



সম্পাদকীয়
কেউ ভাবে না আসল সত্য কী! বিজ্ঞান বিজ্ঞানের কাজ করে চলেছে। দর্শন দর্শনের কাজ করে চলেছে। ইতিহাস ইতিহাসের কাজ করে চলেছে। সাহিত্য সাহিত্যের কাজ করে চলেছে। এরমাঝে উল্লেখিত গ্রন্থে আদি-চিহ্ন এমনভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। তার কারণ এখনও পর্যন্ত মানুষ আসল সত্য কী জানার চেষ্টা-ই করেনি! এই সত্যকে জানানোর জন্য বিভিন্ন পঠন-পাঠন পদ্ধতি তৈরি করা হয়। কিন্তু কোথাও সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করার প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। সেটা সমাজের রাজনৈতিক কারণ-ই হোক, অর্থনৈতিক কারণ-ই হোক, বা ঐতিহাসিক কারণ-ই হোক বা ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রীক হোক, সর্বোপরি বলা যায়, যার করুণায় আসল সত্যকে এই পৃথিবীর মানব-জাতীর কাছে গোপন রাখা হয়ে থাকে। বিশেষ কিছু ধর্ম শব্দটি দ্বারা উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান এই সত্যতা ও প্রচার করবার উদ্দেশ্য গ্রহণ করলেও বিশেষ আধুনিক পদ্ধতি তাকে খণ্ডন করছে।
কেউ ভাবে না, আসল সত্য কী! এটা পূর্বেই ধ্বনিত হয়েছে। যেটা শ্রুতি ভেবে নিতে পারি। কিন্তু, আসল সত্যের মূল উদঘাটন হল, ভাসমান গতি। বলা যেতে পারে, আত্মা ভাসছে, মন ভাসছে, প্রাণ ভাসছে, রিপু ভাসছে, দৃশ্য ভাসছে, পৃথিবী ভাসছে, সূর্য ভাসছে, ভাসছে ঈশ্বর। নিজেও ভাসছি কেবল দেখতে পাচ্ছি না। কারণ অন্ধ হয়ে গেছে স্মৃতির ভিড়ে।
বেদ, উপনিষদ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয় না। সামান্য কিছু পঠন-পাঠনের মধ্যদিয়ে বিষয় ভিত্তিক বিভাজন করে জীবনের গতি আনার চেষ্টা জাগায় মাত্র। অতীতের কিছু গ্রন্থ দেখলে জানা যাবে যে, এই আধুনিক বিজ্ঞান না থাকার আগেও ভারতীয় ঋষিমুণিরা পূর্বেই উল্লেখিত করেছেন যে, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রদের আদান-প্রদান বা দূরত্ব- এই জ্ঞান কী একটুও আধুনিক শিক্ষাকে রোমাঞ্চিত করে না!
রমজান মাস আর রমজান মানেই সংযম। সংযম ক্রীড়ার মধ্যে দিয়ে যদি কেউ এই মাসটি পালন করতে পারেন তাহলে তাঁর শরীরে অনেক উপকার পাওয়া যায়। এমনকী গ্রহ-নক্ষত্রদেরও প্রভাব পড়ে জীবনে। এই মাস শেষেই আসে খুশির ঈদ (ঈদ-উল-ফিতর)। উল্লেখিত আছে যে, নতুন চাঁদকে ইসলামে হেলাল বলে। রমজানের শুরু চাঁদ দেখে এবং শেষ অর্থাৎ ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয় প্রথম চাঁদ দেখে। যার কারণে কোনও বছরই রমজান মাস সুনির্দিষ্ট থাকেব না। একদিন বেড়ে যাওয় বা কমে যাওয়া থাকে। এই খুশির ঈদ-এ সকলকে সাশ্রয় নিউজ-এর পক্ষ থেকে হার্দিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। সর্বোপরি বলতে পারি, বন্ধুর বুকে বুক ঠেকিয়ে ঈদ মুবারক। 🦋
🍁পত্র-সহিত্য
সীমা বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ এই বসন্তে…
প্রিয় বাবা,
আবার সেই বসন্ত পূর্ণিমা! চারিদিকে রঙের বাহার… আমাদের এখানে যদিও এখনও সব গাছেরা রং মাখেনি। ফুলেরা এখনও লুকিয়ে আছে। তবে ব্রাডফোর্ড পিয়ারগাছেরা কিন্তু সাদা রঙে একেবারে আহ্লাদী আহ্লাদী ভাব। এই পিয়ারগাছগুলো আবার একটা একটা স্টেট-এ এক এক রকম রঙ্গে সাজে। ভারী অদ্ভুত, তাই না! বেগুনী রঙ্গের ইস্টার্ন রেডবার্ড ডালপালা মেলে কি সুন্দর এক একটা ছাতার মতন দাঁড়িয়ে আছে। কোন পাতা নেই খালি মনকাড়া ফুলেদের সঙ্গে আছে ফোটোনিয়া গাছেদের লাল লাল পাতা। তার সাথে টিউলিপ, আইরিশ, ড্যাফনে ওডোরা, ড্যাফোডিলদের হাসিখুশী মুখের নাচ…
সহজাত প্রবৃত্তিবশে আমি কিন্তু চারদিকে সেই পরিচিত মুখখানা খুঁজে ফিরছিলাম। সেই মুখ যে মুখে কখনও নিরুৎসাহের রেখাপাত মাত্র হত না, যা কখনও পরিবর্তিত হত না, যা সর্বদা প্রফুল্ল থেকে আমাকে শক্তি, সাহস আর ভালবাসা দিয়ে সাহায্য করত। আজ ক’য়েক সহস্র মাইল দূরে সেই মুখখানি আমার মানসপটে ভেসে উঠল। অতীন্দ্রিয় ভূমিতে দূরত্ব আবার কী? তাই না বাবা?
আমার ভাগ্যে এখন সদাবর্ধমান কর্মের তাণ্ডব। বিশাল যজ্ঞশালা আমাকে কেবল সন্মুখপানে ঠেলছে। আমিও এগিয়ে চলেছি রুদ্ধশ্বাসে। শুধু তোমার প্রাণভরা শুভেচ্ছা আর ভালবাসামাখা আশীর্বাদ আমার সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে। এই অফুরন্ত সম্পদ নিয়েই আজ আমি সুখী। বৃহস্পতিবার ছিল এই দোল পূর্ণিমা… উইক ডেজ-এ ত সময় থাকে না আমাদের এই অভিবাসে। বড্ড ব্যস্ততায় কাটে জানোই তো। মনে আছে বাবা? মা মারা যাবার পর বলেছিলে, তুমিই আমার মা, বাবা, বন্ধু সব।
______________________________________________
আমি ওকে একবার বলেছিলাম যখন সে একটা ভারতীয় ছেলের প্রেমে হাবুডুবু… তখন বলেছিল “ইন্ডিয়ানরা বাদামী। ওরা কালো নয়।” অদ্ভুত যুক্তি, তাই না? ওদের দোষ দেওয়া যায় না বাবা।…
______________________________________________
হ্যাঁ বাপি। আজও স্বীকার করি… তুমি আমার সব!
ওহ হ্যাঁ, তুমি আরও বলেছিলে যে, “এমন কোনও কাজ করবি না, যাতে লোকে তোর দিকে আঙুল তুলে দেখায়। বিদ্যার মধ্যে দিয়ে মেয়েলি ভাবটাকে বিসর্জ্জন দিস না। মানুষকে মানুষ জ্ঞানের মধ্যে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে, তবেই তোকে নিয়ে আমার গর্ব। আর আমি হব সার্থক বাবা”!
-তুমি একেবারে নিশ্চিন্তে থাকো। তোমার পপি কোনওদিন সে কাজ করবে না। তবে, আমার একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে, জানো তো… তুমি ভেবে উত্তর দিও কিন্তু। প্রশ্নটা আমার লেখার মধ্যে আছে…খুঁজে বার করো দেখি… কি আমার প্রশ্ন? তুমি ছোটবেলায় যে স্বামীজির বাণী মুখস্থ করিয়েছিলে আমার আজও তা মনে আছেঃ “তোমার মধ্যে কোনও পাপ নেই, তোমার মধ্যে কোন দুঃখ নেই, তুমি সর্বশক্তিমান ক্ষমতার আধার। আমরা সবাই সমান।”
আজ সকাল মানে শনিবার… হঠাৎ একগাদা ছেলেমেয়ে এসে দরজায় টোকা মারে। তখন ঠিক সকাল সাড়ে দশটা। আমি আর আমার রুমমেট ইভেট তখন ব্রেকফাস্ট সারছিলাম মানে কফির কাপকে দুহাতে জড়িয়ে আদর আর কি। সারা উইকের ব্যস্ততাকে ছেড়ে একটু নিজেদের মতন করে আয়াশ করা ছাড়া আর কিছু না।
যাই হোক, ‘তুই না আমি’ করতে করতে দরজা খুললাম। দরজা খোলার পর ওরা আমাদের নিচে যেতে বলল। আমরা তাড়াতাড়ি ড্রেস আপ করে নিচে গেলাম। এখানকার ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন -এর মাঠে গিয়ে দেখি… এলাহি ব্যাপার! তাজ্জব আমি…! চোখ আমার ছানাবড়া!
টেবিলে টেবিলে লাল, নীল, সবুজ, গোলাপি, হলুদ আবীর সাজানো থরে থরে… মিউজিক বাজছে, সেই অমিতাভের জনপ্রিয় গান, “রং বরসে ভিগে চুনার ওয়ালি, রং বরসে…এ”..! ফুরফুরে মিস্টি একটা ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া রোদেলা দিনটাকে একেবারে মাতোয়ারা করে রেখেছিল যেন। মোতিচূড় লাড্ডু, গরম সামোসা, পেঁড়া, লাল-হলুদ জিলিপি…দই এর লস্সি দিয়ে সাজানো টেবিল… অবাক, জানো বাবা। আমি তো অবাক। কখন করল এরা? একেবারে ভারতীয় আমোদন। সব দেশের ছেলেমেয়েরাই যোগ দিয়েছিল, জানো তো?
আমি একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি তো জানো আমি এই আবীর রং খেলতে ভিষণ ভয় পাই। জীবনে কোনদিন খেলেছি বলে মনে পড়ে না। তাই আর এগুই নি। দেখলাম, ইভেট এগিয়ে মিশে গেল ওদের সাথে। আমি আনমনা হয়ে পড়েছিলাম এই সুযোগে…
হঠাৎ একটা ছেলে আমার মুখে আবীর মাখিয়ে আস্তে আস্তে কানের কাছে বলল… “হ্যাপি হোলি”! সবাই আমাকে দেখছে। সবাই জানে যে আমি রং খেলি না। কিন্তু আমি অচেনা ‘তাকে’ কিছু বলতে পারিনি বাবা। কেন বলো তো?
খালি মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন খেলছিল যে, আবীরের তো সব রং হয়? কিন্তু কালো? আবীরে এই কালো রং তো দেখিনি বাবা কোনওদিন? মানুষ তো একই- তাই না? তা সে সাদা, কালো, খয়েরী, বা বাদামী যাই হোক না কেন? দেশে থাকতে মানুষের এত রঙের বাহা্র দেখিনি, বা বলতে পারো, দেখবার সুযোগ হয়নি। আমরা মানুষ, ব্যাস! এই পর্যন্ত। কিন্তু এই পরবাসে যেন আবীরের রঙ্গের সঙ্গে এই কালো রং-টাও জুড়ে গেছে … এই রং-টার তো কোনও দোষ নেই। তবে কেন এই রং-এর মানুষেরা জেনে যায় যে, ওদের রঙের আদর নেই? কি আশ্চর্য মানুষের অভিরুচি, তাই না? ওরাও তো আমাদের মতন মানুষ। শুধু রংটা ওদেরকে একেবারে আলাদা করে রেখেছে। …সে আবীর দিয়ে যাবার পর আমার সাদা বন্ধু ইভেট আমার কাছে এসে খুবই আস্তে করে বলল…
“হেই! হি ইস আ ব্ল্যাক গাই, ইউ ডিডন্ট সে এনিথিং?”…আমি স্তব্ধ… বাকহীণা হয়ে পরেছিলাম। সাদা ছেলে দিলে বা আমি কি বলতাম? এদেশে খুব সাবধানে সবার সাথে মিশতে হয়। কেন মিশতে হয়। সেটা হল, এরা খুব ডেয়ারডেবিল। একটু এদিক ওদিক দেখলেই সেখানেই তারা শেষ করে দিতে পারে একটা মহামূল্য জীবন। চলে গেছিলাম সেই স্বামীজির আমেরিকা ভিজিটের গল্পে… “কালা আদমী”…!!
তার মানে, আমাদের দেশের মানুষকে ওরা ঘৃণা করে… কিন্তু কেন? এত আমাদের দেশের সেই ছুঁচিবাই মানুষদের মত “তাকে ছুঁয়ো না, সে অপবিত্র।” এরাও দেখছি ছুৎমার্গীর দলে। “ন তত্র চক্ষু্র্গচ্ছতি, ন বাগগচ্ছতি নো মনঃ”-চোখ সেখানে পৌঁছোতে পারে না, বাক্যও নয়, মনও নয়। শুনেছি বহুযুগ ধরেই এই বর্ণ বৈষম্যের খেলা চলছে এই অত্যাধুনিক দেশেও। তাই আজ এই রাত্রেই তোমাকে লিখতে বসেছি। তোমাকে না বলে যে আমি একটুও শান্তি পাই না, বাবা?
জানি তুমি বলেছিলে,
“মানুষের সর্বজ্ঞানী স্রষ্ঠা আর এক নিখুঁত আকৃ্তি গড়তে চাইলেন যার অতুল সৌষ্ঠব সৃষ্টির সর্বোত্তম নিদর্শনকেও অতিক্রম করে যাবে; এই মনে করে স্রষ্ঠা, আপন প্রবল ইচ্ছার শক্তিতে সমস্ত সুন্দর উপাদান জড় করে আপন অন্তরে তা তিল তিল করে সাজালেন; তারপর চিত্রের ন্যায় সব উপাদান জুড়ে জুড়ে গড়ে তুললেন একটি আদর্শ নিখুঁত আকৃ্তি। এই আকৃ্তি জীবন পেলে যেমন হয় তারও রূপ সেই রকম।”
এই সাদা কালো কবে দূর হবে বলো তো, এই দেশে? আজ তো কালো মানুষ-ই এই দেশটাকে শাসন করছে। আজ এই রঙ্গের দিনে এই প্রার্থনা করি যেন আবীরের সব রঙের সঙে এই কালো রংটাও যোগ হয়। তুমি জানো আমি ভীষণ সেনসিটিভ, যদিও ইভেট আমার খুব ভাল বন্ধু। ওকে কি বলে বোঝালে, ও বুঝবে বল তো? সাদা কালোর বৈষম্য -টাকে ওকে ভালো করে বোঝাতে হবে, যাতে ও আর না বলে ‘ব্ল্যাক’।
আমি ওকে একবার বলেছিলাম যখন সে একটা ভারতীয় ছেলের প্রেমে হাবুডুবু… তখন বলেছিল “ইন্ডিয়ানরা বাদামী। ওরা কালো নয়।” অদ্ভুত যুক্তি, তাই না? ওদের দোষ দেওয়া যায় না বাবা। কারণ ওরা ছোটবেলা থেকেই জেনে আসে, কালোরা ভালো হয় না… কালোদের বেশীরভাগ সাদারাই ঘৃণার চোখে দেখে…শুধু ওই কালো রং এর জন্য?
যদিও বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে কিছু কিছু সাদারা কালো বিয়ে করছে বা ওদের সঙ্গে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। জানো বাবা আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, শুধু মানুষ নয়- এখানকার লেকে পর্য্যন্ত সাদা আর কালো হাঁসেরা আলাদা আলাদাভাবে ঘোরাফেরা করে, অদ্ভুত… নিঃসন্দেহে অদ্ভুত। যুক্তিহীণ।
তুমি অনেক চিন্তা করে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে জানাবে কেমন! অনেক অনেক ভালো থেকো… তোমার চিন্তা নেই কোনও। এখন অনেক বেশি রাত হয়ে যাচ্ছে। আজ রাখি…
তোমাকে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানাচ্ছি তোমার আদরের,
পপিমা
পুনশ্চ :
পুরো চিঠিটা পড়ে তুমি… আর সবার নানা মতামত শুনে… আমাকে সব জানাবে, আমি সেই চিঠির অপেক্ষায় থাকব, বাবা।🦋
🍁পত্র-সহিত্য
মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
শব্দ-বাক্যের উত্তাপ
অদিতি,
পড়ন্ত বিকেলের আলোটা আজ তোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ক্ষণিকে উজ্জ্বল, ক্ষণিকে ম্লান। যেই সূর্য মজা করে একটু মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে, বিকেল কেমন অস্থির হয়ে, মুখ শুকিয়ে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। তোর মনে আছে বোটানিকাল গার্ডেনে একবার আমি কেমন লুকিয়ে পড়েছিলাম? আর তুই ডেকে ডেকে অস্থির হয়ে প্রথমে নাকের পাটা ফোলালি, তারপর তোর কালো হরিণ চোখে ডেকে আনলি বান? আমি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে টোকা মারলাম তোর গালে। সেখানে তখন কুলকুল করে ঝর্ণা বইছে। আমাকে দেখেই মুহূর্তে অভিমান ভুলে রোদ ফুটে উঠল তোর মুখে। আজ ঠিক তেমন রোদ বিকেলের গায়ে।
ঠিক তেমন রোদ আমি আইজার মুখেও দেখি। দূর থেকে। মেঘলা মুখে এক চিলতে রোদ, “ওলা! কোমো ভাই ভোসে?” ব্যাস, আবার চোখে মেঘ নেমে আসে। সেই মেঘে লেখা থাকে এক দুঃখগাথা। আমি সবটা পড়ে উঠতে পারি না, কিন্তু অনেকটা বুঝে নিই। আইজা পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে। ইংরাজি জানে না। ওর পাঁচ বছরের ছেলে স্কুল থেকে যেটুকু শিখে আসে সেটুকুও না। স্কুলবাস থেকে নেমেই যখন তীরের মতো ধেয়ে এসে এক লাফে মায়ের কোলে ঝুলে পড়ে তখন আইজা যেন এক প্রস্ফুটিত ফুল, এক আশ্রয়দায়ী বৃক্ষ। তখন কোথায় সেই মেঘ আর কোথায়-ই বা সেই চিলতে রোদ! ছেলের নিবিড় আলিঙ্গনে নিজেকে জড়িয়ে পাশ দিয়ে যেতে যেতে আরেকবার বলে ‘ওলা’। আমিও স্মিতমুখে পুনরাবৃত্তি করি আর খুঁজি ওর খুশিতে উপছে পড়া চোখের মধ্যে কালো মেঘের টুকরোটা।
______________________________________________
এলিস বিয়ান্দ্রোকে স্বাবলম্বী হতে শেখাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আমার বারান্দার সামনে এসে জড়ানো গলায় বলে “ডু ইউ হ্যাভ টেন বাকস?” কখনও দিই, কখনও দিই না। এলিসই বলেছেন সবসময় না দিতে। অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাবে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি, “হোয়্যাট উইল ইউ ডু উইথ টেন বাকস?” ও বলে খাবার কিনবে এমার জন্য।
______________________________________________
তুই ভাবছিস, আমি বড়োই স্যাডিস্টিক হয়ে উঠেছি। খুশির মাঝে দুঃখ খুঁজে বেড়াই। তা নয় রে। বরং দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই একা থাকার অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবুক করে তুলেছে। জীবনের আর কোনো লক্ষ্য পূরণ বাকি নেই। কোনও কিছুকে সামনে রেখে এগিয়ে যাবার তাগিদ নেই। বরং একান্তে বসে নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে বুঝেছি সুখ বল বা দুঃখ সবই ক্ষণিক। ঢেউয়ের মতো আসে যায়, আবার আসে। আসল হল এই বেঁচে থাকাটুকু। যত নিরুত্তাপ হয়ে বাঁচব তত বেশি চিনব জীবনকে, মৃত্যুকে – এই দু’টোর চেয়ে অমোঘ সত্যি কী আর কিছু আছে! দিন দশেক আগে টমেটো বীজ পুতেছিলাম। আজ দেখলাম টবের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট কচি পাতা। মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টিসুখে মন উদ্বেলিত। তারপরেই ভাবলাম, আমি জন্ম দেবার কে? এই মাটি কী আমার? এই বীজ, আলো, হাওয়া, জল কিছুই তো আমি বানাইনি। আমি শুধু একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বীজ রেখেছি। নির্দিষ্ট সময়ে জল দিয়েছি। আর প্রকৃতির নিয়মে তারা জন্মেছে। আমি মালি মাত্র। কাল আমি না থাকলেও এই পাতাগুলো বড় হবে, ফুল দেবে, ফল দেবে, জন্ম দেবে নতুন গাছের হয়তো একাই, হয়তো অন্য কারুর হাত ধরে। আসলে আমিও তো মাটিরই একজন। একদিন ছাই হয়ে মিশে যাব মাটিতেই।
যখন দেশ ছেড়ে চলে আসছিলাম তুই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিলিস, “একদিন তোকে মাটির টানে ফিরতেই হবে!” হয়তো বলতে চেয়েছিলিস, “একদিন আমার টানে ফিরতে হবে।” বলতে পারিসনি। তখন দু’টো টান বড় প্রবল ছিল। মাটির টান আর পেটের টান। এই স্কলারশিপটা নিলে বাড়ির ছাদটা সারানো যেত, বাবার ওষুধের আর সংসারের ডাল-ভাতের লড়াইটা বন্ধ হতো। তাই চলে আসতে হল। তারপরের গল্পটা আর দশটা পাতি গল্পের মতো যা বহুবার লেখা হয়েছে, পড়া হয়েছে। জানিস অদিতি, প্রয়োজন কখনও শেষ হয় না। টালির ছাদ থেকে পাকা ছাদ, কুঁজো থেকে ফ্রীজ, পাখা থেকে এয়ারকন্ডিশন, ভাইপোর অ্যাডমিশন থেকে ভাগ্নীর বিয়ে এভাবেই তালিকা বাড়ে। এই দেশে এসে অনিকেত হয়ে উঠল একটা কল্পতরু কিংবা আলাদিনের জিন। আমি মানুষটা মাঝখানে কোথায় হারিয়ে গেলাম। ফিরে আসব বললে সবাই জিজ্ঞাসা করত ক’দিনের জন্য? ‘পাকাপাকি’ কথাটা বলতে ভয় পেতাম। কী জানি, এই যে এত গুরুত্ব, এত ভালবাসা, এত যত্ন যদি নিমেষে উধাও হয়ে যায়? একেই কী মাটির টান বলে, অদিতি?
আসলে এই টান জিনিসটাই খুব গোলমেলে। যেন এক বন্ধনহীন গ্রন্থি। আমার পাশের বাড়িতে থাকেন এক বৃদ্ধা, তাঁর নাতির ডাউন সিনড্রোম। ছেলেটি পঁচিশ ছাব্বিশ বছর তো হবেই, তার বেশিও হতে পারে। সব কাজ যে নিজে করতে পারে তা নয়। দু’পা চলতে না চলতেই বসে পড়ে, আবার ওঠে, আবার হাঁটে। কাছেই সব্জির মার্কেট। এলিস বিয়ান্দ্রোকে স্বাবলম্বী হতে শেখাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আমার বারান্দার সামনে এসে জড়ানো গলায় বলে “ডু ইউ হ্যাভ টেন বাকস?” কখনও দিই, কখনও দিই না। এলিসই বলেছেন সবসময় না দিতে। অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাবে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি, “হোয়্যাট উইল ইউ ডু উইথ টেন বাকস?” ও বলে খাবার কিনবে এমার জন্য। এমা ওর পোষা কুকুর, ওর একমাত্র বন্ধু। এলিস বলেছেন এমার দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে। রোজগারের চেষ্টা করতে হবে। বিয়ান্দ্রো কখনও কারুর গাড়ি মোছার চেষ্টা করে, কখনও গ্রসারি শপের কার্টগুলোকে সামলে কিছু টাকা পায়। হাত খালি থাকলে আমার কাছে আসে। এ-ও এক প্রকার অচেনা টান। তার নিজের পরণের জামাকাপড় যে সবসময় ঠিকঠাক নেই, সে খেয়াল যে রাখতে পারে না সে এমার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। কোভিড যখন বাড়াবাড়ি রকমের থাবা বসাচ্ছিল বয়স্কদের উপর, এলিস খুব ভেঙে পড়েছিলেন। বলতেন, আমার পরে বিয়ান্দ্রোর কী হবে! অথচ এলিসের কন্যা আর প্রাক্তন জামাতা যে যার মতো সংসারী। সেখানে বিয়ান্দ্রো ব্রাত্য! ‘টান’ বড়োই আজব একটা শব্দ, তাই না?
গ্রীষ্মে আমেরিকার বিকেলগুলো খুব সুন্দর। প্রায় সাড়ে আটটা অবধি বিলম্বিত লয়ে রোদ পড়তে পড়তে সন্ধে নামে। মৃদু হাওয়ায়, অল্প তাপে আরাম কেদারায় গা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে বিশেষ আর কিছু করার থাকে না। সময় দিব্যি রূপকথার ডাইনিবুড়ির মতো সুতো ছাড়তে থাকে আর নিয়ম মাফিক কাজ করে চলে আশেপাশের মানুষজন। বাস থেকে নেমেই বাচ্চারা হই হই করে খেলায় মেতে ওঠে সবুজ ঘাসে। আইজার মতো মায়েরা মিষ্টি মধুর বকুনি দিতে দিতে একাধারে বাড়ি যাবার তাড়া এবং আরেকটু খেলার প্রশ্রয়, দু’টোই দেয়। কেউ পোষ্য নিয়ে হাঁটতে বেরোয় তো কেউ সেকেন্ড শিফটের কাজের জন্য গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কর্মব্যস্ততা যেটুকু দেখতে পাই তা এই বিকেলেই। সকালে তো আর এখানে এসে বসতে পারি না। বাড়ি যতই ছোট হোক, নির্জন হোক তারও কিছু যত্ন লাগে, যত্ন লাগে গাছগুলোর। তাই বিকেলটুকুকে আমার আলস্যের ভাগীদার করে রেখেছি। স্থবির হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া বেশি কিছু করতে ইচ্ছে করে না।
কখনও কখনও সন্ধে গড়িয়ে কখন রাত নামে বুঝতে পারি না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় কেটে যায়। এই একই আকাশ তোর মাথার উপরেও আছে। শুধু সেখানে তারার জায়গায় এখন প্রখর রোদ। ভাগ্যিস এই আকাশকে আমরা ছুঁতে পারি না। নইলে মাটির মতোই ফালাফালা করে ভাগ করে ফেলতাম। বলতাম এই দাগ থেকে ওই দাগ অবধি আমার জায়গা। জানি, আকাশ-সীমাও আছে। আর তা লঙ্ঘন করলে আছে মিসাইলও। তবু যা সচরাচর চোখে দেখা যায় না তা আমার মতো সাধারণ মানুষ মাঝে মাঝে নেই বলে ধরে নিয়ে আনন্দ পায়। যেমন আমি ভাবি, আমি আর তুই এক আকাশের নীচে আছি। যেমন গঙ্গার পাড়ে বসে আমরা সূর্যাস্তের দোল খেলা দেখতাম, এখানেও বারান্দা থেকে লেকের ওপর দেখি মেঘের সেই রঙ। কিন্তু কিছুতেই ভাবতে পারি না আমি আর তুই একই মাটির উপর হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি। ভাবনাতেও যোজন দূরত্ব অজান্তেই তৈরি হয়ে যায়। এদেশের মানুষের কাছে এদেশের মাটি প্রিয়। ওদেশের মানুষের কাছে ওই সীমারেখার মধ্যে যে মাটি সেই হলো মা। আচ্ছা, মাকে কী সত্যিই ভাগ করা যায়? তবু করব। ‘আমার আমার’ বলে বেড়া দিয়ে আগলে রাখব। রক্ষা করার চেষ্টা করব তাকে, যার বুক নিংড়ে নিরন্তর বেড়ে ওঠা ফসলেই গোটা দুনিয়া বেঁচে আছে।
এ বিভেদ কখনও যাবার নয় রে অদিতি। মাটি থেকে শুরু করে জল, জাতি-ধর্ম থেকে শুরু করে চামড়ার রং এমনকি ভাষা পর্যন্ত – সব কিছুতেই বিভেদ আর হিংসা। আমরা শুধু ভেবেই যাব, মনে মনে খুব চাইব সব ঠিক হয়ে যাক, পৃথিবী শান্তিময় হোক। পরেরদিন সকালে রক্তাক্ত খবর শুনে আবারও শুরু করব নতুন দিন। তবু এই ভাবনাটুকু আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকুক। একটা প্রদীপ গোটা একটা বাড়িকে আলোকিত করতে পারেনা ঠিকই, তবে প্রতি উঠোনে যদি শুভ চিন্তার দীপালিকা জ্বলে তাহলে একদিন হিংসে করার মতো, বিভেদ সৃষ্টি করার মতো অন্ধকার মন আর বেড়ে উঠতে পারবে না, এমন আশা রাখা কী অন্যায়?
বেলা পড়ে এলো রে। কম আলোয় আজকাল লিখতে কষ্ট হয়। আবার বারান্দায় বাতি জ্বাললে মৌতাতটা কেটে যায়। কাগজ কলমের পর্ব হয়ত এখানেই শেষ করতে হবে, তবে তোর সঙ্গে কথা বলাটা আজ আর বন্ধ হবে না। তোকে তো জিজ্ঞাসাই করা হলো না যে কেমন আছিস? এমন সময় খোয়াইয়ের ধারে বসে যেমন বলতাম “একটা গান শোনাবি?” এখনও তেমন বলতে ইচ্ছে করছে। মানুষ এত উন্নতি করেছে যে চাইলেই মোবাইলের বোতাম টিপে গান রেকর্ড করে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে নিমেষে পাঠিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তোর জবাবী চিঠিতে সুছাঁদ অক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে তোর মিষ্টি কণ্ঠটাও যে ভেসে আসবে – সেটা আর ইহ জীবনে দেখে যেতে পারব বলে মনে হয় না। সেই আবিষ্কার যদি ভুল করে হয়েও যায়, ততদিনে হয়ত ‘চিঠি’ বলে বস্তুটাই একটা অবলুপ্ত ইতিহাস হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো তোর ও আমার এই চিঠিগুলোই হবে পৃথিবীর অন্তিমতম চিঠি! এরপর হয়ত কেউ আর কোনও দিন কাউকে চিঠি লিখবে না! এভাবেই আমরা একসঙ্গে কোথাও না কোথাও অমর হয়ে থেকে যাব, কী বলিস?
আদর নিস,
অনিকেত
🍁কবিতা
দুর্গাদাস মিদ্যা
অভাবিত কিছু কথা
অভাবিত কিছু কথা মাঝে মাঝে উঠে আসে মনের আকাশে।
কখনো সখনো হারিয়ে যায় অমোঘ নীরবতায়।
বদলে দেয় জীবনের মানে,
পৃথিবীর এই জমিতে দিন রাত কত খেলা চলে যেন মনে হয় কারো কারো হৃদয় ছিটকে উড়ে আসে আর ভেসে যায় মেঘের ভেতর।
অযতন দেখেছি দেখেছি বেদনার সঘন আকাশ ছাই রঙা হয়ে যায়
বিষাদময়তায়।
নানা ভাবনার জাল টেনে তুলে আনে কত পথিকের ছবি
অনায়াসে সে কবি হয়ে যায়।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কত কত ছবি আঁকা হয় হেমন্তের শিশির সজ্জায়য়।
তৈমুর খান
কল্পনা
দূরের পাহাড়ের কাছে
উড়ে যায় আমার নিঃস্ব প্রজাপতি
আজ সে ভিখিরি নয়
অভিমান নেই তার
আজ সে নরম নিগূঢ় পর্যটক
প্রদীপ সেন
তবে আমি কেন নয়?
কোকিলের কথা না হয় আলাদা
সময় ও জো বুঝে নিজেকে জানান দেবার অতি চেষ্টা
তাকে কেন অনুকরণ আর অনুসরণের কুচেষ্টা?
কই, দোয়েল শ্যামা ফিঙে বুলবুল এমন তো নয়!
যার কণ্ঠে যাকিছু আসে, যতটুকুই আসে, ঢেলে দেয়,
স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নির্মোহভাবে।
কই, একবারওতো ওদের শোনার, বোঝার অনুকরণ বা অনুসরণের কথা ভাবা হয় না?
এ কোন্ দীনতা?
এই যে প্রেয়সী কলমকে দিয়ে এতো কিছু বলা,
কে কতটা নিল, কীভাবেই বা নিল,
তাই নিয়ে কোকিলীয় আসক্তির ঘেরাটপে আটকে আছি।
দোয়েল শ্যামা ফিঙে বুলবুল কিছু হলেওতো পারছে,
তবে আমি কেন নয়?
কুন্তল দাশগুপ্ত
পাগল-কথা
বাসা ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। কেউ বোনে। কেউ বাঁধে। কেউ আবার গড়ে নেয়। তা সে যাই হোক, বাসা যে এক নেহাতই স্পর্শকাতর বিষয় তা সকলেই নির্দ্বন্দ্বে স্বীকার পেয়ে থাকে।
বাবুই-এর দিকে দেখুন- দেখবেন দুই-বাবুই মহা ব্যস্ততা ও যত্ন সহকারে গাছের আঁশ খুঁটে তুলে আনছে আর তা দিয়ে বুনে চলেছে আদর-বাসা। তার কত যত্ন! জোনাকি আলোয় বাসার আঁধার মাড়ায়। তারপর ছানাদের ডানা হলে, বাবুই ফেরে না আর পুরনো বাসায়। যত ভোলা-বাসা গুলো হাওয়ায় হাওয়ায় দুলে স্মৃতিটুকু ধরে রাখে ভূমিসাৎ
অনিবার্য জেনে।
গৃহস্থের নানান ফোকরে বাসা বাঁধে পায়রা সকল। যতদিন এলাঢেলা শস্যের দানা ছড়াছড়ি যায় গোটা প্রাঙ্গণ জুড়ে, ততদিন ভারি বকম বকম। ঘূর্ণিপাকের বেঘোরে পড়লে পরে গৃহ-তরণীকা শস্য দানার আসে বন্দি জীবন। হিসেবের খাতা, ভরে ফেলে পাতা। বাঁধা বাসা ফেলে রেখে প্রবাস যাপন পায়রার অভিরুচি। সম্মার্জনী তার কাজ সারে একদিন। গৃহস্থের স্বস্তি ফেরায়।
কুমোরে পোকার বাসা গড়বার রীতি জানি অতি মনোহর। আগান বাগান খুঁজে কাদার গুটিটি এনে কয়েক প্রকোষ্ঠ জোড়া বাসটি গড়ে তোলে রূপদক্ষ কুমোরের মত। নিষিক্ত ডিম থেকে লার্ভা পিউপা হয়ে শেষমেস পূর্ণতা লাভ করে আগামীর দল আর গড়ে তোলা বাসা ভেঙে উড়ে যায় আপন যাপনে। বাসা গুলো পড়ে থাকে একা। ফেরার প্রত্যাশা রাখেনা কখনও।
মানুষ কী করে? মানুষ ঘর বাঁধে। বাড়ি বানায় কিন্তু নিজের বাসা বুনতে পারে না। প্রতি মানুষের বাসা অন্যের কাছে বাঁধা প’ড়ে থাকে। তার খোঁজে কেটে যায় কারো কারো আজীবন। কার কাছে বাসা আছে বুঝতে পারে না যেটা তাহার জন্যে ভালো…
বিপ্লব সাইফুল
ইমাম
হলুদ মিনারের জালালি কবুতর ম্যাকাও পাখির সাথে আমাজন ঘুরে, পালকের বিছানা পেতে শুই গাছের ডালে
বিরহের মেঘবালিকা উড়ে এলে মনের দেশে, বাজে যদি জলের সরোজ, স্বপ্নবৈঠা বেয়ে যাই চাঁদের কাছে, খুলে দেই চন্দ্রপেখম
ক্ষুধার বাঘ কামড় বসালে আহত হয় না পাকস্থলী
জুহি চাওলার চিবুক থেকে পেড়ে আনি লাবণ্যের রুটি
দুঃখ আমার দুধবোন, একই সাথে চুষে খাই সুখের স্তন
যেখানে হীম হয়ে জমে থাকে রাষ্ট্রের অন্ধ তিমি
লৌকিক পাথরে বেড়ে ওঠলে ঠকের ঘর
আলোর বিভায় ছুঁড়ে দেই গতির হার্পূন, স্বপ্নের ধনুর্ধর উড়িয়ে দেই ঠকের কেরামতি
মূলত মানুষ এক জন্মভিখারি
ছলনার ছুরিতে জীবনকে খুন করে কেউ কেউ করে যায় স্বপ্নের ইমামতি!
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ
বিশ্বাস
আলোকিত কামরায় ঢেয়ে এসেছিল
বিবর্তিত প্রজাতির উৎস রেখা
ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে
সবুজের আবডালে কাকতাড়ুয়া
মিথ্যে আচরণে সভ্যতা গড়ে উঠে
কামরাঙা হাওয়ায়…
অরুণাভ ভৌমিক
খোঁজ
মাঝখানে গাড়ি তিনবার থেমেছিল
কেউ ওঠেনি
কেউ নামেনি
খুব কাছ থেকে কে যেন ডাকল
কেষ্ট বাবু ও কেষ্ট বাবু
আমি তখন জলের তলার শহরে
একটা কাঁঠালিচাপা ফুল খুঁজছিলাম!
মমতা রায় চৌধুরী
উত্তরণ
জীবন আজ কঠিন সত্যের মুখোমুখি
মৃত্যু বড়ো না অন্য কেউ সেই সত্য খুঁজি
বেঁচে থেকে লড়াই করা তার চেয়ে বড় কিছু নেই।
মৃত্যু তো ক্ষণিকের অতিথি এটাই ধ্রুব সত্য মানি
তবে কেন এত সুখ এত দুঃখ এত যন্ত্রণা মৃত্যুকে ঘিরে
মৃত্যু যে এক কঠিন অমুক সত্য তাকে নিয়ে বরণ করে
জীবন যুদ্ধে বেঁচে থেকে যাই সঠিক কর্ম করে
কর্মই সকলের চেয়ে বড় তাকেই যাই চিরস্থায়ী করে।
এই ধ্রুব সত্য মেনে যদি সঠিক কর্ম করি
সেটাই আমাদের যথার্থ উত্তরণ একথা হাজারবার বলি।
দেবপ্রতিম দেব
অজানা
শেষের যে ঘুম মানুষ মৃত্যু বলে জেনেছে,
এই জানা অলীক সত্য কারণ
সেই ঘুমের পর মানুষ সময়ে চলে গেছে
অন্য কোথাও …
সুশীতল দত্ত
প্রজাপতি সুখ
প্রজাপতি সুখে বৈকালিক আড্ডা
পূর্বস্রোতাভিমুখী পর্বে কথান্তর পর্ব
নাব্যতায় উজানের বিপরীতমুখী ভাবনা নয়
মধুলোভীর মতো ছুটে এসো
সবুজ কার্পেট বিছানো চাদরে চলুক
জমানো কথা
আর দেরী নয়
এসো বসন্তের হাওয়ায়।
🍁গদ্য
নুসরাত সুলতানা
আমি আর রোযা
যতদূর মনে পড়ে তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। গ্রীষ্মের রাত, আনুমানিক সাড়ে তিনটা হবে। আব্বু ডেকে তুলেছেন – প্যাপিরাস, আম্মু ওট। সর্গাই (সেহেরি) খাবা না? তুমি না রোজা রাকপা? ঘুম চোখে পড়িমরি করে উঠে বসি। রোযা রাখতেই হবে। রোযা রাখা তখন আমি এবং আমায় বয়সী ছেলে-মেয়েদের কাছে বিরাট কৃতিত্বের বিষয়। তখন রোযার দিনে স্কুল পুরো মাস বন্ধ থাকত। রোযা ছাড়া প্রায় দুই-তিন ঘন্টা পুকুরে থাকতাম। সাঁতার কাটতাম, গোসল করতাম। হেলেঞ্চা শাকের ডাটি দিয়ে পোলা পোলা খেলতাম। কিন্তু রোযার দিনে দ্রুত গোসল সেরে উঠে যাই। কারণ আম্মু বলছিলেন- রোযা রেখে বেশি পানির ভেতর থাকলে পশমের গোঁড়া দিয়ে দেহের ভেতর পানি যায় এবং রোযা মাকরূহ হয়ে যায়। বড়রা মশকরা করে বলত- পুহাইরে ডুব দিয়া এক ঢোঁক পানি গিল্লা হালাবি। অতে কিছু অইবে না। কিন্তু আমরা ভয়ে নিজের মুখের ঢোঁক অব্দি গিলতাম না। সারাদিন থু থু ফেলে জিহবা শুকনো করে ফেলতাম। সারাদিন পর লেবু আর চিনির শরবত, গুড়-নারকেল দিয়ে চিড়া ভেজানো, ছোলা, পেঁয়াজু খেতে অমৃত লাগত।
_____________________________________________
রোযার মূল উদ্দেশ্য সংযম এবং মানবতার শিক্ষা। চারিদিকে সামপ্রদায়িক সংঘাতের যেন জয়জয়কার। কিন্তু আমরা শৈশবে শিখেছি অযথা একটা পিঁপড়াকেও আঘাত করা ভীষণ পাপ এবং অন্যায়। এই শিক্ষা আমাদের গুরুজনরাই দিয়েছেন।…
_____________________________________________
একটু যখন বাড়ন্ত বয়স এই ধরা যাক ক্লাস সেভেন -এইটে পড়ি বুঝে গিয়েছিলাম রোযা আর নারীত্বের সম্পর্ক। কিংবা বয়সে বড় চাচাতো বোনরাই বুঝিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কখনও কখনও আযানের একটু আগে রোযা ভাঙার কারণ ঘটত। আর কি যে আফসোস হত সারাদিন রোযা রেখে অল্প একটুর জন্য হল না। আমরা বলতাম- রোযা ফুটা হয়ে গ্যাছে। এই নিয়ে বোনেরা হাসাহাসি করতাম কত! মনে পড়ে সবে কদরের রাতে আম্মুর সাথে সারারাত ধরে নামাজ পড়তাম। অইরাতে এলাকার মসজিদগুলোতে খতম তারাবী পড়াত আর মিলাদ-মাহফিল হত। আমরা অই মিলাদের জিলিপি আর বাতাসার জন্য অপেক্ষা করতাম। সেই রাতে মসজিদ থাকতো মুসুল্লি দিয়ে পরিপূর্ণ। আমার ছোট ভাইয়েরা যেত। ওদেরকে বাতাসা মুসুল্লি বলে ক্ষ্যাপাতাম। বাতাসা আর জিলিপি নিয়ে এলে মুড়ি দিয়ে গভীর রাতে সেসব তবারক খাওয়া হত।
রোযা শেষে যখন স্কুল খুলত সহপাঠী ছেলেরা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করত- এই তুই কয়ডা রোযা ভাঙছ? সত্য কতা কবি। এমন ইঙ্গিতে ভেতরে ভেতরে লজ্জায় মরে যেতাম। কিন্তু মুখে কপট রাগ দেখিয়ে বলতাম – কী সব বাজে কতা কস! ত্রিশ রোযা রাকছি। ভাগ এহান থেইকা। মাইর খাবি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রোযা এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে এসেছিল। রুমমেটরা মিলে সেহেরি খেতাম উঠে। তখন কোনও কোনওদিন রোকেয়া হলের ডাইনিং রুমে খেতে যেতাম। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে হত। অই গভীর রাতে মেয়েদের উপস্তিতি হলরুমে দুপুর নামিয়ে আনত। সেহেরি খেতে খেতেই চলত- আড্ডা আর গল্পবাজি। কাদের শৈশবের রোযা কেমন ছিল সেসব গল্প আড্ডা জুড়ে জেঁকে বসত। ইফতারের সময় হলগেটের বাইরে পাঁচ টাকায় বড় জিলিপি, গোল বড় একটা বেগুনি, পাঁচ টাকায় দু’টো পেঁয়াজু। বিশ টাকার ইফতারে পেট ভরে যেত। আর সাথে নিজের বানানো লেবু আর ট্যাঙের শরবত। সবমিলিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ তৃপ্তি। আবার কোনওদিন টি এস সি’র ভেতরে কিংবা ফুলার রোডে বা মল চত্বরে বসে একসঙ্গে সাত-আট জন বন্ধুরা মিলেমিশে ইফতার করতাম। মেয়েরা হল থেকে বোতল ভরে শরবত বানিয়ে আনতাম, ছেলেরা হাকিম চত্বর থেকে হরেক পদের ভাজাপোড়া ইফতার কিনত। তারপর চা -পর্ব, আড্ডাবাজি।
তারপর চাকরি আর দাম্পত্য জীবনে কত ইফতার বানাই- বিরিয়ানি, পরোটা, গোসত, কাবাব । কিন্তু সেই বিশ টাকার ইফতারের স্বাদ কোথায় পাই! স্বাদ আসলে থাকে সময়ের জিহবায়। আর এখন এই চল্লিশোর্ধ্ব জীবনে এসে চৌদ্দ বছরের ছেলে যখন সব রোজা রাখে ভাবি- এই প্রজন্ম আসলেই এগিয়ে আছে। শুধু রোযাই রাখে না। বাবার সঙ্গে শরবত বানায়, জুস বানায়। আমি নবম শ্রেণীতে বসে প্রথমে উনিশটা রোযা রেখেছিলাম। এখন অফিস থেকে ফিরে ছেলের জন্য তড়িঘড়ি করে ইফতার বানাই আর শৈশবের সেইসব দিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। আর স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে মাটির চুলার কাছে ইফতার বানানোরত আমার মায়ের ঘর্মাক্ত মুখ। সময় বিলীন হয় মহাকালের গর্ভে রেখে যায় আবাহমান জীবনের গল্প।
পরিশেষে বলতে চাই, রোযার মূল উদ্দেশ্য সংযম এবং মানবতার শিক্ষা। চারিদিকে সামপ্রদায়িক সংঘাতের যেন জয়জয়কার। কিন্তু আমরা শৈশবে শিখেছি অযথা একটা পিঁপড়াকেও আঘাত করা ভীষণ পাপ এবং অন্যায়। এই শিক্ষা আমাদের গুরুজনরাই দিয়েছেন। সকল ধর্মের মূলমন্ত্র হোক মানবতা,উদারতা এবং সহমর্মিতা ও ক্ষমা। 🦋
🍁কবিতা
পাপড়ি মণি
মিথ অথবা বখতিয়ারের ঘোড়া
সবুজ গিরিবাজ ডাকে গলা ফুলিয়ে
দুপুর ভেঙে পড়ে প্রেমে, প্রেম গুঁড়ো হয়ে যায় গিরিবাজের ডাকে
আমার কোনো গিরিবাজ নেই
আহত হৃদয়ে ফুটে থাকে লেবু ফুলের মতো প্রেম
যেই তোমাকে পুষেছিলাম সোনার পিঞ্জরে
সেই তুমি কবেই মিথ হয়ে গেছো
কেবল রাত্রি ঘন হলে স্মৃতির কারবালায়
বখতিয়ারের ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে ওঠো!
সুশান্ত মোহন চট্টোপাধ্যায়
চতুরঙ্গ মন
চতুরঙ্গ মন ঘোড়ার গাড়ি
দিগন্তের সীমায় ছুটে চলে
ধূলার আস্তরণে ঢাকা তারা
মূক ইশারায় কেবল ডাকে।
ফেনায়িত সমুদ্রের নীল জলে
আছড়ে পড়ে ঢেউগুলো তটে
শুক্তির ভিতর মুক্তো খুঁজতে
হুটোপুটি লাগে বালুর মাঠে।
অভিজিৎ দত্ত
রোজা
রোজা মানে উপবাস
রোজা মানে ত্যাগ ও সংযম
রোজা মানে শরীর ও মনের উপর
বাড়বে তোমার নিয়ন্ত্রণ।
ঠিক করে রোজা
করতে পারলে পালন
শরীর ও মনে
লাভ হয় বিলক্ষণ।
রোজার উপকারিতা
আজ অনেকেই মেনেছে
বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পরীক্ষা করে
এর সত্যতা দেখেছে।
ঠিক করে রোজা যদি
কেউ করে পালন
আল্লাহ’র সাথে হবে
তার নিশ্চিত মিলন।
আব্দুল হাফিজ
সে দিন ছিল সাতই মার্চ
‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না ‘
বজ্রকণ্ঠে যেন বজ্রপাত
উচ্ছসিত জনতা
উঠিয়েছিল সেদিন মুষ্টিবদ্ধ হাত।
বেজেছিল সেদিন, সে ক্ষণে
একটি দীর্ঘ অজেয়, অমর
একটি গান
সে গানে পাগলপারা জনতা
ফিরে পেয়েছিল বেঁচে ওঠার তান।
একটি কণ্ঠে
শোণিত উচ্চারণ
শিকল ভেঙে খানখান
খুলেছিল লক্ষ জনতার
বজ্র নিনাদ জবান।
‘রক্ত যখন দিয়েছি
রক্ত আরো দেবো ‘
পিতার মহাকাব্যের পঙক্তি
যখন উঠলো বেজে
লক্ষ কন্ঠ ত্বরিতে
জ্বলে উঠলো দারুণ রোষে।
পোয়েট অব পলিটিক্স,
জনতার কবি, সংগ্রামের কবি
অবশেষে সদর্পে পাঠ করলেন তাঁর
অমর কবিতাখানি
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এখানেই গ্রোথিত হল
স্বাধীনতার মন্ত্র
আর এ মন্ত্রেই উত্তাল জনসমুদ্রে
উঠেছিল বৈশাখী ঝড়
সেদিন ছিল ৭ মার্চ
সেদিন থেকেই স্বাধীনতা শব্দটি
আমাদের হলো।
সেদিনই হলো বাঙালির জন্মদিন
সেদিন থেকেই আমরা বাঙালি
সে দিন-ই হলো –
মুজিব মানেই বাংলাদেশ
মুজিব মানেই স্বাধীনতা
মুজিব মানেই শিকল ভাঙার গান
মুজিব মানেই লক্ষ প্রানে
বেঁচে থাকার কলতান।
মোঃ হাবিবুল ইসলাম তোতা
প্রিয়তমা নিদ্রা দেবী আমার
প্রিয়তমা নিদ্রা দেবী আমার
বারবার তোমার বাহুবন্ধনে ফিরতে হয়,
শত বন্দর পেরিয়ে, সকল ক্লান্তি পিঠে চেপে নিয়ে, সকল দুরাশা দূরে ঠেলে রেখে
অবশেষে তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাই।
প্রিয়তমা নিদ্রা দেবী আমার
তোমার আলিঙ্গনে তুমি দুঃখ ভোলাও
শতবেদনার পায়ে বাঁধো বেড়ি
দেহটাকে বারবার তুমি বিনির্মিত কর
সঞ্চিত শক্তির বাঁধন দাও ছিঁড়ে
আমি আবার আগামীর জন্য নির্মিত হই।
প্রিয়তমা নিদ্রা দেবী আমার
তুমি হতাশার বুক চিরে আশা জাগাও
ছিটিয়ে দাও তাতে স্বপ্নের বীজ
মুকুল ফোটাও তুমি শুকনো মন কাননে
রচিত কর তাতে সুর সঙ্গীত।
প্রিয়তম নিদ্রা দেবী আমার
জানি একদিন আপন করে নিবে আমায়
তোমার অতুল আধারে হারিয়ে যাবো
ফেলে রেখে শত কাজ পৃথিবীর মায়া
চিরনিদ্রায়।
প্রিয়তম নিদ্রা দেবী আমার
সেদিন তুমি আমার হবে
আমি হব তোমার
শত ব্যস্ততা পিছু রেখে
হারিয়ে যাব ঘুম না ভাঙ্গা ফুলশয্যায়।
স্বপন পাল
ছেড়ে গেলে
আলো মুখে প্রদীপ নিয়ে
তুলসীমঞ্চটার ওখানে থাকার কথা
এ সন্ধ্যায়, ক্লান্তির আঁধার
বুকে জড়িয়ে এখন যেখানে অবিশ্বাস বসে।
তোমাকে বলেছে কেউ
ওরকম কেন অপেক্ষায় আছো?
জানেনা সীমানা বাঁধা বাড়িটার
আতুসি দরজা, কেউ খুলে ঢুকবে বলে
আলগা খিল নড়ছে বাতাসে।
কে আসে, কে আসে?
সন্ধ্যার সময় ভাল নয়
তোমাকে বলেনি কেউ, কেন আছো?
আলোর সন্ধানে এসে দু’চারটি পোকা
পুড়ে মরা কাকে বলে বুঝলো না
উড়ে চলে গেল, বৃথা রাত্রি ঘন হতে থাকে।
গোলাম কবির
আমার তো সবই আছে
আমার তো সবই আছে!
বুকের গহীনে সন্ধ্যা আছে!
গ্রীষ্মে চৌচির, বর্ষায় প্লাবিত
এবং হেমন্তের পাতা ঝরা
কান্নার এক হৃদয় আছে!
মেঘে ঢেকে থাকা সকাল আছে!
ঘুঘু ডাকা মনকেমন করা
উদাস দুপুর আছে,
প্রফুল্লতাহীন ব্যর্থ বিকেল আছে!
ধূ ধূ শূন্যতার সোনালি ধান
কেটে নেয়ার পরে ন্যাড়া
ফসলের একটা মাঠ আছে!
শুকিয়ে মজে যাওয়া
শাপলার ঝিল আছে!
প্রেতনগরীর মতো হারিয়ে যাওয়া
একটা গ্রাম আছে স্মৃতির ক্যানভাসে!
বুকের মধ্যে ঘরহীন এক ঘর আছে,
এখানেই বহুদিনের অব্যবহৃত
এক উঠোনের শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস আছে,
মজা একটা শ্যাওলা পড়া পুরনো
পাকাসিঁড়ির ঘাট সহ পুকুর আছে,
একটা জল শূন্য শীর্ণ প্রিয় নদী আছে!
অনন্ত বিশ্রামে যাবার প্রস্তুতি নিতে
বাক্সবন্দি সাদা কাফনের
কাপড় সহ খাটিয়া আছে!
আতর আছে, কর্পুর আছে,
লাক্সের একটা সাবান আছে,
তুলা আছে, আগরবাতি আছে!
আমার তো সবই আছে!
প্রাচীনকালে নানি-দাদির কাছে
শোনা রূপকথার গল্পের মতো
রাক্ষস খোক্ষসে ভরপুর
জীবনযুদ্ধে হেরে যাবার গল্প আছে!
জীবন খেয়ে ফেলা ভালোবাসা নামের
দৈত্যের মতো একটা অসুখ আছে!
সেই অসুখ সারাতে কবিরাজ হিসেবে
কল্পরাজ্যে একজন তুমি আছে!
আমার তো সবই আছে!
মাথার ওপর প্রলম্বিত গনগনে সূর্য আছে!
মরে যাবার সাধ আছে,
ভুল করে বেঁচে থাকা জীবন আছে!
সেই জীবনে মরে যাবার অপেক্ষা আছে,
দুঃখ আছে, কষ্ট আছে!
অশ্রু আছে, কান্না আছে!
এখনো মরে যাচ্ছি না বলে
চেপে রাখা দম ফাটানো হাসি আছে!
সত্যি কথা বলতে আমার তো সবই আছে!
আমার মধ্যে শুধু এই আমিই নেই!
আবু তালেব মোল্লাহ্
প্রেমাংশুকে—
এতকিছুর পর
ঝালমুড়ি খাওয়ার ভাণ করে
গল্পচ্ছলে দাঁড়িয়ে ফুটপাতে।
চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিতে একটা ফোন এল,
কথায় কথায়
রোরুদ্যমানা চয়নিকা;—রুদালী সিম্ফনি!
আমাদের আবার দেখা হবে
সময়ের অনুভবে পৌনঃপুনিক-
কী ছিল
কী নেই—
প্রেমাংশু! সবকিছু আমাদেরই অংশ,
তোমার আমার সমুদ্র কি এতদিন শুকিয়ে ছিল?
সাফিয়া খন্দকার রেখা
সমকালীন দৃশ্যপট
প্রশ্নের বারুদে পুড়িয়ে অন্তমিল খুঁজে নেয় হিসেবের খেরোখাতা
ভালোবাসা কিংবা সংসারের গল্পগুলো এখানে সোনা রোদ ছুঁয়ে হারিয়ে যায়
ভালোবাসায় রজনীগন্ধা – গোলাপ অথবা গন্ধহীন ঘাসফুলেরাও মানিয়ে যায়
সংসারে বেহিসেবী উপকরণ লাগে, বুক পকেটে কেবলমাত্র বিশ্বাসের ঘ্রাণ নয়… ঘ্রাণযুক্ত উনুন লাগে
পৃথিবীর সাথে পরিণত পরিচয় ঘটে মূলত সংসার সংসার খেলায়
প্রেমে শরীরের ক্রাইসিস থাকে
সংসারে শরীর থাকে নগ্নতা থাকে… তবুও ভালোবাসার শূন্যতা থাকে
স্বপ্নের ফ্রেমবন্দী সময়ের কৌতুহলে তুমুল তৃষ্ণা মৈথুনে নীল হয়,
নেশার পৃথিবীতে অজান্তেই আমরা পাঠ করে চলছি সমকালীন দৃশ্যপট,
ঘোরের ভেতর গ্লাস ভর্তি দীর্ঘশ্বাস
যদিও আমাদের আয়ু খেয়ে বেঁচে থাকে সময়,
আমরা প্রবেশ করি এক ফসিলের গল্পে,
যে গল্পে থাকে অজস্র বিস্ময়বোধক চিহ্ন
যেখানে ক্ল্যাসিক্যাল মুডে আলোর অলীক আভায় জেগে থাকে
সাহেব – বিবি – গোলাম,
অতঃপর
স্বর্গলোকের নতজানু প্রজাবৃন্দ
🍁গদ্য
সিদ্ধার্থ সিংহ
প্রথম মহিলা আত্মজীবনীকার
প্ৰথম আত্মজীবনী লেখার জন্য বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম মহিলা লেখকদের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন রাসসুন্দরী দেবী। তিনি জন্মেছিলেন ১৮০৯ সালে। অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার পাতাজিয়া গ্রামে। ১৮৬৮ সালে তাঁর যখন সাতষট্টি বছর বয়স, তখন ‘আমার জীবন’ নামে তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের মধ্যে ছোট ছোট মোট ১৬টি রচনা রয়েছে। এবং সেই বই প্রকাশের একুশ বছর পরে তাঁর যখন অষ্টআশি বছর বয়স, তখন সেই আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে ১৫টি ছোট ছোট রচনা রয়েছে। এবং প্রত্যেকটিই শুরু হয়েছে উৎসর্গমূলক এক-একটি কবিতা দিয়ে।
আর তাঁর এই বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শুধু প্রথম বাঙালি হিসাবে নয়, প্রথম ভারতীয় নারী হিসাবে আত্মজীবনী লেখার গড়িমা অর্জন করেন তিনি। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা যিনি ভারতের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছিলেন।
উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যেখানে নারীশিক্ষা প্রায় অসম্ভব ঘটনা ছিল, সেখানে নিজের চেষ্টায় বই পড়া শেখেন তিনি। তাঁর পৈতৃক বাড়িতে একজন মিশনারি মহিলা দ্বারা পরিচালিত পাঠশালা ছিল। সেখানে বাড়ির ছেলেরা পড়াশোনা করত। রাসসুন্দরী সেখানে কিছুক্ষণের জন্য যেতেন এবং আড়াল থেকে পড়া শুনে শুনে অক্ষরজ্ঞান লাভ করেছিলেন। সেই অক্ষরজ্ঞান লাভের পরে রান্নাঘরের মেঝেতে আঁক কাটতে কাটতে বর্ণ লেখাও রপ্ত করে ফেলেন। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বাংলার উনিশ শতকের সমাজের ইতিহাসে রাসসুন্দরী দেবীর লেখা ‘আমার জীবন’ নামের প্রথম আত্মজীবনীটি এক নারীর লড়াই এবং শিক্ষিত হয়ে ওঠার পিছনের কাহিনি ধরা পড়েছে।
১৮০৯ সালে বাংলাদেশের পাবনা জেলার পোতাজিয়া গ্রামে রাসসুন্দরী দাসীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা পদ্মলোচন রায়। মেয়ের যখন মাত্র ৪ বছর বয়স, তিনি মারা যান।এত ছোট বয়সে বাবার মৃত্যুর কারণে বাবার সঙ্গে তাঁর কোনও বন্ধনই গড়ে ওঠেনি। মা এবং একান্নবর্তী পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গেই বড় হয়েছেন তিনি।
প্রথাগত কোনও শিক্ষায় শিক্ষিত হননি রাসসুন্দরী দেবী। তৎকালীন সমাজে নারীর শিক্ষিত হওয়াটাই ছিল অপরাধের। মেয়েদের পাঠগ্রহণ বা পাঠশালায় বসতে দেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হত না। কিন্তু তবু তাঁর পরিবারের মানুষের উদারতার কারণে মাত্র আট বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় তাঁর প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়। সেইকালে ওই বয়সে অন্যান্য মেয়েরা যখন রান্নাবাটি, পুতুলখেলায় মেতে থাকত, সেই সময় তাঁর অভিভাবকেরা রাসসুন্দরীকে পাঠশালায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে এক বিদেশি শিক্ষিকার পাশে বসে বাড়ির অন্য ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন রাসসুন্দরী। ছেলেদের পড়া শুনে শুনেই বাংলা বর্ণমালা শিখে ফেলেন তিনি। এমনকী শুনে শুনেই অল্প-স্বল্প পার্সি ভাষাও রপ্ত করে ফেলেন। হঠাৎ একদিন বাহির-বাড়িতে আগুন লেগে সব ছারখার হয়ে যায়, পুড়ে যায় রাসসুন্দরীর স্বপ্নের পাঠশালাটিও। আগুন লাগার ভয়ে নদীর তীর পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকেই তাঁর পড়াশোনার ইতি।
বারো বছর বয়সে খিড়কিঘাটে আসা মহিলাদের থেকে জানতে পারেন যে, তাঁর পরিবারের লোকেরা তাঁর বিয়ের আয়োজন করছেন। তৎকালীন বাংলায় মেয়েকে বিয়ের কথা জানানোর রীতি প্রচলিত ছিল না। ন’বছর বয়সে গৌরীদান আর তেরো বছর বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়ার রীতি এবং অভ্যাসই সমাজে প্রচলিত ছিল। বারো বছর বয়সেই রাসসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয়। ফরিদপুর জেলার রামদিয়া গ্রামের সীতানাথ সরকারের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়িতে এসে মা-হারা রাসসুন্দরী শাশুড়ি মাকেই নিজের মায়ের স্থান দেন এবং তাঁকেই নতুন মা হিসেবে মান্যতা দেন। শ্বশুরবাড়িতে আটজন দাসী থাকার কারণে সেভাবে প্রথম দু’বছর কোনও কাজই করতে হয়নি রাসসুন্দরীকে। মাটি দিয়ে বিড়াল, সাপ, কুকুর, শিয়াল ইত্যাদি বানিয়ে মজা করতে করতেই দিন অতিবাহিত করতেন তিনি। তখনকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বাধ্য হয়েই বুক অবধি ঘোমটা টেনে সব কাজ করতে হত তাঁকে। বাইরের লোক তো বটেই, এমনকী নিজের স্বামীর সামনেও ঘোমটা সরানো অপরাধ ছিল। কিন্তু বিয়ের প্রথম দু’বছর পরেই তাঁর শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর তখন থেকেই গৃহদেবতার সেবা, ভোগ রান্না, অতিথি সৎকার, রান্না ইত্যাদি সব কাজই তাঁকে একা হাতে করতে হত। মাত্র চোদ্দো বছর বয়স থেকেই তাঁকে প্রায় প্রতিদিনই অনেক রাত অবধি কাজ করতে হত। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, এই বিবাহ নামক বিষয়টিকে তাঁর একটি খাঁচা বলেই মনে হত। বাল্যকালের স্বাধীনতার জীবন শেষ করে পালকি আর নৌকায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। আঠারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তেতাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত রাসসুন্দরী দেবী মোট বারোটি সন্তানের জন্ম দেন। তার মধ্যে ৭ জন জন্মের কিছু দিনের মধ্যেই মারা যায়। এতগুলো সন্তান হওয়ায় এবং তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কারণে অসংখ্য মৃত্যু তাঁকে চোখের সামনে দেখতে হয়েছে। তাঁর সাতটি সন্তানের মৃত্যু হয় চোখের সামনেই। হারিয়েছেন নাতি-নাতনিদেরও। এই সব প্রিয়জনদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা কতখানি দুঃসহ শোকের তা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনিতে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর স্বামীকে হারান ১৮৬৮ সালে। এই বছরেই তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়।
______________________________________________
রাসসুন্দরীর শ্বশুরবাড়িতে অর্থাৎ রামদিয়া গ্রামে বিখ্যাত সমাজসংস্কারক আনন্দমোহন বসু আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন একবার। বাড়িতে মদনগোপালের মূর্তি স্থাপিত ছিল, নিত্যদিন তাঁর পূজায় নিমগ্ন থাকতেন রাসসুন্দরী। তাঁর জীবনের সমস্ত কথাই জানা যায় তাঁর আত্মজীবনী থেকে। ‘আমার জীবন’ নামে সেই আত্মজীবনী দু’টি খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন রাসসুন্দরী দেবী নিজেই।
______________________________________________
কেমন ছিল সে আত্মজীবনী? সে প্রসঙ্গে পরবর্তিকালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটির ‘ঘটনাবলীর বিস্ময়কর ধারাবাহিকতা’ এবং অভিব্যক্তির ‘সহজ মাধুর্য্য’র প্রশংসা করেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, তাঁর গদ্য একটি ‘অতীত যুগের সহজ গদ্য রচনার সংক্ষিপ্তসার’। তাঁর লেখা ’আমার জীবন’ বইটি হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। তাঁর ছেলে ও মেয়েদের নাম যথাক্রমে বিপিনবিহারী, পুলিনবিহারী, রামসুন্দরী, প্যারীলাল, রাধানাথ, দ্বারকানাথ, চন্দ্রনাথ, কিশোরীলাল, প্রতাপচন্দ্ৰ শ্যামসুন্দরী এবং মুকুন্দলাল। তাঁর ছেলে কিশোরীলাল সরকার কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতনামা আইনজীবী ছিলেন এবং বেশ ক’য়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়েরও লেখক ছিলেন তিনি। এর আগে তেইশ বছর বয়সে তাঁর একটি পুত্রসন্তান হলেও গর্ভাবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। সন্তানাদির দেখাশোনার পাশাপাশি সর্বক্ষণ তাঁর মনের মধ্যে বই পড়ার এক অদম্য বাসনা উছলে উঠত। লেখাপড়া শেখার জন্য রাসসুন্দরীর যে আগ্রহ, যে প্রবল ইচ্ছা, তা সেকালে নারীদের মধ্যে খুব একটা দেখা যেত না। কিন্তু সাংসারিক দায়-দায়িত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও পড়তেন একের পর এক বই। সারাদিনের কাজের শেষে তাঁর স্বামীর কাছে এসে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন রাসসুন্দরী। বেশিরভাগ দিনই অনেক রাতে কাছারিবাড়ি থেকে কাজ সেরে ফিরতেন তাঁর স্বামী। আর রাসসুন্দরী তাঁর অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষে আর খেতেনই না। কিন্তু সংসারের কেউই সে খবর রাখতেন না। রামদিয়া গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে তাঁর স্বামীর ‘জয়হরি’ নামে একটি ঘোড়া ছিল। বাড়ির চাকরেরা রাসসুন্দরীর বড় ছেলেকে সেই ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে ঘুরিয়ে বেড়াতেন। কিন্তু লজ্জাশীলা রাসসুন্দরী বাইরের উঠোনে সেই ঘোড়ার সামনে যেতে লজ্জা পেতেন। এমনকী সেই জয়হরি নামের ঘোড়া বাইরের উঠোনে ছড়িয়ে রাখা ধান খেতে দেখলেও তাকে বিরত করতে যেতে সংকোচবোধ করতেন তিনি। তাঁর মনে সব সময়ই একটা ভয় কাজ করত, স্বামীর প্রিয় ঘোড়াকে তিনি কীভাবে বিরত করতে পারেন!
বিয়ের পরে তাঁর মনে হয়েছিল, বিদ্যাহীন জীবন আসলে পশুর মতো। আর তাই বই পড়ার আগ্রহে বাড়িতে থাকা চৈতন্যভাগবতের পুঁথি সংগ্রহ করেন তিনি, তাও নিজে সেটি সংগ্রহ করার বদলে ভয়ে ভয়ে বড় ছেলে বিপিনবিহারীকে দিয়ে সেই পুঁথি নিয়ে আসেন তিনি। সেই চৈতন্যভাগবতের একটি পাতা খুলে রান্নাঘরের এককোণে লুকিয়ে রাখেন আর একই সঙ্গে সেখানে লুকিয়ে রাখেন বড় ছেলের লেখা তালপাতা। সংসারের কাজ সেরে অবসর পেলেই সেই চৈতন্যভাগবতের পুঁথি নিয়ে বসে পড়তেন তিনি। শ্বশুরবাড়িতে তাঁর তিন ননদ রাসসুন্দরীর পড়ার আগ্রহের কথা জেনে বেশ সাহায্য করেছিলেন তাঁকে। ক্রমে পড়তে শিখলেন তিনি। কিন্তু লেখা শেখার জন্য যে কলম, দোয়াত, পাতার দরকার সেগুলো জোগাড় করার কোনও উপায় ছিল না তাঁর। শাশুড়ির মৃত্যুর পরে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব যেমন বেড়েছিল তাঁর, তেমনি সকলের কাছে তিনি বাড়ির কর্তা ঠাকুরানি হয়ে উঠেছিলেন। শুধুই চৈতন্যভাগবত নয়, ধীরে ধীরে আঠারো পর্বের চৈতন্যচরিতামৃত, জৈমিনিভারত, গোবিন্দলীলামৃত, বিদগ্ধমাধব, প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, বাল্মীকি-পুরাণ সমস্ত বইই পড়ে ফেললেন তিনি। কিন্তু বাড়িতে যে বাল্মীকি-পুরাণ ছিল তাতে শুধু আদিকাণ্ড ছিল, সাতটি কাণ্ড ছিল না। ফলে আদিকাণ্ড পডে তিনি এতটাই মোহিত হয়ে পড়েন যে, বাকিগুলো পড়ার জন্য তিনি প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠেন। তাঁর ছেলে দ্বারকানাথ কলেজ থেকে বাড়িতে এলে তিনি তাঁকে বাকি খণ্ডগুলো আনার কথা জানালেন। মায়ের আগ্রহ দেখে তাঁর ছেলে সেই বাল্মীকি-পুরাণ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।কিন্তু সে বইয়ের লেখার হরফ এত ছোট ছিল যে, রাসসুন্দরী বই হাতে পেয়েও তা পড়তে পারলেন না। তাঁর ছেলে কিশোরীলাল তাঁকে চিঠির উত্তর দেওয়া শেখাতে লেখার সব সরঞ্জাম কিনে অভ্যাস করতে বলেন। একদিন সীতানাথ সরকার অর্থাৎ রাসসুন্দরীর স্বামীর টাইফয়েট জ্বর হলে রাসসুন্দরী তাঁকে ছেলে দ্বারকানাথের কাছে কাঁঠালপোতায় নিয়ে যান। কাঁঠালপোতায় থাকাকালীনই কিছু অক্ষর নিজে হাতে লেখা শেখেন রাসসুন্দরী দেবী। ১৮৬৮ সালে মাঘী শিবচতুর্দশীর দিন রাসসুন্দরী দেবীর স্বামী সীতানাথ সরকারের মৃত্যু হলে বৈধব্য যন্ত্রণা গ্রাস করে তাঁকে। ইতিমধ্যে তাঁর তিন ছেলে ও ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
শোনা যায়, রাসসুন্দরীর শ্বশুরবাড়িতে অর্থাৎ রামদিয়া গ্রামে বিখ্যাত সমাজসংস্কারক আনন্দমোহন বসু আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন একবার। বাড়িতে মদনগোপালের মূর্তি স্থাপিত ছিল, নিত্যদিন তাঁর পূজায় নিমগ্ন থাকতেন রাসসুন্দরী। তাঁর জীবনের সমস্ত কথাই জানা যায় তাঁর আত্মজীবনী থেকে। ‘আমার জীবন’ নামে সেই আত্মজীবনী দু’টি খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন রাসসুন্দরী দেবী নিজেই। ঠাকুর পরিবারের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সাহিত্য- সমালোচক দীনেশচন্দ্র সেন রাসসুন্দরীর আত্মজীবনীর প্রস্তাবনা রচনা করেছিলেন। রাসসুন্দরীই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীকার। তাঁর ‘আমার জীবন’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে মোট ষোলোটি অধ্যায় আছে যেগুলির প্রতিটির শুরুতে একটি করে কবিতা রচনা করেছেন রাসসুন্দরী দেবী। ওই বইতেই তিনি জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে বারবারই পরমেশ্বর, দীননাথ প্রমুখের কথা বলেছেন যা তাঁর আধ্যাত্মিক মনের পরিচয় দেয়। পরবর্তিকালে তাঁর নাতনি সরলাবালা সরকার ‘আমার ঠাকুরমা’ নামে একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছিলেন রাসসুন্দরী দেবীকে কেন্দ্র করে। সেই লেখা থেকেও তাঁর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারা যায়। যদিও ১৮৯৯ সালে রাসসুন্দরী দেবীর মৃত্যুর পরে স্বনামধন্য থেকে উঠতি অজস্র কবি-লেখকরা তাঁদের আত্মজীবনী লিখেছেন, কিন্তু সেগুলির মধ্যে ছিল মূলত তাঁদের বাল্য স্মৃতি। রাসসুন্দরী দেবীর মতো পূর্ণাঙ্গ জীবনী কেউ লেখেননি। তার থেকেও বড় কথা, উনিশ শতকের আগে বাংলা ভাষায় কোনও আত্মজীবনীই লেখা হয়নি।
আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে বাল্যস্মৃতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এমন কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক এবং তাঁদের জীবনীগ্রন্থের নাম হল- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়র ’বাল্যস্মৃতি’, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরর ’আমার বাল্যকথা’, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এর ’বাল্যজীবন’, মন্মথনাথ মজুমদার এর ’আদর্শ ছাত্রজীবন’। এ ছাড়া অনেক পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনীতেও মূলত বাল্যস্মৃতিই ধরা পড়েছে। 🦋
🍁কবিতা
আতিকা হাসান
চন্দ্রগ্রাস
যেদিন বললে ফিরে যাচ্ছ প্রতিবিম্বে
সেদিনই খুন হয়েছিল অবিশ্বাসী
রাতের অন্ধকার!
চরমপন্থী চরণ জাবর কাটছিল
ঢেকুর ওঠা হজমের তর্জমায়!
নিমিষে কীর্তন খোলায় নিলামে ওঠে
জটিল বিয়োগের নামতা।
গড়ের মাঠে-
নান্দনিক আসন বিন্যাস
ক্যাপাচিনো কফির মগে চুমুকে চুমুকে উষ্ণতা!
মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রায়-
খোলা শার্টের বোতামে, সৌখিন শাড়ির ভাঁজে
বিমুগ্ধ সন্মোহন ঘোর!
পাশার দানে বারবার ঘুঁটি বদলায়
চতুর খেলোয়াড়
মনজুড়ে জন্ম নেয় নয়াপ্ৰেম।
সেকেলে রোমিও হঠাৎ খুঁজে পায়
জড়িবুটি দাওয়াই,
পুনঃযৌবন হাতড়ে বেড়ায়
অধুনা রাধিকার নরম ছোঁয়া।
তুমি উত্তম…
তাই বলে আমি অধম তো নই!
মোঃ সেলিম মিয়া
পুরুষ মানে?
পুরুষ মানে সকল ত্যাগে বিসর্জনে সুখ,
পুরুষ মানে কষ্ট হজম হাসি মাখা মুখ।
পুরুষ মানে ক্লান্ত দেহ ক্লান্তির নাহি শেষ,
পুরুষ মানে বাঁচার সাহস নেই আকুতির রেশ।
পুরুষ মানে শাসন কর্তা নিরব শোষিত স্বামী,
পুরুষ মানে আত্মসম্মান সংসার গোলামী।
পুরুষ মানে সংসার সুখে কঠিন সংগ্রাম,
পুরুষ মানে চক্ষু জল শুকিয়ে যাবার ম্লান।
পুরুষ মানে ভাগ্যের চাকা ঘুরাবে অবিরাম,
পুরুষ মানে সাদা রক্ত চোখের পরিত্রাণ।
পুরুষ মানে গাঁধার পিঠে মস্ত বড় বোঝা,
পুরুষ মানে কথার হজম চাঁপা দিয়ে পূজা।
পুরুষ মানে সকল আবদার পূরণ করার স্বাদ,
পুরুষ মানে সকল চিন্তা সমাধানের তাজ!
পুরুষ মানে কথার ঝুড়ি কানে বধির শব্দ,
পুরুষ মানে কথার হজম নিজের মুখ জব্দ।
পুরুষ মানে বট বৃক্ষ তপ্ত রোদের ছায়া,
পুরুষ মানে জন্ম পিতা বৃষ্টি রক্ষার ছাতা।
পুরুষ মানে অঙ্গ পুড়ে তিলে তিলে ছাই,
পুরুষ মানে সব বিলিয়েও প্রশ্নবোধক তাই?

চৈতালী দে
এই পথ যদি না শেষ হয়
পথ বোধহয় কথা বলে
আমিও বলি
বিভোর হই একে অন্যের সঙ্গে
পথ বলে,
আমার চেয়ে একা যে আর কেউ নয়
তুমি কি হবে আমার সঙ্গী?
আচ্ছা বলো তো –
পথের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায় !!
সেদিন আমি হারিয়ে গেলাম এই পথের সাথে
সে আমায় নিয়ে গেল এক অদ্ভুত জায়গায়
সেখানকার সব পথঘাট তার চেনা
নিজের মতো করে তার সাথে ঘুরে বেড়ালাম …
গেলাম পাহাড়ি পথ ধরে
উঁচু–নিচু
কখনো পাইনগাছের সারি
কোথাও ওক
কোথাও আমার প্রিয় চিনার
সেদিন ঝলমলে রোদ উঠেছিল
নীলের চেয়েও দুরন্ত রাঙা আকাশ
একটা বিশাল পাহাড়ি এলাকায় সম্পূর্ণ একা
আমারা দুজন
যেন এর চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই –
হটাৎ করেই পথ হয়ে গেল পঙ্খীরাজ
উড়িয়ে নিয়ে গেল আকাশে
নিচে পড়ে রইল নদী
লুটিয়ে থাকা পাথর
হু হু বাতাসের উল্লাস
পাইনের মাতলামি
দূরের পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা বরফ
ঝরে যেতে চাওয়া রোদ !!
সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলাম ফ্লাস্ক ভর্তি কফি – কুকিস
আর পথে পেয়েছিলাম কিছু ফল
সেগুলো দিয়ে আমরা ____
বেশ একটা ডে আউট করে ফেললাম
ছোটখাটো পিকনিক ও বলতে পারো …
তোমরা হয়তো ভাবছো আমি পাগল !!
যেখানে মানুষ ডে আউট করে অনেকে মিলে
আর আমি?
একলা
পথের ডাকে সাড়া দিয়ে …
সেদিন কোথাও ফেরার তাড়া ছিল না
অপেক্ষা করার মতনও কেউ নেই
পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীন একটা যাত্রা
সুখ বোধহয় ছিল হৃদয়ের মাঝে
তাই তাকে খোঁজার আর বৃথা চেষ্টা করিনি …
আর সঙ্গে ছিল আমার সেদিনের প্রেমিক –
“ছোট বড় নানা আকারের পথ “
দীপ্তি চক্রবর্তী
বসন্ত বন্ধু
তুমি বললে লেখা হবো
ঝরবো তোমার কলম জুড়ে
নখের কোণে ঘুমিয়ে যখন
কাটবে বেলা বসন্ত দিনে,
সময়ের আবার অবসর কি
বন্ধু যখন ডাকে
হোকনা ব্যস্ত সময় তখন
নিজের মতো কাজের ফাঁকে,
কাটবে ঘুড়ি সুতোর টানে
রইলো লাটাই হাতে
সুতোয় ভরে মাঞ্জা বানায়
বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে থাকে,
গোপন চিঠি
উড়িয়ে দেবো এলো খামে
চেনা সুতোয় গাঁথবো মালা
ঝলমলে এক বসন্ত বেলা
থাকবে শুরু দিনগুলো এক
সোনায় মোড়া রঙের দামে।
যতন কুমার দেবনাথ
কর্পোরেট ক্ষুধা
ভাঙা হাড় আবার ভাঙি ভুলিয়ে দেই
বাপের নাম
করব খুঁড়ে কঙ্কাল তুলে দাফন করি
জীবিত লাশ
গল্পচ্ছলে কান্না শিখছি
রান্নার আগুনে পুড়ছে কর্পোরেট ক্ষুধা
শুকনো রোদে পাহাড় ভেজে – মচমচে লাঞ্চ।
তাপস চক্রবর্তী
একুশ
একুশের সংখ্যা নির্বাচন> ফেব্রুয়ারী
কিম্বা আট ফাল্গুন।
↓↓
বললে, ভুলে যেও
খসড়া পত্রের কুশলাদি বিনিময়ে।
প্রভাত ফেরি হয়ে শিউলির দোলাচল
যেমন
পলাশ রাতের আঁধার।
আমিও আজকাল→যীশু হই
যীশুতে ক্রুশবিদ্ধ ক্রস চিহ্নটি মুছে যেতেই
বীজগণিত সূত্রে বললাম, কবিদের তৃতীয় চোখে
স্থির হও
↓
↓
শুন্যতার হাপিত্যেশ।
রুমানা আকতার
অপ্রেমের গল্প
আমাদের প্রেম সেই কবেই ফুরিয়ে গেছে
শুধু রয়েছে শুকনো কিছু ,
পাপড়ি আর তোমার হাতের স্পর্শ।
আমাদের দেখা হয়নি বহুবছর,
তবুও, থেকে গেছে তোমার রেখে যাওয়া পদচিহ্ন।
সেই বেঞ্চ , সেই ছাতিম তলা
আর কিছু স্মৃতি আর শব্দের রেশ।
আমাদের একসাথে হাঁটা হয়নি
বছর সাতেক…
তবুও, পুরোনো রাস্তা সেই ল্যাম্পোস্ট
আর হলদে নিয়ন আলোর রেখায়
ভেসে ওঠে আবছা কিছু অংশ।
তারপর —
একটা দীর্ঘশ্বাস সবটা গিলে নেই
অবিচারে , নির্দিধায়..!
আমাদের অজানাই যে প্রেম হয়েছিল
সেই প্রেম কবেই দিক পেয়েছে,
অন্য হাতের ছোঁয়ায় ,
অন্য কন্ঠের জাদুতে
আর ,
আমাদের প্রেম থেকে গেল ধূলো জমা ডায়েরীর
ভাঁজে থাকা পাপড়ির ধূসর রঙে….
🍁গল্প
ঝুমকি বসু
সূর্যমুখী জীবন
উল্টানো কাঁসার থালার মতো সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে ধনুক আকৃতির কর্ণফুলীর অতল জলে, আকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে সারাদিন আলো বিলিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া সূর্যের ম্রিয়মান রক্তিম আভা, টলটলে জলে সেই প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে ষোড়ষী পুষ্পকুন্তলা তার নিয়মিত ভাবনার জট খুলতে থাকে, প্রতিদিনের মতো আজও এই সূর্যডোবা ক্ষণে তার মনে শুধু একটি ভাবনাই দোল খায়। আরাকানের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী রাজকুমারী প্রেমে পড়েছিল চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের। কোনও এক চাঁদনী রাতে জোছনা গায়ে মেখে তারা বের হয় নৌবিহারে। শুক্লপক্ষের চাঁদকে স্বাক্ষী রেখে রাজপুত্র একটি নাম না জানা ফুল কানে গুঁজে দেয় রাজকন্যার। গুনগুন করে গানের সুর তোলে রাজকুমারী, ভালবাসার পালে হাওয়া লেগে নৌকা এগিয়ে যেতে থাকে। ভরা পূর্ণিমার রাতে নদীতে ছায়া পড়ে প্রেমের। আবেগে ভাসতে থাকা অসতর্ক রাজকুমারীর কান থেকে ফুলটি খুলে নীরবে পড়ে যায় নদীর জলে। ছলাৎ ছলাৎ নাও বাওয়ার শব্দ ছাপিয়ে শোনা যায় ফুপিয়ে ওঠা রাজকন্যার কান্না, এ যে তার প্রেমিকের দেওয়া উপহার! রাজপুত্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ফুলটি তোলার চেষ্টা করে রাজকন্যা এবং প্রবল স্রোতের তোড়ে ভেসে যায় অজানায়। প্রেমিকের চোখে তখন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, প্রাণপ্রিয় প্রেমিকাকে উদ্ধারের জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজপুত্র। আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নদীর জলে দেয় আত্মাহুতি।
______________________________________________
পুষ্প, আমি একজন বিপ্লবী। বিপ্লবীকে হতে হয় সন্ন্যাসীর মতো। তার জীবনে ক্রোধ, লোভ এবং কাম থাকলে চলে না। বিপ্লব চালাতে হলে আমাকে ধরে রাখতে হবে কৌমার্য। এখন শুধু আমার ধ্যান জ্ঞান ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। পুষ্প, দেশকে ভালোবেসে একজন বিপ্লবীর স্ত্রী হিসেবে এ জীবন তোমাকে মেনে নিতে হবে।
_______________________________________________
সেই থেকে নাকি এই নদীর নাম কর্ণফুলী। প্রতিদিন সন্ধ্যে নামার আগে নদীর জলে পা ডুবিয়ে এই একটি ভাবনা নিয়ে খেলা করে পুষ্পকুন্তলা, পক্ষে—বিপক্ষে যুক্তি সাজায়, ভালবাসার আবেগ তাকেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ায়, এমন একজন ভালবাসার মানুষকে নিজের জীবনেও ক্রমাগত হাতড়ে বেড়ায়।
সূর্যডোবা দেখতে হবে না আর, জলজ্যান্ত সূর্য এসে গেছে তোর জীবনে।
সই সুনিতার উচ্চারণে ভাবনায় ছেদ পড়ে পুষ্পের।
সূর্য! কি যে আবোল তাবোল বকছিস!
নোয়াপাড়ার সূর্যসেনের জ্যাঠাতুতো দাদা চন্দ্রনাথ সেন তোর সঙ্গে তার ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, পাত্র বিএ পাস, পেশা শিক্ষকতা, সবাই তাকে ‘মাস্টারদা’ নামেই চেনে। ছোটবেলায় বাবা—মাকে হারিয়ে কাকার কাছে মানুষ। এই দাদাই এখন তার অবিভাবক।
বাব্বা, পাত্র এবং তার নাড়ি—নক্ষত্রের খোঁজ নেওয়া শেষ, মনে হচ্ছে আনন্দটা তোরই বেশি হচ্ছে সই?
হবেই তো, প্রতিদিন এক অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে তুই চেয়ে থাকিস, এখন গনগনে জ্বলন্ত সূর্য আসছে তোর জীবনে, এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! কিন্তু সই, একটা ব্যাপার বুঝলাম না, তোর সূর্যের ডাকনাম নাকি কালু! যে সূর্যের আলোয় চোখ পুড়ে যায়, তার নামের সঙ্গে অন্ধকার জড়িয়ে দিল কে!
এটা নিয়ে তুই গভীর ভাবনায় ডুব দে।
সত্যি বলছি, বিয়ের আসরে সূর্যদেবকে এই প্রশ্নটি আমি করবোই।
পুষ্পের এলোমেলো চুলে আলতো খোপা বেঁধে দেয় সুনিতা, হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
চন্দ্রনাথ সেনের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে নগেন্দ্রনাথ দত্ত শুরু করেছেন মেয়ের বিয়ের আয়োজন। পুষ্পের মনে শুধু উৎকণ্ঠা পাক খায় তার স্বামীটিও কী সেই রাজপুত্রের মতো ভালোবেসে আগলে রাখবে তাকে? স্বামীর ভালোবাসার পারদের ওঠানামা টের পাওয়ার আগেই নিজের বুকের বাম পাশে ভালবাসার আসনটি তার জন্য পাকাপোক্ত হয়ে যায়। ছাদনাতলায় কী এক অদৃশ্য কারণে লজ্জানত পুষ্পকুন্তলার বুক দুরুদুরু কেঁপে ওঠে বারবার, অগ্নিদেবতাকে সাক্ষী রেখে সূর্যসেন উচ্চারণ করে ‘যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব’।
বিপ্লবী স্বামীর ঘরের কোণায় কোণায় বই, মাঝখানে চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেগুন কাঠের তক্তপোষে করা হয়েছে ফুলশয্যার আয়োজন। নববধূ স্বামীর ঘরে ঢোকার অপেক্ষায় প্রহর গুনেই চলেছে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেড়ে গেছে ফুল এবং বইয়ের অন্তদ্বন্দ্ব। সূর্যের গোলাকার মুখে পড়েছে গ্রহণের ছায়া। বড়দার অনুরোধ এবং আত্মীয়—স্বজনের চাপে নিজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে করতে হয়েছে নিয়মরক্ষার এই বিয়ে। থমথমে মুখে ঘরের বাইরে অনবরত পায়চারি করেই চলেছে সে।
মেজোমশায়, ঘরে যাও, পুষ্প তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
বউদির এ কথায় সূর্যের অস্থিরতা আরও বাড়ে।
বউদি, আমি কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে আমার মৃত্যু অনিবার্য।
এসব তুমি কি বলছো! এ কথা আমি তাকে বলতে পারবো না, তুমি নিজ মুখে যা বলার বলো।
অগত্যা ঘরের দিকে পা বাড়ায় সূর্য।
আমি জানি, তুমি অনেক আশা নিয়ে এ ঘরে পা দিয়েছো। কিন্তু বিয়েতে আমার একেবারেই মত ছিল না। দাদা এবং আত্মীয়—স্বজনের চাপে আমি বাধ্য হয়েছি। পুষ্প, আমি একজন বিপ্লবী। বিপ্লবীকে হতে হয় সন্ন্যাসীর মতো। তার জীবনে ক্রোধ, লোভ এবং কাম থাকলে চলে না। বিপ্লব চালাতে হলে আমাকে ধরে রাখতে হবে কৌমার্য। এখন শুধু আমার ধ্যান জ্ঞান ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। পুষ্প, দেশকে ভালোবেসে একজন বিপ্লবীর স্ত্রী হিসেবে এ জীবন তোমাকে মেনে নিতে হবে।
পুষ্পকুন্তলা ঘোমটায় আড়াল করে চোখের জল। স্বামীর কথায় তার বুকের বা দিকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। কিন্তু সেই চোখের জল অথবা বুকের ব্যথা অনুভবে আসে না সূর্যের। পথভ্রষ্ট হয় না বিপ্লবী সূর্যসেন। বিবাহিত জীবন তাকে আদর্শচ্যূত করবে এই ভয়ে ফুলশয্যার রাতেই গ্রাম ছেড়ে শহরে পা বাড়ায় সূর্য।
ফাঁকা ঘরে একলা দিন অথবা রাত্রিযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করে পুষ্প। কোনো এক শীতের সকালে স্বামীর ডাকে ঘুম ভাঙবে তার, আদরমাখা গলায় সে বলবে, ‘এক কাপ চা করো তো পুষ্প’ অথবা বসন্তের বিকেলে এক থোকা জারুল ফুল এনে গলা জড়িয়ে ধরবে ‘আমি জানি বেগুনি রঙ তোমার খুব পছন্দের পুষ্পের মনে স্থির বিশ্বাস জন্মায়, একদিন সূর্য ফিরবেই। একটি নিষ্পাপ শিশুর জন্য বুকভরা মায়া সঞ্চয় করে রেখেছিল সে, চন্দ্রনাথ সেনের সন্তান টোনাকে সেই মায়াময় বুক দিয়ে আগলে রাখে পুষ্প। টোনাকে আদর—আহ্লাদ করে সারাদিন, নিজের ভাবনায় জমে থাকা কর্ণফুলীর গল্প শুনিয়ে তাকে ঘুম পাড়ায়।
দিদি, আমি কি তোমার মেজোমশায়ের কাজে কোনও সাহায্যই করতে পারতাম না?
পুষ্পের এমন প্রশ্নে সূর্যের বউদির চোখে এক ফোটা জল এসে পড়ে, সেই জল আচলের ভাঁজে লুকাতে গিয়ে গরম সর্ষের তেলে দেওয়া শুকনো মরিচ এবং পাঁচফোড়ন পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। ধেঁায়া এবং ঝাজে ভরা রান্নাঘর থেকে কাশতে কাশতে মিনমিন করে বলে :
দেখলি পুষ্প, কি কাজটাই না করলাম! ঝাঁজে চোখে জল এসে যাচ্ছে। আচ্ছা, তুই সূর্যকে চিঠি লিখিস না কেন? চিঠি পেলে ভালবাসা জন্মাবে, দেখবি একদিন ছুটে চলে আসবে।
একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে মাথার ভেতর প্রতি রাতে যে অস্থিরতা হয় এই রাতে আর তা টের পায় না পুষ্প। টিমটিমে লন্ঠনের আলোয় পুষ্পকুন্তলা স্বামীকে চিঠি লিখতে বসে।
“আমি দেশের জন্য কাজ করতে চাই। স্ত্রী কি ছাত্রী হতে পারবে না? কেন স্ত্রীর ওপর ভরসা রাখতে পারবেন না তাঁর বিপ্লবী স্বামী?”
মা এবং সহোদরা ব্যতীত অন্য কোনো নারীর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না কোন বিপ্লবী, সূর্যসেনের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে দলের প্রতিটি বিপ্লবী সদস্য। ঠিক এই কারণেই দলে কোনো নারীকে রাখার সম্মতিও মেলে না, যেকোনো দূর্বল মূহূর্ত একজন বিপ্লবীর সাধনা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। সূর্য স্ত্রীর চিঠির উত্তর দেয় না, তবে তার অনুধাবনে আসে পুষ্পকুন্তলার একলা একঘেয়ে সময় কাটতে চায় না। স্ত্রীর জন্য কিছু গল্প—উপন্যাসের বই পাঠিয়ে দেয় সূর্য।
স্বামীর পাঠানো বইগুলোর দিকে মাঝে মাঝেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পুষ্প। পড়তে শুরু করে। কিন্তু কেন জানি কিছুতেই মনটা শান্ত হয় না। বনের মধ্যে একটা হিজল গাছের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব জমে ওঠে, প্রতিদিন হিজলের ছায়ায় গিয়ে বসে ভাবে বিয়ের আসরে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা সূর্যের তেজদীপ্ত মুখ। কখনোবা বউ—কথা—কও পাখির সঙ্গে অকারণ গলা মেলায়, আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ তাকে নেশাতুর করে দেয়।
ভাসুর চন্দ্রনাথ সেন এবং তার স্ত্রী অনুতপ্ত হয়, সূর্যের জীবনে মেয়েটাকে জড়িয়ে তারা বোধ হয় মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে।
পুষ্প, তুই যে এমন বনে বাদাড়ে ঘুরিস, একদিন কিন্তু কঠিন অসুখে পড়বি।
পুষ্প হাসে। কোন পরাধীনতার শিকল আর তার পায়ে বেড়ি পরাতে পারে না। পুষ্প যখন স্বাধীনতার সবটুকু রস নিংড়ে নিংড়ে নিতে থাকে সূর্য তখন স্বাধীনতার খোঁজে গোটা ভারতে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চায়। গুয়াহাটি থেকে অসমে, সেখান থেকে লখনউ। লখনউ থেকে কলকাতা, এসে ওঠে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের গোপন আস্তানায়। ‘ভারতী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। গুপ্ত আস্তানায় হ্যারিকেনের আলোয় রাত জেগে চলে তার ‘পথের দাবী’ পড়া। ‘ভারতী’র জন্য সারা মাস অপেক্ষা করে থাকে সে। একদিন এই গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। পাঠিয়ে দেওয়া হয় আরব সাগরের তীর ঘেষা বোম্বাইয়ের রত্নগিরি জেলে। জেলে বসে এই উপন্যাস পড়তে না পারার আক্ষেপে জ্বলতে থাকে সূর্যের মন এবং মন পোড়ে পুষ্পের জন্য। দীর্ঘদিনের অদর্শন এবং জেলের একাকিত্ব সূর্যের মনে স্ত্রীর জন্য একটা প্রগাঢ় ভালোবাসার বোধ তৈরি করে। কিন্তু ব্যক্তিগত আবেগ প্রকাশ্যে আসতে দেয় না সে। তাহলে যে তার এতদিনের ধ্যান ভেঙে যাবে। স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় গুনতে থাকে দিন। অতঃপর পুষ্পের চিঠি আসে। তবে কাঁপা কাঁপা হরফে লেখা এই চিঠি সূর্যের বুকের কাঁপন আরো বাড়ায়।
‘তোমার দেওয়া দেবী চৌধুরাণী বইটা কাল রাতে শেষ করেছি। আমি যখন থাকব না, তখন টোনার দিকে একটু লক্ষ রেখো’।
সূর্যের বউদির ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়, নিজের প্রতি চরম অবহেলা এবং অযত্নে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় পুষ্প।
স্ত্রীর অসুস্থতার খবর পছে যায় রত্নগিরি জেলে, সূর্যসেনের মন পুষ্পকুন্তলাকে একনজর দেখার জন্য ছটফট শুরু করে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে স্ত্রীকে দেখতে যাওয়ার জন্য বারবার অনুমতি প্রার্থনা করে। অবশেষে সেই আবেদন মঞ্জুর হয়। জেল থেকে এক মাসের জন্য ছাড়া পায় সূর্য, কিন্তু রাখা হল নজরবন্দি। পুলিশ পাহারায় নিয়ে আসা হলো চট্টগ্রাম।
পুষ্প তাকিয়ে দেখো, আমি এসেছি।
সূর্যসেনের গলার আওয়াজে চোখ মেলে তাকায় পুষ্পকুন্তলা, তার ঠোঁটে খেলে যায় মৃদু হাসির রেখা।
যে মুখ একটিবার দেখার জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেছে পুষ্প, সেই মুখে চেয়ে পলক পড়ে না চোখের। এমন গনগনে জ্বলন্ত সূর্যের দিকে পুষ্পের মতো করে আর কেউ তাকাতে পারে না। এ যে তার একান্ত নিজস্ব এক নক্ষত্র! পুষ্পকুন্তলার দুটি চোখ জলভরা দিঘির মতো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। তবু এই জল উছলে গড়িয়ে পড়ে না। মৃত মানুষের চোখের জল যে গাল বেয়ে নামতে পারে না।
[বিপ্লবী সূর্যসেন এবং তার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলার ছায়া অবলম্বনে ] 🦋
🍁গল্প
রেহানা বীথি
অবশেষে দরজাটা খোলেনি
বাড়িতে কেউ আছেন?
প্রশ্নটা বিগলিত জ্যোৎস্নায় কেঁপে কেঁপে হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল অনিকেত। খানিক আগে হওয়া বৃষ্টির ক’য়েকটি ফোঁটা একসঙ্গে ঝরে পড়ল ওর চশমার কাচে। মাথা উঠিয়ে দেখল, ভগ্ন দরজার পাশে একটি গাঢ় বকুল তলায় দাঁড়িয়ে আছে ও। নিচে তাকিয়ে দেখল ভেজা ঘাসের ওপর ঝরে আছে কিছু বকুল। কয়েকটা কুড়িয়ে গন্ধ শুঁকল।
কিন্তু… বাড়িতে কেউ নেই নাকি? কোনও সাড়া নেই!
আবারও ডাকল ও। নাহ্, সাড়া নেই। কেমন এক অসাড় নিস্তব্ধতা চারপাশে। থমথমে। অথচ বাড়িতে কেউ আছে জেনেই এসেছে অনিকেত। এবার কড়া নাড়ল। দরজাটা যেন প্রতিবাদ করে উঠল। ওটার ক্ষতে ভরা শরীরে কড়া নাড়ার শব্দ এক অদ্ভুত বেদনা তৈরি করল। যেন বেদনার ভারে খুলে পড়বে। অনিকেত ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এই ঝিম ধরা রাতে, এই বৃষ্টিপ্রকৃতিতে কি ওকে বাইরেই কাটাতে হবে বাকি রাতটুকু? শীত শীত ভাব এসে জেঁকে ধরল হঠাৎ।
ভয়?
অনিকেতের মতো যুবকের মনে ভয়?
কিন্তু দরজা না খুললে তো এই অচেনা গাঁয়ের, এই অপরিচিত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে। যাওয়ার তো বিকল্প কোনো জায়গা নেই। তাছাড়া ও-ভীষণ ক্লান্তও। কতটা পথ হেঁটে এসেছে!
______________________________________________
বকুলের গন্ধ যেন ধীরে, গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলছে অনিকেতকে। এই বাড়িটি এবং এর ভগ্নদশাও কেমন এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে ওকে। এভাবে এসে কি ভুল করে ফেলেছে?
______________________________________________
জ্যোৎস্না মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু অস্থির মেঘ চাঁদের আলোটুকু ঢেকে দিয়ে নিকষ করে ফেলছে অনিকেতের চারপাশ। মাথার উপরের লাইটপোস্টের বাতি কি নষ্ট? খানিকটা দূরে জ্বলছে, তবে এত ক্ষীণ! কেমন এক অদ্ভুত অস্বস্তি জড়িয়ে ধরল ওকে। তবে আবারও জ্যোৎস্না ফুটল। বকুলের ভেজা পাতাগুলো সেই জ্যোৎস্না মেখে চিকচিক করে উঠল। হঠাৎ করে একটা কুকুর পাশ কাটাল ওর। একটা পা বোধহয় কোনো কারণে আহত হয়েছে প্রাণীটির। লেংচে লেংচে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়াল একটু। দাঁড়িয়ে ঝাড়া দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল সবটুকু জল। তারপর টিমটিম করে জ্বলতে থাকা লাইটপোস্টের নিচে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তবে আহত পা-টিকে কায়দা করে উঠিয়ে রাখল। মুখটা সেই পায়ের দিকে এমনভাবে বাড়িয়ে রেখেছে, দেখে মনে হল ক্ষত জায়গায় ফুঁ দিচ্ছে। দিতেও পারে। অবলা বলে কি ওদের ফুঁ দিতে নেই?
আবারও কড়া নাড়ল অনিকেত। মনে মনে ভাবল, এই শেষবার। এরপর এখানে আর দাঁড়াবে না। কিন্তু তবুও দাঁড়িয়েই রইল। কান পাতল। ভেতরে কারও কাশির শব্দ মনে হচ্ছে! মন চঞ্চল হয়ে উঠল ওর। নিশ্চয়ই এবার দরজা খুলবে কেউ।
ভগ্নদশার ভেতরে আলো জ্বলে উঠল। বড় ক্ষীণ সে আলো। তবুও স্বস্তি, বাড়ির ভেতর একটু আলো তো জ্বলল! একটু মৃদু খসখস আওয়াজও যেন ভেসে এল ভেতর থেকে। কিন্তু তারপর আবারও নিস্তব্ধতা। মিনিটের পর মিনিট কেটে যেতে লাগল। অনিকেত অস্থির হয়ে জোরে বলে উঠল, দয়া করে দরজাটা একটু খুলবেন? আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। দয়া করে দরজাটা একটু খুলুন।
কেটে গেল আরও কয়েকটি নিস্তব্ধ মিনিট। তারপর মনে হল খসখস শব্দ নিকটবর্তী। কিন্তু না। কেউ এল না। আবার নিস্তব্ধ সব।
কুকুরটিও কখন যেন আহত পা ওভাবে তুলে রেখেই ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘুম জড়ানো ভেজা ভেজা পথ, পথের দু’পাশে বৃক্ষের আড়াল। পথ ধরে যতদূর চোখ যায় শুধু নীরবতা, কেউ কোথাও নেই। গাঁয়ের মানুষ কি সন্ধ্যা পেরোলেই ঘুমিয়ে যায়? এখনও? বকুলের গন্ধ যেন ধীরে, গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলছে অনিকেতকে। এই বাড়িটি এবং এর ভগ্নদশাও কেমন এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে ওকে। এভাবে এসে কি ভুল করে ফেলেছে?
এই তুই ক্যাডা? অন্ধকারে এই বাড়ির সামনে কি করোস?
চমকে তাকায় অনিকেত। তিনজন সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলে। পরনে জিন্স-টিশার্ট, মুখে ফিচেল হাসি। আধো অন্ধকারেও ওদের চেহারার তীব্র কুটিল ভাব ঢাকা পড়ে না। ওরা কি নেশা করেছে? কেমন যেন লাগছে!
না, আমি একটা দরকারে এখানে এসেছি। অনেক দূর থেকে এসেছি। কিন্তু ডাকে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। তোমরা কি একটু সাহায্য করতে পারবে?
অনিকেত মোটেও ভীতু নয়, তবুও কেন যেন এই মুহূর্তে ভয়ে ভয়ে কথাগুলো বলল।
ছেলেগুলো হাসতে শুরু করল। হেসে কুটিকুটি হয়ে ওরা একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ল। তারপর বলল-
না, সাহায্য করবার পারি না। তুই দাঁড়ায়া থাক এইখানে। দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া…। অশ্লীল কিছু শব্দ জুড়ে দিয়ে ওরা চলে গেল। যাওয়ার সময় কুকুরটিকে অযথা কিছুক্ষণ বিরক্ত করল, তারপর মিলিয়ে গেল।
আবারও অপেক্ষা। বকুলের গন্ধে বিভোর হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকা।
বাড়ির ভেতরে যে বাতিটা জ্বলে উঠেছিল, সেটা নিভে গেছে। ঘুটঘুট করছে ভেতরটা। আবারও বৃষ্টি আসবে মনে হল। এখন বৃষ্টি এলে কী করবে অনিকেত? কোনও আড়াল তো পায়নি এখনও!
কুকুরটা জেগে উঠেছে। মায়াভরা চোখে অনিকেতের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে। হঠাৎ একটু শীতল হাওয়া খেলে গেল চারপাশে। কেউ একজন আসছে। যে পথটা দূরে আবছা হয়ে গেছে, ওই পথ পেছনে রেখে দৃশ্যমান হচ্ছে কেউ। দূরত্ব কমতেই রাবারের জুতোর অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেল। প্রায় বৃদ্ধ লোকটি হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে অনিকেতের সামনে এসে থেমে গেল। পরনে খাটো করে পরা লুঙ্গি, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, পুরে রাখা পানে একপাশের গাল ফুলে আছে। চোখে চোখ রেখে অনিকেতকে জিজ্ঞেস করল –
কোত্থাইকা আইছেন বাবাজি। এই বাড়িতে ক্যান?
তাই তো, কেন? কেন আজ এখানে অনিকেত? কিসের টানে? চেনে না, জানে না, বাংলাদেশের এক অজগাঁয়ে এসে হাজির! মা বলেছিল, যাসনে, ও-দেশে কেউ তো নেই! তোর বাবাই কোনওদিন যায়নি। তোর দাদু বোধহয় দুই-একবার গিয়েছিলেন।
কিন্তু না। মায়ের কথা কেন যেন মেনে নিতে ইচ্ছে করেনি। কলকাতা থেকে বাংলাদেশ, তারপর…!
এই বাড়িতে যিনি থাকেন, তাঁর সঙ্গে আমি অনেক দূর থেকে দেখা করতে এসেছি।
বলল অনিকেত।
ও আচ্ছা। কিন্তু অসুস্থ বুড়া মানুষ, রাইত-বিরাইতে দরজা বোধহয় খুলবার পারবো না। আপনে এক কাজ করেন, আমার লগে চলেন। রাইত পোয়াইলে এইখানে আবার আইসেন। এখনও তো ভোর হওয়ার দেরি আছে।
অনিকেত দ্বিধায় পড়ে গেল। খানিকক্ষণ আগে রাত কাটাবার জন্যে ও-নিজেই চাইছিল একটু আশ্রয়, কিন্তু এখন? এখন ওর মনে হচ্ছে – চলে যাওয়ার পর যদি কোনো এক সময় দরজাটা খোলে!
নাহ্, যাওয়া যায় না।
অনিকেত বলল-
আপনি যান। আমি অপেক্ষা করি। একসময় নিশ্চয়ই দরজা খুলবে।
প্রায় বৃদ্ধ লোকটি তারপরও দাঁড়িয়ে রইল। যেন কিছু বলবে। কিন্তু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে পান চিবোতে লাগল।
চাঁদের গায়ে মেঘ ভর করছে, আবারও সরে যাচ্ছে। হাওয়ায় মিশে আছে বকুলের গন্ধ। বিস্ময়কর একটি রাত। এমন রাত অনিকেত কখনও দেখেনি। হঠাৎ ওর মনে হল – এ-রাত বুঝি অনন্ত। কখনও শেষ হবে না! যে আশা নিয়ে ও-এসেছে তা-ও কখনও পূরণ হবে না।
কিন্তু ও তো ভীষণ ছোট্ট একটি আশা নিয়ে এসেছিল। এত ছোট আশা কেন পূরণ হবে না? শুধু এই রাত, এই রাতটুকু এই ভগ্নপ্রায় বাড়িটিতে কাটাতে চেয়েছিল ও। চেয়েছিল, বাড়িটির প্রতিটি ইট স্পর্শ করবে, গন্ধ শুঁকবে। ইটের স্পর্শে আর গন্ধে নিশ্চয়ই ওর পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস মিশে আছে! মিশে আছে তাঁদের আত্মার অস্তিত্ব! সেসব অনুভব করতে করতে ও-গল্প শুনবে। ওর পূর্বপুরুষ যাঁদের ওপর এই বাড়ির ভার দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের একজন তো এখনও এখানে বাস করছেন। আগলে রেখেছেন। দাদু আর বাবার কাছে শোনা কথাগুলো তাঁর মুখে শুনবে আর মিলিয়ে নেবে। মেলাতে মেলাতে রাত কেটে যাবে, ভোর হবে। তারপর অনিকেত বেরিয়ে পড়বে। ধীরে পার হবে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে দেশ। কিন্তু তেমন কিছুই তো হল না! নাকি বাড়িটাই ওকে আপন করে নিতে চাইল না! বন্ধ দরজা খুলল না সে কারণেই?
আসেন বাবাজি, দুইজনে একটু বসি। আর কত দাঁড়ায়া থাকবেন? পানের রসে টইটম্বুর মুখে কথাগুলো বলে লোকটি বসল। ঘটনা এবং অন্ধকারের ঘোরে অনিকেত খেয়ালই করেনি, বকুল গাছের গোড়ায় সিমেন্টের বেষ্টনী আছে। এই দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে না থেকে অনায়াসে ওখানে বসা যেত। কী বোকামি! বলল-
আপনি যাননি এখনও? আহা, খামোখা কেন কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছেন?
রাবারের জুতোজোড়া খুলে রেখে বেষ্টনীর ওপর পা তুলে বসল লোকটি। একটি দীর্ঘ হাই তুলে বলল- ক্যামনে যাই? আপনে একলা থাকলে আমার খারাপ লাগবো। বাড়ি গিয়া শান্তি পামু না।
কিন্তু, বাড়ির লোকজন তো আপনার জন্যে দুশ্চিন্তা করবে?
একটু ম্লান হাসল লোকটি। বলল – নাহ্ দুশ্চিন্তা করনের কেউ নাই। পোলাপান নাই, একটা বউ ছিল তারেও ওপরওয়ালা তুইলা নিছে। এখন রাইতে ঘুমাইবার পারি না। ঘুইরা বেড়াই। আপনারে একলা দেইখা দাঁড়াইলাম। এই বাড়িতে আইছেন দেইখাই দাঁড়াইলাম। এই বাড়ির ওপরে আমার খুব টান। আত্মার সম্পর্ক। নাইলে কোনদিক থাইকা কোনদিকে যাইতাম, তার ঠিক নাই।
তা, এই বাড়ির বুড়া মানুষ আপনার কে লাগে?
কেউ না। তবে আগে যাঁরা এই বাড়ির মালিক ছিলেন, তাঁরা আমার পূর্বপুরুষ। একসময় তাঁরা বাধ্য হয়ে ছেড়ে গিয়েছিলেন। আমি শুধু বাড়িটায় একটা রাত কাটাতে এসেছিলাম। পারলাম না!
কী আশ্চর্য, আপনি এই বাড়ির আসল মালিকের বংশের ! কত গল্প শুনছি তাগো। আমার চোইদ্দগুষ্টি তো তাগোর দয়ায় জীবন চালাইছে। বুকে কষ্ট নিয়া এই বুইড়া চাচাগো কাছে বাড়ি দিয়া চইলা গেছিল। তয় এই চাচারাও খুব ভালা মানুষ।
লোকটি একের পর এক তার জানা সব গল্প বলে যেতে লাগল। অনিকেতের মনে হল, ও-যেন দেখতে পাচ্ছে সব। চোখের সামনে বাড়িটির রং পাল্টে যেতে লাগল। নোনা ধরা দেয়ালের বট-পাকুড়ের চারারা মিলিয়ে গেল। ধবধবে সাদা বাড়ির বিশাল উঠোন গমগম করে উঠল। বাড়ির রমণীরা হেঁসেল আর কচিকাঁচাদের সামলাতে ব্যস্ত। পুরুষেরা কেউ ভারিক্কি, কেউ বৃদ্ধ, কেউ বা সদ্য গোঁফ ওঠা যুবক। একটি আনন্দ উৎসবের আয়োজন চলছে কি বাড়িতে? তেমনই তো মনে হচ্ছে! সবার মুখে হাসি, চারিদিকে আলো আর আলো…। অনিকেত নিজেকেও সেখানে আবিষ্কার করে আশ্চর্য হয়ে ভাবল –
এই সময়টায় আমার তো অস্তিত্ব থাকার মতো নয়, কোনভাবেই নয়! তাহলে!
বাবাজি, সুবেহ-সাদিকের সময় হইল। চলেন উঠি। একবার দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়া দেখি, বাড়ির ভিতরে চাচারে দ্যাখা যায় কিনা। গেলে গলা চড়ায়া ডাক দিমু। নিশ্চয়ই সাড়া দিবো।
স্বপ্নোত্থিতের মতো অনিকেত উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফজরের আজান কানে ভেসে এল। চারিদিক আলোকিত হওয়ার জন্যে একটু অপেক্ষা করে ওরা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ফাঁক-ফোকরওলা দরজায় চোখ রাখল দুজনেই। গ্রিলে ঘেরা চওড়া বারান্দা নজরে এল। আবছা।
আবছা বারান্দার মেঝেতে কি কেউ শুয়ে আছে? একজন বৃদ্ধ! ওখানে ওভাবে কেন শুয়ে তিনি?
উদ্বেগ নিয়ে প্রায় বৃদ্ধ লোকটি এক জোর ধাক্কা দিল দরজায়। ক্ষতে ভরা দরজা সশব্দে ভেঙে পড়ল কাঁদতে কাঁদতে। অনিকেত এবং লোকটি ছুটে গেল বারান্দায়। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বৃদ্ধকে সোজা করে দেখল – তাঁর ফ্যাকাসে মুখে কোনও কথা লেখা নেই। 🦋
🍁কবিতা
নবীনকিশোর রায়
প্রথম কলি
পুতুল খেলা শেষ হলে
গুচ্ছবছর কৈশোরে ফেলে-
উত্তরের হাওয়া
তখন সমাগত দ্বারে।
অবাক পৃথিবী তোমার
গোপন ঘরে,
অজান্তে দরজার কপাট খুলে
বিছানার চাদর রাঙিয়ে তুলে!
ঢাকনা খুলে ঋতু সংগোপনে
প্রথম কলি ফোঁটে বাগানে…
তপনকান্তি মুখার্জি
রোদ্দুর
রোদ্দুর হওয়ার ইচ্ছে ছিল অমলকান্তির।
কিন্তু সে ব্যথা দিয়ে গল্প বুনতে পারে না,
লম্বা শ্বাস নিয়ে ছাদে উঠে সূর্য পাড়তে পারে না,
মাথাকাটা ভোরে স্বপ্নবুকে হাঁটতেও পারে না।
তাই তার রোদ্দুর হওয়া হলো না আর।
সে এখন উচ্ছ্বাসহীন অভিমান।
অর্পিতা আচার্য
না
‘না’ বললে বলতে পারো
আকাশ কিন্তু কখনও না বলে নি আমাকে
মন্দিরের পাশের ভিখারিরা না বলেনি
এমনকি দেবতাও নয়
সকালে যে জলের পাশে দাঁড়াই
সে তার আয়নায় গাছের ছায়া ফেলে
জলে গাছে, আমাকে ও আকাশকে একাকার করে দেয়
তোমার না-এর কাছ থেকে
প্রতিদিন চলে যাই দূরে, আরও দূরে
উম্মে ফারহিন
অজুহাতের হাতছানি
ভাবনারা দাবা খেলছিল
কাটাবে সময়ের চুরি করা কিছু অংশ খুঁজে চলা অস্থায়ী বাসায়
ব্যস্ততার অবাধ্যতা ক্লান্তির বার্তায় ঘুম পাড়িয়ে দেয়
চোখের পলকে রাখা স্বপ্নগুলোকে
ক’য়েক সেকেন্ডের নীরবতায় সুখের সাগর হয় উচ্ছ্বসিত
মুহুর্তে ভাটা নেমে আসে যেন কল্পনার চাদরে
ভাঙা চোরা দেওয়াল লিখনে চোখে পড়ে একটাই নাম
একই তরঙ্গ ঘুরে ফিরে আসে বারবার
মহাজাগতিক স্রোতে নিশ্বাসের শব্দ
রাত্রিযাপন শেষ হয় ঘুমের অজুহাতের হাতছানিতে
বিজয় ঘোষ
সমুদ্র কিংবা লীলা
মাটির কাছাকাছি আমি
সমুদ্র এখন অনেক দূরে…
আমি যেমনটা ছিলাম তেমনই আছি
সমুদ্র তবুও আমাকে ডাকে…
আমি কেবলই লীলাবতীর স্বপ্ন দেখি
সমুদ্রের রঙ ঘননীল
স্বপ্নেরও…
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
একপলক
একপলক দেখেছি আর অম্নি পাথর হয়ে গেছি
গল্প উপন্যাসে যেমন হয় তেমনি রেখেছি
দুটি হাত চোখের পাতায়
তারপর সারাদিন আ্যপে ডাউনলোড করেছি
সুলতা সুচরিতা শান্তা সব …
আরো আরো সুন্দরী , উর্বশী রম্ভা সীতা মন্দোদরী
এখন ভাবছি পাঁচ পয়সার
ঝালমুড়ির জন্য
ভাঙ্গাব কি ভাঙ্গাব না হাজার টাকার নোট…
লক্ষ টাকার মিউচুয়াল ফান্ড …
বিপ্লব ভট্টাচার্য্য
জীবন্ত বিগ্রহ
বীরসিংহের মহান পুরুষ
তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা
বর্ণ পরিচয়ের মধ্য দিয়ে।
তোমাকে দেখেছি বার বার,
তোমার মাতৃভক্তি দেখেছি
উত্তাল দামোদরের ঢেউয়ের মাঝে।
তোমার করুন হৃদয় দেখেছি
সমাজপতিদের বিরুদ্ধে, বিধবা বিবাহে।
তোমার তেজস্বীতা দেখেছি
গিরীশ ঘোষের দিকে খড়ম ছোড়ায়।
তুমি করুণার সাগর দীনের বন্ধু,
আমার জীবন্ত দেবতা বিদ্যাসাগর।
কভার : প্রীতি দেব। অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
অথবা : sasrayanews@gmail.com
সাশ্রয় নিউজ
সবার জন্য সবসময়
