



সোনালী মিশ্র ★ সাশ্রয় নিউজ : এক হাতে ইতিহাস, আরেক হাতে প্রকৃতির অলৌকিক শিল্পকলা। এমন কোনও জায়গা বিরল যেখানে দুইয়ের যুগলবন্দী এত নিখুঁতভাবে চোখে পড়ে। হাম্পি (Hampi) দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক (Karnataka) রাজ্যের এক প্রাচীন ইতিহাসের শহর। আর এই হাম্পির হৃদয়জুড়ে রয়েছে মাতাঙ্গ পাহাড় (Matanga Hill)। শহরের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই পাহাড়টির চূড়া থেকে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা যেন জীবন থেকে একখণ্ড স্বপ্ন চুরি করে নিয়ে আসা।
ভোর হতেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম হাম্পি বাজারের কাছেই। সেখান থেকে মাতাঙ্গ পাহাড়ে ওঠার পথ শুরু। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে যেন প্রতিটি ধাপে ইতিহাসের ধুলো পড়ে আছে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল পাথরের শিলাস্তম্ভ। কিছুটা যেন চাঁদের পাহাড়ের মতো বিস্ময় জাগায়। ধীরে ধীরে কষ্টসাধ্য ওপরে ওঠার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ নিচের দিকে চোখ পড়লে দেখতে পাওয়া যায় অচেনা ধূসর ও সবুজের সঙ্গম। সেদিন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলে হঠাৎই বদলে যায় পাহাড়ের রঙ। চারপাশের পাথরগুলো যেন নিজস্ব ভাষায় সূর্যের সঙ্গে কথা বলছে। সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে ধীরে ধীরে নেমে আসে, সেই রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়চূড়ার প্রতিটি কোণে। তখন চারপাশটা অদ্ভুত এক কমলা-সোনালী আভায় ভরে ওঠে। মাতাঙ্গ পাহাড়ের চূড়া থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় সমগ্র হাম্পির বিস্তার। তুঙ্গভদ্রা (Tungabhadra) নদী যেন এক স্নিগ্ধ রেখার মতো বয়ে চলেছে হাম্পির বুকে। নদীর ওপার থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ছে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের (Vijayanagara Empire) ধ্বংসাবশেষে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অচ্যুতরায় মন্দির (Achyutaraya Temple), বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলীর এক নিদর্শন, আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু মন্দিরের (Vishnu Temple) মাথা। একসময় এই সমতলভূমিই ছিল দক্ষিণ ভারতের অন্যতম শক্তিশালী রাজধানী। হাম্পির পাথরগুলো যেন সে কথাই আজও বলে চলে নিঃশব্দে। সূর্যাস্তের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয়, সময় যেন স্থির হয়ে গিয়েছে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। বাতাসে কেবল নিঃশব্দ সুর। দূরে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে কোথাও যেন একটুকরো প্রার্থনার শব্দ ভেসে আসে। হাম্পির চূড়ায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের মুখেও নীরবতা। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে, সূর্য ঢলে পড়ছে হিপ্পানা (Hippana) টিলা পেরিয়ে, পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে সোনালী চূড়া। একটা মুহূর্তের জন্য মনে হয়, এটাই হয়ত সেই স্বর্গ যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস আর সময় একসঙ্গে বসবাস করে।
পাহাড় চূড়ায় এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের। নাম বললেন স্বামী ভবানন্দ (Swami Bhavananda)। বললেন, “এই পাহাড়ে সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়, তার মধ্যেই আমি ঈশ্বরকে খুঁজি। ইতিহাস এখানে মিশে আছে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে।” তাঁর গলায় কোনও নাটকীয়তা ছিল না, ছিল নিঃসঙ্গ এক সত্যবোধ। যাত্রাপথে আরও কিছু বিদেশি পর্যটকের সঙ্গেও কথা হয়েছিল। জার্মান পর্যটক এলেনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। সেদিন এলেনা (Elena) বললেন, “I have seen sunsets in Bali and Santorini, but Hampi has something spiritual in the air.” তাঁর কথায় স্পষ্ট ছিল এক চূড়ান্ত অনুভবের ছাপ। পাশে বসে থাকা এক বাঙালি দম্পতি বললেন, “এতটা ঐতিহাসিক অথচ এমন নিস্তব্ধ জায়গা ভারতে বিরল। এখানকার বাতাসেই যেন প্রাচীন রাজত্বের চিহ্ন লুকিয়ে আছে।” অন্যদিকে, সূর্য পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার পরও পাহাড় ছেড়ে নামতে ইচ্ছে করে না। নিচে নামার সময় আবার চোখে পড়ে সেই প্রাচীন সিঁড়িগুলো। প্রতিটা পাথর যেন আরেকটা গল্প বলে, যেন কোনও কালের নায়ক-নায়িকার পদচিহ্নে ভরে রয়েছে। হাম্পিতে সূর্যাস্ত দেখা মানে শুধু প্রকৃতির এক মনমুগ্ধকর খেলা দেখা নয়, এটি যেন এক অভ্যন্তরীণ যাত্রা। নিজের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে। মাতাঙ্গ পাহাড়ের (Matanga Hill) এই সূর্যাস্ত যেন জানিয়ে দেয়, কিছু অনুভব ভাষায় বোঝানো যায় না। শুধুই উপভোগ করা যায়। বসে থাকতে ইচ্ছে করে আরও কিছুক্ষণ। সুনসান অন্ধকারের মধ্যে, দূর থেকে একটা ঘণ্টার আওয়াজ আসে কোনও পুরনো মন্দির থেকে। মন বলে, এই মুহূর্তে হাম্পিই পৃথিবীর কেন্দ্র। এখানেই ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা আর সৌন্দর্য এক হয়ে গিয়েছে। হাম্পি থেকে ফিরেও বারবার মনে পড়ে সেই চূড়ার বাতাস, সেই সূর্য ডোবার রঙ, আর সেই মৌনতা যা কেবল মাতাঙ্গ পাহাড়েই সম্ভব। আজও চোখ বন্ধ করলে যেন দেখা যায়, তুঙ্গভদ্রার (Tungabhadra) পাশটি দিয়ে রক্তিম সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে পাথরের রাজ্যের কোলের ওপরে।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Kandy Honemoon Travelog | মধুচন্দ্রিমায় ক্যান্ডি: প্রেম, প্রকৃতির আতিথেয়তায়
