



প্রমা
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়
(পূর্ব প্রকাশের পর 👉) প্রমা আজ সকাল থেকেই বায়না ধরেছে তার একটা বেনারসি শাড়ি চাই ,সেই স্কুলে ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাই সাজবে। রানীকে বেনারসি ছাড়া মোটেও মানায় না। প্রমার মা টুকু তার বেনারসি দিতে রাজি নয়,-সে ছিঁড়ে ফেলবে! প্রমা জানে মার সঙ্গে কচা কচি করে লাভ নেই, মা দেবে না বলেছে যখন দেবেই না। অগত্যা শেষে দিদিমাকে ধরল, -আগের দিন যে বলেছিলে তোমার বিয়ে? তো সেই বিয়ের বেনারসি এখনই আমাকে দাও ।
লতিকা দেবী বললেন,
মাথা খারাপ!
আমি একটা ৫ টাকার নরম শাড়ি চেয়েছিলাম তাই দেয়নি, অবশ্য পরে বুঝেছি কেন দেয়নি।
আমার থেকে ওটাও এরা কেড়ে নিতো। কম দামি শাড়ি তাই কাড়া ছেড়ে ছি ছি করতে লেগে গেল। এমন সুন্দর বউ অথচ কিছুই দেয়নি।
যাক গে শাশুড়ি মায়ের তো অনেক আছে,-
ভরে দেবে।
কেউই কিছুই দিল না ।
জমিদার বাড়ি থেকে এসে বড় গিন্নি ছোট গিন্নি দুজনেই আমার শাশুড়ি মা কে বললে বড় দিদি নতুন বউকে কিছু না দিলে বড় বেমানান লাগে। আশীর্বাদী বলেও তো কিছু একটা আছে –
তখন আমার শাশুড়ি মা একটা আধুলি গিনি আমাকে আশীর্বাদী স্বরূপ দিয়েছিলেন।
বড় ননদ জীবিত ছিল না, মৃত্যু কালে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন, সে সম্পর্কে ভাগ্নি হয়। তাই আশীর্বাদই দেওয়ার তার কোন ব্যাপার নেই ।মেজ ননদ ধনী হলেও গরিবের মতো আচরণ, অনায়াসে সে বললে, পরে পশ্চাতে আশীর্বাদী দেয়া যাবে।
ছোট দুই ননদ ছোট তাই আশীর্বাদ দেয়ার কোন দরকার নেই। সংসারে বিনা পয়সার দাসী মিলে গেলাম আমি,- সকাল হলেই ঝাঁটা আর ন্যাতা নিয়ে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী হয়ে লড়াই শুরু।
প্রমা বলে ওঠে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী ঘোড়ায় চড়ে তরোয়াল দিয়ে যুদ্ধ করত, তুমি ঘোড়ায় চড়তে তরোয়াল চালাতে পারো?
উত্তরে বলেন উনি রানী- কত ধনী! তাই না ওনার ঘোড়া আছে, তরোয়াল আছে ,তাই জন্যই না উনি ঘোড়ায় চাপতে তরোয়াল চালাতে শিখেছেন। আর উনার সঙ্গী সাথীরা ও অনেকেই ঘোড়ায় চড়তে তরোয়াল চালাতে জানতো। ওনার নিজস্ব মহিলা বাহিনী ছিল। উনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন-
এটাই ওনার মহান হৃদয় ও সাহসিকতার পরিচয় ।
ব্রিটিশরা ওনাকে টাকা দিয়ে দুর্গ ছাড়তে বললে উনি তাতে রাজি হননি,
প্রমা বলে ওঠে জানি ১৫৪০ জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে গিয়ে ইংরেজরা ঝাঁসি দখল করে নেয়।
রানী পুরুষের বেশে অন্ধকারে পুত্রকে নিয়ে কাল্পি নামক স্থানে চলে যায়। ওই বছরেই গোয়ালিয়রের যুদ্ধে তিনি মারা যান।
এবার তুমি বলো রানী কে বেনারসি ছাড়া মানাবে? আর পুরুষ সাজার জন্য একটা বাবার ধুতি আর ফতুয়া লাগবে। শিগগিয়ে এনে দাও। দিদিমা বললে, দাঁড়া তোর মাকে বলে বেনারসির মতন সুন্দর একটা লাল টুকটুকে কেরালা সিল্ক আছে। ওটা দিতে বলে দেব।
আর তুমি ঝ্যাটা আর নেতা দিয়ে ঠিক কি করতে আমাকে শুনতে হবে।
গরিবদের সংগ্রাম আমাকে জানতে হবে।
তেমন আর কি? ঘর দু’টো মোছা উঠান ঝাড়ু দেওয়া সদর দরজায় জল ঢালা গোয়ালের গোবর নির্দিষ্ট জায়গায় জড় করা ,রান্নাঘর থেকে রাতের খাওয়ার বাসন বার করে চারখানা বাড়ি পার হয়ে পুকুরে ভিজিয়ে আসা ,রান্নাঘর মুছা উনুন নিকানো অর্থাৎ ( কাদা আর গোবর মাখানো) ঘুঁটে কয়লা সাজিয়ে উনুন ধরানো, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, উঠোনের তারে মেলা, চুলটা কোনক্রমে আঁচড়ে দৌড়ে দুধ দোয়া, দুধ জাল দেয়া, সাবু বসানো বড় হাঁড়ি বসিয়ে ভাত বানানো। ডাল বানানো, তরকারি বানানো, শেষে মাছের ঝোল বানানো। এইসব কাজ বেলা দশটার মধ্যে শেষ।
তারপর সবাইকে একে একে খেতে দেওয়া রান্নাঘর পরিষ্কার নিজে গলাধঃকরন।
খাওয়া বাসন পুকুরে নিয়ে গিয়ে মাজা, ঘুঁটে দেওয়া, খড় কাটা আবার দুধ দোয়া, গরুকে জাবনা দেয়া, দিয়ে রুটি তরকারি বানানো সবাইকে খেতে দেওয়া সব শেষে পড়ে থাকা খাবার গলাধঃকরণ, এবার শোয়া-
এখনকার মতন সাবান ছিল না তেল মেকে স্নান করা, আর ছাই দিয়ে দাঁত মাজা!
তোর দাদা মশাই পূজো করত- পুজোর পাওনা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরা ,শিলে লঙ্কা হলুদ বাটা উনুনের আঁচের জন্য কয়লা ভাঙ্গা, গুঁড়ো কয়লা দিয়ে গুল দেওয়া। শিলে ডাল বেটে দড়ি দেয়া, আচার বানানো
মেয়েদের কাজের কি কোন শেষ ছিল রে –
তখন আমি ভাবতাম একদিন একবেলা যদি বাপের বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে পারতাম !
কিন্তু সে গুড়ে বালি!
তাই ভাবতাম যদি আমার কোন অসুখ হয়, তাহলে বেশ হয়।
কিন্তু তাও কখনো হত না।
গরিবের মেয়ে বলে যে যেমন পারতো শোনাত।
ইচ্ছে করে সব ভাত তরকারি খেয়ে নিত।
আমার জন্য কিছুই থাকতো না, গরুর জন্য শেষ আঁচে খুদ সেদ্ধ করতাম।
খিদের জ্বালায় দু’টো তাই নিয়ে একটু ঘি আর নুন ছিটিয়ে খাচ্ছি, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে। বেশি বলতে শুরু করল ঘি শেষ করছে ভিখিরির মেয়ে।
নিজের ঘরে নিজেই চোর!
সেই থেকে খুদের মধ্যে আলু পটল ঝিঙে যা পারতাম কুমড়ো ফেলে দিতাম। আর নুন তেল দিয়ে মেখে খেয়ে নিতাম।
ঘি খাওয়া বন্ধ হল।
অত্যাচার আর সংগ্রাম বহাল রইল।
আচ্ছা ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী তবে বিখ্যাত কেন?
সংগ্রাম তো সবাই করে, লক্ষ্মী ইংরেজ সরকারের অনুদানে কোন সংগ্রাম না করেও আরামে জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি এইখানেই তিনি মহৎ। (ক্রমশঃ)
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব
আরও খবর : Mamata Banerjee Injured : বাড়িতে পড়ে গিয়ে আহত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভর্তি হাসপাতালে
