



🍂ভ্রমণ : লেহ – লাদাখ
বাদামি পাহাড আর সবুজে আবৃত চারপাশ। স্টক কাংরি তুষার শৃঙ্গের উপর শেষ সূর্যের লাল আভা। এরপর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পেরিয়ে পূর্ব দিকে শ্যা গুম্ফা। শ্যা লাদাখের রাজধানী আর লেহ হল লাদাখের জেলা। সোনার জলে গিলতি করা এখানকার শাক্যমুনি বুদ্ধমূর্তি বিখ্যাত।সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে লাদাখ রাজ সেনগে নাম গিয়াল তাঁর বাবার স্মৃতিতে এই গুম্ফা প্রতিষ্ঠা করেন। এর আরও ৫ কিলোমিটার দূরে থিকসে গুম্ফা। লাদাখে অজস্র গুম্ফা। লাদাখি সমাজে গুম্ফা ও তার লামারা অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। থিকসে গুম্ফাটি পাহাড়ের গা বেয়ে থরে থরে সাজানো বাড়ির মধ্যে। সম্প্রতি লেহ – লাদাখ (leh – Ladakh) থেকে ফিরে লিখলেন : পাপড়ি ভট্টাচার্য
খুব অল্প বয়সে ভূস্বর্গ কাশ্মীরভ্রমণ গ্রন্থটি পড়ে একটি স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল তারপর কত পাহাড় কত সমুদ্র সান্নিধ্য হল স্বপ্নটা মনের কোণেই থেকে গেল। হঠাৎ পারিবারিক ভ্রমণের আলোচনায় বলে ফেললাম, সে কথা অতএব পূুজোর ছুটিতে হবে স্বপ্ন পূরণ।
অনেক প্রস্তুতি নিয়ে শ্রীনগরের টিকিট বুক করেছি। সেখান থেকে যাব লেহ, লাদাখ (leh – Ladakh)। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ৩৭০ ধারা খারিজ করে দেওয়াতে আমাদের ভ্রমণসূচি এলোমেলো হয়ে গেল। শোনা গেল মোবাইল পরিষেবা, পেট্রল পরিষেবা সব বন্ধ এদিকে ফেরার টিকিটও কাটা আছে। ফ্লাইট সরাসরি দিল্লী হয়ে কলকাতা। আমরা শ্রীনগরের টিকিট ক্যানসেল করে পরিস্থিতির চাপে পড়ে শেষমেষ লাদাখি মানুষ লিয়াকত ভাইয়ের আশ্বাসে লেহ যাবার টিকিট সংগ্রহ করলাম। কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে লেহ।
ফ্লাইটের জানালা দিয়ে পঞ্চমীর রাতে দেখলাম সুসজ্জিত আলোকোজ্জ্বল কলকাতাকে এরপর একদিকে হিমালয় অন্যদিকে মেঘের উপর দিয়ে লেহ যাওয়ার অসাধারণ দৃশ্য।
ভর দুপুরে ছোটখাটো লেহ এয়ারপোর্টে নেমে ঠাণ্ডায় শরীরকে জ্যাকেট বন্দী করতে হল। প্লেনের উইন্ডো থেকে দেখা স্বর্গটা যেন হাতের তালুতে নেমে এলো।চার পাশের কত রকম ডিজাইনের পাহাড় আমাদের আলিঙ্গন করল। পাহাড়ের বুকের ভিতর দিয়ে হতবাক করা সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে গাড়িতে আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম লের Kuzey রিসর্ট। পাহাড় ঘেরা চারপাশ। কুচুি কুচি বরফ পাহাড়ের গায়ে। রিসর্টের মালিক আসগর ভাই অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, আজকের দিন ফুল রেস্ট। এটা হল শরীরকে ঠাণ্ডার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।সঙ্গী টিভি এবং গরম চা আর কফি।
পরের দিন নরম কম্বলের ভিতর থেকে শরীরকে টেনে বার করে গরম জলে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম।ঝলমল আকাশে রোদ চিকচিক করছে আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে যখন লে লাদাখের সাইট সিন দেখতে বেরোলাম তখন মনেই হল না রাতে মাইনাস ফাইভ-এ কম্বলের ওমে ঘুমিয়েছি।
প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে প্রথমে গেলাম হেমিস গুংফা টিকিট ৫০ টাকা ভেতরে বেশ বড় একটি মিউজিয়াম। বিভিন্ন সম্পদে এই সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ। এরপরের দ্রষ্টব্য স্থান লেহ প্যালেস। লেহ শহরের মধ্যে একটি অনুচচ পাহাড়ের মাথায় রয়েছে লেহ প্যালেস। ন’তলা উঁচু এই প্রাসাদটা শহরের প্রায় প্রতিটি অংশ থেকে দেখা যায়। এক সময় লাদাখ সাম্রাজ্য শাসিত হতো এই প্রাসাদ থেকে। তবে ভেতরে বাইরে এখন আর সেই চাকচিক্য নেই। শুধু ইতিহাসের সাক্ষী। টর্চ হাতে প্রবেশ করতে হয়।
২.
প্রায় সন্ধ্যাতে পৌঁছে গেলাম “শান্তি স্তুপে।” বাদামি পাহাড আর সবুজে আবৃত চারপাশ। স্টক কাংরি তুষার শৃঙ্গের উপর শেষ সূর্যের লাল আভা। এরপর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পেরিয়ে পূর্ব দিকে শ্যা গুম্ফা। শ্যা লাদাখের রাজধানী আর লেহ হল লাদাখের জেলা। সোনার জলে গিলতি করা এখানকার শাক্যমুনি বুদ্ধমূর্তি বিখ্যাত।সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে লাদাখ রাজ সেনগে নাম গিয়াল তাঁর বাবার স্মৃতিতে এই গুম্ফা প্রতিষ্ঠা করেন। এর আরও ৫ কিলোমিটার দূরে থিকসে গুম্ফা। লাদাখে অজস্র গুম্ফা। লাদাখি সমাজে গুম্ফা ও তার লামারা অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। থিকসে গুম্ফাটি পাহাড়ের গা বেয়ে থরে থরে সাজানো বাড়ির মধ্যে। এখানকার বুদ্ধমূর্তিটির কপালে শঙ্খ কুণ্ডলী, স্নিগ্ধনয়নের এটি হল মৈত্রেয় বুদ্ধ মূর্তি।
থিকসে মনাস্ট্রির চারপাশে ফুলের সমারোহ। যেন কাশ্মীর উপত্যাকা। লেহ ফেরার পথে পড়েছে স্তাকনা, মাথো আর স্তক গুম্ফা।
এরপর আমাদের মুসা ভাই গাড়ি দাঁড় করালেন একটা স্কুলের সামনে। রাঞ্চোর স্কুল।স্কুলটি ধস নেমে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমির খান আবার তৈরি করে দিয়েছে তাই নাম রাঞ্চোর্স স্কুল।এরপর লেহ শহরে লাঞ্চ সেরে রওনা হয়েছিলাম শান্তি স্তুপে। যা আগেই লিখেছি।কিন্তু মেঘ আর তুষারপাতের জন্য বিখ্যাত সূর্যাস্ত দৃষ্টিগোচর হল না। তবে পুরো শহর আর কারাকোরাম পাহাড় আমাদের চোখ থেকে কখনওই হারাবে না।
৫ অক্টোবর আমরা রওনা দিলাম লামায়ুরু মনাস্ট্রি অভিমুখে। রাস্তা একশো কুড়ি কিমি। যাওয়ার পথে একটি পাথর সাহেব গুরুদুয়ারায় জুতো খুলে পা ধুয়ে উঠলাম।প্রণাম সেরে লঙ্গরখানায় গরম এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে খুব আরাম হল। এবার গাড়ি গিয়ে পৌঁছল ২৫ কিলোমিটার দূরে ম্যাগনেটিক হিলে। কিছুটা রাস্তা ছাড়া গাড়ি নিজে নিজে চলল। সারথি মুসা ভাই হাতে কলমে দেখালেন। এবারে এগিয়ে গেলাম সিন্ধু নদ আর জাঁসকর নদীর সঙ্গমস্থলে।নীল আর সবুজের দুই দিক থেকে মিলন অসাধারণ দৃশ্য।জল ছুঁতে আমরা গাড়ি করে নামলাম আরও নিচে। চোখ মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মনে হল যেন পাখি হয়ে উড়ে এলাম।
লামাউরু যেতে অনেকটা সময় লাগলেও পথে যেতে যেতে চারপাশের সিনিক বিউটি দেখতে দেখতে মনে হয় ফটোশুটে কাজ কি। এসব সৌন্দর্য স্বর্গের।সমতলের লোকেরা নিজের চোখে দেখলে তবেই সার্থক।এই ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসীম অনন্ত। যদি একটু সাবধানে সতর্ক পা ফেলি। সঙ্গে নিয়েছি অক্সিজেন সিলিন্ডার আর কোকা থার্টি। ভয়টা আবার কি? গাড়ির মধ্যে চোখে ভাসছে লামায়ুরু মনাসট্রির নানা ভঙ্গিমার বুদ্ধমূর্তি। কানে বাজছে ঢোল বাদ্যের সঙ্গে লামার মন্ত্র পাঠ। ফেরার পথ যাওয়ার পথ এখানে এক নয়। অতএব সব দ্রষ্টব্য সেরে নিতে হবে। সেই পাকদণ্ডী পথে পড়ল। পথ মানে পাহাড়ের গা ঘেঁষে গাড়ি যাওয়ার সংকীর্ণ রাস্তা।
দার্জিলিং-এর মত খাদ, জঙ্গল এসব নেই। নানা রঙের পাহাড় একে অন্যের গায়ে সেঁটে রয়েছে। যেন গড় গড়িয়ে ওঠানামা করতে পারব। দূরে পাহাড়গুলোর মাথায় যেন শুভ্র মুকুট। যেন ছিলে কাটা রুপোর নকশা।আসলে বরফের উপর সূর্যালোক। এত সৌন্দর্য ছবিতে আর কতটুকু ওঠে।বলে রাখি লামা যাওয়ার পথে যেতে যেতে নেমেছি এক মাটি রংয়ের পাহাড়ের কাছে। অপূর্ব। ওখানকার মানুষ নাম দিয়েছে মুনস্কেপ বা মুনল্যান্ড। কাছে গেলে মনে হবে, মহাকর্ষের কাছে চলে এসেছি। দিনদুপুরে যখন এত সুন্দর তাহলে চাঁদের আলোয় কেমন হবে তার রূপ? ফিরে যেতে মন চায় না।
৩.
ফিরে এলাম লেহ রিসোর্টে।এই ক’য়েকদিনে আমরা লাদাখি হয়ে গেছি। ঠাণ্ডার সঙ্গে দারুণ বোঝা পড়া।
আমাদের পাশে পাশে নদীও যাচ্ছে পথ দেখিয়ে। মুসা ভাইয়ের কাছে শুনলাম, সিন্ধু নদ আর জাঁস্কর নদী শীতকালে বরফ হয়ে যায়।এই জাঁসকর নদীর বরফের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ট্রেকাররা পৌঁছে যেতে পারে পদম শহরে। এই হলুদ রঙের এব্রো খেবড়ো পাহাড় তখন সমগ্র অঞ্চল জুড়ে সাদা হয়ে মৌন তপস্বীর জটার ভূমিকা নেয়।
৬ অক্টোবর সকালে যাত্রা শুরু খার-দুংলার পথে।খারদুংলা গিরিপথের ১৮০০০ ফিট উচ্চতা। লেহ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব খারদুংলার। আজ আমরা সকাল থেকেই খুব উত্তেজিত। এই বড় মাপের অভিযান কমপ্লিট করতে পারব তো? এরপর আমরা দেখতে যাব নুব্রা ভ্যালি। এই নুব্রা উপত্যকার আকর্ষণ শীতল মরুভূমি। পাহাড়ে মরুভূমি কি আশ্চর্য তাই না? কিন্তু এই মরুভূমির দেশে যেতে হলে আমাদের পেরতে হবে বিশ্বের উচ্চতম গিরিখাত খারদুংলা।
শ্বাসকষ্ট হতে পারে ভেবে গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত রেখে লেহ শহরকে নিচে রেখে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল উপরের দিকে।একটার পর একটা পাহাড় অতিক্রম করে ঘূর্ণায়মান চড়াই-উতরায় পথে যত উপরে উঠছি উত্তেজনার পারদ জমছে। কি আনন্দ।উপর থেকে নিচে তাকালে দেখি কিছু পাহাড় নিচে চলে গেল। ফেলে আসা রাস্তাটা অজগর সাপের মত বেষ্টন করে আছে জটা জুটধারী অন্য পাহাড়কে। নিচের গাড়িগুলো ছোট খেলনা গাড়ি মনে হচ্ছে। এ সৌন্দর্য কি করে বোঝাবো। মনে হচ্ছে কুচি কুচি বরফ ছড়ানো পাহাড়ের গা বেয়ে স্বর্গের সিঁড়িতে উঠছি। ক্রমশ আমরা মেঘেদের সঙ্গে। এত ভাল লাগা কোথাও পাইনি।গাড়ির বাইরে নেমে ফটো তুলতে গেলেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।কোকা ৩০ খেয়ে নিচ্ছি।নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছনো মাত্র তুষারপাত। সাদা পাহাড় আরও সাদা। রাস্তাও সাদা। জমে যাচ্ছি ঠাণ্ডায়। ফটো মনের ক্যামেরায় বন্দী করে নামলাম বরফ শীতল পথে।ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে কোনও রকমে ঢুকে গেলাম আর্মি ক্যান্টিনে। বড় গ্লাস ভর্তি গরম কফি খেয়ে শরীর ধাতস্থ হল। কিন্তু আমাদের থামায় কে! বাঙালির ভ্রমণ নেশা প্রায় পাগলের পর্যায়ে। নাক মুখ ঢাকা কিম্ভুত ছবিগুলো বরফের খেলা ঘরের প্রমাণ।তবে এখানে বরফে হাত দেওয়া মানেই অসুস্থতা ডেকে আনা।
এবারে ফেরার পালা। গাড়িতে বসে আমরা দেখছি।গাড়ির চাকায় চেন বাঁধা হচ্ছে কারণ, প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা বরফে ঢাকা। খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চলছে। দারুণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। উল্টো দিক থেকে মিলিটারি ট্রাক ঝুরো ঝুরো মাটি ফেলতে ফেলতে আসছে। বরফের রাস্তা শেষ হতে চাকা থেকে চেন খুলে ফেলা হল। আবার স্বাভাবিক স্পিডে চলছে গাড়ি ঘোরাল পথে। ড্রাই ফ্রুট সঙ্গে ছিল।কিসমিস, খেজুর, আমনড, কাজু খেতে খেতে যাচ্ছি।নামছি নিচের দিকে। গুলিয়ে উঠল পেট। ধরফর করে গাড়ি থামিয়ে সে কি বমি।বরফ শীতল জল চোখে মুখে দিয়ে আস্তে আস্তে শরীর ঠিক হল নিচে নেমে।
এবার চলেছি নুব্রার পথে।কিন্তু নুব্রা সরাসরি না গিয়ে আমরা ৪০ কিমি আরও এগিয়ে দেখতে পেলাম পানামিক উষ্ণ প্রস্রবণ।এরপরে সিয়াচেন বর্ডার। তারপরে পৌঁছলাম পানামিক মনা স্ট্রি।
৪.
খুব সাজানো-গোছানো আধুনিক। ভেতরে আপেল বাগান। থোকা থোকা লাল টুকটুকে আপেল দেখার আনন্দই আলাদা। সেখান থেকে বেরিয়ে গাড়ি চলল হুন্ডারের দিকে। সেখানেই আছে মরু বালিয়াড়ি। কিন্তু চরাচরে সন্ধ্যে নেমেছে। তাই মুসা ভাই গাড়ি পৌঁছে দিলেন নুব্রার হোমস্টেতে। দু’রাত থাকব নুবরাতে। তাই পরদিন অন্য সব যাওয়া হবে। তবে আমার নাতি একবার চড়ে নিল quadbike . ৮ কি মি বাবাকে পাশে বসিয়ে নিজে বাইক চালিয়ে বিশ্ব জয়ের হাসি নিয়ে ফিরল। সূর্য গেল অস্তাচলে। আমরা চারজন ঢুকলাম ফিরোজ হোমস্টেতে। সেখানে ভাবীর হাতের গরম গরম লাদাখি চাপাটি আর ঘন ডিমের কারি খেয়ে তুলতুলে কম্বলের অন্দরে ঘুম।
৭ অক্টোবর। ঝকঝকে একটি রোদেলা সকাল। নুবরা থেকে ঠিক ন’টায় ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা হলাম তুরতুক গ্রামের দিকে। নুব্রা থেকে এর দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। ভারতের একেবারে শেষ প্রান্তে।সামরিক দপ্তরের চেকিং তো সব সময় আছেই। লাইন অফ কন্ট্রোল এর কাছাকাছি সাবে বালটিস্থানের অংশ।পাকিস্তান বর্ডার কাছেই।মুসলিম প্রধান এই গ্রামটি।চাষবাষে ব্যস্ত কিশোরী, যুবতীগুলোর মুখে অমলিন হাসি আর মুখের সৌন্দর্য অনেকদিন মনে থাকবে।সহজ সরল সাদাসিধে মানুষগুলি এক মুখ হাসি নিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। যেমন করে পুরো রাস্তায় শায়ক বা শিয়ক নদী তার অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে আমাদের পাশে পাশে চলছিল। সে চলেছে কখনও দূরে ছবি হয়ে কখনও খুব কাছে কল কল সবুজাভ জল ছড়িয়ে। ছোট বড় নানা মাপের ব্রীজ পেরিয়ে চলতে চলতে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম সবুজ ঘেরা ছোট্ট গ্রামটিতে। পায়ে পায়ে সেখানে সবুজ, ফুলে ফুলে রঙিন, পাহাড়ের গায়ে গায়ে গাছের বেঁচে থাকা ঝরণার জল সম্বল করে। পাহাড়ি ঝোরা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম।আবার একটা মনাস্ট্রিও দেখা হল। এবার একেবারে শায়ক নদীর জল ছুঁতে আমরা চারজন নেমে পড়লাম।
ঝুলন্ত সেতুর নিচে শায়ক নদী পাথরের খাঁজে খাঁজে মৃদু-কল্লোলে নেচে চলেছে।চারদিকে পাহাড়। কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছিল সবুজ আপেল। আরও নানা ড্রাই ফ্রুট। ধাবায় লাঞ্চ সেরে গেলাম তুরতুক মিউজিয়ামে।সেখানে দেখা পেলাম লাদাখ রাজার শেষ বংশধরের। বয়স জ্যেষ্ঠ মানুষটির তরোয়াল হাতে অন্যান্য অর্থাৎ তাঁর আগের রাজাদের বাবা, কাকা, জ্যাঠার ছবিতে দেখি দারুণ একজন সুন্দর পুরুষ।তরোয়ালটি এখনও আছে তাঁর হাতে। তিনি খুব সুন্দরভাবে হিন্দি ভাষায় বর্ণনা করছিলেন বিগত ইতিহাস। তাঁদের ব্যবহৃত পিতলের, কাঠের সামগ্রীগুলো পুরনো হয়ে গেলেও তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন সব। তাঁর ব্যবহার খুব অমায়িক। তবে এই রাজার জীবনধারণ টুরিস্টদের দেওয়া অনুদানে।আর পাশে ছোট্ট এক ঘেরা জায়গায় বিশাল এক টিনের ট্রাঙ্ক আর দাঁড়িপাল্লা।আমাদেরকে ড্রাই এপিকট বিক্রি করলেন। খুবই সুমিষ্ট ফল। পথের ক্লান্তি নিমেষে উধাও।
৫.
গরীব রাজার বাসস্থান ছেড়ে রওনা হলাম নুবরার দিকে।পথের শিয়ক নদী যেন প্রশ্ন করল রাজ দর্শন কেমন হল?মনে মনে বললাম রাজার মতই। আমার মেয়ে, জামাই, নাতি তাঁকে প্রশ্ন করলেও আমি কোনও প্রশ্ন করিনি।তার চোখ ঘুরে ফিরে আমাকে দেখছিল।সাইনবোর্ড টাঙিয়ে আমি রাজা ছিলাম। এটা আমার ভাল লাগেনি। তবে তার দৃষ্টি অন্যরকম, রাজার মতই।বহুদিন মনে থাকবে।
এবার আমরা পৌঁছলাম শীতল সাদা বালির মরুভূমিতে। পিচসড়ক ছেড়ে বালিয়াড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে খুব ভালো লাগছিল।নানা আকৃতির বালিয়াড়ি রয়েছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। মাঝে মাঝে মরুদ্যানের মত সবুজ প্রান্তর। তার উপর দিয়ে ঝিরঝির করে বইছে জলধারা। আশ্চর্য সুন্দর প্রকৃতি।
এখানে বালিয়াড়ির বুকে আমরা ক্যামেল সাফারিতে নেমে পড়লাম। লাদাখের একমাত্র এই অঞ্চলেই দুই কুঁজ বিশিষ্ট ব্যাকটেরিয়ান উট দেখা যায়। পিঠের দুই কুঁজের মাঝখানে বসার জায়গা। সাফারির সময় আধঘন্টা। এর বেশি হলে বেশি চার্জ। বেশ মজার পথ চলা, উটের পদাতিক ছন্দে উড়ছে বালি। আরোহী নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে ওরা তাড়াতাড়ি পা চালালে আমাদের টাল টামাল অবস্থা। ঘুরে বেরিয়ে উঠকে আদর করে ফিরে চললাম।পিছনে অস্তগামী সূর্যের সোনালী আভা। আহা কি মনোরম পরিবেশ। শীতল মরুর বুকে এক দিকে পাহাড়, অন্যদিকে নদীর তীরে কিছু ছুটে বেড়াচ্ছে কিয়াং।উপত্যকার উপর বয়ে চলা ঝোরার উপর আছে একটি অস্থায়ী সাঁকো। সাঁকো পেরিয়ে নদীর কাছে, আপন ছন্দে পাথর ডিঙিয়ে বয়ে যাচ্ছে শিয়ক। প্রকৃতি একেবারে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে রূপ রাশি। নদী, বালি পাহাড় ও আকাশের বুকে।নুবরা উপত্যকা এতটাই সুন্দর। চললাম হোমস্টের দিকে সন্ধ্যে নামতেই। এখানে সবকিছু সৌর বিদ্যুতে চলে।রাত ন’টার মধ্যে সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। সকালে স্নানের জল ও সৌর বিদ্যুতে গরম হয়।
৮ অক্টোবর। আজ নুব্রা ছেড়ে রওনা দিলাম ১৫ হাজার ফিট উচ্চতার প্যাংগং সরোবরে। প্রায় পাঁচ ঘন্টার যাত্রাপথ এটি। নানা পাহাড়, ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম মিলিটারি বেস ক্যাম্প পেরিয়ে চলেছি ওই সুদুরে।দু’চোখ ভরে দেখছি প্রকৃতি।লাদাখ ভ্রমণে সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী হল প্যাংগং সরোবর।অনেকেই লেহ পৌঁছে চলে যেতে চায় প্যাংগং। দুম করে ৪৪০০মিটার উচ্চতায় পৌঁছে তারা অক্সিজেন সল্পতায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই প্যাংগং সরোবর দর্শনের আগে উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়া জরুরি।
৬.
এই সারাদিনের ভ্রমণে আমাদের ব্রেকফাস্ট আর ডিনার ট্যুরের সঙ্গে ইনক্লুডেড। তাই লাঞ্চটা স্থানীয় ধাবাগুলোতে সেরে নিতে হচ্ছে। আর স্পেশাল চা পান তো নানা জায়গায় চলছে গাড়ি থামিয়ে। তবে লাঞ্চ বলতে যা বুঝি তা খাচ্ছি না। চাওমিন, ফুক্পা মোমো, ম্যাগি উইথ ডিম ঝুড়ি যে যার পছন্দ মত খেয়ে শরীর হালকা রাখতে হচ্ছে। হঠাৎ মুসা ভাই বললেন ওই যে প্যাংগং লেক শুরু হয়ে গিয়েছে। এবার চলব তার পাশে পাশে। আমরা অবাক নয়নে উপভোগ করছি নীল জলের আয়নার স্বচ্ছতা। এ যেন স্বর্গের জলাধার। উপরে পড়ন্ত সূর্যের সে কি রং বাহার। গাড়ি থেকে নামা মাত্র টের পেলাম ঠাণ্ডা কাকে বলে। নাকে মুখে ঠাণ্ডা ঢুকছে। সেই সঙ্গে তীব্র শনশন হাওয়া। আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে আমরা নেমে গেলাম পেংগং লেকের তীরে।স্পর্শ করলাম হিমশীতল জল। ফটো তোলার জন্য এক সেকেণ্ড নাক মুখ বার করে আবার ঢেকে দিতে হচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে, কি করে থ্রি ইডিয়েট সিনেমার ক্লাইম্যাক্স-এর শুটিং হয়েছিল এখানে!
পালিয়ে এলাম কুঁড়েঘরে।এখানকার ছোট ছোট অস্থায়ী তাঁবু ধাঁছের কটেজকে এরা হাট বলে।প্রতিটি কটেজের সামনে কাচ ঘেরা বারান্দা। সেখানে বসে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্যাংগং লেকের রং বদলানো দেখলাম। কখনও নীল কখনও সবুজ কখনও সী গ্রিন।
যখন গাড়ি প্রথম প্যাংগং পাড় দেখাল সেটার নাম লুকুম।এ কটি প্যাংগংএর পশ্চিমতম বিন্দু। যারা এখানে রাত্রি বাস করতে চায়না তাদের দর্শন এখানে শেষ। আমরা প্যাংগং সরোবরের পাড় ধরে যত এগিয়েছি ততই যেন তার রূপ খুলছে।১৩৫ কিলোমিটার লম্বা এই লেকটির এক-তৃতীয়াংশ আছে ভারতে, বাকিটা তিব্বতের অন্তর্গত। চওড়া অবশ্য খুব বেশি নয়,মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার। সারাদিন লেকের বুকে রং বদলের খেলা চলে। সূর্য ডুবতেই ঘন কালো জল আর তিরতিরে ঢেউ।
ঘর থেকে এক পা ক্যান্টিনে যেতে গিয়ে দেখি তুষারপাত হচ্ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে খাওয়া সেরে ঢুকলাম তাঁবু ঘরে। সারারাত ঘুমোব কী শরীর গরম হচ্ছে না। এমন অভিজ্ঞতা কোথাও হয়নি। তবে ভোরে সূর্যোদয় দেখে সব ক্লান্তি চলে গেল।রাতে থেকে এই কষ্ট সহ্য করেছি বলেই তো এমন পাহাড় বেষ্টিত নীল জলের স্বর্গ দর্শন হল।
৯ অক্টোবর। প্যাংগং থেকে আমরা এবার রওনা দিলাম সোমোরিরির পথে। পথে পড়ে চুশুল, সাগালা গিরিপথ, মাহে ব্রীজ হয়ে চললাম। চীন সীমান্তের খুব কাছে।জনমানবহীন দুর্গম রাস্তা।বরফ পড়া শুরু হলে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না।
এখানে প্রকৃতির আরেক রূপ। বিস্তীর্ণ ধুধু সমতল, মাঝে মাঝে স্বল্প উঁচু মত পাহাড়, দূরে বরফাবৃত পাহাড়। প্রায় চার হাজার পাঁচশো মিটার উচ্চতায় রূপের আকর এই অঞ্চলটি কে বলা হয় রূপসু।সোমোরিরি যত এগিয়ে আসে তত দূরের তুষার শৃঙ্গগুলি চলে আসে খুব কাছে। চোখ জুড়ানো সবুজ জলাভূমি পেলদোর পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম সোমেরিরি। ২৯ কিলোমিটার লম্বা ৮ কিলোমিটার চওড়া প্রায় মিনি সমুদ্র যেন। এই সুবিশাল জলাশয় ঘিরে আছে চামসের কাংরি, লামসের কাংরি। মেন টক প্রভৃতি বিভিন্ন তুষার শৃঙ্গ। হৃদের ঢেউ ওঠা নীল জলে সাদা মেঘের ভেলার প্রতিচ্ছবি ক্ষণে ক্ষণে নিজেদের রূপ বদলাচ্ছে।
পেলদো থেকে আরও এগিয়ে ঢুকলাম তাঁবু ঘরে। প্রায় সন্ধ্যা রাত। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে পড়ল বিছানায়। হাওয়া কম, অক্সিজেন খুব কম। অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়।আরেকটা অসুবিধা হল, টয়লেটের বেসিনে জল জমে গেছে। ঈষদউষ্ণ জল হোটেলের ক্যান্টিন থেকে নিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।এরপর ডিনার সেরে লম্বা রাত ঘুমের দেশে। গর্ব হচ্ছে লাদাখ ভ্রমণের আজ উচ্চতম রাত্রিবাস এখানে।একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল ওদের দেওয়া কম্বল এবং তার নিচে সিন্থেটিক ওয়ার দেওয়া পশমিনার ভিতর।যতবার হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে শুতে যাই ভেতরে জোনাকির মত আলো জ্বলে ওঠে। হাতের ঘর্ষণে সৌর বিদ্যুৎ জ্বলে উঠছে দেখে দেখে আনন্দে ঘুমিয়ে পড়লাম। এত ঠাণ্ডায় ঘুমোতে অসুবিধে হয়নি।
৭.
১০ অক্টোবর। সোমোরিরি থেকে লেহ ফেরার পালা।রাস্তা খুব ভাল। পথে পড়ল আরও একটি উষ্ণ প্রস্রবণ।রীতিমত ধোঁয়া উঠছে। পাশে পাশে আগের মত সিন্ধু নদ চলেছে। পথে লাঞ্চ সেরে আমরা বিকেল চারটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম খুজে রিসোর্টে।ফিরে মনে হল আরামদায়ক শীতকাল। খুব এনজয় করলাম আমাদের সান্ধ্যটি পার্টি। এদিকে শ্রীনগরের টিকিট ক্যান্সেলের চক্করে আমাদের একটা এক্সট্রা দিন রয়ে গেল। তাই শপিং আর রেস্তোরাতে লাঞ্চ ঠিক ছিল।কিন্তু সন্ধ্যে রাতে আমন্ত্রণ এল। লিয়াকত ভাই দুপুরের লাঞ্চ আয়োজন করবেন তাঁর বাড়িতে। তাঁর পাঠানো গাড়িতে আমরা সেজেগুজে গেলাম তাঁর বাড়িতে। সুন্দর ছিমছাম সাজানো গোছানো লাদাখি বাড়ি। আর আতিথেয়তার ত তুলনা নেই।তাঁর স্ত্রীর সুন্দর খাবার পরিবেশন সবাইকে মুগ্ধ করল। প্রথমে দিলেন কাচের বাটিতে ড্রাই ফ্রুটস এবং সুপ।তারপর মাটন বিরিয়ানি।রায়তা, চাটনি আর শেষে দুধ আর কলা দিয়ে তৈরি মিষ্টি।এত সুস্বাদু হালকা খাবার মুখে লেগে আছে এখনও।
এরপর তাঁর গাড়িতে ঘুরলাম লেহ মার্কেট। মার্কেটিং সেরে চা পকোড়া খেয়ে ফিরে এলাম রিসোর্টে আগামীকাল সকাল ৯ঃ০০ টায় আমাদের ফ্লইট। বাই বাই লেহ লাদাখ ও লাদাখি সরল মানুষজন।
যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য : কলকাতা থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে লেহ এয়ারপোর্ট। অন্যভাবেও যাওয়া যায়। আসগর ভাই খুজে রিসোর্ট এর মালিক
ব্যবহার ও আতিথেয়তা ভীষণ ভাল। রিসোর্টটিও মনোরম পরিবেশে।🍁
ছবি : লেখক ★ ফিচার ছবি : আন্তর্জালিক।
