Sasraya News

Wednesday, March 12, 2025

Manujesh Mitra : গভীরতম অন্ধকারের নির্জনতম কবি মনুজেশ মিত্র

Listen

দার্শনিক অনুজ্ঞাটিই মনুজেশ মিত্রের কবিতার বিষয়। নদীতীরে বসে নদীর প্রবাহ তিনি দেখেন, নৌকার চলে যাওয়া দেখেন। তীরভূমি ধ্বসে পড়বে তাও জানান। তবু কাঁকড়ার মতো বালিয়াড়ি আঁকড়ে ধরে শুধু এইটুকু বলে দিতে চান। লিখেছেন : তৈমুর খান

 

 

নেক কাব্য লিখে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে কবি খ্যাতির শীর্ষে তিনি কখনোই উঠতে চাননি। মনের টানে কবিতা লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু সেইসব কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখারও কোনো চেষ্টা করেননি। এক নীরব নিভৃতির মধ্যে বসবাস করে যথোচিতভাবে তাচ্ছিল্য করেছেন পার্থিব আসক্তির তথাকথিত সুখ বিলাস মহিমাকে। পরিপাটি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করে কখনো গৌরবকে কাছে টানতে চাননি। এক ধরনের নিবিড় উদাসীনতা তাঁর মরমিয়া সত্তাকে সর্বদা আলাদা করেছে। গড্ডলিকা জীবন প্রবাহ থেকে বিচ্যুত হয়ে তাই সর্বদা অন্তর্মুখী কবিতা রচনা করে গেছেন। গানের সুর দিয়েছেন। ছাত্র পড়িয়েছেন। অভ্যাসবশত পোশাক পরেছেন। কিন্তু সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে তীব্র দার্শনিক চেতনা। বহন করে নিয়ে গেছেন নিজ পুরাতন হৃদয়কে। আর সেই কারণে কাব্যেরও নাম দিয়েছেন ‘এই পুরাতন হৃদয় আমার’।
কার কথা বলছি এতক্ষণ ধরে পাঠক কি তাঁকে চেনেন?
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন পাঁচের দশকের কবি মনুজেশ মিত্র(১৯৩৫-২০১৫)। তখন বীরভূমের মাত্র দু’জন কবিই বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে চোখের মণি হয়ে উঠেছেন—একজন মনুজেশ মিত্র, অপরজন কবিরুল ইসলাম। দুজনেই ইংরেজির ছাত্র,সহপাঠী, বন্ধুও, পরবর্তীতে দুজনেই অধ্যাপক। কবিরুল ইসলামকে নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও নানাভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন মনুজেশ মিত্র।
কবিরুল কবিতায় বীরভূমের বাউল ঘরানাকে বেছে নিয়েছিলেন। রাঙামাটির উদাস দুপুর অথবা গোধূলিলগ্নের ক্লান্ত বিপন্ন পথিক আত্ম-অন্বেষণে পথ খুঁজে চলেছেন। কখনো মুখরিত কাব্যের ঝংকারে, কখনো নীরব স্তব্ধতার আত্মস্ফুরণে। নিখুঁত মিশ্রবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত সব ছন্দেই তিনি ছিলেন সড়গড়। অব্যর্থ অভিক্ষেপে মাত্রার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন । আত্মজ্ঞানের নিরন্তর পর্যায়ে পথভোলা পথিক হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু এরই পাশাপাশি আর একজন কবি অর্থাৎ মনুজেশ মিত্র মিশ্রবৃত্ত বা গদ্য ছন্দের পসরায় দার্শনিক বোধের ফসল তুলছেন। আত্মজীবনের উৎস খুঁজতে খুঁজতে সমূহ মানবসভ্যতাই তাঁর নিরীক্ষণে জেগে উঠেছে। মোট ছয়টি কাব্যেই তিনি সঞ্চারিত করেছেন ভাবনার বিক্রিয়া। এই কাব্যগুলি হলো—
১) আমি অমল আঁধারে(১৯৬৫)
২) কেন প্রতিধ্বনি (১৯৭৭)
৩) পাতারা কোথায় যায় (১৯৯৬)
৪) এই পুরাতন হৃদয় আমার (২০০৫)
৫) আবৃত্তি, তোমার জন্য (২০০৬)
৬) কবিতা সঞ্চয় (২০১৪)

———-

এই মুক্ত হাওয়ার মধ্যেই অনন্তে বিরাজ করা। অনন্তে মিশে যাওয়ার বেদনায় যেমন শূন্য মনে হওয়া, তেমনি মৃত্যুতে বিলীন হয়ে যাওয়ারও বেদনা অনুভব করা। কিন্তু ব্যক্তিকবির চেতনা প্রবাহ মানবসভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিন সঞ্চারিত হবে। চেতনার মৃত্যু হবে না। এই চেতনাতেই অনন্ত জেগে থাকবে। অনন্ত ফসিল হয়ে অনন্তের মধ্যেই তার চিহ্নে বিরাজ করবে। এর যেন বিরাম নেই, শেষ নেই।

———–

নিজের প্রাচীনত্ব উপলব্ধি করেই আয়নার সামনে বসছেন। এই আয়না শুধু আরশিনগর নয়, সমূহ জগতের ধারক ও প্রজ্ঞাবাহক ক্রিয়ায় সন্নিবিষ্ট এক উপলব্ধির জগৎ। তিনি বিশ্বাস করতেন এক বিশাল কবিতা লেখা আছে সবখানে। তিনি নিজে তাই পাঠ করে চলেছেন। তারই ছন্দে মনে দোলা পান। কবিতার মধ্য দিয়েই তিনি সেরে ওঠার কথাও ভাবেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকায়। যদিও কম লিখেছেন, তবু কবিতা লেখাতে কখনো ছেদ পড়েনি।
জীবনে বেঁচে থাকার জন্যই হয়তো সবকিছু করে মানুষ, যেমন করে মাকড়সা। কিন্তু এই করাটাই শেষ কথা নয়। এর গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনও কবি করতে চেয়েছেন আর তখনই দেখেছেন:
“তবু কখন মুখ্য আয়নাটাই হঠাৎ চৌচির।
উঁকি মারে অসংখ্য আমি,চারিদিকে ছত্রখান—
কারটা কে বোঝে, কেই বা মেটায়,
‘কে কার ঝাড়ে বাঁশ কাটে’ তত্ত্ব!
সব প্রয়োজন শুকনো হয়ে
ঝুঁকে থাকে এর ওর ফুলদানিতে,
ধুলোয় ভরে যায় ঘর খসখসে হাওয়ায়—
আর মাকড়সা জাল বুনে চলে প্রাচীন স্ফূর্তিতে।”
(প্রয়োজনের জন্য)
এই প্রাচীন স্ফূর্তিতে জাল বুনে চলা আদিম কৌশলকেই বোঝাতে চেয়েছেন। যে কৌশলে সর্বত্রই ফাঁদ পাতা হয় শিকার ধরার জন্য। ‘শিকার’ শব্দটি বৃহত্তর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থ সম্পদ থেকে ভোগের যাবতীয় সামগ্রী, তেমনি মাকড়সারও মশা-মাছি থেকে রঙিন কীটপতঙ্গ পর্যন্ত তার জালে জড়াতে পারে। কবি এই সত্তা থেকে বেরিয়ে এসেই দার্শনিক সত্তার কাছে প্রজ্জ্বলিত হন, বলেই এক ‘আমি’র ভেতর অসংখ্য ‘আমি’কে দেখতে পান। সব সত্তা সংগঠিত নয়, ছত্রখান হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিচিত্র তাদের অভীপ্সা। সবাই নিজস্ব ফুলদানিতে ঝুঁকে ঝুঁকে একদিন শুকিয়ে যায়। তখন ধুলো ভরা সংসারে খসখসে হাওয়া। ‘খসখসে’ বিশেষণটিরও বিশেষত্ব আছে—যা অসহ্য, কষ্ট ও বেদনাময়।
যে প্রাচীনত্ব নিয়ে কবি তাঁর জীবনের পরিধি পরিমাপ করেছেন সেখানে অন্ধকারেরই ছড়াছড়ি। আমাদের জীবনের এক অদৃশ্য জগৎ বিরাজ করছে। কবি সেই অন্তর্জগতের ঠিকানাই অন্বেষণ করেছেন। জীবন কী, জীবনের ভাবনা কী, জীবনের প্রাপ্তিই-বা কী—এসব দার্শনিক প্রজ্ঞা থেকেই বাস্তব অভীক্ষায় তিনি যে সংঘাত তুলে এনেছেন তা শুধু একজন ব্যক্তির নয়, সমগ্র মানবের আবহমানকালের বিষয়। প্রবৃত্তির অনপনেয় যাপনের ক্রিয়ায় তা জেগে ওঠে। যন্ত্রণার জন্ম দিতে থাকে তারই অপ্রাপ্তির শূন্যতা। জীবনের অভীপ্সা গূঢ়চারী আদিমতা, প্রকাশহীনতা অথবা যাবতীয় ইঙ্গিতময়তাকে কবিতায় তুলে আনেন। জৈব সদ্গতির মধ্যেই রক্তের প্রবাহ আদি জীবনের বোধ ও উপলব্ধিকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। তাই ‘রক্তের ভিতর’ কবিতায় কবি বলেছেন:
“কিছু প্রেমের প্রয়োজন ছিল হে,
কিংবা রক্তের।
অন্তর্নিহিত সেই বৃক্ষটি ঝাঁঝরা হয়ে গেলে
শাখা আর প্রশাখায় দেখো শুকনো শকুনের বাসা
সমস্ত বৃক্ষটি জুড়ে—
দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে
সমস্ত বৃক্ষই এক কথাকার বিশাল শকুন,
বলিত ইচ্ছায় স্তব্ধ মিথ্যায় প্রহত কামান্বেষী…
অতএব প্রেম দাও, না হলে রক্তই।”
সুতরাং দেহই যাবতীয় জীবনের মহিমার আধার হয়ে উঠেছে। দেহ আছে বলে সবই আছে। জৈবিক ক্রিয়ার জন্ম হয়, আবার দার্শনিক চেতনারও বিস্তার ঘটে। দেহ না থাকলে কিছুই থাকে না। কবিও তখন শ্মশানে যেতে অস্বীকার করেন। রক্তই সেইসব বোধ ও উপলব্ধিকে বহন করে বলেই কবি কবিতার শেষ অংশে বলেছেন:
“যন্ত্রণাই জীবনের উচিত আধার,
ক্ষতমুখ দেখে দেখে দেখে
শ্মশানে যাব না আর,কিংবা কোনোখানে।
কেউই দেয় না প্রেম,বরং রক্তের খেলা সোজা
এবং রক্তের মধ্যে অস্তিত্বের-প্রেমের-মনের
কিছু কীট থাকতে পারে। তাই এসো, তুলে ধরো দেহ,
রক্তের ভিতরে নেই ঝুটা কোনো সত্তার বাহানা।”
রক্ত ছলনা করে না, যা সত্য, যা স্বাভাবিক,যা আদিম তাকেই প্রকাশ করে। আদি ও অকৃত্রিম আকরিকের জেগে উঠাকেই ঘুমন্ত জৈব সত্তার জাগরণ বলেই কবি মনে করেন। তখন তাকেই উপলব্ধি করে লেখেন:
“অকস্মাৎ কোনো পাখী ঘুমের গভীরে জেগে ওঠে
পাখিনীর ঈষৎ উত্তাপে…
টুকরো টুকরো শব্দিত আঁধার ঝরে পড়ে
তারপর চলে যায় অগম স্পর্শের অধিকারে।
অনুত্তীর্ণ মানুষ-মানুষী সব জীবনের স্বাদ
ঘামের ফোঁটার মতো চোখে-মুখে মেখে
রাত্রির আসঙ্গে তৃপ্ত হতে চেয়ে চেয়ে
সূর্য ভালবাসে।
স্পর্শের অতীত সেই পৃথিবীর অনেক বাহিরে
সে এক হৃদয়
সূর্য-প্রেমীদের কাছে তবু দুহাত বাড়ায়।”
(রাত্রির শরীরে এক)
টুকরো টুকরো শব্দিত আঁধার ঝরে পড়লে ‘অগম স্পর্শের অধিকারে’ তখন চলে যায়। তখন ‘অনুত্তীর্ণ মানুষ-মানুষী’ জীবনের স্বাদ পেতে রাত্রির আসঙ্গে তৃপ্ত হবার যাপন শুরু করে। আর তখনই সূর্যকে ভালবাসার প্রয়োজন হয়। স্পর্শের অতীত তখন সে হৃদয় আলোকিত উজ্জ্বলতায় প্রকট হতে থাকে। আশ্বাস বা নির্ভরতার প্রয়োজন বোধ করে। একদিকে ভৌম বা কৌম আদিমতা, অন্যদিকে জীবনযাপনের প্রক্রিয়ায় সন্তান-সন্ততির জন্মদান এবং সংসার ধর্ম পালনে তার জীবনে পূর্ণতা খোঁজে। কখনো প্রেমে এবং প্রেম থেকে দূরে অবস্থান করে তার মর্ম উপলব্ধি করে। ত্যাগ-তিতিক্ষায় ও ভোগের প্রাচুর্যে স্বার্থ এবং নিঃস্বার্থের মধ্যে পরিশুদ্ধি খোঁজে। তাই কবিতাটি শেষ হয় এইভাবে:
“অন্তরীণ বোধ আর প্রেমের আখ্যান থেকে,
প্রেম থেকে দূরে।”
জীবন প্রক্রিয়ার বিচিত্র গতি ও কৌশলকেই অনুধাবন করেছেন কবি। বাউল যেমন দেহ-ভাণ্ডের মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ডকে উপলব্ধি করেন, কবিও তেমনি জীবনের প্রবাহকেই সৃষ্টি ও স্রষ্টা সত্তার পরিচয় বলেই মনে করেন। জীবন প্রবাহ ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়ে চলেছে আর রক্তই সেখানে ধারাবাহিকভাবে সংযোগ রক্ষা করছে। সুতরাং সেই উৎস থেকে কোটি কোটি বছর ধরে আমাদের জৈব চেতনার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। যা ছিল—তাই আছে। যা আছে—ভবিষ্যতেও তাই থাকবে; কখনোই আমরা তার পরিবর্তন ঘটাতে পারব না। জীবন প্রবাহের এই তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধিতেও ধরা পড়েছিল, আর সেই কারণেই তিনি ‘নৈবেদ্য’ কাব্যের ছাব্বিশ নং কবিতায় লিখেছিলেন:
“এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়
যে প্রাণ তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়
সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে,
সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দে তালে লয়ে
নাচিছে ভুবনে—সেই প্রাণ চুপে চুপে
বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে
লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরষে,
বিকাশে পল্লবে পুষ্পে; বরষে বরষে
বিশ্বব্যাপী জন্মমৃত্যু-সমুদ্র-দোলায়
দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ার-ভাঁটায়।
করিতেছি অনুভব, সে অনন্ত প্রাণ
অঙ্গে অঙ্গে আমারে করেছে মহীয়ান।

সেই যুগযুগান্তের বিরাট স্পন্দন
আমার নাড়ীতে আজি করিছে নর্তন।”
এখানেও সেই বাউল তত্ত্বের দর্শনটি মিলে যায়। ব্রহ্মাণ্ড এসে দেহভাণ্ডে ধরা পড়ে। নিজের মধ্যেই ফুটে ওঠে অনন্তের পরিচয়। মরমিয়া কবি রুমিও বলেছেন:
“এই পৃথিবীর প্রতিটি পরমাণুর পিছনে লুকিয়ে আছে একটি অসীম মহাবিশ্ব।”
বিখ্যাত লেখিকা বিট্রিস রুবি ম্যাথিউস স্পার্কস (১৯১৭-২০১২) তাঁর বিখ্যাত বই ‘Go Ask Alice’-এ লিখেছেন:
“I really am only one infinitely small part of an aching humanity.”
অর্থাৎ আমি সত্যিই একটি যন্ত্রণাদায়ক মানবতার একটি অসীম ক্ষুদ্র অংশ। এই অসীমতাকে ধারণ করে মনুজেশ মিত্রও কবিতা লিখে গেছেন। প্রতিনিয়ত বেদনার অনুভবকে লালন করেছেন। কবিতার নামও দিয়েছেন ‘বেদনার অনুভব’। লিখেছেন:
“বেদনার অনুভব ভুলে থাকি,
সেই তীব্র আলোড়ন
যাতে বুকের ভিতরে ভাঙে সব ঘরবাড়ি।
ছড়িয়ে রয়েছি, নানাভাবে নানা দিকে—
যেন উৎসবের খই
মঙ্গলকলসে কিছু,কিছুটা আলপনা আঁকা
উঠানের বুকে,কিছু প্রবেশের দ্বারে।
নানান হাতের স্পর্শে, নানান মুখের ওমে
নির্বিকার মন,
এমনকি হাজার অশান্তি শেষে
ডুবে যাওয়া মানুষের মুক্ত হাওয়া নেওয়া।”
এই মুক্ত হাওয়ার মধ্যেই অনন্তে বিরাজ করা। অনন্তে মিশে যাওয়ার বেদনায় যেমন শূন্য মনে হওয়া, তেমনি মৃত্যুতে বিলীন হয়ে যাওয়ারও বেদনা অনুভব করা। কিন্তু ব্যক্তিকবির চেতনা প্রবাহ মানবসভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিন সঞ্চারিত হবে। চেতনার মৃত্যু হবে না। এই চেতনাতেই অনন্ত জেগে থাকবে। অনন্ত ফসিল হয়ে অনন্তের মধ্যেই তার চিহ্নে বিরাজ করবে। এর যেন বিরাম নেই, শেষ নেই। এই বোধকেই ‘আগামীকাল’ নামের কবিতায় প্রতীকায়িত করলেন:
“আবার আগামীকাল ভেসে উঠছে অস্পষ্ট সকালে
কবে থেকে এই নদী শুয়ে আছে আদিগন্ত অকুণ্ঠ প্রান্তরে
বালিতে ছড়ানো ঠ্যাং,
ঢেউ-এর পাঁজরগুলো গোনা যাচ্ছে
কত নিচে হৃৎপিণ্ড আছে
রক্তের জলের স্রোত নেমে যাচ্ছে মূর্খ শিরা বেয়ে,
কত গাছ নুয়ে দেখছে রক্তের ভিতর কত মূর্খতা রয়েছে,
আঘাটায় জমা নৌকা,
ঘাটেতে জমাট বাঁধা কলসির চাক ঘিরে বুকের গুঞ্জন
গ্রাম-গঞ্জ এইসব পাশে রেখে
সাবলীল চলে যাচ্ছে”
এই ‘আগামীকাল’ অনন্তেরই অনিবার্য পরিণতি। মানুষের নিত্য ক্রিয়াকর্মের মধ্যেও অনন্তকে অবলোকন করা যায়।যে চিত্রকল্পগুলি আমাদের উপলব্ধিলোকে জেগে থাকে তা সেই মহাব্যাপ্তিরই আয়োজন। মৃত্যুর স্রোতে শামিল হওয়াতেই এই উদ্যোগ। তাই নদীও কালপ্রবাহ বয়ে চলেছে নিরন্তর। মনে রাখতে হবে আমাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি, দৈনন্দিন জীবনজীবিকা, মোহ ও কামের আয়োজনে জীবন তার পরিবৃত্তি চায়নি। সবই এহ বাহ্য, আগে কহো আর। এই আগে বলবার দার্শনিক অনুজ্ঞাটিই মনুজেশ মিত্রের কবিতার বিষয়। নদীতীরে বসে নদীর প্রবাহ তিনি দেখেন, নৌকার চলে যাওয়া দেখেন। তীরভূমি ধ্বসে পড়বে তাও জানান। তবু কাঁকড়ার মতো বালিয়াড়ি আঁকড়ে ধরে শুধু এইটুকু বলে দিতে চান “এইখানে একদিন আমরাও ছিলাম।”
এই অনিত্য থাকার ঘোষণার মধ্যেই নিত্যতা বিরাজ করবে। আমরা জানি জীবনানন্দের কথায় “মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।”
রূপকাশ্রিত কবিতাগুলির ভাবে ভাষায় এবং শব্দের আতিশয্যে যে কাব্যশৈলী তিনি নির্মাণ করেছেন তা এক দার্শনিক ঘোরের মধ্যেই আমাদের টেনে নিয়ে যায়। তার অপূর্ব ভাষাচিত্র যে দৃশ্যময়তার জন্ম দেয় তাতে সহজেই আমরা অবগাহন করতে পারি। কবি বরাবরই ব্যতিক্রম—কী জীবনে, কী লেখায়, কী জীবনদর্শনেও। প্রচলিত সব পথেই যখন সবাই গতানুগতিক পথিক,তখন কবি সঠিক পথ অন্বেষণেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। সেই সুনিয়ন্ত্রিত, সুবিদিত পথে সকলের সঙ্গে চলতে পারেন না। মূল রাস্তার বাইরেই চলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। অনেকে তাঁর এই চলাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখেন—কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না। বরং দার্শনিক বোধের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে কবির মনে হয়:
“কোনো রাস্তাই পারবে না
আমাকে সঠিক ঠিকানাই পৌঁছে দিতে।”
এই সঠিক ঠিকানা কী তা আমরা কি জানি? কেন এই জন্ম, কেন এই মৃত্যু, কেন এই বেঁচে থাকা ইত্যাদি প্রশ্নগুলি প্রাসঙ্গিকভাবেই ঘুরে আসে। তাত্ত্বিক জীবনের প্রজ্ঞাময় আলোয় কবি এর অর্থভেদ করতে চেয়েছেন। নিজের কন্ঠস্বরে মানুষের কন্ঠস্বর শুনে,নিজেকে গাছের সঙ্গে মিলিয়ে গাছ হয়ে,পাতা ও ডালের সঙ্গে মিলিয়ে পাতা ও ডাল হয়ে ভেবেছেন। জীবনের ব্যাপ্তি ও প্রাচুর্য সমন্বিত করেও প্রাত্যহিক জীবনে রোজনামচায় কবিরও অধিগমন ঘটেছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, সহ্য ও অসহ্যের সীমানায় তবুও শীত ও উষ্ণতার শিকার হয়েছেন। এক ঋষি তুল্য জীবনের মহিমাকে অতি সাধারণ জীবনপর্যায়েও নামিয়ে এনেছেন। তাই বলেছেন:
“প্রতিদিনের চলায় আমার বিশাল মাঠ,
মাঠ মানেই তৃষ্ণা,তৃষ্ণা মানেই চলা?
মাথার ওপর আকাশের বিরাট হাঁ
অট্টহাসি ফেটে পড়ছে, অঙ্গারের মতো
আমার বুক,আমার সর্বাঙ্গ ঝালাপালা।
শীর্ণ পথের দুধারে অপার মাঠ—
এখানে ওখানে ছড়ানো-ছিটানো গম্ভীর পাথরের স্তূপ,
নির্বিকার বালি, তারপর বহুদূর উৎসাহী ঘাসের দল,
মাঝে মাঝে দু-একটিস স্ফুর্তিবাজ, দু-একটি অভিজ্ঞ গাছ,
কোথাও মিথ্যুক গর্ত।
তবু এসবকেই আমি হিংসা করি,
এত সহজ এরা!
তাই আমি লোকালয় খুঁজি।”
(আমার তৃষ্ণা)
এই বিশাল মাঠ, কত অন্তরায়,খানাখন্দ ভরা জীবন, রহস্য ও রোমাঞ্চভরা বাঁচা, আবার বাস্তবের কঠোর কঠিন পর্বও। কবি অতিক্রম করতে করতে সব বেলা-ই সাঙ্গ করে ফেলেন। তখন সব আয়ুর রসদও ফুরিয়ে যায়। আনন্দও ঝরে পড়ে। শুধু বুকের অনির্বাণ আলো-ই পথ দেখায়। কবি বলেন:
“আকাশের আলো মুছে গেলে
জ্বলে থাক তবে সেই আলো,
যা নেভে না কোনোদিন বুকের ভিতর।”
(আমাকে ভালবাসার মধ্যে)
এই আলোকে যদি ঐশ্বরিক বলি, এই আলোকে যদি প্রাণশক্তি বলি তাহলে এই আলোও বোধের চূড়ান্ত সামর্থ্য যাকে কবি আত্মশক্তি হিসেবেই অনুভব করতে পারেন। যা রবীন্দ্রনাথের কথায় “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো,
সেই তো আমার আলো।”
তখন কবি যে রাস্তার সন্ধান পান সেই রাস্তা তো হৃদয়ের রাস্তা।হৃদয়ই কবির কাছে চির জাগ্রত ঘর। সেখানেই তিনি যৌবন রেখে যাবেন। ‘সেই ঘরে’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন:
“আকাশে বাতাসে বড় উন্মাদনা ছোটে
অথবা চাইনে বিশালতা,
হাজার শব্দের ফুল বাইরে যদি ফোটে
ফুটুক, ঘরে তো নির্জনতা।”
শেষ পর্যন্ত যে হৃদয়ের কাছেই ফিরে আসতে হয়, হৃদয়েই জ্যোৎস্নাময়ীর বাস। জীবনানন্দ দাশও জেনেছিলেন—
“সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;”
তখন মুখোমুখি বনলতা সেনেরই সাক্ষাৎ ঘটে।সব পথ একটি পথেই এসে মিলিত হয়।গৌতমবুদ্ধও বলে গেছেন—
“The way is not in the sky; the way is in the heart.”
অর্থাৎ পথ আকাশে নয়; পথ হৃদয়ে আছে। জীবনের সব লেনদেন ফুরিয়ে গেলেও, পৃথিবীর সব আশ্রয় আশ্রয়হীন করলেও, পৃথিবীর সব প্রেম চলে গেলেও জীবনের সীমাহীন ও তুমুল আলোড়ন ও নির্জনতা নিয়ে এই হৃদয়ই বিরাজ করে। এই হৃদয়ের অন্তরালেই অন্ধকারের কবি মনুজশ মিত্র থেকে গেছেন। তাঁর কাছে পৌঁছাতে গেলে আমাদের গভীরতম নির্জনতা এবং গভীরতম অন্ধকার ভেদ করে যেতে হয়।🍁

ছবি : লেখক ও আন্তর্জালিক 

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 23 February 2025 | Issue 53 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | সংখ্যা ৫৩

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment