



কাসেম আলী রানা (Kasem Ali Rana) নিবেদিত প্রাণ একজন লেখক। থেকেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ। তিনি একাধারে মঞ্চ অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার। কাসেম আলী রানা বাংলাদেশ বেতারে তালিকাভুক্ত গীতিকার এবং বেতার নাট্যকার। এ পর্যন্ত বেতারে তিনি ৮ টি নাটক। ২০ টিরও অধিক মঞ্চ নাটক লিখেছেন, যা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চস্থ এবং হচ্ছে। নাটক লেখার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য নাটকে অভিনয়ও করেছেন। এখনও অভিনয় করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০ টি। সম্পাদনা করেন ‘ছড়াশৈলী’ নামে একটি ছড়ার পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সাশ্রয় নিউজ-এর আজকের পাতায় রইল কবির একগুচ্ছ কবিতা।
কাসেম আলী রানা
পচা শামুক
পঁচা শামুকের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকি;
সোয়া দুই ইন্চি জানালার পাশে!
তোমার এতো কিসের অহংকার?
তুমি ঐটুকুই জায়গার মালিক জন্ম থেকে জন্মান্তর।
বিরহের উইল
এই বিরহ শুধু আমার নয়, মহকালের বির্বতনে
এর দায়ভার তোমারও আছে।
বুকের ভিতর কাঠ ঠুকরো পাখির মত নিরবধি খুঁড়ে যাচ্ছ,
যে সকল অনন্ত ব্ল্যাকহোল, তার বিষধর যন্ত্রণা
আমার চলার পথের গোড়ালির হাড় কেবল অবশ করে দেয়।
আমি ঘুমতে পারি না, ঘুমের নামে রাতের বিভৎসতা চেটেপুটে নেশাতুর হই।
রাত্রির এই অন্ধ নগ্নতা চিরন্তন অচল মুদ্রার দীর্ঘশ্বাস।
উত্তর মেরু – দক্ষিণ মেরু সর্ব শর্তে গর্ভবতীর মতো বিরাজমান জীবনভর।
এমন জীবন আর কত বহন করবো? এক জীবনে কত আর পচা গলা ডোবা হয়ে বেঁচে থাকবো?
আমি এবার উত্তাল সমুদ্র হতে চাই,সমুদ্র তটের চোরাবালির ফাঁদ হতে চাই।
যদি তুমি কখনো অহঙ্কারী পায়ে সমুদ্র বিলাস করো,
খোদার কছম প্রিয়, তোমাকে আমার বুকে গ্রাস করে নেবো।
জীবন-যাপনের সকল বিরহ তোমার নামে উইল করে দেবো!
যেতে দাও
যে যেতে চায়, তাঁকে যেতে দাও; কেন সামনে দাঁড়িয়ে
অনুনয় বিনুনয় করে মাতম করো কারবালার!
আমরাতো রাজপথের পথিক, রাজার সাথে সখ্যতা পুরোটা জীবন, যেখান থেকে শুরু করেছি; সেখানে আর
ফিরবো না কোনদিন!
ফিরে যাক; ফিরে যেতে দাও- পূর্বপুরুষদের পরম্পরা মোকামে,আরাম করে বসত করুক; দ্রাক্ষা ফল আর রসে!
এমন যাওয়া কেমন সুখের হতে পারে, তা আমরা কেউ না জানলেও,
যে যায়; সে জানে! সে এই সুখে এতই মোহবিষ্ট থাকে যে, ভুলে যায় অতীত, মুছে ফেলে পিছুটান!
যিনি কাছে থাকেন, লালন করেন, পালন করেন- তিনি সর্বকালের সর্বসেরা মহাজন!
তিনি ভালোবেসে ডাকেন বলে আমরা যাই,
তাঁর ভালোবাসা এতই মধুর, তা পান করে
অনাদিকাল কেটে যায়, শেষ হয় না নেশা, হবেও না কোনদিন,
সব কিছু হবে বিলীন, নেশা রবে অমলিন!
দাও, যেতে দাও, এগিয়ে দাও!
বলে দাও- বিদায় প্রিয়তম, বিদায় অনন্ত, অসীম!
ঠাকুরমার অনুগল্প
রাজা সাহেব নগ্ন হয়ে-
প্রজাকূলের মাথার উপর ক্রমশঃ জল ঢালেন।
গরম জলে-
প্রজাদের দেহের চামড়া পুড়ে পুড়ে ঝলসে যায়,
লাল মাংসে ক্ষত হয়,ক্ষতের পুঁচ রসের লোভে
পৃথিবীর যাবতীয় পোকা-মাকড় সেখানে স্হায়ী ভাবে বসত করে।
রাজা সাহেব এতো কিছু বোঝেন না।
মোসাহেবি মালিশে তিনি ঘুমান, দীর্ঘ ঘুম।
এই রাজ্যের সকল সুখ বিলিন হয় পৃথিবীর গর্ভে আদিম সভ্যতার মতো।
একদিন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে এক নতুন প্রজন্ম।
তারা রাজা সাহেবের নগ্নতাকে হত্যা করে।
খাস
তুমি ফুল তুমি ঘাস তুমি সুখ বারোমাস
তুমি ফড়িং তুমি পাখি তুমি সাদা কাশ।
তুমি উছল তুমি উতলা
তুমি উর্বর তুমি উজলা।
তুমি সাগর, তুমি ঢেউ, তুমি আমার খাস!
দিক নির্ণয়ক কম্পাস
তুমি তো আর শীতের ভোরের দূর্বার মুখে শিশির বিন্দু নও যে আঙ্গুলের ছোঁয়ায় মুছে যাবে।
তুমি তো আর কচু পাতায় শ্রাবণী বৃষ্টির ফোঁটা নও যে হাত রাখলেই গড়িয়ে যাবে।
তুমিতো আর লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্ণফুলীর উজানের জল নও যে, চন্দ্রের টানে ভাটার মতো আড়ালে হারিয়ে যাবে।
হয়তো কোন একদিন তাজমহলের পাথর মাটির গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে, কিন্তু তুমি অনাদিকাল রয়ে যাবে বাংলার ঘরে ঘরে বাঙালির প্রাণের দোসর হয়ে।
ব্যাবিলনের ঘন্টাটাও ঢং ঢং করে আর হয়তো বাজবে না কোন একদিন, কিন্তু তোমার কীর্তি বাংলার আকাশে বাতাসে চিরকাল ছায়া হয়ে, মায়া হয়ে আলো বিলাবে।
মহাকালের গর্ভে মহাজগতের কত শত নক্ষত্র বিলীন হয়ে যাবে অনাদরে, কিন্তু তোমার তর্জনীর যাদু মন্ত্রর বাঙ্গালীর পথের দিশা হয়ে রয়ে যাবে রক্ত থেকে রক্ত কনিকায়!
তোমাকে মুছে দিতে পারে; এমন হাত পৃথিবীতে আজও জন্মায়নি, জন্মাবেও না কোনদিন!
তুমি চির অম্লান অমলিন,তুমি অন্তত প্রেরণার হাতিয়ার, তুমি বাংলার সকল মানুষের ভালোবাসার হাজার বছরের ঐতিহ্য!
তুমি আমার মানচিত্রের স্বাধীনতা, তুমি আমার লাল- সবুজ পতাকা, তুমি আমার পন্চান্ন হাজার বর্গমাইলের খতিয়ান!
তুমি আমার শোকের সমুদ্রে দিক নির্ণায়ক কম্পাস!
আমি আর রাশিদা বানু
বৈশাখের তপ্ত দুপুরে, ঝিম ধরা আকাশের রৌদ্র দহনে,
ঝির ঝির বাতাসে ছুটে যেতাম ফছি কাকাদের আম বাগানে,
আমি আর রাশিদা বানু!
টুপ টুপ করে ঝরে পড়তো সিঁদুর রাঙ্গা কাঁচা আম।
আমরা দু’জন চুপচাপ বাঁশ ঝাড়ে বসে বসে
সিলন দিয়ে আম কাটতাম আর মুখ পুরে খেতাম।
রাশিদা বানুর কাপড়ের গিঁটে বাঁধা থাকতো লবন আর লাল মরিচের গুঁড়ো,
আমার পকেটে ঝিনুকের খোসা দিয়ে বানানো সিলন,
সিলন দিয়ে আম কাটি আর লবন মরিচ দিয়ে দু’জনে মেখে-জোখে খাই, হেসে লুটিপুটি যাই আর বৈশাখী তপ্ত বাতাস গায়ে মেখে ছুটে যেতাম চৌধুরী পুকুর পাড়ে।
তেঁতুল গাছের ডালে ঝুলে থাকতাম ভূত সেজে; আমি আর রাশিদা বানু!
এখানে ভূতের ভয়ে কলসি ফেলে দৌড়ে পালাতো মোল্লা বাড়ির নতুন বউ। গাছের নীচে ভূতের জন্য পাহাড়ি অমলকি রেখে যেত, দক্ষিণ পাড়ার আলাউদ্দিন চৌধুরী। এতেও তার ভয় কাটে না, সেও ভয়ে পালিয়ে যায় পাহাড়ের পেয়ারা বাগানে।
আমি আর রাশিদা বানু একই স্কুলে পড়ি, একই ক্লাসে, একই বই।
আমরা থাকি পাশাপাশি বাড়ি, পাশাপাশি ঘরে, সন্ধ্যায় কালিপদ স্যার আসেন, কুপির আলোতে পড়াতে বসেন বীজগণিত, টেন্স আর প্রিপজিশন!
রাশিদা বানু পড়া ফাঁকি দেয়, আমি লক্ষ্মীমন্ত ছেলে,
রাশিদা কানমলা খায়, আমি পৃথিবীর ফেরেশতা সেজে চুপচাপ থাকি, হাসি গিলে খেতে খেতে পেটে আমার হাসির রাজ্য হয়েছে কয়েক শত!
এক বরষায় বৃষ্টির দিনে রাশিদা বানু চলে গেলো, লালনের দেশে।
সে থেকে আমি বন্ধুহীন, আমি একা, আমি শূন্যতায় কেঁদে কেঁদে খুঁজি তাকে।
রাশিদা বানু আর ফিরে আসে না, আমিও আর হাসি না!
তাঁতের শাড়ী
এত টানাপোড়নের জীবনে মাস শেষে যা রাখতে পারি, তা একদিন ফুঁলে-ফেঁপে বড় হলে, ভেবে রেখেছি- তোমার জন্য একটা তাঁতের শাড়ী কিনবো।
সাদা জমিনে ছোট ছোট নীল ফুলের সবুজ পাড়ের শাড়ী।
ভেবেছিলাম, এই মাসেই বেতন পেলে দুই একদিনের মধ্যে টেরি বাজার গিয়ে অনেক শাড়ীর আড়ত ঘুরে ঘুরে তোমার জন্য আমার পছন্দের তাঁতের শাড়ীটা কিনে ফেলবো।
নীলফুল, সাদা জমিন,সবুজ পাড়ের শাড়ীটা শরীরে জড়িয়ে তুমি যখন অভিসারে আসবে,
তখন তোমাকে কাশের বাগানে একখণ্ড আকাশ জন্ম জন্মান্তর পাহারা দিয়ে রাখবে।
তুমি একটা বড় লাল টিপ পড়ে খোলা চুলে চঞ্চল হরিণীর মতো ছটফট করবে কাশের বনে বনে।
আমিও তোমার এমন রূপে দেখে দেখে নিথর হয়ে থাকবো অনন্ত ছুঁয়ে যাওয়া জীবনে।
হটাৎ করে সেদিন এক বর্ষাতে আমার বুকে কফ বসে গেল।
জ্বর, কাশি শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেনের অভাব, কত রকমের কষ্ট সহ্য করে ডাক্তার বাড়ি থেকে যমকে বিদায় দিয়ে আগের জীবনে ফিরে এলাম।
এর মধ্যে আরও কত কিছু হয়ে গেল, তেল, চাল, আটা, পাট, সুতা, সবজির দাম বেড়ে গেল।
চারিদিকে সব শূন্যতা, আমি আগের চেয়ে আরও শূন্য হয়ে গেলাম।
তোমার জন্য তাঁতের শাড়ীটা আর কেনা হলো না।
আমার চাকরীটা গেল, তুমিও চলে গেলে অন্য ঠিকানায়।
মন খারাপ করো না মেয়ে, দেখো; একদিন ঠিকই তোমার জন্য আমি তাঁতের শাড়ীটা কিনে ফেলবো!
নীল ফুল-সাদা জমিন-সবুজ পাড়-
🍁অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
