



ধারাবাহিক লোক-কথা /১
ইনুইট আমেরিকান ইন্ডিয়ান লোক-কথা (American Indian Folktale) উত্তর আমেরিকার আলাস্কা, গ্রীনল্যান্ড এবং কানাডার মেরু অঞ্চল এবং উপ মেরু অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের একটি জাতিভাষাগত গোষ্ঠী হল ইনুইট। দীর্ঘ অন্ধকার শীতের মাস, প্রবল ঠান্ডায় খাদ্য সংগ্রহের জন্য দিনের পর দিন বলগা হরিণ বা সীল শিকারের জন্য অপেক্ষা করে থাকা, মাথার ওপরে রহস্যময় সুমেরু প্রভার রঙিন গতিচঞ্চলতা… এই সমস্ত মিলিয়ে ইনুইটরা এমন এক পরিবেশে বাস করে, যা তাদের মধ্যে বিভিন্ন রোমাঞ্চকর, অতিপ্রাকৃতিক ও রহস্যাবৃত লোক-কথার জন্ম দিয়েছে। ইনুইট উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে ‘অ্যানিমিজমে’র ধারণা। তারা বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা নদনদী, খালবিল, পাহাড়, মাটি, পাথর সমেত সমস্ত বস্তু, স্থান এবং সমস্ত প্রাণী – সবকিছুরই প্রাণ রয়েছে, অনুভব করার ক্ষমতা রয়েছে, রয়েছে চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাও! আজ ধারাবাহিক লোক-কথার প্রথম পর্ব। লিখেছেন : রাখী নাথ কর্মকার
নিশীথ সূর্যের দেশে আলোর উৎস-কথা
বহু বহু বছর আগে যখন পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা হয়েছিল, তখন সুদূর উত্তরের বরফাবৃত অঞ্চল যেখানে ইনুইট উপজাতির মানুষজন বাস করত, সেখানে সবসময়ই অন্ধকার হয়ে থাকত।
ইনুইট উপজাতির মানুষেরা তখন জানতই না, দিনের আলো কাকে বলে। তারা ভাবত, সারা পৃথিবীটাই বোধহয় এমন অন্ধকারে ডুবে রয়েছে! কিন্তু একদিন একটি বৃদ্ধ কাকের কাছে তারা প্রথম জানতে পারল, এই অন্ধকারটাই সব নয়! ‘আলো’ বলেও কিছু একটা আছে। সেই বৃদ্ধ কাক একদিন তাদের গল্প শোনাল … একবার পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে যাওয়ার সময় সেই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে সে কীভাবে দিনের আলো দেখেছিল!
______________________________________________
যতই সে দূরের ম্লান আলোর আভার দিকে উড়ে যেতে লাগল, সেই আলো যেন ততই আরও উজ্জ্বল, আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগল যতক্ষণ না পুরো আকাশটাই চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া আলোয় ঝলমল করে উঠল!
______________________________________________
ইনুইটরা তারপর থেকে যখনই সুযোগ পেত, সেই বৃদ্ধ কাকের কাছে বসে দিনের আলোর গল্প শুনত। কেমন দেখতে হয় দিনের আলো? দিনের আলোতে কি সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়? তারপর থেকে তারা যত বেশি সেই দিনের আলোর গল্প শুনত, ততই যেন তাদের মনে দিনের আলো পাবার আকাঙ্ক্ষা অদম্য হয়ে উঠতে শুরু করল। অবশেষে একদিন তারা সবাই মিলে বৃদ্ধ কাককে অনুরোধ জানাল, যে করেই হোক, কাককে তাদের এখানে দিনের আলো এনে দিতেই হবে!
–“হে বৃদ্ধ কাক, অনুগ্রহ করে তুমি আমাদের ‘দিনের আলো’ এনে দাও! আমরা তাহলে শিকার করার জন্য আরো আরো দূরে চলে যেতে পারব। হিংস্র মেরু ভালুক অজান্তে এগিয়ে এসে আমাদের আক্রমণ করার আগেই আমরা তাকে দেখতে পেয়ে সাবধান হয়ে যেতে পারব! দয়া করে তুমি আমাদের ‘দিনের আলো’ এনে দাও হে বৃদ্ধ কাক!”
কিন্তু কাক মাথা নেড়ে জানাল- “উঁহু, অসম্ভব। সে এক দীর্ঘ পথ বাছা, অতদূর উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার বৃদ্ধ শরীরে আর নেই!” কিন্তু সকলে মিলে এমন ব্যাকুলভাবে কাকুতিমিনতি করতে থাকল যে বৃদ্ধ কাক আর তাদের অনুরোধ ফেলতে পারল না।
অবশেষে অনেক দোনামনা করে বৃদ্ধ কাক তার ভারি ডানাদুটি ঝাপটে অন্ধকার আকাশে মেলে ধরল, তারপর পূর্ব দিকে উড়ে যেতে থাকল… উড়েই যেতে থাকল …যতক্ষণ না তার ডানাদুটি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারপর একদিন হঠাৎই দূর থেকে দিনের আলোর ম্লান আভা দেখে কাকের মনে হল- “আহা, এতদিনে যেন আমার পরিশ্রম সফল হল!”
দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তিতে ততক্ষণে তার ডানা ভারি হয়ে এসেছিল, তবুও বৃদ্ধ কাক থামল না। যতই সে দূরের ম্লান আলোর আভার দিকে উড়ে যেতে লাগল, সেই আলো যেন ততই আরও উজ্জ্বল, আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগল যতক্ষণ না পুরো আকাশটাই চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া আলোয় ঝলমল করে উঠল! এই তো, মাইলের পর মাইল সবকিছু কেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দেখো! ক্লান্ত পাখিটি এইবার একটি গ্রামের প্রান্তে একটি গাছের ডালে এসে বসল।
সে ছিল এক শীতের সকাল। সেই মুহূর্তে সেই গ্রামের প্রধানের কন্যা পাশের নদীতে খাবার জল নিতে এসেছিল। বৃদ্ধ কাক শুনেছিল, গ্রাম প্রধানের কাছেই নাকি দিনের আলো গচ্ছিত রাখা থাকে। সুতরাং দিনের আলো পেতে হলে আগে প্রধানের বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে! তাই বৃদ্ধ কাক তক্কে তক্কে রইল… প্রধানের মেয়ে যেই না তার বালতিটি নদীর জলে ডোবাল, কাক নিমেষের মধ্যে নিজেকে ধুলোয় পরিণত করে মেয়েটির গরম পোশাকের সঙ্গে মিশে গেল। মেয়েটি জানতেও পারল না, তার সঙ্গে করে বৃদ্ধ কাককেও সে ওদের স্নো-লজে নিয়ে এসেছে! (চলবে)
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Durga Puja 2024 : এবছর দেবী দুর্গার আগমন ও গমন তিথি কবে পড়েছে জানেন?
