



সম্পাদকীয়-এর পরিবর্তে…
সাশ্রয় নিউজ-এর লেখক, পাঠক ও সকলকে শুভ নববর্ষ-১৪৩১ এর প্রীতি ও শুভেচ্ছা। নতুন বছরে সকলের ভালো হোক। সুন্দর হোক।
🍁গদ্য
আনোয়ারা আলম
পহেলা বৈশাখ ও বিশ্বায়ন
বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং আকাশ সংস্কৃতির অবিরাম বিকিরণ যখন পৃথিবীর শত শত ঐতিহ্যবাহী দেশ, জাতি ও সংস্কৃতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে, তখন প্রশ্ন এসে যায় বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে আমরা চেতনায়, মননে ও মেধায় বাংলা নতুন বছরকে কতোটা লালন ও ধারণ করছি, নাকি এটি শুধু একটি দিনের। লালপেড়ে সাদা শাড়ি বা ঘটা করে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ।
_____________________________________________
ভাবতে হবে নববর্ষ নিয়ে তাত্পর্যপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি যেমন দরকার তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দরকার।খেয়াল করুন, রবীন্দ্র – নজরুলের গান কবিতার পর নববর্ষ নিয়ে কি তেমন কোন গান বা কবিতা জনগণকে আন্দোলিত করেছে?
_____________________________________________
আমরা মনেপ্রাণে কতোটা বাঙালি বা বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কতোটা জানি বা মানি। বিশেষত নতুন প্রজন্মের ভেতরে এই চেতনাকে কতোটা আত্মস্থ করাতে সক্ষম হয়েছি। ধর্ম ও জাতি সমার্থক নয়।জাতিগত সত্তা ও ধর্মীয় সত্তা দুটি স্বতন্ত্র বিষয়, এ বিষয়টি অনুধাবন করতে শিখেছিলেন ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্। একটা ছোট প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন “পহেলা বৈশাখ জাতীয় উত্সব হলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার মিলিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং জাতীয় সম্প্রীতি বন্ধন আরও দৃঢ় হবে”।
পহেলা বৈশাখ আর নববর্ষ বাঙালির প্রধানতম অসাম্প্রদায়িক উৎসব। গ্রামবাংলার প্রতিটি খড়ো কুটিরে ‘আমানির’আদলে নববর্ষ আসে সময় সংক্রান্তির আনন্দ হয়ে। চৈত্রের শেষরাতের পান্তার সঙ্গে বৈশাখ ভোরের আমের আমেজ কিষাণ কিষাণীকে দেখায় ফসল নির্ভর জীবনের সোনালি সম্ভাবনা। লোক বাংলার চিরায়ত নববর্ষের মূল প্রণোদনা তিনটি ‘আমানি’ তার ব্যক্তিক বিশ্বাস ও আচার, পুণ্যাহ – তার সামাজিক – আর্থিক প্রথাবিধি আর ‘লোকমেলা ‘ তার সংস্কৃতিচেতনার প্রায়োগিক অভিব্যক্তি। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাংলার ব্যক্তিচেতনা ও সমষ্টি চেতনার প্রায়োগিক অভিব্যক্তি।
সাংস্কৃতিক শক্তিই যে রাজনৈতিক অস্তিত্বের নিয়ামক এ সত্যটি পহেলা বৈশাখের সর্বজনীনভাবে উদযাপনের মধ্যে দিয়ে বিশেষভাবে উদ্ভাসিত ও প্রমাণিত। আর এখানেই নিহিত রয়েছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সমাজতাত্ত্বিক তাত্পর্য, যা কৃষি ও শ্রমপ্রধান বাংলাদেশে আরও প্রাসঙ্গিক। সম্ভবত সেজন্যই নৃবিজ্ঞানী ওয়েস্টার মার্ক পৃথিবীর প্রত্যেক কৃষি সমাজে ‘চাষাবাদের মৌসুমকে কেন্দ্র করে বর্ষপঞ্জি চালুর কথা বলেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ও তাই হয়েছে। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের ‘যুক্তিশীলতার ধারণা ও এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বিবেচ্য।আর সেটি হচ্ছে এই যে, বৃহত্তর ভারতের শাসক হিসেবে মোগল সম্রাট আকবর ভূমি ব্যাবস্থার পুনবির্ন্যাস উপলক্ষে বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত খাজনা আদায়ের দিন- তারিখের ভেতরে সামঞ্জস্য বিধান করেন।অর্থাৎ তিনি তার উক্ত ভূমি প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যুক্তিশীল করার প্রয়াস পান। একথা আজও সত্য, যে কোন কৃষি ও গ্রামীণ সমাজে ভূমি রাজস্বই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উত্স। এক্ষেত্রে যদি ‘যুক্তিশীলতা’ অনুপস্থিত থাকে তাহলে শুধু রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিই হয় না,সামাজিক অগ্রগতি ও সৃষ্টিশীলতা বাঁধাপ্রাপ্ত ও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এখন যে বিষয়ে বলতে হয় তা হলো বিশ্বায়নে পহেলা বৈশাখ কিভাবে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকের শুরুতেই অর্জিত হলো বাঙালির সাবভৌম জাতিরাষ্ট্র। ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো নববর্ষের লক্ষ্য ও আদল।তা এখন পরিণত লাভজনক নন্দনপণ্যে।রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পর এবার আর্থিক প্রবৃদ্ধির পালা। স্বাভাবিক ভাবে যুক্ত হলো বানিজ্য বুদ্ধি। কূশলী উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলেন। তাঁরা লোকশিল্পীদের দক্ষতা ব্যবহার করলেন। তাঁদের মূর্ত ও বিমূর্ত অভিব্যক্তিকে পণ্যে রূপান্তরিত করলেন। এরপর থেকে নববর্ষ শহরে – বন্দরে এমনকি লোক বাংলায়। পূণ্যাহ এখন পণ্য আবহ বা পণ্যাহ। আর বাংলা নববর্ষের তিন অভিব্যক্তি – পান্তা-ইলিশ, পণ্যাহ এবং মিছিল মেলা প্রদর্শনী।সংবাদ পত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এসব কর্মকাণ্ডের বানিজ্যিক প্রদর্শনী। অর্থাৎ সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।
তবে ভাবতে হবে নববর্ষ নিয়ে তাত্পর্যপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি যেমন দরকার তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দরকার।খেয়াল করুন, রবীন্দ্র – নজরুলের গান কবিতার পর নববর্ষ নিয়ে কি তেমন কোন গান বা কবিতা জনগণকে আন্দোলিত করেছে? অথচ বায়না নির্ভর অজস্র গান কবিতা প্রবন্ধ তৈরি হচ্ছে কিন্তু। তাই এখন দরকার একেবারে দেশীয় ঐতিহ্যে নববর্ষকে নিয়ে নতুন করে ভাবা। বিশ্বায়নের স্রোতে রূপান্তরিত নববর্ষকে মনপ্রিয় ও শেকড়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল মানুষের। সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। 🦋[লেখকের বানান অপরিবর্তিত ]
🍁গদ্য
কুণাল কান্তি দে
নতুন বছরে…
চক্রবত পরিবর্তন তে সুখানি চ দুঃখনী চ।
দুঃখের পর তো সুখ আসে। ২০২০ ও ২০২১ ভয়ানক দুঃখ দিয়ে গেল। আজ নূতন বছরে নুতন আশা তো করতেই পারি। আমাদের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন আনে সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে।
_____________________________________________
মানবিক মূল্যবোধ ফিরুক। আশা করছি যেখানে সম্পর্কের দূষণ থাকবে না। ধনী দরিদ্র দের বিদ্রুপ করবে না। শিক্ষার আলো আলোকিত করবে অন্তঃজের কুটির।
_____________________________________________
ভাবনার বদল করে মানুষ। আমরা এগিয়ে চলি পূর্ণতার দিকে। সমস্যার সমাধান করে মানুষের কল্যাণে। শিক্ষা-দীক্ষা চেতনা আমাদের আলোকিত করেছে পৃথিবীর পরিবেশ সুন্দর রাখতে। কত না আলোচনা সেমিনার মিটিং মিছিল করি দূষণ মুক্ত পৃথিবী গড়তে। শান্তিপূর্ণ অবস্থানের জন্য আমরা লালায়িত। আমরা চাই না হানাহানি কাটাকাটি রক্ত ঝরুক এই সবুজ সুফলা মাটিতে। আমরা চাই দূষণ মুক্ত পৃথিবী গড়তে। সম্প্রীতির বাতাবরণ থাকবে জাতিতে জাতিতে। সংহতি ঐক্য বিশ্বকে এক সূত্রে গ্রথিত করবে। মানবিক মূল্যবোধ ফিরুক। আশা করছি যেখানে সম্পর্কের দূষণ থাকবে না। ধনী দরিদ্র দের বিদ্রুপ করবে না। শিক্ষার আলো আলোকিত করবে অন্তঃজের কুটির। অভুক্ত থাকবে না কেউ এই পৃথিবীতে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাবে কেউ যেন ফাঁকা আকাশের নিচে বসবাস না করে। ভাতৃত্ব বোধ গড়ে উঠুক ধর্মের বন্ধনেও। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদ ভুলে শান্তির স্বর্গ প্রতিষ্ঠা হোক। নূতন বছরে এই চাওয়া তো যেতেই পারে। আমাদের চৈতন্যহোক। নুতন দিগন্ত নেমে আসুক ধারার পৃথিবীতে। হে উদাসীন পৃথিবী , আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে তোমার নির্মল পদপ্রান্তে আজ রেখে যায় আমার প্রণতি।
‘আগুনের পরশ মনি ছোঁয়াও প্রাণে। / এ জীবন পুণ্য করো দহনদানে। নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো।’
সব ইতিবাচক আশা আজকের দিনে পূরণ হোক এই কামনা করি। নূতন বছরে আমাদের আশা পূর্ণ হউক। সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। 🦋
🍁কবিতা
বিকাশ সরকার
দমনপুর
তুমি তো টগর, তোমার পাপড়ি ছুঁয়ে মৃদু এক বুনোসুর বাজে
আমরা দুজন তবে দমনপুরেই যাব হিমবন্ত শরতের মাঝে
রেললাইন পাশে রেখে হাঁটি, একটিবারও হাত ছুঁইনি তো
শুধু ভাটগাছ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই, আমি যেন আত্মবিস্মৃত
এইখানে বহু দূর দূর কাশফুল শুধু, পাশে পাশে এক ব্রাত্য আমি
জঙ্গল ঘনসংবদ্ধ হয়ে আসে, টিলা বেয়ে উঠি আর নামি
ভাবো তো, কত রাত গভীর হয়েছে দমনপুর ভ্রমণ বিষয়ে
শীতে শুরু, বসন্ত-গ্রীষ্ম গেল, শরৎ এসেছে অবশেষে ঘন বর্ষা হয়ে
ভেজা রোদ এখন কুয়াশাসঙ্কুল, সরে গেছে বিষাদবাতাস
তুমি আরও ফরসা হয়েছ, শরীরজুড়ে শুধু আশ্চর্য টগরের চাষ
তবু তো ছুঁইনি তোমার শরীর, শুধু চেয়েছি ছুঁতে শিশিরহৃদয়
চেয়েছি পৃথিবীর সকল জঙ্গল যেন আরও ঘন হয়, সবুজাভ হয়
আরও যেন উঁচু হয় বৃক্ষগুলি, আরও বেশি চঞ্চল শাখাপ্রশাখা
আর জমকালো পাখি, আরও বেশি উড়ানসক্ষম তাহাদের পাখা
সব প্রজাপতি তো তোমাকেই দেবো, সব পাখিদের ডাক, সকল ময়ূর
সব বুনোফুল, লতাগুল্ম, হরিণেরা, ঝিঁঝিদের একটানা সুর
এত যে বলেছি, ছোঁব না, তবু তো আমাকে চিরকাল ভাবলে কাতিল
দমনপুর তাই ইচ্ছে হয়ে আছে, তুমি তো যাত্রা কবেই করেছ বাতিল
উৎপলকান্তি বড়ুয়া
আলোর পথে হোক
চৈত্রের রাত শেষে বোশেখের পালা
খুলে যায় শুভ নব ভোরেরই ডালা।
মায়া প্রীতি মাখা হাসি খুশি কথা বলা
বোশেখের আলো পথে শুরু হলো চলা।
বোশেখের শাখে শাখে হাসে কচি পাতা
মহাজন হিসাবের খোলে হালখাতা।
পুরাতন পঁচা বাসি এসব আজ বাদ
মা’র হাতে পাঁচনের রসনার স্বাদ।
দই চিড়া লাবন আর পিঠা পুলি খই
বটতলে মেলা বসে বড় হই চই!
বেত-ঝাঁকা টমটম কাঠ ঢোল বাঁশি
খোকা খুকু খুশি মুখে হাসি রাশি রাশি।
নতুনের ছোঁয়া পেয়ে রাঙা হয় মন
বোশেখের কোলে মায়া আদর যতন।
অশুভ জীর্ণ জরা জলে যাক ভেসে
প্রাণে প্রাণ মিশে থাক ভালোবেসে বেসে।
বোশেখে উজাড় করে হোক কথা বলা
আলোর পথে হোক আজীবন চলা।
আমিনুল ইসলাম
নিঃসঙ্গতা ধুয়ে দিয়ে যায়
ইতিহাসে মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়ে আছে মুঠোফোন;
তার বুকেও শতবর্ষের নির্জনতা।
পাপিয়ার কান্না বা শিরিষশাখার গজল
তরঙ্গের পিঠে সওয়ার হয়ে
আসেনিকো এসবের কোনোটাই।
যদিও তুলোহীন তথাপি পৃথিবীর কানে বাজেনিকো
স্বাতী ও অরুন্ধতির কানাকানি;
এমনকি মার্কিনী আগ্রাসনের মতন
অগ্রগামী যে-অন্ধকার
তার উল্লসিত পদধ্বনিও নয়।
ফলে ওয়াকওভারের পায়ে চলে আসে অন্ধকার
তার হাতে গুটিয়ে যায় সোনালি আলোর চাদর।
অধিকন্তু, তুষারের চতুর্মুখী সাক্ষ্যে
মিথ্যা হয়ে আছে ফল্গুধারার দাবিও।
তবু একটা রোদেলা দুপুরের স্বপ্নে
সারেঙবউয়ের চোখে পৃথিবীর দৃষ্টি প্রসারিত।
কোনো এক দুপুরে আলবার্টাসের ডানার শব্দে ভেঙেছিল
হিমশাসিত নির্জনতার চূড়া,
সে-কথা মনে রখে একটা প্রবাদের গায়ে
হেলান দিয়ে সে জেগে আছে;
অথচ ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে আছে ইতিহাস।
আবু জাফর দিলু
এসো হে বৈশাখ
এসো হে বৈশাখ খরতাপে পোড়া জরাজীর্ণতার
যা কিছু কলুষ রোগ-শোক ব্যাধি ধুয়ে মুছে যাক্,
নতুন ধারায় হাসুক সবুজ স্বপ্নীল আঁখি,
পুত আশা নিয়ে সব ঘরে ঘরে আসুক বৈশাখ।
বছর গড়ানো ঋণের পাহাড় লাঘব ঘটাতে
হিসেব কষার ধূম পড়ে যায় সকলের মাঝে,
হরেক রকম খেলনা-পুতুল বট-আঙিনায়
গেরাম-শহর সেজে ওঠে রঙে নবনীত সাজে।
নীলাভ বেদনা দূর হয়ে যাক্ হোক অবসান
নতুনের গানে বয়ে যাক্ ঢেউ সুখময় ভেলা,
ঋতুর বদল হলুদ বরণে ছড়াক আলোক
প্রজাপতি রঙে হৃদয়ে মিলুক বিচিত্র মেলা।
মায়ের আদুরে হাতের ছোঁয়ায় মুগ্ধ আঁচলে
ছন্দ দোলায় মাতুক মানুষ পুলকের হাটে,
ছড়া-গান আর কাব্য আসরে বাজুক মাদল,
এসো হে বৈশাখ স্বপ্ন-মুখর জীবনের বাটে।
কাকলি দাস ঘোষ
অপেক্ষা
বৈশাখী ফুল ফুটলে
তোমাকে মনে পড়ে।
এরপরে ঝড় ওঠে…
আমাদের উঠান জুড়ে
বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি মানে আমাদের স্মৃতির
টুকরো টুকরো আবেগ
ফুলে ফুলে নরম মুক্তোর আলিঙ্গন।
কালবৈশাখী-সে তো শুধু বৃষ্টি নয়,
বিধ্বংসী ঝড় যেন আমাদের স্মৃতির
ভাঙাচোরা।
এরপরে আবার শান্ত সব..
অপরূপ সজল সবুজ।
আমার সজল দুই চোখ
সেই সবুজের অপেক্ষায়।।
স্মৃতি দাস
আমার চলা
আমি তো নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে চাই
আলো বাতাসের উদারতা
দরজায় কড়া নেড়ে বলে আন্তরিকতায়
এসো আমাকে আশ্রয় করো
যেন জেগে উঠি অন্তরে
প্রতিকূলতা জড়িয়ে যায় পায়ে পায়ে
দু’হাতে সরিয়ে দিই সাধ্যমতো
একের পর এক আবেষ্টন আরও প্রবল
পথ আর এগোয় না
ঝর্ণার বহমানতা অনুশীলনের ইচ্ছে
এতো সব নিগূঢ় প্রচেষ্টা হাত ফসকে যায়
এভাবে কি দৌড়নো যায় বলো
সঞ্জয় আচার্য
পয়লা বৈশাখ
কিছুটা বসন্ত রেখেছি চৌকাঠে কিছুটা হৃদয়ের কোণে।
এরই মাঝখানে
যে বিশাখা নক্ষত্র এসেছে দ্বারে
তাকে ছেড়ে দিয়ে দুয়ার
দূরে চলে যায় রং গোধূলির পলাশ।
আমি তাকে মায়াজল দিই
কিশোর বেলার টলটলে পদ্মপাতায়
সেই পুরনো আসন সেই লাজে নত জ্যোৎস্নায়
হেঁটে যাওয়া রুপোলি উঠোন
কতকাল হলো এই ফিরে ফিরে আসা যাওয়া।
ওগো সন্ন্যাসী বয়স, তবু ভালো করে চেয়ে দেখো
হৃদয়ের এককোণে যে চৈতি বসাক
অনুরাগে ভেসে যায় চলন্তিকা নদীটির বাঁকে
তাকে প্রতিবারই কেমন নতুন করে নিচ্ছে
নববর্ষের থই থই পয়লা বৈশাখ।
স্বাতীলেখা রায়
কবিতা পাঠালাম
লিখতে গেলে বেশ বুঝতে পারি
কিছুর সাথে কিছুর সম্পর্ক নেই
কাগজ পেলে কলম নেই
কলম পেলে শব্দ নেই
কিছু দুর্বোধ্য অভিনয়ও নেই
অতঃপর
কলমে কালির মত চিন্তা বোধ চেতনা ঝেড়ে
খামের ওপর শুধু লিখি
কবিতা পাঠালাম
দেবীপ্রসাদ বটব্যাল
আমি কিন্তু হীরের গোলাম
শালবনের কোনো আধারকার্ড নেই
শরীর’ফাটা আঠায় গৃহস্থের পেঁচামুখী সুখ
জুলজুল চোখের আঠায় চিটচিটে ক্যাকোফনি।
অদূরেই জীবনের ইতিহাসে জলচর…
হয়তো কখনো ভেসেছিল আকাশযান।
উড়ে গেছে, কেঁদপাতা সরণী জুড়ে
বছর শেষে মুরগির ছাল ছাড়িয়ে
ঝরা পাতায় শোক নেমে আসে উদ্দাম
‘বিট্টুওয়া কে পাপা শুনো- ঢপ্ ঢপ্ ঢপ্’
সাথে দেদার ফুর্তির উদোম ঢেকুরে আমোদ
চুম-আবদ্ধ যুবক যুবতী দুটি ভ্রমের অভ্রান্ত থাবায়
ষোলো সংখ্যার প্রামাণ্য তুরুপ হয়
‘পেয়ার’ ভেঙে এ গেম জিততেই হবে
মনে আছে তো কালো’পান বিবি?
আমি কিন্তু হীরের গোলাম।
🍁গদ্য
নুসরাত সুলতানা
আবাহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য বৈশাখ
প্রারম্ভিক কথা
চৈত্রের শেষ দিন মাটি চৌচির হওয়া রোদে আমরা যখন বাতাসের আদুরে স্পর্শ পেতে বাড়ির দক্ষিণে খোলা মাঠের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য বেরুতাম; দেখতাম বাবা আদুল ঘর্মাক্ত গায়ে ডাল ধরনের কিছু একটা খাচ্ছেন। ভেতরে শাকপাতা এবং ডালপালাও আছে।পরে জেনেছি ১৩ রকমের বনজ ফল ও সবজি দিয়ে রান্না হত এক ধরনের তরল খাবার যাকে বলা হত ঝোল। প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিতে বাবা মেজ চাচীর হাতের ঝোল খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন। মেজ আম্মাও ঝোল রেঁধে সঙ্গে সঙ্গেই মাটির পাত্রে পাঠিয়ে দিতেন ছোট দেবরকে। এর পরেরদিনই বৈশাখের প্রথম দিন বা বাংলা বছরের প্রথম দিন। সেদিন দেখতাম ঘর-বাড়ি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখা, ভালো খাবার রান্না করা; যার ভেতর মাংস, মিঠা পানির মাছ, আম ডাল, বিভিন্ন রকম ভর্তা, এসব থাকত। অইদিন আনা হত দেশী ফল; তরমুজ, বাঙ্গি এসব। বাজারের দোকানে দোকানে বসত চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ দুদিন ধরে হালখাতা। এই দু-দিন ক্রেতা বা ভোক্তারা মিটিয়ে দিতেন দোকানদারের সমস্ত পাওনা। দোকানদার ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। হালখাতার মিষান্ন খাবারের জন্য বাড়ির মেয়েরাও অপেক্ষা করে থাকত। গ্রামে স্কুল, কলেজের মাঠে বসত চুরি, ফিতা, মাটির তৈজসপত্র, ঝুরি ভাজা, গজা, দানাদার মিষ্টি, বাতাসা, এসব নিয়ে মেলা। বাড়ির নারী,শিশু কিংবা পুরুষ কাউকেই দেখা যেত না নতুন কাপড় পরতে। তবে মেলা থেকে নারী-পুরুষ, শিশুরা কিনে আনত ছিকা, ঝালর, মাটির হাড়ি, কাচের চুরি, বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ঘর সাজানো সামগ্রী, ঝুরি,তালের পাখা এসব ক্ষুদ্র শিল্প গোষ্ঠীর তৈরি পণ্য। এমনই ছিল শৈশব মানে ৯০ এর দশকের পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের চেহারা।
তার কিছু পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশাখ উদযাপন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পুরোটা যেন সেজে উঠত হরেক রঙ আর বাহারি মেলায়। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, টি. এস. সি, রোকেয়া হল সংলগ্ন পুরোটা রাস্তা জুড়ে চুড়ি, গয়নার পশরা, কাঁচা আম ভর্তা সে এক হুলস্থুল বৈশাখ উদযাপন। যা অমলিন আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকবে আমৃত্যু।
_____________________________________________
সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না।
_____________________________________________
জিরো দশকে এসে পুঁজিবাদ, অতিপ্রযুক্তি যখন মানুষের ঘাড়ে কালসাপের মতো নিশ্বাস ফেলছে ; তখন ফ্যাশন হাউসগুলোর লাল সাদা রঙের অতি বাড়াবাড়ি, ইলিশ পান্তায় বৈশাখকে বন্দী করে ফেলার জোর অপচেষ্টা আর ইলিশের অবিশ্বাস্য মুল্য এসবকিছুর কারণে বৈশাখ কখনো কখনো মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের এক মৃদু আফসোসেও পরিনত হয়েছে।
বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
আর্য আগমনের অনেক আগে থেকেই বাংলায় আদি মানুষের অস্তিত্ব ছিল। নৃবিজ্ঞানের ভাষায় এদের বলা হয় অস্ট্রিক বা অস্ট্রলয়েড গোত্রের। সহজ ভাষায় বললে বলা যায় কোল, ভীল, কৈবর্ত মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি গোত্রের মানুষ।
বাঙালি জাতি পরিচয়ের ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয় গুপ্তযুগ (৩২০ খ্রি.- ৬৫০ খ্রি.) থেকে এবং এ যুগেই প্রথম ক্ষুদ্র রাজ্যপুঞ্জগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় বিশাল রাজ্য। যেমন গুপ্তদের সাম্রাজ্যিক ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষুদ্র রাজ্যের বদলে বৃহৎ রাজ্য যেমন পূর্ব ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গরাজ্য ও উত্তরাঞ্চলের গৌড় রাজ্য। বৃহৎ বঙ্গের প্রথম এবং ঐতিহাসিকভাবে সুনির্দিষ্ট এবং শক্তিশালী শাসক। শশাঙ্ক (খ্রিস্টপূর্ব আনু ৬০০ খ্রি.-৬২৫ খ্রি.) তাঁর দক্ষ শাসনের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার যাত্রা শুরু এবং পাল ও সেন আমলে এসে সে সত্ত্বা আরো বিকশিত হয়ে বাঙালি জাতির শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে। সে ভিত্তির ওপরই স্থাপিত বাংলায় সুলতানি রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের নাম দেয়া হয় বাঙ্গালাহ বা বাংলা এবং বাংলা রাষ্ট্রের অধিবাসীরা পরিচিত হয় বাঙালিয়া বা বাঙালি নামে। সুলতানি আমলেই আবার সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য তৈরি হয় একটি সাধারণ ভাষা। নাম বাংলা ভাষা। শতকের পর শতক ব্যাপী বিকশিত হয়ে সুলতানি আমলে এসে আমরা পাই বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা। এরপর আসে মোঘল এবং বিভিন্ন ঔপনিবেশিক জাতি- পর্তুগীজ, ফরাসি এবং সবশেষে ইংরেজ। প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতি এবং সভ্যতার সংমিশ্রণেই তৈরি হয়েছে আজকের বাঙালি জাতি।
ফিরে দেখা বৈশাখ
সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেক কাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না।তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ এর তাৎপর্য
পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ বাঙালি জাতির উৎসব। এই উৎসব বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির অনুষ্ঠান। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত “মঙ্গল শোভাযাত্রাকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে। এটি সমস্ত বাঙালির অনেক বড় সাংস্কৃতিক অর্জন। যখন সংস্কৃতির কোমর ভেঙে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে জোরালো ভাবে, যখন ধর্মান্ধতার জয়জয়কার চলছে, দেশ ব্যাপি চলছে বঙ্গবন্ধু, লালন প্রমুখ মহাপুরুষ -এর মূর্তি ভাঙার মহোৎসব তখন বৈশাখ প্রবল ঝাঁকুনি দিক বাঙালির মন আর মননে। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি যেমন বাঙালির ধমনিতে প্রবাহিত, তেমনি বৈশাখ বাঙালির নাড়িতে পোতা। ইউটিউব আর সোসাল মিডিয়া যখন বইয়ে দিচ্ছে অপসংস্কৃতির জোয়ার। তখন বাঙালি তার সাংস্কৃতিক চেতনার মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আঁকড়ে ধরতে পারে রবি ঠাকুর, লালল, নজরুল, আব্দুল করিম, আব্দুল আলীম প্রমুখ শিল্প-সাহিত্যের বাতিঘরদের। বৈশাখ কেবলই বাহ্যিক অনুষ্ঠানে আবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠুক আমাদের সাংস্কৃতিক স্রোতের উৎসধারা। শুদ্ধ সংস্কৃতিতে অবগাহন করে বেড়ে উঠুক সুস্থ প্রজন্ম। বাংলাদেশ হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর মানবিক উৎকর্ষের আদর্শ।
শেষকথা
বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় – আদি পুরুষ ছিল অনার্য জনগোষ্ঠী – কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা, কৈবর্ত। এরা ছিল কৃষক, জেলে, মৃৎশিল্পী। তারপর যত জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণেই বাঙালি জাতির বিনির্মান হোক না কেন মূল আদি পুরুষের রক্ত এবং সংস্কৃতির প্রভাব বাঙালির জনজীবনে ছিলই। তাই একুশ শতকের আগে উৎসবের প্রাণকেন্দ্রে ছিল মাছ-ভাত, দেশী ফল, গ্রামাঞ্চলের ময়রার বানানো মিষ্টান্ন, মাটির তৈজসপত্র, বাঁশের তৈরি বিভিন্ন গৃহসামগ্রী।এরপর এদেশে তেরশত শতকে আসে তুর্কী তথা মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারপর মোঘল শাসকরা।
বিভিন্ন জাতি এবং ধর্মের প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতির উত্তোরণ ঘটলেও বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে বরাবরই থেকেছে বাঙালিয়ানা। স্বাধীন বাংলাদেশে কে কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে বৌদ্ধ সেই প্রশ্ন যেমন গৌন তেমনি কে নিন্মবিত্ত, কে মধ্যবিত্ত এবং কে উচ্চবিত্ত সেই প্রশ্নও গৌণ। বৈশাখ হোক সকল বাঙালির প্রাণের উৎসব।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া।
🍁গদ্য
সোমা বিশ্বাস
কিছু কথায় কিছু বেদনায় তবুও আশা ও ভালবাসায়…
কবি শঙ্খ ঘোষের কথায় “শূন্যতাই জানো শুধু শূন্যের ভেতর এত ঢেউ আছে সে কথা জানো না?” আসলে আমরা চাওয়া পাওয়া, রাগ অভিমান, ভালোবাসা নিরাশা, ধাপ্পাবাজ তোলাবাজ সবকিছু নিয়ে যেন বিচলিত। সময় সময়ের মতো বয়ে যায়। কিন্তু মানুষের জীবন থেকে ভালো সময়টা যেন অল্পতেই শেষ হয়ে যায়! তবুও মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে ব্যথিত হয় ঠিক। হৃদয়ে নতুন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে প্রত্যেক বছরের শুরুতেই যেমন নতুন করে পরিকল্পনা নতুন আশার কথা জাগায়, বর্ষ শেষে গিয়ে সেই আশাগুলোর হতাশার গল্পে জমাট বাঁধে বা একই অনুভূতি থেকে যায় অনেক কিছু হবার ছিল কিন্তু সে সত্যি কিছুই হলো না বা সামান্য কিছু হল… এই যে অনেক পাওয়ার মাঝে অনেক চাওয়ার মাঝে ‘এই সামান্য কিছু’ এই সামান্য কিছুই বা কম কিসের ?’এই সামান্য কিছুই’ তো জীবনের উপাদান বা জীবনের মরুভূমিতে মরুদ্যান বলা যায়।
_____________________________________________
একজন হয়ত স্বপ্নকে কিনে নিল অন্যদের স্বপ্নকে ভেঙ্গে বা যে সেই স্বপ্নগুলোয় মানুষ কেমন আশা হতো হয়ে দেখতে ভুলে যায় বা ভাবতে ভুলে যান। আবার কেউ কেউ তার মধ্যে থেকেই নতুন করে স্বপ্ন দেখে জীবনের জন্য বা জীবন ধারণের জন্য।
_____________________________________________
ভাবনাগুলোকে কাজে রূপান্তরিত করতে আমাদের যতটা মেহনত দরকার, যতটা বুদ্ধির দরকার যতটা পারদর্শিতা দরকার; আমাদের মধ্যে হয়তো কখনো কখনো সময়ের স্রোতের সাথে চলতে গিয়ে বা একটা দেখনেপনা স্বভাবের মধ্যে যেতে গিয়ে কেমন যেন আসল কাজ ছেড়ে নকলের পেছনে খুঁজে বেড়াই! সেই খুঁজে বেড়ানোর দায় বা দায়িত্ব মানুষের মধ্যে কি সঠিক ভাবে ধরা পড়ে?
আজকাল মানুষের মানসিকতা কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে” এবং সেই ধারা বজায় রাখতে গিয়ে আমরা নিজেদেরকে খুশি করার জন্য অন্যদেরকে এত বেশি আহত করি বা এত বেশি আশাহত করি তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখি? একজন হয়ত স্বপ্নকে কিনে নিল অন্যদের স্বপ্নকে ভেঙ্গে বা যে সেই স্বপ্নগুলোয় মানুষ কেমন আশা হতো হয়ে দেখতে ভুলে যায় বা ভাবতে ভুলে যান। আবার কেউ কেউ তার মধ্যে থেকেই নতুন করে স্বপ্ন দেখে জীবনের জন্য বা জীবন ধারণের জন্য। কিছু প্রত্যাশার স্বপ্ন বা আশাহতর স্বপ্ন এভাবেও আসে যেমন ধরুন না এই যে সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে সংবাদপত্র হোক মানুষের আলোচনায় হোক কিংবা আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো যারা শিক্ষিত সমাজ শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে তাদের চাকরির বদলে যেমন অশিক্ষিত ছেলে মেয়েরা নিজেদের প্রভাব বা প্রভাবশালী লোকেদের খাটিয়ে ঘুষ দিয়ে কাজ পাচ্ছে তাদের মানসিকতাকে কিভাবে বিচার করবেন? রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ করে এসে সামান্য সদস্য হোক বা বিশেষ কোনও পদে থাকলেই বেশিরভাগ সময় বা বেশিরভাগ জনেরই পাঁচ বছর পর তার যে উন্নতির শিরোপা সেটা কি কখনো মেলাতে পারবেন কিভাবে সম্ভব হলো? অথচ তার কোন রোজগারের সেভাবে উৎস নেই বা শিক্ষা নেই তবুও তার রমরমা এগুলোকে আমরা কিভাবে মেনে নেব? কন্যাশ্রী বা লক্ষী ভান্ডার সত্যিই কি যাদের দরকার তারা সকলেই পাচ্ছেন বা তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে ? কখনো কি মনে হয় না হঠাৎ করে যখন টিভির পর্দায় বা সংবাদপত্রে বিস্ফোরণের নিউজগুলো ভেসে ওঠে বসবাসের এলাকায় কি করে সম্ভব যেখানে এলাকাবাসী একসাথে বেঁধে থাকার চেষ্টা করবে সেখানে জনসমাজের মধ্যেই হঠাৎ বিস্ফোরণ এবং তাতে বাসস্থানের সাথে প্রান সংশয় থেকে যাচ্ছে বা হঠাৎ করে মানুষের অযাচিত মৃত্যু ঘটছে? ! এসবগুলি সম্বন্ধে আমরা কবে সচেতন হব ? সরকার বা প্রশাসন এগুলির কি ব্যবস্থা নিচ্ছে বা নেবে? এগুলো কি আমাদের আশাহত করে না যখন দেখবেন আমি, আপনি বা আমাদের মত হাজার হাজার ছেলে মেয়ে একটা কাজ পাচ্ছে না বা সারাদিন কাজ করার পর সামান্য কিছু উপার্জন তার প্রয়োজনে বা তার সংসারের জন্য, বা তার নিজের জীবন যাপনের জন্য সেটাও কি মানুষকে ভাবায় না? নিশ্চয়ই ভাবায় কিন্তু সেটার সঙ্গে এই ভাবনাটাও কাজ করবে যে আপনি বা আপনারা যা কিছু করছেন বা যেটুকুই করুন সেটুকু কিন্তু মাথা উঁচু করে করেছেন বা করবেন ওখানে কোন তোষামোদ বা পালিশ করা বা মন রেখে কথা বলা আপনার সেভাবে স্বভাবে নেই । দিনের শেষে আপনি শান্ত মাথায় বিনা অভিযোগে ঘুমোতে যেতে পারবেন সিবিআই আসবে কিনা বা চুরি নিয়ে নতুন কোন তদন্ত হবে কিনা এইসব ব্যাপার গুলো আপনাকে ধাওয়া করবে না !
একটু হলেও তো বাঁচবার স্বস্তি আছে থাক না প্রাচুর্যহীন জীবন মানুষ কখনো তার গাড়ি বাড়ির স্ট্যাটাস কে সঙ্গে নিয়ে যায় না যেটা নিয়ে যায় সেটা হল ব্যবহার। আপনার ব্যবহার বা আপনার ভালো কাজ আপনাকে মানুষের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে হয়ত সমালোচনা থাকবে। হয়ত ভুল ত্রুটি থাকবে তবুও কোনও কোনও সময় আপনার লড়াই আপনার জীবন সংগ্রাম অন্যদের কেউ অনুপ্রাণিত করে ব্যক্তি বিশেষে বা মানুষ বিশেষে কখনো কখনো তার রেশ যদি বহুদূর বিস্তৃত হয়। তাহলে সেটা জনসমাজের মধ্যেও প্রভাব ফেলবে একটু হলেও। আপনার তো দুটো কথা বলে প্রতিবাদ করবার কথা আছে, ভাষা আছে নাকে না বা হ্যাঁকে হ্যাঁ বলার এটাই তো আপনার বাঁচবার স্পর্ধা বা শিরদাঁড়া।
একটা গাছ কিন্তু নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সারা বছর ধরে রোদ বৃষ্টি জল মানুষের আঘাত কখনও কখনও তার উপরেও নেমে আসে তবুও কিন্তু সে মাথা উঁচু করে বাড়তে থাকে। আমাদের মানুষের মন, মানুষের মানসিকতাও যেন সেই ভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচবার ক্ষমতা রাখে ঠিক যেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর ভাষায় “চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য উচ্চ যেথা শির” কিংবা অন্যভাবে শ্রীজাতের ভাষায় বলা যায় “জীবন অনেক বড় কে কদিন বাঁচে আমি শুধু ঋণী থাকি মুহূর্তের কাছে।” যে কোনও অবস্থাতেই আমাদের বোধ বুদ্ধি বিচার বিবেচনা যেন মন থেকে ধুয়ে মুছে সাফ না হয়ে যায় ! হাজার যন্ত্রণা বেদনার মাঝেও জেগে থাকুক মানুষের আশা ভরসা সাহসিকতা এবং কিছু প্রতিবাদ করার মতো শব্দ বা মানসিকতা। সকলকে জানাই শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা সকলে ভালো থাকুন, নববর্ষের নব প্রভাতের সূর্যের আলোর মতো মানুষের মনে শুভ বোধ জাগ্রত হোক এই কামনা-। 🦋
🍁কবিতা
পরাণ মাঝি
এসো হে…
শেষ বসন্ত পার করে এলাম। রোদে পোড়া কপাল।
রাতে ও দিনে ঘামের শিশির ভিজিয়ে দিয়ে যাবে এবার।
ঝরাপাতা ও যৌবনদীপ্ত ধূলো মেখে চলবে দিনগুজরান-
ছায়া ভালোবেসে গাছকে মা বলে ডাকি,
অসীম শান্তি বটের কোলে
মা’কে মনে পড়ে, মা’কে মনে পড়ে মা!
জিভ ভিজিয়ে কবে আসবে তুমি
সবুজ সবুজ ঘাসের গদিতে গড়াগড়ি খাবো।
জলকথার কারুকলায় আদুল গায়ে ভিজে যাবো বলে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি-
এসো হে বর্ষ – শুভ নববর্ষ!
বাবুল আনোয়ার
দাওনি
আমাকে দাওনি কিছুই
বেলা- অবেলায়
পথ ভোলানো চোখ
রেখে গেছ তবু
বিকেলের শেষে
বুক কাঁপানো শোক।
শিরোনামহীন
রাত নীল হলে ম্লান হয় ফাল্গুনী আকাশ
গভীর প্রসারিত অন্ধকার পথ ধরে চলে
হাজার বছরের একবিংশ এক্সপ্রেস
মেঘের আড়ালে ঘুমিয়ে মেঘ
গাঢ় সবুজের বনে বিষণ্ন অনুরাগে
ঝুলে থাকে বেহুলার শাড়ি
রাত নীল হয় দু’চোখের বেদনায়
সরবে নীরব হয় বঞ্চিত বাসনার কুসুৃম।
প্রেমাংশু শ্রাবণ
বৈশাখে খুঁজে পাওয়া
বিচ্ছিন্ন সময় ডিঙিয়ে চিনেছি কিভাবে?
সে কথা না হয় থাক।
এই যে বৈশাখ সাজে সেজেছ তুমি
মেঘ রং আঁকা শাড়ি, নীল পাড়, কপালে ধোঁয়াটে ধূসর টিপ-চিবুকে রক্তমাখা দাগ,
ঠোঁটের মাঝখানটায় বিদ্যুৎ চমকানো হাসি,
চোখের ইশারায় না বলা কথা
যেন গুমোট মেঘের পূর্বাভাস।
এসবের পাশাপাশি -অরণ্য হারাবার আমন্ত্রণে
বৈশাখ সাজে সেজেছ তুমি।
বাতাসে উড়ছে চুল,
চুল উড়তে থাক
বুকের আঁচল খসে যাক বোঁটা থেকে
স্তনযুগলে শোভা পাক বিন্দু বিন্দু জলরাশি।
বৃষ্টি ধোয়া পদ্মপাতায় আটকে পড়া শিশির তুমি
তারপরও কি তোমাকে চিনবার অসুবিধা হবার কথা?
তোমাকে চিনেছে বকুল বৃক্ষ
নাদান প্রেমিক আমি
কোনও এক বৈশাখে চিনেছি তোমায়।
কপিল কুমার ভট্টাচার্য্য
মেঘের খেলা
মেঘের কাছে চাইতে গেলাম বারি তখন আমায় করে দিল আড়ি, তারপর চাইতে গেলাম হাওয়া বলল রেগে বন্ধ কর চাওয়া-
সব দিয়েছি তোমাদেরই মাঝে
নষ্ট করছো সবাই মিলে
সকাল বিকেল সাঝে,
প্রকৃতি তাই অনেক হয়েছে বিরূপ দেখাচ্ছে সে আজকে নিজের স্বরূপ,
মনের মাঝে অনেক ছিল আশ্ ঘটনা আমায় করল উদাস্।।
রুকসানা রহমান
তোমাকে খুঁজছি বৈশাখ
কেন বারবার ঘুমঘোরে তোমাকে ডাকি
কাক ডাকা ভোরে জেগে উঠি উতলা মন উদ্বিগ্ন চোখে পড়েছি কাজল
রাঙালাম ওষ্ঠ, লাল শাড়ি পরে পথে নেমে আসি, আমি কি?
তোমাকে খুঁজছি বৈশাখ।
আজ নাগরিক আয়োজনে তুমি প্রধান অতিথি!
টিএসসি চত্বরে ছুটে যেতেই দেখি দাঁড়িয়ে আছ তুমি!
আমাকে দেখে তুমিও ছুটে এলে ভিড় ঠেলে
আমার হাতে হাত রাখতেই আনন্দের বিহ্বলতার
অনুস্পর্শে ছুঁয়ে দিলে অপার মগ্নতা দু’পায়ে পরালে উষ্ণ নূপুর
বৈশাখ তুমি কি আমার এক পৃথিবীর সন্ধ্যা অনুরাগের সুরভিত নিরুপম সুর।
তবে কেন আজ মধ্যরাতে
কিসের আক্রোশে ডেকে আনলে ঝড় ঘোর
হৃদয়ে এঁটে দিলে মারণাস্ত্র
একি, মুখোশ খুলতেই চমকে উঠি হাজার বছর আগের
সেই তুমি, আবার এসেছ ফিরে? কাজল চোখের জলে ভেসে গেল সব মুগ্ধতার আবির
বেদনার কম্পিত ওষ্ঠে দখল করল সেই মেঘনাদ…
এ জনমে এসেও ভালবাসার বন্দরে
রয়ে গেল খাঁ-খাঁ-শূন্যতা।
কুন্তল দাশগুপ্ত
এলোমেলো
সিঁধকাঠি ব্যাকরণ গৃহস্থ জানে?
কোনখানে
সুরঙ্গমুখ
জানে কি সুলুক?
ভিতরের তালা
খোলা
কী এমন কাজ ডাকাতের!
ঢের
দূরে থেকে
কে কখন কাকে
লুট ক’রে নেয়
ন্যায়-অন্যায়
ভুলে,
কে বা বলে আর খুলে।
মেলে ধ’রে হলুদ খাতাটি
আপনার কাটা-ছবি সাঁটি
আর ভাবি
হৃদয় ঘরের চাবি
কে নিয়েছে তবে?
কবে?
কাজ নেই
সেই
হিসেবে
জানি ভুলে যাবে,
দেবে না ফিরিয়ে।
ফেরৎ চাইব গিয়ে?
ধুর! কে চায়?
জিম্মায়
আছে যার
হৃদয়ের ঘর
তার কাছে চাবি থাকা সুখ।
অসুখ
কে চায়
গোধূলি বেলায়?
হরফলীনা
ঘৃণা
করে।
বাইরে ও ঘরে
শতমুখে সখা-সখী জনে
প্রতিক্ষণে
নিন্দায়
জ্বলে যায়,
জ্বালায়
হরফলীনায়।
সে তখন
সোনামন
তিক্ততার আকাশ ছুঁয়েছে
ধুলোয় শুয়েছে
তার
আপনার
মেহগনি সুখ।
মুখ
ঢেকে হাসির আড়ালে
আবডালে
লুকোয় হৃদয়
মধুময়।
প্রেম জানে
দূরে থাকবার মানে—
আরও বেশি টান।
গান
গায়
জানাতে বিদায়
বিরহের ভ্রম
হৃদয় তখন।
দূরে গেলে
এত কাছে মেলে
অন্তর্লীণা!
ধারণা ছিল না।
এতটুকু ইশারায়
অনুভবে পাওয়া যায়
অনুখন।
বাতাস যেমন
দেখা না দিয়ে
থাকছে জড়িয়ে,
সেইমতো
আমিও তো
ছোঁয়া পাই।
আলো-অন্ধকারে যাই—
যাই উচ্চাবচে,
আনাচে-কানাচে,
অনর্গল কথা বলি
এগলি-সেগলি
ঘুরে ঘুরে—
অতি দূরে
যে রয়েছে আপন
মধুমতী মন
মধুক্ষরা,
ভরা
গ্রীষ্মে
জ্বলনের মাসে
ছড়াছড়ি চেতনা আমার
আপনার
মতো ক’রে
ভিতরের ঘরে
কুড়িয়ে, সাজিয়ে রাখে।
রামগিরি শিখরেতে
যেতে যেতে
জিতে নেয় মেঘ-মন।
আবডালে থাকা তার
হৃদয়ের ভার
ঘন হয়ে আসে
চিদাকাশে।
চোখের পাতারা
দিশাহারা
হয়ে যায়
চায়
অশ্রু প্রতিরোধ।
অবোধ।
ফোঁটায় ফোঁটায়
তারা ঝরে যায়
মৃত্তিকায়
যা আমার
একান্ত চরাচর।
কিশোরগঞ্জের ভরপুর বন্যায়
পেয়েছি তোমায়।
আমার আবাল্য সাথী
সমব্যথী।
বনলতা,
তোমার নীরবতা
কী বাঙ্ময়!
আজ মনে হয়,
কালকেতু বিষে
মিশে
তোমার সবুজ
অনন্ত অবুঝ
চেতনায়
খুন হয়ে যায়।
এখনও অরবে থেকে
আপন রক্ত মেখে
সেজে নিতে চাও!
চোখ বুজে তাও
মেনে নিতে বলো!
ছিন্নবৃন্ত আমি যে কাঙালও
তোমার।
নীল-সবুজের বাহার
এখনও গুঞ্জিত
তৃষিত
মননে অন্তর্লীণা!
চেয়ে দেখবে না!
কত ব্যথিত হৃদয়
তোমাকে স্বরূপে পেতে চায়।
হরফে হরফে আঁকে
চেতনার প্রতি বাঁকে
অমরাবতীর রূপ।
চুপ
ক’রে থেকে
ভাঙা তোমার রেণু মেখে
সুখে আছে কিনা,
হরফলীনা—
বুঝো আন্তরিক।
আমার চতুর্দিক
ঢেকে রেখো।
ভালো থেকো।
মতি গাজ্জালী
ঢাকের বাজনা
ঢাকের বাদ্য-বাজনা শুনি কান পেতে, যেতে যেতে
পথ হয় না শেষ- কেন রে ঢুলি ঢাক বাজাস, ঊর্ধ্বশ্বাস
আমার আরও ঊর্ধ্বমুখী- তুই বাজিয়ে সুখী, শুনে আমি দুঃখী-
এত পুরনো ঢাক, এখনও সবাক, ভাবতেই লাগে অবাক-
একটুও কী ফাটেনি ঢাকের চর্ম, ঢাকের কাঠি কী লৌহবর্ম!
দুহাত হয়নি তোর ক্লান্ত অবশ! তোর ছোঁয়া বুঝি মধুর পরশ!
সেই কবে থেকে দূরের ঢাক, করছে হাঁকডাক, আরেকটু দূরেই না হয় থাক!
ঢাকের বাদ্য-বাজনা আমার খুব প্রিয়। তবুও আজিকে লাগছে অপ্রিয়-
কানে লাগছে তালা, ঝালাপালা, তুই পালা, হবি কী তুই বৌয়ের ভাই শালা!
ধান বুনেছি, সঙ্গে বুনেছি স্বপ্ন। একটু কর সবুর, শীষে লেগেছে পাকা,
সোনালী ধানের শীষে তাকা, চোখ করিস না বাঁকা, কাটবার দে সময়,
ডাকলে আসিস, একটু দে আশিস, যদি পারিস ঢাকের বাজনা বন্ধ রাখিস!
গীতা চক্রবর্তী
লালন
লালনের ঘরে বালিহাঁস নিবিড় আশ্বাস
ছুঁয়ে দেখো কতটা বিছানো পৃথিবী ছায়া।
অন্তরীক্ষ খুঁজতে যেওনা, সব শূন্যতা।
এই তো বেশ যতটা ভেসে থাকি আপন বলে,
চোখের ওপর পলাশের রঙ মেখে, নাগরিক সুখে রাধা প্রেম।
উড়ে যায় শিমুলে কৃষ্ণচূড়ায় তখন বসন্ত চড়া রোদের দহন
প্রেমিক স্বভাব নিয়ে স্বপ্ন কেড়ে খায় কবিতা আঁকে শরীরে
পোশাকের নেই কোনো পার্বন অনন্ত পথচলা
নীরব চোখের জল ধেয়ে এসে পাথরের বুকে আছড়ে পড়ে।
তবুও লালন নিভৃতে চুপ থাকে।
🍁গল্প /১
প্রদীপ সেন
লাভ লেটার
দুপুর একটা। কেকা সবেমাত্র স্নান সেরে উঠোনে ভেজা শাড়ি সায়া ব্লাউজ তারে ঝুলিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় পা রেখেছে। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক আসে- কেমন আছো, মিমি?
চমকে ওঠে কেকা। পরিচিত কণ্ঠস্বর। ওই নামে একজনই ডাকতো ওকে – অম্লান। তবে কি…
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চমকে ওঠে কেকা। পেছনে দাঁড়িয়ে অম্লানই তো। এ বাড়ির ঠিকানা কীকরে পেল সে?
______________________________________________
তোমার পনেরোটা লাভ লেটার রয়ে গেছে আমার কাছে। এগুলো ফেরত দিতেই এসেছি। আমি ভারমুক্ত হলাম আর তুমি নিরুদ্বেগ। চুটিয়ে সংসার করো। অল দ্য বেস্ট।
______________________________________________
অম্লানের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে প্রেম ছিল কেকার। কিন্তু বড়ো মাইনের চাকরি করা বিজয়কে বিয়ে করে কেকা। অম্লান পরাজিত সৈনিকের মতো পিছে সরে এসেছে। আজ হঠাৎ কেন এসেছে সে? তার কাছে কেকার পনেরোটা লাভ লেটার রয়ে গেছে। ও-গুলো নিয়ে সে কেকাকে ব্ল্যাকমেল করবে না তো? কেকার সুখের সংসারে আগুন লাগিয়ে দেবে না তো?
পরাজিত প্রেমিক গুলিতে আহত বাঘের মতোই নাকি হিংস্র হয়ে ওঠে। তার ওপর অম্লান বেকার। এই সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন সে? এ সময়ে বিজয় বাড়িতে থাকে না জেনেই কি ডিল করতে এসেছে সে? ভয় আর ঘেন্না কেকার মনে জেঁকে বসেছে।
দু-পা এগিয়ে এসে অম্লান বলে – জানি কী ভাবছ তুমি? অতটা খারাপ হয়ত নই আমি। আমার হাতে সময় নেই। অনেক দূরে চলে যাচ্ছি চিরদিনের মতো। আর কোনও দিন দেখা হবে না আমাদের। তোমার পনেরোটা লাভ লেটার রয়ে গেছে আমার কাছে। এগুলো ফেরত দিতেই এসেছি। আমি ভারমুক্ত হলাম আর তুমি নিরুদ্বেগ। চুটিয়ে সংসার করো। অল দ্য বেস্ট।
কাঁধে ঝোলানো সাইড ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে কেকার দিকে এগিয়ে দিল অম্লান। বলল – এগুলো এক্ষুনি পুড়িয়ে ফেলো। আসছি। চলে যায় অম্লান।
কেকা চটপট প্যাকেট খুলে দেখল অম্লান মিথ্যে বলেনি। পনেরোটি চিঠিই আছে। সে দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসস্টোভ জ্বেলে চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলে। বড্ড হাল্কা মনে হলো নিজেকে। রান্না ঘরের দরজা ভিজিয়ে কেকা শোবার ঘরে ঢুকল। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। ওপারে বান্ধবী মালা। বলল – তোকে একটা স্যাড কাম গুড নিউজ দেওয়ার আছে রে। কী জানি তুই খবরটা কীভাবে নিবি! একটু আগে অম্লানের বাইক অ্যাকসিডেন্ট হয়। হি ওয়াজ স্পট ডেড।
থরথর করে কাঁপতে থাকে কেকা। মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায় ফ্লোরে। ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে সে। চোখ দুটো তার অবাধ্য হয়ে ছলছল করে ওঠে। 🦋
🍁কবিতা
তানজীর সৌরভ
গ্রাভিটির ওপারে…
তুমি ছেড়ে গিয়েছ আমার স্টেশন
এখনও বসে আছি- বাদামের ডালা, চিপসের ঝুড়ি নিয়ে
আমড়া, পেয়ারা, কামরাঙ্গার থালা সাজিয়ে
সময়ের ট্রেন এলে উড়ে যাব গ্রাভিটির ওপারে
এখনও সকাল আসে রোদ্দুরের কোলাহল সমেত
চাঁদ ওঠে রাতে; তারার মখমল মনে হয় আকাশকে
কারা যেন ওড়ায় প্রবারণার রঙবেরঙের ফানুস
কৃষ্ণ পূজার ধূপগন্ধী ছড়িয়ে আছে রাই মহলে
দেখো, স্টেশন মাষ্টারও তোমার কথা জিজ্ঞেস করে
কিছু বলি না; হেসে দিই এক খিলি পানের মতন
ট্রেন আসছে ট্রেন যাচ্ছে; জীবন যেন এক ক্রসিং খেলা
ঐ এলো দিশেহারা ঞ বগি; সিট নাম্বার পোনে এগারো
ঝিকঝিক ঝিকঝিক ধুকপুক ধুকপুক সময়ের কাঁটা
জানালায় কি অপূর্ব দৃশ্য, খেতের বাঁক, বাগানের আলোছায়া
জঙ্গলের মাথায় পাটে বসা সূর্য; তোমার অমলিন মুখ
যাচ্ছি প্রিয় পৃথিবী, যাচ্ছি চলে গ্রাভিটির ওপারে…
শ্রীমতী সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
নতুন বছরের আশা
একটু পরিবর্তন চায় যে মন
ভুলতে চায় গতানুগতিক জীবন।
তবু ভোরবলাটা হওয়া চাই
ঠিক ছেলেবেলার মতন।
সকাল থেকে রাত
সব কাজগুলো যেন হয় ঠিকঠাক।
সব ভালো যার শেষ ভালো
নতুন সূর্যোদয়ের পানে সব এগিয়ে চলো,
বছরের প্রথম দিনটা সবার কাটুক ভালো।
ভালোমন্দে সুখে দু:খে বোনা
আসুক এক নিশ্চিন্ত নতুন বছর।
হয়তোবা কোনো আশার আলো
আনবে বয়ে শিমুল পলাশ।
নতুবা প্রচণ্ড কালবোশেখী ঝড়ে
পড়বে ভেঙে যত তাসের প্রাসাদ।
নতুন করে গড়বে কত পাখির বাসা
দূরে ফেলে যত বেদনা ও নিরাশা।
অনেকেই উঠবে গেয়ে রবি ঠাকুরের সুরে
ঘরে ঘরে পাড়ায় পাড়ায় ঐ যে দূরে দূরে।
গাইবে সেই চেনা গান
“এসো হে বৈশাখ এসো এসো “।
আবু তালেব মোল্লাহ্
সমাপিকা পদাবলী
হিরণ মালা যে ছবি এঁকেছিল
এই সেই অড়হর ক্ষেত,
বৃষ্টিজল নেমে যাবার চিকন নালার পরে
আমবনে সামুদ্রিক গোরস্থান—
এইখানে দাঁড়িয়ে শব্দের ব্যঞ্জনায় ঘুম ভেঙে
বসে ছিল স্বপ্নের নক্ষত্রপাড়া:
ভাবতে ভাবতে ভাঙা রাস্তার শেষে
বাহন গতি বাড়ায়—দৃষ্টি যায় দূরে।
মোমবাতি প্রজ্বলন স্মৃতি মুখে
নির্মীয়মান ভবনের ছাদ ধ্বসে পড়ে,
দুর্ঘটনার অন্তিম যাত্রায় লেখা হয় সমাপিকা—
জানিনা কখন ফোনকল কেটে যায়।
মিতা দাস
মণিপুরের ইরোম
লোহা মোড়ানো মেয়ে,
তোমায় দেখলাম না তো!!
আশ্চর্য!!
মণিপুরের শর্মিলা!
তুমি কোথায়??
লোহা মোড়ানো মেয়ে, নারী
তোমায় এবার জলন্ত মণিপুরে
দেখলাম না তো!!
বোধহয় রাগ করে আছো
ওরা তোমায় ভোটে জেতায়নি বলে…
শুধু নব্বই টা ভোট পড়েছিলো
তুমি চেয়েছিলে মণিপুরের হাল ধরতে
ওরা দেয়নি
ভোট ও দিয়েছে মাত্র নব্বই
তুমি মণিপুরে নেই কিন্তু
তোমার প্রাণ তো মণিপুরের আটক
তাই আবার সেই চার মে’ র ঘটনা
আবার তোমায় নাড়া দিল
মণিপুরের চানু!
তুমি ফিরে এসো মণিপুরে
সেই দুই নগ্ন মেয়ে তোমায় আপ্রাণ ডাকছে
এসো লোহা মোড়ানো মেয়ে, নারী ও আবার এখন তো তুমি মা!!
হামিদুল ইসলাম
আজও ফোটে সূর্যমুখী
কথা ছিলো
কথার গর্ভে ছিলো খিদের আঁচড়
আজও বিশল্যকরণীর জলে ডোবে নগ্ন শরীর
বৃক্ষপুরুষ
নৈকট্য ভাঙতে পারে না ব্যবধান
বিষণ্ণতা এ ঘরে ও ঘরে
রক্তের মিছিলে সাজিয়ে রাখি রোদেলা দুপুর
অনাহুত কিংখাব রূপালী নগর
মন পোড়ে রোজ
হৃদয়ের ক্ষত পুড়ে পুড়ে উস্কে ওঠে আগুন
পোড়াতে পারে না কাঁটাতারের বেড়া। একুশের বিদিশা
হৃদয়ের ঈশ্বর
কথার ভুবনে কথা রাখি
তুমি এলে বৃষ্টি নামে। ফিরে আসে কেতকী রাত
সূর্যমুখী ফোটে
রক্তবীজে জন্ম নেয় আমাদের ঈশ্বর
রফিক আনম
সুন্দর, আপেক্ষিক দূরত্বে
দূর থেকে চাঁদ দেখো কতো অপরূপ
কাছে গেলে মাটি আর পাথরের স্তুপ
ধনহীন ভাবে শুধু সব সুখ ধনে
ধনী মরে কষ্ট কষে সুখ ভোগে অন্যে
অস্ত্রের অভাব পোষে- নিরাপত্তাহীন
অস্ত্রধারী চিরদিন অস্ত্রের অধীন
দূর থেকে মসনদ- মখমল শয্যা
দেখে দেখে লোক হাসে রাণী ঢাকে লজ্জা
ছোঁয়া পেলে খসে পড়ে লজ্জাবতী লতা
সবুজ সোনার অঙ্গ হারায় স্নিগ্ধতা
দূরে দূরে থাকো বন্ধু আরো দূরে যাও
দৃষ্টির বাইরে র’বো যদি সুখ পাও
পচে মজে মৃতপ্রায় থেমে থাকা নদী
মানুষ সুন্দর খুবি- দূরে থাকে যদি
জ্যোতির্ময় রায়
চন্দ্রটিপ
চাঁদটা গেল অন্ধকারে মিলিয়ে
ঝিনুকখোলা হাসি নিয়ে
প্রবাসী আলোয় তারারা আসে
অসংখ্য ঝলকে ভাসে
ওরা নিজেরাই জ্বলজ্বল
স্বমহিম প্রোজ্জ্বল
গাছপালা
নদীনালা
মাটি আর মরা
অন্ধকার ভরা
তারকা বলেই তো মাটি থেকে দূরে
নিজেরাই আছে তীব্রতার জোরে
দুধেল গাইয়ের সূঁচালো শিঙবাঁকা চাঁদ আসে চিলতে জ্যোৎস্না ভাসে
আবারও
মেঠোপথ ধরে সাজ
তারাগুলো উপরে আরো
যেন তাজ
নিঃশ্বাস-দূরে চাঁদ
মায়ের আহ্লাদ
চুমু খাই আহা
চন্দ্রটিপ তাহা!
সুব্রত চক্রবর্ত্তী
“এসো হে বৈশাখ”
এসো হে বৈশাখ –
নব রূপে নব সাজে
এসো বারেবারে নব তেজে,
এসো ধরাধামে
নতুনের আয়োজনে।
এসো হে বৈশাখ –
নিয়ে শান্তির বারতা
নিয়ে সুখের স্নিগ্ধতা,
ধ্বংস করো মহামারী
হানাহানি মারামারি।
এসো হে বৈশাখ –
নাশো হাহাকার দুর্ভিক্ষ
ঘুচাও সকল দুঃখ ;
কর হে পৃথিবী প্রেমময়
আজ মানুষেরে করো চিন্ময়।
এসো হে বৈশাখ –
দুর্বলেরে দাও শকতি
যেনো কভু নাহি করে আকুতি,
পাপ ক্ষয় হোক লভি পূণ্য
এ ধরণী হোক দ্যুতি পূর্ণ।
এসো হে বৈশাখ –
প্রখর খর তাপ দাহ
পুড়াও আবর্জনা গ্লানি সহ ,
নির্বাকেরে করো প্রতিবাদী কথা বলা
মধুময় হোক আগামীর পথ চলা।।
শারাবান তহুবা
বৈশাখ বেদনার জল
বৈশাখে ডালের আড়ালে ঝুলে আছে মায়াবতী মন।
প্রণয় উত্তাপে পুড়ে, ষোড়শী তরুণীর মতো উপচে পড়া শরীর,
বৈশাখের তপ্ত হাওয়া ভেসে নিয়ে যায় জীবনের স্বপ্ন যত…।
এভাবেই যুগ,বছর, ক্ষণ,দিন, মাস
ঘুরতে থাকে কালের চক্রে
বৈশাখ!! স্বপ্ন কাড়েনা শুধু…
প্রকৃতিকে দান করে দুই হাত ভরে।
বৈশাখের আগমনে ভরে ওঠে
বাংলার রূপ…
মাঠে মাঠে সবুজ ধানের সুখ সাঁতার কাটে
গাছে গাছে উঁকি দেয় রঙিন প্রজাপতি
বৈশাখ!! বেদনার জল বুকে নিয়ে উড়ে যায় দূর গগনে
ক্ষণিকেই ফিরে আসার…
ভয়াল তৃষ্ণা নিয়ে।
আশ্রাফ বাবু
রাজত্বের নববর্ষ
বাংলা নববর্ষ বাঙালির উৎসব
ঐতিহ্য মণ্ডিত কালের যাত্রাপথ,
উদযাপন আর রীতিতে নানা পালাবদল
অর্জন করেছে নবজীবনে বাংলার শপথ।
গ্রাম-নগর নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষ
হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান বাংলার উৎসব,
শতবর্ষ আগে থেকে বাংলার মানুষ
চিত্তে আনন্দে বিমোহিত এক মনোভাব।
রাজত্বের দিনগুলো চেতনার প্রতিফলন
বাংলা নববর্ষ অবলম্বন অনুষঙ্গে,
গভীর অভিঘাত লক্ষ করা হয়না
ঘোষণা করেছে দীর্ঘদিন এক সঙ্গে।
শাহী সবুর
পয়লা বৈশাখ
চৈত্র শেষে বৈশাখ এসে
সাড়া জাগায় সবার মনে,
বৈশাখ মেলায় ছুটছে সবাই
মন বসে না ঘরের কোণে।
বটের তলায় বৈশাখ মেলায়
রঙের জোয়ার চলছে বয়ে,
রঙবেরঙের পোশাক পরে
চলছে সবাই পুলক লয়ে।
বৈশাখ মেলায় রঙের খেলায়
আমজনতা উঠছে মেতে,
মিলন মেলায় এলো সবাই
একটুখানি শান্তি পেতে।
পান্তা ভাত আর কাঁচা মরিচ
খাচ্ছে বসে বটের তলে,
ঢোল তবলা কাশি বাঁশি
বাজায় সবাই দলে দলে।
বাঙালিদের পয়লা বৈশাখ
এ যেন এক প্রাণের মেলা,
বৈশাখ এলে ঘরে ঘরে
ভাসায় সবাই রঙের ভেলা।
শারমিন সুলতানা
নববর্ষের বন্দনা
নতুন বছরের খুশিতে আমি
নয়নে কাজল মাখি,
আলতা রাঙ্গিয়ে হাতে পায়ে
কোমর দুলিয়ে নাচি।
দুহাত ভরা চুড়িতে আজ
বিনুনি ঘুরিয়ে খেলি,
কানে ঝুমকো, গলায় হার
আঁচল উড়িয়ে মেলি।
এইতো আমি বেশ আছি
রাঙ্গিয়ে ঠোঁটের হাসি,
কপালে দিয়েছি লাল টিপ
কতো যে ভালোবাসি।
ফুলের মালা গুঁজে দিয়ে
সেজেছি কেশবতী চন্দনা,
সাদা লাল পেড়ে শাড়ি জরিয়ে
করেছি নববর্ষের বন্দনা।
🍁গল্প /৩
সুফিয়া শিউলি
অভিমান
তুমি আকাশ দেখেছো? আজ আকাশের পুব কোণে একটা তারা এখোনো জ্বলজ্বল করছে, দেখেছো?
এখনো? তবে সে তারা নয়; স্যাটেলাইট আলো!
কি হল তাতে, ধরেই নাও না, সে তারা, সে আজ তোমার আমার জন্যই জ্বলছে! জেগে আছে এই মধ্য দুপুরেও।
প্রথমত এই অসহ্য ঝলসানো দুপুরে আকাশে মুখ করা যায় না, চোখ পুড়ে যায় যেন রোদের ঝলকের অনুভবে। দ্বিতীয়ত আমাদের জন্য আজ কোনও তারা জেগে নেই। আছে শুধু মন ঝলসানো তপ্ত রৌদ্দুর।
তবে কি আর কোনও আশা বেঁচে নেই?
একটা সুযোগ… ঠিক দেখো বদলে দিবো নিজেকে। তোমার জন্য… শুধু তোমার জন্য গড়ে নিবো নিজেকে। তোমার এই তপ্ত ঝলসানো রৌদ্দুর সাক্ষী।
তুমি যেমন আছো তেমনি থেকো, শুধু তোমার নারী আবেগী বন্ধুদের সঙ্গে গা ঘেষে বসে সময় নষ্ট কর না। আমি চুলোয় ভাত চাপানোর অভাব মেনে নিতে পারি কিন্তু তোমাকে ভাগ কর্তে পারি না। যদি কোনদিন দেখি একা বসে আছো পরিতাপে, সেদিন না হয় আকাশের পুব কোণে তারাটা খুঁজে দেখবো।
আজও তো আমি ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা চাইছো কিন্তু মুখের অবয়বে কোনো পরিতাপের রেখাচিহ্ন নেই।
আমি উঠি, অনেকটা পথ। দিনের আলোয় বাস ধরবো।
ধীমান আর কিছুই বলল না। তিতিরের হেঁটে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকলো শুধু…।
_____________________________________________
আমার বুক ধক করে উঠেছিল তখন পবনের কথায়; প্যান্টের বাম পাশের পকেটের দিকে হাত বাড়িয়েও আবার হাতটা টেনে নিয়েছিলাম। কি হবে টাকার ব্যাগ চেক করে ; জানি তো সে এখন সাহারা মরুভূমি।
_____________________________________________
মাথার ওপর দিয়ে একটা কাক বিরহী সুরে কা কা করে উড়ে গেল।
মনে পড়লো সেদিন ধুম বৃষ্টি; নাহ…. না না না তুফান উঠে ছিল মনে হয়। আমি ছবিরহাটে বটগাছটার গা ঘেষে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম তোমার অপেক্ষায়। কথা ছিল সকাল সকাল চলে আসবে, কিন্তু এসেছিলে এগারোটার পরে।
আমি দুমাস আগে থেকেই কাজীর সাথে কথা বলে রেখেছিলাম এই দিনটির জন্য। অবশ্য কাজী আমার পরিচিত। ঠিক সরাসরি আমার নয়, পবনের কেমন যেন লতায় পাতায় আত্মীয়। পবনেই কথা বলিয়ে দিয়েছিল।
তারপর তুমি এলে যখন আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না, কী অসম্ভব সুন্দর লাগছিল তোমায়, সবুজ চিকন পারে সাদা তাঁতের শাড়ীতে তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর নারী যেন। খোলা চুলে বাম কানের কাছে দোলনচাঁপা, দু-ভুরুর মাঝে চেয়ে আছে একটি সবুজ বড় টিপ। দুপুর দুটোর মধ্যে আমাদের বিয়ের কার্যাদি শেষ হয়েছিল।
পবন বলল, কি রে তোরা বিয়ের খাওয়া দিবি না? চল পুরান ঢাকার বিরিয়ানি দিয়ে খাওয়াটা সেরে আসি।
আমার বুক ধক করে উঠেছিল তখন পবনের কথায়; প্যান্টের বাম পাশের পকেটের দিকে হাত বাড়িয়েও আবার হাতটা টেনে নিয়েছিলাম। কি হবে টাকার ব্যাগ চেক করে ; জানি তো সে এখন সাহারা মরুভূমি। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে। যা ছিল সে তো রেজিষ্ট্রেশন ফি দিতেই শেষ। খুব বেশি হলে রিকশা ভাড়াটা দিতে পারবো।
তোমার চোখে ফাকি দিতে পারিনি কিন্তু, ঠিক ফ্রেম বন্দী হয়েছিল আমার মুখের ভাবান্তর তোমার চোখে। তুমি পবনকে বুঝতে না দিয়ে আলতো করে আমার বাম হাতের তালুতে চাপ দিয়ে চোখে চোখে ইশারায় বুঝিয়ে ছিলে, ভেবোনা, আমার কাছে আছে।
স্বস্তির ঘাম ঝরেছিল আমার।
এই তো সেদিনের কথা, একটা ডিম ভেজে দুজনে ভাগাভাগি করে খেলাম। শার্টের উপরের দিকের বোতামটা বাইরে কোথায় যেন পড়ে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি, ঐভাবে অফিস করে বাসা ফিরতেই তোমার চোখে প্রথমেই বিষয়টি ধরা পড়ে গেল। সে কী রাগ তোমার! “এভাবে কেউ অফিস করে? তুমি লক্ষ্য করবে না? তোমার কি একটুও হুশ জ্ঞান নেই? বুকের ওপরটা একদম খোলা!
আমার খুব রাগ হয়েছিল সেদিন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে তুমি এত কথা বলছো কেন? বোতামটা বাইরে কোথায়ও পড়ে গেছে আমি দেখিনি; আমি দেখিনি, তো… কি হয়েছে? এটা কোন বিষয় হল!
তুমি আরও রেগে গেলে। “এটা কোন বিষয় না? খোলা বুক নিয়ে তুমি অফিস করলে, অফিসের সবাই সেটা দেখলো, তোমার মহিলা কলিগরা চেয়ে চেয়ে দেখলো তোমার বুক!
মানে? মানেটা কি? ওদের আর কোন কাজ নেই। ওরা সবাই কাজ ফেলে শুধু আমার বুকের দিকেই তাকিয়ে ছিল?
তাছাড়া আর কি!
এবার আমার হাসি পেল। তুমি কি পাগল? আমার মহিলা কলিগদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, শুধু তোমার হাজবেন্টের বুকের দিকেই তাকিয়ে থাকবে?
থাকবেই তো। তাকিয়ে থাকার মতোই তো আমার হাজবেন্টের বুক।
পাগল! তুমি সত্যিই আস্ত একটা পাগল! তারপর কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললাম, যদি তারা সবাই আমার বুকের দিকে তাকিয়েও থাকে তো আমি কি করতে পারতাম বল? তখন কি আর বাসা এসে শার্ট চেঞ্জ করে যাওয়া সম্ভব ছিল? ঢাকা শহরের জ্যামে যেতে আসতেই তো অফিস টাইম শেষ হয়ে যেত।
কেন আশেপাশে কোন কাপড়ের দোকান ছিল না। চট করে একটা কিনে পরে নিতে দোকানের ট্রেয়াল রুমে।
হা হা হা পাগল… পাগল বউ আমার… যা বেতন পাই একশত টাকাও বাড়তি খরচ করার উপায় আছে বল?
তখন তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে। “আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার মাথাটা যে কি হয় মাঝে মাঝে। সত্যি তো আমরা দুজনে যা আয় করি তা তো বাসা ভাড়া দিয়ে মাসের খরচই ঠিকঠাক হয় না। আর আজ এতকিছুর পরে তোমার কাছে সব ভুল হয়ে গেলো আমার একটা ভুলে! অতসীর মনে কি ছিল, কতদিন ধরে ছিল আমি যে সত্যিই জানতাম না; সেদিন পবনের বিবাহ বার্ষিকীর ঘরোয়া অনুষ্ঠানে পবন অতসীকেও ডেকেছিল, আমাদের কলেজের বন্ধু সে, তাই ডাকতেই পারে। অতদিন পর অতসীকে দেখে আমিও বেশ আবেগী হয়ে পড়েছিলাম। সেটা হয়তো আমার বড় ভুল হয়ে গেছে কিন্তু অতসী তো জানতোই না আমার বিয়ে হয়েছে! তাই আমাকে দেখে তার উচ্ছ্বাস, আবেগ, আমার দিকে অপলক চেয়ে থাকা, কাছাকাছি বসা কি দোষের হবে? হা আমি তোমার উপস্থিতি কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়ে কলেজ জীবনে ফিরে গিয়েছিলাম। তোমার সাথে পরিচয় করে দেবার বদলে অতসীর সাথে বেলকনিতে গল্পে বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। এটা আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু আমি বিবাহিত পুরুষ বলে কি পুরনো নারী বন্ধুর সাথে আলাদা করে কথা বলতে পারবো না? তোমার ক্ষেত্রেও তো এটা হতে পারতো? তবে হা অতসী তোমাকে জানার পর ঠিকমতো করে কথা বলতে পারেনি। কেমন বোকা বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গিয়েছিল। হয়তো এটাই তোমার মনে ক্ষত করে দিয়েছে, তাই বলে আমাকে এত বড় শাস্তি দিয়ে চলে গেলে?
তূমি চলে যাওয়ার এই সময়টুকুই আমার কাছে অজস্র দিন মনে হচ্ছে, তাহলে আর বাকি দিনগুলোতে কি করে থাকবো? না না না তোমাকে ফিরতেই হবে…। 🦋
🍁গল্প /৪
বিপ্লব সাইফুল
ক্ষুধা ও গোলাপের গল্প
শুক্কুর কোনোক্রমে দাঁতে দাঁত চেপে অন্ধকার ছিটকি ঝোপটার নীচে উপুর হয়ে থাকে। পায়ুপথ থেকে রক্ত বেড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে শুখনো মাটি। ব্যথা আর ভেজা অনুভূতিটা সে মাথা থেকে সরিয়ে দিতে পাশের শিউলি গাছটা থেকে ভেসে আসা ঘ্রাণে ডুবে থাকতে চেয়েও পারছে না। মজিদের শক্ত শিশ্নটা তার মনোযোগ বারবার শিউলির ঘ্রাণ থেকে ব্যথায় ফিরিয়ে আনছে। মজিদের মুখ থেকে একধরনের গোঁগোঁ শব্দ বেড়িয়ে এসে সন্ধ্যা পরবর্তী শিশু রাত্রির নীরবতায় কেমন বিভৎস বাগড়া দিচ্ছে।
এই ব্যথার ভেতর শুক্কুরের কেমন গা গুলাচ্ছে। বমির বেগটা চেপে রাখতে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলে হঠাৎই মজিদ দুইহাতে শুক্কুরের দুই কাঁধ চেপে ধরে শক্ত করে। তার গোঁগোঁ শব্দটা আরও তীব্র হয় আর মজিদের কোমরের উঠানামা এতো দ্রুত হয়ে যায় যে শুক্কুরের প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসে। এরইমধ্যে সে কোনও ক্রমে বলে, কাকা আর পারতাছি না।
মজিদ অনেকটা খেঁকিয়ে ওঠে, চুপ কর খানকির পোলা, পাঁচশো টেকার একটা আনাম নোট দিসি। বান্দির পুত গায়ে লাগে না!
_____________________________________________
এক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুক্কুরের দিকে। মায়মুনার এই দৃষ্টি শুক্কুরের ভেতরটা কেমন তছনছ করে দেয়। কিন্তু এই একটা হাত নিয়ে সে মায়মুনার জন্য কিছুই করতে পারে না। এই অক্ষমতা শুক্কুরকে ঘুণ পোকার মতো কাটে।
_____________________________________________
বলতে বলতেই মজিদ তার শরীর ছেড়ে দেয় শুক্কুরের ওপর। মজিদের স্খলন ঘটে গেলে শুক্কুর আর বমিটা আটকে রাখতে পারে না। শুক্কুরের বমিতে মজিদ তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে ওর কোমর বরাবর একটা লাথি ঝেড়ে বলে, যা মাগির পুত, ডোবায় নাইমা ধুইয়া ফালা।
ছিটকি ঝোপটা থেকে কিছুটা নিচেই নোংরা পানির ডোবাটা। শুক্কুর প্রায় গড়িয়ে গিয়ে ডোবায় নেমে যায়।
হিমশীতল পানিতে সে কিছুটা আরাম বোধ করলেও তার গা ঘিনঘিন করে পায়ুপথে হাত দিতে। সেই সঙ্গে একটা ভয়ও তাকে আটকে ধরে। সাপখোপ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবুও সে গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে মজিদ ডোবার কিনারে এসে ধুয়ে নেয় তার ন্যাতানো পুরুষাঙ্গ। মসজিদের মাইকে আযান ভেসে এলে। বাড়ির উঠোন থেকে মজিদের যুবতী মেয়ে আছিয়া বাবা বাবা বলে হাঁকডাক শুরু করে। সেই হাঁকডাকে মজিদ কেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, শুক্কুইরা পানিথন ওড।
শুক্কুর অনেকটা নিঃশব্দে উঠে এলে মজিদ বলে, প্রর্থমবার এর লাইগা এট্টু ব্যাদনা অইছে। ঠিক হইয়া যাইবো। কাইল আহিস। আমার এই বেডি মাগীগো দিয়া পোষায় না। ছোটকালের অভ্যাস। ছাড়ন তো যায় না। হোন শুক্কুইরা, দুনিয়ায় টেকার চাইতে বড় কোন বাপ নাইক্কা। এইডা মনে রাহিস। যা অহন। কাইল এশার পর আহিছ। আমার বাড়ির উঠোনে উঠবি না, নামা দিয়া যাগা। কথাগুলি শেষ করে মজিদ আর দাঁড়ায় না। শুক্কুর মাটি থেকে সার্টটা তুলে নিয়ে বাড়ির নামার অন্ধকার পথ ধরে হাঁটা দেয়। তার একটা হাত অসার হয়ে ঝুলে থাকে জীবনের ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে!
পথটা বেশ অন্ধকার আর ঝোপঝাড়ের নিচ দিয়ে। হাঁটতে অনেকটা কষ্ট হচ্ছে। শুক্কুর পা টিপে টিপে হাঁটছে। এই পথ ধরেই গ্রামের শেখ সীমানায় পৌঁছানো যায়। গ্রামের শেষ বাড়িটাই শুক্কুরদের। বাড়ি বলতে একচালার ছোট্ট একটা ঘর। দুজন মানুষের নিবাস। হাঁটতে হাঁটতে শুক্কুরের মায়মুনার কথা মনে পড়ে। আজ ওদের বিয়ের এক বছর। শুক্কুরের ডানহাতটা অকেজো আজ বহু বছর। চৌদ্দ পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত হাতটা ভালোই ছিল। তারপর হঠাৎই ওর হাতটা শুকাতে থাকে। অভাবের সংসার। চিকিৎসা হয়নি। একসময় হাতটা অবশ হয়ে যায়। বামহাতের জোরে কাজকাম পাওয়া মুশকিল। মায়মুনাও বিয়ের তিনমাস পর থেকে পঙ্গু হয়ে বিছানায়। মায়মুনার ভাই ঢাকায় রিকশা চালায়। তার বাসায় বেড়াতে গিয়েই অ্যাক্সিডেন্টটা হয় মায়মুনার। এর আগে মজিদের বাড়িতে কাজটাজ করতো মায়মুনা।
মায়মুনার মুখটা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে যায় শুক্কুরের। সেই শূন্য বুকে কোথা থেকে যেনো এক বিবাগী হাওয়া এসে দোল খায়।
শুক্কুরের জীবনে প্রেম ভালোবাসা বলতে এই মায়মুনাই। সেই মেয়েটাও অচল হয়ে পড়ে আছে আজ এতটা দিন। মায়মুনা আজকাল খুব একটা কথা বলে না। কেবল কেমন এক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুক্কুরের দিকে। মায়মুনার এই দৃষ্টি শুক্কুরের ভেতরটা কেমন তছনছ করে দেয়। কিন্তু এই একটা হাত নিয়ে সে মায়মুনার জন্য কিছুই করতে পারে না। এই অক্ষমতা শুক্কুরকে ঘুণ পোকার মতো কাটে। অভাবে অভাবে জীবন চলে গেলো। মায়মুনার চিকিৎসা হলে সে ভালো হতে পারত।
আজ ক’দিন ওদের চুলা জ্বলেনি। শেষ পর্যন্ত সে মজিদের কাছে যায় কিছু টাকার জন্য। মজিদ তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সন্ধায় ঘটে যাওয়া বিষয়টির প্রস্তাব করলে শুক্কুরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু ক্ষুধা বড় নির্মম!
হাঁটতে হাঁটতে শুক্কুর তাদের বাড়ির কাছে চলে আসে। বাড়ির উল্টো পাশে ছোট একটা বাজার। সে বাড়িতে না গিয়ে বাজারে যায়। একটা ব্রয়লার মুরগী কিনে। আধা কেজি পোলাও চাল কিনে। সাথে দশ টাকার গরম মসলা। আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী।
মায়মুনা পঙ্গু হওয়ার পর থেকে শুক্কুরই রান্নাটা করে।
বাজার থেকে বের হওয়ার পথে সে দেখতে পায় তাদের গ্রামের হারু অনেক ফুল নিয়ে যাচ্ছে। সে প্রথমে কিছুক্ষণ ফুলগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভেতর একটা বাসনা বলকায়। শেষ পর্ষন্ত সে হারুকে ডাকে, হারু ভাই এট্টু হুইনা যাও। হারু পিছন ফিরে শুক্কুরকে দেখে এগিয়ে এসে বলে, কিরে শুক্কুর ডাকলি যে?
শুক্কুর প্রথমে কিছু বলে না, তার চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে থাকে ফুলগুলির ওপর। পরে বলে, হারু ভাই এত ফুল দিয়া কি করবা?
হারু হাসে। তারপর বলে, ক্যান তুই জানোস না? আমাগো চুমকির আজকা গাঁয়ে হলুদ।
শুক্কুর আমতা আমতা করে বলে, হারু ভাই একটা গোলাপ আমারে দিবা?
হারু বলে, তুই গোলাপ দিয়া কি করবি?
একথায় শুক্কুরের মুখে একধরনের লজ্জা ফুটে ওঠে। সে লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বলে, মায়মুনারে দিমু।
হারু আর কিছু বলে না। হাসে। তারপর পলিথিনের ব্যাগ থেকে একটা গোলাপ বের করে শুক্কুরের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ফুলটা দিতে দিতে প্রশ্ন করে, ওই শুক্কুইরা তর লুঙ্গি ভিজা ক্যান?
শুক্কুর বলে, ডোবায় নামছিলাম মাছের লাইগা, পাইনাই।
এরপর হারু বলে, যা বাইত যা।
শুক্কুর বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। তার ভেতর তখন এক আজব জ্যোৎস্নার ঢল নামে।
সে ভুলে যায় তার ব্যথা আর অপমান! 🦋
🍁কবিতা
মিতা নূর
নববর্ষের ছোঁয়ায় সবার জীবন ভরে উঠুক আনন্দে সুখে
বৈশাখ মাসে আমার আম কুড়ানোর মেয়ে বেলা,
সেতো হারিয়ে গেছে কবেই,
সবার ভাগ্যে কি আর সুখের সময় থাকে,
গ্রাম ছেড়ে আজ শহর মুখী ভাতের অভাবেই।
কারোর জীবন স্বপ্ন ভাঙে,কারোর জীবন ফুল ফুটে,
তাই তো,
আম কুড়ানো ছোট্ট হাতে আজ ফুলের ঝুড়ি উঠে,
রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে,
শখের ফুল দশ টাকায় বিকিয়ে, দু’বেলার ভাত জোটে।
একেই বলে ভাগ্য, শহরের আপুরা,
এক বাটি ভাত খায় হাজার টাকার নোটে!
আহারে জীবন এগুলো আমার ভাবাটাও পাপ,
এগুলো তো শুধু ধনীর বিলাসিতা বটে!
ধীরে পায়ে আমার বেড়ে উঠা, অভাবের হাত ধরে,
বুকের জমানো স্বপ্ন গুলো মাটিচাপা দিয়ে,
কঠিন কংক্রিটের শহরে।
আমারও ছিল শখের, লালপেড়ে শাড়ি কানের দুল,
চোখে কাজল অভাগী কপালে, কালো টিপ,
ছিলো খোলা চুলে গাঁদা ফুল।
হারিয়ে গেছে সব, জীবনের বসন্ত আসার আগেই,
রোদ বৃষ্টি ঝড়,বটের ছায়ায় কাটছে শূন্য জীবন,
তবু বেঁচে আছি এটাই অনেক, খোলা আকাশের বুকে।
বুক ভরা শুভকামনায়,
নববর্ষের ছোঁয়ায় সবার জীবন ভরে উঠুক আনন্দে সুখে।
স্বপন কুমার ধর
নববর্ষের আগমনে
তপ্ত বাতাস দিচ্ছে আভাস,
আসছো তুমি ধেয়ে,
আম,তরমুজ,আঙ্গুর এ তাই,
বাজার যাচ্ছে ছেয়ে।
সেল্ এর বাজারে বাড়ছে যে ভীড়,
জামা-কাপড় সব কিনতে,
পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা তাই,
হাঁক ডাক দেয় বেচতে।
মিষ্টি দোকানে লাগছে যে ভীড়,
তোমারই আগমনে,
কুশল বিনিময়,আহারাদি সহ,
ব্যস্ত থাকবে পূজা-পার্বণে।
পুরোনো দিনের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে,
নতুন কে বরন করবো,
প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমরা,
এভাবেই এগিয়ে চলবো।
নূরুজ্জামান হালিম
বৈশাখী উৎসব এবং সম্রাট আকবর
স্যাটেলাইট ক্লিনিক বিক্রি করছেন একজন হকার
তার খুব ভোটের দরকার;
বিউটি পড়েছে বৈশাখী শাড়ী
লাল নকশি পাড়ি;
মনিষা সেজেছে খুব,
সুন্দরীদের থাকে নাকি
রূপের অসুখ!
বোশেখ জমবে কী খুব?
সরকারি কর্মচারী যত সুখে হাসফাস
সবার চোখে মুখে
ইলিশে মাছের হাসি,
তারা পেয়েছে বৈশাখী বোনাস;
চৈত্রের পান্তা নিয়ে বৈশাখে বসে আছে আছিয়া বিবি,
নুন আর লংকার সাথে
হরেক রকম তিতা,
যেন সংসারে আগত বছর জুড়ে তেতো স্বাদের প্রস্তুতি।
কৃষক কিনছে কীটনাশক,
তার নেই পহেলা বৈশাখ
ক্ষেতে ধরেছে মড়ক,
পাড়ায় টানাটানির মহামারী,
তালেব মাস্টার আর
পহেলা বৈশাখ করবে না
বোশেখ কেমন যেন,
রাজার মত হয়ে গেছে
বছর কয়েক ধরে-
নববর্ষের শোভাযাত্রায়,
জুটেছে নতুন ছক্কা,
স্বপ্নের বৈশাখীও চলছে দূরে দূরে।
“বৈশাখের বিশ্বায়ন” নিয়ে টেলিভিশনে
এসেছেন সম্রাট আকবর
আর আবু তালেব মাস্টার
টেলিফোনে একজন মোল্লা সম্রাটকে প্রশ্ন করেছে–
বৈশাখী কী হিন্দুয়ানী উৎসব?
সম্রাট হাসছেন !
এরপর-
একজন বেসরকারি মাস্টার বেক্কলের মত প্রশ্ন করলেনঃ
“জাহাপনা বৈশাখী ভাতার কী খবর?”
এবারো সম্রাট আকবর হাসলেন,
তারপর আবু তালেব মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
“মাস্টার তোমরা চিরদিন,
বেক্কলে থেকে গেলে-
আমি তো তোমাদের কাছে খাজনা নিব বলেই এসেছিলাম
বোনাস দিব বলে তো নয়।”
মমতা রায় চৌধুরী
নিরবিচ্ছন্নতা
চৈত্রের পাতা ঝরার বিকেল যখন শেষ হয়
গাজনের হর হর হর মহাদেব সুরে
মন ভেসে যায় সেই গ্রাম বাংলার ভিটেতে
যেন ভাটিয়ালির সুরে তার বাঁধা থাকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে।
আকন্দ ধুতরার ঘ্রাণ মেঠো বুনো একরাশ মাতাল মোহময় উগ্রতা
আম ,জাম, কাঁঠাল ,বটের ছায়ার হিম শীতলতা
আমাকে পাগল করে এই দিনগুলোর হাতছানি।
শহুরে সভ্যতায় অভ্যস্ত হয়েও এক নিরবচ্ছিন্ন টান
একরাশ বনকলমির পেলব ইশারা আঁকড়ে ধরে
ফিরে যাই বারবার সেই গাজনের সন্ধ্যায়।
মা ,দিদা -ঠাকুমার স্নেহময় হাতখানির পরশ পাই
বনচালতা, লাউ আর লঙ্কা মরিচের গন্ধে।
তবুও কোথায় যেন এক ফাঁক রয়ে যায়
নাগরিকতার ছোবল বসেছে গ্রামীন সভ্যতাতেও।
তবুও এক নিরবচ্ছিন্ন টান প্রজন্মের পর প্রজন্ম যন্ত্রণাকে চেপে রেখে ছুটে যাই নববর্ষকে স্পর্শ করে নবীন প্রাণে আনন্দে মেতে উঠতে।
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
গোপন ভাঁজ
মন খারাপের পৃষ্ঠাগুলো ভাঁজ করে রাখার পর
বড় বেশি একা হয়ে যাই-
কুলুঙ্গিতে কঁকিয়ে ওঠে, সতেরোর কৈশোর
বঙ্গলিপিতে চুরিয়ে লেখা প্রথম প্রণয়
পড়ে রইল কলেজ ক্লাস গ্যাপ দেওয়ার বেতান্ত
সাইকেল চড়ে তোকে নিয়ে সটান হাজারদুয়ারি
মশগুল দুপুরে আমি তখন তোর অবাধ্য সিরাজ
তুই বসরাই গোলাপ হাতে আমার ষোড়শী লুৎফা
তারপর মনে নেই, অপমানের সন্ধ্যা
মায়ের কাছে জ্যোৎস্না নিঙরানোর গল্প শুনিয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আমার অবুঝ কন্দরে
ঘুম ভাঙতে শরীর জুড়ে জেগে উঠেছিল যযাতি অন্ধকার…
🦋অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জাতিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
