Sasraya News

Thursday, May 15, 2025

Sahaj Path : সহজ পাঠ-কিছু লেখাপড়া, কিছু গল্পগাছা 

Listen

রবীন্দ্র জয়ন্তী 

তীব্র কোনও কল্পনা না মণ্ডিত করে অবিচ্ছিন্ন জীবনের ধারাপাত পড়ে যান। পড়লে আরও বিনোদন-অনুপযোগী দৃশ্য দেখার চোখ তৈরি হয়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখলে নেতিবাচক বলে কোনও অভিজ্ঞাকে বাতিল করা চলে না। কল্পনার মনকে সহজ পাঠ হয়তো বা এড়িয়ে চলেছে, এমন মনে করাও চলে না। কল্পনার প্রতি ফুলবনে রবীন্দ্রনাথ যে অক্লান্ত ঘুরেছেন, তা সহজ পাঠে আবির্ভূত হয়েছে অজস্র ধারে, বিবিধ প্রকারে। লিখেছেন : তন্বী মুখোপাধ্যায় 

 

‘সহজ পাঠ’ এককথায় গল্পগাছায় লেখাপড়া।একেবারেই প্রথমে আমাদের শিখতে হয় বাস্তব দিয়ে। অথচ শিশুসাহিত্যে কল্পনারই প্রাবল্য। সহজ পাঠ-এর চারটি ভাগে যে-সব গদ্য-পদ্য সাজানো রয়েছে, তাতে বিশেষভাবে বাস্তব জগৎ ধরা পড়েছে। সহজ পাঠের আঁকায় লেখায় সবেতে। ‘ছোটো খোকা’ শব্দে শুরু হয়েছিল প্রথমভাগ, ‘শান্তিনিকেতন’ নিবন্ধের ‘…জানতে শিখবে’ শব্দ দুটোতে তারই চতুর্থ ভাগ শেষ হল। একপক্ষে ছোটোদের ভাষা শেখানো, সাধারণ জ্ঞান লাভ করানোর লক্ষ্য থাকলেও আর এক পক্ষে কিন্তু ছিল সকলের শিক্ষার সময় মনকে সরস ও সজীব করার উপযুক্ত বিষয় কিছু নির্বাচন করা, তথা সেই বিষয়গুলি ব্যক্ত করার বৈশিষ্ট্যে আমাদের চলমান জীবনের সজীবতা পরিবেশন। অথবা বলা ভালো, জীবনে সজীবতা সঞ্চার। আর সাহিত্যের লাবণ্য, সুচারুতার সঙ্গেও পরিচয় ঘটানো। বিচিত্র ও বিচিত্রতর দাবি, এক পাত্রে এই সাঙ্কর্য ধারণ করার বৃত্তান্ত– সহজ পাঠ।

ছবি : সংগৃহীত ছবি

 

 

রবীন্দ্রনাথ প্রায়শই গল্প লিখেছেন ছন্দে, আর তার পার্থক্য বুঝতে দেননি। তাছাড়া ভূগোল বিজ্ঞানের অবাক করার ক্ষেত্রগুলি সহজপাঠে সহজ এবং চিত্তগ্রাহী ভাষায় এমনভাবে লেখা হয়েছে। কৌতূহল বরাবর বজায় থাকে, শিক্ষকতার সজোর চেষ্টা নেই, বরং আছে আনন্দের উপাদান জুড়ে দেওয়ার ইচ্ছা।গাছ, কুকুর, গণ্ডার , মাকড়সা, শিশির, কুয়াশা, এসব ছোট-বড়ো বহু বিষয় নিয়ে রচনায় গাল্পিক রস এক-আধটুকু থেকে গেছে, এমনই ছিলো শান্তিনিকেতন আশ্রমের পড়ানোর আদর্শ। সহজ আর মধুর করে দেখিয়েছেন লেখক ‘গাছের বীজ কী ক’রে ছড়ায়’।

 

সহজ পাঠের প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগে শুধুই ঘটমান সাংসারিক পৃথিবীকে রবীন্দ্রনাথ বিস্তর আকারে-প্রকারে টানটান করে মেলে দিয়েছেন, ভাঁজে ভাঁজে থাকা অন্তরাল আর নেই, অজস্র আলো পড়েছে গতিময় জীবনযাত্রার প্রায় সবখানে। অনুপুঙ্খ অথচ বাহুল্যবর্জিত জীবনচিত্র। প্রথমভাগের প্রথম পাঠের আগে অক্ষর-পরিচয়ে ‘য়’, ’ৎ’, থেকে ‘চন্দ্রবিন্দু’ পর্যন্ত না থাকলেও ‘ক্ষ’ আছে। প্রয়োগের বৈচিত্র্য উন্মোচন করে অক্ষর চেনানো হয়েছে, জীবনশৈলিও। প্রতি দুই পঙক্তির লেখায় কিছু চেনা ক্রিয়ার পদ। ‘বলা’ কওয়া’ দিয়ে শুরু হয়েছে খুব সরলভাবে, এবার বাংলার কাজের সরণীতে বেশ কিছু নিজস্ব প্রয়োগ, ‘বসে খায়’, ’ডাক ছাড়ে’ ‘হাঁক দেয়’। সকর্মক ব্যবহারে চালচিত্র চলমান হয়েছে; বাক্য ক্রমান্বয়ে বড়ো। ‘জেলে-ডিঙি চলে বেয়ে’, “চোখে তার লাগে ধোঁয়া’,’বোঝা নিয়ে হাটে চলে’ বা ‘সারা দিন ধান কাটে’ এই উদাহরণগুলো নানা কাজের মধ্যে ক্রমশ পাঠককে এনে ফেলে। প্রথম পাঠে কর্মস্রোতে মিলের খানিকটা সজ্জা-পড়তে সোজা, দুলে দুলে পড়ার কথা ভেবেই হয়তো বা লেখা, আর আছে সক্রিয়তার নিরীক্ষা। ‘পাখি বনে গান গায়।/মাছ জলে খেলা করে। /ডালে ডালে কাক ডাকে।/খালে বক মাছ ধরে।‘ একটি ছবিতে বনে বাঘ, জলে মাছ, গাছে পাখি দেখা গেছে। ঠিক ঠাক থাকলেও একফোঁটা কোনও অতিরেক নেই। এরকম সর্বজনগ্রাহ্য।
প্রথমদিকে আরও কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। কর্তার ব্যক্তিনাম এসেছে কাজ করার ব্যাকরণগত ভাষ্যের প্রয়োজনীয়তা কমে গিয়েছে। নাম টম ডিক হ্যারি নয়,  রীতিমত সশরীরে সপদবি অবতীর্ণ হয়ে ‘মধু রায় খেয়া বায়।‘ বাকিরাও কেউ অচেনা নন, পরিচয় তথা আত্মীয়তা আছে সকলের সঙ্গে- যেমন- ‘’পাতু পাল আনে চাল, দীননাথ রাঁধে ভাত, গুরুদাস করে চাষ’ প্রভৃতি। এই প্রথম শুধু ছন্দোমিলেই নয় নাম- পদবিধারী ব্যক্তিরা বিষয় হয়ে অন্যের জীবনের পাতা ওল্টানোর আগ্রহ জাগাচ্ছেন। গল্প যেই হবে এই পদবিধারি ব্যক্তিরা পরিণত হবেন তার বিশুদ্ধ চরিত্রে।
দৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্য মিলে যেতে থাকলো, পদ্যের ছন্দেও গদ্যের কৌতূহল ব্যাপ্ত করা সম্ভব হয়েছে। প্রথমে ছায়ায় অবগুন্ঠিতা পাড়া, বধূভাব তাতে আরোপ করা, ছবির মতো পাড়ার গহনতা ধীরে ধীরে উপলব্ধ, পাড়ার থেকে কিছু আলাদা তালবন ঘেরা দিঘি, কিন্তু পাড়ার সকলের কাছের সরু গলি, হরি মুদির দোকান, একটু–আধটু বিশেষত্বের চিহ্নও রয়েছে, ঢেঁকিতে বুড়ি এ পাড়ায় ধান ভানে, সকালবেলায় মা-ছেলে গোরু দোয়, কানাই-বলাই সর্ষে–কলাইয়ের টাল দেয়, বড়ো মেজো দুই বউ ঘুঁটেও দেয়।এই গ্রামের পাড়াজাত চিত্র পাওয়া যায় খুঁটিনাটি প্রায় ধরে ধরে।
প্রথম ভাগেই আস্তে আস্তে এলো গল্পের মুখ্য টান, আরো গভীর আঁকিবুকি। কিছু অবাক করার উপাদান থাকলো তাতে। টিয়েপাখি কথা বলে, ওড়ে না। তার পায়ে বেড়ি। “ও আগে ছিল বনে। বনে নদী ছিল, ও নিজে গিয়ে জল খেত।“ এই পাখি পোষার গল্প, কেননা এখানে একটি প্রাণীর জীবনের খাতবদলের বিশেষ বিবৃতি আছে। নৈসর্গিক অনুভূতিও বিস্তারিত লেখা হয়েছে। “বেলা হল। মাঠ ধূ ধূ করে। থেকে থেকে হূ হূ হাওয়া বয়। দূরে ধুলো ওড়ে।” জ্ঞানের কথা নয়, আস্তে আস্তে মনে স্থান পায় অনুভবের স্পষ্টতার কথা। প্রতিটি বাক্য ধরে ধরে বোঝার জগৎ না- বোঝার জগতের চেয়ে বেশি হয়ে উঠতে থাকে। শিক্ষা বলতে আমরা সাদামাঠাভাবে এটাই বুঝি।
নানারকম ঋতুর ছবি। বাদলার মেঘই কত রকম।যেমন- “বাদল করেছে। মেঘের রং ঘন নীল।“ আবার, “পূর্ব দিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো। পশ্চিম দিকের মেঘ ঘন নীল।” এমন কী, পরমুহূর্তেই মনে হয়, ”হঠাৎ কীসের মন্ত্র এসে/ ভুলিয়ে দিলে এক নিমেষে বাদল-বেলার কথা।/হারিয়ে-পাওয়া আলোটিরে/ নাচায় ডালে ফিরে ফিরে/ ঝুমকো ফুলের লতা।।“ কখনও ‘রৌদ্র ঝাঁঝাঁ করছে’,কখনও শীতের বেলা , কখনও ফাল্গুন মাস। তার সঙ্গে মিলিয়ে এসে যায় বিবরণী। পদ্যে ও গদ্যে তা একই-রকম গতিচঞ্চল।অবিশ্বাস্য এই কথননিচয়ে কিছুই নতুনত্ব থাকে না থাকে শুধু প্রবাহে বিশ্বাস।সবই বিশেষপ্রকারে ঘটমান।বিশেষ যুক্তাক্ষরের শব্দ শেখানো চলতে থাকে প্রায় পরোক্ষে।উচ্চারণে গুরুত্ব দিয়ে ‘রঙ’ হয় ‘রং’, সহজের টানে ‘সঙ’ হয় ‘সং’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি : সংগৃহীত

আমরা সকলে কি সদাসর্বদা লক্ষ্য করি যে রোদ পড়ে এলে দলে দলে কাকেরা পুবের অন্ধকারপানে তাকিয়ে ডাকে? মামুলি তো বটেই এমন কী ম্রিয়মান করা পরিস্থিতি, তাও সব বিশদ করার দাবিতে আসে,  বর্জিত নয় জীবন-যাপনের কোনও টুকরো ভাগই।যতটা লেখক দেখেছেন, ততোটাই লিখতে দায়বদ্ধ থেকেছেন, এইভাবে- গোটা দিকচিহ্নিত এক- একটি সময়ের কথা বলা হয়েছে। সোজা সরল চোখে আগে দেখতে পেয়েছি কি বন্যায় ‘বেচারা গোরুগুলোর বড়ো দুর্গতি। এক হাঁটু পাঁকে দাঁড়িয়ে আছে । চাষীদের কাজকর্ম সব বন্ধ… পাড়ার নর্দমাগুলো জলে ছাপিয়ে গেছে… ইত্যাদি। তীব্র কোনও কল্পনা না মণ্ডিত করে অবিচ্ছিন্ন জীবনের ধারাপাত পড়ে যান। পড়লে আরও বিনোদন-অনুপযোগী দৃশ্য দেখার চোখ তৈরি হয়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখলে নেতিবাচক বলে কোনও অভিজ্ঞাকে বাতিল করা চলে না।
কল্পনার মনকে সহজ পাঠ হয়তো বা এড়িয়ে চলেছে, এমন মনে করাও চলে না। কল্পনার প্রতি ফুলবনে রবীন্দ্রনাথ যে অক্লান্ত ঘুরেছেন, তা সহজ পাঠে আবির্ভূত হয়েছে অজস্র ধারে, বিবিধ প্রকারে। কখনও যেন প্রায় স্বতঃসঞ্জাত, কখনও শব্দশিক্ষার সঙ্গে অনুপ্রাসজড়িত হয়ে এলেও মহারাজ হংসরাজ সিংহ-এর পরিচয়ে যখন বিবৃত হয় যে ‘তিনি পাংশুপুরের রাজা’, তখন ‘পাংশুপুর’ নামের কল্পনার সঙ্গে একটা চমৎকৃতি মিশে থাকে। আনন্দবাবুর অভ্যর্থনা আতিথ্যের নির্দেশ দিতে গিয়ে অভিনবভাবে উপস্থিত হয়েছে এক অন্ধ গায়ক। এমন একটা বনের ধারে কুটির তৈরির কল্পনা করা হয়েছে, যেখানে বাঘ- ভাল্লুক- রাক্ষস আসবে না; শুধু আসবে নিরীহ হরিণ, অপরূপ ময়ূর, কলগুঞ্জন করা শালিখ, আদুরে কাঠবেড়ালি। ফাঁক পূরণের এই চলনসই কল্পনায় মায়াসৃষ্টি।

ছবি : সংগৃহীত

আরও আছে কবিতায় স্বপ্ন। স্বপনের গল্পের শুরু ও ইতি।–বলার রকম-সকম গল্পের মতো।– অথচ কী ঘটে কী স্বপ্নে মনে হয় তার ব্যবধান লক্ষ করতেই হয়।
“আমি বলি, কাকা মিছে করো চেঁচামেচি,
আকাশেতে উঠে আমি মেঘ হয়ে গেছি।“
সব স্বপ্নের শেষ ঘুমে তলিয়ে হয় না, এখানেও হলো না।
-“যেমনি এ কথা বলা অমনি হঠাৎ/ কড়কড়্ রবে বাজ মেলে দিল দাঁত।/ভয়ে কাঁপি, মা কোথাও নেই কাছাকাছি-/ ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি বিছানায় আছি।“ নিছক ভাবনার কথাও ধরা দেয়। সেখানে বিষয় গদ্যের, মূর্তি পদ্যের।–
“আমি ভাবি ঘোড়া হয়ে মাঠ হব পার।/ কভু ভাবি মাছ হয়ে কাটিব সাঁতার।/ কভু ভাবি পাখি হয়ে উড়িব গগনে ।/কখনো হবে না সে কি ভাবি যাহা মনে।“
পরের ভাগে গল্পের আকার তৈরি হয়েছে। আগের পর্বে যা ছিল নেহাত পরিমিত, তাই হয়ে উঠলো সমন্বিত কাঠামো।শক্তিবাবুর আক্রমকে নিয়ে বন্দীপুরের বনে বাঘ মারতে যাওয়ার কাহিনী রীতিমতো বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা হলেও তাতে গল্পের বাঁক সুবিন্যস্ত করা হয়েছে।ছোটো ছোটো বর্ণনা দিয়ে গল্পের সন্ধি ভরানো হয়েছে-“… গাছের গুঁড়ির সঙ্গে চাদর দিয়ে নিজেদের বাঁধলেন, পাছে ঘুম এলে প’ড়ে যান।কোথাও আলো নেই। তারা দেখা যায় না। কেবল অসংখ্য জোনাকি গাছে গাছে জ্বলছে।“ কাঠুরিয়াদের সহৃদয়তা মনকে স্নিগ্ধ করে। ডাক্তার বিশ্বম্ভরবাবু আর তাঁর অসমসাহসী চাকর শম্ভুর ডাকাতের মোকাবিলা করার ঘটনাও মনে হয় অসম্ভব কিছু নয়। তবু শিক্ষার জন্য সহমর্মিতার দিকটি উল্লেখ্য।ভয় যেই মাত্র কাটলো আহত ডাকাতদের চিকিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন বিশ্বম্ভরবাবু।এরকম সত্যি আর গল্পের মাঝামাঝি আছে উদ্ধবের মেয়ের বিয়ের কাহিনী।ভূস্বামী অন্যায় করে উদ্ধবকে পীড়ন করলেও দুর্লভের পিসি কাত্যায়নী ঠাকরুণের ন্যায়পরতা ও বদান্যতায় গরিব উদ্ধবের মেয়ে নিস্তারিণীর বিবাহ ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে।নিটোল গল্প নয়, তবু গল্পের চরিত্রগুলির অভিনবত্বে গল্পের স্বাদ জমাট হয়েছে। অন্ততঃ দুর্বলের প্রতি হওয়া অন্যায়ের সাধ্যমতো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করাও সাধুবাদের যোগ্য। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও চলে।
সহজ পাঠের তৃতীয় চতুর্থ ভাগে গদ্যপাঠ লিখেছেন বহু মনস্বী লেখক।নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামীর ‘সর্দার মশাই’, উপেন্দ্রনাথ দাস লিখিত ‘শহুরে ইঁদুর ও গেঁয়ো ইঁদুর’,’কচ্ছপের কাণ্ড’; ক্ষিতীশ রায় মহাশয়- কথিত ‘তেলে ও জলে’, ‘মেঘমালা”,‘দুর্মুখ’, ’সোহরাব-রুস্তম’; তনয়েন্দ্রনাথ ঘোষের ‘জয়তিলক”; নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “প্রজাপতি” এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আব্দুল মাঝির গল্প’, ‘গেছো বাবা’ প্রভৃতি আকারে প্রকারে স্বাদে প্রযত্নে গল্পই। ‘গেছো বাবা’ নাটকাকারে লেখা, নাট্যসন্ধিৎসাসমৃদ্ধ।বাকি লেখা নানা রূপ চিন্তা ও আঙ্গিকবুদ্ধিতে অনুলিপ্ত। অনেকগুলি লেখায় রূপকথা সুলভ চালচিত্র ও কল্পনা এসেছে, যেমন-প্রজাপতি- ‘সত্যিকারের রূপকথা’।অপরূপ তার আবহ, অপরূপ তার বেদনা, অথচ তাতে আছে যুদ্ধ, পরাজয়,ক্ষয়, ক্ষতি,রাজপুত্র রাজকন্যার বন্ধুত্ব ও বিচ্ছেদ।‘মেঘমালা’ ও তদ্রূপ। মেঘলোকের রাজা অম্বুদরাজের মেয়ে মেঘমালা ও বরুণদ্বীপের রাজার ছেলে অর্ণবের বিবাহের পরিবৃত্ত। চমক কল্পনার দ্যুতিতে, বাক্যের অলংকৃতিতেও।–“রাজার আদেশে শ্রাবণ-পূর্ণিমার রাত্রে বিয়ের দিন স্থির হল। সেদিন কী ঘনঘটা। এ দেশ থেকে, ও দেশ থেকে মেঘের দল ভিড় ক’রে এল; কারও হাতে বিদ্যুতের মশাল, কেউ-বা গুরু গুরু শব্দে মাদল বাজিয়ে সারা আকাশ মুখর করে তুলল’।
নীতিগল্পও তৈরি হয়েছে।বাঁদররা মানুষের খাদ্য গাব ফল খেতে গিয়ে পড়ল বিপদে। মার খেয়ে তাদের শিক্ষা হল, সর্দারের উপস্থিতবুদ্ধিতে তারা কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে ফিরে এলো যখন তারা সর্দারের বাধ্য হলো। শহুরে ইঁদুরের সঙ্গে ভোজ খেতে গিয়ে গ্রামের ইঁদুরও বিপদে পড়লো- গেঁয়ো ইঁদুর মনে করেছে-“এমন ভয়ে ভয়ে প্রাসাদে থেকে রাজভোগ খাওয়ার চেয়ে আমাদের গোলাবাড়িতে নিশ্চিন্ত মনে কলাই আর বাসি পিঠে খাওয়া অনেক ভালো।নমস্কার বন্ধু, তোমার শহরের ভালো নিয়ে তুমি থাকো। আমি গাঁয়ের ইঁদুর, গাঁয়েই ফিরে যাচ্ছি।‘কচ্ছপের বাচালতা ও চাঞ্চল্য তিরস্কৃত হয়েছে। কখনও নির্লোভ হ’তে বলা হয়েছে তো কখনও নির্ভয়।‘ভয়’ যদিও কবিগুরুর একটি কবিতা, আসলে এটির উদ্দেশ্য নৈতিক। এতে এক ভীতুর গল্প ছড়ায় বলা। ‘ভয়’ যদিও কবিগুরুর একটি কবিতা, এতে এক ভীতুর গল্প ছড়ায় বলা। ভয়কে লজ্জা পাওয়াতে চেয়েছেন কবি, বিষম ভীতুকে নির্মম উপহাস করেছেন।সে ভীতু লোকটির আচরণ গল্পগাছায় মজা করে বলা।কীসে সে না ভয় পায়!- “দিনের আলোতে ভয় সামনের দিঠেতে, / রাতের আঁধারে ভয় আপনারি পিঠেতে।”

সহজ পাঠ, দ্বিতীয় ভাগ। ছবি : সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ প্রায়শই গল্প লিখেছেন ছন্দে, আর তার পার্থক্য বুঝতে দেননি। তাছাড়া ভূগোল বিজ্ঞানের অবাক করার ক্ষেত্রগুলি সহজপাঠে সহজ এবং চিত্তগ্রাহী ভাষায় এমনভাবে লেখা হয়েছে। কৌতূহল বরাবর বজায় থাকে, শিক্ষকতার সজোর চেষ্টা নেই, বরং আছে আনন্দের উপাদান জুড়ে দেওয়ার ইচ্ছা।গাছ, কুকুর, গণ্ডার , মাকড়সা, শিশির, কুয়াশা, এসব ছোট-বড়ো বহু বিষয় নিয়ে রচনায় গাল্পিক রস এক-আধটুকু থেকে গেছে, এমনই ছিলো শান্তিনিকেতন আশ্রমের পড়ানোর আদর্শ। সহজ আর মধুর করে দেখিয়েছেন লেখক ‘গাছের বীজ কী ক’রে ছড়ায়’।–“…তাই গাছকে বাঁচতে হলে চাই মাটির রস, বাতাস, আর আলো। সুস্থভাবে বাঁচতে গেলে এ তিনটি জিনিসই গাছের যথেষ্ট পরিমাণে দরকার। এই তিনটি জিনিস নিয়ে নিজেদের মধ্যে যাতে কাড়াকাড়ি মারামারি না করতে হয়, তাই যেন সব গাছেরই চেষ্টা ফাঁকা জায়গায় থাকবার। …গাছেরা কিন্তু একবার যেখানে জন্মায় সে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে পারে না। তাই যেন তারা গোড়াতেই সাবধান। বীজ- অবস্থাতেই যাতে তারা দূরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তার
ব্যবস্থা যেন আগে থাকতেই করা থাকে।”
ইতিহাসের কথাও আকর্ষণীয়, আকর্ষক শক্তি দিয়ে লেখা হয়েছে। সম্রাট অশোকের জীবনকাহিনী। -“অশোকের প্রধান লক্ষ্য ছিল অহিংসা। মানুষ যে শুধু মানুষকেই ভালোবাসবে তা নয়, চারি পাশে যত পশুপাখি রয়েছে তাদেরও ভালবাসবে আর মনীষীদের জীবনেও আছে অজস্র ওঠাপড়ার কাহিনী। জীবনকথা এমনভাবে সহজপাঠে বলা হয়েছে, যাতে দেবেন্দ্রনাথ, পিয়ার্সন, এন্ড্রুজ প্রমুখদের জীবনের আদর্শ চেনা যায়। সেই আদর্শ চেনাতেই ‘শান্তিনিকেতন’-এর বিষয়েও আলাপ- আলোচনা।কথনের রসবৈচিত্র্যে নিতান্ত জানাকথাতেও দুর্লভ স্বাদ পাওইয়া যায়। একাধারে সহজপাঠে পড়াশোনার, আদর্শ- নৈতিকতার সঙ্গে একাত্মতাস্থাপন ও জড়- প্রাণে অস্তিত্বময় চলিষ্ণু ধারার ক্ষুদ্র তুচ্ছেরও ধারণাগঠন সম্ভব হয়েছে।

সমস্ত ছবি : সংগৃহীত 

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 4th May 2025, Issue 63 | সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | সংখ্যা ৬৩ | ৪ মে ২০২৫, রবিবার

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment