Sasraya News

Saturday, February 15, 2025

literature : কুন্তল দাশগুপ্ত-এর আলেখ্য ‘অন্তরীণ’

Listen

হাসিও তো তীব্র এক শরীরি যাপন। বৌদ্ধিক। তাহলে? এসো তবে সে যাপনে এই আকালেও। সেখানে তোমার আমার সীমান্ত থাক সুরক্ষিত। আকাঙ্ক্ষারা মুলতুবী থাক প্রলঙ্ঘনের। বরং এসো নো ম্যানস ল্যান্ডে চ্যালেঞ্জ ছাড়া, আসবে যখন কোঁচড় ভরে সময় এনো। বৃত্তগুলো নিটোল রাখার দায় আমাদের। কী আর করা মধ্যবিত্ত জীবন যাপন। পেট শুনেছে মনের কথা কোন দিনই বা! জানলা তবু আকাশ দেখে হাতছানি দেয়। আলেখ্যটি লিখেছেন : কুন্তল দাশগুপ্ত 

 

 

অন্তরীণ 

কুন্তল দাশগুপ্ত 

 

 

 

কঘেয়ে দেয়াল আর কড়িকাঠগুলো রোজ আমায় মারে। আমি দুঃখ ভুলতে জানলার কাছে গেলুম, জানলা আমাকে পেয়ে এমনি ভাব দেখাতে লাগল যেন সে একটা কেউকেটা, আকাশের হাতছানি সে দেখতেই পেল না। আকাশ ভাবল তার বুঝি ভারি গুমর হয়েছে, তাই সে মুখ ভার করে রইল। আমি তো জানলার হতে চাইনি মোটেই কিন্তু কী করব দরজায় হুড়কো তুলে ঘর দিয়েছে মাঠের পানে হাঁটা, তার মাঠের কোলে বসার শখ হয়েছে। এদিকে মাঠের কোল আলো করে আছে মেঘ-বিজলী, ঘরের সঙ্গে তাদের দারুণ আড়াআড়ি তাই ঘর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পা ঠুকতে লাগল, তার মাঠে নামতে না পারার ক্ষোভ চাপা থাকছিল না। জানলা আমায় পথ দেখাল। দেখি পথ ওড়বার জন‍্য ডানা মেলেছে। দেখে, আমার পথের পিঠে চেপে উড়ে যেতে ইচ্ছে হল খুব, অমনি জানলার গরাদগুলো আমায় রে রে করে তেড়ে এল। আমার দরজায় হুড়কো, জানলায় গরাদ। আমি চোখ বন্ধ করলুম— ফুটে উঠল অন্ধকার।

অন্ধকার! সে তো বারণ, বারণের সঙ্গে রোজ সকাল-সন্ধে লড়াই হয়। কখনো সে আমাকে চিৎ ক’রে দেয়, কখনো আমি তাকে তুলে আছাড় মারি। ডানা মেললেই বারণ আকাশ চুরি করে, চোখ খুললেই জ্বালিয়ে দেয় অন্ধকার। সেদিন বাগানে ছুঁতে গেলুম ফুলের শরীর ও অমনি কাঁটা বাড়িয়ে দিল। ভাগ‍্যিস হাওয়া ছিল, সে কাঁটার ঘাড় ধরে দিল মটকে। হাওয়ার সঙ্গে আমার ভারি বন্ধুত্ব। হাওয়া আমার চুলে বিলি কেটে আদর করে। আমি হাওয়ার আঙুল ধরে হেঁটে বেড়াই নদীর পাড় ধরে আর হাওয়ার দুহাত ভরে দিই কবিতার গুঁড়ো দিয়ে, এসময় বারণ আমার দিকে চোখ লাল করে চেয়ে থাকে। আমার সঙ্গে ছায়ার মত লেগে থাকে বারণ। বারণের আঙুল আমি ধরতে চাই না, ঘেন্না করি ওকে, তবু ও সামনে এসে দাঁড়ায়। একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধুলো ওড়াচ্ছিলুম— বারণ আমায় পাঁজাকোলা করে তুলে এনে ঘরে পুরে হুড়কো লাগিয়ে দিল আর আজ যখন বসুমতী অ্যাভিনিউ-এর ডাকে পা বাড়াচ্ছি তখন কত্ত খুঁজলুম কিন্তু বারণকে কোত্থাও দেখতে পেলুম না।
বারণকে কাঁচকলা দেখাতে না পারার আফশোষে তারায় আগুন জ্বেলে এগুতে লাগলুম আর ঠিক তক্ষুণি একটা আকাল গলগল করে বের হয়ে আসছিল, আমি অবাক হয়ে দেখছিলুম তার ক্ষিদে। ভবিষ্যৎটাকে পুরো খেয়ে সে বর্তমানকে ধরেছে। একে একে বর্ণগুলোকে সে গিলে ফেলল। এক বর্ণহীন ধূসরতা ছড়িয়ে গেল চারিদিকে। আকালের লালা ঝরা ক্ষিদে বুঝে দৌড়ে ফিরলুম, দেখলুম আমার লেখার টেবিলে উঠে বসে আছে একটা ঢাক। আমি ঢাকটাকে নাড়াতে পারলুম না। বুঝলুম টেবিল থেকে একে নামানোর ক্ষমতা আমার নেই, আমি কেবল বাজাতে পারি। ঢাক বাজাতে দেবার অছিলায় আকাল যে আমার মাথা খেতে চায় তা বুঝতে আর বাকি রইল না। আমি নিজের দিকে তাকালুম, দেখলুম আমার তর্জনী আকাল খেয়ে ফেলেছে, খেয়ে ফেলেছে আমার স্বরযন্ত্র। আমার শঙ্খ-ঘন্টা-চন্দনকাঠ-চন্দন পিঁড়ি গেছে আকালের গর্ভে। ঘরের কোনায় রাখা, ভর দিয়ে দাঁড়ানোর লাঠি কবে খেয়েছে খেয়াল করিনি। ঘরের বাইরে চেয়ে আজ দেখলুম বেমালুম খেয়ে ফেলেছে ভরসা! এই মুহূর্তে আকাল খেয়ে ফেলেছে আমার পায়ের তলার মাটি। আমি পড়ে যাচ্ছি… পড়ে যাচ্ছি এক অতল কালো গহ্বরের মধ‍্যে আর পড়তে পড়তে অনুভব করছি আকাল আমার শিরদাঁড়া খেতে পারেনি।
এই…এই সত্যটুকু বিশ্বাসের হাতে জমা ক’রে দেখি ফোনের টাওয়ারে বেঁধা চাঁদ-বুক থেকে জ্যোৎস্নার ফিনকিতে বহুতল-ছাদ ভাসাভাসি। তবে, তার অধিকার নেই কোনো আজ বাতাসবাড়ির খোপ ভাসিয়ে দেবার। তাই, টাওয়ার চুঁইয়ে নেমে জ্যোৎস্নার ফোঁটা কথা হয়ে ছুঁয়ে যায় শ্রমণ-শ্রবণ। শূন্যেই ভেসে থাকা শব্দ-তরীতে লেগে যায় রূপো রঙা জ্যোৎস্নার গুঁড়ো। নদীজল ডাক দিয়ে তাহার গভীরে ডুব দিতে বলে নাগকন্যের খোঁজে। শ্রমণ, শ্বাপদ ঘেরা ইট-জঙ্গলে জ্যোৎস্নায় স্নান ক’রে পুষ্প সাজান, যেন— ফুলের নরম বুক মধুমাখা দেখে কোনোদিন কোনো কীট দন্তে কাটেনি! আঁধার ঘরের দিকে চোখ ঠেরে ঠেরে একমনে অবিরাম বিজলী জ্বালান। আমার কাশির সঙ্গে ওঠা রক্তের রং
জ্যোৎস্নায় আরো যেন গাঢ় মনে হয়। আমি রয়ে যাই বেঁচে-থাকা চেষ্টার প্রত্যেক দিনে এই একটু একটু করে মরে মরে যাওয়া নিয়ে…

এবং তোমাকে চাই।
চেয়ে থাকি।
থেকে যাই… চলে যেতে।
যেতে যেতে খুঁটে খুঁটে আনি নানান সুবাস, সুবাসিত করে তুলি মিথ্যে ঘর-দোর। বকুলগন্ধে বন্যা এলে শুধু কি শরীরই ভেজে? তবু অনিশ্চিত শরীর পোহাই… শরীর-বন্দি যত অনুভব শরীরের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়?
তবে কেন শিশিরের ডাক কানে বাজে? থেকে যায় জমা করা ঘামের ফোঁটারা? ঘামতে ঘামতে হাসি। ঘেমো হাসির অনায়াস তোমাকে মাখাতে চাই শরীরে শরীরে…। শরীর, শরীর… সে কী শুধু দখলের! আর কি তাহার কোনো দাম নেই যাপনে যাপনে? হাসিও তো তীব্র এক শরীরি যাপন। বৌদ্ধিক। তাহলে? এসো তবে সে যাপনে এই আকালেও। সেখানে তোমার আমার সীমান্ত থাক সুরক্ষিত। আকাঙ্ক্ষারা মুলতুবী থাক প্রলঙ্ঘনের। বরং এসো নো ম্যানস ল্যান্ডে চ্যালেঞ্জ ছাড়া, আসবে যখন কোঁচড় ভরে সময় এনো। বৃত্তগুলো নিটোল রাখার দায় আমাদের। কী আর করা মধ্যবিত্ত জীবন যাপন। পেট শুনেছে মনের কথা কোন দিনই বা! জানলা তবু আকাশ দেখে হাতছানি দেয়। আমার কথাও বলব তোমায় হৃদয় খুলে নিজের ভাষার খোলস ফেলে তোমার ভাষায়। কেবল তুমি আসবে বলো নো ম্যানস ল্যান্ডে বজায় রেখে দুরত্বকে শিল্প মাফিক। পাপোশে পা মুছে নিলেও যায়না ধুলো, তাই তো তোমায় ডাকছি এমন আকুল হয়ে।
জল আনবে এক ঘটি ভর সেই ইঁদারার? প্রাণ জুড়োবো আলগোছে ঐ স্নিগ্ধ জলে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু জমে আগুন জ্বলে? জ্বালব না তা। ছা-পোষা যে আমরা এখন। বরং চলো নোনতা জলে বানাই নদী যে নদীটা বইবে শুধু বয়েই যাবে। কোনো কাজেই লাগবে না সে উন্নয়নের। নুনের দানা জমবে কেবল উভয় পাড়ে। সে নিঃসাড়ে মিলিয়ে দিও নিজস্বতা। ফিরিয়ে রেখ জোয়াল টানা অবাধ্য ঘাড়। বুকের নরম। ওম। জেনো তবুও টের পাই ঠিক। বলবে তুমি উষ্ণতা নাই। ভীষণ শীতল। তবুও দেখ নিস্তল এক বিপুল প্রেমে নকশাদারী স্বর্ণ ফ্রেমে নিচ্ছ আমায়। ডাকলে যাকে পাও, তাকে নাও কী নিঃসাড়ে! উপেক্ষা-ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেই দায় চলে যায়! প্রেম! চলে যায়!

ভাঙা ফ্রেমের মানুষ কী আর এত্ত সহজ? বন্ধক সে দেয়নি মগজ কারও কাছেই। তোমার বিপুল নিঃসাড়ে সে সাড়ে ফেরে। হিমেল তোমার নিঃশ্বাসে তার চোখের পাতা বন্ধ হল। তাহার এমন অসুখ দেখে এত্তটা সুখ! ঘুরিয়ে শ্রীমুখ রাখবে যদি, জীবন-নদী মোহনা পেতে ঠোক্কর খেতে এবং খেতে এখনও যাবে…
কবে বা থামাবে এই চলা…
কিছু না বলেই এই এত, এত কথা বলা!

আমার বিভান কথা সব তোমার কথাচুড়োর তলায় ছড়িয়ে দিতে যেই ব্রেক কষলুম, গিয়ার নিলুম নিউট্রালে অমনি, অমনি পথ এমন হ্যাঁচকা টান মারলে যে টাল সামলানোর রিফ্লেক্সে আঙুল চেপে বসল স্টার্টিং বাটনে আর গর্জন করে উঠল ইঞ্জিন।

সে কী আওয়াজ!
কেঁপে উঠল ত্রিভূবন।
বাঁ-পা থেকে দেহভার গিয়ে পড়ল ডান-পায়ে, মাটি থেকে উঠে এল বাঁ-পা, রিফ্লেক্সেই হিল করল গিয়ার। বাঁ হাতের আঙুল চারটে হতভম্ব হয়ে ক্ল্যাচ ছেড়ে দিল।

হিল— হিল— হিল…
ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড-ফোর্থ পেরিরে ফিফ্থ গিয়ার নিয়ে বাইক উল্কা হল।
তোমার কথাচুড়ো হারালো।
উড়ে গেল আমার বিভান-কথারা, চলে গেল না ফেরার দেশে বাতাস-বাহন।
তোমার কথাচুড়ো স্থানু। দেখতেছিল গর্জমান এক যন্ত্র সওয়ার, পাঁচের ডাকে খুব ছুটেছি, খৈ লুটেছি। বেবাক ফাঁকা রাস্তা আমায় পৌঁছে দেবে শূন্য ঘোরে। যত্ন ক’রে। ভূবনকারায় অন্তরীণের শূন্যমিতি কষলে শেষে শূন্য পাব এবং হব।
শূন্য আমার প্রণাম নিও
প্রণাম নিও
নিও…🍁

ছবি : সংগৃহীত 

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 26th January 2025 | Issue 49 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | চিঠি সংখ্যা |২৬ জানুয়ারি ২০২৬ | সংখ্যা ৪৯

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment