছে পাহাড় সমতল
বাংলা আদিবাসী উপত্যকা পুঁজিপতির হাতে
একে একে অবসান পাঠশালা ধূসর বই স্লেট!

বিস্তীর্ণ বিপ্লব নতুন লেখা হতে পারে কি ফের?
আবার একটি ভাষার আন্দোলন, আষাঢ় ভিজিয়ে যে ভাষা মাটির
ভাষার হানাদাররা সদা চঞ্চল
স্বদেশী দুখুকে ভিখিরি করতে চায় ফের শস্য-উৎখাতে
আজ হরবোলা পর্যন্ত নেই!
ফসলের ফিসফিসানি, পাতা, পাখির ডাক শোনাবে
যে ভাষায় পলাশের-রঙ কথা বলে, যে ভাষার দেশ
তাতে অক্ষর-শব্দ ছাড়া কিছু নেই জীবন্ত
ঘাসপোকা, ধানপোকা, ঝিঁঝিপোকা স্মৃতির ভারে জোনাকিও মরেছে!

অরণ্যগর্ভে বীজপত্রীর চিৎকার শুনছি-
ওরাও জানে আমার শস্যের ভাষা বাংলা
এ ভাষা অক্ষর-শব্দ শুধু নয় বাংলার চিত্ররূপ!
অজস্রটা ক্ষত স্বভাষার তর্জনী তুলে কি ফের ফিরবে?

 

 

 

 

বর্ণশ্রী বকসী

নিক্ষেপ

 

কিছু কবিতার নিবিড় পাঠে জেগে ওঠে চরাচর
স্নিগ্ধ রাতের মোহময়ী মূর্তির মত দাঁড়িয়ে চাঁদ,
ছুঁয়ে থাকে আঙুলে যে মীড়ের গমক তার সুরে
নির্লিপ্ত নীরবতা আর রৌদ্রের দিনলিপি-

চাদর জড়িয়ে পড়ে শীর্ণা নদীর বুকে জলরেখা
বেলাভূমি কখন যেন ফিসফিসানি দূরত্বের সীমা
অতিক্রান্ত হয়েছে যে জীবন একদিন পাখির পালকে
লেখা ছিল আদুরে যাপনের স্বপ্নমাখা গুজরান ।

অনুরণন পূর্ণতা পেলে আস্ত রাগিণীর নির্মাণ
ছেঁড়া ঘুড়ি, মাঞ্জায় গুড়ো গুড়ো কাঁচ-

এই তো সেদিন নুয়ে পড়া অশক্ত কাঠামোর মধ্যে
প্রতিফলিত ঋজুতা আদতে শেষেরও আছে শুরু
ধ্রুবপদ, গোলকের বর্তুল আকার দিক্ চিহ্নবাহী
নিক্ষেপ করতে গিয়ে ধরা পড়ে সমতা প্রাপ্তির নেশা
আনন্দ মিছিল বের হলে সর্বাগ্রে তুমি-আমি ও আমরা…

 

 

 

 

যতন কুমার দেবনাথ

একই ডায়ালগ

 

বছরটা নতুন বলেই কি-না কে জানে
ভুলে গেলাম পুরনো নামতা

কোন্ তেলে কাজ হয়
কোন্ দুধ খাঁটি
তেল মাখানো বাঁশ বেয়ে বাজারদর-বাঁদরের ওঠানামা…

একই অভিনেতা একই ডায়ালগ
উপস্থাপন বিজ্ঞাপনের ভাষা নতুনত্বে থ্যালথ্যালে আ’ল্লাদ

চমক বলতে ওই চামচা বদল ও বডিল্যাঙ্গুয়েজ।

 

 

 

 

শম্পা ঘোষ

যোগ বিয়োগ

 

নৈঃশব্দে বাঁধ মানে না মন
অক্ষরবৃত্তের দুদিকে সাজানো মোমবাতি
স্পর্শকাতর হৃদয়ে ঋজুতায় আমার প্রকাশ তোমার মানভঞ্জন কালে সূর্যদাগে গলে যায় মোমবাতির সব অস্তিত্ব,
ভালোবেসে তোমাকে দিয়েছিলাম আমাজনের গভীরতা,
আবেগ নিষ্পৃহ হলে অর্থহীন সব
বিশ্বাস ছুয়েছিল আকাশের উচ্চতা
শ্রান্ত দুপুর মেতেছিল রোহিত তরল রসে
তোমার প্রতিটা শব্দ বুঝিয়েছিল ছিল আমার জীবন্ত হবার প্রমাণ।
তবু নির্বাক মৃত চড়ার মতো
নদী চিহ্ন বহন করে চলে,
অঙ্গীকারে আস্কারা লুকিয়ে থাকে
মৃত জীবাণু কোষের মত,
আমি বারবার হেরেছি উড়ন্ত পালকের কাছে
আপন মুদ্রায় হয়েছি
বিচ্ছেদবাগী
মুলতুবী থেকে গেছে অনুভূতির কাহিনী,
হারানো বাঁশির খোঁজে কাজল ধোয়া চোখে তাই খুঁজে চলি সৃষ্টি স্বরলিপি
জ্যামিতিক বলয়ের পার করে আসা হয়নি তোমার,
নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শূন্য ওপারে বায়ু আর স্রোতের সঙ্গমের সাক্ষী হয়ে থেকে গেছি আমি।
শূন্যতার যোগ বিয়োগে অটল বিশ্বাসে তুমি নতুন করে বেঁচে ওঠো আমার ভিতর বারেবার।

 

 

 

 

সুশীতল দত্ত

সরণিরেখা

 

 

ঝড় মানুষের জীবন আটকে দেয়,
ভেঙে পড়ার পর কিছুক্ষণ ভাবনা
তারপর…
আবার এগিয়ে যাওয়া-
দূরে বহুদূরে নদীর গতির মতো।
হারিয়ে যেতে যেতে
মনে পড়ে যায়
অতীত কথা।
সেই কথায় এসে জড়ো হয় আরও কথামালা,
কিন্তু জীবনে ঝড়ের মুখোমুখি হতে হয়;
এক দুই তিন-
এভাবে যেতে যেতে হয়তো বা
স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে
কিছুক্ষণের জন্য বাকবিনিময়।
জীবনে ব্যর্থ হলে-
বহু মানুষের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়,
সমালোচনার পর সমালোচনা চলতেই থাকে।
কিন্তু থমকে যেতে নেই,
এরই মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়
মেঘ যেভাবে ভেসে যায়।
মনে রেখো, যতই সমালোচনা হোক
ভেঙে পড়লে হবে না।
এগিয়ে যেতে হবে।
ঋষির মতো ধ্যানমগ্ন থেকে
কিছুক্ষণ পর জেগে উঠতে হবে,
কালবৈশাখীর ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে-
জীবনের স্বপ্ন।
বাধাবিপদ যাই আসুক না কেন
সংগ্রামী চেতনায় এগিয়ে যেতে হবে।
অন্ধকারের বুকে আলো জ্বালাতে
ছুটে যেতেই হবে।
সমালোচনার ঝড়ে এগিয়ে গেলেই
মিলবে হাতছানির এক জগৎ,
পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে কান খাড়া রাখতে হয়
সেইসঙ্গে চোখও…
এগিয়ে গেলেই খুঁজে পাওয়া যাবে
এক অনুভূতির শিহরণ।

 

 

 

 

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment