



হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় : ইংরেজি ভাষার সঙ্গে আমার কোনও বিবাদ নেই বরং একসময় ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ বশতঃ ওই বিষয়টি নিয়ে পড়ার বড় ইচ্ছে জাগে। সুযোগ যে আসেনি একথা বললে মিথ্যে বলা হবে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম বটে তবে যাক সেসব কথা, আজ সংস্কৃতি নিয়ে কিছু প্রলাপ বকতে ইচ্ছে হল। তাই ইংরেজি বিষয়টির অবতারণা করলাম। গৌরচন্দ্রিকা থাক মনের কথা বলি—
আমরা কালচার্ (Culture) এই ইংরেজি শব্দটির সঙ্গে সকলেই পরিচিত। কিন্তু ক’য়েকদিন ধরে কিছু অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায়, অনুষ্ঠিত অংশে খুব বেশি বেশি একটা শব্দ বড় কানে বেজে উঠলো…! তাই চুপ করে থাকতে পারলাম না। কালচারের তর্জমা করে অনেকেই বলছেন কৃষ্টি! এই কৃষ্টি শব্দটি নিয়েই কিছু কথা। এটা কানে শোনামাত্র যেন মনে হচ্ছে এঁটেল পোকা পশুর গায়ে যেমন কামড়ে ধরে বসে থাকে অনুরুপ ভাষার গায়েও শব্দটি এঁটে বসেছে। তবে যে মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের এতো আন্দোলন তাঁর প্রতি আমাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই?
যে মানুষের কালচার্ আছে তাকে আমরা সংস্কৃতিমান বলতেই পারি। ধরুন, যদি শব্দটাকে বিশেষ্য করে বলি তাহলে সংস্কৃতি মত্তা বলব। ওজনে একটু ভারি হলেও হলফ করে বলতে পারি রোমহর্ষক হবে না। ভালো করে ভেবে দেখুন ইংরেজিতে যখন কাউকে কালচারড বলি সেই মানুষটি কে বাংলা তর্জমা করে কৃষ্টিমান বা কৃষ্টি মত্তা বলাটা কি শ্রুতিমধুর শোনাবে…!
দেখুন ইংরেজিতে কালচার্ শব্দটা চাষ এবং ভব্যতা দু’টোতেই চলে। কিন্তু তাই বলে আমাদের এমন ফিরিঙ্গিয়ানা যেন একদম বেমানান। জানি কিছু মানুষ নিশ্চিত এতক্ষণে আমাকে গালিগালাজ শুরু করেছেন তবুও বলছি একটু ভাবুন।
আমরা কালটিভেটেড বলতে পারি কিন্তু কোনও উঁচু দরের মানুষকে চাষ করা মানুষ বললে কি শোভা পায়! খুব স্পষ্ট করে বলি— কৃষ্টি এই শব্দটি ইংরেজি শব্দের পায়ের মাপে বানানো। এতোটা প্রণতি শোভা পায় না। মাপ করবেন আমার ধৃষ্টতা একথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছিলেন।
সংস্কৃত ভাষায় কিন্তু কর্ষণ বলতে চাষ করাই বোঝায় যদিও ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ যোগে মূল ধাতুটাকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থবাচক করা যেতে পারে কারণ সংস্কৃত ভাষায় নিয়ম তাই উৎ বা প্র উপসর্গ যোগে কৃষ্টি শব্দকে মাটির থেকে মনের দিকে তুলে নেওয়া যেতেই পারে,যেমন – উৎকৃষ্টি, প্রকৃষ্টি। কিন্তু ইংরেজি ভাষার কাছে, তো সে দাসখৎ লিখে দিইনি যে তার অবিকল অনুবর্তন করে ভৌতিক ও মানসিক দুই অসবর্ণ অর্থকে একই শব্দের পরিণয় — গ্রন্থিতে আবদ্ধ করব?
আসুন একটু ফিরে দেখি। বৈদিক সাহিত্যে ঢুকলে দেখবেন এখানে শিল্প সমন্ধেও সংস্কৃতি শব্দের প্রয়োগ আছে। আত্ম সংস্কৃতি বার্ব শিল্পানি’একে ইংরেজি করা যেতে পারে , ‘Art indeed are the culture of soul’। ” ছন্দময়ং বা এতৈর্যমান আত্মা নং সংস্কুরুতে’ — এই সকল শিল্পের দ্বারা যজমান আত্মার সংস্কৃতি সাধন করে। মারাঠি, হিন্দি প্রভৃতি অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় সংস্কৃতি শব্দটাই কালচার্ অর্থে স্বীকৃত হয়েছে। সংস্কৃত বুদ্ধি, সংস্কৃত চিত্ত cultured intelligence, cultured mind অর্থে কৃষ্ট চিত্ত, কৃষ্ট বুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্ট এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
শেষের কথায় আসি, যে মানুষ cultured তাকে কৃষ্টিমান বলার চেয়ে সংস্কৃতিমান বললে তার প্রতি সম্মান করা হবে।
ক’য়েকটি উদাহরণ লক্ষ্য করে দেখুন—
★কৃষ্ট – Ploughed or tilled, cultivated ground.
★কৃষ্টি – men , races of men , learned man , or pandit , ploughing or cultivating the soil.
★সংস্কার – making perfect , accomplishments , embellishments,
★সংস্কৃত- perfected, refined, adorned, polished, a learned man.
★সংস্কৃতি- perfection.
এবার তো কৃষ্টিটা এড়িয়ে চলুন এইসব কাজে!
ছবি : আন্তর্জালিক
