



রেজাউদ্দিন স্টালিন বাংলা ভাষার অন্যতম কবি। এছাড়াও তিনি একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। থাকেন বাংলাদেশে। কবির কলম বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে কাব্যে-সাহিত্যে। বাংলাদেশে বসবাসকারী আরেক কবি রোকসানা রহমান -এর গ্রন্থ সম্পর্কে কবি রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন লিখলেন সাশ্রয় নিউজ -এর আজকের পাতায়।
বিশ্ব কবিতা এমন কি বাংলা কবিতায় প্রেম এক চিরায়ত বিষয়। আত্মজৈবনিকতা, নর-নারীর মিলনাকাঙ্খা কবিতার বিষয় হিসেবে পুরানো। কিন্তু আমারা এই বৃত্তাবদ্ধতার বাইরে যেতে পারি না। প্রেম গাঁথার ভেতর আমাদের ঐতিহ্যিক গৌরব লুকিয়ে আছে। ময়মনসিংহ গীতিকা, মধ্যযুগের কৃষ্ণকীর্তন, মহুয়া মলুয়ার পদাবলী অধুনা জসিমউদ্দীনের নক্সীকাঁথার মাঠ, সোজন বাঁধিয়ার ঘাট আমাদের উত্তরাধিকার। বিশ্বসাহিত্যে লায়লি মজনু, শিরি ফরহাদ, রোমিও জুলিয়েট এসব প্রেমোপাখ্যান মানব সভ্যতার গভীরতম আকাঙ্খার সঙ্গে যুক্ত। প্রেম প্রকাশের বাহন কবুতর, টিয়াপাখি, তরপর দূত এবং আধুনিক সময়ে ডাকঘর-ডাকপিয়ন। এখন এই শতকে প্রযুক্তি সহজ করে দিয়েছে যোগাযোগ। ইন্টারনেট, ই-মেল, ট্যুইটার, ইমো, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ব্লগ এবং মোবাইল কোথাও কোথাও টেলিফোনও চালু আছে। তবু পাঁচ হাজার বছরের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম পত্র বা চিঠিকে মানুষ ভুলতে পারে না, উপেক্ষা করতে চায় না। বিশেষ করে কবি- লেখকগণ ঐতিহ্যের নবায়ন করেন।

যখন চিঠির চল উঠে গেছে তখন কবি রোকসানা রহমান লিখছেন পত্রকাব্য। ঐতিহ্যের অনুশাসন মান্য করার মধ্যে কাব্যিক আনুগত্য আছে।রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পত্রগুলো কাব্যিক ও প্রজ্ঞাময়। কাফকার চিঠি তার দর্শনের সারাৎসার।আনাফ্রাঙ্ক তাঁর চিঠির জন্য বিখ্যাত। সাম্প্রতিক সময়ে তাহলে কি চিঠির মূল্য কমে গেছে! মানুষ কি চিঠি লিখবে না, পত্রের মূল্য দেবে না! দিক না দিক কবিদের স্বপ্নের চিঠিগুলো পৌঁছে দেবে দিগন্তের ডাকহরকরা।যদিও সত্তুর দশকের কবি হালিম আজাদ – কবিতায় উচ্চারণ করলেন, “একদিন এই ডাকঘর উঠে যাবে।” ডাকঘর উঠে গেলেও চিঠি থাকবে। আজ থেকে নয় বছর আগে কুঁড়েঘর প্রকাশনী প্রকাশ করেছিল আমার “কুড়িটি প্রেমের চিঠি”, তার তৃতীয় সংস্করণ হয়েছে।কবি রোকসানা রহমান লিখলেন ২০২৪ সালে পত্রকাব্য। এতে প্রমাণ মেলে চিঠির দিন শেষ হবে না,পত্রের পল্লব শুকোবে না। রোকসানা রহমানের পত্রকাব্যের নাম, “অনামিকায় রেখেছি যতনে।” প্রকৃত প্রস্তাবে রোকসানার আত্মজৈবনিক অনুভব বিধৃত হয়েছে গ্রন্থটিতে। ভূমিকায় আমি ওর কবিতার সবচে গুরুত্বপূর্ণ চরণ তুলে দিয়েছি : “শুনতে কি পাও শব্দের সফর? খুব কাছে, খুব কাছে-
ভালোবেসে খুন করেছো অনায়াসে”। ভূমিকাটি শেষ করেছি হিন্দি ভাষার বিখ্যাত কবি সুদার্শন ফাকিরের বিখ্যাত গীতি কবিতা দিয়ে, “এই ধন এই যৌবনের বদলে ফিরিয়ে দাও শৈশবের বর্ষাকাল,সেই কাগজের নৌকা বৃষ্টির জল।” রোকসানা রহমানের পত্রকাব্যময় এই কবিতার বইয়ের ছত্রে- ছত্রে ফিরে পাবার আকুতি, না পাওয়ার হাহাশ্বাস, ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের কোলাজ।কিন্তু রোকসানা ভোলেননি, পত্রগুলোর গীতিময়তার কথা। স্মরণ রেখেছেন গীয়ম আপোলোনিয়রের অনিবার্য উক্তি, অন্ত্যমিলের চেয়ে গীতিময়তা বেশি জরুরি। প্রত্যেক প্রজন্মের কবিকে
গীতিময়তার নবায়ন করতে হয়।
আর ফ্রি ভার্সের যুগে অন্ত্যমিল যুক্ত কবিতা কি সারমেয়র লেজের মতো! এ কবিতার বইটি সম্পূর্ণত মুক্তছন্দে লেখা। মোট ২৪ টি কবিতা বাংলায়। একটা ইংরেজি অনূদিত কবিতা। গ্রন্থের নামাকরণ শীর্ষক কবিতাটি ‘Fostered Thy love in my Ring Finger’ অনুবাদ করেছেন আশিক ইকবাল মণ্ডল। এই গ্রন্থের একজন মূখ্যজন মাসুদ। তাঁকে লক্ষ্য করে যত আয়োজন। পত্রকাব্যের ১৭ সংখ্যক কবিতায় মাসুদকে উদ্দেশ্য করে সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, I do not know,you also do not know, no body ever knows why man fall in love with a woman.
রোকসানা সংসারকে উপেক্ষা করেননি বরং সংসারকে জীবনাঙ্গের সঙ্গে যুক্ত রেখেই প্রেমাস্পদের যাচনা করেছেন। নয় সংখ্যক কবিতার এক জায়গায় বলছেন, “প্রিয়তম নাই বা দেখা হলো এই পৃথিবীর ঘাটে,
আমরা যাবো সেখানে স্বর্গের সেই উদ্যানে-
হোক সেখানে মিলন।”
কিংবা দশ সংখ্যক কবিতা :
”মাসুদ শুধুই ভেবে যাবে,দাও না খোঁপায় ফুল পরিয়ে,এবার কাছে এসো বোতামটা দাও,আমার ওষ্ঠের স্পর্শে গেঁথে দিই।”
রোকসানা রক্তমাংসের সংক্রমণকে অস্বীকার করেননি বরং রক্তমাংসময়তার ভেতরেও যে মরমী প্রেমের আকর থাকে তাকে আশ্রয় করেছেন। এই গ্রন্থে কবিতা সম্পর্কে রোকসানা রহমান তাঁর ধারণা চমৎকার আবেগে তুলে এনেছেন, “কবিতা মৃন্ময়ী তৃষ্ণা আমার।তোমার আত্মার জলে ভেসে যাই অন্তহীন সুখের ভেলায়।”
ক্রমাগত কবিতাকে হৃদয় দিয়ে যাচনা করেছেন কবি প্রেমাস্পদের মতো। তাঁর প্রেমিক কি কবিতা। তাঁর প্রেমিক কি অনন্তের পাখি। যে ধরা দেয়, আবার দেয় না।
কবিতা এই অধরা শিল্পকলা। আমরা সেই পরম অনন্তের সাধনা করি। আজন্মকাল এই সাধনা ছাড়া কবির মুক্তি নেই। প্রেমে, বিরহে, জয় পরাজয়ে কবিতা মানবের অভয়। ব্যক্তি থেকে সমষ্টি, সমকাল থেকে চিরকাল -এই আবর্তে কবিতার পর্যটন। রোকসানা একজন পর্যটক। তার পত্রকাব্যের পর্যটন আমাদের কাব্যযাত্রাকে প্রাণিত করুক এই প্রত্যাশা। 🍁
🦋বই : অনামিকায় রেখেছি যতনে ★ লেখক : রোকসানা রহমান
আরও পড়ুন : Book Review : বিপরীত মেরুর অন্তর্বর্তী অনুভূতির স্পন্দিত অনুভব
