



ইংরেজি নিউ ইয়ার ২০২৪ সংখ্যা
তাহমিনা কোরাইশী গল্প ছাড়াও কবিতায় পরিচিত নাম। থাকেন বাংলাদেশে। ওঁর গল্প, কবিতা হোক অন্য কোনও লেখা পাঠক আঁটকে যান। সাশ্রয় নিউজ-এর আজকের পাতায় রইল তাহমিনা কোরাইশী-এর একটি ছোটগল্প।
প্রতিবিম্বে
তাহমিনা কোরাইশী
শীতের পাতা ঝরার সময় শেষ। আছে কেবল রুক্ষ কিছু ডালপালা। তবু রূপ লাবণ্যের জীবনের গল্প বলে সাদা বরফের ফুল। নিজেকে সাজায়। এই ডিসেম্বরে ওদের রূপের বন্দনায় মেহেতাজ অহনির্শি। পুরো বাড়িটিতেই রুম টেম্পারেচার অ্যাডজাস্ট করাই আছে। ঘরে বসে বুঝতে পারছেনা মেহেতাজ কতটা ঠাণ্ডা বাইরে যাতে করে স্নো ফল হচ্ছে। অবশ্য আগেই অ্যানাউন্স করা হয়েছে কখন কোথায় কতটা সময় ধরে স্নো ফল হবে। তবুও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তুলোর মত বরফ পড়া দেখতে দেখতে অতীতে ফিরে যেতে ভালবাসে। সেই সব দিনে যেখানে তার ভাগ্য নির্ধারণের খেলা চলেছিল। এমনই দিন যখন পান থেকে চুন খসে পড়াটা কষ্টের। ঠিক এ ভাবেই কি চলে যেতে হয়? তবুও চলে যায় তুহিন স্বধীনতার ক’দিন আগেই। আজও মনের কোণায় দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে সে আগুন। সারাটা বছর তাকে তুষ দিয়ে ঢেকে রাখে মেহেতাজ। মুক্তিযোদ্ধা তুহিন পল্টনের ছেলে পাশাপাশি বাড়িতেই ওদের বসবাস। তবুও লুকিয়ে চুরি করেই ওদের দেখা দেখির পালা। গোপনে চিঠি আদান প্রদান। কাছাকাছি বা পাশাপাশি কি কখনও হয়নি ওদের মিলন! সন্ধ্যাে ছুঁইছুঁই সময়ে আলো আঁধারিতে পণ্টনের অলিগলি পথে গাছপালার আড়ালে আবডালে! হাতে হাত ছুঁয়ে থাকা কতটা সময়।অঙ্গীকারবদ্ধ দু’টি মানব-মানবীর প্রেম আখ্যান। দেশ স্বাধীন হলে বিজয়ের বেশে হবে গাঁটছড়া বাঁধন। সময় দিল না জীবন সেই সুখ আনন্দটুকু গ্রহণের। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে তখনই দুঃসংবাদ নিয়ে এলো ওমর তুহিনের বন্ধু। হন্তদন্ত ভাবেই এলো মেহেতাজের সামনে।
_____________________________________________
একান্ত সান্নিধ্যে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, মন খারাপ? মনের বিষন্নতায় দীর্ঘশ্বাস জড়িয়েই মেহেতাজ তার নিবিড় আস্থার মানুষটির বুকের কাছে ঘেঁষে বলে, পালিয়ে যত দূরেই যাই না কেন, মনের কোণে তার অবস্থান দিনে দিনে আরও দৃঢ় হয়ে গেছে। যতই চাই মুছবে না সেই অমোচনীয় দাগ।
_____________________________________________
মেহেতাজের দৃষ্টি কাড়ে। সে জানতে চায়।
-কি হয়েছে এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমায় ওমর ভাই? কোনো খারাপ সংবাদ?
কান্না ভেজা কন্ঠে উচ্চারিত হলো, তোর তুহিন বেঁচে নেই। শহীদ হয়েছে। সাভারের ভয়াডুবি ব্রীজ ওড়াতে গিয়ে। আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানী আর্মির একটি জীপের যে কয়জন ছিল তারাও মারা গেছে। দু’পক্ষের অনেকেই আহত হয়েছে। নয়পল্টনের কাশেম ভাই কাছ থেকে শুনে এলাম।
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে মেহেতাজ। আজ তার ভয় নেই, নেই লাজ শরম, আছে ভালবাসায় ভরা একটি মন যা অসময়েই চৈত্রের কাঠফাটা মাটি। বলে, আমি বিশ্বাস করি না। আমাকে নিয়ে যাবে ওর কাছে?
ওমর মেহেতাজকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে, রাস্তায় বের হওয়াটা এখন বিপজ্জনক। ওরাই অনেক ভয়ে আছে। নদী পথে নৌকায় করে সদরঘাটে আনবে। তারপরে আজিমপুরে দাফন করা হবে। তুহিনের বাবা, মা গিয়েছেন আনতে।
কি করবে কি করা উচিৎ ভেবে পায় না। ঘরে মা বাবা ভাই বোন সবাই জেনে গেছে ওর ভালবাসা আজ শহীদ বেদীতে। তাই বাবা মায়ের সতর্ক দৃষ্টি মেয়ের দিকে। কোনোও অঘটনা যেন না ঘটিয়ে বসে। লোক জানাজানি হলে মেয়েকে পাত্রস্থ করবে কি ভাবে! সেই ভয়ে আছেন তারা। মেহেতাজের নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। পাগল প্রায় দিন যাপন। মাঝে মধ্যে ওমর ভাই তুহিনের বন্ধু সে এসে সান্তনা দিয়ে যায়। এই মন তো কাঁচা মাটি তা দিয়ে যে শিব গড়েছে তাকে তো ভাঙা এতো সহজ নয়। পাগল প্রায় মেহেতাজ কোথায় যাবে, কি বলবে কাকে! বুকের মাঝে কষ্ট দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে।
দেশ স্বাধীন হল। পড়ার অনেকেই ফিরে এলো বিজয়ের পতাকা হাতে। সে এলো না। আমাকে কথা দিয়ে কথা রাখলো না। মনকে সান্তনা দেয় লাল সবুজের পতাকা উপহার দিয়েছে আমাদের। কিন্তু আমি তো এখন থেকে একলা পথের পথিক। পথ চলতে যে সঙ্গীটির প্রয়োজন ছিল সে আজ হারিয়ে গেছে। জীবনের মানেই বদলে গেছে। তোমাকে ছাড়া এ জীবন অর্থহীন। ভাবনায় বেদনায় রক্তক্ষরণ। মনে ডিপ্রেশন। কোনও কিছুই ভালো লাগে না। না লেখা পড়া, না ঘুরা বেড়ানো, না খাওয়া দাওয়া। এত লম্বা পথ তুহিনকে ছাড়া কি ভাবে পার করবে ভাবতে ভাবতে। ট্রমায় চলে যায়। বাবা মা ভাই বোন কারও কথা তার গ্রহণযোগ্য বা মনোপুত হয় না। পাগলামিতে পেয়ে বসেছে ওকে। কি যে আবল তাবল বকছে! কি করবে বাবা মা ভেবে পায় না। অবশেষে ওমর পথের দিশারী হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। নানাভাবে মেহেতাজকে নিজের আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করে।সফলতার সূত্র হয়ে বিয়ের মন্ত্র পাঠ করেছে মেহেতাজ আর ওমর। তবু নিশ্চিত হতে পারে না মেহেতাজ। সে কি অনুকম্পা করে তাকে গ্রহণ করেছে! কতই না প্রশ্ন তার। তারপরে এল শর্ত। মেহেতাজ বলেছে, এই লোকালয়ে আছে তার পায়ের চিহ্ন। সেখানে নয় অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে। পল্টনের স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকা মানুষটি একদণ্ড তাকে বাঁচতে দেবে না। মনের বোঝাটি ঝেড়ে ফেলতে ওমরকে তার প্রস্তাব মানতে হল।
আরও পড়ুন : Upper primary Job seekers : চাকরির দাবিতে মিছিল উচ্চ প্রাথমিক চাকরিপ্রার্থীদের
দু’জনে একদিন উড়ে যায় দূরের আশ্রয়ে। শীতের অতিথি পাখির মত নয় গ্রীষ্মের দেশ থেকে শীতের দেশে ওদের অবস্থান দৃঢ় করে নেয়।
অনেকক্ষণ যাবৎ শার্শিতে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা মেহেতাজের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ওমর। একান্ত সান্নিধ্যে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, মন খারাপ?
মনের বিষন্নতায় দীর্ঘশ্বাস জড়িয়েই মেহেতাজ তার নিবিড় আস্থার মানুষটির বুকের কাছে ঘেঁষে বলে -পালিয়ে যত দূরেই যাই না কেন, মনের কোণে তার অবস্থান দিনে দিনে আরও দৃঢ় হয়ে গেছে। যতই চাই মুছবে না সেই অমোচনীয় দাগ।
ওমর নির্ভরতায় নিজের কাছে টেনে নেয় মেহতাজকে। বলে, আমিও কি চাই সে আমাদের কাছ থেকে মুছে যাক? সে থাকবে আমাদের অস্তিত্বে। বাংলার পথে প্রান্তরে লাল সবুজের অবয়বে। আমাদের গর্বে আমাদের অহঙ্কারে।
অঙ্কন : প্রীতি দেব
[সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস। ই-মেল : sasrayanews@gmail.com ]
