



সম্পাদকীয় 🌱
নামের খোঁজ করে কী হবে মানুষের খোঁজ করো। তোমাকে কে চিনল না চিনল তার মোহে অন্ধ হয়ে ডুব দিলে অকালেই সবশেষ হয়ে যাবে যে। সময় থাকতে থাকতে নিজেকে শুদ্ধ করো। শুদ্ধ হলেই মুগ্ধ হবে। পথের খোঁজ করতে হবে না। নিজের খোঁজ করো। তাহলেই পথ তোমার কাছে আসবে।
জীবন-দর্শনে কখনও কী ত্যাগ খুঁজে পেয়েছ? যদি পেয়ে থাকো তাহলেই তোমার অজান্তে খুশির অশ্রু আনন্দে আত্মহারা হয়ে হৃদয়ে ধাবিত হয়েছে।
মনের বন্ধ জানালা হাস্যরসের সম্মোহন। দিবারাত্র আমিকে উজ্জীবিত করে। মোহের বাসা তৈরি করে কামনায় লিপ্ত হয়। কামনা আত্মার নয়। মনের রিপুর বন্ধনে জাগরিত এক বিশেষ চাওয়া। সময় থাকতে থাকতে মনের জানালা খোলো। নিজের আমিকে চেনো মনের গভীরে। মনের গভীরে নিজের খোঁজ করো। খুঁজতে থাকো খুঁজতে থাকো খুঁজতে থাকো…
সাশ্রয় নিউজ-এর পক্ষ থেকে কবি জীবনানন্দ দাশ-এর ১২৫ তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
🍁মনে রেখে 🍁
জীবনানন্দ দাশ -এর কবিতা
বনলতা সেন
হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা;
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
বোধ
আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মত বীজ বুনে আর
স্বাদ কই! -ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।
পথে চ’লে পারে—পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে;
আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।
আমি থামি—
সেও থেমে যায়;
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হ’য়ে,—
সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
আমার মনের মতো না কি?-
তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাল্টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি ; -বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;-
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন,–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!
এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? -করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চাল্কুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
—সেই সব।
আবার আসিব ফিরে
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হ’য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হব-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কশ্মীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে; আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙায়;
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে; হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে; রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়;-রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে-
সুচেতনা
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবু তোমার কাছে আমার হৃদয়।
আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
কেবলিই জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরো প্রাণ
মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে-এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মণীষীর কাজ;
এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল,-
প্রায় ততদূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেব, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না হলেই ভালো হ’ত অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হ’ল সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়-
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
সিন্ধুসারস
দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি হে সিন্ধুসারস,
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি
নাচিতেছে টারান্টেলা-রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি
চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা-দুটি আকাশের গায় ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।
মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান, আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ
নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে: আবার তোমার গান।
শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান।
জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে-হারায়েছি আনন্দের গতি; ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান-এই বর্তমান
হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের-বেদনার আমরা সন্তান?
জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান,
তুমি পিছে চাহোনাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই, বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর
পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।
যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পনার নিঃসঙ্গ প্রভাত
নেই তব; নেই নিম্নভূমি-নেই আনন্দের অন্তরালে প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।
স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো-পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা
বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়বীর আরশিতে হয় শুধু দ্যাখা রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতো রেখা
প্রাণে তার-স্নান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো; একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো
নিভে গেছে; যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, করে না বুনন মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে অবিচল শালিকের মন,
মেঘের দুপুর ভাসে-সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন।
মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিড়ি নদীটির পাশে;
সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে।
তুমি সেই নিস্তব্ধতা চোনোনাকো; অথবা রক্তের পথে পৃথিবীর ধূলির ভিতরে
জানোনাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;
সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;
গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের-ইন্দ্রধনু ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন
হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।
এই সব জানোনাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডানার উল্লাসে; রৌদ্রে ঝিল্মিল্ করে শাদা ডানা ফেনা-শিশুদের পাশে
হেলিও ট্রোপের মতো দুপুরের অসীম আকাশে।
ঝিকমিক্ করে রৌদ্রে বরফের মতো শাদা ডানা,
যদিও এ-পৃথিবীর স্বপ্ন চিন্তা সব তার অচেনা অজানা।
চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি-জন্ম তুমি নিয়েছিলে কবে, বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে সবে
আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে দুর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে।
শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে।
ধানের রসের গল্প পৃথিবীর পৃথিবীর নরম অঘ্রান
পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই-আর তার প্রেমিকের স্নান নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক, তৃণের মতো প্রাণ,
জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায়
শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।

জীবনানন্দ দাশ-এর শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
কবিতা কী এ-জিজ্ঞাসার কোনো আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় যে কবিতা অনেক রকম। হোমারও কবিতা লিখেছিলেন, মালার্মে, র্যাঁবো ও রিলকেও। শেকস্পীয়র, বদলেয়র, রবীন্দ্রনাথ, এলিয়টও কবিতা রচনা করে গেছেন। কেউ-কেউ কবিকে সবের ওপরে সংস্কারকের ভূমিকায় দেখেন; কারো-কারো ঝোঁক একান্তই রসের দিকে। কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস-শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়।
বিভিন্ন অভিজ্ঞ পাঠকের বিচার ও রুচির সঙ্গে যুক্ত থাকা দরকার কবির; কবিতা সম্পর্কে পাঠক ও সমালোচকেরা কীভাবে দায়িত্ব সম্পন্ন করছেন-এবং কীভাবে তা করা উচিত সেই সব চেতনার ওপর কবির ভবিষ্যৎ কাব্য, আমার মনে হয়, আরো স্পষ্টভাবে দাঁড়াবার সুযোগ পেতে পারে। কাব্য চেনবার, আস্বাদ করবার ও বিচার করবার নানারকম স্বভাব ও পদ্ধতির বিচিত্র সত্যমিথ্যার পথে আধুনিক কাব্যের আধুনিক সমালোচককে প্রায়ই চলতে দেখা যায়, কিন্তু সেই কাব্যের মোটামুটি সত্যও অনেক সময়ই তাঁকে এড়িয়ে যায়।
আমার কবিতাকে বা এ-কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কেউ বলেছেন, এ-কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ- চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ-কাব্য একান্ত প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য-কোনো-কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো-কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। কিন্তু কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য। এই-তারতম্যের একটা সীমারেখাও আছে; সেটা ছাড়িয়ে গেলে সমালোচককে অবহিত হতে হয়।
নানা দেশে অনেক দিন থেকেই কাব্যের সংগ্রহ বেরুচ্ছে। বাংলায় কবিতার সঞ্চয়ন খুবই কম। নানা শতকের অক্সফোর্ড বুক অব ভার্সের সংকলকদের মধ্যে বড়ো কবি প্রায় কেউ নেই, কিন্তু সংকলনগুলো ভালো হয়েছে। ঢের পুরোনো কাব্যের বাছবিচারে বেশি সার্থকতা বেশি সহজ, নতুন কবি ও কবিতার খাঁটি বিচার বেশি কঠিন। অনেক কবির সমাবেশে একটি সংগ্রহ; একজন কবির প্রায় সমস্ত উল্লেখ্য কবিতা নিয়ে আর- এক জাতীয় সংকলন: পশ্চিমে এ-ধরনের অনেক বই আছে; তাদের ভেতর কয়েকটি তাৎপর্যে-এমন কি মাহাত্ম্যে প্রায় অক্ষুণ্ণ। আমাদের দেশে দু-একজন পূর্বজ (ঊনিশ-বিশ শতকের) কবির নির্বাচিত কাব্যাংশ প্রকাশিত হয়েছিল; কত দূর সফল হয়েছে এখনও ঠিক বলতে পারছি না। ভালো কবিতা যাচাই করবার বিশেষ শক্তি সংকলকের থাকলেও আদি নির্বাচন অনেক সময়ই কবির মৃত্যুর পরে খাঁটি সংকলনে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পায়। কিন্তু কোনো-কোনো সংকলনে প্রথম থেকেই যথেষ্ট নির্ভুল চেতনার প্রয়োগ দেখা যায়। পাঠকদের সঙ্গে বিশেষভাবে যোগ-স্থাপনের দিক দিয়ে এ-ধরনের প্রাথমিক সংকলনের মূল্য আমাদের দেশেও লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের কাছে ক্রমেই বেশি স্বীকৃত হচ্ছে হয়তো। যিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেননি তাঁর কবিতার এ-রকম সংগ্রহ থেকে পাঠক ও সমালোচক এ-কাব্যের যথেষ্ট সংগত পরিচয় পেতে পারেন; যদিও শেষ পরিচয় লাভ সমসাময়িকদের পক্ষে নানা কারণেই দুঃসাধ্য।
এই সংকলনের কবিতাগুলি শ্রীযুক্ত বিরাম মুখোপাধ্যায় আমার পাঁচখানা কবিতার বই ও অন্যান্য প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা থেকে সঞ্চয় করেছেন, তাঁর নির্বাচনে বিশেষ শুদ্ধতার পরিচয় পেয়েছি। বিন্যাস-সাধনে মোটামুটিভাবে রচনার কালক্রমে অনুসরণ করা হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ
কলকাতা। ২০.৪.১৯৫৪ 🪔
🍁 কবিতা
বিকাশ সরকার
হ্যালুসিনেশন সিরিজ /বিয়াল্লিশ
কেউ নেই, শুধু নদী তুমি কাছে আছো
তুমি এক রোগানদী
তোমার নির্জন ঠান্ডা ঠোঁটে
আমি চেপে ধরেছি আমার পুরু, ছালওঠা এই ঠোঁট আর জলের ভিতর, জলে পড়ে থাকা
স্নিগ্ধ, সন্নিবিষ্ট পাথরকুচিগুলির ভিতর
বেজে উঠছে দুরূহ সেতার
জলশব্দে ভেসে যাচ্ছে ভুলগুলি, অপমৃত্যুগুলি
কেউ নেই, শুধু নদী তুমি কাছে আছো
আমি তোমার পাশে পুঁতেছি ভ্যালিয়ামচারা
একা অভিশপ্ত, শুয়ে আছি সেতারের দুরূহ সুরের ওপর
দেবব্রত সরকার
না বলা ভাষ্য
কথাগুলো সাজানো থাক ঠিক যেভাবে সাজানো ছিলো
পৃথিবীর ঘরে তোমার নামের পাশে যে নাম ছিলো
শব্দকথা নেশার মতো পড়ি ঘুমিয়ে স্বপ্নের ঘোরে
পান্ডুলিপি এক রাতের খাবার হলো এ সব পড়ে
নিয়তির অদৃশ্য পথে আছি আঁধার জীবন ঘিরে
আকাশের নীলে হারিয়ে ফেলেছি এক যে সত্য ফিরে
অবকাশ ঘটেছে তার পর উত্তর খুঁজেছি দেখো
প্রতিপদে কথা বলার সময় যেন তাঁর না বলা ভাষ্য
অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে স্বপ্ন দেখায় চোখের মনি
ভালোবাসা রঙ সবুজ হলুদ ফুলে স্ব- রাগ খনি
যতদূর তাকিয়ে দেখি তুমি নির্জন আতরে মগ্ন
আমাদের ভাষা প্রকাশ করার কথা কি অর্থে ভগ্ন
কবিতার ক্ষরণ বৃদ্ধি হলে তোমার বাঁধানো চোখে
সমুদ্রের জল উথলে উঠলে জল কি ঝরে পড়ে
বোঝানোর ক্ষমতা কার আছে জীবনে জীবন বাঁকা
কবিতার খাতা কেঁদেছে দেখেছ চেয়ে কি কবি আঁকা
সোমা বিশ্বাস
ভেসে যাচ্ছে সেই সব ”শ্রাবস্তীর কারুকার্য ”…
“সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোর আঁধারে ”
সত্যিই এখন আলো যেন বড্ড কম; ধোঁয়া বেশিটাই
ভেসে যাচ্ছি কোন গভীর অন্ধকারের ছোঁয়ায়-
“বনলতা” “সুরঞ্জনা” “সুচেতনা” আজ অস্তমিত
চারিদিকে শুধু নির্লজ্জ লোভ হিংসা যৌনতা প্রস্ফুটিত
আবহমান যেন বড় নিষ্ঠুর হয়ে অপেক্ষা করছে
সহযোগিতার বদলে একজন অপরের পেছনে লাগছে
মিথ্যে প্রলোভন আর কথা বেচাঁর খেলা
নিমেষে বদলে দেয় স্নিগ্ধ মনের মেলা
কোথায় সেই “রূপসীবাংলা” “শ্রাবস্তীর কারুকার্য” মন
তবেকি আজও; “পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন?”
শহিদ মিয়া বাহার
জমা রেখে যেও
কোথাও কোনও ফুল নেই নিঝুম বাগানে
গীতিহীন সরোদ ডালে বাজে না কখনও
গোলাপী সাকুরার মিথ
তবু তুমি হলুদ ফ্রেসিয়া
দূরের রাধাচূড়ায় বাজে তোমার চৈতিলী পায়েল!
আমি এক সুদূর মোহনা
আকন্ঠ পান করি লিলাক অধরের থৈ থৈ নীল
জলাশয়ে তোমার অর্কিড ঘ্রাণের নিরুপম গীত!
মালতী বাগানে বৃন্তের ভেতর সারারাত জেগে থাকি আলোর সারথি
জিন্দেগীর মৈথুন নিয়ে
প্রতীক্ষায়…।
ছেড়ে যাবার আগে
মেঘ-বারি-আকাশের দেশে জমা রেখে যেও
প্যনোরমিক প্রেম
আমি সৌরজগত ফুঁড়ে রঙধনু হব!
সুবীর সরকার
পতাকা
নদীর নাম যদি দুধকুমোর হয় তবে তার পাশে একটা
ব্যক্তিগত দেখা থাকে। সেই দেখার সমদুরত্বে উদাসীন বক পাখির আহ্লাদ। মাঠের দিকে চলে যায় শীতার্ত মানুষ। হিম জমছে ফড়িঙের পাখায়।
এদিকে লাল টমেটো দিবারাত্রি নির্জনতা শেখায়।
পথে পথে পতাকা পুতি আর ক্যারামের গুটি
খুঁজি
স্মৃতি
সব জমায়েতে খুঁজে পাই কুঁজো হয়ে যাওয়া
বৃদ্ধদের
স্মৃতি থেকে গন্ধ সরে আসছে।
স্মৃতিতে প্রবেশ করছে লাফা শাক, পুইপাতা,
বালুবাড়ির তরমুজ।
সম্পর্কে জড়তা এলে থেমে গিয়ে আবার শুরু
করতে হয়
স্মৃতিতে নদীর হাওয়া।পাটকাঠির বল্লম।
বাহাউদ্দিন সেখ
জীবন্ত কঙ্কাল মৃত গাছ
জীবন তো এক মৃত লাশ,
ঠিক দাঁড়িয়ে থাকা এক পাতা ঝরে যাওয়া
কঙ্কাল শুকনো গাছের মতো।
তবুও তো মৃত গাছ দাঁড়িয়ে থাকে,
ভাবে যদি আকাশে মেঘ এসে ধুয়ে দেয়
শুকনো গাছের ডাল অথবা শিকড়।
মৃত গাছও ভাবে যদি বেঁচে যাই মেঘ বৃষ্টির একফোঁটায়!
তবুও তো সেই জীবন্ত কঙ্কাল মৃত গাছ দাঁড়িয়ে প্রত্যাশায়।
রোকসানা রহমান
অচেনা নগর
আমি কি জাগরণের ভিতর স্বপ্ন দেখি
না আধো ঘুম আমার মস্তিকের চোখ
ধাঁধিয়ে, একই স্বপ্ন প্রতিটি রাত আমাকে
বিভ্রম করে তোলে।
আমি দেখি, বেপরোয়া এক নদী থেকে উঠে আসা এক শিকারী
কি আশ্চর্য আগুন চোখের কম্পনে প্রশ্নদীর্ণ আমি।
আমি কি হাঁটছি-নাচছি রাতের নৈঃশব্দে
স্বপ্ন কি একটা ফাঁদ নাকি আমার আত্মার
ঢেউ…!
পথ দেখায় আগুন বাতাসের স্বপ্ন ভূমিতে সাজানো পাতার শীতল বিছানার…?
এই স্বপ্নময় রাত কি যথেষ্ট নয়, ঘুমে কিংবা জাগরণে- কোথায় নিয়ে যেতে চায়
এভাবেই যেতে হবে ঐ-অচেনা নগরে…!?
খেয়াঘাটে
কার পথ চেয়ে মেলেছো ঐ আঁখি ওগো দুরায়িত মেয়ে
এসেছে কি কাছে ছুঁয়েছে কি মেঘ অনিমেষ
রৌদ্রজল ভেঙে…!?
দিশেহারা মেয়ে মোহনায় ভাসো অনিবার্য ত্রিনয়নে
প্রেমের ব্যাকুল ধ্যানে।
দখিনা বাতাস স্পর্শে ছুঁয়েছে কি ঐ অবয়ব
ছুঁয়েছো কি তুমি বুকের গহীনে নিরব, নিঃশব্দ অভিমান…?
বর্ষা ঝরে আঁচলে নৃত্যের মুর্ছনায়, যা তুমি নিয়ে যাবে টিকেট বিহীন শেষ খেয়াযানে…
সে তোমায় পান করিয়েছিলো স্বর্গের সুধা রুবির মত উদ্ভাসিত ওষ্ঠে
ভালোবাসার উদার কন্ঠে এঁকেছিল আলপনা।
ওগো দুরায়িত মেয়ে কার জন্য এই জল ভেঙে অপেক্ষা-
শিউলি ফুলের মাঠ- ঘাট প্রান্তরে
শুনেছো কি তার নিঃশ্বাস…
তুমি সমুজ্জ্বল শেতস্বচ্ছ স্ফটিকের মত সুকোমল
নিঃশ্বাসের কাছে হয়ে উঠেছিলে মেলে দিয়েছিলে মৌনতার সৌরভ
পেয়েছিলে কি কুন্জবীথিকায় তারকা মশাল
স্বপ্ন হাতে নিকষিত হেম।
হাসান হিমাদ্রি
আত্মার অধিগ্রহণ…
পরাধীনতার আভরণে
হয় কি আত্মশুদ্ধি করণ?
ফিরিঙ্গীদের অধিগ্রহণে
তসবিহ তোয়াজ অনুসরণে
আজ সত্য শৈলীর স্খলন।
তাই ক’য়েক শতক নির্যাতনের
আসেনা স্মরণ বিসর্জন।।
আকিকা দিয়ে জোড়া খাসি
নাম রাখছি আরববাসী
চাষ করেও নিজের জমি
নথিতে সবাই বর্গাচাষী।
সাজিয়ে কাতার সারি সারি
করি অন্ধ অনুসরণ,
অদ্যাবধি অলীক নীতির
এক অকাট্য সমীকরণ।।
নিজেই নিজেকে দিচ্ছি ধোঁকা
স্বাধীন ভূমি মুক্ত পতাকা
নিছক খাতা-কলমেই আঁকা
এর মানে কি আমরা বোকা?
বিশ্বসভায় পেয়েছি আসন
সেথা মিথ্যে বুলির সম্ভাষণ
খান খাজানা সাঙ্গ সবই
হলে আত্মার অধিগ্রহণ
আর কতটা অধঃযাত্রায়
বিবেক হবে দংশন।।
জাহানারা বুলা
নিদ্রাহীন অসুখের কোলে
ঘুম বিজয়ী অর্জুন আমি
প্রতিটি রাত্রির আচ্ছন্ন অন্ধকারে উন্মিলীত থাকি
সুদূরের নীহারিকা বন্ধু বলে ডাকে
বন্ধু হয় চন্দ্রালোক, নক্ষত্র-
উজ্জ্বল উজ্জীবিত যারা
অথচ, তোমার নূপুরের শব্দ
রাতের শাব্দিক নির্জনতার
ঝিঁঝিঁ ধরা স্তব্ধতার কাছে হেরে যায়।
চেয়ে থেকে দেখি উদ্ভট কত ছবি-
আমাকে কুর্নিশ করে
গুল্মলতারা ধীর পায়ে হেঁটে এসে-
ফাঁসের দড়ির মতো জাপটে ধরে
দেহখানি পাথরের মতো অনড় অচল মৃত শব।
আলস্য নেই কোনও
যুদ্ধের ডামাডোলে নেচে উঠি নিয়ত-
শিবের ছায়ার মতো
শুধু তোমার জন্য’ই যুদ্ধ নেই
নেই কোনও তন্ত্র-মন্ত্র এই রাজনের
যেখানে অসহায়ত্ব বুকের গভীরে
সেখানে তান্ডব কি করে মানায় কখনও?
কাতর পিপাসায় ওষ্ঠ ধর শুষ্ক
চোখ দু’টো কাঁপাকাঁপা-
মৃদু বাতাসের স্পর্শে পত্র পল্লব যেন।
হাতের মুঠোয় বুঁজে যাওয়া আলো
তখনও প্রতীক্ষা করে নিদ্রাহীন অসুখের কোলে-
আসবে না জানে।
শারাবান তহুরা
স্মৃতি
শৈশবে ধূলা বালির বুক চিরে কবিতা আসত আমার চোখের পাতায়
নবীন টগবগে শৈশবে অন্ধকারকেও
মনে হয় আলোকিত রাত।
কৈশোরে বাবা-র টেবিল আর মা-এর রান্নার ঘ্রাণে
কবিতা আমার মন ভরাত
খুঁজে পেতাম সরষে ফুলের মাঝে গুপ্তধন।
যৌবনে সবুজ বনানী, মাঠের সোনালী ফসল
কবিতা হয়ে খেলত সারাদিন
যৌবন ছিল কবিতার জন্য চমৎকার সময়
নিবিড়ভাবে আবদ্ধ করতো কবিতারা আমাকে
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখাত ভালবাসার
কবিতার প্রেমে জীবন হয়ে উঠতো অমৃত
যৌবনে কবিতারা, সকাল, দুপুর সাঝে
আমার বন্ধনহীন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে
ছায়া হয়ে সুর তুলত মনের অতলে
কবিতার প্রেমে মুগ্ধ হতাম
কবিতা ছুটত আমার জন্য
আহ্লাদে রসিক যৌবন সীমানা পেরিয়ে
ছুঁয়ে যেত অসীমে।
পৌঢ়ত্বে এসে…
কবিতা ডানা মেলে উড়ে যায়
আমার সীমানা ছেরে
কবিতার উপেক্ষা, অবহেলা, অযত্নকে
রোধ করার সাধ্য হয়ত-বা আমার নেই
আমার ভালবাসার কবিতা
আজ শুধুই স্মৃতি।
রুমানা আকতার
প্রশ্ন উত্তর
সে জিজ্ঞেস করল
পাহাড় ভালবাসো নাকি সমুদ্র…?
আমি বললাম-
“একটা কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে একচাদরের উষ্ণতায় দেখব সূর্যোদয় “।
সে আবার বলে উঠল
গ্রীষ্মের দুপুর না শীতের ঘুম…?
আমি বলে উঠলাম-
“বৃষ্টি ভেজা দুপুরে তোমার হাতে আমার আঙ্গুল”।
সে কিছু সময় থেমে
আবারও প্রশ্ন করল
গল্প না উপন্যাস…?
আমি বললাম-
“শেষের কবিতায় দেবো ডুব…”।
এবার সে মিষ্টি হেসে
জিজ্ঞেস করল,
গোলাপ না রজনীগন্ধা…?
আমি বললাম-
“একগুচ্ছ বেলীর সুবাস আর কাঠগোলাপের মায়া”
এবার সে বলল-
চা না কফি…?
আমি বললাম-
“তোমার ঠোঁটের উষ্ণ চুমু…”।
সে গম্ভীর সুরে বলল,
কি চাও বল তো তুমি…?
আমি বললাম-
“এই অগোছালো তুমি…”
ভ্রমণের নেশা
সকালে ট্রেনে
ভিড়ে ঠাসা ব্যস্ততা পেরিয়ে,
পৌঁছে গেলাম
জলস্রোতের গাঁ ধরে গড়ে ওঠা গ্ৰামে।
ঝিকঝিক শব্দের গতিশীলতার কারনে
শহুরে বাতাস যখন বদলে গেলে,
শুদ্ধ মেঠো সুগন্ধে
ঠিক তখনই-
“মনে হলো এইতো আমি প্রকৃতির কতটা কাছে।”
ঘন্টা খানেক পর পেরিয়ে
পৌঁছে গেলাম পদ্মানদীর তীরে,
কি অপরূপ, কি স্নিগ্ধতা লুকিয়ে আছে
এই ধূসর সাদা জলের রূপে।
আমি তখন ব্যস্ত দু-হাত মেলে
শহুরে ক্লান্তি,অবসন্নতা, একাকীত্ব
বিষাদে ঘেরা স্মৃতিগুলোকে
জলাঞ্জলি দিতে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেলে
ওপার এবার কোনও পারেই নেই সুখ,
আসলে তো মনের-ই ছিল ভীষন অসুখ।
উম্মে ফারহিন
আগন্তুক পাতা
থমথমে আকাশ
একটু পরেই বেল বাজার শব্দ
দরজায় কালো শূন্যতা
প্রবেশ করল ঠাণ্ডা হাওয়া কিছু আগন্তুক পাতার সাথে
বজ্রপাতের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ মন
আবহাওয়া দপ্তরের সাবধানতার পরও বাঁধ মানে না আবেগের ঘরগুলো
ফারাক্কা মাইথন পাঞ্চেত তেহরি কেউই উত্তির্ণ হয়নি পরীক্ষায়
জলধারণ ক্ষমতা দিন দিন মাইনাসের দিকে
আচ্ছা আরও কয়েকটা নদী মিশিয়ে ওদেরকে ভাঙলে কী হয়
নিরুত্তরের বাজনা
সম্পর্কগুলো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে
কোনোভাবেই গুছিয়ে উঠতে পারছিনা
হাতে ব্যথা নাকি ব্যাগ ভর্তি বুঝে উঠার আগেই আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে
গুলিয়ে যাচ্ছে সব সমীকরণ
এমন নয় যে সমাধান আমি পারি না
পরীক্ষায় অনেকবার সব অঙ্ককে ছুঁয়ে এসেছি
সরলরেখা বরাবর হেঁটেছি
কিছু উত্তর মিলেছিল কিছু দাঁড়িয়ে ছিল বোকার মতো
আজ সব প্রশ্নের উত্তরে শুধু মাথায় আসে নিরুত্তরের বাজনা
সুবীর ঘোষ
জীবন
জীবন কোথায় গিয়ে
জীবনের সঙ্গে মিশে যায়!
বিকেল কখন থেকে
আরেক বিকেল গড়ে তোলে!
ঝরা পাতা যত শব্দে পড়ে
কানের শব্দ তত মাথায় ঢোকে না ।
কোথায় বেড়াতে গেলে
থাকবে না মানুষের ঘ্রাণ?
চক্রব্যূহে জীবনের সন্ধান
কোনখানে গাঁথা থাকে জানো?
সংক্ষিপ্ত অবকাশ
ঘাসফুল চাপা পড়লে কষ্ট হয় বুকের ভেতর।
আমাদের দিনগুলো চলে গেলে
ঘাসফুল লজ্জায় অবনত থাকবে বহুদিন।
আমার হাতের বেড়ে যে আলিঙ্গন
পরিমাপ পায়নি কোনোদিন
অন্তরের মাপ দিয়ে তাকে আজ
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।
অবকাশ সংক্ষিপ্ত্ করে ফিরে গেলে
কান্নায় ভেঙে পড়বে কল্পনামালা।
প্রীতম ভট্টাচার্য
ছদ্মসুখ
ঝক ঝকে রোদে কংক্রিট ভিড়ের মাঝে-
পাখিদের বাসা বাধা আর হলোনা এবেলা।
অথচ বৃষ্টি তুফানেই ভেঙ্গেছিল তার বাসা খানি।
দিনে দিনে স্বপ্ন জুড়ে জুড়ে তৈরি করা তার বাসা।
পাখির এই গল্পটা আত্মবিশ্বাস থেকে বিশ্বাস পালিয়ে যাবার গল্প।
স্বপ্ন চুরমার হওয়ার গল্প।
ইদুর দৌড়ের রাজনীতিতে পাখি আর আমি –
একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
বৃষ্টিতে ঘর ভাঙ্গে
রোদে আর তৈরি করা হয় না
বান্ধবী বলেছিল-
দুই জনে হাতে হাত ধরে যেখানে বসে থাকব, সেখানেই তো ঘর।
আমি না হয় গল্পটা বুঝলাম।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে
পাখিদের এই গল্পটা বুঝানো যাবে তো?
প্রজাপতি মন
আমার স্বপ্নগুলো অযত্নে নষ্ট হয়
অক্ষর থেকে শব্দের রূপান্তরে
চেনা মুখগলো অচেনা হয়।
উদাস মেঘের মত আমার মন
রঙিন প্রজাপ্রতি হয়ে উড়ে যায়
বেলা শেষে গল্প শেষ হয়,
একা থাকার গল্পে তবুও-
পুরুষ প্রেমিকের মন বেঁচে থাকে।
খাতুনে জান্নাত
ভাঙাগড়া
শরীরে শরীর ভাঙে লবণের ধারা
কাতর সজল চোখ বিছানা বলয়
লোমশ প্রসার বুক, বিম্ব নাভিমূল
সজীব-ক্লান্ত ধ্যান জঙ্ঘার আলয়
প্রার্থণার পত্রজ্ঞানে আনত মস্তক
ঝালর কারুকাজ শয্যা, জায়নামাজ
কুয়াশার বেশভূষা পোতা ঘটিবাটি
ঝুরঝুর চুরচুর হৃদয়ের কাচ
ভাঙে সীমা, ভাঙে তেজ তেজের পাহাড়
ভেঙে ভেঙে চৌচির মজ্জার বন
স্বপ্ন, মগজ, মন, কামের তিয়াস
ভেঙে ভেঙে টানটান রমণীয় মন
ভাঙে ভেদ, ভাঙে ক্লেদ রক্তের ধার
ভেঙে ভেঙে হেসে উঠে বীজ নতুনের
অভিশাপ আহ্লাদ ভীরু দাসক্ষত
নতজানু, ভগ্নতা ভাঙে দুই তীর।
আমার মা
আমার মায়ের মধ্যে প্রচণ্ড সাহস ছিল।
আঙুলগুলোকে সচল করে আমাদের গতিময় করে তুলতেন অনায়াসে
আমরা নকশি ফুল, আমরা ঝাড়বাতি, আমরা হাত-পাখায় বন্ধুর পত্র-লিখন।
ভোরের বাগানে রেণু-ফুল-ঘ্রাণ
ছুটছি, দৌড়াচ্ছি কাজের স্রোত…
মা ভালবাসতেন বই
গল্পে গল্পে হারাতাম-
রামায়ন, মহাভারত, কসসুল আম্বিয়া
গাজী কালু চম্পাবতী
শরৎ-ফাল্গুনী বিকাল
রাত নিঝঝুম রেডিও নাটক…
মায়ের মধ্যে গুঁড়োগুঁড়ো স্বপ্ন ছিল
শুদ্ধ উচ্চারণে আমার বর্ণমালা
কবিতা গানে মুখরিত প্রাণোচ্ছ্বাস
গ্রাম পেরিয়ে শহরের সিঁড়ি
দেশ পেরিয়ে মহাবিশ্ব;
মা তখন গর্বিত বঙ্গ জননী…
মায়ের মধ্যে আগুনও ছিল।
তাই তো পুড়ছি ভেদ, ক্লেদ, দ্বিধা, শিকল।
সমতার ভিতে জীবন গড়তে
সংগ্রাম চলবেই চলবে…
মন্দিরা লস্কর
ছবি
এতটা শুষ্কতা চোখে কেবল হলুদ পাতা দেখায়,
বিস্তর বিছানো অনিহা।
সকল আর্দ্রতা ঢেকে যায় নীল পরতে
ভেসে ওঠে চামড়ায় সাদা আচরের মত অবহেলা।
খাঁ খাঁ শূন্যতা
নেই যা কিছু তার অপেক্ষায়
অবারিত সময় গুছিয়ে নেবার আগেই এলোমেলো উড়ে যায় ঠাণ্ডা বাতাসে।
খুব তেষ্টা পায় শীতকালে
এলোপাতাড়ি বৃষ্টি আঁকতে থাকি আকাশে।
দিঘি
দিঘির পাড়ে বাড়ি আমার
গাঢ় সবুজ জল, যার অগভীর তল ছুঁয়ে আমার মেয়ে বেলা থেমে গেছে।
সবুজ ঘাসে ঘেরা মাটির পাড়
আমার সমস্ত ভালো মুহূর্তগুলো কেটেছে এইখানেই।
এইসব জলের কথা লিখতে লিখতে আমার হাত পচে যাবে একদিন।
জানি শুশ্রুষা চেয়েও আবার সেই জলের কাছেই যাব।
আজকাল বাঁধানো সিঁড়ি, ভাঙা পার নেই আমার,
সাজানো হয়ে গেছে যে যার মত।
তীব্র জলকষ্টের পর নিজের শরীরে আঁকতে থাকি দিঘি।
বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে চিকন ঢেউ।
একটা নিশ্চিত রূপে ডুবে যেতে চাই
যার তল পেলে হারানোর ভয় নেই আর।
শ্রীমান দাস
কৃষক বলো না আর
সুদীর্ঘ আবাদের পর
যে কৃষক বুঝলো না মাটির ধর্ম,
জমির অন্তরের বোবা ব্যথা…
তাকে কৃষক বলো না আর।
ছিনিয়ে নাও নাঙ্গল
শুকিয়ে দাও সেচনালা,
মিথ্যে করে দাও
বৃষ্টিপাতের সকল পূর্বাভাস।
মাটির সাথে জমেনি প্রেম,
শুধু দায়ে পড়ে মরসুমী দেখা…
এভাবে কি আবাদ হয় বলো!
যে কৃষক বোঝেনি কোনওদিন
মাটিরও হতে পারে অভিমান
একরোখা রাসায়নিক ব্যবহারে,
তাকে আর বীজ দিও না হাতে।
শব্দের মায়াজালে
বুকের ভেতর অজানা স্রোত
তলদেশ ফুঁড়ে ওঠে ভয়ের বুদবুদ !
হৃদস্পন্দনে যখন উদ্ধগতি খুউব,
তোমার কবিতাঘরে তখন
আমার নিঃশব্দ পায়চারি।
তুমি মেলে দিলে শব্দের বিছানা।
আমি এলিয়ে দিলাম শরীর …
তুমি জড়িয়ে নিলে বুক পেতে
আমি হারিয়ে গেছি শব্দের মায়াজালে।
নবীনকিশোর রায়
বিচরণ
বসতির সংলগ্ন এলাকায়
হাঁটাচলায় অভিযোগ ছিল না
নির্ভরশীল বিচরণের মাঠে
ষন্ডা ষাঁড়দের দাপট এখন!
মাঠ
আস্তাবলে হাতি ঘোড়া নেই রাজার
যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে খোয়াড়
বিশ্বস্ত অনুচরেরা জটলা বেঁধে
প্রীতি-খেলার মাঠ করে ছারখার!
প্রদীপ সেন
কাক ও কোকিল কাহিনি
হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আগাছার ভিড়ে
দাঁড়িয়ে থাকা আমড়া গাছের ডালে
কোকিলটা উড়ে এসে বসে।
বসন্তের ফুরফুরে স্নিগ্ধ বাতাস।
মন তার উড়ো উড়ো।
নাওয়া খাওয়া ছেড়ে অনুক্ষণ শুধু কুহু আর কুহু।
গানের লহরে মুগ্ধ জনে জনে।
কী মিষ্টি! কী মিষ্টি!
ওদিকে ক্লান্ত কাকটা উড়ে এসে
আমড়া গাছের ডালে বসে, কোকিলের পাশেই।
অহঙ্কারী কোকিলের গলা ওঠে সপ্তমে,
দেখানোপনার নেশায় গলা ছেড়ে গান চলে সমানেই।
মৌন হয়ে বসে থাকে কাক।
কী আশ্চর্য! নির্গুণের মিষ্টি কণ্ঠের কত না কদর!
কাকভোরে গাত্রোত্থান, ঘরে ঘরে জাগরণী গান
প্রকৃতির ঝাড়ুদার।
প্রাপ্তি? অনির্বচনীয় অবজ্ঞা আর অপ্রিয় উপস্থিতি।
কাক কালো কোকিলও কালো
অথচ কালোয় কালোয় ফারাকটা আকাশ-পাতাল।
ময়
যেদিন আমার ভাগ্যের সাথে তোমার ভাগ্যের
গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছিল,
আমি মনে মনে সন্দিগ্ধ ছিলাম-
কী জানি, কী হয়!
জীবনযুদ্ধে বহুরথী বেষ্টিত যে অভিমন্যুটা
প্রতিকূলতার চক্রব্যূহে থেকে মেতে আছে সংশপ্তকে
ভাগ্যচক্রে তার হাতে হাত ধরে সাথে থাকার
প্রতিজ্ঞা করেছিলে তুমি, করেছিলাম আমিও।
বরাভয় দিয়ে বলেছিলাম-
পাশে আছি, সাথে আছি, কথা দিলাম।
সেই থেকে সচেষ্ট থাকি
তোমার সমর্পণের যোগ্য প্রতিদান দিয়ে যেতে।
তুমি যদি আমিময় হতে পারো,
আমি তবে কেন নয় তুমিময়?
দেখি, ময়ের এই অগ্নিপরীক্ষায়
একে অপরের যোগ্য হয়ে উঠতে পারি কি না।
বর্ণশ্রী বকসী
লোকনৃত্য
দু’টি ঘাঘরা পরা অলংকার আবৃত শরীর নাচে
লোকসংগীতের সুর হিল্লোলিত অবয়বে তোলে
মায়াবী আবেদন। ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে ছুঁয়ে যায়
অদেখা মনের কাচের দরজায় প্রতিফলনের চিহ্ন।
রঙের বিচ্ছুরণ ঘুঙুরের তালে তালে ছিটকে যায়
কোমরের বিছুয়া ডাকে প্রিয়তম সেই সন্ধ্যায়-
জয়সলমির জাগে বিরহী নারীর বেদনার মাত্রায়
দূর থেকে প্রকাশিত বেহালার নির্ঝর খোঁজে মুখ
মৃত্তিকার গন্ধ মেখে নাচুনি বেহুল্যার অবিরাম চলা
আমোদিত বালির ওড়া পাঁজর জমাট বাঁধে ভাবে
ফলাফল প্রকাশ হওয়ার আগেই ক্যাম্পফায়ার
অগ্নিবলয় ঘিরেই শহুরে হুল্লোড়…
মরুভূমির ঘ্রাণ
অতিক্রান্ত রাস্তার তিনবাতির নিচে দাঁড়ালেই
থমকে যায় সময়ের বাঁক, অনন্ত প্রবাহ থেকে
বেছে নেওয়ার মুহূর্তের জন্য এই বেঁচে থাকার
আকুলতা! খোলা আকাশের নীল বেদনার দানা
জন্ম দেয় এক মস্ত সমীকরণের, সেই নির্দেশ মেনে
অজানা চিঠির উত্তরের প্রতীক্ষায় দিন গুজরান।
মরুভূমির ঘ্রাণ ছুঁয়েছিল মরমের দ্বার সন্ধ্যার
অনালোকিত পরিসরে, তাঁবুঘর, সন্দিগ্ধ শব্দ
ধুলো ওড়ে জিপের গতির তীব্রতায়-
উটের জীর্ণ পিঠে চেপে বসা মানুষের ভার ব্যথা দেয়
তবু খাদ্যের জোগান আর মালিকের রোজগার…
বালি ফেটে জেগে ওঠা ঝোঁপ থেকে প্রাণের স্পন্দন
এই তো সব মরুভূমির সুরম্য অনন্ত বহমান গান।
রাজকুমার ধর
মা
স্নেহ পিপাসু সন্তানরা
কেড়ে নেয় মায়ের আভরণ-
মাকে কে-খাওয়াবে, কে-পরাবে
রাস্তার ধারে দাঁড়াতে দাঁড়াতে
কখনও আবার
জলে ভাসতে ভাসতে
খসে পড়ে মায়ের রক্ত মাংস
পালক
দু’টি পাখি
ঠোঁটে শুকনো খড় নিয়ে
উড়ে যায় পুকুর পাড়ের গাছে
সারাদিন কী ব্যস্ততা-
নিজের ঠোঁটে সাজানো ঘরে
ঢুকতে গিয়ে
ঝেড়ে ফেলে কিছু পালক-
কিছু ধুলোবালি
নাসির ওয়াদেন
সোহাগ
দিন-কুয়াশার হিম ভেজা
রূপালি বিছানা
নিস্তব্ধ নিরুত্তর বাতাস
গিলে খায় হিংসার বীজ
যুবতী-বাতাস স্মৃতি আমার
নিত্যদিন
হ্যারিকেন হয়ে জ্বলে
মেহেদীপাতার গন্ধমাখা
ধোঁয়া
জোছনার আলো হয়ে
ঝরে ধর্ষিতা শরীরে…
এবারের বর্ষণের দিনে তুমি
কতটা সোহাগ ধরে রাখবে-
পরিবার
স্বপ্নে স্বপ্নে ভরা শিউলি-ঝরা রাত
বি-নির্মাণে ভরে দেবে ভরে দেবে
অনন্ত পুরুষ হৃদয়
পাহাড়ের বুকে রোপন করেছি
এক অদ্ভুত আঁধার গাছ
শুধু ভাতের বাহারি
আলো-রাতে টানাটানি
কখনও কখনও লাল হয়ে জ্বলে
মাটির কুপির আলো
ঘরে বাড়ন্ত ভাত। শরীরে আগুন ছ্যাকা
আমাদের পূর্বপুরুষের গায়ে
ফোসকা পড়েছে বুঝি?
পরিবার- জ্ঞাতিকুটুম্ব- সহোদরা
অন্নপূর্ণার ফেরার অপেক্ষা…
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
চোরাবালি
একটা চরিত্রের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছিলাম
একটা না পারা না হওয়ার দৈব ফ্যান্টাসি
কথাগুলো শুনছিলাম অন্যমুখে
যুগপৎ হর্ষ বিষাদ খেয়ে ফেলছিল
ঘুমোতে পারছিলাম না খাবার গিলতে পারছিলাম না
সেখান থেকে শুরু অমিল খোঁজার
সেখান থেকে শুরু হাস্নাহানার রাত
সেখান থেকে শেষ দান কে-দিয়েছিল
ভাবতে ভাবতে মাথার ভেতর জেগে উঠছিল অভয়ারণ্য
যার বাঘ এখন বুড়ো দাঁত নড়বড়ে
নখ খুবলে নিয়েছে কোনও চিরযৌবন প্রত্যাশী
আর একটানা শিসের শব্দে বয়ে যাচ্ছে এলোমেলো
কোথায় কোনএ টাইম মেশিনে রেখে গেছে জন্মান্তর বাটন
আর কতক্ষণ কতটা নিঃশব্দ খুন আর কতটা চূড়ান্ত
ঠিক ভুল ঠিক ভুল করতে করতে বিষাক্ত বাতাস
জানি না জানি না আর কত অপচয় রয়ে গেল তুচ্ছ আমাতে
দেখ নাই
সকলেই ছিল গুরু
তুমি শুধু দেখ নাই দেখ নাই
প্রেম রসে মজে ছিলে
পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে
গুটিক ঘুমিয়ে ছিল
কেউ কেউ জেগে ছিল সোচ্চার
সবার হিসেব খাতে
সবার ব্যালেন্স কপি হচ্ছে
ভাব যদি গতি নেই
তুমি ছাড়া কেউ নেই ভাববার
অনেক পাগল আছে
অনেক বেগানা দিল ধড়কন
তুমি গুরু মনোপলি
ভাবলে সে গুড়ে বালি
নাসিকায় তেল দাও
যাও গে হে নিজ নিজ গর্তে
বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
মাতৃভাষা
সন্তানকে স্তন্য দিয়ে যে ভাষায়
প্রথম কথা বলে মা
যে ভাষায় পারিপার্শ্বিক সবাই কথা বলে
সেই তো মাতৃভাষা।
মাতৃভাষা বহতা নদীর মতো
নদীর যেমন স্রোত থাকে, স্রোতে নানা ছন্দ
সজীব ভাষা ঠিক তেমনি উদ্দাম বিভঙ্গ,
গর্ব নিয়ে বলতে পারি বাংলাভাষাও তাই
এই ভাষাতেই আছে জাদু, আছে কতো রঙ্গ!
বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলা আমার প্রাণ
হাসিকান্না সুখ-দুঃখের গান
এই ভাষাতেই জীবন আমার এই ভাষাতেই মরণ।
আমার ভাষা বাংলাভাষা, তোমার হয়তো অন্য
তোমার ভাষায় কথা বলেই তুমি হও ধন্য
তোমার ভাষায় স্বচ্ছন্দ তুমি ভাবনা ও চিন্তায়
নিজের ভাষা ভালোবাসা যায় অপরকে শ্রদ্ধায়।।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আমি
দো-আঁশের ক্ষেতে যেতে চাই
শক্তহাতে লাঙল ধরে আমি
মাটিকে উর্বর করতে চাই
বীজ বপন করতে চাই
ফসল ফলাতে চাই।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আমি…
[স্বীকারোক্তি 👉 কবি জীবনানন্দ দাশ-এর সমস্ত লেখাগুলিই সংগৃহীত (আন্তর্জালিক) ]
🍁অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
🌞সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী… ই-মেল : sasrayanews@gmail.com
