Sasraya News

Article : ব্যক্তিপ্রচ্ছদেই অনন্তের বিনির্মাণ

Listen

সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিগত বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে একজন কবি নিজেকে স্বপ্নদর্শী করে তোলেন। সুতরাং কবিদের অন্তর্দৃষ্টি ও বোধের নিরন্তর পরিবর্তনটি ব্যক্তির উপরেই নির্ভর করে। নতুন কবিতার ধারণাটিও তাই স্থির নয়। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা পরিবর্তনশীল। লিখেছেন : তৈমুর খান 

 

 

 

 

 

ব্যক্তিপ্রচ্ছদেই অনন্তের বিনির্মাণ

 

 

হাল্কা রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসেছি। সকালের চাট্টি ভেজা ভাত খেয়ে কবিতা লিখব। একে তো শীতকাল। সূর্য কুয়াশার ভেতর বাঁশি বাজাচ্ছে। কী সুন্দর হলুদ বাঁশি। আমার চারপাশে গ্রামীণ জীবন। রোদ পোহানো, আগুন পোহানো সকাল। এসবই লিখব। লিখতে লিখতে নগর জীবনের জটিল আনন্দে আমি ঢুকে যাব। আহা, কী সুন্দর আনন্দ! মেয়েরা উড়ছে। উড়তে উড়তে এ-ছাত ও-ছাত ফুলের টবে টবে ফুটছে। আমি কিছুতেই ওদের ধরার মন্ত্র জানি না। আমি হাঁ করে গ্রামীণ মাটির দাওয়ায় বসে বসে লিখব ওদের।
নিবেদন কত দূর যাবে জানি না, এরকমই একটা সময় পেরিয়ে এসে আমি সেইসব কবিতাদের দেখতে পাই। আমার বদলে কেউ কেউ লিখে দিয়েছে। এই রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়া পৃথিবীতে এখনও কেউ কেউ পিঠ সেঁকে নিচ্ছে সূর্যের আলোয় আর মানবিক কবিতা লিখছে। ভবিষ্যৎ কুয়াশাময় তবু মানবিক সূর্যের বাঁশি শুনতে পাচ্ছে। নগর জীবনের জটিল প্রেমমুখর সময় থেকে গ্রামীণ জীবনের নির্জন ও কোলাহল কবিতায় মিশে যাচ্ছে। আমি তখন সেইসব কবির লেখায়, তাঁদের শব্দবোধে, তাঁদের আত্মিক নিবেদনে ডুবে যাচ্ছি। দুঃখের খই ফুটছে চারপাশে। হাত পেতে বলছি—তাই দাও—। আনন্দের তাকানো একবার দেখতে পেয়ে মনটা ভরে যাচ্ছে। কী সুন্দর চোখের দৃষ্টি। নীল ভুরু। পদ্ম পদ্ম মুখ। মুহূর্তকে ডেকে দেখাচ্ছি। হ্যাঁ, এখনও পৃথিবীর চায়ের দোকানে সুন্দরেরা আড্ডা দিতে আসে। রাজনীতি, ফলানানীতি, তস্যনীতি নিয়ে অনেক আলোচনার ঝড় ওঠে, তার মাঝেও সুন্দর চুপচাপ বসে থাকে। দেখলে মায়া হয়। তার পকেটে বাজারের ফর্দ। এত হৈ চৈ ভিড়ের ভেতরে থেকেও সে ‘নতুন লেখা’ খোঁজে—
“কীভাবে নতুন লেখা হবে ভাবি, আর
রোদ্দুর ঘুরে যায় ছাতের আলসেতে
দূরের স্টেশনে দেখি সন্ধ্যা নেমে আসে

সাত-পাঁচ ভেবেটেবে একটু বেরোই
কিছু দূরে পৃথিবীর চায়ের দোকান
পাড়ার বখাটে ছেলে, মাস্টার, দালাল…
বামকথা, রামকথা, অর্থকথা ওড়ে
পৃথিবীর ফর্দ ওড়ে বুকের পকেটে”
(পার্থপ্রতিম মজুমদার)

 

 

 

 

‘হয়ত পিয়াল তুমি জান’ কাব্যের এই কবিতাটিতেই কবি যে নতুন লেখার কথা বলেন তাঁর জীবন থেকেই নেমে আসা কোনও সকালের কথা। বেলা যাওয়া রাতের অন্ধকার নেমে আসছে। নানা কূটতর্কে এবং বস্তু চাহিদার ফর্দ নিয়ে আমাদের দিন চলে যাচ্ছে। এর মধ্যেই নতুন লেখা যেন নতুন ঈশ্বরের মতো। কেন না প্রকৃত নতুন লেখাতেই মননের উত্তরণ ঘটে। কবি নিজেকেই গড়ে নেন। র‍্যাঁবো কবেই বলেছিলেন “The poet makes himself a visionary by a long, immense and reasoned derangement of all the senses.”
অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিগত বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে একজন কবি নিজেকে স্বপ্নদর্শী করে তোলেন। সুতরাং কবিদের অন্তর্দৃষ্টি ও বোধের নিরন্তর পরিবর্তনটি ব্যক্তির উপরেই নির্ভর করে। নতুন কবিতার ধারণাটিও তাই স্থির নয়। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা পরিবর্তনশীল। উড়ে বেড়ানো মেয়ের মতোই ছাতে ছাতে কবিতাও উড়ে বেড়ায় – visionary by a long, immense তো এটাই। তা ফুলের টবে ও ঢুকে যায়। আকাশের পাখিও হয়ে যায়।

 

 

 

 

স্বয়ংক্রিয়তা বা Automatic Writing-ও কবিতা লেখায়। এক ঘোরের মধ্যে কবি চলে যান। তখন সমস্ত বিস্ময়ের পাশে বসে কবি হৃদয় খোলেন। অব্যক্ত কথাগুলি সংকেতের মেঘ, পাখি, নক্ষত্র, জেনাকি, আগুন হয়ে উড়তে থাকে। দু-একটি কথা দারুণ রাগিও হয়। তারা সাপ হয়ে ফণা দোলায়। নির্জনের মাঠে খেলা করে। জীবনানন্দ দাশের অব্যক্ত কথারা, অথবা বাসনারা তো ‘ঘোড়া’ এবং ‘শিয়াল’ হয়ে গিয়েছে। এইসবই একজন নতুন কবির কাছে নতুন ভূমিকা। তিনি ভাবেন—
“কীভাবে উন্নতি হবে আমার কবিতা ও গদ্যের;
এই কথা ভাবি আর শুয়ে শুয়ে কলম চালাই।”
(সুকৃতি)
কবি ‘নাস্তিকের কাব্য’ লিখতে গিয়ে প্রথমেই শুয়ে শুয়ে কলম চালানোর কথা বলেছেন। ‘শুয়ে শুয়ে’ Automatic Writing-এর-ই ইঙ্গিত দেয়। কবিতার ও গদ্যের উন্নতি অর্থাৎ ভিন্নতা যে এভাবেই সম্ভব তা কবি জানেন। তাই ‘বিচ্ছিন্ন চিন্তার’ নিচে ঢাকা পড়ে থাকেন। জীবন উদোম হয় সমস্ত ডানা খুলে। যেন প্রস্তুতি— “in a way approaching the condition of automatic writing.” টি. এস. এলিয়টের এই কথাটি আজও সত্যি। সংকেতে বেজে ওঠা প্রেম, প্রেমের কষ্ট আজও জোরালো করে ধরে কবিতা।

 

 

 

নতুন কবিতা এবং নতুন কবি যেভাবে তাঁদের দৃষ্টি ও পথ পাল্টে নেন, অনুভূতি ও চিত্রকল্পের, ভাষা ও শব্দবোধের প্রয়োগও পাল্টে দেন তা সূক্ষ্ম ব্যাপার। নৈঃশব্দ্যের বাতাবরণে গভীর এক ব্যঞ্জনাময় ভাষাহীন ব্যাখ্যাহীন ঐশ্বর্য যেন বিরাট বিস্ময় নিয়ে দেখা দেয়। ‘কবি’র পরিচয় দিতে গিয়ে অরিন্দম নিয়োগী তাঁর ‘ভূপাখি ভস্মপাখি’ কাব্যে লিখেছেন—
“আজ নৈঃশব্দ্যের শিখর বালি ও ছাই মেখে আছে
লোহা তার পড়ে রয়েছে রোমশ উঠানে
এখানে শ্রাবণ তবু ফিরে ফিরে আসে
বাউলের ভূমিকায়, ঝরে পড়ে চুল
চুলের ভেতর অন্তহীন বসে থাকা, বসে বসে
নির্ভার সিঁড়ির আলো ও ছায়ায় ক্রমশ ডুবে যাওয়া
যে জানে এইসব তন্ত্রের ব্যবহার,অবগাহনের মানে
সেই কবি, তার জন্য বজ্রনিশান,
সমস্ত পিপাসার বোবা আয়োজন”

কবিতাটিতে যে ভাবনার সন্নিবেশ ঘটেছে তা বাস্তবের কোনও সচরাচর বোধ থেকে আসা ভাবনা নয়, তীব্র নৈঃশব্দ্যে ডুবে গেলে যে অন্তর্দৃষ্টি জেগে ওঠে, নিজের যেভাবে ইচ্ছার বিনির্মাণও করে নেওয়া যায় এই তন্ত্রের ব্যবহারের কথা কবি বলেন। তাই ঝরে পড়া চুলের ভেতর অন্তহীন বসে থাকা, নির্ভার সিঁড়ির আলোয় উত্তরণ পাওয়া একজন কবিরই কাজ। তার জন্য বজ্রনিশান এবং সমস্ত পিপাসার বোবা আয়োজন অপেক্ষা করে থাকে। বজ্রনিশান এবং বোবা আয়োজন বিশেষণ দুটিতে আছে পরম বিস্ময় কিন্তু প্রখর এক ব্যাপ্তি, যা জীবন জুড়েই বিরাজ করে। কার্লাইল বলেছেন, “Silence is more eloquent than words.” বিবৃতির ভাষণের চেয়ে নীরবতা অনেক বেশি অর্থব্যঞ্জক একথা কবি বোঝেন। তাই নৈঃশব্দ্য নিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু হয়। ভূপাখি ভস্মপাখি পার্থিব জীবনেরই নির্জ্ঞান ব্যত্যয়—একথা ভুলে গেলে চলে না।
শীতের রোদ্দুরে চাট্টি ভেজা ভাত খেয়ে যে কুয়াশার বাঁশি শুনতে শুনতে কবিতার কথা ভাবছি সে-তো লেখা হচ্ছে। গ্রামীণজীবন থেকে শহুরে জীবনের অন্বয়গুলি প্রবৃত্তিরেখায় বেজে উঠছে। দৈনন্দিন জীবনচর্চার রুটিনে কিছুটা তফাত থাকলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের স্রোতে সবাই ভাসমান। সেখান থেকেই কিছু মণিমাণিক্য তুলে এনে জীবন সাজাই। সাজো, সাজো জীবন। কবিতা তো এই সজ্জারই বাতাবরণ। বুক ফেটে তখন অর্জুন সিকদার ‘প্রতিবাদের লেখাগুলি’ ছুঁড়ে দেন আমার কণ্ঠে। কণ্ঠ বেজে ওঠে। হাওয়াও ওঠে। ঘোষণা হয়। যে নীরবতা স্তব্ধতার ধ্যান শেখাত, সেই নীরবতাও সরে গিয়ে আনে মুখরতা, উচ্চকিত ঘোষণা, ঘোষণার আবেদন—
“এস হে বজ্রনির্ঘোষের বসন্ত
একবার অন্তত লালন কর আমাকে
হাতে তুলে নি স্বপ্ন-সময়ের রাইফেল

সেফটি ক্যাচ অন্
পার হয়ে যাই ইতিহাসের চেকপোস্ট।”

 

 

 

 

বসন্ত বজ্রনির্ঘোষের হলেই তো সমারোহ শুরু হয়। সেখানেই লালিত হতে চাই। কুয়াশায় আছি বলেই তো বসন্তের আকাঙ্ক্ষা। হাতে স্বপ্ন-সময়ের রাইফেল তুলে নিয়ে হতাশা আর বেদনার সঙ্গে লড়াই করা যায়। সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক অশুভর বিরুদ্ধেও দাঁড়ানো যায়। ইতিহাসের চেকপোস্ট পার হতে হলে তো লং-মার্চ করেই সৈনিক কবিকে পার হতে হবে। চাই উচ্চকিত অনুরাগ দরকার। না হলে তো জীবন সংরাগ ও মুখরিত হবে না। নতুন কবিকে চেকপোস্ট পার হতে দেখি। গতানুগতিক ঔচিত্যবোধ তাঁর থাকবে কেন? সে তো unrestrained।

 

 

 

এভাবেই দেখি ব্যক্তিজীবনের প্রচ্ছদের ভেতর নৈর্ব্যক্তিক জীবনের স্রোত মিশে যাচ্ছে। নিজেরই শীত ও ব়োদের বাঁশিতে যে জীবনের রূপ দেখেছি সেই জীবনে কত কত কণ্ঠম্বর, কত কত নীরবতা। ভেজা ভাত আর কুয়াশার খাদ্য খেয়েই বসন্তের উন্মুখ ঘোষণা। এভাবেই পরস্পর সময়-ছায়াগুলি হেঁটে গেছে। স্ববিরোধী আলোকে স্তব্ধতা ও মুখরতা বিরাজ করেছে। নিজেকে মনে হয়েছে জীর্ণ, বৃদ্ধ আবার তরুণ যুবকও। জীবন উৎস থেকে পরিণতি আবার পরিণতি থেকেই উৎসমুখে ফিরে এসেছে। শব্দে-ভাবে, কথায়-না-কথায় পেয়েছে মুক্তি। পৃথিবীময় এই মাটির দাওয়ায় বসে বসে দেখি একজন প্রাচীন প্রাজ্ঞ কবিও এই দশকের নির্ণীত তিরন্দাজ হয়ে যান—
“….. কত ধ্বনি, জাগে চরাচরে—
কত বার্তা, হয় বিনিময়—
সেই বোঝে, বার্তা যার তরে;
উনজনে, উদাসীন রয়।”
(মন চল নিজ নিকেতনে)

অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র শহরের জটিল বিন্যাসে বসেও নিজ নিকেতনের এভাবেই অন্বেষণ করেন। তখন আমারও বোধ দীপ্ত হয়। এই শীতের সময়ে বার্তা বিনিময় করতে থাকি এক সত্তা থেকে আর এক সত্তায়। অব্যাহত দৌড় শুধু। দৌড়ের মাঝেই এক-একটা ভাবের জগৎ খুলে যায়। আমার মাঝেই আবার আমি জন্মাই। নতুন আমি জেগে উঠি। নতুন কবিকে দেখি। বহু প্রাচীন কবিতার ভেতর দিয়েই যেন নতুন কবিতা উঠে আসে। বিনির্মাণ চলতে থাকে। উৎস ও অনন্তে এই বিনির্মাণ।

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read