Sasraya News

Saturday, February 15, 2025

Rosalind Franklin : রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন : দ্য ডার্ক লেডি অফ ডি এন এ

Listen

🦋গদ্য 

 

উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও বাবা আর্থার কিন্তু ছিলেন নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরোধী, তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে (Rosalind Franklin) তাঁর সোশ্যাল ওয়ার্কার হোক, অত পড়াশোনার দরকারটা কী? মেয়ে কিন্তু তাঁর এই ব্যাপারে নিজস্ব সিদ্ধান্তে অনড় ছিল, সে যে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে পাড়ি দিতে চায়। তাঁর চোখে যে তখন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন! তারপর কী হল? লিখছেন : রাখী নাথ কর্মকার 

 

 

 

 

রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন…

 

কদিকে মারণ ক্যান্সারের হাতছানি, অন্যদিকে গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব – ডাবল ট্রাজেডির শিকার হয়েও কিন্তু রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনকে ইতিহাস আজও ভোলে নি। বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি…স্টাডি অফ জেনেটিকসে তাঁর অনস্বীকার্য অবদানের জন্যে আজও তিনি চিরস্মরণীয়।

১৯২০ সালের ২৫শে জুলাই, লন্ডনের নটিংহিলে এক সম্পন্ন ইহুদী পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন রোজালিন্ড এলিস ফ্রাঙ্কলিন। বাবা এলিস আর্থার ফ্রাঙ্কলিন শহরের ‘ওয়ার্কিং মেন’স কলেজে’ পড়াতেন, মা ছিলেন মুরিয়েল ফ্রান্সিস ওয়েলি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যু এবং অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে নোবেল পুরস্কার হাতছাড়া হলেও ১৯৫৩ সালে ডিএনএ’র গঠন আবিষ্কারের পিছনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আজ সর্বজনস্বীকৃত। ভৌত রসায়নবিদ, ক্রিস্টালবিদ, ব্রিটিশ আণবিক জীববিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন এক সুন্দর মনের মানুষও। ছোটবেলা থেকেই পাতার পর পাতা নিখুঁত অঙ্ক কষে সবাইকে অবাক করে দেওয়া প্রখম মেধার অধিকারী মেয়েটি ছিল ক্রিকেট, হকিতেও সমান দক্ষ! স্নেহময়ী পিসি হেলেন বেন্টুইচ ছোট্ট, মিষ্টি ভাইঝির প্রতিভায় গর্বিত হয়ে মাঝে মাঝেই স্বীকার করতেন, দেখতে বটে এইটুকুনি – মেয়ে কিন্তু অঙ্কে বড়ো সেয়ানা! ১৯৩৮সালে, ছ-ছটি ডিস্টিংশন নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পরে যখন স্কলারশিপের ত্রিশ পাউন্ড আর দাদুর কাছ থেকে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া পাঁচ পাউন্ড কীভাবে খরচ করবে, ভেবে কুল পাচ্ছে না মেয়েটি, কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে বাবা তাকে জানালেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল পরিস্থিতিতে যেসব রিফিউজি ছেলেমেয়ে অর্থের অভাবে পড়াশুনো করতে পারছে না, এই অর্থ তাদের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ। মেয়েটি কিন্তু দ্বিধা করল না, সঙ্গে সঙ্গেই মনস্থির করে নিল-বেশ, তাই হবে। নিজের ক্ষুদ্র ইচ্ছেপূরণের শখ তাঁর কাছে সেইমুহূর্তে নিতান্তই বাহুল্য বলে মনে হতে শুরু করে!

উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও বাবা আর্থার কিন্তু ছিলেন নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরোধী, তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে তাঁর সোশ্যাল ওয়ার্কার হোক, অত পড়াশোনার দরকারটা কী? মেয়ে কিন্তু তাঁর এই ব্যাপারে নিজস্ব সিদ্ধান্তে অনড় ছিল, সে যে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে পাড়ি দিতে চায়। তাঁর চোখে যে তখন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন!
১৯৪১ সালে ফ্রাঙ্কলিন কেমব্রিজের নিউন্যাম কলেজের ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। কেমব্রিজের শেষ বছরেই তাঁর সাথে আলাপ হল বিখ্যাত বিজ্ঞানী মারি কুরির পুরোন ছাত্র ফরাসি শরণার্থী অ্যাডরিন উইলের সঙ্গে, ফ্রাঙ্কলিনের কেরিয়ার ও জীবনের উপর উইলের গভীর প্রভাব দেখা গিয়েছিল। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে তিনি লন্ডন এয়ার রেইড ওয়ার্ডেন হিসেবে যোগ দিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত রসায়ন পরীক্ষাগারে ১৯৬৭ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রোনাল্ড নরিশের অধীনে কিছুদিন কাজ করার পরেই ১৯৪২ সালে তিনি ‘ব্রিটিশ কোল ইউটিলাইজেশন রিসার্চ অ্যাসোশিয়েশন’ (BCURA)এর অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ অফিসার হিসেবেও কাজ শুরু করলেন। সেখানে কয়লার ছিদ্রতা এবং হিলিয়ামের ঘনত্বের তুলনা নিয়ে স্টাডি করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কয়লা ছিদ্রের সূক্ষ্ণ সংকোচনের সঙ্গে সছিদ্র স্থানের প্রবেশভেদ্যতার মধ্যে সম্পর্কও আবিষ্কার করলেন। ১৯৪৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যাময় থেকে ফ্র্যাঙ্কলিন পি এইচ ডি লাভ করলেন। এর পরেই তিনি ১৯৪৭ সালে ফ্রান্সের জাতীয় কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে এক্সরে ক্রিস্টোলোগ্রাফার জাক মেরিংএর সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলেন। মেরিং তাঁকে শিখিয়েছিলেন এক্স-রশ্মির বিচ্ছুরণ, যা উত্তপ্ত কার্বনে গ্রাফাইটের উৎপাদনের ফলে যে স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন ঘটে… এই বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই ফ্র্যাঙ্কলিনের রিসার্চ এবং মূলত তাঁর ‘জীবনের রহস্য’-অর্থাৎ ডিএনএ গঠনের আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

 

 

 

১৯৫০ সালে ফ্র্যাঙ্কলিন লন্ডনের ‘কিংস কলেজে’ রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ শুরু করলেন। সেখানে তিনি ডি এন এর গঠন নিয়ে স্টাডি করতে এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। সেই সময়েই ফ্র্যাঙ্কলিন এবং তার ছাত্র রেমন্ড গসলিং একটি আশ্চর্যজনক আবিষ্কার করলেন। ডি এন এ ‘বি’ ফর্মের এক্স রে বিচ্ছুরণের একটি ছবি তাঁরা তুললেন যা ‘ফোটোগ্রাফ ৫১’ নামে পরিচিত – ডি এন এর গঠন চিহ্নিত করতে যা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক আবিষ্কার। ছবিটি তোলা হয়েছিল ফ্র্যাঙ্কলিনের নিজস্ব কৌশলে একটি মেশিনের সাহায্যে যেটি তিনি নিজে রিফাইন করেছিলেন। এই এক্স রে বিচ্ছুরণ ফটোগ্রাফটি ডি এন এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট এক ছবি তুলে ধরেছিল, এবং ফ্র্যাঙ্কলিন সেটির কাঠামো নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরুও করেছিলেন। ফ্র্যাঙ্কলিনের রিসার্চ নোট থেকে এও জানা যায় যে, তিনি সমাধানের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলেন, ডি এন এর ঘনত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, এমনকি মলিকিউলের দুটি ইন্টারলকিং চেনও তাঁর নজরে পড়েছিল…

 

 

 

কিন্তু ইতিমধ্যেই এক গভীর সমস্যা দেখা দিল! ফ্র্যাঙ্কলিনের সহকর্মী মরিস উইলকিন্সের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব তাঁর পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াল। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাসে, উইলকিন্স ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্র্যাঙ্কলিনের অনুমতি ছাড়াই তাঁর ‘ফোটো ৫১’টি প্রতিদ্বন্দ্বী বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসনের কাছে প্রকাশ করে দিলেন। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গেই ডি এন এ’এর ইতিহাস পুরোপুরি বদলে গেল! এই জেমস ওয়াটসনও তাঁর নিজের ডি এন এ মডেল নিয়ে কাজ করছিলেন কেমব্রিজে ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে। ফ্র্যাঙ্কলিনের এই সুবিবেচনাপূর্ণ ল্যাব রেজাল্ট তাঁদের নিজস্ব ডি এন এ মডেল তৈরিতে সাহায্য করল। ১৯৫৩ সালের ৭ই মার্চ তা তাঁরা প্রকাশও করে বসলেন। ১৯৬২ সালে এই কাজের জন্যে ওয়াটসন, ক্রিক আর উইলকিন্স নোবেল পুরস্কার পেলেন। ক্রিক এবং ওয়াটসন গবেষণার পুরো কৃতিত্ব নিজেরাই নিলেন এবং এপ্রিল ১৯৫৩ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় মডেলটি প্রকাশ করার সময় একটি ফুটনোটে শুধু উল্লেখ করে দিলেন, ফ্র্যাংকলিন এবং উইলকিন্সের অপ্রকাশিত অবদানদ্বারা তাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন! অথচ, সত্যি বলতে কী, তাদের সম্পূর্ণ কাজের ভিত্তিই ছিল ফ্র্যাঙ্কলিনের ফটো এবং তাঁর আবিষ্কার!

মার্কিন লেখিকা ব্রেন্ডা ম্যাডক্স ২০০২ সালে তাঁর ‘রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন : দ্য ডার্ক লেডি অফ ডি এন এ’ নামে ফ্রাঙ্কলিনকে নিয়ে লেখা বইটিতে লিখেছিলেন, ফ্রাঙ্কলিন জানতেনই না ওয়াটসনরা তাঁর গবেষণার উপরই তাঁদের ঐ ‘নেচার’ আর্টিকলটি প্রকাশ করেছিল, এবং জানলেও হয়ত তিনি তার জন্য কোনও অভিযোগও করতেন না। কারণ ফ্রাঙ্কলিনের শিক্ষা তাঁকে সেই প্ররোচনা দেয় নি। ফ্রাঙ্কলিনের সংক্ষিপ্ত জীবনের অন্যতম মূলধনই ছিল তাঁর চারিত্রিক ঔদার্য, সৌজন্যবোধ এবং সহনশীলতা!
১৯৫৬ সালের রংবাহারি শরতের শীতার্ত অবেলায়, ফ্রাঙ্কলিনের ক্যান্সার ধরা পড়ে। ১৯৫৮সালের ১৬ই এপ্রিল, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে এই কর্মযোগী, নির্বিবাদী মানুষটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রেখে যান তাঁর মহানুভবতা আর অনমনীয় মনোভাবের দলিল, তাঁর অপ্রতিম আবিষ্কার ও অপ্রাপ্তির আলেখ্য।

ছবি : আন্তর্জালিক 

আরও পড়ুন : Sasraya News | Sunday’s Literature Special, Issue 26, 28 July 2024 | সাশ্রয় নিউজ। রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২৮ জুলাই ২০২৪ | সংখ্যা ২৬

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment